মহুয়ার রাতদিন পর্ব-০৯

0
12

#মহুয়ার_রাতদিন.৯✍️ #রেহানা_পুতুল
পাশ থেকে আরেকজন পুরুষ জ্ঞানগর্ভ সুরে বললো,
“ওদের এখন শত্রু আছে। এক তার ফুফুরা। আরেক তার জামাইরা। হয়তো এর বাইরে আরো কেউ আছে।”

এমন একাধিক প্রশ্নবাণে জর্জরিত তারা নিজেরাই। কয়েকজন মহুয়াদের ঘর ভিটায় টর্চের ও মোবাইলের আলো ফেলে ফেলে দেখলো। এলমুনিয়াম ও টিনের কিছু হাঁড়িপাতিল,প্লেট,বাটি,জগ ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। ওভাবেই সব পড়ে রইলো। গভীর আফসোস করতে করতে বাড়ির লোকজন যার যার ঘরে চলে গেলো।

হাসপাতালের ওয়ার্ডের দুটো টুলে বসে মহুয়া ও তার মা কান্নারত কণ্ঠে দোয়াদরুদ পড়ছে। মায়ের অনুমতি নিয়ে মহুয়া তার খালাকে ফোন দিয়ে জানালো। ফোন তার বালিশের নিচে ছিলো বিধায় অক্ষত ছিলো। তার কাঁধের ব্যাগটাও নাগালে ছিলো। যেহেতু সকাল হলেই আবার কর্মে যেতে হতো তার। রাতে বুলবুলিকে কোলে নিয়ে ঘর হতে বের হওয়ার সময় মহুয়া, তার ব্যাগ ও মোবাইলটাও হাতে নিয়ে বের হয়। তাই ব্যাগে থাকা টাকাগুলোও অক্ষত ছিলো।

তার খালা বাকি আত্মীয়ের জানালো। ভোর না হতেই তারা ছুটে এলো হাসপাতালে। মহুয়া ও তার মা একটু ভরসা পেলো নিকটজনদের দেখে।
মায়ের কাছে তাদেরকে রেখে মহুয়া বাড়িতে এলো। ঘর ভিটার কয়েকটি ছবি তুলে নিলো দুঃখের স্মৃতির এলবামে জমা করবে বলে।

সে শূন্য চোখে ঘর ভিটার দিকে ঠায় চেয়ে রইলো ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায়। মহুয়াকে দেখে পাশের ঘরের দাদী,চাচী,ভাবিরা এগিয়ে এলো। তাদের দেখে মহুয়া ঝরঝর করে আবারো কেঁদে ফেললো।

এক দাদী তাকে প্রবোধ দিয়ে বললো,

“বইন কান্দিস না। যা আছে থালা,বাটি নিয়া ল। ধুইয়া আমগো ঘরে রাইখা দে। নয়তো টোকাই পোলাপান আইসা নিয়া যাইবো। আমগো ঘরে নাস্তা খাইস। চিতই পিঠা খোলায় দিতাছে।”

মহুয়া নাক চোখ ঢলে মুছে নেয় সুতী ওড়নাটার এককোণ দিয়ে। ঢুলির বেড়ার তৈরি অক্ষত ছোট্ট রসুই ঘরটায় গেলো সে। দরমার উপর থেকে ভাতের মাড় জমানো হাঁড়িটা নিয়ে নিলো। বস্তার ভিতর হতে কিছু কুঁড়ো নিয়ে মাড়ের সাথে গুলিয়ে নিলো। বাইরে গিয়ে খোয়াড় হতে হাঁস-মুরগিগুলো ছেড়ে দিলো। কুঁড়োর হাঁড়িটা তাদের সামনে রাখলো। অমনি রোজকার মতো সেগুলো হুড়মুড় করে খেয়ে নিলো তাদের খাবার। হাঁসগুলো টইটই করছে ভাতের জন্য।

মহুয়া ঘরের ভিতরে গেলো ছাঁই মাড়িয়ে। যা পেরেছে তুলে নিয়েছে খুঁজে খুঁজে। পুকুর ঘাটে নিয়ে সব ধুয়ে নিলো। নিজেও হাতমুখ ধুয়ে নিলো। ভাতের পাতিলের নিচের ভাতগুলো অতটা পুড়েনি। সেগুলো ধুয়ে হাঁসগুলোকে খেতে দিলো।
সেই চাচাদের উঠানে বাঁশের মাচায় নিয়ে শুকাতে দিলো হাঁড়িপাতিলগুলো।

মহুয়া তাদের রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসে দুটো খোলাজা পিঠা খেলো নারকেল কুরানো দিয়ে। পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“বুলবুলি কী তোর মায়ের কাছে আছে?”

“হ্যাঁ চাচি। তাইতো রক্ষা। বুলবুলি আমার চেয়ে বেশি মায়ের কাছেই থাকে। নয়তো চাকরি করি কীভাবে আমি?”

“অ। তাও কতা।”

মহুয়া খোয়াড়ের চাবিটা তার হাতে দিয়ে নিরীহ গলায় বললো,

“দাদী,চাচী, আমি হাসপাতালে যাই। আমাদের এগুলো শুকালে একটা বস্তায় ভরে রাখবেন। এই নেন চাবি। হাসঁমুরগী সন্ধ্যায় খোয়াড়ে ঢুকে গেলে তালা দিয়ে দিবেন। সকালে আমি এসে তালা খুলে খাবার দিবো। মিরনের জন্য দোয়া করবেন।”

“আইচ্ছা যা। আল্লার হাওলা। দিমুনি তালা। খেয়াল রাখুম তোগো রসুই ঘর আর খোয়াড়ের দিগে। আর কী দেখুম। কিছুই তো নাই। তোরা মা,মাইয়া চিন্তায় মইরা যাইস না। একটা গতি খোদা কইরা দিবই।”

মহুয়া মাথায় ওড়না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় ছলছল চোখে। বাড়ির সীমানা পার হতেই দেখলো সাবের মহাজন ব্যস্ত পায়ে তাদের বাড়ির দিকেই আসছে। মহুয়া পায়ের গতি শ্লথ করলো তাকে দেখে। তিনিও থামলেন। তার চোখেমুখে উদ্বেগ। বিচলিত ভাব।

মহুয়া তাকে নিয়ে এসে খোলা ঘরের সামনে দাঁড়ালো। বিস্তারিত জানালো কাঁদোকাঁদো গলায়। তিনি কণ্ঠে সহানুভূতির ঝড় তুলে বললেন,

“আমি বাজারে মিলে আইসাই শুনলাম তোমাগো ঘরে রাইতে আগুন লাগছে। বেড়ার ঘরে আগুন লাগলে আর কিছু থাকে নাকি। চলো,তোমার লগে আমিও হাসপাতালে যামু তোমার ভাইরে দেখতে।”

“চাচা আমিতো যাবো অটোতে।”

“আমি ডাইরেক্ট রিকসা নিয়া যামু। তুমি চাইলে আমার লগে আসতে পারো। নয়তো ওয়ার্ড নাম্বার দাও।”

মহুয়া ওয়ার্ড নাম্বার বলে দিলো। দুজন আলাদাভাবে হাসপাতালে গেলো। সাবের যেতে যেতে কাশেমকে মহুয়াদের বিষয়টা জানালো। শুনে তিনি ছেলে আসিফকে জানালেন।
আসিফ অবাক হলো। মর্মাহত হলো বেশ। বললো,

“বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। আমি মহুয়াকে ফোন দিচ্ছি বাবা।”

সাবের মহাজন হাসপাতালে গেলো। তার আগে মহুয়া পৌঁছে গেলো। তিনি বার্ণ ইউনিটে গিয়ে মিরনকে দেখলেন মহানুভবতার দৃষ্টিতে। মহুয়ার হাতে আসতে কিছু টাকা দিয়ে এলেন। সংকোচপূর্ণ চোখে হলেও টাকাগুলো নিতে হলো মহুয়ার। প্রয়োজনের কাছে লজ্জা,সংকোচ হার মানে।
টাকা বেঁচে থাকার অবলম্বন। টাকা পথ চলার শক্তি।

মহুয়াকে দেখেই তার শিশু কন্যা বুলবুলি আসার জন্য ছটপট করছে। মহুয়া মেয়েকে কোলে নিয়েই এদিক সেদিক যাচ্ছে। ওয়ার্ডের একটা শয্যায় মিরন অর্ধমৃত হয়ে পড়ে আছে। তার শরীরের পোড়াস্থানগুলো ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। স্যালাইন চলছে। তরল খাবার চলবে শুধু।

মহুয়া,তার মা,নিকটজনেরা ঘুরেফিরে মিরনকে দেখছে। মিরন স্পেশাল ছেলে হওয়ার সবার মনে আলাদা একটা সিমপ্যাথী আছে তারজন্য। তবে আশার কথা হলো কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেছে ৪/৫ শতাংশ পুড়েছে মিরনের শরীর। তাই মিরন ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে।

মহুয়া হাসপাতালের বাইরে গিয়ে খালা,মায়ের জন্য রুটি ও ডালভাজি নিয়ে এলো। হালিমার খেতে ইচ্ছে করছে না। থাকি থাকি তার কেবল বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে। তার এতদিনের সংসারটা চোখের সামনে ছাঁই হয়ে গেলো। প্রতিটি জিনিসে তার কত স্মৃতি, কত আবেগ জড়ানো ছিলো। কত টুকরো গল্প মিশে আছে সংসারের কতকিছুতে।

মহুয়ার মোবাইল বেজে উঠলো উচ্চস্বরে। আসিফ। রিসিভ করেই আহত গলায় মহুয়া তাকে সালাম দিলো। আসিফ বললো,

“ওয়ার্ড নং বলো। আমি আসছি। তোমার ভাইকে দেখে তারপর দোকানে যাবো।”

মহুয়া ওয়ার্ড নং বললো। আসিফ মোবাইল রেখে দিলো। মা,খালাকে জানালো আসিফের কথা। তারা দু’বোন নিজেদের একটু গুছিয়ে নিলো পরিপাটি করে। বসে বসে তারা তসবিহ পাঠ করছে। মহুয়া সম্ভাব্য সবস্থানে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনার কথা সব জানালো।

আসিফ সরাসরি চলে এলো ওয়ার্ডে। দুইহাত ভরে ফলমূল নিয়ে এলো। মেয়ের দোকানের মালিক, সেই হিসেবে হালিমা ও তার বোন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এতে আসিফ বিব্রত হলো। সে নম্র ভঙ্গিতে সালাম দিলো মহুয়ার মা ও খালাকে। তাদেরকে বসতে অনুরোধ করে নিজেও বসলো একটি টুল টেনে। মিরনের মাথায় হাত রেখে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলো। মহুয়া সব জানালো। তবুও আসিফ গিয়ে চিকিৎসকের সাথে দেখা করলো নিজের পরিচয় দিয়ে।

সব শুনে আসিফ ফিরে এসে বসলো। বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা করবেন না খালাম্মা। মিরন সুস্থ হয়ে যাবে।”

“বাবারে, আল্লায় যে কী মুসিবতে ফালাইলো আমাগোরে। মরার উপর খাড়ার ঘা। একদিকে আমার ছেলের এই অবস্থা,আরেকদিকে ঘরতো পুড়ে ছাঁই। আমাগো মাথা গোঁজারও নাই যে ঠাঁই।”

“আমি দেখি কী করা যায়। বাবা ও সাবের কাকার সাথে এ নিয়ে আলাপ করবো। কিন্তু আগুন কীভাবে লাগলো? একবারে পুরো ঘরটা পুড়ে গেলো?”

“কীভাবে লাগলো জানি না। তবে ঘরের কিছু হইতে যে লাগেনাই এইটা নিশ্চিত বাবা। ঘরে কোন কূপি,হারিকেন জ্বলেনাই। কয়েল জ্বলেনাই। সিগারেট খাওয়ারও লোক নাই ঘরে।”

নিদারুণ গলায় বলল হালিমা।

“জিনিস যায় তার,ঈমান যায় তার। বুবুরাতো ঘুমায়া ছিলো তখন। কারে সন্দেহ করবো।”
ব্যথিত স্বরে বললো মহুয়ার খালা।

মহুয়া তার মোবাইলে তোলা ছবিগুলো বের করে আসিফকে দেখালো। আসিফ ছবিগুলো জুম করে দেখলো। বুঝতে পারলো মহুয়াদের অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা দুর্বল।

আসিফ বললো,
“তুমি কী বলো এই বিষয়ে?”

“আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে বাইরে থেকে। কে বা কারা দিয়েছে জানি না। তবে যারাই দিয়েছে, হয় তারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। নয়তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখে নিঃশ্ব করে দিতে চেয়েছে।”

বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী সুরে বললো মহুয়া।

“তুমি তাদের খুঁজে বের করতে চাও না?”

“চাই। কিন্ত আমার একার লড়াইটা কঠিন হবে।”

“তুমি একা নও। আমি পাশে আছি। তোমাকে হেল্প করবো। কারণ এসব অমানবিক, অ-মানুষদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব!”

আসিফের কথায় মহুয়াদের সবার মনোবল বেড়ে গেলো প্রচন্ডভাবে। আসিফের দিকে তারা প্রীত চোখে চাইলো। আসিফ তাদের বললো,

“আমি এখন আসি। দোকানে যাবো। টাইমলি মহুয়ার সাথে সব বিষয়ে আলাপ করবো।”

তারপর আসিফ দোকানে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় দিলো। বাড়িতে গিয়ে তার বাবার সাথে মহুয়াদের পরিবার ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একটু আলোচনা করলো। তখন তার বাবা তাকে বললো,

“সাবের ভাইয়ের মিলে মহুয়ার বাবা অনেক বছর শ্রম,ঘাম দিছে। তাই সাবের ভাইয়েরও হাত বাড়ানো উচিত। সবাই মিলে ওদের আগের ভিটার ঘর তুলে দিতে হবে।”

“এতো খুব মহৎ কাজ বাবা। সেটাই করতে হবে।এগিয়ে আসতে হবে সবার।”
খুশীমনে বলল আসিফ।

“শোন,আমি মহুয়া মেয়েটার জন্য একটা পাত্র ঠিক করছি। আগের জামাইরে সে তালাক দিয়ে দিবে। তারপর উপযুক্ত সময়ে বিয়ে হইবো। এতে তার মায়ের কাঁধ ভারমুক্ত হইবো।”

“বিয়ে? মহুয়ার? বুঝলাম না,কবে থেকে আপনি এত জনদরদী হয়ে উঠলেন? সেতো আমাদের কেউই না। অথচ তার একটা নিশ্চিত জীবন আপনি ঠিক করে ফেললেন?”

অদ্ভুত চোখে চেয়ে ভীষণ অবাক কন্ঠে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো আসিফ।

চলবে…৯