#মহুয়ার_রাতদিন. ১৩ ✍️ #রেহানা_পুতুল
পুরুষালী গলা শুনে মহুয়া রুমের আড়াল হতে উঁকি মারলো। দেখলো তার সেই পুরোনো প্রিয়মুখটি। বিস্ময়ে! লজ্জায়!সংকোচে মহুয়ার মরে যাওয়ার উপক্রম!
আগেরদিন বিকালে মিরন প্রতিদিনের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। পাশের ধান ক্ষেতের খালি জমিতে কয়েকবাড়ির ছেলেরা মিলে বল খেলে। সবার সাথে জমির পাড়ে বসে খেলা উপভোগ করে মিরন। তারপর বাজারে গিয়ে এক কাপ চা ও এক পিস কেক খেয়ে মিরন বাড়িতে ফিরে আসে। মিরন যেহেতু অসুস্থ, তাই তার চলাফেরার দৈনন্দিন রুটিন মা,বোনের মুখস্থ।
খেলা শেষ হলো। বিকেল ফুরিয়ে গেলো। সাঁজের আগমন ঘটলো। কিন্তু মিরন এলো না। হালিমা ও মহুয়া উদ্বিগ্ন হলো। বোরকা পরে মা,মেয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে মিরনকে খুঁজতে বের হলো। কোথাও মিরনের চিহ্নটুকু নেই। এভাবে বাড়ির ও আশপাশের বাড়ির মানুষজন জেনে গেলো। সবাই হায়-হুতাশ শুরু করলো। চারপাশ ঘনিয়ে আঁধার নেমে এলো। হালিমা ঘরে ফিরে এলো। নাতনি বুলবুলিকে পাশে বসিয়ে কান্না জুড়ে দিলো। মহুয়া বাজারে চলে গেলো। গ্রামের পরিচিত যে ছেলের দোকানে মিরন চা খায় রোজ।
তাকে ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আলফু ভাই, মিরন চা খেতে আসছিলো বিকেলের শেষের দিকে? তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
“হ। আইছিলো তো। এক কাপ মালাই চা আর একটা ‘ক্রিম বন’ খাইলো। এরপর দেখলাম সাবের মিয়ার মিলের ভিতরে গেলো। তারপর তো আর জানি না বইন।”
বিচলিত স্বরে জানালো আলফু।
পা চালিয়ে মহুয়া মিলে গেলো। মিরনকে দেখতে পেল না। উপস্থিত অন্যদের কাছে মহুয়া জানতে চাইলো,
“আমার ভাই মিরন মিল থেকে বের হয়ে কোনদিকে গেলো,আপনারা দেখেছেন?”
“কই মিলে তো তোমার ভাইরে দেখিনাই। অবশ্য আমি আইলাম বেশীক্ষণ হয়নাই।”
জানালো লোকটি।
অন্যরা বললো,
“আমরাও দেখিনাই। তাই কইতে পারি না।”
“সাবের চাচা বিকালে মিলে আসছে?”
“হ আইছিলো। আবার চইলা গ্যাছে।”
মহুয়া বিমর্ষ নয়নে সম্ভাব্য সব স্থানে মিরনকে খুঁজলো। ফলাফল শূন্য। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেলো মহুয়া। আশাহত গলায় মাকে সব জানিয়ে বললো,
“আম্মা,কী করবো এখন? কোথায় খুঁজবো আর?”
“তোর নানাগো বাড়ি,খালাগো বাড়ি মোবাইল কর।”
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো হালিমা।
“মিরন এই জনমেও একা একা কোন আত্মীয়ের বাড়ি যায় নি আম্মা। আজ হঠাৎ কেন যাবে? তবুও ফোন দেই।”
বলে মহুয়া সব আত্মীয়ের বাড়ি ফোন দিয়ে খোঁজ নিলো। সবার এক কথা। মিরন যায় নি। বাড়ির মানুষজন মহুয়াদের ঘরে জড়ো হলো। কারো কারো কথামতে বাড়ির আশেপাশের ডোবা,খালেও মিরনের সন্ধান করলো। লাভ হলো না। মহুয়া কান্নাজড়িত সুরে আসিফকে মিরনের বিষয় জানালো। আসিফ চিন্তিত হলো।
বললো,
“সকাল হোক। দেখো মিরন ফিরে আসে কি-না। নইলে থানায় যেতে হবে।”
পল্লীগ্রাম। রাত হতেই নির্জনতা ভর করলো পরিবেশজুড়ে। সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো।
মহুয়া চট করে মাকে বললো,
“মা,আলফু বললো মিরনকে মিলে ঢুকতে দেখেছে। আবার মিলে যারা ছিলো তারা বলল সাবের বিকেলে মিলে গিয়েছে। যদিও তারা মিরনকে দেখেনি মিলে। তাহলে সাবের মহাজনের বাড়িতে একবার যাওয়া জরুরী নয়?”
“হ, তাই তো। ভালো কথা মনে করছত।আলফু ছেলেটা আন্দাজে মিছা কতা কওনের পোলা না। এখন রাইত হইয়া গ্যালো। অমাবইস্যার আন্ধার মাড়ায়া ক্যামনে যাইবি? ভোরে যাইস। বুলবুলি তখন ঘুমায়া থাকবো। হের বাদে থানায় গিয়া পুলিশরে জানাইতে হইবো। বইসা থাকনের টাইম নাই। আইচ্ছা সাবের কিছু করেনাই তো মিরন রে? সেইতো তোর, আমার উপরে বহুত ক্ষ্যাপা!”
তসবী হাতে দোয়া দরূদ পড়তে পড়তে আল্লাহর নাম জপতে জপতে বললো হালিমা।
“এটা আমারও একটু একটু মনে হচ্ছে। দেখি আগে তার বাড়ি যাই। একা যাওয়া ঠিক হবে মা?”
“এখন হইলে সমস্যা আছিলো। ভোরে এই ঘর ওই ঘরের মুরুব্বিরা নামাজ পড়তে উইঠা যায়। সমস্যা নাই। তুই ঘরে যাইস না। দুয়ারের বাইরে খাড়ায়া জিগাবি আর চইলা আসবি।”
“হ্যাঁ। সেটাই। ঘরে যাওয়ার কাজ নেই আমার।”
সারারাত নির্ঘুম কাটে মহুয়া ও হালিমার। অপেক্ষা প্রভাতকালের। ভোরের আলো না ফুটতেই মহুয়া বোরকা পরে বেরিয়ে যায় সাবেরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাবের তার ঘরে নামাজ পড়ে উঠলো মাত্র। তখন ঘরের দরজায় বাইরে হতে আস্তে করে টোকা পড়লো। সে আধপাকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে চাপানো দরজার দুই কপাট মেলে ধরলো। মহুয়া তাকে সালাম দিয়ে ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলো।
সাবেক অবাক চোখে দুঃখিত গলায় বললো,
“হায় খোদা! কি কও? ভিতরে আসো। ভালো কইরা শুনি।”
মহুয়া এক পা অতিক্রম করে ঘরের ভিতরে গেলো। এবং সামিনে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“চাচা, আলফু বললো তার দোকান হতে চা খেয়ে মিরন আপনার মিলে গেলো। এবং আপনার মিলের লোকজন বলল আপনি বিকেলে মিলে ছিলেন।”
“আলফু কইছে? একদম মিছা কথা। তোমার ভাই মিরন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আমি বিকালবেলায় মিলে ছিলাম তা সত্য। কিন্তু আমি থাকা অবস্থায় তোমার ভাইরে দেখিনাই। তার আগে পরে গেছে কি-না সেইটাতো আমি জানি না।”
মহুয়া হতাশ হয়। তার ধারণা ছিলো সাবের থেকে হয়তো কোন ক্লু পাবে মিরনের। সে বিদীর্ণ স্বরে বললো,
“আচ্ছা চাচা। আসি তাহলে।”
মহুয়া পা বাড়াতেই তার হাত ধরে ফেললো সাবের। ভিতর হতে দরজা বন্ধ করে দিলো। মহুয়ার মুখ চেপে ধরলো যেন চিৎকার দিতে না পারে। তার অল্পক্ষণ পরেই মিজান গিয়ে হাজির হলো সাবেরের ঘরে।
মিজান ভাই! তিনি না চট্রগ্রামে থাকেন? বাড়িতে কখন এলো আর এতো ভোরে এখানেই বা কেন? মহুয়া আর কিছু ভাবতে পারে না। সম্বিৎ ফিরে পায় মিজানের হেঁড়ে গলায় আওয়াজে।
“এই মহুয়া এদিকে আয়।”
মহুয়া পা টিপে টিপে যায় মিজানের সামনে। আড়ষ্ট হতে ঘরের দেয়াল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। মিজান ভিতর হতে দরজা বন্ধ করে দিলো। সাবেরের গলা টিপে বললো,
“মিরন কোথায় বল? নইলে তুই এখন গুম হয়ে যাবি কসম। মহুয়ার বাপে সারাজীবন তোরে ভাই বলছে। কিন্তু নিজের লোলুপতার জন্য ভাতিজিসম মহুয়াকে বিয়ে করতে চাইলি। সে রাজী না হওয়াতে তার আলাভোলা সহজ সরল ভাইটাকে গুম করলি। যেন মিরনকে খুঁজতে মহুয়া তোর কাছে আসে, আর তুই নোংরামিতে মেতে উঠবি। বল মিরন কই?”
সাবের গর্জন করে উঠলো।
“এই শুয়োরের বাচ্চা। মিরনরে আমি গুম করছি প্রমাণ কী?”
“প্রমাণ আলফু।”
বলে মিজান সাবেরের বিশেষ স্থানে জোরে লাথি মারলো। বয়স্ক সাবের নিতে পারল না। ওমাগো! বলে ভয়ানক যন্ত্রণায় হাত চেপে ধরে বসে পড়লো। বুঝলো তার আর রক্ষা নেই। কারণ সে এবং গ্রামের সবাই জানে মিজান খুবই বদরাগী ছেলে। একবার মারপিট করে আপন চাচাতো ভাইকে ছুরিকাঘাত করে র ক্তা ক্ত করেছিলো মিজান।
মহুয়ার মুখে কোন রা নেই। পূর্বের স্থানে কুঁজোর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।
সাবের কোঁকানো স্বরে বললো,
“ধানের গোলার ভিতরে আছে।”
মহুয়া দিশেহারা হয়ে ছুটে গেলো বিশাল ধানের গোলার দিকে। যেই চৌকির উপরে গোলাটা অবস্থিত, মহুয়া সেই চৌকিতে পা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখলো তাই ভাই মিরন। আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
“ভাই,মিরন। এই মিরন উঠে আয়।”
বোনের আদরমাখা কণ্ঠ শুনে মিরন জেগে উঠে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মিজান এগিয়ে গেলো। মিরনকে ধরে গোলার ভিতর হতে বের করে আনলো। মিরনকে সাবেরের সামনে এনে বললো,
“এত কাহিনী করার টাইম নাই। আমি যেটা ধারণা করছি সেটা সত্যি কিনা বল? তুই মহুয়ার সাথে অশ্লীল কাজ করার জন্য এই নাটক করছিস। ঠিক?”
সাবের মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ঠিক।
মহুয়া নির্বাক হয়ে যায়। মিজান বলে,
“এখন কী সাজা দিবো সাবের মহাজনরে? নাকি থানাপুলিশ করবো? বাড়ির সবাইকে ডেকে আনবো?”
সাবের হাতজোড় করে মাফ চাইলো মিজানের কাছে। মিজান বললো,
“আজকের পর হতে মহুয়াদের পরিবারের কারো কোন রকম ক্ষতি হলে তার দায়ভার তোর নিতে হবে। রাজী?”
সাবের সম্মতি জানায়।
” মহুয়ার পা ধরে বল,আম্মা আমার ভুল হইছে মাফ কইরা দাও।”
সাবের মনে মনে ফুঁসে উঠছে। যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। কেউ দেখে যাবে। এদের বিদায় করা জরুরী। তাই উপায়হীন হয়ে সাবের মহুয়ার পা ধরে মিজানের শিখিয়ে দেওয়া কথা বলল।
মিজান ও মহুয়া মিরনকে নিয়ে চলে যায়।
“মিজান ভাই হঠাৎ করে এই বাড়িতে এলেন কেন?”
লজ্জা ও ইতস্তত কণ্ঠে জানতে চাইলো মহুয়া।
“যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। এত সাহস দেখিয়ে একা যাওয়া উচিত হয় নি তোর।”
“বুঝলাম। মিরনকে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে ছিলাম। অতটা ভাবতে পারিনি। বুঝে উঠতে পারিনি।
আপনার বিষয়টা বুঝলাম না মিজান ভাই?”
“সেটা বাড়িতে গিয়ে চাচীর থেকে জেনে নিস।”
“আচ্ছা।”
পুরোপথ কেউ আর কোন কথা বলে না। মিজান তাদের বাড়ির পথে পা রাখে। মহুয়া মিরনের গলা পেঁচিয়ে ধরে নিজেদের বাড়ি চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় মহুয়া বাকরুদ্ধ! মিরনকে দেখে হালিমা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে। মহুয়া বড় বড় স্বাস ফেলতে থাকে। ঘটনার সারাংশ মাকে বললো।
শুনে হালিমা ভীতসন্ত্রস্ত! সে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই ক্যামনে সাবেরের বাড়ি গেলি বাপ? ক্যামনে? কও তো মায়েরে?”
মিরন বললো,
বিকালে সাবের তাকে চিপস কিনে দেয়। মিল থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। দূর আছে সেই জায়গা। পথের উপর একটু সময় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে। তারপর আবার তাকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে যায়। সময় সন্ধ্যার পর। রাতে ভাত খাইয়ে দিয়ে গোলার ভিতরে তাকে লুকিয়ে থাকতে বলে। সে রাজী না হলে রাকে ভয় দেখায়। মিরন ভয়ে রাজী হয়।
হালিমা বললো,
“নিজের মনের সামান্য খায়েস মেটানোর লাইগা মানুষ এতবড় হারামিপানা করে। মন চায় কুচি কুচি কইরা ফালাই এই বেটারে।”
বুলবুলি জেগে যায়। কান্না করে। তাই মহুয়া মিজানের বিষয় জানতে পারেনি তৎক্ষনাৎ!
সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরেই আসিফের মনে হলো মহুয়ার কথা। মিরনের কথা। তার ভাবনায় ঠাঁই হলো এই মহুয়ারা বড় একা। ঘুরেফিরে তাদের জীবনে বিপদ লেগেই আছে। মহুয়াদের রাত-দিন এভাবে যেতে পারে না। আসিফ ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে নিলো।
বাবা মাকে বললো,
“ভাবছি মহুয়াকে বিয়ে করবো। ওরা অসহায়! যতটুকু ওকে দেখেছি ভালই মনে হলো।”
“মনে হওয়া আর বাস্তবতা এক? তুই না সেদিন কইলি এই মেয়ের সাথে তোর কথাই হয় না? আর এখন কী কস তুই? তাইলে ত আমাদের আন্দাজটাই ঠিক হইলো। কই গ্যালো তোর লম্বা কথা? আমাদের উপযুক্ত তোর দোকানের বেতনভুক্ত সামাইন্য একটা কর্মচারী মেয়ে?”
রোষপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন আসিফের পিতা কাশেম।
চলবে…১৩