#মহুয়ার_রাতদিন. ১৪ ✍️ #রেহানা_পুতুল
“কই গ্যালো তোর লম্বা কথা? আমাদের উপযুক্ত তোর দোকানের বেতনভুক্ত সামাইন্য একটা কর্মচারী মেয়ে?”
রোষপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন আসিফের পিতা কাশেম।
“বাবা, কে কার উপযুক্ত এটার মানদণ্ড কী অর্থ দিয়ে বিচার হয়?”
” তো কী দিয়া হইবো? সমাজ এমনিই। যেই কথা ঠোঁটে নিছত, সেইটা ঠোঁটের বাইর করবি না কইলাম। গিলা ফালা।”
পাশ থেকে আসিফের মা আফিফা বললো,
“আমরা চান্দের দ্যাশে বাস করি না। এই সমাজের কথা আত্মীয়স্বজনের কথাও মাথায় রাখতে হইবো। হেরা গরিব! অসহায়! তার লাইগা পাশে দাঁড়াইছস,উপকার করছোস,যেহেতু হেগো কেউ নাই,এই পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু মাঝখান দিয়া ভূতে ধরার মতন কী ভুলভাল কথা কইলি।”
আসিফ উঠে যায়। তার ধারণা ছিলো অন্তত তার মা তাকে সাপোর্ট করবে। কিন্তু না,তার মাও বেঁকে বসলো। স্বামীর সুরে কথা বলল।
বুলবুলিকে স্তন পান করিয়ে ফের ঘুম পাড়িয়ে দেয় মহুয়া। তার রাতে ঘুম হয়নি, ভোরেও উঠে যেতে হয়েছে। নিজের উপরে গেলো ঝড়। সবমিলিয়ে ট্রমাটাইজড মহুয়া। একই অবস্থা মিরনেরও। থেমে থেমে কেঁপে উঠে মিরন প্রবল বৃষ্টিতে ভেজা পাখির ছানার মতো।
মহুয়ার চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুমে ঢলে পড়ে। ঘন্টাখানেক পর ঘুম থেকে উঠে যায়। দোকান আছে বলে। সে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মা,মিজান ভাই কীভাবে জানলো? আমাদের তো উদ্বার উনিই করলো। বাপরে! বীরের মতো গিয়ে হাজির হলো ঢাল তলোয়ার ছাড়া।”
“এই পোলার হাত পা দুই জোড়াই চারখান ঢাল তলোয়ার। আর কিছু লাগে? মিজানের অতীত মনে কইরা দেখ।”
“ঠিক বলছ মা। তুমি গেলে তাদের বাড়ি? না মিজান ভাই আসলো?”
“মিজানই আসলো। এসে কইলো,চাচী আমি পরশু বাড়ি আসছি। কাল বাড়িতে ছিলাম না। নানাদের বাড়িতে গেছিলাম। আইসা শুনলাম মিরন নাকি নিখোঁজ । আমি আজ সকালেই চিটাগাং চইলা যাইতাছি। তাই যাওয়ার আগে আপনারে দেখতে আইছি। মিরনের খোঁজ পাইছেন চাচী?
পরে আমি কানতে কানতে কইলাম, বাবা হ হাঁচাই শুনছ। আলফু নাকি দেখছে মিরনরে মিলে ঢুকতে। তাই মহুয়া সাবেরের বাড়িতে গেছে। সাবের আবার মহুয়ারে বিয়া করতে চাইছে। মানা করনে ক্ষেইপা আছে আমাগো উপরে। তার দেওয়া ঘরের সব কাঠকুঠ নিয়া গেছে লোক দিয়া।
এসব শুইনাই মিজান লম্বা লম্বা পা ফালায়া চইলা গ্যালো। আমারে কিছু কয়নাই। যদিও আমি বুঝতে পারছি মিজান সাবেরের বাড়িতেই যাইতাছে।”
“ওহ! এবার বুঝলাম কাহিনী। মিজান ভাই যাই করুক না কেন আমাদের পরিবারের সাথে আগে থেকেই ভালো চলে। বিপদে আপদে এগিয়ে আসে। সাবের বেটারে যেই উষ্ঠা লাথি আর শাসানি দিয়েছে মা, জনমের জন্য সোজা হয়ে যাবে আশাকরি। নইলে তো মিজান ভাই আছেই।”
“হ, এইটা আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিচ্ছু না। মিজানরে ফেরেশতার মতন সেখানে পাঠাইয়া দিলো তোগো দুই ভাইবোনরে রক্ষা করনের লাইগা। আবার বাড়ি আইলে একবেলা দাওয়াত দিয়া খাওয়ামু তারে। ঘরের পালা মুরগী জবা দিমু।”
“দিতে পারবা। সমস্যা নেই।”
বলেই মহুয়া কৃতজ্ঞতার সাথে মিজানকে স্মরণ করে। আস্তে ধীরে তৈরি হয়ে নেয় দোকানে যাওয়ার জন্য। মিরনের কথা আসিফকেও মোবাইলে জানিয়ে দিলো মহুয়া।
মহুয়া দোকানে যাওয়ার আগে ভাইকে ভালো করে শাসিয়ে দেয় মায়া মায়া কণ্ঠে।
“ভাই আর কোনদিন ওই কুত্তার মিলে যাইবি না। কেউ তোর পকেটে টাকা ভরে দিলেও তার কথামতে কোথাও যাবি না। ক্ষেতে গিয়ে একটু খেলা দেখবি। আলফুর দোকানে গিয়ে চা খাবি। তারপর বাড়িতে চলে আসবি। মা আছে,তোর ভাগনি আছে। সময় কেটে যাবে এমনিই। বুঝলি ভাই।”
মিরন অনুগত হয়ে ঘাড় হেলিয়ে বোনের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে।
মিজান বাসে যেতে যেতে ভাবতে থাকে মহুয়ার কথা। মহুয়া তার পাশের বাড়ির মেয়ে। সম্পর্কে চাচাতো বোন হয়। দেখতে আগের মতই লাস্যময়ী আছে। মেয়ে হওয়াতে বাহ্যিক সৌন্দর্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি। মহুয়াকে বিয়ে করতে চাইলে কী তার পরিবার আপত্তি তুলবে? ভুল হয়ে গিয়েছে, মহুয়ার মোবাইল নাম্বারটা নেওয়া উচিত ছিলো। তাহলে তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়ার বাহানায় টুকটাক কথা হতো মহুয়ার সাথে। এতে ভাব জমানো যেতো। মহুয়ার মনকেও বোঝা যেতো।
মহুয়া দোকানে চলে যায়। আসিফও আসে দুপুরের দিকে। আসিফ সুযোগ খুঁজছে মহুয়াকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ মিলছে না। সে চেয়েছে কথাগুলো মোবাইলে না বলে সরাসরি বলবে মহুয়াকে। কিছু বিষয় কিছু মানুষের মুখোমুখি হয়ে বললে বিপরীত মানুষটার দিক হতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। দোকান শেষে মহুয়া বাড়ি চলে যায়। গিয়েই তার মায়ের কাছে শুনলো বুলবুলির দাদী সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে বললো,
“কে বলছে তোমাকে? পাশের বাড়ির ওই ভাবিটা?”
“হ। আহারে তকদির। তার ছোট পোলা জেলখানায়। মারে দেখতে আসতে পারবো নাকি,কি জানি। থানার নিয়ম ত কইতে পারি না। বেটি নাকি বাগিচার ভিতরে পাকা সুপারি পাড়তে গেছিলো। পানক সাপ কুণ্ডলী পাকাইয়া বইসা ছিলো। সে মাথা তুইলা সুপারি চাইতে চাইতে আগাইতাছিলো গাছের গোড়ার দিকে। অমনি সাপের গায়ে পাড়া পড়ছে। আর সাপে করছে দংশন। হাসপাতালেও নাকি নিছিলো। আহ জিন্দেগী! আহ মরণ! আল্লায় আমার মরণ ক্যামনে রাখছে কে জানে।”
মহুয়ার একটু খারাপ লাগলো তফুরার জন্য। পরক্ষণে আবার বিষিয়ে উঠলো মন। তফুরা তার সাথে শাশুড়ী হিসেবে যতটুকু ভালো চলেছে, তার চেয়ে বেশী নিষ্ঠুরতা করেছে। তার মেয়েকে মেরে ফেলেছে। তার বর্তমান মেয়েকেও মেরে ফেলার জন্য তার ভাতে বিষ মিশিয়েছে। খেতে দেয়নি ঠিকভাবে।
হালিমা বললো,
“তুই যাইবি নাকি? তোগো ত এহনও ছাড়াছাড়ি হইনাই।”
“আমি গেলে নানান কথা উঠবে মা। ঝামেলা পাকিয়ে যাবে। যেহেতু আমি তাকে ছেড়ে দিবো। আর গিয়ে কাজ নেই। একটার পর একটা বিপদ লেগেই আছে আমাদের। তাই সেদিকে সময় দিতে পারছি না। রাতে আসিফ ভাইকে ফোন দিবো। উনার তো পরিচিত ল.ইয়ার আছে। এর আগেও উনি আমাকে সঠিক তথ্য নিয়ে দিয়েছে।”
সন্ধ্যার পর মহুয়ার বড় জা তাকে ফোন দিলো। মহুয়াকে অনুরোধ করে বললো,
“তোর কাঁটা দূর হইছে। চইলা আয় মাইয়া নিয়া।”
“ভাবি সবকিছু মিলিয়ে জল যে পরিমাণ ঘোলা হয়েছে এবং যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, আমার ফিরে যাবার অবকাশ নেই। মাফ করবেন আমাকে। একা আছি। ভালো আছি। বেঁচে আছি।”
জায়ের কথা শুনে মহুয়ার মনে হলো এখন আমানদের বাড়ির অন্যরাও তাকে ফুসলাতে থাকবে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কারো কথায় পটে যাওয়া যাবে না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে। যেই কথা সেই কাজ।
সে রাতে মহুয়া নিজেই আসিফকে ফোন করলো। আসিফ অবাক হলো না। কারণ মহুয়া তাকে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ফোন করে। যদিও এর বাইরে কখনো ভুল করে মহুয়া তাকে ফোন দেয়নি। এমন কি সেও না। তবে মহুয়ার আজকের ফোন পেয়ে আসিফ অন্যদিনের চেয়ে খুশী হলো। সে নিজেই ভাবছে মহুয়াকে ফোন দিবে। কিন্তু মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো মহুয়ার অপ্রত্যাশিত ফোনকল তার হৃদয়ে সুখের ফল্গুধারা বইয়ে দিলো। যদিও আসিফ সেটা গোপন করলো মহুয়ার কাছে। মহুয়া সালাম দিলো। আসিফ সালামের জবাব দিয়ে ঠান্ডা গলায় জানতে চাইলো,
“মহুয়া কেমন আছো? দোকানে সেই পরিবেশ ছিল না বলে জিজ্ঞেস করতে পারিনি কিছু। মিরন কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি আছে মিরন। আমরাও আছি ঠিক যেমন থাকার কথা।”
মহুয়ার কণ্ঠ নিষ্প্রভ! ধীর! ক্লান্ত!
“তো বলো কী সমস্যা এখন?”
“ভাইয়া,আমি বুলবুলির আব্বুকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। কীভাবে কী করতে হবে আমি তো জানি না। আপনি তো আগেও এমন বিষয়ে আমাকে হেল্প করেছেন, তাই আপনার শরনাপন্ন হলাম।”
“ঠিক আছে আমি খোঁজ খবর নিয়ে সব ওকে করছি। ফাইনাল করেই তোমাকে জানাবো।”
তার পরের সপ্তাহে মহুয়া আসিফের সাহায্য নিয়ে আমানকে তালাক দিয়ে দিলো। রুলস মেনে প্রথমে লিখিত নোটিশ পাঠালো আমানের কাছে তাদের বাড়ির ঠিকানায়। তারপর কাজির কাছে ও আমানদের গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে। এখন মাত্র কার্যকর হওয়ার অপেক্ষা। মহুয়া প্রলম্বিত স্বাস ছাড়লো। যেন তার বুকের উপর হতে বিশাল পাথর সরে গেলো।
তার দু’চারদিন পর এক রাতে আসিফ নিজেই ফোন দিলো মহুয়াকে। কারণ এখন মহুয়াকে যে কেউ বিয়ে করার প্রস্তাব দিতে পারে। দেরী করলে নিজেই ফেঁসে যাবে পরে। মহুয়া রিসিভ করলো। আসিফ একথা ওকথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“মহুয়া,মানুষ হিসেবে আমাকে তোমার কেমন লাগে?”
“খুব ভালো লাগে আসিফ ভাই। অন্যের বিপদে যে মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে মহানুভবতার হাত বাড়িয়ে দেয়,সে নিঃসন্দেহে একজন ভালো মনের অধিকারী। তাকে পায়ে ঠেলার বা ইগনোর করার কোন সুযোগ নেই।”
মহুয়ার অকপট স্বীকারোক্তি।
মহুয়ার কথা শুনে আসিফের নিজের উপর আত্মবিশ্বাস দিগুণ হয়ে গেলো। তার অন্তরটা নেচে উঠলো। সে নড়েচড়ে বসলো বুক টানটান করে। কণ্ঠে রসসুধা ঢেলে বললো,
“আমি তোমার ও বুলবুলির এক আকাশ নির্ভরতা হতে চাই। চিরদিনের জন্য। নির্ভর করা যায় আমাকে?”
মহুয়া বিদুৎ শকের মতো কেঁপে উঠলো। হাত থেকে মুঠোফোনটা পড়ে গেলো বিছানার উপরে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ কী শুনলো সে? সত্যি না-কি বিভ্রান্তি!
“হ্যালো…হ্যালো…মহুয়া এনি প্রবলেম? আমাকে শুনতে পাচ্ছো?”
মহুয়া অবিশ্বাস্য চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের উপরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ওপ্রান্ত হতে ভেসে আসছে আসিফের ভরাট অথচ নরম কণ্ঠস্বর।
চলবে…১৪