#মহুয়ার_রাতদিন. ১৫ ✍️ #রেহানা_পুতুল
মহুয়া অবিশ্বাস্য চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের উপরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। ওপ্রান্ত হতে ভেসে আসছে আসিফের ভরাট অথচ নরম কণ্ঠস্বর।
“হ্যাঁ.. হ্যাঁ…শুনছি।”
ভীষণ অপ্রস্তুত গলায় বলল মহুয়া।
“শুনলে হবে না মহুয়া। আনসার দিতে হবে।”
“সবকিছুর আনসার হয় না বা দেওয়া যায় না।”
নিচু ও নমনীয় স্বরে বলল মহুয়া।
না বোধক জবাবে মহুয়ার প্রতি আসিফের আগ্রহ ও ভালোলাগা গতি পেলো নদীর স্রোতের মতো। মাধূর্যভরা স্বরে বলল,
“তুমি সময় নাও। আমি আছি।”
“আপনার ফ্যামেলি আমাকে মেনে নিবে?”
“নাহ।”
“ফ্যামিলির অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। তাদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবেন।”
“নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিব না?”
“নাহ। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার সাথে আপনার যায় না। তেল জল কখনোই মিশে না। কখনোই এক হয় না। আবেগ আর বাস্তবতা ভিন্ন।”
“বাহ! আবেগের বয়সে বাস করে আমাকে আবেগের বুলি শেখাচ্ছো?”
“বয়স আবেগের। এটা সত্যি। কিন্তু আমার বাস্তবতা বিবেকের। তাই পিষে ফেলেছি আবেগের জীবনকে!”
“তোমার নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামিল হতে চেয়েছি।”
মহুয়া নিরুত্তর! ফোন রেখে দিলো। আসিফ মোবাইলের স্ক্রিনের উপরে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলো। সে ভাবলো কী আর হলো কী। তার শুধু ধারণা নয় বিশ্বাস ছিলো, মহুয়া এক বাক্যে রাজী হয়ে যাবে। জীবন নিয়ে এত বড় অপরচুনিটি সে ভুলেও হাতছাড়া করবে না। মহুয়ার আত্মমর্যাদাবোধ দেখে আসিফ বিস্মিত হলো।
এদিকে মিজান কোনভাবে মহুয়ার মুঠোফোনের নাম্বার যোগাড় করলো। ফোন দিলো। আননোন নাম্বার। রিসিভ করে সালাম দিয়েই মহুয়া বললো,
“হ্যালো… কে?”
“তোকে সুরক্ষিত উদ্ধার করলো যে,আমি সে।”
ভণিতা না করেই চঞ্চল সুরে জবাব দিলো মিজান।
“ওহ! মিজান ভাই? কেমন আছেন? ফোনে আপনার সাথে এই প্রথম কথা হচ্ছে। তাই নাম্বার দেখে চিনতে পারিনি। আমার নাম্বার কার থেকে সংগ্রহ করেছেন?”
চমকিত সুরে জিজ্ঞেস করলো মহুয়া।
” ভালো আছি। আমার নাম্বার তোর সংগ্রহ করার কথা ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা যখন হচ্ছে না,তাই আমিই তোর নাম্বার যোগাড় করলাম।”
“আসলে মিজান ভাই খুবই দুঃখিত! ফোনে কথা বলার বিষয় মাথায় আসেনি। কিন্তু আম্মাতো অপেক্ষায় আছে, আপনার বাড়ি আসার জন্য। আপনাকে দাওয়াত দিবে বলছে।”
“বাঁচালাম তোকে। চায় আম্মা! আজব! তুই চাস না?”
হেয়ালী হেসে বললো মিজান।
মহুয়া বললো,
“চাইবো না কেন মিজান ভাই? অবশ্যই চাই।”
এভাবে কিছুক্ষণ পর দু’জনের দুষ্টমিষ্ট রসালো বাক্যলাপের ইতি ঘটে। মিজান আপ্লুত হয় মহুয়ার সাথে কথা বলতে পেরে। মহুয়াও আপ্লুত হয়ে উঠে মিজানকে ফের মনে করে। ফিরে গেলো তার কৈশোরে। মিজানদের বাড়ির উপর দিয়ে যখন স্কুলে যেতো,মিজান একটু আধটু কথা বলতো তার সাথে। মাঝে মাঝে দোকান থেকে কোন খাবার কিনে দিয়ে বলতো,
“টিফিন খাইস। তোর নামের আর আমার নামের শুরুতেই ‘ম’ অধ্যাক্ষর, খেয়াল করেছিস?”
চোখের পাতা ঝাপটিয়ে মহুয়া বলতো,
“তাই বুঝি কিছু কিনে দেন?”
মিজান চাপা হেসে বলতো,
“না। তোর জন্য মায়া লাগে। তাই।”
বালিকা মহুয়া মুখ টিপে লাজুক হাসতো। মেঠোপথের পাড় ধরে স্কুলে হেঁটে যেতো। তার আবেগী মন বুঝে নিতো মিজান তাকে পছন্দ করে। তাই নিজের ভিতরের অনুভূতিগুলো অন্যভাবে ঢেউ তোলে তার বুকের ভিতরে।
কিন্তু মহুয়ার এই ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেলো। এবং স্পষ্টতই বুঝতে পারলো মিজান তাকে এটা সেটা কিনে দিতো তারা দরিদ্র বলে। যেটা ছিলো মিজানের ভালোবাসা নয়। করুণা বা সহানুভূতি দেখানো। তাই তো মহুয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেও মিজানের কোন হেলদোল নেই। এবং মিজান উৎফুল্ল মনে সবার সাথে তার বিয়ের দাওয়াত খেলো।
বিয়ের পর মহুয়া স্বশুর বাড়ি চলে যায়। আর কোনদিন দেখা হয়নি তার সেই ভালোলাগার পাশের বাড়ির মিজানের সাথে। এতবছর পর ধমকেতুর মতো মিজানের আগমন তার ভিতরটাকে নিংড়ে দিলো।
মহুয়ার মেয়ে বুলবুলি অনেক অসুস্থ! তাই মহুয়া দোকানে যায় নি। ছুটি নিয়েছে এক সপ্তাহ। কিন্তু আসিফ ধরে নিলো মহুয়া সংকোচে তার চোখের আড়াল থাকছে নিজেকে একটু থিতু করে নেওয়ার জন্য। সে ছুটি দিতে কার্পণ্য করল না।
এদিকে মহুয়ার সাথে কথা বলার পর মিজানের ভিতরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। হুটহাট মনটা পুলক অনুভব করে। বেখেয়ালি পথ চলে সে উদাসি বনের পাখির মতো। মনের আরশীতে রঙধনুর মতো ভেসে উঠে মহুয়ার কিছু স্মৃতি! তার বালিকা বেলার কচি কচি কণ্ঠে বলা কিছু কথা,কিছু প্রশ্ন! মহুয়াকে কী আবার ফোন দেওয়া ঠিক হবে? আগের মহুয়া আর বর্তমান মহুয়ার ব্যবধান বিস্তর! জীবনের কঠিন বাঁক মহুয়াকে কোথায় নিয়ে গেলো। কিভাবেই বা কাটছে মহুয়ার রাত-দিন? অনিয়ন্ত্রিত আবেগের কাছে ধরাশায়ী হলো মিজানের মন। তাই সাতদিন না ফুরাতেই মহুয়াকে ফোন দিলো মিজান। মহুয়া রিসিভ করলো। কুশলাদি বিনিময় করলো মিজানের সাথে। মিজান তাদের পরিবারের নানা প্রসঙ্গ তুলে মহুয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। মহুয়া পূর্ণ মনোযোগে মিজানের কথাগুলো শুনলো।
মিজান বলল,
“মহুয়া তুই তো এখন সিংগেল মাদার। তোর সামনে পুরো একজীবন পড়ে রয়েছে। সাথে তোর মেয়েরও। আমার সম্পর্কে তোকে নতুন করে বলার কিছুই নেই। সরাসরিই বলি। তোর আপত্তি না থাকলে আমার কাছে চলে আসতে পারিস।”
“সেই স্কুল লাইফের মতো আবারো করুণা! আবারো সহানুভূতি!”
তুচ্ছ হেসে জবাব দিলো মহুয়া।
“কসম খেয়ে বলছি এমন কিছুই নয়। তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। ভিতর হতে টের পাই তোর প্রতি আমার ভালোবাসা ছিলো। অমোঘ টান ছিলো। সেই টানেই তুই স্কুলে যাওয়ার সময় আগ বাড়িয়ে একটু কথা বলতাম। তোকে খাবার কিনে দিতাম। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না আমার। তুই অন্যের হয়ে গেছিস। আমাকে ক্ষমা কর মহুয়া। মানুষ মাত্রই ভুল। না উপলব্ধি করতে পেরেছি নিজের ভালোবাসা! না উপলব্ধি করতে পেরেছি তোর ভালোবাসা!”
“আমার এখন এসব শোনার মানসিকতা নেই। মন মরে গিয়েছে মিজান ভাই। পাশাপাশি বাড়িতে এই বিয়ে সুখকর হবে না। আমাদের দুজনের জন্যই এই কথাটা।”
“মন কখনো মরে না। পরিস্থিতি মনকে দমিয়ে রাখে। নিভিয়ে দেয়। উপযুক্ত বন্ধু বা সঙ্গী পেলে সেই মন আবার জীবন্ত হয়ে জ্বলে উঠে দাউদাউ করে। মধুর প্রণয়ে হৃদয়ের আনাচকানাচ দুলে উঠে। তুই অভিমান করে আমাকে প্রত্যাখ্যাত করছিস। অভিমান ভুলে আমার বুকে আয়। আমি চাচীর কাছে প্রস্তাব রাখবো।”
“রাখতে পারেন। লাভ নেই।”
দুজন দুজনের থেকে বিদায় নেয়।
মহাজন সাবের মহুয়াদের আর কোন বিরক্ত করছে না। তফুরা মরে গেলো। আমান জেলে। আসিফ তাকে বিয়ে করতে চায়। আগমন হলো মিজানের। সেও পেতে চায় চিরসঙ্গী হিসেবে। সব মিলিয়ে মহুয়া কেমন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলো।
কোন সিদ্ধান্ত নিবে সে?
মহুয়াকে ফোন করে আসিফ। বললো,
“কাল তো দোকানে আসবে। তারপর বাড়িতে যেও না। রিকশা নিয়ে ‘আয়োজন’ রেস্টুরেন্টের সামনে যেও। একসাথে লাঞ্চ করবো। এবং কিছু কথা আছে আমার। কেমন?”
মহুয়ার মন সায় দেয় না। কিন্তু আসিফ তার মালিক। তাই মানা করার জো নেই। সে বললো,
“আচ্ছা আসিফ ভাইয়া। ঠিক আছে। থাকবো।”
তার পরেরদিন মহুয়া দোকানে গেলো। আসিফও গেলো। বৃহস্পতিবার বলে দোকানে বিক্রির ধুম ছিলো। কাষ্টমারের ভীড় ছিলো। তাই অন্যদিনের চেয়ে দোকান থেকে বের হতে মহুয়ার দেরী হয়ে গেলো। মহুয়া দোকান থেকে বের হয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়িতে যাওয়ার পথ ধরলো। বাসে উঠে গেলো। আসিফকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিলো।
“খুব সরি। আমার ছোট মেয়ে আছে। এমনিতেই আজ বেশ দেরি হয়ে গেলো। কাল বাইরে দেখা করবো।”
আসিফ রিপ্লাই দিলো,
“আচ্ছা মহুয়া। কোন সমস্যা নেই।”
সময় বর্ষাকাল। অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। চারপাশ কিছুটা আঁধার হয়ে এলো। জ্যামপূর্ণ রোড। তাই বাস থেমে আছে।বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। মহুয়ার উদ্বিগ্নতা বাড়ে তার ছোট্র বুলবুলি পাখিটার জন্য। বাস স্টেশনে এলো অধিক সময় পার করে। কোন রিকশা নেই। মহুয়ার সাথে ছাতাও নেই। সে একটি দোকানে ঝাঁপের নিচে দাঁড়ালো। অপেক্ষা বৃষ্টির গতি মন্থর হওয়ার।
তারপর মহুয়া পা বাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। ডানে বামে রিকশা খোঁজে। বৃষ্টির দরুন পল্লীর পথঘাট সরব থেকে নিরব হয়ে গেলো। হাঁটতে হাঁটতে মহুয়া বাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা নিরব স্থানে এলে দেখলো একটি সিএনজি। সে দরদাম করে সিএনজিতে উঠে পড়লো। বাড়িতে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। বুলবুলি তাকে খুঁজছে হয়তো। তার পাশে ছিলো আরো দুজন পুরুষ যাত্রী। একটু পর সিএনজি অন্যপথে টার্ণ করলো। মহুয়া আৎঁকে উঠে। চিৎকার দেয়। অমনি তার মুখ বন্ধ হয়ে যায় একটি পুরুষালী হাতের থাবায়।
মহুয়ার মুখ বেঁধে ফেলে একজন যুবক। বাকিজন বললো,
“এবার যত পারিস চিল্লা সুন্দরী! একটু পরে দেয়ালের ভিতরের কুদাকুদি বাইরে থেকে কোন পক্ষীও টের পাইবো না।”
বলেই দু’জন অচেনা যুবক ডেভিল হাসি দিলো উচ্চস্বরে!
চলবে…১৫