নীড়বৃষ্টি পর্ব-০৭

0
7

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

রাত নেমে এসেছে অনেক আগে। আকাশে দেখা যাচ্ছে শুল্কপক্ষের চাঁদ। চারিদিক নিস্তব্ধ। ছাদের ওপর হালকা বাতাস বইছে। সেই বাতাসে দুলছে নীলা বেগমের ছাদ বাগানের গাছের পাতা এবং ফুলগুলো। টবে থাকা গন্ধরাজ গাছের ফুল হতে ভেসে আসছে মৃদু মাদকীয় ঘ্রাণ। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো অয়ন সুকায়দায় দু ঠোঁটের মাঝে সিগারেট চেপে ধরে রেখেছে। পরনে তার একটা কালো রঙের টি শার্ট এবং ট্রাউজার। দৃষ্টি হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিন পানে নিবদ্ধ। নির্বিকার ভঙ্গিতে দেখছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির লেটেস্ট খবর। হুট করে কারো আগমনে চোখ তুলে তাকায় সে। সিগারেটটা হাত থেকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে এক পায়ে পিষে সেটাকে ঢেকে ফেলে নীরবে। নিতুন অবশ্য লক্ষ্য করে পুরো দৃশ্যটা। সে কাছে এসে বলে,

“তুমি ওটা ফেলে দিলে কেন, ভাইয়া? তোমার কী মনে হচ্ছে আমি আম্মুকে গিয়ে তোমার সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে নালিশ করবো? চিন্তা করো না। এটা তো আমাদের ফ্যামিলি ট্রেডিশন। আমাদের দাদা বদরুজ্জামান মাহমুদ সিগারেট খেতেন, আমাদের আব্বু কামরুল মাহমুদ সিগারেট খান, উনার বড়ো পুত্র অয়ন মাহমুদও সিগারেট খাচ্ছেন, একটু বড়ো হয়ে আমিও সিগারেট খাওয়াটা শিখে নিবো। দ্যা লেগেসি অফ মাহমুদ ফ্যামিলি হবে এটা। সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের ছেলেপেলেরাও এই ধারা অব্যাহত রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।”

অয়ন ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“দিন দিন ভয়ংকর রকম পেকে যাচ্ছিস তুই।”

নিতুন অবাক হয়ে বলে,

“তো পাকবো না? এটাই তো আমার পাকার বয়স। এই বয়সে না পাকলে আর কবে পাকবো? তোমার মতো প্রায় ত্রিশের ঘরের বুড়ো হয়ে? উঁহু, তোমার মতো বাত্তি হতে আমি আগ্রহী নই।”

অয়ন চোখ পাকিয়ে তাকায়। কিন্তু নিতুনের মাঝে ভয়ের কোনো উপদ্রেক দেখা গেলো না। উল্টো সে দাঁত বের করে বলে,

“আমি ভাবছিলাম ছাদে এসে দেখবো তুমি এক কোণে লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে ফোনে কাউকে মিষ্টি মধুর কথা বলছো। আড়ি পেতে আমিও সেসব কথা শিখবো বলে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি দেখি ঘাটের মরা ডোনাল্ড ট্রাম্প কার সঙ্গে কামড়াকামড়ি করছে সে-ই নিউজ দেখছো।”

অয়ন বলে উঠে,

“মিষ্টি মধুর কথা আবার কী জিনিস? তাছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত সকলের। তোকেও এজন্য বলি রোজ সকালে উঠে পত্রিকায় একবার চোখ বুলাবি। আই-কিউ শার্প হবে এতে করে। ভবিষ্যতে বিসিএসের এক্সামের জন্য এসব খুব কার্যকরী টিপস।”

নিতুন ভাইয়ের পাশে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে বলে,

“যার মিষ্টি মধুর কথা বুঝার মতো আই-কিউ নেই, সে কি-না আমাকে আই-কিউ নিয়ে জ্ঞান দেয়।”

নিতুনের কথাকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে অয়ন বলে,

“পড়াশোনা শেষ তোর? হোমওয়ার্ক করেছিস?”

“হ্যাঁ, আজকে হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করেছি। মিসকে প্রমিজ করে রেখেছিলাম যে আজ হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে রাখবো। তাছাড়া মিসের ভয়ংকর মাইর খাওয়ার সাধ মিটে গিয়েছে আমার।”

অয়ন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“হোম টিউটরের কথা বলছিস? উনি মারে তোকে? আম্মু আব্বু জানে?”

“হ্যাঁ। স্নেহা মিস ভয়ংকর মাইর দেয়। গত একমাসে আমার কয়টা কাঠের স্কেল ভেঙেছেন উনি হিসাব নেই। আম্মু আব্বু সব জানে। আম্মু তো প্রথম দিনই মিসের সঙ্গে ডিল করেছিল, যেন হাড্ডি আম্মুর জন্য রেখে মাংস মিস বুঝে নেয়। কি ভয়ংকর শিশু নির্যাতন হয় দেখেছো? আমাকে এরা কুরবানীর গরু পেয়ে রেখেছে মনে হয়।”

অয়নের মনে পড়ে যায় আজ দুপুরে কাঠফাটা রোদের নিচে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকা স্নেহার মুখখানা। মুখখানা দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় মেয়েটা বেশ রাগী। কিন্তু সে-ই রাগের মাত্রা যে স্টুডেন্টকে পিটিয়ে স্কেল ভেঙে ফেলার পর্যায়ের সেটা অয়নের জানা ছিল না। অয়নের মনে প্রশ্ন জাগে। স্নেহার রাগ সর্বোচ্চ পারদে পৌঁছালে তিনি কেমন ভয়ংকর কাজ করেন? অয়নের ভাবনার মাঝেই নিতুন আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলে উঠে,

“ভাইয়া, আকাশের চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।”

“হু?”

“বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছো তুমি?”

অয়ন নিতুনের প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রয়। নিতুন সামান্য গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বলে,

“চাঁদ ঢাকা পড়ে চারিপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। তার উপর বাতাসে ফুলের মনভুলানো ঘ্রাণ। আমি শুনেছি, এরকম আবহাওয়া জ্বিনদের খুব পছন্দ।”

এতক্ষণে সবটা পরিষ্কার হয় অয়নের কাছে। তার মুখের রঙ পাল্টে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করে। কিছুটা মিছে তেজ দেখিয়ে সে বলে,

“পড়াশোনা ফেলে ছাদে গল্প করতে চলে এসেছিস। সকালে ক্লাস নেই তোর? যা, এক্ষুণি বাসায় যা। তুই না গেলে আমি যাচ্ছি। আমার তোর মতো এতো ফালতু সময় নেই। সকালে কাজ আছে আমার। এখন গিয়ে ঘুমাতে হবে।”

কথাগুলো বলে হাই তুলতে তুলতে নিচে চলে যায় অয়ন। নিতুন পড়ে বিপাকে। আশেপাশে তাকিয়ে সে কিছুক্ষণ দেখে নেয় চারিপাশের পরিবেশটা। দূর হতে একদল কুকুরের ঘেউঘেউ ডাক ভেসে আসছে। নিতুন শুনেছিল কুকুর জ্বিন জাতিকে দেখতে পায়। তারমানে কী কুকুর গুলো ওরকম কিছু দেখেই এভাবে চিল্লাচ্ছে? ভীত নিতুন আয়াতুল কুরসি জপতে জপতে ভোঁ দৌড় দিয়ে নিচে চলে যায়। মনে মনে ঠিক করে আজ রাতে ভাইয়ার সঙ্গে ঘুমাবে।

__________

চারিপাশের নিস্তব্ধতা চিরে একটু পর পর শোনা যাচ্ছে এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। সরকারি হাসপাতালের বিশাল বারান্দাটা টিমটিমে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। দেওয়ালের সাদা রঙে সময়ের ক্লান্তি এবং অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। বারান্দার এককোণে থাকা পুরনো একটা স্টিলের বেঞ্চিতে বসে আছে স্নেহা। আলো আঁধারিতে ভরা হাসপাতালের এই বেঞ্চিটা যেন তার অস্থায়ী আশ্রয়। পরনের ওড়নাটাকে গায়ে শালের মতো প্যাঁচিয়ে রেখেছে সে। হ্যান্ডব্যাগটাকে নিজের পাশে বেঞ্চির উপর রেখে কাধের ব্যাগটাকে সতর্ক ভঙ্গিতে কোলে নিয়ে বসে আছে।

বাসা থেকে বের হওয়ার পর যখন খেয়াল হলো যে রাতে থাকার মতো পরিচিত কোনো জায়গা নেই তার, তখনই মনে হলো নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আপাতত হাসপাতালে রাত্রিযাপনই বেস্ট অপশন। আজকের রাতটা চোখ কান খোলা রেখে কাটাতে হবে তার। ক্যাম্পাসের পরিচিত এক সিনিয়র আপুর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। আপুর প্রেমিক ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে সক্রিয় দাপুটে এক বড়ো ভাই। কালকের মধ্যেই আশা করা যাচ্ছে হলে একটা খালি সিট স্নেহা পেয়ে যাবে। যদিও, এরকম ক্ষমতা খাটিয়ে ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা স্নেহা কখনোই বলে নি। কিন্তু আপু যেহেতু নিজ থেকেই এই ব্যবস্থা করে দিলো তাহলে সে আর নাকোচ করবে কেন? দূর্নীতি এবং ক্ষমতার দাপটে চলা দেশটায় স্নেহা না-হয় নিজের নিরাপত্তার জন্য এতটুকু ক্ষমতার ব্যবহার গ্রহণ করলো। এতে বিশেষ কোনো ক্ষতি দেখছে না সে। উল্টো স্নেহা ভালো করেই জানে, এই শহরে কোনো একা মেয়ের পায়ের নিচে জমি এবং মাথার উপর ছাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

গা ঝিম ধরে আসায় স্নেহা একটু নড়েচড়ে বসে। বেঞ্চটা ধাতবের হওয়ায় হাড়ে ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু তার ভেতরকার টানটান স্নায়ু এসব অনুভব করার মতো অবসরে নেই। বারান্দা জুড়ে থাকা অন্যান্য বেঞ্চে কিছু রোগীর আত্মীয় স্বজন গুটিসুটি মেরে বসে আছে, কেউ বা দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কেবল স্নেহার দু-চোখেই ঘুম নেই। তার অপেক্ষা ভোরের আলো ফোটার। আজকের রাতটা স্নেহার নিকট পরীক্ষা সরূপ এবং আগামীকালের সকালটা হয়তো নতুন শুরুর।

__________

সাভার মডেল থানার ভেতর জানালার ফাঁক গলে দুপুরের সূর্যের আলো প্রবেশ করছে। গরমে থানার ভেতর কর্মরত প্রায় সকলের মেজাজটাই আজ ভয়াবহ। তবে অয়ন বেশ শান্ত মুখেই নিজের ডেস্কে বসে ঠান্ডা লেবুর শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। তার কপাল জুড়ে দেখা যাচ্ছে একফালি ঘাম। টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাগজপত্র। অয়ন সেসবে চোখ বোলাচ্ছিল। এরমাঝে হুট করেই দরজায় টোকা পড়ে। অয়ন অনুমতি দিতেই রুমে প্রবেশ করে মডেল থানায় কর্মরত ওসি মনিরুল। অয়নকে লম্বা করে একটা সালাম দিয়ে ওসি সাহেব বলেন,

“স্যার, ওই ড্রাগ এডিক্ট ছেলেটা সামিউল। ওর কথা অনুযায়ী ড্রাগ ডিলারকে আমি নির্দিষ্ট ঠিকানাতেই দূর হতে চিহ্নিত করতে পেরেছি। আমি ভেবেছিলাম ছোট খাটো ড্রাগ ডিলার কেস হবে হয়তো এটা। কিন্তু এখন মোটেও সেটা মনে হচ্ছে না। এটা লোক্যাল গ্যাং নয়, স্যার। এর পিছনে বড়ো কারো হাত আছে।”

পূর্ণ মনযোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটুকু শুনে অয়ন প্রশ্ন করে,

“সন্দেহজনক কিছু পেয়েছেন?”

“স্যার, ডিলার ছেলেটা এলাকার মোটামুটি পরিচিত মুখ। সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে জানতে পেরেছি, ছেলেটা একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সেচ্ছাসেবী সদস্য হিসেবে যুক্ত আছে।”

অয়ন জানতে চায়,

“এরেস্ট করেছেন ছেলেটাকে?”

ওসি মনিরুল কিছুটা ভীতু গলায় প্রশ্ন করে,

“এরেস্ট করাটা কি ঠিক হবে, স্যার? এমপি আখতার সাহেবের দলের লোক। সাভারে উনার প্রভাব সম্পর্কে তো আপনি জানেনই।”

অয়ন অবাক হয়ে বলে,

“অদ্ভুৎ! কেসের জন্য ইন্টেরোগেশন করার প্রয়োজন পড়লে কি আমরা ধরবো না? মন্ত্রী এমপির দলের লোকদের জন্য কি আলাদা করে সংবিধানের আইন পাশ হয়েছে নাকি?”

ওসি ইতস্তত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“সরি, স্যার। বুঝতে পেরেছি।”

“আপনি এখন যেতে পারেন। ছেলেটাকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। ভেতরের খবর বের করার চেষ্টা করুন। মাদকবিক্রিতে কে কে জড়িত আমি লিস্ট চাই। যেকোনো ক্লু পেলে আগে আমাকে জানাবেন। এবং কাউকে বলুন তো ওই সামিউলের আপডেট জেনে আমাকে জানাতে। টেস্ট করিয়ে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে নাকি শিওর হোন।”

“জি, স্যার।”

ওসি সাহেব বেরিয়ে যেতেই অয়ন আবার কাগজপত্র দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতে পারলো না সে। এক হাতে ঘাড় মালিশ করতে করতে চোখ জোড়া কিছুক্ষণের জন্য বুজে নিলো। যখন চোখ মেললো, তখন টেবিলের উপর রাখা ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের গ্যালারির প্রিয় এলবামের রাজ্যে চলে গেলো। আঙুলের চাপে ওপেন করে গ্যালারির সবথেকে প্রিয় ছবিটা। অসম্ভব রূপবতী এক রমণী একটা উঁচু বিছানায় দু পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পরনে তার তাঁতের শাড়ি। যত্ন করে আঁচলটা তুলে রাখা হয়েছে বাঁ কাঁধে। কপালে নিখুঁতভাবে বসানো ছোট্ট একটা গোল টিপ। মাঝখানে শিথি করে আঁচড়ানো লম্বা চুলগুলো একপাশ করে সামনে এনে রাখা হয়েছে। অনাড়ম্বর আভিজাত্যে মোড়ানো রমণীকে দেখে অয়নের ক্লান্তি এবং খারাপ লাগা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। এ-ই খাঁ খাঁ গরমেও তার মনে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে। ফোনটা রাখার আগে শেষবারের মতো ছবিটাতে চোখ বুলিয়ে নেয় অয়ন।

__________

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হলে একটি সিট পেয়েছে স্নেহা। ভাগ্য সহায় ছিল বলে বেশি একটা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয় নি তার। তাছাড়াও সে আগে থেকেই হলের সিটের জন্য এপ্লাই করে রেখেছিল। এটাও তার ক্ষেত্রে একটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে গিয়েছে। তৃপ্তি আপুর ক্লাস ছিল বলে তিনি স্নেহাকে কেবল রুমের চাবিটা বুঝিয়ে দিয়েই দ্রুত চলে গিয়েছেন। স্নেহার অবশ্য খুব একটা মাথাব্যথা নেই তা নিয়ে। নিজের রাস্তা নিজে চিনে নেওয়াতে সে অভ্যস্ত। বরং উল্টো কেউ তাকে সেই সাহায্যটুকু করার চেষ্টা করলেই সে অপ্রস্তুত বোধ করে। হলের অফিস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহা নিজ গন্তব্যে পা বাড়ালো। পথিমধ্যে নিজ মনে মুখস্থ করে নিতে থাকলো হলের প্রতিটা অলিগলি।

মেইন বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই স্নেহা লক্ষ্য করে এককোণে রয়েছে দুটো ফ্রিজ এবং দুটো ওয়াশিং মেশিন। তাছাড়া নিচ তলাতেই একপাশে একটা ছোট্ট দোকানও রয়েছে। মেয়েদের যেন টুকটাক জিনিসপত্র কেনার জন্য কষ্ট করে হলের বাইরে না যেতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। কিছুটা হেঁটে যেতেই হলের ক্যান্টিনও চোখে পড়ে স্নেহার। যাক, এখানে অন্তত কেউ খেতে বসলেই তার কানের কাছে আলু পটলের হিসাব নিয়ে চিল্লাবে না। ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে ঘুরে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই স্নেহা চোখ পিটপিট করে ফেলে। কী একটা অবস্থা! এটা সিঁড়ি নাকি কোনো গোলকধাঁধা! নিজেকে ধাতস্থ করে স্নেহা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। হলটা প্রধানত দুই ব্লকে বিভক্ত। স্নেহার রুম পড়েছে বি ব্লকে। ব্যাগ হাতে তিন তলায় উঠে স্নেহা খুঁজতে থাকে ৩০৩/বি নম্বর রুমটা। খুব একটা বেগ পোহাতে হয় না তাকে। দু কদম হেঁটে যেতেই রুমটা পেয়ে যায়।

হাতের ব্যাগটা রেখে স্নেহা তাকে বুঝিয়ে দেওয়া চাবি দিয়ে লক খুলে রুমে প্রবেশ করে। জানালা বদ্ধ রুমটাতে প্রবেশ করেই তার দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। স্নেহা দ্রুত ব্যাগটা রেখে গিয়ে জানালা দুটো খুলে দেয়। সে দিনের বেশিরভাগ সময় ঘরের বাহিরে থেকে বড়ো হওয়া মানুষ। বাহিরের মুক্ত এবং খোলামেলা পরিবেশে অভ্যস্ত সে। তাই জানালা বন্ধ করে রাখাটা তার নিকট অপছন্দনীয় একটা ব্যাপার। জানালা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একফালি আলো প্রবেশ করে রুম জুড়ে। এবার রুমটাকে ভালো করে দেখার সুযোগ হয় স্নেহার। দুই সিটের এই রুমটাতে দুটো সিঙ্গেল বেড রয়েছে। রয়েছে দুটো পড়ার টেবিলও। দেয়াল জুড়ে কেমন একটা গোলাপি রঙের প্রলেপ। স্নেহার রুমমেট অবশ্য এখন রুমে উপস্থিত নেই। তবে তার বিছানা, টেবিল এবং দেয়াল জুড়ে ঝুলে থাকা বিভিন্ন আর্টওয়ার্ক দেখে স্নেহা বুঝতে পারে মেয়েটা খুব শৈল্পিক এবং রুচিশীল গোত্রের কেউ। অপরিচিতা মেয়েটার ব্যাপারে আন্দাজ লাগানো বন্ধ করে স্নেহা নিজের বিছানা এবং টেবিলের পানে তাকায়। ধূলো জমা বিছানা, টেবিল পরিষ্কার করার শক্তি খুঁজে পায় না সে। সারারাত দু চোখের পাতা মেলে জেগেছিল সে। তীব্র ঘুম তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ব্যাগ খুলে নিজের দুটো সুতির ওড়না বিছানায় বিছিয়ে নিয়ে ব্যাগগুলোকে লকারে তুলে রাখে সে। বাদবাকি কাজ সব জমা রেখে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে স্নেহা। জীবন নিয়ে ভাবার খুব একটা সময় পায় না। তার আগেই ঘুম তাকে গ্রাস করে ফেলে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]