নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.
শরীর এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ঘুমে নিমজ্জিত স্নেহার সময়ের খেয়ালই ছিল না। তার যখন ঘুম ভাঙলো তখন সূর্য প্রায় ডুবে যাওয়ার লগ্ন চলছে। স্নেহা আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে তার অপর পাশের টেবিলে বসে একটা মেয়ে মনযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। মেয়েটা স্নেহার দিকে পিঠ করে থাকায় পরিষ্কার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। তবে স্নেহা বুঝে নিলো এটাই তার রুমমেট। রুমমেটের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে স্নেহা আবার চোখ বুজতে নিলেই তার কিছু একটা মনে পড়ে। তড়িৎ গতিতে সে চোখ মেলে তাকায়। উঠে বসে নিজের ফোনটা বালিশের পাশ থেকে হাতে তুলে নিয়ে সময় দেখে।
বিকাল পাঁচটা বেজে তিন মিনিট তখন। আজকের সবগুলো স্টুডেন্টকে পড়ানোই মিস গেলো তার। এর মধ্যে দু’জন স্টুডেন্ট কলও দিয়েছিল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় স্নেহা সেই কল গুলোর আওয়াজ টের পায় নি। বুকে খিদার টান নিয়েই স্নেহা চোখ বুজে ঝিম মেরে বসে রয় কিছুক্ষণ। তখনই একটা চমৎকার মেয়ে স্বর বলে উঠে,
“উঠে গিয়েছেন, আপু?”
স্নেহা চোখ মেলে তাকায়। দেখে চেয়ারে বসে থাকা চমৎকার দেখতে মেয়েটা তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। রুচিশীল মেয়েটার চেহারা যেন স্রষ্টার নিখুঁত সৃষ্টির প্রতিচ্ছবি। দুধে আলতা গায়ের রঙ, মায়ায় ভরা চোখ জোড়া, লিপস্টিক বিহীন ঠোঁট যুগলও যেন হালকা গোলাপি রঙা ফুলের পাপড়ির মতো দেখতে। স্নেহার একটা বাজে স্বভাব আছে। হাসিখুশি কিংবা সুখী মানুষ দেখলে সে নিজের চোখ ফেরাতে পারে না। না চাইতেও কোথাও একটা তার মনে ভাবনা উদয় হয়, ‘আমি কেন এরকম খুশি হতে পারি না?’
স্নেহাকে ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে মেয়েটা নিজেই আবার বলে উঠে,
“আপু? আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন বলে আমি ডাকি নি। তৃপ্তি আপু এসেছিলেন। আপনি ঠিকঠাক স্যাটেল হয়েছেন কি-না দেখতে এসেছিলেন। উনার থেকে জানলাম আপনি এপ্লাইড ম্যাথম্যাটিকস ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট, সেকেন্ড ইয়ার। আপনার নামটা কিন্তু চমৎকার। স্নেহা! কী মায়া মায়া আদুরে নাম!”
সুন্দর দেখতে মেয়েটার কণ্ঠস্বরটাও চমৎকার সুন্দর! কী যেন বলে? হ্যাঁ, এই মেয়ের কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত খুব চমৎকার মানাবে বলে স্নেহার মনে হলো। মনে মনে একটা হতাশার নিঃশ্বাসও বুঝি ফেললো। উপরওয়ালা যাকে দেয়, তাকে সবই দেয়। স্নেহা ভদ্রতার খাতিরে কেবল প্রশ্ন করে,
“নাম কী? কোন ডিপার্টমেন্ট? কোন ইয়ার?”
এর থেকে বেশি কিছু জানার নেই স্নেহার। তাই এই তিনটা প্রশ্নই করলো সে। মেয়েটা সপ্রতিভ হেসে জবাব দেয়,
“ঐন্দ্রিলা মুনতাহা। ডিপার্টমেন্ট অফ ফাইন আর্টস। ফার্স্ট ইয়ার।”
এতক্ষণে স্নেহা বুঝতে পারে মেয়েটার এতো শৈল্পিক ভঙ্গিতে সব গুছিয়ে রাখতে জানার রহস্য! স্নেহা শুনেছিলো শিল্পী গোত্রের মানুষেরা না-কি খুব শৌখিন হয়। এই মেয়েটাও সেরকমই। যাক, স্রষ্টার চমৎকার নিখুঁত দেখতে সৃষ্টি মেয়েটাও হয়তো একদিন চমৎকার সব চিত্রকর্ম সৃষ্টি করবে। ভালোই! স্নেহা শুকনো গলায় বলে,
“আমার বাহিরে যেতে হবে এখন। পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। অবসরে কথা হবে।”
এইটুকু বলেই স্নেহা তাদের মধ্যকার কথার ইতি টেনে উঠে পড়লো। তার এখন দ্রুত একটু বাজারে গিয়ে টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে হবে। ঐন্দ্রিলাও সামনে ফিরে নিজের কাজে মনযোগ দিলো।
__________
পুলিশের মামলা ভীতির থেকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সামিউলকে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। সামিউলের রিহ্যাবে যাওয়ার ব্যাপারটা পুলিশ এসে সব দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। তবে সামিউল যাওয়ার পর থেকে মোমিনা বেগম কেমন নিশ্চুপ বনে চলে গিয়েছেন। সারাদিন বাসায় চালচুলো বসান নি তিনি। নিজ রুমে আলো নিভিয়ে শুয়ে আছেন। আমিনুল সাহেব অফিস থেকে ফিরে গায়ের পোশাক বদলে লুঙ্গি পরে টিভির সামনে বসেছেন। টিভি দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন কে জানে! বাকি রইল শায়না, তো মেয়েটা পড়ার টেবিলে বসে থাকলেও পড়ায় তার মন নেই। একে তো ঘরের এমন থমথমে পরিস্থিতিতে তার কেমন দমবন্ধ অনুভব হচ্ছে, তার উপর মা’য়ের মেজাজের ভয়ে মুখ ফুটে খিদের কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারছে না সে।
ভাইয়া যাওয়ার পর মা সারাদিন সোফায় বসে একা একা বিলাপ করেছেন যে ওই কালসাপটা নাকি উনার সংসার এবং সন্তান ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। শায়না ভালো করেই বুঝতে পারে যে কালসাপ সম্বোধনটা স্নেহা আপুকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। কিন্তু তার কিছু বলার সাহস হয় না। বাসার কোনো ঝামেলার মাঝে তার কিছু বলার অনুমতি নেই। হাজার হোক সে তো এখনো বাচ্চা মানুষ। বড়দের মুখের উপর কথা বলাটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। তবে মাঝেমধ্যে শায়নার খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে সবাইকে চুপ করিয়ে দিতে। বাসায় সবাই যখন ঝগড়া করে তখন শায়নার ছোট্ট মস্তিষ্কের ভেতরটা দপদপ করতে থাকে। পাখির বাচ্চার ন্যায় দেহটা আতংকে কাঁপতে থাকে। বাড়িটাকে জাহান্নাম বলে মনে হয় তার। ইচ্ছে হয় দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু শায়না তো বাচ্চা মানুষ। তার তো কোথাও একা যাওয়ারও অনুমতি নেই।
শায়নার কেবল মুখ বুজে ঘরের অশান্তি সহ্য করার অনুমতি আছে। আপু থাকতে যদিও সেটার পরিমাণ কম ছিল। ঘরে কোনো অশান্তি হলে আপু সুন্দর রুমে এসে দরজা আটকে ফুল ভলিউমে শয়তান দূর করার দোয়া ছেড়ে দিতো ফোনে। সে-ই দোয়ার শব্দে ঘরের অন্য কারো কণ্ঠস্বর পরিষ্কার কানে পৌঁছাতো না। মনে হতো আসলেই শয়তান দূর হয়ে যাচ্ছে। শায়না ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেতো। মাঝেমধ্যে খিলখিলিয়ে হেসেও উঠতো। স্নেহা আপু তখন কপাল কুচকে বলতো,
“হাসছিস কেন? দেখছিস না, শয়তান দূর করছি? তুই চুপচাপ পড়তে বস। আমার সামনে দাঁত বের করে হি হি করবি না। কানের নিচে একটা দিবো না-হয়।”
স্নেহার সেই রাগ মিশ্রিত হুমকি শুনে শায়না আরো হাসতো। মনে হতো জগতে শয়তান দূর করার মতো মজার কাজ আর দুটো নেই। কিন্তু এখন আপু নেই। এই থমথমে অশান্তিতে ভরা বাসাটায় শায়না আরো একা হয়ে পড়েছে। প্রতি মুহূর্ত তার কেমন বিষণ্ণ কাটছে। কবে সে-ও মুক্ত হবে? খুঁজে পাবে একটা সুস্থ পরিবেশ?
__________
আব্বুর অর্ডার দিয়ে বানানো মোটা জালি বেতের দুটো বাড়ি পিঠে পড়তেই নিতুন তারস্বরে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় পড়তে শুরু করেছে। নীলা বেগম ছেলেকে শাসিয়ে রান্নাঘরে যেতেই নিতুন হাত পা ছড়িয়ে টেবিলে মাথা এলিয়ে দেয়। তার আর ভালো লাগে না। মিসের ওদিনের কথা শুনে তার মনে হয়েছিল আসলেই পড়াশোনার বিকল্প নেই। কিন্তু আজ সমাজ বই খুলে বসতেই তার মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বি ঐতিহ্য পড়ে তার কী লাভ হবে? সে একবিংশ শতাব্দীতে বাস করা এক বালক। ঔপনিবেশিক যুগের এতো কেচ্ছা জেনে সে কী করবে?
হতাশ নিতুন হাই তুলতে তুলতে টেবিল থেকে মাথা তুলে বসতেই পিঠা হাতে রুমে প্রবেশ করে অয়ন। পিঠার মনমাতানো ঘ্রাণে নিতুন আড়চোখে তাকায়। দেখে ভাইয়া তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে খুব আমোদ করে তেলের পিঠায় কামড় বসাচ্ছে। নিতুন গাল ফুলিয়ে বইয়ের দিকে তাকায়। তার মন গেয়ে উঠে বিদ্রোহের গান। দুশমন ভাইয়া! দুশমন আম্মু! দুশমন আব্বু! সবাই তার দুশমন! আব্বু এনে আম্মুর হাতে জালি বেত তুলে দিয়েছে, আম্মু সেই জালি বেত দিয়ে তাকে দুটো মাইর দিয়ে বলে গিয়েছে স্কুলের পড়া শেষ না করলে আজকে একটাও পিঠা নিতুনের ভাগে পড়বে না, আর এখন ভাইয়া এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে পিঠা খেয়ে তাকে লোভ দেখাচ্ছে। কি নিষ্ঠুর সবাই!
অয়ন চেয়ার টেনে নিতুনের পাশে বসে। সুস্বাদু পিঠায় আরেকটা কামড় বসিয়ে সে প্রশ্ন করে,
“খাবি?”
নিতুনকে খোঁচানোর জন্যই প্রশ্নটা করা হয়েছে। প্রশ্নটা করে অয়ন বেশ মজাও পাচ্ছে। নিতুনকে অহেতুক খেপাতে অয়নের খুব মজা লাগে। খোঁচাটা জায়গামতো লাগে। নিতুন মুখ ফুলিয়ে তাকায়। অয়ন হেসে ফেলে। ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বলে,
“প্যারা নিস না। আম্মু তোর জন্য আলাদা পিঠা রেখেছে। পড়া শেষ কর আগে ভদ্র বাচ্চার মতো। কী পড়ছিস দেখি তো! ওহ, সমাজ! মজার সাবজেক্ট! আমি সবসময় এটাতে নাইন্টি প্লাস পেতাম।”
সমাজ বিষয়ের প্রতি ভাইয়ের পারদর্শীতার আলাপ নিতুনের পছন্দ হয় না। সে মুখ কালো করে বলে,
“তোমার কাছে সব নিরামিষ জিনিসই সবসময় পছন্দ হয়। সমাজ বই কী মানুষ পড়ে? অপ্রয়োজনীয় আলাপ দিয়ে ভর্তি বই। এগুলো শিখে আমার কী লাভ? চাকরি করতে গেলে সেখানে মহারাজা অশোকের জীবনপুথি আমার কোন কাজে লাগবে?”
“তোর কাছে তো বীজগণিতও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। চাকরিতে এগুলো কাজে লাগবে না-কি না সেসব পরের বিষয়। চাকরি পাওয়ার জন্য আগে ভালো রেজাল্ট করতে হবে তোর। ভালো রেজাল্টের জন্য এসব পড়া বাধ্যতামূলক। পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি সমস্যা থাকলে একটা বুদ্ধি দিতে পারি। আপাততর জন্য কষ্ট করে ভালো রেজাল্ট করে সকলকে দেখিয়ে দে। পরে ভবিষ্যতে গিয়ে তুই শিক্ষামন্ত্রী হতে পারিস। তখন নিজের মনমতো নিয়ম এপ্লাই করে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনিস। চমৎকার বুদ্ধি না?”
ভাইয়ের গছিয়ে দেওয়া বুদ্ধি বোধহয় নিতুনের পছন্দ হলো। তাকে ভাবুক দেখালো। নাহ, নিজের ভবিষ্যৎ বদলানোর সুযোগ নেই তো কী হয়েছে? নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন অবশ্যই বদলে দিবে নিতুন। তারা বাচ্চাকাচ্চাদের কখনো এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিস পড়তে দিবে না সে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবতেই নিতুনের দাঁত বেরিয়ে হাসি এলো। সে হাসি-হাসি মুখ করেই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“ভাইয়া? আর কতকাল মা’য়ের হাতের রান্না খাবে, বলো তো? তোমার মনে হয় না তোমার এখন ভাবীর হাতের রান্না খাওয়ার বয়স হয়েছে? আরেকটু দেরি করলে তো তোমার মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে যাবে। তখন মেয়েরা তোমাকে আংকেল জোন করে দিবে!”
পড়াশোনার কথার মাঝে এরকম অপ্রয়োজনীয় আলাপ শুনে অয়ন সামান্য রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমার বিয়ে নিয়ে তোর এতো চিন্তা কেন? নিজের চিন্তা কর আগে। পড়াশোনা না করে গোবেট হলে মেয়েরা তোকেও টাইমপাস জোনে ফেলে দিবে। তখন মজা বুঝবি। পড়তে থাক চুপচাপ। হোমওয়ার্ক কর। তোর মিস তোকে হোমওয়ার্ক দিয়ে যায় নি করার জন্য?”
“মিস তো আজকে আসেই নি।”
পিঠায় শেষ কামড় বসাতে নেওয়া অয়ন থেমে যায়। কিছুটা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কেন?”
“সেটা আমি কীভাবে জানবো? মিস আসে নি। আমিও কল করি নি। কোনো লজিক্যাল কারণই আছে হয়তো। না-হয় পাষাণপ্রিয়া মিস তো ঝড়, তুফান, সিডরের মাঝেও পারলে আমাকে পড়ানোর জন্য এসে হাজির হয়।”
অয়ন এবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“পাষাণপ্রিয়া কে?”
নিতুন বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,
“কে আবার? স্নেহা মিস। আমি আমার পুরো জীবনে উনার থেকে পাষাণ মানুষ দেখি নি। কিন্তু মেয়ে মানুষকে শুধু পাষাণ ডাকলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাই সাথে প্রিয়া বসিয়ে উনাকে পাষাণপ্রিয়া বানিয়ে দিয়েছি।”
নিতুনের কথা শুনে অয়নকে কিছুটা ভাবুক দেখালো। যদিও স্নেহাকে নিয়ে ভাবা তার কাজ নয়। তবুও এই অনুচিত কাজটা সে করলো। নিজ মনে ভাবার চেষ্টা করলো স্নেহার না আসার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে। বাসায় কী কোনো ঝামেলা হয়েছে? কিন্তু ওই ঝামেলাযুক্ত ভাইটা তো রিহ্যাবে বিদায় হয়েছে। তাহলে? কোনো যুতসই উত্তর খুঁজে না পেয়ে অয়ন একটু আশেপাশে তাকায়। অতঃপর চোরের মতো নিচুস্বরে ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করে,
“কী কারণে উনাকে এতো পাষাণ মনে হয় তোর?”
ভাইয়ের এরকম প্রশ্ন করার ভঙ্গিমা দেখে নিতুন সন্দিহান চোখে তাকায়। তবে পরমুহূর্তেই নিজের কষ্টের কথা মনে করে টলমল চোখে তাকিয়ে বলে,
“মিস ভয়ংকর মাইর দেয়। আরে রিমান্ডে নেওয়া আসামীকেও বোধহয় তোমরা এতো জোরে মারো না, যত জোরে উনি আমার পিঠে স্কেল ভাঙে। আমার তো মনে হয় মিসের সাথে জ্বিন আছে। না-হয় মিস এতো শক্তি কীভাবে পায়? চৌদ্দদিন আগে আমার পিঠে উনি এক স্কেল ভেঙেছেন। এখনো সেটার ব্যথায় আমি চিৎ হয়ে শুতে পারি না। মিসের জন্য একটা নতুন নাম রাখা দরকার আসলে। জ্বিনের সর্দারনী নামটা কেমন?”
জ্বিনের নাম শুনে অয়নের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার মনে পড়ে যায় হসপিটালের ঘটনা। কানে ড্রেসিং চলা অবস্থায়ও স্নেহাকে সে সামান্য টু শব্দ করতে দেখে নি। সাধারণ মানুষের তো একটু হলেও ব্যথা অনুভব হয়। তাহলে কী স্নেহার সঙ্গে জ্বিন থাকার ঘটনাটা সত্যি হতে পারে? অয়নের গ্রামে দাদু বাড়ির পাশের বাড়িতে এক লোক থাকতো। মনু মিয়া। লোকে বলতো মনু মিয়ার সঙ্গে নাকি জ্বিন আছে। এ কথা শুনে অয়ন ভয়ে কখনো মনু মিয়ার আশেপাশে ভিড়তো না। তবে এখন কী তার নিতুনের মিসের থেকেও দূরে থাকা উচিত?
বড়ো ভাইয়ের ফ্যাকাশে মুখখানা দেখে নিতুন ভারী মজা পায়। তার ভাই পৃথিবীতে দুটো জিনিসকে সবথেকে বেশি ভয় পায়। এর মধ্যে একটি হলো ভূত-প্রেত। তবে অয়নের ভয়ের ধরণটা ভিন্ন। সে সাধারণত কখনো ভয় পায় না। তবে কেউ যদি তার সামনে ভূত-প্রেত নিয়ে কথা তুলে তখন তার মধ্যে ভয় কাজ করা শুরু করে। এছাড়া সে নিজ থেকে কখনো জ্বিন ভূতের কথা স্মরণ করে না।
নিজের মজার ইতি টেনে নিতুন বলে,
“আমি তো মজা করছিলাম। তুমি কী সত্যি ভেবে বসলে? পুলিশ হয়েও কী পরিমাণ ভীতু তুমি!”
নিতুনের মজা ধরতে পেরেই অয়নের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সে ভারী রাগ দেখিয়ে বলে,
“কে ভয় পেয়েছে? হ্যাঁ? তাছাড়া তোর লজ্জা করে না? নিজের মিসের নামে বানিয়ে কথা বলিস কেন? এই শিক্ষা দেই তোকে আমরা?”
নিতুন হাই তুলতে তুলতে বলে,
“প্রশ্ন আমিও তুলতে পারি। চোরের মতো আমার মিসের ব্যাপারে প্রশ্ন করো কেন? মেয়ে মানুষের প্রতি এভাবে চোরের মতো আগ্রহ দেখানো তোমাকে শোভা পায়?”
ছোট ভাইয়ের কাছে পরাজিত হয়ে অয়নের চেহারা থমথমে রূপ ধারণ করে। রাগে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে গলা ছেড়ে ডাকে,
“আম্মু… আম্মু। নিতুন পড়াশোনা করছে না। আমার সঙ্গে বেহুদা আলাপ শুরু করেছে।”
অয়নের কথার পিঠেই রান্নাঘর থেকে নীলা বেগমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“ওই অসভ্যের বাচ্চার পিঠে দুটো কিল বসাও তো, বাবা।”
মায়ের আদেশবাক্য শুনে নিতুন মুখ ভেংচি কেটে বলে,
“আমাকে অসভ্যের বাচ্চা বলা মানে বাবাকে অসভ্য বলা। আহ! বাবা যদি জানতো, আমার কারণে দিনরাত উনাকে আম্মুর থেকে কত গালমন্দ পেতে হয়!”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]