নীড়বৃষ্টি পর্ব-০৯

0
5

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৯.

স্নেহার হল জীবনের দ্বিতীয় দিন আজ। গতকাল প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিস কিনে হলে ফিরে সব গুছিয়ে নিতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল তার। মধ্যে কেবল কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে ক্যান্টিন থেকে রাতের খাবারটা খেয়ে এসেছিল। অতঃপর মধ্যরাত অব্দি জেগে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সেড়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। ভাগ্যিস তার রুমমেট মেয়েটা তার সে-ই ব্যস্ততার মাঝে তাকে সামান্যতম বিরক্ত করে নি। মেয়েটা অতিরিক্ত বাচাল প্রকৃতির হলে স্নেহার তার সঙ্গে একই রুমে থাকতে বেশ অসুবিধা হয়ে যেতো। ভাগ্যিস এই ঝামেলাটুকু আপাতত পোহাতে হবে না তার।

সকাল সকাল আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠতেই স্নেহার চোখ যায় রুমে উপস্থিত অপর টেবিলটার দিকে। একটা ঢিলেঢালা টি শার্ট এবং প্লাজো পরিহিত ঐন্দ্রিলা নিজ টেবিলের চেয়ার টেনে বসে আছে। মাথার চুলগুলোকে উঁচু করে খোপা করে রেখেছে সে। তার সামনে দাঁড় করানো বেশ বড়সড় একটা ক্যানভাস। বাম হাতে রয়েছে একটা কাঠের আর্ট প্যালেট। সে-ই প্যালেটে দক্ষ ভঙ্গিতে রঙ মিশিয়ে তাতে তুলি ছোঁয়াচ্ছে ঐন্দ্রিলা। অতঃপর সেই তুলির নরম ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিচ্ছে ক্যানভাসের সাদা পাতা। ক্যানভাসটা উল্টো দিকে ফিরিয়ে রাখায় ঐন্দ্রিলা ঠিক কী আঁকছে তা দেখার সুযোগ হলো না স্নেহার। সে অবশ্য বিশেষ আগ্রহও দেখালো না। বরং নীরবেই বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু খুঁজতে।

স্নেহাকে উঠে যেতে দেখে ঐন্দ্রিলা নিজের হাত থামিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,

“গুড মর্নিং, আপু।”

বিছানা গোছাতে ব্যস্ত স্নেহা ভদ্রতার খাতিরে কেবল জবাব দেয়,

“গুড মর্নিং।”

ব্যস! এরপর দুটো মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো বাক্য বিনিময় হয় না। দু’জনেই নিজেদের কাজে মনযোগ দেয়। কেউ-ই কারো ব্যক্তিগত জীবনে আগ্রহ দেখায় না। স্নেহা অবশ্য বিছানা গুছিয়ে চলে যায় ব্রাশ করে, হাত মুখ ধুয়ে, রেডি হতে। আজ ক্লাস শেষ করে যথাসময়ে তার স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। ভুলেও মিস দেওয়া যাবে না। সামনের দিনগুলোতে খুব প্রেশার যাবে তার উপর দিয়ে। একে তো তার নিজের উপর দিয়ে কোর্স ফাইনালের ধকল যাবে। অপরদিকে নিতুন এবং তনু নামক আরেকটা স্টুডেন্টরও মধ্য বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে। নিজের পাশ করাটা যেমন জরুরী, তেমনই স্টুডেন্ট গুলোকেও পাশ করানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে তার উপর। আগামী এক মাস হাত থেকে স্কেল নামানোর সুযোগ পাবে না সে। এসব আণ্ডাবাচ্চাদের সঙ্গে বেতের ভাষায়ই কথা বলে সে। এ-র বাহিরে মিষ্টি মধুর কথা স্নেহার মুখ দিয়ে আসে না।

__________

গাঢ় নীল রঙের পরিপাটি ইউনিফর্মে সুশ্রী চেহারার এএসপি অয়ন থানার সার্কেল অফিসে নিজস্ব কেবিনটায় প্রবেশ করে। তার কাঁধে ঝকঝকে রূপালি ব্যাজে লেখা হয়েছে ASP। নিচে লেখা তার সার্কেলের নাম, সাভার। ব্যাজের পাশে টানটান করে লাগানো কাঁধের ফিতায় তিনটি রূপালি তারকা রয়েছে, যা তার পদমর্যাদা প্রকাশ করছে। বাঁ পাশে বুক পকেটের উপর আঁটা রয়েছে তার নামফলক। যেখানে ইংরেজি গোটা অক্ষরে কালো ব্যাকগ্রাউন্ড এবং সাদা হরফে লেখা ‘Ayon Mahmud’। বুকে চকচকে ছোট একটা রঙিন ব্যাজ, যেখানে লাল সবুজ পতাকার ছায়ায় লেখা, বাংলাদেশ পুলিশ। কোমরে শক্ত করে বাঁধা কালো চামড়ার বেল্টে ঝোলানো তার সার্ভিস পিস্তল।

বিগত এক দু দিনে অয়নকে সিভিল গেটাপে দেখে অভ্যস্ত থানার লোকেরা আজ প্রথম তাকে ইউনিফর্মে দেখলো। এবং দেখতেই তাদের মাঝে সামান্য ভয় কাজ করলো। বলা হয়ে থাকে সিনিয়র অফিসারের ইউনিফর্ম যতটা পরিপাটি হয়, কাজ নিয়ে তিনি ততটাই খুঁতখুঁতে হোন। খুঁতখুঁতে সিনিয়র আবার সকলের পছন্দ হয় না। এরকম অফিসারদের মেজাজ সাধারণত ঠান্ডা হয়, তবে সামান্য এদিক ওদিক হলেই সে-ই মেজাজ তুঙ্গে চলে যেতে সময় লাগে না।

অয়ন নিজের কেবিনে প্রবেশ করে চেয়ারে বসতেই তার পিছু রুমে প্রবেশ করেন ওসি মনিরুল। ভদ্রলোক এসেই প্রথমে বলেন,

“স্যার, আপনি যে-ই ড্রাগ ডিলারকে ধরতে বলেছিলেন তাকে গতকাল রাতে ধরে আনা হয়েছে। ফোন বাজেয়াপ্ত করে ছেলেটাকে প্রশ্ন করে যাওয়া হচ্ছে রাত থেকে। কিন্তু এখনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বের করা সম্ভব হয় নি।”

“ফোন থেকে কিছু পাওয়া গিয়েছে?”

“ফোন এখনো চেকিং এ আছে, স্যার। সম্পূর্ণ চেকিং শেষ হতেই আপনাকে রিপোর্ট করা হবে। কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি-না, দেখা যাক।”

“আচ্ছা, আমাকে আপডেট জানবেন। এবং…”

অয়নের সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তার কেবিনে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করে একজন কন্সটেবল। ওসি মনিরুল চোখ রাঙিয়ে ধমকে উঠে,

“এগুলো কেমন অভদ্রতা? স্যারের রুমে প্রবেশের পূর্বে নক করতে হয়, জানো না? অনুমতির প্রয়োজন নেই?”

কন্সটেবল ভীত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“দুঃখিত, স্যার। আসলে ডিসি স্যার এসেছেন থানায়। একদম বিনা নোটিশে এসে হাজির হয়েছেন। সবাই উনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি ভাবলাম দ্রুত এসে আপনাদের জানানো উচিত।”

ডিসি স্যারের কথা শুনতেই অয়ন অবাক হলো। আব্বু থানায় এসেছে? কেন? কী কারণে? অয়নকে তো এ-ই ব্যাপারে কিছু জানায় নি। তাছাড়া ডিসি সাহেব খুব জরুরী কোনো কাজ ছাড়া কখনো থানা পরিদর্শনে যায় না। তাহলে কী জরুরী কোনো ব্যাপারেই আব্বু থানায় হাজির হয়েছে? অয়ন চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার কেবিনের দরজা ঠেলে দাঁড়ায় আরেকজন কন্সটেবল। ঠিক পরপরই রুমে প্রবেশ করেন ডিসি কামরুল মাহমুদ। ওসি মনিরুল সহ উপস্থিত অন্য কন্সটেবল আদবে নতজানু হয়ে ডিসি সাহেবকে সালাম দেয়। অয়নও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সালাম দিয়ে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”

ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার সকলের সালামের জবাব নিয়ে নিজের ছেলের চোখে চোখ রেখে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমার ছেলের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলার প্রয়োজন।”

কামরুল সাহেবের কথা শুনে সকলে বেশ অবাক হয়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অয়নও। সে কখনো কোথাও গিয়ে নিজের আব্বুর পরিচয় বিলিয়ে বড়ো হয় নি। তার চাকুরিজীবনেও হাতেগোনা দু-চার জন মানুষ বাদে আর কেউ-ই জানে না যে সে ডিসি কামরুল মাহমুদের ছেলে। ব্যক্তিগত ভাবেই ব্যাপারটা অয়নের অপছন্দনীয়। কারণ এতে করে মানুষ বিভিন্ন ধরনের মনগড়া কথা বলার সুযোগ পাবে বলে সে মনে করে। তাদের মনে ধারণা তৈরি হবে যে অয়ন বোধহয় নিজের বাবার জোরে এতদূর এসেছে। আব্বুর এহেন পরিচয় প্রকাশে অয়নের মুখে অসন্তোষ প্রকাশ পায়। তবুও সে নীরব রয়। রুমে উপস্থিত বাকিরা নিজেদের বিস্ময়তা চেপে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কামরুল সাহেব নিজ থেকেই এগিয়ে এসে ছেলের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসে। অয়নকে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কামরুল সাহেব বলেন,

“দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”

অয়ন বসে। টেলিফোন হতে কল করে কামরুল সাহেবের আপ্যায়নের জন্য ব্যবস্থা করতে বলে। অতঃপর কান থেকে টেলফোনটা নামিয়ে নিজের আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলে,

“সবার সামনে আমি তোমার ছেলে এটা বলা কী জরুরী ছিল?”

কামরুল সাহেব কপাল কুচকে বলেন,

“লুকানোর মতো কারণ তো দেখছি না।”

অয়ন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ওরা এখন আমাকে নিয়ে গোসিপ করবে। বলবে তোমার বদৌলতে হয়তো আমার চাকরি হয়েছে। রাতদিন জেগে পড়াশোনা করে আমার বিসিএস এক্সাম দেওয়ার মূল্যটা তাহলে কোথায় থাকবে?”

কামরুল সাহেব থমথমে গলায় উত্তর দেয়,

“দুনিয়ার মানুষের কাজই হচ্ছে ভাবা। নিজেদের ভাবনার জগতে একেক মানুষকে নিয়ে তাদের একেক মতামত। সে-ই মতামতগুলো সত্য হোক নাকি মিথ্যা সেটা তারা কখনোই দেখবে না। নিজেদের ভাবনাকে চিরন্তন সত্য বলে মেনে আসাটাই তাদের স্বভাব। তাদের ভাবসাবটাই এমন যেন তোমার দুই কাধের ফেরেশতার সঙ্গে তাদের খুব খাতির। দেখলে মনে হবে, তোমার সকল আমলনামা তাদের মুখস্থ। এরকম সবজান্তা মানুষ কী ভাববে বা বলবে, তা নিয়ে ভাবাটা নিজের প্রতি একপ্রকার অপমান।”

আব্বুর কথাগুলো অয়নকে প্রভাবিত করে। আসলেই তো! কে কী ভাববে তা ভেবে সে এতো অস্থির হচ্ছে কেন? সে নিজে তো জানে যে সে কখনো অসৎ পন্থা অবলম্বন করে নি। তাহলে মানুষের ভুল ধারণাকে সে কেন ভয় পাচ্ছে? অয়নের রাগটা মুহূর্তেই নাই হয়ে যায়। সে কিছুটা লজ্জিত বোধ করে বলে,

“সরি, আব্বু। আমার ওভাবে প্রশ্ন করাটা ঠিক হয় নি। তুমি ঠিক বলেছো।”

কামরুল সাহেব নীরবে দেখেন ছেলের মুখে ফুটে উঠা লজ্জিত বোধের ছাপটুকু। উনার বুকের গভীরে এক প্রশান্তি এসে ভিড়ে। মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। হয়তো কোনো গোপন নেক কাজের বিনিময়ে আল্লাহ উনাকে এতো চমৎকার একটা ছেলে নেয়ামত সরূপ দিয়েছেন। এই যুগের তরুণদের দেখে উনি প্রায়ই চিন্তিত হোন। উচ্ছ্বাস এবং উশৃঙ্খলার দাপটে এদের পা মাটিতে পড়ে না। অথচ উনার ছেলে অয়ন যেন সে-ই স্রোতের বিপরীতে চলছে। চোখেমুখে মায়া এবং সরলতা, আচরণে ভদ্রতা, ব্যবহারেও সকলের প্রতি নম্রতা। কখনো আম্মু-আব্বুর মুখের উপর দ্বিতীয় কথা বলে না। সকলের সঙ্গে ডাউন টু আর্থ আচরণ করে। বিলাসিতা থেকেও নিজেকে শত হাত দূরে রাখে। আর অয়নের সবথেকে বেশি চমৎকার যেই ব্যাপারটি রয়েছে সেতি হলো তার শেখার মানসিকতা। কামরুল সাহেব প্রায়ই মুগ্ধ হয়ে দেখেন অয়নকে কিছু বললে অয়ন সেটা হালকা করে উড়িয়ে দেয় না, বরং মনযোগ দিয়ে সে-ই কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। এছাড়া নিজের দ্বারা কোনো ভুল হলেও সেটা উপলব্ধি হওয়া মাত্রই স্বীকার করে নেয়। সবকিছু মিলিয়েই কামরুল সাহেব অনুভব করেন যে, এই ছেলেই উনার সবথেকে বড়ো সাফল্য। এই বড়ো পদ, সম্পদ কিংবা দামী কিছুই উনার কাছে মূল্যবান নয়। বরং অয়নই উনার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

কামরুল সাহেবের ভাবনার মাঝেই কেবিনের দরজায় কেউ নক করে। অয়ন অনুমতি দিতেই একটা ছেলে ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করে। ডিসি এবং এএসপি স্যারের জন্য গরম গরম চা, কলিজা সিঙ্গারা, বিস্কুট এবং ইত্যাদি সাজিয়ে নিয়ে এসেছে সে। ছেলেটার হাতে তিনটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিতেই ছেলেটা হেসে অয়নকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে যায়। অয়ন নিজের আব্বুর দিকে একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে এবার প্রশ্ন করে,

“তুমি হঠাৎ থানায় এলে যে? তখন বললে জরুরী কথা আছে। কিছু হয়েছে, আব্বু?”

কামরুল সাহেব এবার নিজের এখানে আসার উদ্দেশ্য খোলাসা করে বলেন,

“আমার কানে খবর এসেছে যে এমপি আখতার সাহেবের দলের লোককে তোমার কথায় থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।”

অয়ন বুঝতে পারে আসল ঘটনা। সে কিছুটা হেসে বলে,

“বাব্বাহ! খবরটা তোমার কানে কে দিলো? এমপি আখতার নিজে কল করেছে না-কি?”

কামরুল সাহেব বলে,

“তার মানে ঘটনা সত্য।”

অয়ন এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“একটা ড্রাগ ডিলিং কেসে ছেলেটাকে এরেস্ট করা হয়েছে, আব্বু। এখানে মন্ত্রীর বিচলিত হওয়ার কারণ দেখছি না আমি। তবুও যদি উনি অতিরিক্ত বিচলিত হন তবে আমার সন্দেহের তীর উনার দিকেও যাবে। তুমি এখানে কেন এসেছো সে-ই কারণটা হয়তো আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আব্বু, তুমি অন্তত আমাকে এখন কেসে ইনভলভ হতে নিষেধ করো না।”

“আমি তোমাকে নিষেধ করতে তো আসি নি, বাবু। শুধু জানাতে আসলাম। মন্ত্রী সাহেবের কল করার মানে হলো জলঘোলা আছে। তোমার কাজে বাঁধা দিবো না, কিন্তু একটু সমঝে চলো। নিজের দায়িত্ব পালন করো। কিন্তু কাউকে শত্রু বানানোটা এড়িয়ে চলো। তোমার আম্মুর হাজার বাঁধা অমান্য করে আমি তোমাকে এই পেশা বেছে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছি। তোমার সামান্যতম ক্ষতি হলে তোমার আম্মু উন্মাদ হয়ে যাবে।”

অয়নের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। আম্মু তাকে কতটা ভালোবাসে তা তার অজানা নয়। তবে আম্মুর দোহাই দিয়ে তাকে সতর্ক করা আব্বুও যে তাকে ভালোবাসে, সেটাও সে ভালো করে জানে। বাপ ছেলে আরো দশ-পনেরো মিনিট টুকটাক জরুরী আলাপ করে চায়ের চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে। কামরুল সাহেব উঠে দাঁড়াতেই অয়নও এগিয়ে আসে নিজের আব্বুকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে। রুম থেকে বের হতেই সকল অফিসাররা কামরুল সাহেবকে সালাম দিতে থাকে। কামরুল সাহেবও খোশমেজাজে সকলের সালাম জবাব দিতে থাকে। থানার গেটের কাছে পৌঁছাতেই হুট করে তিনি পিছনে ঘুরে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ওহো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! তোমার আম্মু তোমার জন্য দুপুরের খাবার পাঠিয়েছে, বাবু। এখন থেকে বাহিরের খাবার খেতে নিষেধ করেছে। তোমার জন্য প্রতিদিন বাসা থেকে খাবার পাঠানো হবে।”

অয়নের সঙ্গে ওসি মনিরুল সহ আরো কয়েকজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিল। সকলের সামনে এভাবে বাবু ডাকায় অয়ন লজ্জায় পড়ে যায়। অভিমান নিয়ে কিছুটা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রয় আব্বুর দিকে। কামরুল সাহেব ছেলের অভিমান বুঝলেন না। উল্টো বললেন,

“মনে করে খাবার খেয়ে নিও, বাবু। তোমার আম্মু কিন্তু রাগ হবে। আমি যাই তাহলে।”

কামরুল সাহেব চলে যান। অয়ন হতাশ ভঙ্গিতে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। আশেপাশের অফিসারদের ঠোঁট টিপে হাসির আভাস সে ভালোই টের পাচ্ছে। হতাশায় তার বুক চিরে আবারও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। উনত্রিশ বছরের পুরুষ হয়ে যাওয়ার পরও আম্মু-আব্বু এখনো তাকে বাচ্চাদের মতোই ট্রিট করে। ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে মাঝেমধ্যে একটু অয়নকে লজ্জায় পড়তে হয়, এই যা!

__________

ক্লাস শেষ করে সবে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছে স্নেহা৷ উত্তপ্ত গরমে তার মেজাজ তুঙ্গে উঠে আছে। মেজাজ তুঙ্গে উঠার পিছনে অবশ্য কারণ আছে। তার কোর্স ফ্যাকাল্টির বেহুদা ভাব! ক্লাসে ঢুকেই টাকলা লোকটা অহেতুক ফাফর দেখাতে থাকে। যেন জগতে তিনি একাই শিক্ষিত এবং বাকিসব গরু ছাগল। সে-ই ফাফরবাজ লোকের সঙ্গেই আজ ক্লাসে সকলের সামনে স্নেহার তর্ক লেগে গিয়েছে। চুপচাপ বসে থাকা স্নেহাকে ভদ্রলোক হঠাৎই দাঁড় করিয়ে বুলেটের গতিতে প্রশ্ন করা শুরু করে। অতঃপর স্নেহাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই তার উপর আরোপ লাগিয়ে দেয়, তার না-কি ক্লাসে মনযোগ নেই। অহেতুক কথা শুনে স্নেহারও মেজাজ চটে যায়। এ নিয়ে ভদ্রলোককে সে দুটো ত্যাড়া উত্তর দিতেই অসভ্য লোক রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়। টাকলু চান্দিটা দিয়ে যেন আগুন বের হতে থাকে উনার। স্নেহার কী যায় আসে তাতে? সে অসভ্য লোকের সেই রাগকে দুই টাকার পাত্তা দেয় না। যদিও ত্যাড়া উত্তর দেওয়ার বিনিময়ে তাকে বেয়াদব তকমা পেতে হয়েছে। কিন্তু সেটা স্নেহার জন্য নতুন কিছু না। দুনিয়াতে সত্যবাদীর অন্যতম সমার্থক শব্দ বেয়াদব।

নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় স্নেহা। গরম মেজাজ নিয়ে আপাতত নিতুনকে পড়াতে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আগে পাঁচ মিনিট বসে সে নিজের মাথা ঠান্ডা করবে তারপর পড়াতে যাবে। একটা বিশাল ছায়া দেওয়া গাছ দেখে সেটার নিচে ফুটপাতে বসে পড়ে স্নেহা। গরমে ত্যক্ত হয়ে খোলা চুলগুলোকে হাতখোপা করে নেয় সে৷ এতে যদিও তার কানের ড্রেসিংটা দৃশ্যমান হয়, তবে স্নেহা সেটার পরোয়া করে না। ব্যাগ খুলে একটা অলটাইম বনরুটির প্যাকেট বের করে সে। সে-ই সঙ্গে একটা সাগর কলা। সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে কিনে ব্যাগে রেখে দিয়েছিল সে। আপাতত দুপুরে হাতে ভাত খাওয়ার মতো সময় নেই দেখে কলা বনরুটিই খেতে শুরু করে সে। সে-ই সঙ্গে অফুরন্ত সময় নিয়ে দেখতে থাকে পথচারীদের আনাগোনা। হুট করেই কোথা থেকে একটা কালো রঙের কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে এসে স্নেহার আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে। স্নেহা লক্ষ্য করে কুকুরটার গতিবিধি। নীরবেই সে সামান্য বনরুটির টুকরো ছিড়ে তার সামনে রাস্তায় রাখে। ক্ষুধার্ত কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে সেই টুকরোটার গন্ধ শুকে নিয়ে তা খেতে শুরু করে।

এই অলস দুপুরবেলায় স্নেহা যেন একটা সঙ্গী পেয়ে গেলো। এতো এতো মানুষের ভীড়ে একটা পশু সঙ্গী। যার শান্ত উপস্থিতি স্নেহাকে একাকী বোধ করাচ্ছে না। স্নেহা আবারও বনরুটির একটা টুকরো ছিড়ে দেয় কুকুরটাকে। কুকুরটা খেতে খেতে একবার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। যেন নীরবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় নীরব থাকা স্নেহা নিজের এই সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। কণ্ঠে মৃদু তাচ্ছিল্য নিয়ে প্রশ্ন করে,

“কিরে! চাল, আলুর দাম বেড়েছে দেখে কী ক্ষুধা নিয়ে পথে পথে ঘুরছিস? খাবার দেয় না কেউ তোকে?”

কুকুরটা কোনো জবাব দেয় না, শুধু লেজ নাড়ায়। হালকা বাতাস বইছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। স্নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে। নিজে অর্ধেক পানিটুকু পান করে নিয়ে কুকুরটার দিকে তাকায়। কুকুরটারও বোধহয় তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু স্নেহার কাছে তাকে পানি খাওয়ানোর কোনো উপায় নেই। আপাতত উপায় খুঁজে বের করার মতো সময়ও স্নেহার হাতে নেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলে,

“পানির হিসাব বাকি রইলো। আরেকদিন খাইয়ে পুষিয়ে দিবো নি। আমি তোকে খুঁজতে পারবো না, তুই আমাকে খুঁজে নিস।”

বলেই স্নেহা ঘুরে চলে যেতে নেয়। কিন্তু কী ভেবে যেন থেমে যায়। ঘুরে তাকায় কুকুরটার দিকে। কালো কুকুরটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে। স্নেহা নিজের স্বভাব বহির্ভূত একটা কাজ করে। সামান্য ঝুকে কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার মাঝে নিজের হাত নোংরা হওয়ার চিন্তা নেই। বরং সামান্য মায়া রয়েছে। কণ্ঠে নিজের প্রতি একপ্রকার তাচ্ছিল্য নিয়েই সে বলে,

“তোর মাথায় হাত বুলানোরও মানুষ আছে, অথচ দেখ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনো টের পাই নি কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কেমন লাগে।”

কুকুরটা আবারও লেজ নাড়ে। স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। উল্টো ঘুরে হাঁটা শুরু করে সে। খেয়ালই করে না যে রাস্তার অপরপ্রান্তে বাইক নিয়ে দাঁড়ানো কেউ একজন পুরো দৃশ্যটা মনযোগ দিয়ে পরখ করেছে। স্নেহার অজানা রয়ে যায় ব্যাপারটা।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]