নীড়বৃষ্টি পর্ব-১৬

0
5

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.

দু’দিন ভয়ংকর জ্বরে ভুগে আজ তৃতীয় দিনের মাথায় অয়ন কিছুটা হুশে ফিরেছে। একা একা উঠে বসা কিংবা হাঁটাচলাও করছে বাসার ভেতরে। তাপমাত্রাটা কমলেও, দূর্বলতাটা এখনো ওকে ছেড়ে যায় নি পুরোপুরি। খুব ধীরে ধীরেই তাই চলাফেরা করছে সে। ছেলের এই সামান্য সুস্থ হওয়াটাও নীলা বেগমের অস্থিরতা কমাতে পারে নি। ছেলেকে পুরোপুরি আগের অবস্থায় দেখার আগ অব্দি উনার এই অস্থিরতা কমবেও না।

অয়ন আপাতত ক্লান্ত শরীরে জল ঢেলে গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। শরীর তুলনামূলক কিছুটা সতেজ লাগছে তার। ভেজা শরীর মুছে গায়ে চাপিয়েছে একটা আয়রন করা বেবি পিংক রঙের প্লেইন শার্ট। সঙ্গে রয়েছে কালো প্যান্ট। মাথার চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে গায়ে সামান্য পারফিউমও মেখেছে সে। আম্মুর মুখে শুনেছে গতকাল নিতুনের মিস এসেছিলেন। উনি নাকি নিতুন এবং অয়নকেও দেখে গিয়েছেন। হায়, অয়ন! বেচারা, অয়ন! সে তো তখন বেহুশের ন্যায় বিছানায় পড়ে ছিল। জ্বরের ঘোরে তাকে দেখতে কেমন লাগছিল, কে জানে? মিস কি আবার তাকে হাতে পায়ে লম্বা হওয়া একটা বালক ভেবে গেলো না তো?

আয়নায় নিজেকে একদফা দেখে নিলো অয়ন। অতঃপর পকেটে ফোন এবং ওয়ালেট ঢুকিয়ে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নীলা বেগম তখন নিতুনকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। দরজা খোলা ছিল বিধায় অয়নকে তিনি রুমের ভেতর থেকেই দেখতে পেলেন। আশ্চর্য হয়ে ডাকলেন,

“বাবু?”

অয়ন মা’য়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নীলা বেগম জিজ্ঞেস করেন,

“কোথায় যাচ্ছো, বাবা?”

প্রেমে পড়লে দু চারটা মিথ্যা বলতে হয় বাসায়। অয়নও তাই সুন্দর করে গুছিয়ে আম্মুকে নিজের জীবনের প্রথম মিথ্যেটা বললো,

“বাসায় বসে শরীর ম্যাজম্যাজ লাগছে, আম্মু। তাই বাহিরে একটু হাঁটতে বের হচ্ছি। প্রাকৃতিক বাতাসে শরীরটা ফুরফুরে লাগবে।”

নিতুন এবং নীলা বেগম দু’জনই কেমন সরু দৃষ্টি মেলে তাকায় অয়নের দিকে। অয়ন ঘাবড়ে যায়। জীবনের প্রথম প্রেম এটা তার। এই প্রথম প্রেমের উদ্দেশ্যে বলা প্রথম মিথ্যাটা কি জলে গেল? নিতুন সরাসরি বলে বসে,

“এই দুপুর বেলায় বের হচ্ছো হাঁটতে? তা-ও প্রাকৃতিক বাতাস খেতে? তা-ও আবার এসব প্যান্টে টাক ইন করে শার্ট পরে? সে-ই সঙ্গে আবার হাতে ঘড়ি ঝুলিয়ে? গায়ে পারফিউম মেখে? ভাইয়া, তুমি ঠিক আছো? বাইক থেকে পড়ে কি মাথায় চোট পেয়েছিলে?”

ছোট ভাইয়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় অয়ন। মনে মনে নিতুনকে নিজের ভালোবাসার প্রথম দুশমন বলে ঘোষণা করলো সে। দুশমন নিতুন! অয়নের চোখ পাকানোর মাঝেই নীলা বেগম প্লেট রেখে উঠে এলেন। বড়ো ছেলের কপাল ছুঁইয়ে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে,

“বাবা, খারাপ লাগছে বেশি?”

অয়ন দ্রুত মাথা নেড়ে জবাব দেয়,

“একদম ঠিক আছি, আম্মু। এখন গায়ে তাপও নেই। বাহির থেকে একটু ঘুরে আসলে আরো ফুরফুরে অনুভব করবো।”

অয়নের অদ্ভুৎ কথা নীলা বেগম কিংবা নিতুন কারোই বোধগম্য হচ্ছে না। অয়ন তাদের আর কিছু বুঝার কিংবা বলার সময়ও দিলো না। মা এবং ভাইকে বিদায় দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। নীলা বেগম বেকুবের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে ছেলেটা কোথায় হাঁটতে গেল?

__________

আজ দু’দিন ধরে সূর্য যেন খুব তেজ দেখিয়ে আকাশ দখল করে বসে আছে। নিজের তেজে সে সকলকে ভস্ম করে দিবে বোধহয়। এই তেজি রোদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অয়ন রিকশায় চড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে স্নেহাকে দেখার খুব তাগিদ অনুভব করছে সে। বাইকটা নিয়ে বের হলে বোধহয় বেশি ভালো হতো। কিন্তু শরীরের দূর্বলতার কথা ভেবে আর এই ঝুঁকিটা নেয় নি অয়ন। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি চারিপাশে বুলিয়ে চলেছে স্নেহার একঝলকের আশায়।

রিকশাওয়ালা গত আধঘন্টা ধরে এই একই পথে চক্কর কেটে চলেছে। নিজের যাত্রীর মাথার তার কাঁটা নাকি সেটাও মনে মনে ভাবছে। না পেরে একটা পর্যায়ে প্রশ্ন করেই বসলো,

“মামা, আর কতক্ষণ ঘুরবো?”

অয়ন স্বভাবসলুভ ভদ্র কায়দায় জবাব দেয়,

“আপনি চালাতে থাকেন, মামা। গন্তব্য পেলে আমি থামতে বলবো। যা খুঁজে চলেছি তা পেয়ে গেলে আপনাকে খুশিমনে একশো টাকা বাড়তি দিবো বকশিস হিসেবে।”

একশো টাকা বকশিসের কথা শুনে রিকশাওয়ালার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। মনে মনে দোয়া করেন, উনার যাত্রী যেন নিজ গন্তব্য খুঁজে পায়। উনার মতো দিন আনে দিন খায় মানুষের কাছে একশো টাকার একটা নোটও খুব মূল্যবান কিছু। একশো টাকায় আজ রাতে খাওয়ার জন্য ডিম কিনে নিয়ে যেতে পারবেন তিনি। বাড়তি দুটো টাকা রয়ে গেলে ছেলেমেয়ের জন্য দুটো সবুজ রঙের কাঁচা আমের ক্যান্ডিও নিয়ে যেতে পারবেন।

আরো মিনিট সাতেক ঘোরাঘুরি করার পর হুট করেই অয়ন নিজের গন্তব্য খুঁজে পায়। দ্রুত রিকশাওয়ালাকে বলে, রিকশা থামাতে। বৈশাখ মাসের এই আকাশ ফাঁটা রোদে হুড তোলা রিকশার নিচে বসে অয়ন শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে একটা স্টেশনারি দোকানের দিকে। দোকানের বাহিরে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর পানে তার সম্পূর্ণ মনযোগ। উত্তপ রোদ এসে পড়ছে স্নেহার শ্যামবর্ণ মুখে। সে-ই শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়েই অয়নের হুট করে স্নেহাকে রুদ্রাণী বলে মনে হলো। এই রাগ, বিরক্তি, কঠোরতায় মোড়ানো স্নেহার প্রেমে সে দূর থেকেই আরো একবার ডুবে গেল। চোখ বুজে একটা বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে অয়ন রিকশাওয়ালাকে বললো,

“মামা, রিকশা ঘুরাও।”

“আপনে না কী খুঁজতেছিলেন?”

“যা খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গিয়েছি। আজকের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। বেশি লোভ করে পাপী হতে চাচ্ছি না।”

অয়নের কথার আগামন্ডু কিছুই বোধগম্য হলো না রিকশাওয়ালার। তিনি নীরবে রিকশা ঘুরিয়ে চালাতে শুরু করেন। পিছনে বসে থাকা অয়নের মনে তখন বৈশাখ মাসের প্রেমের ঝড় আলোড়ন তুলেছে।

__________

গরমে ত্যাক্ত স্নেহা অনেকগুলো নোটস ফটোকপি করাতে দিয়েছে। দোকানদার কাগজের কপি বানাতে স্নেহা বাহিরে দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে কখনো নিজেকে বাতাস দেওয়ার চেষ্টা করছে তো কখনো নিজের ঘাম মুছে চলেছে। ছায়ার আশায় দোকানের শেডের নিচে চাইলে দাঁড়ানো যেত অবশ্য। কিন্তু সেখানে একটা ছেলেদের দল হুমড়ি খেয়ে নিজেদের কাগজ ফটোকপি করানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য ছায়ার জন্য এতো ছেলেদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার মতো পাগল স্নেহা নয়। সয়ে নিলো সে এই গরম। কী এমন হবে? পোড়ার অভ্যাস স্নেহার বহু পুরনো। হোক সেটা রোদে বা জীবনে।

রোদে পুড়তে পুড়তে স্নেহার স্মৃতিপটে হঠাৎ ভেসে উঠে গতকাল দুপুরের একটা দৃশ্য। নিতুনের মা নীলা বেগমের সঙ্গে আলাপ চলছিল তখন তার। ভদ্রমহিলা স্নেহাকে বলেন যে নিতুনের যেহেতু আপাতত আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই স্নেহা যেন নিতুনকে বাসায় একটু সময় নিয়ে এক-দুই ঘণ্টা বেশি পড়িয়ে স্কুলের পড়াটা পুষিয়ে দিয়ে যায়। বিনিময়ে অবশ্য স্নেহার বেতন দুইগুণ বৃদ্ধি পাবে। স্নেহা একাকী একটা মানুষ হলেও তার টাকার প্রয়োজন রয়েছে খুব। মা’র রেখে যাওয়া সম্পত্তি যদিও আছে স্নেহার নামে। কিন্তু স্নেহার কেন যেন সে-ই সম্পত্তির প্রতি বিশেষ আগ্রহ নেই। মা’র জিনিস, যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক। তাছাড়া স্নেহা এই খেটে খাওয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কখনো একেবারে অক্ষম হয়ে গেলে তখন না-হয় সেই সামান্য জমিতে একটা বাসা তুলে ঠাই নেওয়া যাবে।

গতকাল নীলা বেগমের সে-ই প্রস্তাবে স্নেহা রাজি হয়ে যায়। এরকম সুযোগ স্নেহাও হাতছাড়া করে না। তবে সে নীলা বেগমকে জানিয়েছে যে এক চাপে প্রতিদিন এতক্ষণ পড়ানো তার পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। মাঝেমধ্যে সে দুপুরে নিতুনকে এক ঘন্টা এবং সন্ধ্যার পর দেড় ঘন্টা পড়িয়ে দিয়ে যাবে। এতে করে নিতুন এবং স্নেহা দু’জনের উপরই চাপ কম পড়বে। নীলা বেগম রাজি হয়। তারপর? তারপর নীলা বেগম বলেন,

“এসেছ যেহেতু তোমার ছাত্রকে দেখে আসো। ওর পায়ের কী অবস্থা করেছে সেটা দেখে দুটো রাম ধমক লাগাও। আমি ততক্ষণে একটু রান্নাটা দেখে আসি।”

বলে নীলা বেগম চলে যান রান্নাঘরে। স্নেহা নিজের হাতের খালি গ্লাসটার দিকে তাকায়। ভদ্রমহিলা কষ্ট করে বানিয়েছেন বলে জিনিসটা না খেয়ে রেখে দেওয়া অপমানজনক হবে বলেই স্নেহা নিজের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কারো ঘরে শরবত পান করেছে। খালি গ্লাসটা রেখে স্নেহা উঠে দাঁড়ায়। এসেছে যেহেতু সেহেতু নিতুনকে দেখে নেওয়া উচিত বলে মনে হয়। তাই রুম থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় নিতুনের রুমের দিকে।

দরজা খোলাই ছিল। নিতুন বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ট্যাবে গেমস খেলছে। আব্বু ওর উপর সদয় হয়েছে। অসুস্থ নিতুন বিছানায় বসে আর কি-ই বা করবে? তাই সময় কাটানোর জন্য ওকে গেমস খেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মিসকে দেখতেই নিতুনের স্টুডেন্ট সত্তা জেগে উঠে। সে দ্রুত হাত থেকে ট্যাব ফেলে সালাম দেয়। সালামের জবাব নিলেও স্নেহা দরজার ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়। ভেতরে পা রাখতে অস্বস্তি হচ্ছে তার। নিতুন ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেই বলে,

“মিস, আপনি এসে বসুন। ভাইয়া ঘুমোচ্ছে চুপচাপ। অসুস্থ তো, তাই আম্মু দু’জনকে এক রুমেই রেখেছে। দু’জনে আলাদা রুমে থাকলে আম্মুর খেয়াল রাখতে কষ্ট হতো। তাই আরকি…”

নিতুনের বাবু ভাইয়া আসলেই বেহুশের ন্যায় ঘুমোচ্ছিল। উনার অর্ধেক শরীর ছিল কম্ফর্টার দিয়ে ঢাকা। মুখটাও অন্যদিকে ঘুরানো ছিল। তাই স্নেহা কিছুটা দুই কদম এগিয়ে রুমে পা রেখে নিতুনের খোঁজখবর নিতে থাকে স্বভাবসলুভ রাগ দেখিয়ে। এরই মধ্যে নীলা বেগম এসে হাজির হতেই নিতুন মা’কে নিজের কাছে ডাকে। কানে কানে কী যেন বলে। নীলা বেগম হেসে বলেন,

“এটা এভাবে কানে কানে বলার কী আছে? এই স্নেহা, তুমি বসো। না খেয়ে আজকে কোথাও যেতে পারবে না। আন্টি কিন্তু রাগ করবো। শখ করে রেধেছি, কিন্তু ছেলে দুটো খাওয়ার অবস্থায় নেই। অন্তত তোমাকে শখ করে নিজের রান্না খাওয়াতে পারলেও শান্তি পাবো।”

কথাটুকু বলেই নীলা বেগম নিতুনকে ধরে অন্য একটা রুমের ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। মিসের সামনে দিয়ে এই রুমের ওয়াশরুমে যেতে তার লজ্জা লাগছিল। প্রথমত নীলা বেগমের অয়নের সৎ মা হওয়ার ব্যাপারটা শুনে এবং দ্বিতীয়ত নীলা বেগমের এমন আদর-শাসন মিশিয়ে অধিকার খাটানোতে স্নেহা কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। নিতুন এবং নীলা বেগমের পিছুপিছু তারও রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা খেয়াল ছিল না। যখন সম্বিৎ ফিরে পেল তখন তার চোখে পড়ে বিছানায় অসুস্থ পড়ে থাকা অয়ন। অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখা মুখটা ঘুমের ঘোরে স্নেহার দিকে ফিরিয়েছে। নীলা বেগম হয়তো সত্যই বলেছিলেন। মায়ায় মোড়ানো একটা মুখ। অসুস্থ অবস্থায় চেহারায় মায়ার ছাপ যেন বেড়ে গিয়েছে।

হুট করেই ঘুমের ঘোরে জ্বর কাতুরে স্বরে মা’কে ছোট্ট করে ডাকে অয়ন। স্নেহা বুঝতে পারে এই ডাক নীলা বেগমের উদ্দেশ্যে নয়। এই ডাক নীলা বেগমের বাবুর নিজের জন্মদাত্রী মা’য়ের উদ্দেশ্যে। স্নেহার হুট করে মনে হয় তার চোখের সামনে শুয়ে থাকা এই লোকটা অয়ন নয়। এই লোকটা একটা মা হারা ছেলে। যার দিকে তাকিয়ে স্নেহা নিজেকেই হুঠাৎ দেখতে পাচ্ছে। স্নেহার মনের কোন কোণে লুকিয়ে থাকা মায়া হটাৎ সামান্য উঁকিঝুঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসে। সে কেমন একদৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকিয়ে রয়।

তারপর? তারপর হুট করেই হুশ ফিরে পেতে স্নেহা বেরিয়ে আসে সেই রুম থেকে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসে দৃষ্টি নত করে রয়। নিজের মনকে শাসিয়ে বলে,

“তুই এবং ওই লোক এক না। ওই লোকের মা না থাকলেও একটা আম্মু আছে, তোর সে-সব কিছু নেই। বোকা হবি না, স্নেহা। তুই বোকা না। ওই লোক অয়ন মাহমুদ হয়ে জন্মেছে। তুই জন্মেছিস স্নেহা তাসমিয়া হয়ে। অয়ন এবং স্নেহা ভিন্ন দুই জগতের বাসিন্দা। কত মানুষেরই মা নেই। এতে মায়া উথলে উঠার মতো কিছু নেই।”

নিজ মনে আরো বিভিন্ন বুলি আওড়ে নীলা বেগমের আয়োজন করা দুপুরের খাবার সামান্য সৌজন্যতার খাতিরে মুখে তুলেই বেরিয়ে এসেছিল স্নেহা। রিকশা না পেয়ে হেঁটে মূল রোডের উদ্দেশ্যে হাঁটছিল সে। তবে কিছুদূর যেতেই কেমন পেট উথলে রাস্তার ধারে বমি করে সব উগড়ে দেয় সে। গতকাল দুপুরে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের এই অবস্থা দেখে স্নেহার কেবল একটা কথাই মনে হয়েছিল। কুকুরের পেটে যেমন ঘি হজম হয় না, তেমন স্নেহার পেটে জীবনে খাতির যত্ন হজম হয় না। প্রকৃতি সেটা আবারও প্রমাণ করে দিলো।

___________

গতকালের স্মৃতি থেকে স্নেহা যখন বেরিয়ে আসে তখনও তার আরেকটা ফাইলের কাগজের ফটোকপি চলছে। শেষ হতে এখনো বেশ সময় বাকি। স্নেহা ওড়না দিয়ে আবারও নিজের তিরতির করে ঘামতে থাকা গলা মুছতে নিলেই হুট করে তার কামিজের এক কোণে টান পড়ে। স্নেহা চোখ নামিয়ে নিচে তাকায়। একটা মেয়ে বাচ্চা দাঁড়িয়ে তার কামিজ ধরে টানছে। বাচ্চাটা যে ফুল বিক্রেতা তা তার বেশভূষাতেই স্পষ্ট। স্নেহাকে তাকাতে দেখে বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করে,

“আপা, কোন ফুলডা সুন্দর?”

বাচ্চাটার হাতে একটা ছোট্ট বালতি। সেখানে রয়েছে হরেক রঙের গোলাপ। লাল, গোলাপি, সাদা, হলুদ… স্নেহা অনাগ্রহ নিয়ে জবাব দেয়,

“জানি না।”

বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটা রঙের একটা করে ফুল নিয়ে মোট চারটা গোলাপ এগিয়ে দেয় স্নেহার দিকে। স্নেহা বিরক্তি নিয়ে বলে,

“টাকা নেই রে।”

বাচ্চাটা কীভাবে যেন স্নেহার হাতে চারটা গোলাপ ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“টাকা লাগতো না। ভাইয়ে একশো গোলাপের দাম দিছে। আপনে চাইলে সবডি নিতে পারেন ফুল। এই ছাতাডাও রাখেন। রোইদে দাঁড়ায় থাইকেন না।”

স্নেহা চরম বিস্মিত। অবাক হয়ে সে নিজের হাতে গছিয়ে দেওয়া ফুলগুলো এবং বাচ্চা মেয়েটার এগিয়ে ধরে রাখা ছাতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বিস্ময়তা কাঁটার পূর্বেই একটা আখের শরবত বিক্রেতা তার সামনে এসে এক গ্লাস শরবত হাতে হাজির হয়ে বলে,

“আপা, অনেক গরম পড়ছে। খাইয়া নেন তাড়াতাড়ি। ভালো লাগবো।”

এমন তাজ্জব ঘটনায় স্নেহার চেঁচানোর কথা। কিন্তু স্নেহা চেঁচাতে পারলো না। তার পূর্বেই সে দেখতে পেলো চোখের পলকে তার সামনে দিয়ে একটা বাইক চলে গিয়েছে। বাইকটা এবং বাইকে বসে থাকা হেলমেট পরিহিত মানুষকে চিনতে তার খুব একটা অসুবিধা হলো না। এটা সেই অসভ্য, লাফাঙ্গা, স্টকার বাইকওয়ালা। স্নেহা লোকটাকে নাগালে পেল না। তবে সে পিছন থেকেই চেঁচিয়ে উঠে,

“এক্ষুণি বাইক থামাও, লাফাঙ্গা কোথাকার!”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]