নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.
হাত শক্ত করে মুঠো করে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে অয়ন। নিতুন সোফায় বসে ভাইকে দেখে চলেছে। ভাইকে অনুসরণ করে বারবার ডানে বামে চোখ ঘুরিয়ে এখন তারও মাথ ঘোরাচ্ছে। বাড়ির পরিবেশটা অত্যাধিক পরিমাণের শীতল। নিতুনের চোখের পর্দায় এখনো ভাসছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। পড়া ছেড়ে নিতুন আড়চোখে বারান্দায় মিসকে দেখছিল। ফোন কানে ধরে রাখা মিসের হঠাৎই যেন কী হয়। তিনি ধপ করে বারান্দায় বসে পড়েন। নিতুনের পায়ে চোট। উঠে দৌড়ে যেতে পারে না সে। তাই জোরে চেঁচিয়ে মা এবং ভাইয়াকে ডাকে। ততক্ষণে নিতুনের চোখের সামনেই মিস বারান্দার ফ্লোরে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন।
নিতুনের চিৎকারে ততক্ষণে নীলা বেগম এবং অয়ন ছুটে এসেছে। তাদের আলাদা করে কিছু বলতে হয় না। রুমে প্রবেশ করতেই তাদের চোখে পড়ে বারান্দায় থাকা স্নেহার পরিস্থিতি। নীলা বেগম দ্রুত ছুটে যায়। পিছু পিছু যায় অয়নও। ভদ্রমহিলা চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়েটার মাথা নিজের কোলে নেয়। অয়নকে তাড়া দেয় পানি নিয়ে আসার জন্য। অয়ন তখন দিশেহারা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে আসে।
নীলা বেগম নিজেই কিছুটা পানি নিয়ে স্নেহার চোখে মুখে ছিটায়। গালে আলতো থাপ্পড় মেরে ডাকে,
“স্নেহা? এই স্নেহা? কী হয়েছে, মা? স্নেহা? আল্লাহ! শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এই, স্নেহা?”
অয়ন দম খিচে এক হাঁটু গেড়ে বারান্দার দরজার কাছে বসে ছিল। দেখছিল স্নেহার নিষ্প্রাণ ফ্যাকাশে মুখটা। পানির ছিটায় এবং নীলা বেগমের ডাকাডাকিতে স্নেহা ততক্ষণে চোখের পাতা পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অয়ন ধীর স্বরে বলে,
“আম্মু, উনাকে রুমে নিয়ে যাও। তুমি একা সামলাতে পারবে না? পারমিশন ছাড়া আমি হেল্প করতে চাইছি না।”
“হ্যাঁ, অসুবিধা নেই। আমি ওকে নিয়ে যাই, বাবা। তুমি একটু গিয়ে ফার্মেসি থেকে বাকের ভাইকে ডেকে আনবে? এসে প্রেশারটা দেখে যাক। জ্বরটাও মাপা জরুরী।”
অয়ন সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায় বাকের কাকাকে ডেকে আনতে। নীলা বেগম একা হাতেই স্নেহাকে আগলে ধরে নিয়ে যায় রুমে। নিতুনের বিছানায় বইপত্র, পায়ের ব্যান্ডেজের কাপড় থেকে শুরু করে ইত্যাদি ছড়ানো ছিটানো থাকায় নীলা বেগম স্নেহাকে ধরে পাশের এবং সবথেকে সন্নিকটের রুমে নিয়েই বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজে অতঃপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে থার্মোমিটার খোঁজার কাজে।
__________
বাকের ভাই এসেছেন বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। অয়ন এবং নিতুন লিভিং রুমে অপেক্ষমাণ। রুমের ভেতর স্নেহার সঙ্গে তাদের আম্মু রয়েছে। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তেই আছে অয়ন। তবে নিতুন আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না। সে জিজ্ঞেস করেই বসে,
“মিসকে আজকে অস্বাভাবিক লেগেছে আমার। তোমার কী মনে হয়, ভাইয়া? মিস হঠাৎ ফিট খেল কেন?”
অয়ন চোখ গরম করে তাকায় নিতুনের দিকে। নিতুন সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায়। বুঝতে পারে ভুল জায়গায়, ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে সে। অয়নের হঠাৎ কিছু একটা খেয়াল হয়। সে দ্রুত এগিয়ে যায় নিতুনের রুমের দিকে। নিতুন কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো বসে রয়। আজ হঠাৎ সবাই এমন আজিব আচরণ কেন করছে?
__________
স্নেহার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন প্রায় বিকেল। চোখ মেলে তাকাতেই সে সবার আগে নিজেকে একটা অচেনা রুমে আবিষ্কার করে। তার থেকেও অবাক করার ব্যাপার হলো তার সামনেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিতুনের বাবু ভাইয়া। হুট করে চোখ মেলে নিজেকে এরকম পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে স্নেহার সব প্রোসেস করতে এক মিনিট সময় লাগে। কিছুক্ষণ ভাবতেই তার মনে পড়ে যায় ও-ই ফোন কলটার কথা। আকাশ… ওই ছেলেটা… সুইসাইড!
স্নেহা আতংকে লাফিয়ে উঠে বসতে চায়। কিন্তু পারে না, শরীর সায় দিচ্ছে না। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ প্রতঙ্গ ব্যথা করছে। জ্বর পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে তাকে। এ কী লজ্জাজনক একটা পরিস্থিতি! এ কী যন্ত্রণা! জগতের সকল মুসিবত কী শুধু স্নেহাকেই খুঁজে পায়? জীবনটা কী সামান্য রহম করতে পারে না স্নেহার উপর?
অসহায় বোধ করা স্নেহা যখন অস্বস্তিতে ছটফট করছে, অয়ন তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু কদম এগিয়ে এসে বলে,
“এখন কেমন বোধ করছেন?”
স্নেহা দ্রুত নিজের গায়ে ওড়না ঠিকঠাক আছে কি-না দেখে উঠে বসে। বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে,
“আই এম সরি…”
স্নেহা পুরো কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই অয়ন বলে,
“উঠবেন না, টেক রেস্ট।”
“না, কয়টা বাজে? নিতুনকে পড়ানো হলো না। আরো স্টুডেন্ট আছে। হলেও যেতে হবে। আই এম সো সরি…”
“স্নেহা, বসুন।”
স্নেহা মানে না বারণ। জোর করে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ব্যাগ খুঁজতে নেয় নিজের। নীলা বেগম ঠিক সে-ই মুহূর্তে প্রবেশ করে। অয়নের আর কিছুই করতে হয় না। নীলা বেগমই স্নেহাকে সামান্য ধমকে বলেন,
“এই মেয়ে, বোকা নাকি? উঠছো কেন? বসো, আমি ভাত বেড়ে নিয়ে আসছি। খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। দেখি, জ্বর কেমন এখন?”
বলতে বলতেই নীলা বেগম স্নেহার কপালে হাত রাখে৷ স্নেহা অপ্রস্তুত হয়। অভ্যস্ত নয় সে। মোটেও অভ্যস্ত নয়। তাই এক কদম পিছিয়ে যায়। নীলা বেগম ততক্ষণে বলছেন,
“এখনো খুব জ্বর। বসো তুমি। আমি ভাত নিয়ে আসি। আর একদম খাবার নিয়ে ঘাড়ত্যাড়ামি করবে না। আমার কিন্তু পছন্দ না। চুপচাপ খেয়ে ওষুধ খাবে।”
বলেই নীলা বেগম বেরিয়ে যান। স্নেহা থম মেরে তাকিয়ে রয় ভদ্রমহিলার যাওয়ার পানে। এভাবে তার উপর অধিকার খাটিয়ে কথা বলায় স্নেহার রেগে যাওয়া উচিত। কিন্তু তার রাগ উঠছে না মোটেও। কেন উঠছে না সে নিজেও জানে না। এই এতো এতো মানসিক চাপে স্নেহা হাঁপিয়ে উঠেছে। কিন্তু হাঁপালেই তো বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই তার। ওই ছেলেটা বেঁচে আছে কি-না জানতে তো হবে। তার ফোনটা কোথায়?
নিজের ব্যাগটা বিছানার একপাশেই খুঁজে পায় স্নেহা। ব্যাগ হাতড়ে ফোন পায় না। আশেপাশে চোখ বুলানোর সময়ই হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা জিনিস। রুমের এক কোণে একটা কাপড়ের স্ট্যান্ডে পুলিশের নীল রঙা ইউনিফর্মটা ঝুলছে। স্নেহা চমকায়। নিশ্চিত হতে রুমে উপস্থিত অয়নকে জিজ্ঞেস করে,
“এটা কি আপনার বেডরুম?”
“হু।”
অস্বস্তিতে স্নেহার আবারও মাথা ঘুরে উঠতে চায়। এতক্ষণ সে একটা দামড়া লোকের বিছানায় অচেতন হয়ে পড়েছিল ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। মনে মনে রেগে যায় এই পরিবারের তিন সদস্যের উপর। না, না। তিন না, বরং দুই সদস্যের উপর। নীলা বেগম কোন আক্কেলে নিজের দামড়া বাবুর রুমে একটা মেয়েকে এনে শুইয়েছে? আর এই লোক? এই লোকই বা কোন আক্কেলে অনুমতি দিয়েছে? পুঁটি মাছের সাইজের আক্কেল নিয়ে ঘুরে না-কি এরা?
অয়ন ছোট করে হাঁফ ছেড়ে বলে,
“নিতুনের বেডরুমের অবস্থা নিজেই জানেন। ওর রুমের একদম পাশেই আমার রুম, তাই আম্মু এখানে নিয়ে এসেছে। চাইলে আম্মু নিজের রুমেও নিতে পারতেন, কিন্তু সেটা তুলনামূলক দূরে আপনি জানেন। আম্মুর একার পক্ষে আপনাকে এতক্ষণ ক্যারি করে ভার বওয়াটা কষ্টকর হতো। আমার হেল্পও আপনার পছন্দ হতো না, তাই করি নি। যাই হোক, আপনি কি এটা খুঁজছেন?”
অয়নের যুক্তিগত কথার পাশাপাশি নিজের ফোনটা অয়নের হাতে দেখে স্নেহা অবাক হয়। বুঝতে পারছে না এই লোকের হাতে তার ফোন কেন। তার ফোনে কোনো কিছু দেখে ফেলে নি তো? বুঝতে পারছে না স্নেহা। আপাতত বুঝতে আগ্রহীও নয়। সে দ্রুত ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে যায়। নাহ, আকাশের তরফ থেকে কোনো ম্যাসেজ আসে নি। কল? সেটা আর চেক করার সুযোগ পায় না স্নেহা। তার আগেই নীলা বেগম প্লেটে ভাত বেড়ে এসে হাজির হয়েছেন। স্নেহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি বলেন,
“এই, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। আন্টি হাত ধুয়ে এসেছি, আমি-ই খাইয়ে দিচ্ছি। হাত কিন্তু হ্যান্ডওয়াশ দিয়েই ধুয়েছি। তোমার অসুবিধা নেই তো?”
স্নেহা প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না। অমতও প্রকাশ করতে পারে না। তার আগেই নীলা বেগম ওকে বসিয়ে নিজে মুখোমুখি বসে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগে এই বাসারই বিশেষ পোলাও রোস্টের আয়োজন স্নেহার পেটে সয় নি। অথচ আজ ভদ্রমহিলার নিজ হাতে লাল শাক দিয়ে মেখে খাওয়ানো ভাত স্নেহার পেটে সয়ে যাচ্ছে। সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ভদ্রমহিলার দিকে। মাথা থেকে ক্ষণিকের জন্য দূর হয় আকাশ নামক আপদের চিন্তা। না চাইতেও এই মা স্বলুভ আচরণ পেয়ে স্নেহার ভেতরটা কাঁপে। শক্ত একটা খোলস একটু একটু করে খুলে পড়তে শুরু হয়। সে নিজের চোখ নামিয়ে নেয়। মমতায় মোড়ানো ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস হয় না। স্নেহা তাহলে লোভী হয়ে পড়বে। এই লোভ করার স্পর্ধা ও দেখাতে চায় না।
নীলা বেগম তখন স্নেহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলছে,
“অসুস্থ হলে নিজের হাতে খেয়ে কখনো স্বাদ পাওয়া যায় না। আমি এই কারণে বাবু এবং নিতুন অসুস্থ হলে সবসময় জোর করে মুখে তুলে খাইয়ে দেই। নিজের হাতে খেতে গেলে যে-ই খাবার নিয়ে এরা তালবাহানা করে, আমি খাইয়ে দিলে সেটা চুপচাপ খেয়ে নেয় পুরোটা। এই, আরেকটু বড়ো করে হা করো। চড়ুইয়ের ডিমের সাইজের লোকমা খেলে পেট ভরবে না-কি?”
স্নেহা কিচ্ছু বলে না৷ কিচ্ছু না মানে কিচ্ছু না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষে নীলা বেগম ওষুধও খাইয়ে দেয় যত্ন করে। পুরোটা সময় অয়ন রুমের দরজার কাছটায় দেয়ালে সামান্য হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে সবটা। ততক্ষণ সে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না স্নেহা খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ায় হলে ফেরার জন্য। নীলা বেগম স্নেহাকে জোর করে,
“কিছুক্ষণ বসো, রেস্ট নাও। শরীর ভালো লাগলে যেও। তোমার বাসায় কল করে ইনফর্ম করে দাও।”
‘বাসা’ শব্দটা স্নেহার কানে বাজে। তবুও সে ভদ্রতার সহিত জবাব দেয়,
“না, আন্টি। যেতে হবে এখন। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সরি। নিতুনকেও সরি বলবেন। আগামীকাল এসে আমি ওর আজকের পড়া কাভার করে দিবো নি।”
“আরে, বোকা। সরি বলছো কেন? উল্টো আমার রাগ হচ্ছে যে অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়াতে কেন এলে? আগামীকাল তোমার আসার দরকার নেই। বাসায় ভালো করে রেস্ট নাও। রাতে খেয়ে আরেকটা নাপা খেয়ে নিও। আর বাড়ি ফিরে কাউকে বলো মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিতে।”
স্নেহা আর কিছু বলে না। মাথা নত করে চুপচাপ বেরিয়ে যায়। অয়নকে সক্রিয় দেখায়। সে কিছুটা দায়িত্ব নিয়েই আম্মুকে বলে,
“আমি বাইক নিয়ে পিছু যাই। রাস্তায় আবার মাথা ঘুরিয়ে পড়লে? সেফলি পৌঁছালে, থানায় চলে যাবো।”
“আচ্ছা, বাবা। সাবধানে থেকো। রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। দেরি হলে মেইন রোড দিয়ে এসো। অন্ধকার গলিটলি সেফ না।”
__________
নিতুনদের বাসা থেকে স্নেহা যখন বেরিয়েছে তখন সন্ধ্যা প্রায়। রাস্তার চারিপাশে ঘন গাছগাছালি থাকায় অন্ধকার যেন দ্রুতই নেমে এসেছে। স্নেহা এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো রিকশা পায় না। তাই সে হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ হাতড়ে ফোনটাও বের করে। সরাসরি কল করে দুপুরের সে-ই নাম্বারটায়। বেশ অনেকক্ষণ রিং হয়, কিন্তু কলটা রিসিভ হয় না। স্নেহা আতংকে আবার জমে যাচ্ছে। একহাতে নিজের মাথার চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে।
ঠিক সে-ই মুহূর্তে তার পাশে এসে থামে একটা বাইক। বাইকে বসে থাকা অয়ন উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে,
“এই, ঠিক আছেন? খারাপ লাগছে আবার?”
স্নেহার এ-ই মুহূর্তে অয়নকেও অসহ্যকর লাগছে। সবার সমস্যাটা কী? স্নেহাকে কি একটু স্নেহার মতো ছেড়ে দিতে পারে না এরা? রাগ, আতংক এবং অসুস্থতায় স্নেহা না চাইতেও চোখ গড়িয়ে জল পড়তে শুরু হয়। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। অয়ন অপ্রস্তুত হয়। দ্রুত বাইক ছেড়ে নামে। স্নেহার পাশে দাঁড়িয়ে অস্থিরতায় নিজেও ছটফট করতে থাকে। আন্দাজ লাগাতে থাকে জীবন কতটা দূর্বিষহ ঠেকলে স্নেহারা কাঁদে? অয়ন মা-বাবার অতি ভদ্র বাবু হলেও, এই মুহূর্তে ওর সংযম থাকে না। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“প্লিজ কান্না থামান, না-হয় কেউ খুন হবে আজ।”
স্নেহার হুশ নেই। অয়নের কথা সে শুনেছে কি-না বুঝা যাচ্ছে না। সে নীরবে মুখ ঢেকে কাঁদতে ব্যস্ত। অয়ন আরেকটু সংযম হারায়। এবার সরাসরি হাত বাড়িয়ে স্নেহার মাথায় রাখে। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“কান্না করবেন না, স্নেহা।”
অয়ন এই জিনিসটা শিখেছে তার আম্মুর কাছে। মা’কে মনে পড়লে অয়ন যখন কাদতো, তখন আম্মু সবসময় তার মাথায় এভাবেই হাত বুলিয়ে দিতো। অয়নের খারাপ লাগা তখন দূর হয়ে যেতো। টের পেতো মা না থাকলেও তার একটা আম্মু আছে। মনটা হালকা হয়ে আসতো। সে চাচ্ছে স্নেহার মনটাও হালকা হোক।
কিন্তু স্নেহার মন হালকা হলো কি-না তা বুঝা গেল না। অয়নের হাত মাথার উপর টের পেতেই স্নেহা চকিতে ঘুরে তাকায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে এক মুহূর্ত অয়নকে দেখে সে আবারও কাদে। এবার আর রাখঢাক করে না, নীরবে আবডালে না। বরং কিছুটা শব্দ করেই ডুকরে কেঁদে উঠে। অয়ন বুঝে উঠতে না পেরে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। ভাবে স্নেহার হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু অবাক হয় যখন স্নেহা কান্না এবং আকুতি মিশ্রিত স্বরে বলে উঠে,
“সরাবেন না। দুই মিনিট মাথায় হাত রাখুন। শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে…”
অয়ন মায়া ভরা চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে স্নেহাকে। ধীরে ধীরে আবার নিজের হাতটা রাখে মেয়েটার মাথায়। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মনে মনে আওড়ায়,
“আপনি চাইলে কখনো সরবো না স্নেহা। আপনি চাইলে সবসময় আমার হাত পাবেন মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনি চাইলে মানুষ হিসেবে না, একটা অয়ন হিসেবেই পাবেন আমাকে।”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]