ঘর কুটুম পর্ব-০৬

0
4

#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৬_

আলতো আলো এসে পড়েছে জানালার পর্দা পেরিয়ে। রুমের ভেতর হালকা সোনালি রঙে ছেয়ে গেছে। তিতলি এখনও কুশানের পাশে ঘুমিয়ে। আজ আর তাকে ডেকে তোলেনি রুপন্তি। জন্মদিন বলে কথা, আজ তার স্কুলের থেকে মুক্তি। ঘুম থেকে উঠতে তাই দেরি হচ্ছে একটু। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় তিতলি। পাশ ফিরেই চোখে পড়ে তার বাবা। বহু প্রতিক্ষিত, বহু কাঙ্ক্ষিত মানুষটি একেবারে তার পাশে। সে যেন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠে,
–” পাপা!”

হঠাৎ এই চিৎকারে কুশানের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখে, তিতলি তার গলায় ঝুলে আছে। মেয়ের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আনন্দে। চোখ আধবোজা রেখেই সে হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকের উপর টেনে নেয়। তিতলির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে,
–” হ্যাপি বার্থডে, মা!”

তিতলি বাবার বুকের উপর মাথা রেখে বললো,
–” থ্যাংকিউ পাপা! তুমি লেট কলে ফেলেছো। আমি তো অনেক অপেক্ষা কলেছিলাম।”

একটা ক্ষীণ কষ্ট লুকিয়ে আছে তিতলির কন্ঠে। শিশুরাও যে অপেক্ষা করতে জানে, সেই অপেক্ষায় হৃদয় ভাঙে, তা যেন আবার বোঝা গেলো। কুশান একটু চুপ থেকে বলে ওঠে,
–” আমি জানি মা। আই এ্যাম সরি। তোমার পাপা খুব ব্যাস্ত ছিলো। সত্যি বলছি, ভুল হয়ে গেছে। তুমি রাগ করো না, প্লিজ!”

–” লাগ কলিনি। কিন্তু, মনে খালাপ লাগছিলো। আমি তোমাল ভয়েস শুনতে চেয়েছিলাম। তুমি আন্টিদেল মতো ফোন কলে আমাকে উইশ কলতে।”

কুশান আস্তে করে বলে,
–” তুমি ঠিক বলেছো, মা! আমি খুব বাজে কাজ করে ফেলেছি এইটা। আমার ছোট্ট মেয়েটা এতো অপেক্ষা করেছে আর আমি…”

পরমুহূর্তেই কুশান তিতলির মুখে আরেকটা চুমু দিয়ে বলে ওঠে,
–” তোমার পাপা আজ সারাদিন তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে। যা চাও তাই হবে। আমার আম্মুটা কি চায়?”

তিতলি নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে বলে,
–” আজ তুমি সালাদিন আমাল সাতে থাকবে।”

কুশান হালকা হেসে বললো,
–” আচ্ছা! আজ আমরা কেক কাটবো, বাইরে খেতে যাবো, ঘুরবো, শপিং করবো, আরও অনেক মজা করবো।”

তিতলির চোখ জ্বলে উঠে আনন্দে। উচ্ছ্বাসে বলে,
–” সত্যি?”

–” একদম সত্যি, মা!”

এদিকে রুপন্তি রান্নাঘরে রান্না করছে। চুলার আগুনের তাপে শরীর ঘেমে উঠছে। সকালের নাস্তা আর দুপুরের রান্না একবারেই করে নিচ্ছে, যেন আজ মেয়েটাকে একটু বেশি করে সময় দিতে পারে। রান্না শেষে রুমে আসে সে। দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে দেখে তিতলি কুশানের বুকের উপর মাথা রেখে কথা বলছে। আর কুশান চোখ বন্ধ করে মেয়ের সাথে কথা বলছে। কুশান ঘুম থেকে উঠে বেশ দেরি করে। আজ হয়তো মেয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। দৃশ্যটা অপূর্ব। একজন মা ও স্ত্রী হিসাবে তার চোখের সামনে এই ভালোবাসা দেখা খুব আনন্দের হওয়া উচিত ছিলো। অথচ রুপন্তির মনে কিছুই স্পর্শ করছে না। হৃদয়ে আজ কোনো আলো জ্বলে না। তিতলি রুপন্তিকে দেখে চেচিয়ে বলে ওঠে,
–” মাম্মাম! পাপা আজ আমাদেল বেলাতে নিয়ে যাবে।”

তিতলির উচ্ছ্বাস যেন ঘরের দেওয়াল কাঁপিয়ে দেয়। রুপন্তির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে, কেবল তিতলির জন্য। মেয়ের মুখে হাসি দেখলে রুপন্তি দুনিয়া ভুলে যেতে পারে। তিতলির কথায় কুশান চোখ তুলে তাকায় রুপন্তির দিকে। কাজ করার জন্য রুপন্তি এখন ঘর্মাক্ত। এমন রুপে কেউ বলবে না রুপন্তি এক বাচ্চার মা। রুপন্তি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে কুশানের দিকে। তারপর তিতলির দিকে তাকিয়ে বলে,
–” দেখা যাবে। এখন চলো, ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে হবে।”

তিতলি বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
–” পাপা! তুমিও চলো। খাবে আমাল সাথে।”

কুশান তিতলির কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–” অবশ্যই, মা!”

তিতলি খুশিতে কুশানকে জড়িয়ে ধরে। এই ছোট্ট সংলাপ, এমন মুহুর্ত, সাধারণ চোখে দারুন লাগে। কিন্তু, এই দৃশ্য রুপন্তির ভেতরটা জ্বালিয়ে দেয়। আগুনের মতো দাউ দাউ করে উঠে শরীর। এই মানুষটাই তো গতকাল রাতে মেয়ের জন্মদিন ভুলে গিয়ে গভীর রাতে ফিরেছিলো। যে মানুষটার মুখে একটুখানিও দুঃখের ছাপ ছিলো না, এখন সে যেন নিখুঁত পরিবারের নিখুঁত পিতা হয়ে উঠেছে হঠাৎ। গতকাল রাতের কান্না, অবহেলা, সব কিছু আজ সকালে এমন করে ঢেকে দিচ্ছে? এখনের এই সব কিছু তার কাছে কৃত্রিম লাগছে। রুপন্তির মনে হয়, এইসব নাটক, অস্থায়ী, আলগা ভালোবাসার অভিনয়।

রুপন্তি আর এক মুহুর্ত দাড়ায় না। কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার হাত শক্ত হয়ে আসে। চোখে জমে থাকা ঘুম, ক্লান্তি, আর অভিমানে চোখ জোড়া লাল হয়ে আসে। রুপন্তি জানে আজকের দিনটা তার মেয়ের। সে চায় না তার মনের ঝড় মেয়ের আনন্দে বাঁধা হয়ে দাড়াক। তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে একের পর এক মুখোশ পরার জন্য।

শপিংমলের সাদা ঝকঝকে আলো যেন একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি করেছে। চারপাশে মেটালিক রঙের ছোঁয়া, উজ্জ্বল কাঁচ ঘেরা শোরুম গুলোতে সারি সারি ঝুলে থাকা জামা কাপড়, ম্যানিকুইনের সাজানো নিখুঁত সৌন্দর্যে। ব্যাস্ত দোকানিরা ভদ্র ও নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে কথা বলছে ক্রেতাদের সঙ্গে। শহুরে আয়েশি ছায়া যেন প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে। ছোয়া ধীরে ধীরে হাঁটছে এক দোকান থেকে অন্য দোকান। আজ বাড়ি থাকতে ইচ্ছে করছিলো না একদম। বিকেলটা থমকে ছিলো, বাতাসও যেমন ভারি। রান্নাঘর, ঘরকন্না, চারপাশের নির্লিপ্ততা, সব কিছুই যেন একরকম বদ্ধ খাঁচার মতো লাগছিলো। শাশুড়ির সাথে গল্প করার মতো ভাগ্য তার নেই। গল্প করতে বসলেই বাচ্চা না হওয়ার নিয়ে কটু কথা বলা শুরু করে দিবে। ছোয়ার সহ্য হয় না এইসব৷

শিশিরের ছোট বোন শ্রেয়া অবশ্য আলাদা৷ শিক্ষিত, সচেতন, আধুনিক মানসিকতার তরুনী। সে বুঝে সব সময় সব কিছু মানুষের হাতে থাকে না। ছোয়া শ্রেয়ার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে পারে। মাঝে মাঝে দুজন এক সাথে বের হয়, কিন্তু তাও খুব কম। শ্রেয়ার নিজের একটা জগৎ আছে, ভার্সিটি, বন্ধুমহল, ক্লাস, টার্ম পেপার, সব মিলিয়ে শ্রেয়া নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। তাই ছোয়া বেরিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে এই শপিংমলে। আলো, আর নানান রকম মানুষের মাঝে যেন নিজেকে একটু গা ঢাকা দেওয়া যাবে। আজকের বেরোনোর পেছনে ছোয়ার নিজস্ব কারনও আছে। আসলে, ছোয়ার প্লান চলছে বাবার বাড়ি যাওয়ার। অনেকদিন যাওয়া হয় না। সবার জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাবে ছোয়া। কারন, এখনো সেই বাড়িটা তার আশ্রয়। সেই শৈশবের ঘর, যে ঘরে কোনো প্রশ্ন থাকে না। কেবল, গ্রহন করে নেওয়া হয়।

সৌভাগ্যবশত, এইসব বিষয়ে শিশির কখনো বাঁধা দেয়নি। এমনকি প্রশ্নও তোলে না। সংসারে সে কখনো টাকার হিসাব কষে দেখেনি। শিশির একটা বড় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ইকামের অভাব নেই। ছোয়া নিজে চাকরি করে না, কিন্তু সেটা কখনো সে বুঝতে পারে না। শিশির তার স্ত্রীকে টাকা পয়সার দিক দিয়ে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। টাকা, পয়সা, শপিং, বাবার বাড়িতে খরচ এইসব নিয়ে একবারও প্রশ্ন তোলে না শিশির। তবুও, কিছু কথা থাকে যা অর্থের চেয়ে বড়। সংসারে কিছু প্রশ্ন থাকে যা অর্থ দিয়ে মাপা যায় না। সন্তানহীনতা যেমন। একটা ঘরে হাসি কান্না নেই, চিৎকার নেই, খেলনা নেই, ওখানে প্রেম থাকলেও একদিন একটা শূন্যতা জমতে জমতে দেয়াল পর্যন্ত চির ধরিয়ে দেয়।

ছোয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে শোরুমের এক পাশ দিয়ে। ঝুলিয়ে রাখা জামা কাপড় গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। রঙ, কাটিং, ফেব্রিক, সব মিলিয়ে তার নিজের একটা রুচি আছে। হুট করে কিছু কিনা তার স্বভাবে যায় না। সে দশটা দোকান না ঘুরে একটা জামা কিনবে না। ঠিক সেই সময়, পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
–” ছোয়া!”

ছোয়া থেমে যায়। কাঁধ ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায়। সামনে দাড়িয়ে আছে একজন পুরুষ। মানুষটাকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে ছোয়ার। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের মাঝে মিলতে থাকে ছবিটা। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এ তো তার প্রাক্তন কৌশিক। কৌশিকের মুখে এক ধরনের মৃদু হাসি। ছোয়ার গলা শুকিয়ে আসে। সে আস্তে করে ফিসফিস করে বললো,
–” কৌশিক!”

কৌশিক নরম কন্ঠে বলে ওঠে,
–” চিনতে পেরেছো তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম, চিনতে পারবে না হয়তো।”

ছোয়ার বুকের ভেতর ধক করে উঠে। এই মানুষটা, একসময় যাকে নিয়ে সে ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন দেখতো। যাকে না পেলে মনে হতো জীবনটাই থেমে যাবে। সে ভাবতো, এই মানুষটা ছাড়া তার জীবন কল্পনা করাও অসম্ভব। সে ভাবতো, এই মানুষটিই হবে তার ভবিষ্যতের একমাত্র সত্য। সেই মানুষটাই আজ তার সামনে দাড়িয়ে, এই শপিংমলের কৃত্রিম আলোয় বাস্তবের চেয়েও বাস্তব হয়ে। আসলেই, সময় বলে কিছু আছে। সময় এমন ভাবে পাল্টে দেয় জীবন, যেন মানুষগুলোও নতুন হয়ে যায়৷ এই মুহুর্তে, হঠাৎ করে দেখা পেয়ে ছোয়া অস্থির হয়ে পড়ে। মুখে হাসি আসছে না, চোখে জলও আসছে না। কিন্তু, একটা টান, অদ্ভুত অস্বস্তি বুকের মাঝে গেঁথে বসে আছে। ছোয়ার ঠোঁট কাঁপছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, হাসবে নাকি কাঁদবে। অভিমান, ভালোবাসা কিছুই নেই। কিন্তু, একরকম অস্থিরতা গলা জড়িয়ে ধরে। এতোগুলো বছরের নিস্তরঙ্গ জীবনের মধ্যে এই হঠাৎ আগমন ছোয়ার অনুভুতি শক্তি আটকে ফেলেছে।

কৌশিক দুই পা এগিয়ে আসে ছোয়ার দিকে। ছোয়া এখনও রুপবতী, কিন্তু এখন সে অন্যকারো। কিন্তু, কৌশিকের মনে হয়, বর্তমান ছোয়ার থেকে আগের ছোয়া আরও রুপবতী ছিলো। ছোয়া নিজেকে সামলিয়ে বলে,
–” তুমি এখানে?”

কৌশিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–” শপিং করতে এসেছিলাম। উপর ফ্লোর থেকে তোমাকে দেখলাম। ভাবলাম, এতোগুলো বছর, দিন পর দেখা হয়েছে, কথা না বলে যাই কিভাবে? যদি কিছু মনে না করো, উপরের ফ্লোরে ক্যান্টিন আছে, ওখানে বসে একটু কথা বলা যায় কি? অনেক দিন পর দেখা, তাই বললাম। অবশ্য, যদি তোমার অসুবিধা না হয়।”

ছোয়া কিছু সময় চুপ থাকে। মুখে দ্বিধা, মনে দোলাচল। সে জানে, এই মানুষটা একটা সময় তার সব কিছু ছিলো। এখন কেবল একটা পরিচিত মুখ। কিছু সময় কথা বললে কি কোনো পাপ বা ক্ষতি হবে? এইটা তো অন্যায় কিছু না। ছোয়া আস্তে মাথা নেড়ে বললো,
–” না! সমস্যা নেই। চলো।”

ছোয়া আর কৌশিক ক্যান্টিনের জানালার পাশে গিয়ে বসে। কাচঘেরা জানালা দিয়ে শহুরে পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। ক্যান্টিনটা বেশ ছিমছাম, কিন্তু আধুনিক সাজ। মানুষের ভিড় কম, তাই বসতে সুবিধাই হয়। কৌশিক দুইটা কফি অর্ডার করে। এরপর কিছুক্ষন নিরবতা, তারপর প্রশ্ন করে,
–” আমি যদি ভুল না করি, তাহলে তোমার হাসবেন্ডের নাম শিশির, রাইট?”

ছোয়া মাথা নাড়ে,
–” হ্যা! শিশির চৌধুরী!”

–” কেমন চলছে জীবন?”

–” ভালোই!”
ছোয়ার উত্তর ছোট।

ছোয়া একটু হাসে। সেই পুরনো, ধীর হেসে ফেলা, যেইটা কৌশিক চিনে ফেলে। কৌশিক হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
–” পুচকি কোথায়?”

প্রশ্নটা স্বাভাবিক। এমন প্রশ্ন যে কেউ করতে পারে। কিন্তু, ছোয়ার চোখে তীব্র এক দৃষ্টির ছায়া পড়ে। হাসি মিলিয়ে যায় ঠোঁট থেকে। ছোয়া নিচু গলায় বলে,
–” এখনো নেওয়া হয়নি।”

এক মুহুর্তের জন্য কৌশিকের ভ্রু কুচকিয়ে উঠে। মুখে বিস্ময় ভেসে উঠে। বিয়ের তো অনেক বছর হয়ে গেছে। এখনো বাচ্চা নেয়নি, এইটা কেমন কথা? তবে সে প্রশ্ন করে না। ছোয়া নিজেই প্রসঙ্গ ঘোরায়,
–” আমার কথা বাদ দাও। তুমি কি করছো এখন?”

–” জব করি। তোমার স্বামীর মতো বিশাল চাকরি না। মাঝারি মানের। কিন্তু, ভালোই চলছে।”

–” বউ কোথায়?”
ছোয়া হালকা হেসে জিজ্ঞেস করে।

কৌশিক হেসে ফেলে। তেতো শান্ত হাসি।
–” তোমার বিয়ের চার বছর পর আমি বিয়ে করেছিলাম। ছয় মাসও টেকেনি। ডিভোর্স হয়ে গেছে।”

–” কেন?”
ছোয়া একটু অবাক হয়।

–” হ্যা! মেয়ে ভালো ছিলো। শিক্ষিত, ভদ্র। কিন্তু, আমি তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে পারিনি। আমি তো ঠিক করে ছিলাম বিয়ে করবো না। কিন্তু, মা এক প্রকার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে জোর করে বিয়ে দিলো। বলতো, জীবন থেমে থাকে না। আমি চুপচাপ মেনে নিয়েছিলাম। ভাবলাম সময়ের সাথে সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবো। আমিও চেয়েছিলাম সংসার করতে, কিন্তু পারিনি। সত্যি বলতে, আমি প্রতিদিন তার মধ্যে ছোয়া নামক মেয়েটিকে খুঁজে বেড়াতাম। তার হাসি, তার অভিমান সব কিছুর পেছনে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজতাম। একটা জায়গা থেকে বোঝা গেলো, এই বৈবাহিক সম্পর্কটা আর টেকানো সম্ভব নয়। আমি কোনোদিন তাকে নিজের মতো করে গ্রহন করতে পারিনি।”

এক মুহুর্তে ছোয়ার চোখ ছলছল করে উঠে। সে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কৌশিকের দিকে। কৌশিক দ্রুত বলে ওঠে,
–” ছোয়া! আমি তোমাকে কোনো দোষ দিচ্ছি না, বিশ্বাস করো। তখন পরিস্থিতি আমাদের হাতে ছিলো না। তুমি তোমার মতো করে নিজের পথ বেছে নিয়েছিলে, যা একদম ঠিক ছিলো। তুমি আমার কপালে ছিলে না, এইটা আমি মেনে নিয়েছি। তোমার তো করার কিছুই ছিলো না। পরিস্থিতির কাছে আমরা দুজনেই হেরে গিয়েছিলাম। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই। আচ্ছা, আমরা এইসব অতীত বাদ দেই। তুমি এখন কেমন আছো, সেইটা শুনি। শিশির কেমন? তোমার স্বামী সম্পর্কে কিছু বলো।”

ছোয়া হাসার চেষ্টা করে,
–” কি বলবো?”

–” আরে একটু বলো, তোমার সম্পর্কে।”

–” এইতো, আমি, আমার শ্বশুর, শাশুড়ী, স্বামী আর ছোট একটা ননদ থাকি।”

–” শিশিররা কি দুই ভাই বোন?”

–” নাহ! তিনজন। শিশির বড়। পরে দুইবোন। একজনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেকজন এখনো পড়াশোনা করে।”

ছোয়া আর কৌশিক কথা বলতে থাকে। পুরনো কথা, নতুন কথা, জীবনের ছেঁড়া পাতাগুলো একে একে উল্টে যায়। একটা সময় দুইজনেই হালকা হয়ে যায়। তবে সময় কারোর জন্য দাড়িয়ে থাকে না। ছোয়া ধীরে উঠে দাড়ায়।
–” আমাকে এখন যেতে হবে, কৌশিক!”

কৌশিক একটু থেমে বলে ওঠে,
–” ছোয়া! আমাদের মধ্যে যা ছিলো সেগুলো অতীত। কিন্তু, আমরা তো এখন বন্ধু হয়ে থাকতে পারি, তাই না? আমি চাই, তুমি সুখে থাকো। কিন্তু, আমরা তো বন্ধু হয়ে থাকতে পারি। জীবনের যে রাস্তা থেকে আমরা আলাদা হয়ে গেছি, সেই রাস্তা ভুলে আমরা একটা নতুন রাস্তা খুঁজতে পারি না? শুধু বন্ধুত্বের রাস্তা।”

ছোয়া মাথা নাড়ে,
–” অবশ্যই! আমি কোনো সমস্যা দেখি না।”

–” তাহলে, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা পেতে পারি?”

ছোয়া নিজের নাম্বার দেয়। কৌশিকের নাম্বারটাও নিয়ে নেয়। দুজনে একে অপরকে বিদায় জানায়। ছোয়া ধীরে ধীরে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে। কাঁচ ঘেরা করিডোর পেরিয়ে শপিংমলের বাইরে এসে দাড়ায়। হালকা হাওয়া বইছে। গভীর ভাবে নিঃশ্বাস ছাড়ে। যেন অনেকক্ষণ আটকে রাখা কিছু ছেড়ে দিচ্ছে। চারপাশে কৃত্রিম আলোয় সব কিছু ঝলমলে। কিন্তু, সেইসব ছোয়ার চোখ স্পর্শ করে না। ছোয়া ব্যাগ থেকে শিশিরের ফোন বের করে। ফোন স্ক্রিনে শিশিরের ফটো। ছোয়া মনে মনে বলে ওঠে,
–” আমি শুধু ওর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছি। কৌশিক আমার অতীত। আর তুমি যাই হও না কেন, দিন শেষে তুমি আমার স্বামী। সব কিছুর পরেও আমার ঘরটা তুমি। আমার মানুষটাও তুমি। আমি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি শিশির!”

#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹