ঘর কুটুম পর্ব-০৭

0
3

#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_৭_

রাত অনেক আগেই নেমেছে। বাইরে আধো মেঘে ঢাকা চাঁদের আলো। হালকা কুয়াশার মত আবরণ চারপাশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ছাদঘেঁষা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ছোয়া। রুমে শিশির অফিসের ল্যাপটপে কাজ করছে। কিন্তু দুইজনের মাঝখানে একটা ভারী নীরবতা জমে উঠেছে, যেন চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ঠিক অনুভব করা যায়।ছোয়ার মনে আজ হালকা অথচ গভীর এক টানাপোড়েন। কৌশিক। আজ হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়া পুরনো মুখটা যেন কাঁচের জানালার ভেতর দিয়ে বারবার তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোয়া জানে, সে আর কৌশিকের প্রতি কিছু অনুভব করে না। ভালোবাসা, অভিমান, আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই। তবু, মনে একটা ধাক্কা লেগেছে। অতীত যেমনই হোক, তা যে একেবারে মুছে ফেলা যায় না। ছোয়া নিজেকে বোঝাতে থাকে,
–” আমি তো শুধু নাম্বারটা দিয়েছি। এতে কি অন্যায় হলো? প্রাক্তন বলে কি মানুষ বন্ধু হতে পারে না?”

তবে কৌশিকের মুখে সেই শেষ কথাগুলো, আমি প্রতিদিন তার মধ্যে তোমাকে খুঁজতাম ছোয়া। এই একটা লাইন ছোয়ার বুকের ভেতর অজান্তেই হাহাকার তুলে দিয়েছে। মনটা আপনেই ফিরে গেছে কয়েক বছর আগের সেই দিনগুলোর দিকে। কৌশিক আর ছোয়ার সম্পর্কটা ছিল তিন বছরের। অল্প বয়সের একরকম পাগলপারা প্রেম, যেখানে হিসাব নেই, শুধু অনুভব আছে। কৌশিকের পরিবার ছিল সাধারণ, সীমিত আয়ের। কিন্তু, ছোয়ার বাবা ছিলেন শহরের নামকরা একজন ব্যবসায়ী। একমাত্র মেয়ে হিসেবে ছোয়া ছিলেন তার অহংকার। কৌশিকের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানাজানি হতেই এক ভয়াবহ ঝড় নামে ছোয়ার জীবনে। ছোয়ার বাবা বলেছিলো, ঐ ছেলের কাছে যেতে হলে তাকে হ*ত্যা করে যেতে হবে। এই বাক্যটা ছোয়ার বাবা বলেছিলেন ঠান্ডা গলায়, কিন্তু ছোয়ার বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

একটা সময় ছোয়া আর লড়তে পারেনি। চোখের পানি আর মায়ের নীরব কান্না মিলিয়ে ছোয়া মাথা নত করে নেয়। সম্পর্কটা ভেঙে দেয়। নিজের ইচ্ছেকে হত্যা করে, পরিবারের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করে। আর পরের কয়েক মাসের মধ্যেই শিশিরের সঙ্গে বিয়ে। বিয়ের শুরুতে ছোয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে শিশিরকে মানিয়ে নিতে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের দায়িত্বশীলতা, নীরব উপস্থিতি, আর স্থিরতায় একটা শ্রদ্ধা জন্মে গেছে। ভালোবাসাও হয়তো। কিন্তু ভালোবাসা আর সম্পূর্ণতা এক জিনিস নয়। কিন্তু, অবশেষে ছোয়া কি সুখি হয়েছে? কৌশিকের ফেলানো দীর্ঘশ্বাস গুলো কি তার বর্তমান জীবনের কারন?

ছোয়া চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়।
তারপর ধীরে পা ফেলে ফিরে আসে নিজের রুমে।
রুমের ভেতর শিশির ফাইল এক পাশে রেখে ফোন স্ক্রল করছে। ওর গলায় ক্লান্তি স্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টিতে কোনো বিরক্তি নেই। শিশির চোখ তোলে।
–” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

ছোয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ে,
–” না!”

শিশির হালকা হাসে,
–” বোতলে পানি শেষ। একটু পানি এনে দাও তো।”

ছোয়া চুপচাপ এগিয়ে আসে। বেড সাইড টেবিল থেকে খালি বোতলটা তুলে নেয়, বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

ছোয়া রান্নাঘরে দাড়িয়ে নুডুলস নাড়ছে। গরম ভাপে শরীর ঘেমে উঠেছে। সকালের নাস্তা করার পর থেকেই ব্যস্ত সে। আজ একটু তাড়াহুড়ো। ননদ শিথী সকাল সকাল এসেছে পাঁচ বছরের ছেলে রোহানকে নিয়ে। এসেই রোহান দাবি করেছে মামির হাতের নুডুলস খেতে চায় সে। ছোয়া হেসেছিলো। এই ছোট্ট ছেলেটার মুখে এমন আদুরে কথা শুনলে তার মনটা নরম হয়ে যায়। নিজের সন্তান না হওয়ায়, ছোয়া সব শিশুর মধ্যেই একটা অদ্ভুত টান অনুভব করে। তারা যেন নিজের না হয়েও নিজের মতো, এমনই মনে হয় ছোয়ার। নুডুলস রান্না হয়ে গেলে ছোয়া ড্রইংরুমে এসে দেখে রোহান সোফায় বসে টিভিতে কার্টুনে মগ্ন। ছোয়া মৃদু হাসে। তারপর বলে,
–” রোহান! আসো, আমি খাইয়ে দেই তোমাকে।”

রোহান খুশি মনে দৌড়ে আসে। ছোয়া তাকে ডাইনিং এ বসিয়ে নরম হাতে খাওয়াতে থাকে। রোহান খেতে খেতে বলে ওঠে,
–” মামি! তুমি জানো, আমার স্কুলে কাল একটা নাটক হয়েছিলো। আমি সেখানে পুলিশ হয়েছিলাম।”

ছোয়া হেসে উঠে।
–” ওয়াও! তাহলে এখন তুমি সাহসী পুলিশ অফিসার? তুমি কি দুষ্টু লোকদের ধরতে পারো?”

রোহান উৎসাহ নিয়ে বলে,
–” অবশ্যই! আমি দুষ্টু লোকদের ভয় পাই না।”

খাওয়ানো প্রায় শেষ। তখনি শিথী আসে ওদের কাছে। কিছুক্ষণ নীরবে দাড়িয়ে দেখে রোহান আর ছোয়াকে। তারপর এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসে। রোহান বলে,
–” আম্মু! মামির নুডুলস অনেক মজা।”

শিথী হালকা হেসে বলে,
–” হুম! খাওয়া শেষ? যাও, টিভি দেখো।”

রোহান ছুটে যায় ড্রইংপ্লেসের দিকে। টিভি অন করে কার্টুনে মনোযোগী হয়ে যায়। ছোয়া একটু নড়েচড়ে বসে। শিথীর সাথে ছোয়ার সম্পর্ক মোটামুটি রকমের। ছোয়ার সাথে সরাসরি কোনো ঝামেলা না করলেও মায়ের কান ভারি করে শিথী। ছোয়া ব্যাপারটা বুঝলেও পাত্তা দেয় না। শিথী মুখ খুলে,
–” তোমার শরীরের কি অবস্থা, ভাবি?”

–” ভালো।”

শিথী যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু থেমে যায়। ছোয়া সেটা বুঝতে পারে। ছোয়া আস্তে করে বলে,
–” তুমি কি কিছু বলতে চাও, শিথী?”

–” হ্যা! ভাবি! আসলে কথাগুলো বলা খুব দরকার। কারন, এইভাবে তো চলতে পারে না।”

ছোয়া কিছু বলে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিথীর দিকে। শিথী বলে চলে,
–” দেখো ভাবি, ভাইয়ার একটা জীবন আছে। একটাই ছেলে সে। বংশ টিকিয়ে রাখারও একটা দায় থাকে, তাই না? আমি এখন অন্যের সংসারে চলে গেছি। সময় হলে শ্রেয়ারও বিয়ে হয়ে যাবে, অন্যের সংসারে চলে যাবে। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। একটা সময় তুমি, ভাইয়া, আমি, আমরা সবাই বৃদ্ধ হয়ে যাবো। তারপর? শেষে এই রক্তের ধারা কে বহন করবে? এই বংশ কে টিকিয়ে রাখবে?”

ছোয়ার দেহে এক ধরনের স্নায়বিক উত্তেজনা তৈরি হয়। রক্ত বিন্দু যেন দ্রুত ছোটাছুটি শুরু করে। শিথী বলে যায়,
–” এতো গুলো বছর হয়ে গেলো, একটা সন্তানের মুখ দেখা গেলো না। মা, আব্বুরও তো ইচ্ছে করে, ছেলের ঘরের নাতি কোলে নেওয়ার। আর এই চাওয়াটা তো অন্যায় না, বলো?”

ছোয়ার গলার স্বর ঠান্ডা, কিন্তু গভীর,
–” তুমি আসলে কি বলতে চাচ্ছো, শিথী?”

শিথী এবার একদম স্পষ্ট সুরে বলে ওঠে,
–” দেখো ভাবি, অনেক বছর হয়ে গেছে তোমাদের বিয়ে হয়েছে। একটা সন্তান পর্যন্ত হয়নি। ভাইয়ার জীবনে এই কষ্টটা অনেক বড় হয়ে দাড়িয়েছে। মা তো সব সময় বলে, সংসার একটা জায়গায় এসে থেমে গেছে। একঘেয়ে হয়ে গেছে। ভাইয়া তো চুপচাপ থাকে। কিছুই বলে না। কিন্তু, তার মনেও তো একটা অভাব আছে, তাই না ভাবি?”

–” তোমার ভাইয়ার অভাব তুমি বুঝো?”

–” অবশ্যই বুঝি। নিজের ভাই আমার। ভাবি এমন করে আর কতোদিন? তোমার উচিত ভাইয়ার জীবন থেকে সরে যাওয়া। মাও এইটাই বলেন।”

চোখ বন্ধ করে ফেলে ছোয়া। এমনটা সে আন্দাজ করেছিলো তবুও সরাসরি মুখে শোনা, এইটার তীব্রতা অনেক। শিরাগুলো যেন কাঁপছে ভেতরে ভেতরে। ধীরো বলে ওঠে,
–” আমি শিশিরের জীবন থেকে সরে যাবো?”

শিথী মাথা নাড়ে। মুখে এক ধরনের আড়াল হীন নির্মমতা।
–” হ্যা ভাবি! তোমার উচিত সরে দাড়ানো। তুমি ভাইয়ার ভালো চাইলে, অবশ্যই ভাইয়ার ভবিষ্যতের কথা ভাববে। ভাইয়ার একটা পূর্ন সংসার হোক। যেখানে একটা বাচ্চার হাসি থাকবে, একটা পূর্নতা থাকবে। সব কিছু তো আর দায়িত্ব, ভালোবাসা দিয়ে হয় না।”

–” তোমার ভাইয়া রাজি?”

–” তুমি রাজি করাবে। তুমি তো চাও ভাইয়ার জীবন সুন্দর হোক, বলো?”

ছোয়া আস্তে করে বলে,
–” আমি অবশ্যই বলবো তোমার ভাইয়াকে। তোমরাও বোঝাও তোমার ভাইয়াকে। যদি সে রাজি হয়, আমি অবশ্যই তোমার ভাইয়ার সুন্দর জীবন পাওয়ার রাস্তা থেকে সরে দাড়াবো।”

শিথী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।
–” ধন্যবাদ ভাবি! আর যাই হোক, একটা বন্ধ্যা মেয়েকে নিয়ে তো সংসার হয় না, বলো?”

ছোয়া নিজেকে সামলিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। শরীরটা যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, তবুও শান্ত। আস্তে করে বলে,
–” আমি একটু রুমে যাচ্ছি। আমার একটু কাজ আছে।”

–” ঠিক আছে!”

ছোয়া ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে হাঁটে। পেছন থেকে শিথীর কন্ঠস্বর, আর রোহানের কার্টুনের আওয়াজ, রোহান বলা আদুরে কথা সব আওয়াজ গুলো মিলে মিশে যায়। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় ছোয়া। রুমের নিস্তব্ধতায় চারপাশ যেন ভারি হয়ে আসে। সে বিছানার উপর উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বুকেড ভেতর আগুনের মতো কষ্ট পাক খাচ্ছে। এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। চোখ বন্ধ করে ফেলে ছোয়া। কিছু দেখতে চায় না সে, কিছু শুনতেও চায় না। শুধু একটুখানি ঘুম দরকার, হয়তো তাতে কিছুক্ষণের জন্য সব ভোলা যাবে। শুধু একটু ঘুম।

শহরের ব্যস্ততম জায়গাগুলোর একটিতে অবস্থিত এক বিশাল অফিস বিল্ডিং। যার বাইরে থেকে যেমন চকচকে, ভেতরের পরিবেশও তেমনি ছিমছাম, শৃঙ্খলিত। শিশির বসে আছে নিজের কেবিনে। চোখের সামনের খোলা একটি ল্যাপটপ, যার স্ক্রিনে শিশিরের চোখ নিবদ্ধ। পাশে রাখা আছে কিছু রিপোর্ট আর ক্লায়েন্ট ফাইল। হঠাৎ কেবিনের দরজায় টোকা। শিশির বলে,
–” কাম ইন।”

দরজাটা খুলে যায় ধীরে। পরিপাটি বেশে প্রবেশ করে একজন জুনিয়র স্টাফ আশিক। শিশির স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
–” বসুন।”

আশিক শিশিরের অপজিটের চেয়ারে বসে। তারপর মার্জিত ভাবেই বললো,
–” স্যার! আমি আসলে কোনো অফিশিয়াল কাজে আসিনি। একটা ব্যাক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।”

–” বলুন।”

আশিক একটা ইনভাইটেশন কার্ড শিশিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–” স্যার! আগামীকাল আমার মেয়ের তিন বছর পূর্ন হবে। ওর জন্মদিন উপলক্ষে ছোট্ট একটা আয়োজন রেখেছি বাসায়। আপনার আর ম্যামের উপস্থিতি খুব ভালো লাগবে আমার আর আমার পরিবারের।”

শিশির হালকা হাসে। কার্ডটা হাতে নেয়। তারপর বলে,
–” আপনার মেয়ের জন্য অনেক দোয়া রইলো। ও যেন অনেক সুন্দর একটা জীবন পায়।”

–” আপনি যদি নিজে এসে ওকে উইশ করে যান, তাহলে খুব ভালো লাগবে। অবশ্যই ম্যামকে নিয়ে আসবেন।”

শিশির একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
–” চেষ্টা করবো। দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ!”

–” তাহলে, আজ আসি স্যার! আগামীকাল আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবো।”

শিশির মাথা নাড়ে। আশিক চলে যায়। শিশির কার্ডটার দিকে তাকায়। মিষ্টি একটা ডিজাইন। গোলাপি রঙের ঝলমলে কার্ডে ছোট্ট মেয়ের হাসিমুখের একটা ছবি। শিশির কার্ডটা খুললো। হেডিং এ লেখা, হ্যাপি বার্থডে টু আওয়ার লিটিল এঞ্জেল, পড়শি। শিশিরের বুকের কোথাও একটা সুড়সুড়ি লাগে। না! এটা শুধুমাত্র একটা কার্ড নয়, এটা একটা অন্য জগতের জানালা। একটা বাড়িতে ব্যাস্ততার আভাস। মা রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত, বাবা ডেকোরেশন নিয়ে, আর বাচ্চা মেয়েটি তার সাজগোছ। কেক বাছা, গিফট প্যাকিং কতো কি। আর এখানে? শিশিরের জীবনে নেই কোনো পড়শি, নেই কোনো আনন্দের বাড়ি। একটা দীর্ঘশ্বাস গলায় আটকে আছে। মানুষ কতো আয়োজন করে একটা শিশুর জন্য। একটা সন্তান, একটা ঘর এই তো চাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু, তার জীবনে? ইশশশ! তার যদি একটা বাচ্চা থাকতো। তাহলে, সেও অনেক আয়োজন করে সুন্দর করে তার বাচ্চার বার্থডে পার্টির আয়োজন করতো। কিন্তু, সেইটা যে সম্ভব নয়।কারনটা সে নিজেই। নিজের ভেতরে থাকা এমন একটা অক্ষমতা শিশিরকে যেন ধ্বংস করে দিচ্ছে মনের দিক দিয়ে।

ছোয়ার মুখটা মনে পড়ে শিশিরের। নিঃশব্দ, শান্ত অথচ গভীর এক অভিমানী চোখ। ওরও নিশ্চয় মা হতে ইচ্ছে করে। একটা ছোট্ট মুখকে বুকে জড়িয়ে ধরতে, আদর করতে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, এই অপূর্নতার মূলে যে সে নিজে। শরীরের কোথাও এক অদৃশ্য সীমাবদ্ধতা, যার কারনে পুরো একটা সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। ছোয়ার মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কখনো ছিলো না। শিশির সব কিছুই বুঝে। কিন্তু, সে ভয় পায়। এই সমাজের ভয়, এই মানুষগুলোর পিঠপিছে করা কটুবাক্যের ভয়। সবাই কতো সম্মান করে তাকে। কিন্তু, সবাই যখন জানবে শিশির সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অক্ষম, তখব এরাই হাসাহাসি করবে। না না না শিশির কখনোই এভাবে নিজেকে দেখতে পারবে না।

একটা জোরে নিশ্বাস নেয় শিশির। ল্যাপটপ কিবোর্ডে হাত রাখে সে। কিন্তু, আঙুল গুলো যেন জমে আছে। টাইপ করতে ইচ্ছে করছে না। এক ঝটকায় ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় শিশির। ঘড়িতে চোখ রাখে। অফিস টাইম প্রায় শেষ। চেয়ারের উপর থেকে কোর্টটা তুলে হাতে নেয় সে। ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় সে।

শিশির কেবিন থেকে বের হতেই করিডোরে দেখা হলো তার কলিগ মিসেস.তিথির সাথে। মৃদু হেসে মিসেস.তিথি এগিয়ে এসে বলে,
–” এডভ্যান্স কংগ্রাচুলেশন, মিস্টার শিশির।”

শিশির হালকা হাসে। কিন্তু, ভ্রু কুচকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–” কেন?”

–” আপনি খুব তাড়াতাড়ি প্রোমশন লেটার পেতে চলেছেন।”

শিশির আরও একটু হাসে। নম্র স্বরে বলে ওঠে,
–” থ্যাংকিউ মিসেস.তিথি!”

কিছুক্ষণ আলাপ করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে শিশির। অফিস পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে নিজের গাড়ির সামনে দাড়ায় সে। কিছু সময় তাকিয়ে থাকে গাড়িটার দিকে। জীবনের লক্ষ্য ছিলো নিজের বড় একটা অবস্থান তৈরি করবে, সে করেছে। ইচ্ছে ছিলো নিজের একটা গাড়ি হবে, সে কিনেছে। ইচ্ছে ছিলো বড় একটা ফ্লাট কিনবে, সে কিনেছে। ইচ্ছে ছিলো, একাউন্ট ভর্তি টাকা বানাবে, সে বানিয়েছে। জীবনের সব জায়গায় সফলতা অর্জন করেছে সে। কিন্তু, আজকাল মনে হয়, তার জীবনের কোনো অর্থ নেই। নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। হালকা হাসি ফুটে উঠে শিশিরের ঠোঁটে। নিজের অজান্তেই নিজের জীবনের ব্যর্থতার সাথে তার রোজ পরিচয় হয়। এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসে স্টার্ট দেয় শিশির।

সন্ধ্যার নরম আলোয় শহর যেন এক বিশাল উৎসবময় নকশা। ট্রাফিক সিগন্যালের রঙিন আলো, গাড়ির হর্নের শব্দ, মানুষের ভিড় সব কিছু মিশে এক জীবন্ত শহরকে আঁকছে। শিশির নিজেকে এই ঝকঝকে নগরীর এক কোণায় হারিয়ে ফেলতে চায়। অ্যাপার্টমেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করে লিফটে করে নিজ ফ্লোরে এসে পৌছায় শিশির। দরজায় বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় শিথী। শিশির জিজ্ঞেস করে,
–” কখন এসেছিস?”

–” সকালে।”

শিশির জুতো খুলে ঘরে ঢোকার সময় রোহান দৌড়ে এগিয়ে আসে। শিশির রোহানকে একটু আদর করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমে ঢুকতেই শিশির দেখে, ছোয়া কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে। শরীর খারাপ নাকি? দুপুরে যখন কথা হলো তখন তো ছোয়া কিছু বলেনি। শিশির তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে,
–” ছোয়া! কি হয়েছে তোমার?”

ছোয়া মুখ খুললো না। হালকা পিটপিট করে তাকায়। ছোয়ার ফরসা গাল গুলো লাল হয়ে আছে। শিশির ছোয়ার কপালে হাত দিতেই আঁতকে উঠে। প্রচন্ড জ্বর বয়ে যাচ্ছে ছোয়ার শরীর দিয়ে। যেন শরীর ঝলসে দিতে চাইছে।

#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹