#_ঘর_কুটুম_
#_মারিয়া_রশিদ_
#_পর্ব_১৬_
সকালের নরম আলো জানালার পর্দা গলে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশেই ঘুমিয়ে তিতলি। একটানা ঘুমের কারণে তার মুখে একটা স্থিরতা দেখা যায়। কুশান ঘুম থেকে উঠে বসে। শরীরটা কেমন হালকা লাগছে, এক ধরণের মানসিক আরাম যেন ছড়িয়ে আছে ভেতর জুড়ে। বিছানা থেকে নেমে হালকা হামি দিতে দিতে ওয়াশরুমে যায়, ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ঘর পেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে থমকে দাঁড়ায়। রূপন্তি বসে আছে চুপচাপ। মুখ নিচু করে রাখা, হাতে কোনো কাজ নেই। অথচ সে সবসময় ব্যস্ত থাকে কিছু না কিছু নিয়ে। আজ যেন সময় থমকে গেছে তার চারপাশে। চোখের পাতা লালচে ফোলা, স্পষ্ট বোঝা যায়।
কুশানের মনে হয়, কিছু একটা হয়েছে। হঠাৎ একরকম চিন্তিত হয়ে এগিয়ে আসে রূপন্তির দিকে। রূপন্তি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেঝের দিকে। কুশানের পায়ের শব্দে মুখ তোলে সে। সেই চোখে এমন কিছু থাকে, যা কুশান কল্পনাও করেনি। প্রচণ্ড রাগ, বেদনা, ঘৃণা আর অভিমানের বিষাক্ত মিশ্রণ। রুপন্তি উঠে দাড়ায়। কুশান কিছু বলতে যাবে তার আগেই, ঠাস! একটা শক্ত চড় পড়ে কুশানের গালে রূপন্তির হাতে। কুশান হতবাক। মুহূর্তে চারপাশ থেমে যায়। গালে হাত দিয়ে কুশান তাকিয়ে থাকে রূপন্তির দিকে। যেন সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না, এটা বাস্তব না দুঃস্বপ্ন। রূপন্তির ঠোঁট কাঁপে, চোখে জল এসে আটকে থাকে পাতার কিনারায়। তবু সে গড়াতে দেয় না। গলার স্বর ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে জ্বালাময়ী আগুন।
–” ছোট*লোক। চরিত্র*হী*ন। বেই*মান!”
কুশান কিছু বলতে যায়, কিন্তু শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। মুখ খোলা থাকে, কথা আর বেরোয় না। রুপন্তি বলে,
–” তোমার সঙ্গে আজকের পর থেকে আমার সব শেষ। অনেক সহ্য করেছি, অনেক মানিয়ে নিয়েছি, কিন্তু এইটা সম্ভব না।”
কুশান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে তার চোখ চলে যায় টেবিলের ওপরে রাখা নিজের ফোনটার দিকে। রুপন্তি চেচিয়ে বলে ওঠে,
–” গতকাল রাতে আমার কাছে কেন এসেছিলে, কুশান? ফারজানার কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে সেই চাহিদা মেটাতে?”
এই প্রশ্নের উত্তর নেই কুশানের কাছে। মুখটা লাল হয়ে গেছে লজ্জা আর অপমানে। গলা শুকিয়ে আসে।
রূপন্তি কাঁপতে থাকা কণ্ঠে বলে যায়,
–” সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম, তোমার মতো একজন নোংরা, নর্দমার পতঙ্গের মতো মানুষের প্রেমে পড়ে। বিয়ে করেছিলাম। সংসার করেছিলাম। এটা আমার পাপ ছিল, শাস্তি পেয়েছি।”
–” রূপন্তি, প্লিজ! আমার কথাটা শোনো একবার।”
ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলে কুশান।
–” না!”
রূপন্তি থামিয়ে দেয়,
–” তোমার মুখ থেকে আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তোমার শরীরের ক্ষুধা মেটাতে তুমি অন্য নারীর শরীর খোঁজো। তোমার মতো পুরুষের সাথে একটা মেয়ে কিভাবে সংসার করবে বলো? কীসের বিয়ে? কিসের ভালোবাসা? অপমান ছাড়া আমি কিছুই পাইনি এই সম্পর্কে।”
কুশান যেন একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে, যার ওপারে পৌঁছানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেছে।
–” তোমার যদি নেশা করে এসে মারধর করা স্বভাব হতো, তবু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তুমি? তুমি এমন একজন, যে নিজের চাহিদার জন্য ভালোবাসার মুখোশ পরে নারীর শরীর খোঁজো। এটা মানা যায় না।”
–” রূপন্তি!”
কুশানের কণ্ঠে অনুনয়।
–” চুপ!”
রূপন্তি গর্জে ওঠে, কিন্তু সেই গর্জনের ভেতরেও এক ভাঙা হৃদয়ের আর্তনাদ থাকে।
–” আমি তিতলিকে নিয়ে আজই বের হয়ে যাচ্ছি। আজ থেকে আমি আর তোমার স্ত্রী নই। ডিভোর্সের জন্য আবেদন করব খুব দ্রুত। কারণ আমি তোমার মতো একটা নোংরা, নীচ, বেই*মান পুরুষের সঙ্গে আর এক মুহূর্তও থাকবো না।”
এবার সত্যিই কুশান পিছিয়ে আসে একধাপ। যেন তার পায়ের নিচে মাটি নেই।
–” তুমি তিতলিকে নিয়ে যাবে মানে?”
–” হ্যাঁ, নিয়ে যাবো। তিতলি আমার। একটাও কাগজ যদি আদালতে যায়, আমি প্রমাণ করে দেবো তুমি ওর উপযুক্ত বাবা নও। কোর্ট কোনোদিন তিতলিকে তোমার হাতে দেবে না। কতোটা নিচে নামলে মানুষ এতোটা নোংরা হতে পারে, ভাবতেই ঘৃ*ণা লাগে।”
এই বলে রূপন্তি ঘরের দিকে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে কুশান একের পর এক ধাক্কা দেয় দরজায়।
–” রূপন্তি! রূপন্তি, দরজাটা খোলো প্লিজ! আমি ভুল করেছি, জানি, কিন্তু একবার আমার কথা শোনো! তিতলিকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তোমাদের ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না এখন। প্লিজ! রূপন্তি,দরজাটা খোলো। আমাকে একটা সুযোগ দাও।”
কুশান কান্নায় ভেঙে পড়ে। গলায় ঝাঁঝ, বুকের ভেতরটা মোচড়ায়। ভেতরে বসে রূপন্তি কাঁদছে নিঃশব্দে। চোখের জল চোয়ালে গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু সে নীরব। উঠে যায় ওয়্যারড্রোবের দিকে, একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ বের করে। তিতলির কিছু কাপড় গুছিয়ে নেয়, নিজেরও কয়েকটা জামাকাপড়। ঔষধ, কাগজপত্র, তিতলির স্কুলের আইডি কার্ড, সব টুকটাক গুছিয়ে নিতে থাকে।
কুশানের গলা বাইরে থেকে ভেসে আসে।
–” প্লিজ! একটা শেষ সুযোগ দাও, রূপন্তি! আমি সত্যিই বদলে যাবো।”
কিন্তু এখন আর সে শব্দ রূপন্তির মনে কোনো সাড়া জাগায় না। কখনো যে শব্দগুলো ছিল তার বেঁচে থাকার কারণ, আজ সেগুলো কেবলই বাতাসের কম্পন। দরজার ওপর হাতের শব্দগুলো ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। ভেতরে বসে রূপন্তি নিঃশব্দে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিচ্ছে, কিন্তু সে দৃঢ়। আর কোনোভাবে এই ঘরে থাকা সম্ভব নয়। এমন সময় তিতলির ঘুম ভেঙে যায়। ছোট্ট চোখদুটো আধো ঘুমে ভরে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে সে।
–” মাম্মাম! পাপা দলজা থাবায়। তুমি দলজা খুলে দাও।”
মিষ্টি কণ্ঠে বলে মেয়েটি।
রূপন্তি একবার তাকায় তার দিকে। মেয়ে যে কিছুই বুঝে না, সেটাই যেন তাকে আরও ছুরির মতো বিঁধে যায়। কিছু বলে না সে। শুধু গুছিয়ে যেতে থাকে নিজের কাপড়, তিতলির জামা, কিছু নথিপত্র। বাইরে থেকে আবার কুশানের কণ্ঠ,
–” রূপন্তি! দরজাটা খোলো। আমি শপথ করছি, এবার থেকে আমি একদম ভালো হয়ে যাবো।”
তিতলি চুপচাপ শুনছে। তারপর আবার বলে ওঠে,
–” মাম্মাম! পাপা ডাকছে, দলজা খুলে দাও।”
রূপন্তি এবার ধীরে ধীরে তার পাশে গিয়ে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মেয়ের। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু গিলে ফেলে সে। তিতলিকে এই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না, সে জেগে থাকলে কুশানের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া অসম্ভব। এক মুহূর্তের দ্বিধা। তারপর রূপন্তি উঠে গিয়ে ঔষধের বাক্স থেকে কম পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ বের করে আনে। হাত কাঁপছে সামান্য। নিজের মেয়ে, তাকে ঘুম পাড়াতে হবে জোর করে। এমনটা করতে হবে কোনোদিন ভাবেনি সে। কিন্তু আজ আর কোনো উপায় নেই।
রুপন্তি তিতলির কাছে এসে মমতা মেশানো গলায় বলে,
–” আম্মু! এই মেডিসিনটা খেয়ে নাও।”
তিতলি নির্বিকারভাবে ওষুধ খেয়ে নেয়। ছোট্ট মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
–” মাম্মাম! দলজা খুলো। আমি পাপাল কাছে যাবো, পাপা ডাকে তো।”
রূপন্তি শান্ত স্বরে বলে,
–” মাত্র মেডিসিন নিয়েছো, একটু পর যেও, আম্মু।”
কিছুক্ষণ পর তিতলির চোখ আধো হয়ে আসে, তারপর নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ে। রূপন্তি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, চোখের জল মুছে ফেলে। তারপর কোলে তুলে নেয় তিতলিকে। ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই কুশান হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে। মুখে আতঙ্ক আর অনুনয়ের ছাপ।
–” তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো, রূপন্তি?”
রূপন্তির চোখে দহন। ঠান্ডা গলায় বলে,
–” তোমার মেয়ে? কে তোমার মেয়ে? তিতলি একটা পবিত্র শিশু। সে কখনোই তোমার মতো নোংরা, চরিত্র*হী*ন মানুষের মেয়ে হতে পারে না। সে আমার, শুধু আমার।”
কথাগুলো যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কুশানের বুকের ভেতর। সে এগিয়ে আসে, দুহাত জোড় করে বলে ওঠে,
–” রূপন্তি! আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ! আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিও না। আমি বদলে যাবো, সত্যিই বদলে যাবো। শেষ একটা সুযোগ দাও আমাকে।”
রূপন্তি একবার তাকায় তার দিকে। কুশানের মুখে চোখের পানি, অনুতাপের ছাপ। তবু তার ভেতরের কঠিন বরফটুকু গলতে চায় না। সে ধীরে ধীরে বলে,
–” সুযোগ? আমি কি তোমাকে সুযোগ দিইনি? রাতের পর রাত তুমি দেরি করে আসতে, কতবার ভেবেছি তুমি বদলাবে। যদিও আমি ভাবতাম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, কিন্তু তুমি কিনা পরনারীর কাছে যাও। তুমি তোমার নোংরামিকে ভালোবাসো, আমি না। আজ তোমাকে ক্ষমা করলে, আমার নিজের নারীসত্তাকে অপমান করা হবে। তোমার মতো একজনের পাশে থেকে আমি প্রতিদিন নিজের ঘৃণায় মরবো, তুমি সেটা বুঝবে না।”
কুশান ভেঙে পড়ে হাঁটু গেড়ে।
–” রূপন্তি! আমি সত্যিই…”
কথাগুলো শেষ হয় না, কান্নায় ডুবে যায়। রূপন্তি একবার ঘুরে তাকায়, শেষবারের মতো। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু স্থিরতা। সে তিতলিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে দরজার বাইরে পা বাড়ায়। দরজার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো এসে পড়ে কুশানের মুখে। সে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে মেঝেতে।
বুকের ভেতরটা হাহাকারে ভরে যায়। একটা অদ্ভুত শূন্যতা, যেন পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে। তার কান্নার শব্দে ঘরের দেওয়ালও কেঁপে ওঠে। রূপন্তি পেছনে ফিরে তাকায় না। তার পদক্ষেপের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আর কুশান পড়ে থাকে সেই দরজার সামনে। চুলে হাত ঢুকিয়ে, বুক ভেঙে কান্নায় ডুবে।
…
নির্জন এক সন্ধ্যা। শহরের মাঝেই গড়ে ওঠা একটা ছোট্ট কফিশপ। শান্ত, পরিপাটি, মনোমুগ্ধকর সাজসজ্জায় ঘেরা। জানালার ধারে টেবিলে বসে আছে রূপন্তি, ছোয়া আর অরুনিমা। তাদের সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। দূরে প্লে এরিয়ায় খেলছে ছোট্ট তিতলি। চুল এলোমেলো করে খেলে বেড়ানো একরত্তি মেয়ে, যেন এক ঝলক রোদের মতো। এই তিনজন তিন বান্ধবী। একসাথে বেড়ে ওঠা, একসাথে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পার করা, জীবনের প্রতিটি বাঁক একসঙ্গে দেখা। কিন্তু আজ, তারা তিনজন তিনটি ভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছোয়া ধীরে কফিতে চুমুক দিয়ে রূপন্তির দিকে তাকায়। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর প্রশ্ন করে বসে,
–” তাহলে ঠিক করেই ফেলেছিস? ডিভোর্স দিবি?”
রূপন্তির চোখে স্থিরতা, ভেতরে জমে থাকা কঠিন সিদ্ধান্তের ছাপ স্পষ্ট। শান্ত গলায় জবাব দেয়,
–” হ্যাঁ, ছোয়া! আমি ডিভোর্সের জন্য আবেদন করেছি। আর যাই হোক, ওরকম একটা মানুষের সঙ্গে আর থাকা সম্ভব না।”
একটু থেমে যেন নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নেয়, তারপর আবার বলে রুপন্তি,
–” তুই ভেবে দেখ, শিশির ভাইয়ের হরমোনাল সমস্যার জন্য তোর মা হওয়া হয়নি ঠিকই, কিন্তু তবু তুই সংসার ছাড়িসনি। কারণ, শিশির ভাই অন্তত চরিত্রবান। তুই জানিস, ওর মন অন্য কোথাও নেই। আর কুশান? আমার অনুপস্থিতিতে অন্য নারীর কাছে যাওয়া। এমন মানুষের সঙ্গে জীবন কীভাবে কাটাই বল তো?”
ছোয়া চুপ করে যায়। সত্যের সামনে যুক্তির জায়গা ছোট হয়ে আসে। এইবার কথা বলে অরুনিমা। তার কণ্ঠে ছিল কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা চিন্তা,
–” এখন তোর পরিকল্পনা কী?”
রূপন্তি আড়চোখে তিতলির দিকে তাকায়। মেয়েটা নিঃশব্দে খেলছে, কিছুই জানে না মা কী ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
–” বাবার বাড়িতে থাকাও তো সম্ভব না। ওটা আরেক নরক। নিজে ভালোবেসে, পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। এখন সকাল-সন্ধ্যা খোঁটা শুনি। তাই ভাবছি একটা চাকরি খুঁজে বের করতেই হবে। আমার এই মুহূর্তে একটা আয় দরকার। আমি মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই।”
ছোয়া একটু চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর বলে,
–” আজকাল চাকরি পাওয়া খুব কঠিন, তুই জানিসই তো।”
রূপন্তির গলা কাঁপে না, দৃঢ় থাকে,
–” চুপ করে থাকলে হবে না, ছোয়া। আমার মেয়েটা আছে। ওকে মানুষ করতে হবে। নিজের একটা পরিচয় গড়তে হবে। আর কোনোভাবেই বাবার বাড়িতে থাকতে চাই না।”
ছোয়া মাথা হেঁট করে বলে,
–” আচ্ছা! আমি শিশিরের সঙ্গে একটু কথা বলি। যদি কোনো চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে।”
রূপন্তি চোখে কৃতজ্ঞতার ঝিলিক নিয়ে মাথা নাড়ায়। এইবার সে মুখ ঘুরিয়ে অরুনিমার দিকে তাকায়।
–” অরু! তুই আর আরাভ ভাইকে ফিরিয়ে দিস না, প্লিজ।”
অরুনিমা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,
–” আমার এখন ভয় লাগে, রূপন্তি! যদি সেও একদিন বদলে যায়?”
রূপন্তি একটু হেসে ফেলে। সেই হাসির ভেতরে ছিল অভিজ্ঞতার তিক্ততা আর সহমর্মিতার কোমলতা।
–” সবাই একরকম হয় না, পাগলী। আমার জীবনে তিতলি আছে, শক্ত একটা ভিত্তি। ছোয়ার জীবনে শিশির ভাই। কিন্তু তোর? তুই কেন নিজের জীবন থেকে সুখটুকুও সরিয়ে দিবি? এত এড়িয়ে যাচ্ছিস, তবুও আরাভ ভাই তোকে চায়। তাকে একটা সুযোগ দে না একবার, শুধু একটা সুযোগ।”
অরুনিমা কিছু বলে না। চোখের ভেতর অনিশ্চয়তার স্রোত। এই মুহূর্তে ছোয়া হালকা হেসে বলে,
–” তিতলি বিরক্ত করে না?”
রূপন্তির মুখে মায়ামাখা হাসি।
–” করছে, প্রচুর কান্নাকাটি করে। মাঝে মাঝে সামলাতে কষ্ট হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিতলির খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। তিনজনে একসাথে তাকায় মেয়েটার দিকে। সে দোলনায় চড়ে হেসে উঠছে, পাশে অন্য একটা বাচ্চাকে কিছু বলছে।
এক টেবিলে বসে থাকা তিন বান্ধবী, রূপন্তি, ছোয়া, অরুনিমা। তারা একসাথে বড় হয়েছে, একই পথে হেঁটেছে, অথচ এখন তারা তিনটি ভিন্ন পথের যাত্রী।
তিনটি জীবন, তিনটি গল্প। ভালোবাসা, ত্যাগ, অভিমান আর নতুন করে শুরু করার সাহস।
তারা জানে না সামনে কী আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে, কফির ধোঁয়ার মাঝে তারা ভাগ করে নেয় তাদের ভার। আর জানালার ওপাশে, নরম অন্ধকার। খেলার জায়গায় খেলা করে বেড়ায় ছোট্ট তিতলি! একটা ভবিষ্যৎ, যাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় রূপন্তি।
#_চলবে_ইনশাআল্লাহ_🌹