মেহবুব পর্ব-৮+৯

0
4

‎#মেহবুব
‎#তাবাসসুম_তোয়া
‎#পর্বঃ৮+৯

‎ছেলেরা সবাই বাসার পাশের মসজিদে ছিলো। আর আমরা মেয়েরা বাড়িতে। আকদ সম্পন্ন হওয়ার পর যখন খেজুর বিতরন চলছে তখন উনি অনেকটা
‎সিরিয়াস ভঙ্গিতে ফ্লাটে ফিরলেন, এটা দেখে সবার মধ্যেই চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে! সবার একটাই প্রশ্ন

‎” কি সমস্যা জামাই চলে এলো যে। ”

‎আন্টি আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলেন। ডাইনিং এ গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন উনাকে

‎” আব্বা কোন সমস্যা? ইউনিট থেকে কল এসেছে ? ফিরতে বলেছে? ”

‎আমি রুমে বসে এটা শুনেই আমার জান যায় যায়! কি বলে?এবার আমার হার্ট এট্যাক হবে নিশ্চিত! আমার দম বন্ধ হয়ে এলো! নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম!

‎উনি সেই গাম্ভীর্যমাখা চেহারা নিয়ে আমার রুমের দরজার সামনে এসে দাড়াতেই এক এক করে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
‎উনি আন্টিকে বললেন,

‎” আসছি আম্মু এক মিনিট! ”

‎উনার মুখ ভঙ্গি দেখেই আমার কান্না আসলো তার মানে আর্জেন্ট কল এসেছে নিশ্চয়ই! ফিরতে বলেছে উনাকে!

‎উনি ভিতরে ঢুকলেন না, তখনও রিনি আপু আমার পাশে বসে ছিলো, উনি বললেন

‎ ” আপু এক মিনিট, it’s urgent. ”

‎আমি এবার একেবারেই ভেঙেচুরে গেলাম। এতো আর্জেন্ট ব্যাপারটা কি?
‎আমার ভেঙেচুরে কান্না পেলো। কষ্টে হৃদয়টা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
মনটা মানবো না মানবো না বলে বিদ্রোহ করে উঠলো। অন্তরআত্মা সব চিৎকার শুরু করে দিয়েছে।
‎তখনই মন বললো এটা বললেই উনি বলবেন আমি আবারও ফেল করেছি!
‎বহু কষ্টে কান্না আটকে আছি। কাঁদবো না উনি যাই বলুক। সব মেনে নিতে প্রস্তুত!
‎বিদায় জানাতে হলেও হাসি মুখেই জানাবো৷ আমিও উনারই স্ত্রী! উনার মতোই কনক্রিট হবো ইনশাআল্লাহ! কান্না করছি আর মনকে বলছি, বোঝাচ্ছি এগুলো !
‎শুধু ভয় হচ্ছে উনি মোটেও সুস্থ হননি! কিভাবে ফিরবেন কি করবেন? আমি উনার ক্ষত গুলোও দেখতে পেলাম না। আমার এমন কপাল! একবার চোখের দেখাও দেখা হলো না মানুষটাকে! উফফ, আকদ না হতেই এ কেমন বিচ্ছেদ! উফফ কি কঠিন জীবন! মনকে শক্ত করছি!
‎এ জীবন আমি নিজে বরন করেছি! আমি উনার অর্ধাঙ্গিনী আর এভাবেই কাটবে আমার সারাজীবন। আমাকে উনার হিম্মত হতে হবে কখনই উনার প্রতিবন্ধক নয়! আমার চোখ ছলছল হলো কিন্তু কন্ঠ না।

‎রিনি আপু বের হয়ে গেলেন। আমিও বিছানা থেকে নেমে পড়েছি। উনার সামনে এগিয়ে এসেছি৷ অন্তরের কান্না আমার সকল লজ্জা নিয়ে চলে গেছে। আমি বাস্তবে দাড়িয়ে আছি।
‎উনি গেটটা আটকে দিলেন৷ তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে পাঞ্জাবির কটিটা খুলে সোফায় ফেললেন। আমি উনার কর্মকাণ্ড দেখছি আরেকটু পাশে এসে দাড়ালাম। উনার কষ্ট হচ্ছে কি? বুকের ক্ষততে? কেন যে এতো টাইট শেরওয়ানি পড়েছেন উনি! জিজ্ঞাসা করবো কি? আবার এই মোটা কটিটা কেন পরতে হবে। টিশার্ট পরে বিয়ে করতে আসলেও আমি কিছু বলতাম না! কান্নায় কন্ঠরোধ হয়ে গেছে। তবুও কোনমতে জিজ্ঞাসা করলাম,

‎”কোন সমস্যা?”

‎উনি কেমন ঐ বড় বড় চোখের পাপড়ি জোড়া তুলে আমার দিকে তাকালেন! মাথা ঝাকাঁলেন শান্ত ভঙ্গিতে। আমি উনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম উত্তরের আশায়! উনার চোখ কি ছলছল করছে?নাহ, বুঝতে পারলাম না। উনার চোখ কি লাল? তাইতো! আমার অন্তর কেঁপে উঠলো! আমি আবারও চোখের দিকে তাকালাম! উনি বললেন,

‎Yeah, it’s very confessional. it’s a matter of the heart.

‎বলেই হুট আমাকে আগলে নিলেন শক্ত করে৷ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! খানিকক্ষণ, অনেকক্ষণ…..

‎স্তব্ধ হয়েই থাকলাম। তারপর
‎তারপর…. কি হলো কি জানি! আমি খুব করে কান্না শুরু করে দিলাম।

‎আমার অন্তর আগে থেকেই কাঁদছিলো। উনি আগলে নেওয়াতে কান্নারা আর বাধা মানলো না৷ কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে লাগলাম।
আমি একেবারে চুরমার হলাম। আমার কান্নার বেগ যতটা বাড়ছে উনি ঠিক ততটাই শক্ত করে আমাকে আঁকড়ে নিচ্ছেন।
‎ভেঙেচুরে যাচ্ছে আমার হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে জমা থাকা অভিমান কষ্ট ক্ষোভ! সকল অভিযোগ কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে৷ ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হচ্ছে এতো বছরের অপেক্ষার কষ্ট গুলো !
আর আমি অঝোর ধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছি উনার বুক৷

‎আমার জানি না কি হচ্ছিল, শুধু কাঁদছিলাম !
আমার এতো কান্না কোথায় লুকিয়ে ছিলো?
হৃদয়ের কোন প্রকোষ্ঠে?
সারাজনমের কান্না যেন কাঁদলাম আমি। উনি কিচ্ছুটি বললেন না, শুধু আঁকড়ে ধরে থাকলেন আমাকে শক্তভাবে, আরোও শক্তভাবে! মনে হচ্ছিল আমি গুড়ো হয়ে মিশে যাচ্ছি তার সাথে!
‎আমি যখন শান্ত হলাম ঠিক কত মিনিট পর নাকি ঘন্টা, উনি তারও অনেক পরে আমাকে ছাড়লেন! এবার আমার মুখটা তুলে চোখ গুলো মুছিয়ে দিলেন গভীর মমতায়। তারপর বেশ খানিকক্ষণ..

‎অনেকটা সময় পর উনি আমার কানের কাছে বললেন,

” মেহবুব,আমার মেহবুব,
welcome to my life, মেহবুব।”

‎আমি চোখ বন্ধ করে নাজুক হয়ে পড়ে থাকলাম তখনও। আমি সেদিন আরোও একটা বড় সত্য আবিষ্কার করলাম। কনক্রিটের দেয়ালের ওপারে থাকা আহমেদ আল তারিককে! আসলে সে কনক্রিটের আবরনে থাকা নরম তুলতুলে এক সত্তা! সে ছিলো প্রয়োজনে বজ্রের মতো কঠোর আর প্রয়োজনে কুসুমের মতো কোমল!
‎মন বললো আমি তাকে পেয়েছি। পুরোপুরি ভাবেই পেয়েছি। আমি তাকে আরোও অনেক আগেই পেয়েছি। শুধু বৈধতার কাগজ ছিলো না তাই ধরা দেয়নি! না কথায়, না ব্যবহারে! কিছু বিষয় থাকে মনের অতি সংগোপনে। উনিও ছিলেন ঠিক তেমনি!

‎দরজায় এর মধ্যে টোকা পড়েছে কয়েক বার। উনি আমাকে ছেড়ে কটিটা বা হাতের উপর ভাঁজ করে নিয়ে গেট খুলে গটগট পায়ে বের হয়ে গেলেন৷ রিনি আপু দৌড়ে এলো।

‎” কি বললো? ফিরে যেতে হবে? ”

‎আমি চুপচাপ চোখ মুছে মাথা ঝাঁকালাম।

‎”নাহ ”

‎আমার অবস্থা দেখে উনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না।

সবাই একদম মূহুর্তের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল।
পুরো পরিবেশ ঠিক হয়ে গেল। সবার গুঞ্জন থেমে গেল। জামাই ফিরে যাচ্ছে না এর থেকে আনন্দের খবর আর কি হতে পারে।

‎তবে সবাই কেমন মিটিমিটি হাসছিলো। রিনি আপু আমাকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‎”এদিকে আয়, তোর মেকআপ নষ্ট হয়েছে। কাঁদছিলিস খুব?”

‎আমি তখন বুঝলাম সবার হাসির কারন। সিরিয়াসলি তখন আমার এতো লজ্জা লাগছিলো! আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মাটিটা দুই ভাগ হয়ে যাক আমি নেমে যায়! উফফফ!



‎দুই পরিবার মিলে আমি একমাত্র মেয়ে। এজন্য আমার আদর সবসময় বেশিই ছিলো! আব্বুর কলিজা ছিলাম আমি। আমি রাগ করে খাওয়া বন্ধ করলে আমার আব্বুও খাওয়া বন্ধ করে দিতো। আমার সেই বড্ড আদরের বাপ। আমি তাকে ছেড়ে কিভাবে যাবো? এই ঘর, এই পরিচয়,এই মা সব ছেড়ে আমি রওনা দিচ্ছি আরেক ঠিকানা,পরিচয় বরন করতে!
‎আব্বু আমাকে যখন উনার হাতে তুলে দিচ্ছিলো, আমি দেখছিলাম উনার হাত কাঁপছিলো! আব্বু কাঁদছিলো।

‎” আমার বোকা মেয়েটা ওতোকিছু বোঝে না বাবা। ওকে বুঝিয়ে রাখতে হয়। আমার কলিজার টুকরা, আমার মুনিবা। আমার বড় সন্তান! আল্লাহর রহমত হয়ে ও এসেছিলো বাবা আমার জীবনে! এই এটুকু সময় থেকে ওকে কত যত্নে বড় করেছি বাবা, যদি তোমার কখনও মনে হয় ও তোমার কাছে অসহ্য কিংবা তোমার আর ভালো লাগছে না, তখন তুমি আমার মেয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিও। কখনও ভুলেও আঘাত করো না বাবা। না কথা দিয়ে না হাত দিয়ে। আমার অতি যতনের রাজকন্যা! ”

‎শক্ত কঠিন উনাকেও দেখলাম নড়েবড়ে, চোখ লাল। আব্বুর হাতের ওপর হাত রেখে সে বললো,

‎”আব্বু, আপনি আমাকে যে আমানত দিলেন সে আমানতের যথাযথ মূল্যায়ন,সম্মান বজায় রাখবো ইনশাআল্লাহ। আমি ওয়াদা করছি আব্বু আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত এই আমানতকে আগলে রাখবো। আমি বা আমরা যদি কখনও কোন ভুল করি আপনারা গুরুজন আমাদের শুধরে দিবেন। কখনও আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারাবেন না আব্বু। আমাদের জন্য সবসময় দোয়া করবেন। আপনাদের দোয়ায় আমাদের সবচেয়ে বড় পাথেয়। আমরা যেন দেশ ও জাতির জন্য সবসময় বরকতময় হতে পারি! ”

‎আকদ বাড়িতে হলেও অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হলো বাসার পাশের কমিউনিটি সেন্টারে। আকদ শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই সেখানে চলে গেল।
‎আমাদের বিয়েতে কোন ওয়েডিং ফটো শুট হলো না৷ উনার কঠোর নিষেধ। উনি এগুলো পছন্দই করেন না। ছোটখালা শাশুড়ী বললেন।

‎”তোরা ভবিষ্যতের জন্য কোন অ্যালবাম রাখবি না৷ মানুষ তো স্মৃতি জমায় পরে দেখবে বলে। ”

‎উনার কাটকাট উত্তর ছিলো

‎” আমি ওর অ্যালবাম, ও আমার। স্মৃতি দেখতে ইচ্ছে হলে দুজন দুজনকে দেখবো আর অতীত মনে করবো। বাচ্চাদের বসে বসে আমাদের বিয়ের গল্প শোনাবো। ওরা মন দিয়ে আঁকবে সে ছবি। ব্যস হয়ে গেল! ”
‎____________

‎বাপ্পি আম্মুর অনেক কাছের একজন! সে আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলো

‎”আন্টি আপনার শুধু একটা মেয়ে কেন?আর একটা দুইটা হইলে আমার কষ্ট কমে যেত! এ যুগে মেয়ে খুঁজে পাওয়া যে কি কষ্ট!!”

‎আমার শাশুড়ি ওর পিঠ চাপড়ে বললো

‎”কেন বাবা, তুমি কি মেয়ে খুঁজছো? তোমার এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, সে দায়িত্ব আমার! দেখছো না তোমার বড় ভাইও দায়িত্বটাও আমার ছিলো! ”

‎”হ্যাহ, ভাই কত দায়িত্ব তোমার উপর দিয়েছিলো আমার জানা আছে! এটা বাচ্চা মেয়েকে নিজে পছন্দ করে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলো, দেখে রেখো! আমিও কেন একটা বাচ্চা পাইলাম না? ইসস! ”

‎তারপর মুহাইমিনের পিঠে চাপড় দিয়ে বললো

‎”ঐ বেটা তুই মাইয়া হইবার পারলি না! ”

‎তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো

‎”তোরে একটুও ভালো লাগছে না। মুনিবা ভাবীহ! “শেষ শব্দটা কেমন কৌতুক করে বললো!

‎সবাইকে বিদায় দিয়ে,আমার ছোট্ট মুহাইমিনকে সাথে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। মুহাইমিনের সাথে বাপ্পির ভাব সবচেয়ে বেশি। সারাদিন ভাইয়া ভাইয়া বলে ফেনা তোলে!
‎উনি চুপচাপ গম্ভীর, এজন্য বাচ্চাদের সাথে উনার ভাব তেমন জমে না! আমি নিজেই এখনোও যে ব্যাক্তির সাথে ভাব জমাতে পারিনি! বাচ্চারা কেমনে পারবে?

‎বিয়ের পর আন্টি আম্মু হয়ে গেল। আমাকে আম্মুই নিয়ে আসলো। উনি কোথায় জানি না। গাড়িতে উনাকে দেখলাম না। আমাকে রেখে আগে আগে চলে গেছেন কেন জানি না? প্রাইভেটে উঠার পর আম্মু বললো আব্বু মানে শশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এজন্য উনি আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন!

‎সন্ধ্যার সময় যখন প্রাইভেট কারটা সেই স্বপ্নের রাস্তায় ঢুকলো আমি অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম পুরোটা রাস্তা জুড়ে লাইটিং! আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার স্বপ্নে রাস্তাটা ঠিক এমনই ছিলো! সেই চিরচেনা রাস্তা আমার! আমার জীবনের রাস্তা! যেই রাস্তায় আমি হেঁটে গেছি উদ্দেশ্যহীন ভাবেই! শত শত বছর ধরে কত শত বার! যে রাস্তায় এসে থমকে গেছে আমার সকল চেতনা, বিচার বিবেচনা! আমি শুধু জানতাম আমাকে এই পথ ধরেই হাঁটতে হবে। তাই হেঁটে গেছি অবিরত!

‎প্রাইভেট কার থেকে নামতে গেলেই উনি কোথা থেকে উদয় হলেন। সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সবাই চিৎকার দিয়ে বললো

‎” ভাই কোলে নেন ”

‎আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার স্বপ্নের পুরুষ! এ যে এক অন্য মানুষ! পাঞ্জাবিতে কি দারুন লাগছে তাকে! আমার তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হলো! যে পিপাসা আমার মেটেনি কভুও! যে রুপে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম! লোকটা এতো সুন্দর কেন! উফফ। ছেলেদের একটু কম সুন্দর হতে হয়! কিন্তু উনি! অসম্ভব সুন্দর! এজন্য সবাই তাকেই দেখতে থাকে বার বার!
‎উনি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন? ঐ বড় বড় চোখ জোড়ার দৃষ্টি কি ভয়ানক মারাত্মক! সিরিয়াসলি সেটা দৃষ্টি নয় যেন গুলি! পাপড়ি দুটো আগে আস্তে করে তোলেন যেন গুলি তাক করছেন, তারপর ঠাস করে তাকান একদম বুলেট এসে বিদ্ধ হয় অন্তরে! আমি বার বার বিদ্ধ হয় সেই বুলেটে! আমার ইচ্ছে করে চোখ জোড়া হাত দিয়ে ঢেকে রাখি! আমি কখনও সে চোখে তাকাতে পারিনা ! উনি আবারও ইশারায় অনুমতি চাইলেন,

‎আমার ভীষণ লজ্জা লাগলো। চোখ জোড়া নামিয়ে নিলাম! এখানে কত বড় মানুষ আছে। আমি আস্তে করে বললাম

‎”এখানে আম্মু খালা মামারা সবাই আছেন ”

‎উনি বুঝলেন। তাই আর জোর করলেন না। হাত ধরেই স্বাভাবিক ভাবেই নামালেন। আমি নেমে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম!

‎দোতলা বাড়িটার আগাগোড়া লাইটিং করা! এই ভরসন্ধ্যে বেলায় সেটা দেখতে অপূর্ব লাগছে। আমার মানসপটে এঁকে গেল এ কোন অনবদ্য ছবি! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে জীবন দেখতে লাগলাম! আর জীবন আমাকে কি কি দিচ্ছে সেটা!
‎পাশের জন বুঝলো কি আমার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া!
সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো

‎”তোমার স্বপ্নের বাড়ি দেখতে স্বপ্নের মতো হয়েছে? ওহ সরি কলিজার টুকরা বাড়ি! ”

‎আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ বন্ধ করে নিলাম!
‎পাশের বড় হাতের থাবায় আমার হাত হারিয়ে গেল। সে আলতো করে আমার হাতে খেলা করছে আমি টের পাচ্ছি! সে বাড়িতে আমি এর আগেও অনেকবার এসেছি। তবুও আজ একদম অন্যরকম লাগলো। এ বাড়ি আমি চিনি না। ধীর পায়ে হেঁটে নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় থামলাম। সিঁড়ির গোড়ায় তেমন কেউ ছিলো না। সবাই সামনের লাইটিং এর ওখানে ছিলো। শুধু কাজিনরা আমাদের পিছু পিছু আসছিলো। উনি হুট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়! সবাই হোহ হো শব্দ তুলে শিস বাজালো! আমি ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরলাম তাকে, বললাম

‎” আপনি অসুস্থ! ”

‎উনি বললেন

‎” আমি সুস্থ! প্রমান চাই তোমার? ”

‎আমার কান ঝালাফালা হয়ে গেল সে কথায়! চোখ শক্ত করে বন্ধ করে পড়ে থাকলাম। আমি তার ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম! কারো কোলে থাকার অনুভূতি কি ভয়ানক প্রশান্তিদায়ক সেটা স্ট্রংলি অনুভব করলাম! আমি চাইলাম এ প্রশান্তিদায়ক যাত্রার শেষ কখনও না হোক,আমি জগতের সবকিছুর বিনিয়মে শুধু এই জায়গাটাই চাইবো। বার বার চাইবো!! উনি দোতলায় উঠিয়ে নামিয়ে দিলেন। আম্মুর হাতে তুলে দিয়ে আবারও নিচে চলে গেলেন।
‎আম্মু আমাকে আদর করে মিষ্টি মুখ করে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। কতশত আত্মীয় স্বজন এসেছেন। আঙ্কেল মানে আব্বু আজ সকাল থেকেই অসুস্থ। বিকালের দিকে হাসপাতালে এডমিট করানো হলো! এজন্য পুরো বিয়ের দায়িত্ব পড়েছে একা উনার ঘাড়ে। বাপ্পিও দায়িত্ব পালন করছে কোমর বেধে। একফাঁকে আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে

‎” বহু আগে মা দখল করেছিস আজ আবার বড় ভাই! এই তোর ইনটেনশন কি বল? আমাকে ঘর ছাড়া করতে চাস? ”

‎ওর কথায় সবাই হাসলো!
‎উনাকে দেখলাম কাজের ফাঁকে একবার দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললেন

‎” কি বৌ দখল হয়ে গেছে? আমি কি ভাগে পাবো না? ”

‎খালামনি আর মামীরা হেসে উঠলেন। আম্মু উনাকে বললেন,

‎” তোমার বৌ হওয়ার আগে ও আমার মেয়ে! ”

‎” তা মেয়ের জামাইকে রুমে প্রবেশের অনুমতি দিবেন শাশুড়ী আম্মা ? ”

‎সবাই আবারও হেসে উঠলো। কাজিনরা বললো,

‎ “কোন সুযোগ নেই। বৌ পাবেন রাতে। এখন আমাদের দখলে।”

‎উনি সবার দিকে একবার দৃষ্টি বোলাতেই সবাই থেমে গেল। আমি বুঝলাম এরা সবাই আমার দলে,আমার মতোই মানুষটাকে ভয় পায় !
‎উনি আম্মুকে বললেন,

‎”আম্মু এদিকে আসো, মেহমানদের থাকার জন্য নিচের ফ্লাটে এরেঞ্জ করা হয়েছে, যত কাঁথা বালিশ আছে তোমার আলমারিতে সব নিচে পাঠাও।” এসব বলতে বলতে চলে গেলেন দুজনেই।

‎কাজিনরাও গেল। সবার দায়িত্ব আলাদা আলাদা ভাগ করে দেওয়া হলো। বাপ্পি এসে জুনায়েদ আর সাকিবকে বললো

‎ ” তোমরা তোমাদের খালাকে সাহায্য করো।
‎আর মেঝ খালা, সেজ খালা আর মামীরা আপনারা সব মেয়েদের খাবারের ব্যবস্থা করেন৷ ”

‎রাতে খাবারের সময় আম্মু এলেন আমাকে খাওয়াতে। আমার ক্ষুধা ছিলো না মোটেও। এক গাল খেয়েই থেমে গেছি। সে খবর কিভাবে জানি পৌঁছে গেছে উনার কাছে। উনাকে দেখলাম পর্দা ঠেলে চুপচাপ এ রুমে এসে বসলেন সরাসরি আমার সামনের সোফায়।

‎কি সে বসার স্টাইল! পাঞ্জাবির উপরের বোতামটা খুলতে খুলতে সোফায় পিঠ এলিয়ে এক মিনিটের মতো চোখ বন্ধ করে থাকলেন। আমি তাকিয়ে দেখতে থাকলাম। আসলেই ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছে এই অসুস্থ শরীরে। উনি হুট করেই চোখ মেলে তাকালেন। সেই বড় বড় চোখ! আর সেই চাহুনি দেখে আমার খাবার আটকালো গলায়! উনি স্বাভাবিক ভাবে সামনে থাকা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন। আম্মুকে বললেন

‎”এগুলো এখনও কি পরিয়ে রেখেছো? খুলে দাওনি কেন? ”

‎” আরে তুই দেখবি না! ”

‎” দেখলাম তো আবার কি দেখবো। ”

‎তখন খালাম্মা ডাকলেন আম্মুকে। আম্মু উনার দিকে তাকালেন। উনি যেতে ইশারা করলেন। আমি খপ করে আম্মুর হাত চেপে ধরে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলাম। সেটা দেখে দু’জনেই হাসলো। আম্মু বললেন

‎”পাগলি মেয়েটা”

‎তারপর উনার দিকে তাকিয়ে বললেন

‎” আমার মেয়েকে ধামকি দিবেনা। বড় সাধের মেয়ে আমার! আর জোর করবা না যতটুকু পারে খাবে। আবার পরে ক্ষুধা লাগলে খাবে। রাতে তোমাদের রুমে খাবার পাঠাবো। ঠিক আছে? ”

‎আম্মু চলে গেলেন দরজাটা ভেজিয়ে। উনি ঐ সেই চোখ জোড়া তুলে তাকালেন আমার দিকে…..

‎চলবে।