#মেহবুব
#তাবাসসুম_তোয়া
#পর্বঃ১৩ (শেষ পর্বের প্রথমাংশ)
তারপর কেটে গেল কতগুলো দিন,মাস,বছর! আমি সেবার দু সপ্তাহ পর ঢাকায় ফিরলাম। আম্মু রেখে গেলেন। আর উনি?
উনি তো আরোও আগেই আমাকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন উনার ইউনিটে,বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টে।
প্রত্যেকবার ফিরে যাবার সময়ই উনি আমাকে, আম্মুকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়ে যান।
এটা উনার অভ্যাস! আর আমি কেঁদেকেটে একাকার হই! আমি তার থেকে বিদায় নিতে চাইতাম না একটুও। কিন্তু উনি কি মানবেন? উনি খুব সুন্দর ভাবে বলে যেতেন সেই ধারালো কথা গুলো। যেগুলো ক্ষতবিক্ষত করতো আমাকে। আমি চাইতাম সব ছেড়ে ছুড়ে যতদিন বেঁচে আছি তার পাশেই থাকবো, কিন্তু উনি! পাহাড়ি মানুষটা পাহাড়ের মতোই অবিচল!
”পড়াশোনা শেষ করে আমার কাছে এসো।”
কিন্তু এটা যে কেন শেষ হয় না! এতো বছর লাগে পড়াশোনা শেষ হতে! আমি ত্যাক্ত বিরক্ত!
সেবার ফিরলাম তো কিন্তু ফিরলো কি আমার মন? ক্লাস পরীক্ষায় ব্যস্ত সময় কাটালেও আমার মন পড়ে থাকলো বান্দরবানের অফিসার্স মেসের সেই ছোট্ট রুমটিতে! মানুষটা কি করে! মানুষটা কই! শুধু ঐ চোখ জোড়া দেখতে ইচ্ছে হয়! যে চোখ জোড়ায় আমার রাজ্যের জড়তা, লজ্জা! অথচ সামনে না থাকলে বারবার ঐ চোখ জোড়াকেই মিস করি। ঐ ধারালো চাহুনিকে! প্রথম প্রথম তো ভীষণ কাঁদতাম! কেন জানি না, ফোন দিলে যখন কথা বলতে পারতাম না তখন বুঝতেন আমি কাঁদছি! আমাকে শান্ত করতে কত কথা যে বলে যেতেন! সেসব কথা এঁকে যেত আমার মানসপটে!
দেড় মাসের মাথায় যেদিন সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো,ফ্যাকাল্টি বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে নামছি তখনই হাস্যরত উনাকে দেখলাম বিল্ডিংয়ের সামনেই! আমি উন্মাদ হয়ে গেলাম! দ্রুত সিড়ি বেয়ে নেমে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম ঐ সেই পরম আকাঙ্ক্ষার জায়গাটাতে! আমি আবারও কাঁদলাম! উনি বললেন
”এই তো আমি, তবে কেন এই কান্নাকাটি মেহবুব! ”
সেই পড়ন্ত সন্ধ্যায় তেমন কেউ ছিলো না বিল্ডিংয়ের সামনে তবুও তিনি আমাকে নামিয়ে দিলেন। চুপচাপ বললেন,
”পাবলিক স্পেস”
তারপর আমাকে নিয়ে চললেন উনার হোটেলে, যেখানে উনি উঠেছেন! স্বপ্নের মতো কাটলো দুটো দিন! আমাকে খুলনা পৌছে দিয়ে উনি ফিরলেন বান্দরবান।
তারপর মাস ছয় পর উনাকে না জানিয়ে একদিন বান্দরবান চলে গেলাম। ক্যান্টনমেন্টে আমাকে সাহায্য করলেন নির্ঝর ভাইয়া। উনি তখনও কোয়াটার পাননি, নেননি! পরিবার নেই কোয়াটার কেন! অফিসার্স মেসেই থাকতেন। নির্ঝর ভাইয়া আমাকে উনার রুমের চাবি এবং মেস কমান্ডারের কাছ থেকে পারমিশন ম্যানেজ করে দিলেন!
উনি আসার আগে লুকিয়ে থাকলাম, উনি গেট খুলেই যখন আমাকে আবিষ্কার করলেন, পুরো শকড্ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, চোখেমুখে কি অপার বিস্ময় !! আমার স্বপ্নের মানুষটার সেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া রুপটা আমার এত্তো এত্তো ভালো লাগলো!
আমি হেসে চললাম অবিরত! তারপর স্তব্ধতা কাটিয়ে উনি আমাকে তুলে নিয়ে সাঁই সাঁই ঘোরালেন! উনার সেই পাগলা হাওয়ার ভেসে গেলাম আমি! ভেসে গেল দীর্ঘ প্রতিক্ষা!
তারপর কি সুন্দর কয়েকটা দিন। একদম সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখার মতোই। উনি ছুটি নিয়ে আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়, রুমা বগা লেক।
আমি আমার আজন্মকালের সাথীর কেনু আঙ্গুল ধরে ঘুরে বেড়ালাম জীবনের এই পথ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা থেকে শুরু করে পাহাড় নদী গিরিপথ ছাড়িয়ে হাজার হাজার মাইল! উনি উনার এক হাতের সাহায্য আমাকে কোলে নিয়ে হেঁটে গেলেন কতশত রাস্তা! এ পাহাড় থেকে সে পাহাড়! এই ঝর্ণা থেকে ঐ নদী। নিজ হাতে নৌকায় বয়ে নিয়ে চললেন আমার জীবন তরীর অসাধারণ মাঝি!
সেবার সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো হর্স রাইডিং।
আর্মি ইকুয়েস্ট্রিয়ান ক্লাবের সেই স্নিগ্ধ বিকেলটা ছিলো জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিকেল। আমি প্রথমে ভাবতেও পারিনি উনার পরিকল্পনা কি।
যখন একজন সৈনিক একটা উজ্জ্বল বাদামী ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এলো, উনার দিকে রাইডিং হেলমেটটা এগিয়ে দিতেই উনি পরে নিলেন আর ঝাঁপ দিয়ে উঠে পড়লেন বাদামী ঘোড়াটার পিঠে, সেটা দেখেই আমার হুশ উড়ে গেল।
উনি আমার ফ্যাকাসে মুখ দেখে মিষ্টি করে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি ধরলাম না। আমি ভয় পাচ্ছিলাম ভীষণ সাথে উচ্ছ্বাস, নতুন চমক!! বিকেলের নরম সোনালী রোদে চিকচিক করছিলো ঘোড়ার পিঠ! উনি বললেন,
” Don’t’ move, stay right here, I’m coming”
বলেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন ক্লাবের ট্র্যাকে। ঘন গাছপালায় ঘেরা শান্ত শীতল সে ট্র্যাক!
আমি তাকিয়ে দেখলাম,
তেজস্বী সেই নওজোয়ান ঘোড়সওয়ার! যে যুগ যুগ ধরে ছুটে বেড়িয়েছে এই পৃথিবীর আনাচেকানাচে! ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে সকল মিথ্যার দূর্গ সেই নাঙ্গা তলোয়ার হাতেই!
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম আমার স্বপ্নের পুরুষের দিকে! এটা কি সত্যিই উনি? আমার আহমেদ আল তারিক? এ যে একদম ভিন্ন রুপের মানুষ! যে রুপ আমি দেখিনি কখনও!
উনি মূহুর্তেই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন,
আমি দাড়িয়ে থাকলাম দুরুদুরু বুকে, খানিকটা সময় পরই দেখলাম তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম,
সৈনিক বললেন
”ম্যাডাম স্থানচ্যুত হবেন না, ভয় নেই স্যার অনেক দক্ষ।”
বাতাসের বেগে ছুটে আমার সামনে এসে হালকা ঝুঁকে এক লহমায় উঠিয়ে নিলেন আমাকে উনার ডান হাতের সাহায্যে!
আঁকড়ে ধরলেন পরম প্রশান্তির জায়গাটাতে। আমি খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
তারপর,
তারপর…শুধুই ছুটে চলা অবিরত!
আমি যখন ঠিকভাবে বসে উনাকে ধরে নিয়েছি আষ্টেপৃষ্টে তখন উনি ছেড়ে দিলেন আমায়। দুই হাতের সাহায্যে ছুটালেন ঘোড়ার লাগাম! ছুটলেন কত শত মাইল! আমি মুগ্ধ হয়ে, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকলাম। বেশ সময় পর উনি বললেন, সামনে তাকাও, চোখ মেলো, তীব্র বাতাসে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম। বাতাসের তোড়ে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল!
আমি জানি না আমাকে নিয়ে কোথায় ছুটলেন! আমার জানার দরকারও ছিলো না। আমি শুধু জানলাম আমি ভাসছি জীবনের ভেলায়! উড়ছি বাতাসের বেগে!
উনি এভাবে চলতে চলতে আরেকটা কথা বললেন, একজন মেজরকে দেখেছিলেন নিজ স্ত্রীকে এভাবে ঘোড়ায় চড়াতে। সেদিন উনার ইচ্ছা হয়েছিল, আল্লাহ যদি কখনও সুযোগ দেয় তবে আমাকে নিয়েও এমন ভাবে ঘোড়ায় চড়বেন। গতকাল চিম্বুক পাহাড়ের ঘোড়া দেখে উনার সে কথা স্মরণে এলো! আমি বললাম
”যদি আমাদের বিয়ে না হতো? ”
ঐ ধারালো চোখের চাহুনি দিয়ে তাকিয়ে বললেন
”কিভাবে হতো না বলো?
আমি কি তোমাকে অন্য কাউকে হতে দিতাম? ”
আমি সে চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কি আত্মবিশ্বাস!
তারপর চোখের ইশারায় আকাশ দেখিয়ে বললেন
“ঐ দরবারে আর্জি জানিয়ে রেখেছিলাম, উনি কি এই নগন্য বান্দার আর্জি ফেলতেন? ”
আমি বাতাসে ভাসছিলাম আর উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
” আর যদি মারা যেতাম তখন তুমি কি করতে সেটা তোমার ব্যাপার ছিলো!”
আমি আবারও কাঁদলাম! উনি আমার সে চোখের পানি ঝরতে দিলেন না! কি করলেন সেটা বলা যাবে না। উনি আমাকে নিয়ে চললেন পাহাড় পেরিয়ে অন্য পাহাড়ে। পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে নামার সময় ভীষণ ভয় লাগছিলো আমার। উনি আগলে নিলেন শক্ত করে,
” আমি আছি তো ”
জীবনের এতো রং,রুপ,সতেজতা, প্রানবন্ততা! টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে ছুটে চলার মধ্যে যে কি ছিলো! আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমি অন্ততকাল ধরে যেন এটারই প্রতীক্ষায় ছিলাম! এই জীবনের! উনি আমাকে জীবনের সকল বৈচিত্র্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন! সকল আনন্দের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে দিলেন! আমার সে উচ্ছ্বাসে উনি হলেন বিস্মিত! আমি বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলাম!
জীবনের এতো আনন্দ! আল্লাহর সৃষ্টির কি অপার সৌন্দর্য্য, মহিমা। সবকিছু ভরিয়ে দিলো আমার জীবনের প্রতিটি কোণা!
আমরা দুজন নতশির নগন্য বান্দা সন্তুষ্ট চিত্তে সিজদাবনত পড়ে থাকলাম মহান রবের দরবারে!
‘আমাদেরকে আপনার করুনা থেকে কখনও নিরাশ করবেন না। কখনও মুখ ফিরিয়ে নিবেন না।’
বান্দরবন ট্রিপটা ছিল একরকমের অঘোষিত হানিমুন! আমি তাকে সারপ্রাইজ করতে এসে নিজে সারপ্রাইজড হয়ে ফিরে এলাম!
তবে সাবধান করলেন তাকে না জানিয়ে এতো বড় পদক্ষেপ আর কখনও যেন নেওয়া না হয়!
প্রত্যেকবার যখনই উনার সাথে দেখা হয় আমার কাছে মনে হয় ‘এ আমার নতুন বিয়ে!’
আমরা সবসময় থেকে গেলাম নিউলি ম্যারেড ক্যাপল!
এতোকিছুর মাঝে আমাদের যে ঝামেলা হয় না তা নয়। আমি তো এখন বেশ বিদ্রোহী! উনার মতে! মাঝে মাঝেই নাকি বিদ্রোহ ঘোষণা করি! তবে
প্রত্যেকবার পরাস্ত হই সেই দৃষ্টির কাছে! সেই বড় বড় অপরিসীম সুন্দর দুটো চোখ! উনিও যেন জানেন কিভাবে আমাকে পরাস্ত করতে হবে। যখন আর আমার সাথে পারেন না, তখন চুপচাপ আমার দুহাত চেপে ধরে সামনে বসে পড়েন! তারপর ঐ ভয়ংকর চোখ জোড়া দিয়ে তাকিয়ে থাকলেই আমি কুপোকাত !!
এখনও প্রতিবারই সেই লুকোচুরি খেলি! প্রথম প্রথম ভীষণ লজ্জা পেয়ে লুকোতাম কিন্তু যখন লজ্জা অনেকটা কমে গেছে, তখনও লুকায় কারন উনি ব্যাপারটা ভীষণ পছন্দ করেন। উনি খুঁজে হয়রান হন। কারন এখন আর আমি সেই অবোধ বালিকা নই! আমি এখন মেজরের স্ত্রী! বুদ্ধি বেড়েছে সাথে কর্মদক্ষতাও! এখন আমাকে খুঁজে পেতে তার বেশ বেগ পেতে হয়!
আমি উনার পছন্দের লিস্ট মুখস্থ করে ফেলেছি। প্রত্যেকবার সব গুলো কাজ আমি রিপিট করি! উনার মুখের ঐ তৃপ্তির হাসি দেখার জন্য! উনার মুখের ঐ প্রশান্তি হওয়ার জন্য!
প্রত্যেকবার আমি তাকে একটা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করতাম সে বুঝতে চাইতো না কখনই! এবং সে ব্যাপারে কথা বলতেও পছন্দ করতো না! একদম মিউট হয়ে থাকতো! বার বার আমার আকুতি তার কাছে প্রত্যাখ্যাত হতো!
কিন্তু প্রত্যেকবার বিদায় নেওয়ার সময় উনি যে কথা গুলো বলতেন তখন আমার মনে হতো আমার হাতে সময় কত কম! কিংবা আমার হাতে আর কোনদিনই সুযোগ আসবে না! আর তাই আমিও একবার করলাম বড় পাগলামি তাকে বুঝতে দিলাম না মোটেও! কিন্তু যখন সত্য প্রকাশিত হলো!
উনি ছুটে এলেন বান্দরবান থেকে একদম উদ্ভ্রান্তের মতোই!
সেইবার মাস খানেক পার হয়েছিল আমাকে হলে রেখে উনি ফিরেছেন। একদিন সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম। সানি জ্যোতিরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। আম্মুকে ফোন দিলো,ফোন পেয়েই আম্মু যেন উড়ে এলেন! এই দিনের প্রতিক্ষায় যেন উনি ছিলেন। ডাক্তার বললো
” প্রেসার ডাউন হয়ে সেন্সলেস”
তারপরও কিছু টেস্ট দিলো। টেস্টে ধরা পড়লো সেই সত্যিটা। আম্মু উনাকে কিচ্ছুটি বললেন না। কারন আম্মুও জানতেন উনি শুনলে খবর আছে! কারন একটাই!
আম্মু আমাকে খুলনা নিয়ে চলে এলেন। সেদিন রাতে যখন আমি আম্মুর রুমে এলাম, আম্মু ভিডিও কলে কথা বলছিলেন উনার সাথে,আমি বেখেয়ালে উনার ভিডিওর রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়লাম, আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
” ও এখানে কেন? কবে গেল? ক্লাস চলে না? কালকেও তো কথা হলো? ”
”একটু অসুস্থ বাবা, তাই নিয়ে আসলাম, হলের খাবার খেতে পারে না, তাই একটু যত্ন আত্তি করে পাঠাবো! ”
বাপ্পি লুকোচুরির ব্যাপারটা জানতো না,সে কোথা থেকে উড়ে এসে তখন বাড়িতে ঢুকেছে। ভাইকে দেখেই বলে ফেললো
” ভাইয়া চাচা হচ্ছি, আনন্দে তো আমার নাচতে ইচ্ছে করছে! তুমি এখনও ওখানে কিভাবে? ”
ব্যস একটা কথা! তারপর সব ঠান্ডা! আম্মু বাপ্পির পিঠে দিলেন এক ঘা! আমি একপাশ থেকে উনার থমথমে চেহারা দেখছি!
উনি শুধু আম্মুকে একবার জিজ্ঞাসা করলেন।
” আম্মু কথাটা সত্যি? ”
আম্মু আমতাআমতা করে বললেন,
”আলহামদুলিল্লাহ আব্বু, আলহামদুলিল্লাহ পড়ো।”
উনি খট করে ফোনটা কেটে দিলেন।
পরদিন ভোরেই পৌঁছে গেলেন খুলনা! বলতে গেলে ছুটে এলেন বান্দরবান থেকে একদম উদ্ভ্রান্তের মতোই!
তারপর ড্রয়িং-এর সোফায় এসে বসে থাকলেন চুপচাপ। চেঞ্জ অব্দি করলেন না। আম্মু শরবত দিলেন, সেটাও খেলেন না। বসে থাকলেন চুপচাপ। আম্মু ছেলেকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলেন
” হবু বাবা মিষ্টি বাদে বাসায় ফিরেছে! এটা কোন কথা!”
উনি আম্মুর দিকে এমন ভাবে তাকালেন! আম্মু আর কিচ্ছুটি বললেন না। রুমে চলে গেলেন। আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম!
উনি ক্ষেপেছেন খুব! পুরোটাই আমার পাগলামি!
উনার ভয় আমাকে নিয়ে! আমার ওয়েট গেইন করা নিয়ে! এতো খায় সব খাবার কই যায়!
উনি বলেন ‘ এতো ক্যাডেট মানুষ করলাম আর স্ত্রীর ওয়েট গেইন করাতে পারলাম না! ‘
উনি বলেছিলেন অনার্স শেষ হোক আমিও ঢাকাতে আসি তারপর দেখা যাবে। কিন্তু আমি তা মানি নাই!
পুরো একটা সকাল ড্রয়িংরুমে বসে থেকে রুমে আসলেন। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। উনি আমার পাশে এসেই শক্ত করে আমাকে আগলে নিলেন সেই প্রথম দিনের মতোই! মাত্র কিছুক্ষণ! আজ আমার কান্না পেলো না। পেলাম ভয়। তখন আমার মনে হলো সিদ্ধান্তটা আসলেই হঠকারী হয়েছে। উনার অনুমতির প্রয়োজন ছিলো! তারপর আমার হাত ধরে আম্মুর রুমে নিয়ে আম্মুর হাতে দিয়ে বললেন,
” তোমার মেয়ে যেন আমার সামনে না আসে! কি করে বসবো বুঝতে পারছি না! ”
আগামী পর্বে সমাপ্ত ….
#মেহবুব
#তাবাসসুম_তোয়া
#পর্বঃ১৩ ( শেষ পর্বের বর্ধিতাংশ)
দুপুরে খেতে বসেছি উনি গিয়ে সোফায় বসেছেন। চুপচাপ দেখেছেন ঠিকমতো খাচ্ছি কিনা! তারপর সারাদিন আম্মুর রুমেই ঘুমিয়ে ছিলাম। শরীর ভীষণ ক্লান্ত আমার! রাতের দিকে রুমে গেছি।
কিছু বললেন না। সেটা দেখে সাহস বেড়ে গেল। উঠে কাছে এগিয়ে গিয়ে উনার সামনে দাড়িয়েছি!মানুষটাকে দেখছি অথচ একবারও ছুতে পারছি না! এটা কোন কথা! উনি সরে গিয়ে ডাকলেন
” আম্মু তোমার মেয়ে এই রুমে কেন? নিয়ে যাও সামনে থেকে! ”
আমি গেলাম না, আম্মুও আসলো না। কারন আমি নিষেধ করেছি। আমার লড়াই আর কত উনি লড়বেন। তাই আমিই চেষ্টা করি! উনি কিছুক্ষণ পর রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সেই যে এসেছেন,একটাবার চোখ তুলে তাকাননি! একবারও না!
আমিও রুম থেকে বেরুলাম পিছু পিছু! উনি বাপ্পির রুমে গেলেন। আমিও। বাপ্পি বেচারা ইশারায় শুধালো
” আমি কই যাবো?”
উনি বের হয়ে ছাদ গেলেন। আমিও! পিছু পিছু ঘুরতে সেই আনন্দ লাগছে! শুধু ভয় লাগছে যদি ধামকি দেয়! উনার রাগ সম্পর্কে আমার ততদিনে বহুত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তবে এবার আনন্দের ব্যাপার এই যে আমি যাই করি উনি কিচ্ছু বলবেন না। কারন আমি অসুস্থ। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি!
ছাদে বসে বসে বোর হচ্ছিলাম! কিচেনে এসে কফি বানিয়ে নিলাম। উনার পছন্দের। গিয়ে দেখি কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছেন। সামনে কফিটা এগিয়ে দিতেই এমন রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তাকালেন!
আমার অন্তরআত্মা খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে গেল! সেই ভয়ংকর দৃষ্টি! আসার পর প্রথম দৃষ্টি দিলেন তবুও এতো ভয়ংকর! উনি রেগে গেলে কিংবা কষ্ট পেলে চোখের শিরাগুলো লাল হয়ে উঠে! আমার এবার কান্না পেলো! আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম! উনি টের পলেন তবুও এলেন না। আমি বিছানার গিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়েছি৷
খানিকক্ষণ পর টের পেলাম বালিশটা কেউ সরিয়ে দিলো। আমি চোখ খুললাম না৷ উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ! সেটা টের পেলাম
” হয়তো এটাই ভাবছেন নিজের সেই পিচ্চি স্ত্রী এতোটা অবাধ্য হয় কিভাবে?”
কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পায়নি। সকালে উনাকে পেলাম না হয়তো মর্নিং ওয়াকে গেছেন!
ফিরলেন মারিয়া আপুকে সাথে নিয়ে। উনি ডাক্তার। আমার সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমার ডায়েট চার্ট কেমন হওয়া উচিত! আমার কি কি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সব আলোচনা করলেন। আপু উনাকে আশ্বস্ত করলেন
” সব ঠিক আছে, ওয়েটটা বাড়াতে হবে, এতো চিন্তা করোনা,সমস্যা হবে না আশা রাখছি, শুধু খেয়াল রাখো ঠিক মতো খায় কিনা! ”
সকাল পেরুল, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে উনি কিচ্ছুটি বলছেন না! আমার আর ভালো লাগলো না। মানুষটা এমন করলে কেমন লাগে! সরি বলেছি হাজার বার, জড়িয়ে ধরতে গেছি হাজারবার! বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন! উনি কাবাড থেকে কাপড় নামাচ্ছিলেন, আমি এগিয়ে গিয়ে আমার থ্রি পিস নামাতে গেলাম, ওমনি মাথাটা ঘুরে উঠলো।
কাবাডে হেলান দেওয়ার আগেই উনি ধরলেন। একটু মাথা ঘুরে উঠেছিল কিন্তু উনি ধরাতে ইচ্ছাকৃত কিছুক্ষণ উনার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উনি আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন৷ আমি নিশ্চিত!
আমি উনার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দেখে হেসে ফেললাম। উনি আমার ডান গালটা দু’আঙুল দিয়ে চিমটি দিয়ে ধরলেন বেশ জোরে! ধরেই থাকলেন! সত্যি ব্যথা পাচ্ছিলাম। আমার গাল লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি! কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বললাম
“আমি অসুস্থ আমাকে মারছেন?”
উনি চোখের দৃষ্টিকে গাঢ় করে বললেন
”এতোটা অবাধ্য তুমি কি করে হতে পারো মুনিবা? সময় চলে যাচ্ছিল?নিজের দিকে তাকিয়েছ কখনও? ”
আমি মাথা নাড়ালাম ” হু ”
উনি বিরক্তিমাখা ভ্রু দিয়ে বললেন
” হুউ? ”
” হু, এই যে আপনার সময় গুলো এতো মহামূল্যবান, দেড়’দিন পেরিয়ে গেল আপনি একবারও ভালবাসলেন না! এত সুন্দর একটা খবর দিলাম তবুও! থাকবেন আর একদিন! তাহলে কি সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না? ”
উনি হতাশ হয়ে ছেড়ে দিলেন!
” এখন কি সত্যিই মাথা ঘুরেছিলো? ”
আমি বললাম
”একটুখানি! ”
” এই শরীর নিয়ে তুমি কি করবা আমি ভাবতেই পারছি না! মাথা ভারী হয়ে আছে! আব্বু আমাকে জেলে পাঠাবেন নিশ্চিত!”
”আপনি জানেনই না,আব্বু নাতি নাতনির নাম ঠিক করা শুরু করে দিয়েছেন! খুশিতে কয়েকটা ডিগবাজীও দিয়েছেন নিশ্চিত!”
উনি কেমন অদ্ভুত চোখ তাকালেন! কটমট দৃষ্টি! একদম খেয়ে ফেলবেন!
” তোমার পানিশমেন্ট তোলা থাকলো মিসেস তারিক। সুস্থ হওয়ার পর অবশ্যই পাওনা পরিশোধ করা হবে। ”
আমি মনে মনে বললাম ‘ ততদিনে ভুলে যাবেন ‘
উনি আমার চোখের হাসি দেখে বুঝলেন মনে হয়, বললেন
”হাসবেন না, তারিক এতো সহজে পানিশমেন্টের কথা ভোলে না ”
___________________
অসুস্থ আমি বহু কষ্ট সেবার তাকে মানালাম।তিনদিনের ছুটিতে ছিলেন!
আমাদের রেখে ফিরলেন। আমি খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর ডমেস্টিক ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছালাম!যশোর টু ঢাকা। প্রেগন্যান্সির জন্য প্লেনেও চড়তে পারলাম! সেই আনন্দে সকল কষ্ট উবে গেল! জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি!
বকশীবাজারের শিক্ষা বোর্ডের পাশেই একটা ভালো ফ্লাট দেখেছে বাপ্পি, সেখানেই উঠলাম। ঢাবিতে যাওয়া আসা সুবিধা হবে। আম্মু আমাকে একা ছাড়লেন না। এজন্য আমার দুই আম্মু কিছুদিন পর পর আমাকে সঙ্গ দিলেন।
উনি ফিরেই আগে বদলির এপ্লাই করেছিলেন। ঢাকা আসবেন। আমার সাথে থাকবেন। বহুত হয়েছে দূরে থাকা! আমাকে আর একা ছাড়বেন না অফিসার!
সেই বদলির অর্ডার মঞ্জুর হলো এক মাসের মাথায়।স্ত্রী অসুস্থ এজন্য ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি হলো। রিলিভ অর্ডার হাতে পাওয়ার পর ইউনিটের সকল কাজ হ্যান্ডওভার করে ফিরলেন ঢাকা। উনি এসেই কয়েকদিন থাকলেন সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে। সেখানে এক সপ্তাহ কাটিয়ে কোয়াটার এলটমেন্টের জন্য এপ্লাই করলেন। কিন্তু সেখান থেকে জানালো হলো ৩/৪ মাস লাগতে পারে।
তখন উপায় না পেয়ে লিভিং আউটের পারমিশন চাইলেন। আমার জন্য সহজেই সেটাও মঞ্জুর হলো।তবে বকশীবাজারের এদিকে থাকার অনুমতি নেই! ডিওএইচএস বারিধারার দিকে থাকার অনুমতি আছে। সুন্দর দেখে একটা ফ্লাট নেওয়া হলো। আমি অসুস্থ ছিলাম বলেই হয়তো প্রথম প্রথম লিফট ব্যবহার করতে গিয়ে মাথা ঘুরতো। উনি আমাকে শক্ত করে ধরে থাকতেন। পরে সেটা ঠিক হয়ে গেল।
বারিধারার সেই ফ্লাটে শুরু হলো আমার নতুন সংসার! ছোট খাটো সকল জিনিস তিনি নিজ হাতে কিনলেন। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম একজন দায়িত্বশীল পুরুষকে। সে জানে একটা সংসারে কি কি লাগে? আমি অসুস্থ তাই একদিনও বের হতে পারিনি। উনি আম্মুকে আমার কাছে রেখে সব গোছালেন।
আমাদের যখন একসাথে সংসার হলো তখন আমার তিনমাস পার হয়েছে ।
একটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে উনি একদম চেঞ্জ হয়ে গেলেন। যে উনাকে আমি চিনতাম উনি সেটা নন একবিন্দুও। উনি এখন আমার সব বিষয়ে খুব সেনসেটিভ! আর আমাকে নিয়ে তার রাজ্যের ভয়! এতো দিনের ড্যাম নির্বিকার ব্যাপারটা আর থাকলো না। আমি একটু অসুস্থ হলেই খুব সর্তক হয়ে যান যেন! প্রতিটি পদক্ষেপ খুব মেপে মেপে ফেলেন। ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট চলে অনবরত। আমার ভীষণ বমি হচ্ছে সে সময়। খেতেই পারছি না৷ সে যেন অস্থির হয়ে উঠছে ভিতরে ভিতরে কিন্তু আমাকে বুঝতে দিতে চান না। কিন্তু ততদিনে তাকে আমি বেশ ভালো মতোই পড়া শিখে গেছি! তার প্রতিটি ব্যাপার ধরতে পারি এমনকি দৃষ্টিও!
মেজর ডাক্তার দিনা ম্যামের কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়েট দুই মাসে বেড়েছে এক কেজি। এতো সেবা যত্নের পরও! আগে ছিলাম ৪২ এখন ৪৩। আমার ওজন কখনও ৪২ থেকে বাড়তেই চাই না! এত গুলো বছর ধরে আমার ওজন হয়তো ৪২ এর ঘরেই।
ডাক্তাররা তবুও অভয় দিলেন। বমি হলে সমস্যা নাই খেতে হবে। এবং খেতেই হবে। ঠিক কি পরিমাণ কষ্ট আমি করেছি সেই সময়টাতে। খাবারের কোন গন্ধ সহ্য করতেই পারতাম না। কিচেনে দরজা ছিলো না তাই সব ঘ্রান ঘরে আসতো। উনি এটা টের পাওয়া মাত্রই মিস্ত্রি ঢেকে কিচেনে থাই গ্লাস লাগিয়ে দিলেন। গ্যাসের চুলার উপর কিচেন হুড বসালেন। আম্মু আমাকে রান্নাঘরেই যেতে দেয় না। রান্নার সময় দরজা আটকানো থাকে, সাথে চলে কিচেন চিমনি। যার কারনে সেই ঘ্রান আর আমাকে কষ্ট দিলো না। আমি শুধু একটা জিনিস খেতে পারতাম। সেটা খেজুর। উনি আমাকে সকালে উঠিয়ে আগে পানি তারপর খেজুর দিতেন। আমার মরিয়ম আর আজওয়া খেজুরটা পছন্দ ছিলো৷ মরিয়মটা কড়কড় করে খাওয়া যায় তাই সবসময় কিছু চিবাতে ভালো লাগতো!
আর উনি সবসময় সেটা বাসায় রাখতেন। চোখের সামনে রাখতেন। যেন উঠে নিতে পারি। আমার কষ্ট দেখে উনার চেহারা যে এতোখানি হয়ে যেত টের পেতাম। একদিন মাঝ রাতের দিকে ঘুমিয়েছি, ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ বমি। আমি উঠেই দেখি উনি নামাজে, দৌড়ে বাথরুমে গেছি উনিও দ্রুত সালাম ফিরিয়ে আমার পিছনে পিছনে গেছেন।বমির সময় আমাকে ধরে থাকতেন। রুম সবসময় উনি নিজ হাতে পরিষ্কার করতেন!
এমন কত রাত তাকে দেখতাম আল্লাহ দরবারে ধর্না দিতে। কখনও কখনও আমাকে নিয়েই দাড়িয়ে যেতেন। বলতেন “অসুস্থ মানুষের দোয়া কবুল হয়, আসো দোয়া করি। ”
একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠেই উনি আমাকে খুঁজছেন, আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। বের হতেই উনার কেমন তটস্থ চেহারা। আমি বললাম
” কি হয়েছে? আপনার বাচ্চা কি আমাকে দুদন্ড ঘুমাতে দেয়!আমার বড্ড ইচ্ছে করে হাত পা মেলিয়া সারাদিন সারারাত সারামাস, সারাবছর ঘুমিয়ে থাকি! ”
উনি রাগ করলেন মনে হলো!
”কি আশ্চর্য! তুমি সারা বছর কেন ঘুমাবো! যতসব পাগলামি কথা! আসো তো ”
আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম। জিজ্ঞাসা করলাম
” খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন ”
উনি আমাকে আঁকড়ে নিয়ে বললেন
” সকল খারাপ থেকে আল্লাহ আমার স্ত্রী আর সন্তানকে দূরে রাখুন! ”
কি যে কষ্টের গেল সেই মাস গুলো! তবে শেষের দিকে অবশ্য ওতো কষ্ট হয়নি। তখন স্বাভাবিক হতে পেরেছি। সবরকমের খাবার টুকটাক খেতে পারি! যেটা খেতে পারি সেটা হাজির হতো!
______________________
চার মাসের মাথায় প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়েছি। শুয়েছিলাম সেই বেডটাতে কখন থেকে আর সনোলজিস্ট প্রোবটা ঘুরিয়েই চলেছেন খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে। আমার ভয় হচ্ছে ভীষণ! উনি বলছেন!
“ইসস! একটার মধ্যে আরেকটার পা জড়িয়ে যাচ্ছে! ”
আমি অবাক হয়ে শুধালাম
” আপু কোন সমস্যা? ”
উনি বললেন
” হ্যাঁ, ঠিকমতো সনাক্ত করতে দিচ্ছেই না এরা দুজন। একটার মধ্যে আরেকটা জড়িয়ে আছে! ”
আমি সাত আসমান থেকে পড়লাম! বললাম
” টুইন বেবি! ”
উনি বললেন
”কেন আগে জানতেন না! এটাই প্রথম আল্ট্রা ? ”
আমি মাথা নাড়ালাম,
”জ্বি ”
আমি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ছি আর আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমার স্বপ্ন ছিলো টুইন বেবির। আমি মোবাইলে টুইন বেবি দেখলেই বার বার দেখতাম। আল্লাহর কাছে চাইতাম আর সত্যি সত্যিই আমার টুইন আসছে! নার্স আমার চোখে পানি দেখে শুধালো
” কোন সমস্যা? ”
আমি বললাম
” না। ”
শুধালাম ” বাচ্চারা ঠিক আছে? ”
” হ্যাঁ তবে খুব চঞ্চল! একদম শান্ত হচ্ছে না! আমাকে ঠিকভাবে দেখতেই দিচ্ছে না! ”
আমি মনে মনে ভাবলাম, শান্ত গম্ভীর মানুষের বাচ্চা চঞ্চল হয় কেমনে! তাইলে এই দুটো আমার একার বাচ্চা! বাচ্চাদের বাবা বকবে এখন তিনজনকে! আমি কল্পনা করছি
উনি তিনজনকে এক লাইনে দাড় করিয়ে শাসাচ্ছেন, উনার হাতে ইয়া লম্বা লাঠি,
“এই তোমরা স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারো না কোন সময়! সবসময় ছুটোছুটি! ”
যখন সনোগ্রাফি রুম থেকে বের হচ্ছি তখনও হয়তো আমার চোখ ভেজা ছিলো। উনি খেয়াল করেছেন। এগিয়ে আসতে চাইলেন কিন্তু সব মহিলা পেসেন্ট, আমি ইশারায় থামতে বললাম। আমাকে দেখে উনার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
ভীড় ঠেলে বের হতেই আগলে নিলেন। বললেন
” কাঁদছো কেন? কোন সমস্যা? ”
আমি চোখ উচিয়ে উনার লাল হয়ে যাওয়া চোখের শিরা দেখছি! উনিও ভয় পাচ্ছেন! মনে হয়।এমনিতেই আমাকে নিয়ে তটস্থ থাকেন!
আমি চোখ মুছে বললাম
” গেজ করেন? ”
” কি গেজ করবো? বলো কি সমস্যা? ”
” সমস্যা নয় সুসংবাদ। ধারনা করেন, সংবাদটা কি?”
খুশিতে উনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো! বললেন
” আমার মেয়ে হবে? ”
আমি বললাম
”এখনও সেটা বোঝা যায়না, পাঁচ মাসের পর বোঝা যাবে! ইস! মেয়ের বাপ হবার কত শখ! ”
উনি ভাবলেন৷ তারপর অধৈর্য হয়ে বললেন
” বলো না, চিন্তা হচ্ছে! ”
আমি হাতের দুটি আঙুল তুলে দেখালাম। প্রথমে বোঝেননি প্রখর মেধাবী মানুষটা। পরক্ষনেই চমকে তাকালেন! প্রচন্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন
”টুইন”
আমি মাথা ঝাকাতেই ঝুপ করে আমাকে আঁকড়ে ধরলেন এতো মানুষের মাঝে! আমিও ভেজা চোখে উনার উল্লাসে দেখলাম, তবে আমার মনে হলো আচ্ছা এটা পাবলিক স্পেস না? এতো মানুষের মাঝে আগলে নিলে সম্মান যায় না।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম মানুষটার পাগলামি! যখন ছাড়লেন তখন দেখলাম উনার চোখ চিকচিক করছে। তারপর বললো চলো। ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে ফিরতি পথে উনি হাসপাতালে মসজিদের ওয়েটিং স্পেসে আমাকে বসিয়ে বললো,
” কিছুক্ষণ বসো আমি আসছি।”
উনি ভিতরে গেলেন। আমি বাইরে টুকটুক করে হাটাহাটি করছি। মসদিজের দরজায় সামনে আসতেই তাকে দেখতে পেলাম। উনি সিজদায় পড়ে! উনার দেহ দুলছে অবিরত!
বাসায় ফিরে এই নিউজে সবাই পাগল হয়ে গেল ! দুই দুইটা বাচ্চা বংশে প্রথম! আমাদের বংশ, উনার বংশ কোথাও নেই! বাপ্পি যে কি করবে বুঝতে পারছে না! আনন্দে আত্মহারা! আনন্দের ঠেলায় একবার একে ফোন দেয় আরেকবার অন্যকে! ও সবসময়ই আমাদের এখানে যায় আসে! ও আমার কাছে এসে বললো,
” মুনিবা ভাবীহ, তোর সব কসুর মাফ! এতোবছর জ্বালিয়েছিস সবটার! মা নিয়েছিস, ভাই নিয়েছিস সবটার! ”
আমি চোখ উল্টে বললাম
” মাফ চাইছি তোর কাছে? বরং তুই মাফ চা!ছোটবেলা থেকে যা করেছিস আমার সাথে! ”
উনার চোখ গরমে থামলাম আমরা দুজন।খাবার সময়ে আমি আম্মুকে মুখ ফসকে বলে ফেললাম
” বাচ্চা দুটো খুব চঞ্চল! ডাক্তার বলছিল খুব নড়ছে একটার ঠ্যাং আরেকটার মধ্যে ঢুকায় দেয় খালি! তাই আলাদা করে পুরোটা পরীক্ষা করতে অনেক টাইম লাগলো! ”
উনি কেমন করে তাকালেন।
” আমার বাচ্চাদের চঞ্চল বলে! দাড়াও আজই ঐ সনোলজিস্টের চাকরি যাবে! ”
সাত মাসের সময় যখন জানলাম এক ছেলে এক মেয়ে তখন উনার আনন্দ আর দেখে কে?সত্যি সত্যিই উনি মেয়ের বাপ হচ্ছেন এটা যেন উনি কল্পনাও করতে পারেননি! সারাদিন আমার মেয়ে এটা খাবে আমার মেয়ে ওটা খাবে, ঐ দেখো আমার মেয়ে আমার মতোই খাদক,এগুলো খাও তো।
বাপ্পি তো তাদের নাম ঠিক করে ফেললো,তাহিয়া – তাহসিন। উনি শুনে বললেন,
”ছেলের নামটা মায়ের সাথে মিলিয়ে রাখো। ”
আমি বললাম,
” এটাই ভালো। তবে দুটো নামই মায়ের সাথে মিলালে ভালো,কারন যে চাই নি তাকে তো ভাগ দেওয়া ঠিক নয়! ”
উনি কেমন চোখ গরম করে তাকালেন!
______________________
আমার আট মাসের কষ্টের আরেকজন সঙ্গী ছিলেন আমার আম্মু। আব্বুকে বাসায় একা রেখে আম্মু পড়ে থেকেছে আমার কাছে। মেজ ফুফুর বাসা পাশে ছিলো তাই রক্ষা! তারপর কিছুদিন পর পর দুই আম্মু অদলবদল করে থাকলো। পাশের কেউ জানলো না কোনটা শাশুড়ী কোনটা মা । আম্মুই ছিলেন বেশি। কেউ কোনদিন বলতো না উনি আমার শাশুড়ী ! বারিধারার ঐ ফ্লাটের আশেপাশের সবাই জানতো উনিই আমার আম্মু। কিভাবে জানতো জানি না।
একদিন পাশের ফ্লাটের একজন ভাবী এসে আম্মুর সাথে বলছিলেন
” আপনার জামাইটা আসলেও খুব ভালো মানুষ! এতো যত্ন করে আপনার মেয়ের। এ যুগে এমন ছেলে পাওয়াই যায় না। ”
আমি সেটা শুনে মিটিমিটি হাসলাম। ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” মুনিবা বিবি জামাইকে কি দিয়ে বশ করেছো? আমাদের শেখাও আমরাও একটু বশ করি! আমাদের আশপাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ তুলেও তাকায় না! কি জাদু করেছো গো তুমি !! ”
আমি হাসলাম। উনি উনার দুঃখের কথা বললেন। উনার হাসবেন্ড ক্যাপ্টেন। কিন্তু হাসবেন্ডের জ্বালায় বাসায় কোন কাজের মেয়ে রাখতে পারেন না৷ এমন বিপদ! আর শাশুড়ী এমন খাটাশ! দুশ্চরিত্র ছেলের এসব বিষয় নিয়ে কোনদিন তো কিছু বলবেই না উল্টো বৌয়ের চরিত্রের দোষ দিয়ে বেড়ায়! ফ্লাটে ফ্লাটে বলে বেড়াবে’ বৌয়ের স্বামী সামলানোর যোগ্যতা না থাকলে তো পুরুষ মানুষ বাইরের দিকে মুখ দিবেই! ”
আম্মু উনার দুঃখে দুঃখিত হলেন। গল্পের মধ্যে
বাপ্পি এসে আম্মুকে ডাকলেন
”মা এদিকে আসো তো! ”
উনি ভীষণ অবাক হলেন। বললেন
”ওটা আপনার দেবর না?”
আমি মাথা নাড়লাম!
”তাহলে আপনার আম্মা কে আম্মু…. এটুকু বলেই থেমে গেলেন! চোখ বড় বড় চেয়ে বললেন
” যিনি গেলেন উনি আপনার শাশুড়ী? ”
আমি মাথা নাড়ালাম। আমার কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে গেল! আমি এমন কপাল নিয়ে এসেছিলাম যেখানে খুব প্রিয় কিছু মানুষ পেয়েছিলাম! তার মধ্যে এই অবলা নারীটা অন্যতম!
ভাবী উঠে এসে হাত চেপে ধরলেন।
”মুনিবা বিবি দেখি তোমার কপালে একটু কপাল ঘষি! ইয়া আল্লাহ! এ আমি কোনদিন দেখিনি! ”
উনি চলে গেলে, আম্মু ডাকলেন,
”মুনিবা খেয়ে যা মা৷ ”
আমি গেলাম তবে খেতে নয়, আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি কাঁদছি দেখে চোখ কেমন উল্টে তাকালেন।
” তোরে ভূতে পাইছে! কাঁদছিস কেন! প্রেসার কমানোর ধান্দা! খেতে বস।”
তখনই উনি এলেন। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আছি
দেখে বললেন
” কি মা মেয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছ নাকি। কি হয়েছে? ”
আম্মু বললেন
” যাহ আমি কাঁদছি নাকি। ঐ ফ্লাটের সজীবের বৌ এসেছিল। মেয়েটা মনে করেছে তুই আমার জামাই! ”
এটা শুনে উনি হাসলেন। আমি চোখ মুছলাম।
আম্মু বললেন
“আমি তোকে পেটে ধরিনি বলেই কি আমি তোর মা নয়? তুই আমার কাছে আমার সেই মেয়েটা যাকে আল্লাহর কাছে খুব করে চেয়েছিলাম, আল্লাহ তখন দেননি। কারন পরে তোকে দেবেন বলে। তাতেই আমি আল্লাহর কাছে চিরকৃতজ্ঞ! যাক আয় বাবা খেতে বস। তাহলেই হবে। ”
খেতে বসে মা ছেলে টুকটাক গল্প করছিলো আমি তাকিয়ে তাকিয়ে উনাদের দেখছিলাম,
আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল! আমি যাদের জন্য কোনদিনও তেমন অন্যতম কিছুই করিনি, তবুও উনারা আমাকে ভালোবেসেছেন অপরিসীম! যেই ভালবাসায় কোন স্বার্থ ছিলো না। জীবন আমাকে সবটা দিয়েছিলো, যা আর দশজনকে দেয়নি! আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম কি এমন মহান কাজ আমি করেছি আল্লাহ আমাকে এতোটা দিলেন?
সেদিন রাতে উনাকে আঁকড়ে ধরে অনেক কাঁদলাম! সারাজীবন দিয়েও এ ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না!
আট মাসের সময় একদিন রাতে আমি ওয়াশরুমে গেছি, ঠিক তখনই ঝপ করে শব্দ হলো! সেই শব্দে উনিও উঠে গেছেন। আমি দেখলাম আমি একদম ভিজে গেছি৷ ভিজে গেছে আমার পুরো ড্রেস। উনি আমার অবস্থা দেখে সাথে সাথে আমাকে এসে ধরলেন। কি হলো! নিচে তাকিয়ে দেখলেন পুরো ফ্লোর ভেজা! উনি সেই মূহুর্তে আম্মু আম্মু বলে চিৎকার দিলেন। ছেলে মানুষ এসব ব্যাপার তেমন জানে না! আম্মুকে ডাক দিতেই তিনি দৌড়ে এলেন।। আম্মু ভয় পেলেন না বললেন
“সময় চলে এসেছে, চলো হাসপাতাল! ”
এমনিতেই আমার বাচ্চাদের ওয়েট অনেক কম। উনার মাথায় বাজ পড়লো যেন। আম্মু ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন।
গ্যারেজে এক ফ্রেন্ডের গাড়ি ছিলো, সেই রাত দু’টোয় অনেক বিল্ডিংয়ের ভাবীরা এলো। আমাকে এতো আদর করে বিদায় দিচ্ছিলেন আমার মনে হলো
” এ শেষ বিদায় ”
উনি আমাকে ছাড়লেন না একবিন্দুও। পুরোটা রাস্তা আঁকড়ে ধরে থাকলেন। আমিই বরং উনার চেহারা দেখে বললাম
” ভয় নেই। ”
উনি বললেন
”ভয় পাবে না মোটেও। খুব সামান্য অপারেশন। আমি থাকবো সেখানে। অনুমতি নিয়েছি।”
”আমি তো ভয় পাচ্ছি না, আপনি ভয় পাচ্ছেন। ”
ভয় পাওয়ার কারন ছিলো তার কাছে। আম্মুর কাছে শুনেছিলাম, উনি নাকি বিপদের আগে খানিকটা টের পান। এবারও আমাকে নিয়ে বিপদের ভয় পাচ্ছেন! আমি উনার দিকে দেখে মিষ্টি করে হাসলাম।
”আমাদের জন্য যেটা মঙ্গল আল্লাহ সেটাই করবেন আশাকরি ”
উনি আমার মুখটা দুহাতের আজলায় ভরে নিয়ে বললেন,
” তোমাকে সাবধান করছি মিসেস তারিক যদি উল্টোপাল্টা কোন চিন্তা করেছেন তবে ঐ জীবনে গিয়ে সেই শোধ তুলবো! আপনি আমাকে চেনেন না আজও! আমি আপনাকে কোনদিনও ক্ষমা করবো না। আল্লাহর কাছে বিচার তোলা থাকবে এই বলে দিলাম। ”
আমি বললাম, আপনি যে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন?
”যায় তো নি। তাই তোমারও পারমিশন নেই! ”
সেই শক্ত কঠিন অবিচল মানুষ টার এতোটা নড়বড়ে রুপ ভালো লাগছিলো না। উনাকে উনার রুপেই মানায়! কঠিন এবং গম্ভীর! স্ত্রী সন্তানের চিন্তার ভারে উনি যেন কেমন হয়ে গেলেন! ঠিক যেন আমার আব্বুর মতোই!
_______________________
ওটিতে উনি আমার সাথেই। আমার পালস অক্সিমিটার লাগানো হাতটা ধরে ছিলেন শক্ত করেই৷ সিজারিয়ান সেকশন সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন সবাই মেজর র্যাঙ্কের। একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন। সিনিয়র সার্জন। সবাই প্রানবন্ত হাস্যজ্জ্বল মানুষ।
প্রথমেই ছেলে বাচ্চাটাকে বের করা হলো। সে সামনে ছিলো। একজন নার্স ছেলেটাকে ফ্রেস করে একটা ট্রে তে করিয়ে দেখালেন। তবে হাতে দিলেন না। উনি বাচ্চাকে দেখেই সালাম দিলেন। আমি চুপচাপ দেখলাম আমার গম্ভীর ছেলেকে৷ যে কাঁদার বদলে মুখ ভার করে আছে, অবস্থা
” এ আমি কোথায় এলেম! ”
আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। এরপরেই মেয়েটা্কে বের করা হলো। ডাক্তাররা যেন কি বলাবলি করছিলো। উনি আমার হাত ছেড়ে ওদিকে এগিয়ে গেলেন। আমি কিছু বুঝলাম না। শুধু শুনলাম উনার কন্ঠস্বর।
” আম্মু আমার আম্মু এই যে মা, তাকাও ”
বেশ কিছুক্ষণ কাটলো টের পেলাম না ওদিকে কি চলছে। তবে সবাই কথা বলছে। কারো পিঠে জোরে জোরে থাবা পড়ছে। স্যাকশন পাইপের শব্দ পাচ্ছি!
আমি ভয় পেয়ে গেলাম! নার্সটাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? উনি বললেন
” মেয়ে বাচ্চাটা রেসপন্স করছে না! স্যার পাগল হয়ে গেছে!”
ইয়া আল্লাহ! কি বলে! আমিও কাঁদতে শুরু করলাম! উনার কত্ত শখ মেয়ে বাচ্চার! আজ যদি উনার হাতের উপর এসেও মেয়েটা চলে যায় পাগল হয়ে যাবেন উনি! আমি সেই বজ্রকঠিন সত্তাকে একবার দেখার চেষ্টা করলাম। ডাক্তাররা চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি দেখতে পেলাম না। আমার সামনে পর্দা দেওয়া ছিলো। সবাই তটস্থ। আমিও মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম! তখন মনেহয় আরোও দুজন ওটিতে ঢুকলেন!
আমার সাথে থাকা সার্জন হঠাৎ চিল্লায়ে উঠলো।
” পেসেন্টের প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। সিস্টার, সিস্টার ইনজেকশন।”
একজন বললো অক্সিজেন লাগাও। স্যাচুরেশন নেমে যাচ্ছে! ইয়া আল্লাহ! পেসেন্ট এতোটা আনস্টেইবেল হয়ে যাচ্ছে কেন! তারিক স্যার, স্যার। ”
তখন উনাকে দেখলাম আমার কাছে ছুটে এলেন। উনার বিধস্ত চোহারা। যে চেহারা দেখে আমার অন্তর কেঁপে উঠলো! আমি চোখের দিকে তাকাতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। কেমন যেন চারিদিকে সাদা সাদা ধোঁয়া ধোঁয়া! উনি ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিলেন।
একজন সার্জন বলে উঠলেন ,
”Sir, keep her awake.
Do not let her lose consciousness.”
উনি এবার পাগলের মতো বলে চললেন,
” মুনিবা এইতো আমি। মুনিবা, এই মুনিবা, তাকাও।দেখো আমাকে? ”
উনি আমার গালে চিমটি দিয়ে ধরলেন। হাতের তালুতে চাপ দিচ্ছিলেন।
” সিস্টার কল ডাঃএকরামুল রাইট নাও।
সিস্টার এক্ষুনি আইসিইউ বেড ফাঁকা আছে কিনা খোঁজ নিন। তাড়াতাড়ি একটা বেড রেডি করুন। কুইক। ”
আমি সব শুনছিলাম আর আস্তে আস্তে যেন সাদায় মিলিয়ে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে ডাক্তারের চিল্লাচিল্লি উনার ভাঙা কন্ঠস্বর শুনতে পারছি৷ আচ্ছা কন্ঠটা এমন শোনাচ্ছে কেন? উনি কি কাঁদছেন?
”জেগে থাকতে হবে তোমাকে। এই মেয়ে মুনিবা! মুনিবা আমি সব হারাতে পারবো তবুও তোমাকে নয়! তোমাকে তাকাতেই হবে। এই মেয়ে, Hey girl, get up! Open your eyes! hey girl.
আমি উনার কান্না শুনতে পাচ্ছি! এত গুলো বছরেরও যে বজ্রকঠিন মানুষটার কান্না আমি দেখিনি সেই মানুষটার কান্না দেখতে হচ্ছে! উনার কান্নায় আমার আরোও কষ্ট হচ্ছে! আমি বলতে পারছি না!
কি সুন্দর চারিদিকে এতো সাদা! ওগুলো কি মেঘ! কি জানি! সুন্দর প্রশান্তিরা ছুয়ে যাচ্ছিল আমায়। আমি সাদায় ভেসে আছি। শুধু দূরের কোথাও থেকে একটা সুক্ষ্ম স্বর।
” hey girl open your Eyes. This is my order.
You have never disobeyed my orders.
You have never,You have never.”
____________________
তারিক ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছিল সে? স্থির থাকতে পারছে না! ছেলেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসতে দেখে এগিয়ে গেলেন মিসেস জামান।
” আব্বা কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন? ”
তারিক যেন মাকে খেয়াল করেনি৷ চলে যাচ্ছিল। মিসেস জামান হাত ধরে ঝাঁকি দিলেন
” তারিক!”
তারিক কেমন করে মায়ের দিকে তাকায়। বলে চললেন মিসেস জামান,
” কি হয়েছে? ওরা যে মেয়ে বেবিটাকে এখনও দিলো না, ছেলেটাকে দিয়েছে সেই কখন! ”
”মেয়ে বেবি! ” তারিক জিজ্ঞাসা করলো!
মিসেস জামান এবার ভয় পেলেন,
”কি হয়েছে তোর? মুনিবার কি অবস্থা? বাচ্চাদের মধ্যে মেয়ে বেবিটা কই! ”
বাপ্পি ছুটে এলো তখন
”মা মেয়েকে NICU তে দিয়েছে, আমাদের যেতে বললো তুমি আসো আমার সাথে। ওর সাপোর্ট লাগবে। ”
তারিক কেমন চোখে তাকিয়ে সেই লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালের করিডর বেয়ে। তার বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে! তাকে যে সেই দরবারে যেতে হবে! যেখানে ধর্ণা দিয়েই ও এই সামাজ্যের মালিক হয়েছিল৷ ওর সামাজ্যের পতন হচ্ছে। ও কেন দাড়িয়ে থাকবে?
বাপ্পি হয়তো টের পেলো। সেও ছুটে গেল ভাইয়ের পিছু৷ জাপটে ধরলো পিছন থেকে
” কি হয়েছে, কোথায় যাচ্ছো? মেয়েটা সুস্থ হয়ে যাবে ইনআশাল্লাহ। ওকে সাপোর্টে দেওয়া হয়েছে।”
তারিক ছাড়িয়ে নিলো ভাইয়ের হাত।
”ভাবী কোথায়? ”
“আই সি ইউ তে। ”
বাপ্পি স্তব্ধ হয়ে গেল
”তুমি কোথায় যাও? ”
”আসছি?”
ব্যস আসছি বলেই হারিয়ে গেল তারিক!
_________________________
তারিক পৌছে গেল সেন্ট্রাল মসজিদের ভিতরে। গিয়েই সিজদায় পড়ে গেল,
” আমার স্ত্রী আমার সন্তান! আল্লাহ আমি জানি তুমি বান্দাকে এমন বোঝা চাপিয়ে দাও না যে বোঝা সে বহন করতে পারবে না! এ যে বড় ভারী বোঝা খোদা৷ এ আমি টানতে পারবো না। আমি আমার অপারগতা স্বীকার করছি।
কেউ না জানুক তুমি তো আমায় জানো! আমি এটা নিতে পারবো না, প্রভু৷ কখনোই পারবো না। এতো বড় শাস্তি আমাকে দিও না। ওদের জানের বদলে আমাকে নিয়ে নাও। তবুও আমার মেয়ে, আমার স্ত্রীকে সুস্থ করে দাও ”
আহমেদ আল তারিক উন্মাদ হলো প্রায়। জীবন তাকে এই দিন দেখাবে সে কি জানতো কোনকালেও! সে এই ভয়ই পাচ্ছিল।
তারিক তবুও কাঁদলো। পৃথিবীর সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা যখন শেষ হয়ে যায় তখনও বাকি থাকে যে দপ্তর সেটাই হচ্ছে ঐ আরশের দপ্তর। সেই দপ্তরে আবেদনপত্র জমা দিতে থাকলো একটার পর একটা। মঞ্জুর হলো কি সে আবেদন?
জীবনে কখনও হার না মানা তারিক কি তবে এবার হেরে যাবে! ভীষণ বিধস্ত হয়ে সে পড়ে থাকলো সেই দরবারে!
একবেলা পেরিয়ে গেলো। কোন খোঁজ পাওয়া গেল কি তারিক, মুনিবা কিংবা বেবি গার্লটার!
_____________________
যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম আমার পাশে আম্মু আব্বু,আমার আম্মু আব্বু,মুহাইমিন।
হয়তো কাঁদছিলেন কি?
কি জানি আমাকে দেখামাত্রই চোখ মুছে আমার সারা গালে আদর করে দিলেন আম্মু।
” সোনা মেয়ে আমার! দেখো আমরা সবাই আছি। এই তো আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে গেছে ”
আমার গলা কেউ আটকে রেখেছিলো৷ আমি শুধু দেখতে পারছিলাম।
আম্মু বললেন,
” মেয়ে ছেলে দুজনেই একদম সুস্থ। গত দুদিন NICU কেয়ারে রাখা ছিলো। তারপর থেকে আর কোন সমস্যা হচ্ছে। একদম স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছে। তুমি দেখবা ওদের। ”
আব্বু বললেন,
”সবাই একদম সুস্থ মা,এখন তুই সুস্থ হয়ে যা মা। আমাদের আর কিচ্ছু দরকার নেই! ”
আমার চোখ উনাকে খুজছিলো, আম্মু বুঝলেন৷।
” তারিক আছে, বাইরেই আছে, চিন্তা করো না দাড়াও পাঠাচ্ছি! ”
আব্বু আমার কপালে চুমু দিলেন। আমার পাশে দাড়িয়ে থেকে দোয়া কালাম পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। ডাক্তার এলো। হাসিমুখে বললো
”আঙ্কেল আবার পরে দেখবেন। রেস্ট করতে দিন।”
আমার দৃষ্টি তাকে খুজছিলো,
ডাক্তার বুঝলো,
” স্যার আছে তো। আসতেছে, আপনি ঘুমান ”
______________________
আমার উপর ভারী কিছু পড়ে আছে টের পেলাম। আস্তে আস্তে আমার জ্ঞান আসছে। ঘুম ভাঙছে। ধীরে চোখ মেলে দেখি, আমার বুকের উপর কারো মাথা! বুঝলাম এটা উনিই। উনি বাদে আর কারো এতো কাছে আসার অনুমতি আছে?উহু।
আমি আস্তে করে বললাম ” আসসালামু আলাইকুম। “কিন্তু শব্দ বের হলো না। কেমন ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ!
উনি সাথে সাথে মাথা উঠালেন। পাগলের মতো আমার সারা গালে স্পর্শ দিতে থাকলেন। আমি অসাড় হয়ে পড়ে থাকলাম। চোখ বেয়ে পানি বেয়ে চললো।
পাগল উনাকে দেখে আমার কেন জানি হাসি পেলো!
আমি চুপচাপ মানুষটার পাগলামি দেখছি। আমাকে আগলে ধরলেন ….. যেন ছাড়লেই পালিয়ে যাবো।
এই মানুষটা এতোটা পাগলা কে জানতো? আমি কি এতোদিনেও জেনেছি একবারও! নাহ তো!
তখনই কেবিনে ঢুকলো দুই আম্মু। তাদের দুজনের কোলেই দুটো বাচ্চা। আমি মেয়েকে একবারও দেখিনি। আম্মু এসে মেয়েটাকে উনার কোলে দিলেন!
” আমার ছেলেটাও যে এতো পাগল তা আজ জানলাম! কই পড়েছিলে? এটা কোন কথা! স্ত্রীর পাশে থাকবা না? ”
উনি মেয়েকে বুকের সাথে মিলিয়ে নিলেন। আজ কান্না আটকালেন না সেই বড় বড় চোখ বেয়ে মুক্তোর দানার মতোই কতগুলো বিন্দু ঝরলো৷ ঝরে পড়লো মেয়ের গায়ে৷ মেয়েটা চোখ বন্ধ করেছিলো। পানি পড়তেই কান্না করে উঠলো। শুধালেন
”কানে আজান দেওয়া হয়েছে? ”
”হুম বাপ্পি তো ছেলেটাকে বের করার পরই আজান দিয়েছে আর ও যখন কেয়ারে ছিলো দরজায় দাড়িয়ে দিয়েছে। কানে দেওয়া হয়নি! ”
উনি এবার নিজের গলা ঝেড়ে মেয়ের কানটা নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে হালকা স্বরে আজান শুরু করলেন। আমার আম্মুও এগিয়ে এলো। ছেলেটাকেও এগিয়ে ধরলো বাবার দিকে। বাবা আজান দিতে দিতেই দুজনকে দুহাতে ধরলেন।আম্মুও এগিয়ে এসে ছেলেকে সাহায্য করলো। এবার উনার কন্ঠে কান্না। উনি ভাঙা কন্ঠে আজান দিচ্ছেন। আমি চুপচাপ শুনছি সে কান্নারত আজান। আমার কি যে ভালো লাগছে!
আমি চুপচাপ তার চোখ দেখছি। কল্পনায় সেই চোখ।সেই দৃষ্টি! জীবন দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে! কত কিছু দেখলাম!
রক্তচক্ষু দৃষ্টির সেই চোখে পাগল করা ভালবাসা দেখলাম।সেই চোখেই আজ আবারও আমি আমার জন্য কান্নাও দেখলাম। আমার বাচ্চাদের জন্যও। এতোও সৌভাগ্য ছিলো আমার! কি কপাল নিয়ে জন্মেছি আমি!
আমার চোখের কোণে অশ্রুর অপ্রতিরোধ্য ধারা বয়ে চলল, মনের গভীরে, নিঃশব্দে, অনন্তকাল ধরে।
সমাপ্ত