জলতরঙ্গের সুর পর্ব-০৭

0
2

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৭
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

একটা রোদেলা ব্যস্ত সকাল।
ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির পেছন দিকটা একটু নিরিবিলি। ঊর্মি হাঁপাতে হাঁপাতে লাইব্রেরির প্রাচীর ঘেঁষে বকুল গাছটার ছায়ায় বসে পড়ল, কাঁধের ভারী ব্যাগটা নামিয়ে রাখল পাশে। ওর হাতে ধরা মোড়ানো কাগজে গরম কফি।

আজ সকালে একটা প্রেজেন্টেশন ছিল ওর।‌ ক্লাসে ঢোকার আগে মনে হচ্ছিল কিছুই ঠিকমতো গোছানো হয় নি। তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও বলে গেছে সব পয়েন্ট, ডায়াগ্রাম, রেফারেন্স। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়েই একরাশ ক্লান্তি এসে ভর করেছে ওর চোখে মুখে।

মাথাটা টনটন করছে, কফিটা খেলে যদি একটু ঠান্ডা হয়। পিছনে ঘাড় ঝুঁকিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো ও।
পাখিদের কিচিরমিচিরে ভরা বকুল গাছটা শান্ত লাগছে, কিন্তু ওর মনটা অদ্ভুত অস্থির।

এই অনার্সের শেষ বর্ষ—
ভবিষ্যৎ নিয়ে হাজার প্রশ্ন, অথচ জবাবটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। মাস্টার্সে কোথায় ভর্তি হবে, চাকরি নাকি আরও পড়াশোনা… ভেবে ভেবেই মাথা ব্যথা হবার জোগাড়। বন্ধুরা একে একে আলাদা হয়ে যাচ্ছে পথভেদে। কেউ চাকরির পরীক্ষার জন্য কোচিং করছে, কেউ স্কলারশিপ খুঁজছে।

তার বিপরীতে ঊর্মি এখনো সিদ্ধান্তহীন। থেকে যাবে, নাকি পাড়ি জমাবে অন্য কোনো পথে?

তার মধ্যেই ভেতরে একটা অনুভূতি মাঝেমাঝে এসে বিঁধে যায় আজকাল—
দুরন্ত পাখির মত ছুটে বেড়ানোর সময় পায়ের নিচে শাড়ি আটকে কীভাবে পা হড়কে গিয়েছিল ওর। একটা শক্ত হাত ওকে সামলে নিয়েছিল ঠিক সময়ে।

সেই কয়েক মুহূর্তের ছোঁয়া, কোনো শব্দ ছাড়াই কেবল দুটো দৃষ্টি মুখোমুখি হয়েছিল এক অসমাপ্ত চেনা ভঙ্গিমায়।

আজ এই দুপুরবেলায় লাইব্রেরির পেছনের ছায়াঘেরা কোণায় বসে, ও যেন আবার অনুভব করল সেই মুহূর্তটার ভার। ওর এখনো স্পষ্ট মনে আছে মানুষটার চোখে লুকানো আতঙ্ক, আর দ্রুত সরে যাওয়া বেসামাল স্পর্শ।

তারপর সেদিন আবার একটা অপরিচিত বাড়ির ছাদে অন্ধকারে ভয় পেয়ে ও কিভাবে জাপটে ধরেছিল মানুষটাকে। ভাবলে এখনো লজ্জায় কান গরম হয়ে ওঠে ওর।

ঊর্মি চোখ বন্ধ করল। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো খুব গোপনে। তারপর ধীরে চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকাল ও।

নিজেকে বলল যেন,
“এগুলো তুচ্ছ। খুব তুচ্ছ। জীবন এর চেয়ে অনেক বড়।
বারণ করেছিল না, আশেপাশে যেতে? ঊর্মি ওই ছায়ামানবের ছায়াও মাড়াবে না কোনোদিন।”

কফির কাপে চুমুক দিল ও।
ঠিক তখনই ওর বান্ধবী তুলি এসে দাঁড়ালো ওর কাছে।
“ঊর্মি? তুই এখানে একা একা? ক্লাসের পর খুঁজছিলাম তোদেরকে।”

ঊর্মি হাসল হালকা করে।
“একা থাকতে আজকাল বেশ ভালো লাগছে।”
তারপর একটু থেমে বলল, “বাকিরা কোথায়?”

“কী জানি! কাউকেই পেলাম না। তোকেও যে এখানে পাবো ভাবি নি!”

ঊর্মি আবার কফির কাপটা হাতে নিল। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে বলল,
“হঠাৎ করেই সবাই কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তাই না?”

“হুঁ… সফলতাকে ছোঁয়ার আশায় ছুটছে সবাই… ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুলি।

ঊর্মি চুপ করে থাকল। চোখ নামিয়ে দেখল কফির কাপে তলানিতে ভাসতে থাকা ফেনাটা গলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কফির গন্ধ, চারপাশের কোলাহল, দূরের গাছতলা থেকে ভেসে আসা কোনো গিটারের বাজনার সুর সবের মাঝেই যেন ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত ব্যস্ততা।

আশ্চর্য! আগে তো কখনো এমন মনে হয়নি!
আজকে কি হঠাৎ করেই ইউনিভার্সিটির পরিবেশ পাল্টে গেল?

“গত উইকের নোটসগুলো কালেক্ট করা বাকি আছে না?।ভেতরে যাই চল…” প্রসঙ্গ পাল্টে বলল ঊর্মি।

তুলি মাথা নাড়ল। ঊর্মি জামা থেকে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দুজন মিলে হেঁটে গেল লাইব্রেরির দিকটায়।

__________________________________

চট্টগ্রাম উপকূলে অবস্থিত একটি নৌঘাঁটির
কনফারেন্স রুম।

ঘড়িতে সময় দুপুর একটা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নীল পর্দা টানা কাচঘেরা ঘরে বসে আছে দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা।রুমের ভেতরে এসির ঠান্ডা হাওয়ার বিপরীতে আলোচনার টেবিলের উপর যেন ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে এক অদৃশ্য উত্তাপ।

টেবিলের এক পাশে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার, অন্য পাশে একটি বিদেশি নেভাল প্রতিনিধি দল। আলোচনার বিষয়— আসন্ন এক যৌথ সামুদ্রিক মহড়া। কাগজপত্র, মানচিত্র, স্যাটেলাইট ইমেজ, কোঅর্ডিনেটস ছড়িয়ে আছে চারদিকে।

প্রথমে কথা হচ্ছিল সহজভাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল— কিছু এলাকা নিয়ে বিভ্রান্তি বা গোপন উদ্দেশ্য আছে অপর পক্ষের।
তাদের প্রস্তাব— মহড়ার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সীমা বরাবর কিছুটা ‘ফ্লেক্সিবিলিটি’।

রাজনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক কৌশল, বিনিময়ের ইঙ্গিত— সবই আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ছে কথাবার্তায়।

টেবিলের একপ্রান্তে বসে আছেন ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল, নিখুঁতভাবে পরিপাটি তার ইউনিফর্ম, চোখে দৃষ্টি স্থির, মনোযোগী। সামনে খোলা একটি ফাইল, পাশে রাখা ট্যাবলেটে মহড়ার ম্যাপ ও কনফিগারেশন।

বিদেশি দলের একজন প্রতিনিধি কথা শুরু করলেন নরম গলায়,
“Gentlemen, we are only asking for flexibility in zone access. It’s a standard drill configuration.”
[আমরা কেবলমাত্র অঞ্চল ব্যবহারে সামান্য নমনীয়তা চাইছি। এটা একেবারেই প্রথাগত একটি মহড়ার কাঠামো।]

কল্লোল ট্যাবলেট থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলেন সংযত গলায়,
“No flexibility in sovereignty. Your ‘standard drill’ overlaps with our exclusive maritime zone.”
[ সার্বভৌমত্বে নমনীয়তার প্রশ্নই আসে না। আপনাদের তথাকথিত ‘স্ট্যান্ডার্ড ড্রিল’ আমাদের এক্সক্লুসিভ জলসীমায় পড়ছে। ]

বিদেশি প্রতিনিধি একটু হেসে চাপা সুরে বললেন,
“Come on, Captain. Don’t be so stiff. We all know boundaries are fluid in these waters.”
[আহা ক্যাপ্টেন, এতটা কঠোর হবেন না। আমরা সবাই জানি, এই জলসীমায় সীমানাগুলো সব সময় স্পষ্ট থাকে না।]

এইবার কল্লোল টেবিলের উপর খানিকটা ঝুঁকে এলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
“Gentlemen, boundaries aren’t fluid. Waters are. Our laws are not.”
[ স্রোত ভাসমান, সীমানা আর আমাদের আইন নয়, জেন্টেলম্যান।]

এক মুহূর্তের কঠিন নিস্তব্ধতা নেমে এলো রুমেজুড়ে।

তারপর কল্লোল আবার ম্যাপে ফিরে বললেন,
“Let’s continue with the original layout. Any technical collaboration is welcome, but the geography remains ours.”
[চলুন, মূল বিন্যাস অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নেই। কারিগরি দিক থেকে সহযোগিতা আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু ভৌগোলিক সীমা আমাদেরই থাকবে।]

সাথে সাথেই একজন বাংলাদেশি লেফটেন্যান্ট নোট টানতে টানতে বলল,
“Copy that, Sir. Updating the config sheet.”

বিদেশি প্রতিনিধির চেহারা গম্ভীর হলো, তিনি যেন বুঝে গেছেন এই টেবিলে আলোচনার সীমা ঠিক কোথায়। তবুও একবার শেষ চেষ্টা করলেন। তিনি কিছুটা হেসে, চাপা কূটনৈতিক ভঙ্গিতে বললেন,
“Captain, just remember, alliances thrive on understanding. A little concession today can mean deeper cooperation tomorrow.”
[ক্যাপ্টেন, শুধু মনে রাখবেন, মৈত্রীর সাফল্য নির্ভর করে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর। আজকের সামান্য ছাড় কালকের গভীর সহযোগিতার পথ খুলে দিতে পারে।]

কল্লোল শান্তভাবে তাকালেন তার দিকে। আবেগহীন কন্ঠে বললেন,
“True alliances are built on respect, not compromise in sovereignty.”
[ প্রকৃত মৈত্রী গড়ে ওঠে সম্মানের ভিত্তিতে, সার্বভৌমত্বের সাথে আপসের ভিত্তিতে নয়।]

এরপর তিনি চেয়ার সোজা করে বসলেন, চোখ নামালেন ফাইলের পৃষ্ঠায়। স্পষ্ট ইঙ্গিত— এই আলোচনার যবনিকা এখানেই।

টেবিলের অন্য প্রান্তে থাকা একজন অফিসার কাগজপত্র গুছিয়ে বললেন,
“Let’s proceed with the finalized parameters. Drill coordination will be shared within 48 hours.”
[চূড়ান্ত শর্ত অনুযায়ী এগোনো যাক। মহড়া সমন্বয়ের বিস্তারিত আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।]

বিদেশি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চোখাচোখি করল একবার। চাপা ভঙ্গিতে গা ছেড়ে দিয়ে বসলেন কেউ কেউ, দু একজন কিছু না বলে মাথা নাড়লেন। আলোচনার ওজন বুঝে গিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উপপ্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল পাশে বসা কল্লোলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মুখে কিছু না বললেও তাঁর চোখে ফুটে উঠল প্রশংসার চিহ্ন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রশ্নে কল্লোলের অটল অবস্থানের প্রতি অকপট প্রশংসা।

ক্যাপ্টেন কল্লোল এবার ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
“We appreciate your presence. Let’s make this exercise a success; without redrawing the lines.”
[ আপনাদের উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ। আসুন, এই মহড়া সফল করি; সীমানা না পাল্টেই। ]

সবাই উঠে দাঁড়ালেন, করমর্দনের মাধ্যমে শেষ হলো একটি ঠান্ডা স্নায়যুদ্ধ।

বিদেশি প্রতিনিধি দলের একজন পেছনে তাকিয়ে এক পলক দেখে নিলেন সেই লোকটিকে
যার চেহারায় নেই কোনোরকম উষ্ণতা ,
কথায় নেই কোনোরকম আপোষ,
যার একেকটা বাক্য, শীতল ছুরির মতো কেটে যায় অপ্রকাশ্য অভিপ্রায়ের কুয়াশা।

To be continued…