জলতরঙ্গের সুর পর্ব-০৮

0
2

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ০৮
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

নৌ ঘাঁটির প্রধান ফটকের পাশের প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের একটি গাড়ি। আগের রাতে গাড়িটি কোনো রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ঘাঁটির সীমানা পেরিয়ে বাইরে গিয়েছিল। চালক ছিল একজন প্রশিক্ষণরত নবীন ক্যাডেট। এখন সেই গাড়িটাই তার নিষিদ্ধ যাত্রার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল মাঠটাতে, নিয়মভাঙার অনড় প্রতীক হয়ে।

ঘাঁটির কনফারেন্স রুমের ভেতর ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল দাঁড়িয়ে আছেন সামনে রাখা টেবিলের পাশে। পরিপাটি ইউনিফর্ম, কাঁধের র‍্যাংক ব্যাজের নিচে গেঁথে আছে অতীতের বহু শৃঙ্খলার ইতিহাস। তাঁর মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, নির্লিপ্ত চেহারায় বিরাজ করছে একরাশ গাম্ভীর্যতা।

তার সামনে দাঁড়ানো জুনিয়র অফিসার বলে যাচ্ছেন একটানা, “…Sir, trainee said, he just went to meet his friend, wasn’t outside the secure perimeter for long—”

কল্লোল নিরুত্তাপ গলায় মাঝপথে কথা কেটে দেন।
“Rules are not for interpretation. They’re to be followed.” [নিয়ম ব্যাখ্যার জন্য নয়। মেনে চলার জন্য।]

তারপরে ধীরে তাকালেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তরুণ ক্যাডেটের দিকে। তরুণের চোখের চঞ্চলতা চাপা পড়েছে একরাশ ভয় আর অপরাধবোধে।

“গতরাতে ঘাঁটির বাইরে গিয়েছিলে তুমি?”
কল্লোলের গলা স্থির, কিন্তু এতটাই ঠান্ডা যে ঘরটা যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল।

ছেলেটি ধীর স্বরে বলল,
“স্যার, একজন বন্ধুর অসুস্থতার খবর পেয়েছিলাম… জরুরি ছিল…”

কল্লোল থামিয়ে দেন মাঝপথে,
“তুমি নৌবাহিনীতে এসেছো বন্ধুর জরুরি ডাক শুনতে?”

ছেলেটির মুখ লাল হয়ে ওঠে, নিচু গলায় বলে,
“নো, স্যার।”

কল্লোলের গলা ঠিক আগের মতোই ঠান্ডা, তাতে যেন শীতল ইস্পাতের মতো বাজে কিছু একটা,
“Your uniform says you’re ready to serve. But your actions say you’re not ready to obey. That contradiction is dangerous.”
[তুমি এই ইউনিফর্ম পরেছো সার্ভ করার জন্য। কিন্তু তোমার আচরণ বলছে তুমি আদেশ মানার উপযুক্ত নও। এই দ্বৈততা বিপজ্জনক।]

তিনি ডান হাতে একটা সাদা কাগজ তুলে সহকারী অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, “Issue temporary suspension. Effective immediately. No further hearing.”
[অস্থায়ী বরখাস্ত জারি করো। এখন থেকেই কার্যকর। পরবর্তী শুনানির দরকার নেই।]

তরুণ সৈনিক অবাক চোখ তাকিয়ে থাকে, কিছু বলতে যাবে, সেই মুহূর্তে কল্লোল চোখ তুলে তাকালেন একবার। আর কোনো কথা হয় না, সেই বরফ শীতল দৃষ্টিতে থেমে যায় সব আপত্তি।

নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সেই তরুণ, তার চাকরিজীবনের প্রথম বড় ধাক্কা নিয়ে।

_____________________________________

বিকেল সাড়ে চারটা। জানালার ফাঁক দিয়ে পড়ছে পড়ন্ত রোদ, বারান্দার গাছগুলো আলতো হাওয়ায় দুলছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ওপেন থাকা Google Docs-এ একের পর এক আসছে প্ল্যানিং আপডেট।

ঊর্মির স্কুলের তিন বান্ধবী— নিশাত, তানিয়া, আর মেহরিন।

তিনজনেই এখন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, কিন্তু বন্ধুত্বটা থেকে গেছে কিশোর বয়সের মতোই। নিশাত থাকে চট্টগ্রামে, ওর হুটহাট ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা বরাবরের মতোই আছে। তানিয়া এখন রাজশাহীতে পড়ে, ছুটি পেলেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। আর মেহরিন ঢাকাতেই থাকে, ওর সাথে ঊর্মির প্রায়ই দেখা হয়।

আরেকজন আছে রুবেল। সে ঊর্মিদের সমবয়সী নয়, দুই ব্যাচ সিনিয়র। সে একটা স্বল্পপরিচিত ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে যুক্ত, মাঝেমধ্যে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করে। নিশাত একবার ঘুরতে গিয়ে ওর সাথে পরিচিত হয়েছিল, সেখান থেকেই বাকি দুইজনের সাথেও আলাপ।

এই ট্যুরের পরিকল্পনাটা এসেছে নিশাতের মাথা থেকেই।

“একটা স্পটে যাব, যেখানে নেটওয়ার্কও যায় না ঠিকঠাক! রীতিমতো আউটডেটেড একটা ছোট্ট দ্বীপ। চল একটু নিরিবিলি একটা ট্যুরটা দিই!”

“সেন্ট মার্টিন না। বেশি ভিড়। একটা কমন দ্বীপের মতো হয়ে গেছে…” রুবেল বলল।

নিশাত আবার বলল, “তুমি না বলেছিলে একটা অফবিট লোকেশন জানো?”

রুবেল একটা ম্যাপ দেখিয়েছে ওদেরকে,
সেন্ট মার্টিন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট একটা দ্বীপ, নাম কেউ জানে না ভালো করে। কিছু স্থানীয় জেলে গিয়ে মাছ ধরে মাঝেমধ্যে, কিন্তু পর্যটকদের পা পড়ে না ওখানে।

“এটাই পারফেক্ট!” বলল তানিয়া।

ঊর্মি চুপচাপ দেখছিল স্ক্রিনে ভেসে থাকা নীল-সবুজ একটা বৃত্তের মতো জায়গা।
সমুদ্রের বুকে বিচ্ছিন্ন, নিঃশব্দ একটা দ্বীপ। হঠাৎ যেন মনে হলো এই দ্বীপটা ঠিক ওর মতো—
চেনা জগৎ থেকে একটু আলাদা, বিচ্ছিন্ন।

প্রথমে একটু দোনোমোনা করছিল ও। কারণ বাড়িতে কাউকে জানানো যাবে না। জানালেই মা-বাবা হাজারটা প্রশ্ন শুরু করবেন। এই ঝামেলার মধ্যে ও পড়তে চাইছে না। তাই না জানানোটাই ভালো হবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ও।

কিন্তু না জানিয়ে এতদূর যাবে সেটাও ঠিক মনস্থির করতে পারছে না ঊর্মি। আরেকদিকে অনেকদিন ধরে নিজেকে একটু বেশি ক্লান্ত, একটু বেশি একা লাগছিল ওর। তাই শেষমেশ সব দ্বিধাকে পাশ কাটিয়ে বলেই ফেলল—
“আমি আসছি।”

পরের কয়েকদিন গ্রুপ চ্যাটে ঝড় বইলো:

“সানগ্লাস আনবি তো?”

“সেলফি স্টিক মনে করে আনবি কিন্তু।”

“ঊর্মি কি বই নিয়ে যাবি?”

“অবশ্যই। আর কে জানে, যদি দ্বীপের কোনায় একটা কাঠের দোতলা বাড়ি পেয়ে যাই…”

“তানিয়া বলেছে ক্যামেরা আনবে!”

“রুবেল, দ্বীপে কী ওয়াইফাই পাওয়া যাবে?”

“না, কিন্তু ডুবে যাওয়ার জন্য ঢেউ পাওয়া যাবে!”

ঊর্মি নিঃশব্দে স্ক্রল করে।
মনটা যেন এই প্ল্যানের দিকেই ছুটে যাচ্ছে বারবার।
ওর একটা অংশ চায় হারিয়ে যেতে।
আর একটা অংশ মনে মনে ভাবে— এই যাত্রাটা কি কেবলই বন্ধুত্ব আর অ্যাডভেঞ্চারের জন্য, না কি নিজের ভেতরের একাকিত্ব থেকে পালানোরও একটা উপায়?

____________________________________

ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই।

মিরপুরের এক পুরোনো গলির মাথায় একটা গোলাপী রঙের ব্যাগপ্যাক ঘাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি।
শহরবাসীর ব্যস্ততায় মোড়ানো সকাল, গলির মাথায় অটো আসছে যাচ্ছে।

হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এলো,
“ঊর্মি! এত তাড়াতাড়ি?”

ঊর্মি ঘুরে দাঁড়ায়। মেহরিন, নীল রঙের ব্যাকপ্যাক কাঁধে এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে। একটা উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে মেহরিন বলে ওঠে,
“এত সকালে সকালই এমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী ভাবছিলি?”

ঊর্মি কাঁধ উঁচু করে হালকা হেসে বলে,
“ভাবছিলাম… আমরা আসলেই যাচ্ছি?”

মেহরিন চোখ কুঁচকে বলে,
“মানে? এখন পিছিয়ে পড়বি নাকি?”
তারপর নিজের নীল ব্যাকপ্যাকটা শক্ত করে চেপে ধরে যোগ করে,
“এই এক্সক্লুসিভ অ্যাডভেঞ্চারে যদি না যাস, নিশাত তোকে রিমুভ করে দেবে আমাদের চিরন্তন ফটো অ্যালবাম থেকে!”

ঊর্মির হাসি পায়। সেই চেনা বন্ধুত্বের গলা, যেটা সব সময় একটা ভরসা হয়ে থেকেছে ওর পাশে ।
ওর চোখে পড়ে, রাস্তার ওপারে একটা শিউলি গাছ। মাটিতে ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখে মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে আসে।

“না রে, যাবই। মনটাই কেমন যেন… ক্লান্ত, জানিস?”

মেহরিন এবার আর হাসে না, ও শুধু বলে,
“চল, এবার একটু মনটা হাওয়ায় উড়িয়ে আসি।”

ওরা দুজনেই একটা অটোতে উঠে পড়ে। রওনা দেয় কমলাপুরের উদ্দেশ্যে। পথজুড়ে ট্রিপ নিয়ে উত্তেজনা, গ্রুপচ্যাটে প্ল্যানিংয়ের ঝড় বয়ে গেছে আগেই, কিন্তু এখন মুখোমুখি কথা বলার স্বাদই আলাদা।

“তোর খারাপ লাগছে না?”

“মানে?”

“এই ক’দিন সবার থেকে আলাদা থাকবি, ফোনও কাজ করবে না ঠিকমতো।”

ঊর্মি একটু চুপ থেকে বলে,
“ঠিক এইটাই তো চাইছি… সবকিছু থেকে দূরে, নিজের কাছে।”

মেহরিন তাকায় ওর দিকে, ওর চোখে যেন অন্যরকম একটা ভাব।

সামনের রাস্তা গন্তব্যের দিকে এগোয়, আর পিছনের শহরটা ফিকে হয়ে যায় একটু একটু করে।

__________________

ঘণ্টাখানেক পর ওরা পৌঁছে যায় বাস টার্মিনালে।
বাস ছাড়ার আগে দুজনেই বসে জানালার পাশে। ঊর্মির চোখ ছুটে যায় ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে থাকা শহরের দিকটায়।

“তোর মনে হয় না, কোনো একটা অজানা জায়গার দিকে ছুটে গেলে, পুরোনো কিছু আর ছুঁতে পারবে না?”

“মনে হয়।”

“তারপরেও আমরা যাই।”

মেহরিন কিছু বলে না। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে।

বাস চলতে শুরু করে। চেনা শহরটা পড়ে থাকে পেছনে।

এগিয়ে যায় দুটো মেয়ে…
অজানা একটা দ্বীপের দিকে,
অজানা কিছু অপেক্ষার দিকে।

To be continued…