#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৩
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
বিকেলবেলা।
ঘরের ভেতর মৃদু আলো ছড়িয়ে আছে। ভারী পর্দা টানা জানালার উপর।
ঊর্মি ঘুমঘুম চোখে বসে আছে কেবিনের সাদা বিছানাটার ওপর। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় একটু শুয়েছিল ও। তাতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে টের পায়নি।
ঘুমটা খুব গভীর ছিল না, কিন্তু বেশ কল্পনাময়।
একবার যেন ও নিজেকে দেখেছে বিশাল ঢেউয়ের মাঝে, আরেকবার মনে হয়েছে ও কারও হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের পাড়ে।
ঘুম ভাঙার পর মনে পড়ল না, সেই হাতটা কার ছিল। শুধু একটা শীতল স্পর্শ মনে পড়ে… অচেনা নয়, আবার পুরোপুরিও চেনা না।
বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসে ও চোখ বুজে রাখল কিছুক্ষণ। ঘরের বাতাসটা ঠান্ডা আর নিঃশব্দ। বাইরে জাহাজের গা ঘেঁষে নোনা হাওয়ার শব্দ মাঝে মাঝে আসছে, আর খুব দূর থেকে ভেসে আসছে ইঞ্জিনের একঘেয়ে গুঞ্জন।
হঠাৎ করে কিছু মনে পড়তেই চোখ মেলল ও। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বালিশটার দিকে। তারপর একটু দ্বিধা নিয়ে হাত বাড়াল সেদিকে।
বালিশের নিচে এখনও গুঁজে রাখা আছে চিরকুটটা। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে সেই চিরকুটটা বের করে আনলো ও।
ছোট্ট সাদা কাগজটায় গুটিগুটি অক্ষরে লেখা তিনটে শব্দের দিকে তাকিয়ে ঘুমঘুম চোখদুটোতে একরাশ মেঘ জমলো। চিরকুটটা পড়লেই যেন কিছু অনুভব উঠছে বুকের গভীর থেকে। আবার পরক্ষণেই মন বলছে, এটা কিছু না… শুধু ফর্মাল সৌজন্য।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। আঙুলের ডগা দিয়ে কাগজটা ছুঁয়ে থাকল কিছুক্ষণ। চোখেমুখে অভিমান নিয়ে নিজেই নিজেই ফিসফিস করল,
“এই মানুষটা এত গম্ভীর কেন? কিচ্ছু বুঝি না…”
ঊর্মি গাল ফুলিয়ে চোখ নামাল কাগজটার দিকে।
ঠিক তখনই,
টুক… টুক… টুক…
কেবিনের দরজায় নক হলো।
পরক্ষণেই ধাতব নব ঘোরানোর আওয়াজ।
ঊর্মি চমকে ওঠে। কাগজটা তড়িঘড়ি করে ভাঁজ করে বালিশের নিচে গুঁজে দেয় আগের মতো।
দরজাটা খুলে গেল। অপ্রত্যাশিতভাবে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করল কল্লোল। প্রথমেই চোখ নামিয়ে সোজা তাকালো ঊর্মির বালিশের দিকে, তারপর চোখ তুলে চাইল ওর মুখের দিকে।
উর্মির বুক ধক করে উঠল। গোমড়ামুখোটা চিরকুট বালিশের নিচে লুকাতে দেখে ফেলেছে নাকি?
তারপর ওর ভয়টাকে সত্যি করে কল্লোল সন্দেহজনক দৃষ্টিতে এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল ওর দিকে,
“বালিশের নিচে কী, মিস?”
“কোথায়? ক-কিছু না… কিছু না!”
কল্লোল কয়েক পা এগিয়ে এল ঘরের ভেতর। সাদা ইউনিফর্মের উপর তখন বিকেলের আলো পড়ে ম্লান হয়েছে কিছুটা। আর চোখে সেই চিরচেনা শীতল স্থিরতা।
ও বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল ঊর্মিকে,
“তাই? তাহলে তোতলাচ্ছেন কেন?”
ঊর্মি চোখ বড় বড় করে তাকাল ওর দিকে, মুখে নির্দোষ ভাব ফুটিয়ে বলল,
“কো-কোথায় তোতলাচ্ছি! আপনি নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন! আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। আপনি কিছু দেখে থাকলে সেটাও নিশ্চয়ই আপনার কল্পনা।”
কল্লোল একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সদ্য ঘুম থেকে জাগা ফুলো ফুলো মুখটার দিকে। নাকের দুপাশে তেল জমে গাল দুটো চকচক করছে। ইচ্ছে করছে টুপ করে নাকের ডগায় পরপর দুটো চুমু খেতে। কল্লোল নিষিদ্ধ ইচ্ছেটা দমালো বহু কষ্টে। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“সকালে বালিশের পাশে কিছু পেয়েছিলেন?”
“কই নাতো, আমি তো কোনো চিরকুট পাইনি।”
বলেই সাথে সাথে মনে মনে জিভে কামড় দিল ও।
ইশ্! ঊর্মি রে! কি করলি এটা! এই করোলাটা এখন নিশ্চিত বুঝে যাবে বালিশের নিচে কি লুকিয়েছি…
“হুম….! তো সেটাই বুঝি লুকাচ্ছিলেন বালিশের নিচে?”
ধরণী দ্বিধা হও! এই ব্যাটা কি মনের কথা পড়তে পারে নাকি? এখন কি জবাব দেবে ঊর্মি!
মুখখানা গম্ভীর করল ও। চোখে একরাশ অভিমান জমে আছে এখনো। ও মুখ ফেরালো অন্যদিকে।
কল্লোল এবার ঘরের এক কোনায় থাকা চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল বিছানার কাছাকাছি।
“এখনো রাগ করে আছেন আমার উপর?”
ঊর্মি ফিরে তাকালো না। কল্লোল আবার বলল, “আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে আমি কিছুই দেখিনি! ভুল করে আমি যেটা আপনার বালিশের পাশে রেখে গেছিলাম, সেটা নিশ্চয়ই সাগরের হাওয়ায় উড়ে গেছে, ঠিক আছে? এবার তো তাকান এদিকে! ঊর্মি?”
ঊর্মির মুখখানা তেতো করোলার স্বাদের ন্যায় বিকৃত হলো। ওকে কী ভাবে এই লোকটা? একটা দশ বছরের বাচ্চা? কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে! কিভাবে ভোলানোর চেষ্টা করছে দেখো, যেন ঊর্মি কিছু বোঝেনা!
নাকের পাটা ফুলে উঠল ওর। ও একদম কথা বলবে না এই লোকটার সাথে।
কল্লোল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
একবার ঊর্মির দিকে তাকিয়ে, আবার নিজের দিকে তাকিয়ে যেন মাপছে, এই অভিমানী পাহাড়টা পেরোনো যাবে কি না; নাকি মাঝপথেই ধস নামবে।
ঊর্মির গাল ফুলে আছে, নাকের পাটা কাঁপছে অভিমানে।
এমনভাবে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, যেন কল্লোলের অস্তিত্বটাই স্বীকার করতে চায় না। কল্লোল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর অভিমানী মুখখানার দিকে। অভিমানী মুখটা এই মুহূর্তে বড্ড আদুরে লাগছে কল্লোলের কাছে।
কোনো শব্দ করছে না মেয়েটা।
না অভিযোগ, না প্রশ্ন… তবু চারপাশের বাতাসটা ভার হয়ে আছে একরাশ অনুচ্চারিত কথায়।
কল্লোল ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কি বলবে।
সেদিন যে মেয়েটাকে হঠাৎ করেই একটা কড়া কথা বলে ফেলেছিল ও, তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে সেই বাক্যটা এভাবে গেঁথে থাকবে মেয়েটার ভেতর, এতটা গভীরভাবে। আর ও নিজেও হঠাৎ করে সেই মেয়েটার প্রতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়বে যে, অভিমান ভাঙানোটাও তখন হয়ে উঠবে অবশ্য কর্তব্য!
কল্লোল একটুখানি ঝুঁকে চেয়ার থেকে ওর দিকে এগিয়ে এল, গলায় সেই চেনা গম্ভীরতা নেই, তার বদলে ঠোঁটের কোণে খেলা করছে একফালি দুষ্টু হাসি।
“জানেন, আপনি যখন রেগে যান… তখন আপনাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগে।”
ঊর্মি কপট বিস্ময়ে ঘুরে তাকাল, চোখ কুঁচকে গেল ওর।
গম্ভীরমুখো করোলাটা এইমাত্র কি বলল?
তারপর যেটা শুনেছে সেটা নিশ্চিত হতে ও জিজ্ঞেস করল, “কি বললেন?”
কল্লোলের গলার সুরে আগের মতই দুষ্টুমি মেশানো,
“হ্যাঁ। একদম সত্যি বলছি। ভ্রু কুঁচকে যায়, নাক ফুলে ওঠে… গাল দুটো ফোলা ফোলা, আর চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোয়! কনফিডেন্স, রাগ, কিউটনেস— সব একসাথে!”
কল্লোলের মুখে গম্ভীরতা নেই, বরং চোখে-মুখে যেন একরকম অদ্ভুত ছেলেমানুষি ফুটে উঠেছে।
ঊর্মির কিছুই বুঝলো না কি বলছে এই লোক! ও ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “আপনার মাথা ঠিক আছে তো?”
কল্লোল হাসল, মাথা নিচু করে বলল,
“ঠিক নেই… ইদানিং আপনি আশেপাশে থাকলে গোলমাল লেগে যাচ্ছে।”
ঊর্মি হা করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এই লোকের মাথা নিশ্চিত গেছে! কী বলছে এগুলো?
ঊর্মির নাক আরও একটু ফুলে উঠল এবার। আবারো ওকে ভুজুং ভাজুং বোঝানোর চেষ্টা করছে?
চোখ নামিয়ে বিছানার চাদরে আলগোছে আঙুল বোলাতে থাকল ও।
“আমি বাচ্চা না, মিস্টার ক্যাপ্টেন।”
কল্লোল মুচকি হাসল, “আপনি ঠিক বাচ্চা নন।
তবে আপনি এখনও বড়দের মতো কষ্ট লুকোতে পারেন না। তাই আপনার অভিমান, মিথ্যে অস্বীকার— সবকিছু এত স্পষ্ট হয়ে ওঠে…”
বলতে বলতে কল্লোল এক মুহূর্ত চোখ রাখল ওর চোখে।
ঊর্মি এবার এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে নিল।
তারপর মুখ ঘুরিয়ে রেখেই বলল, “আমি কিন্তু এখনো রাগ করেই আছি।”
কল্লোল হাসল, “হ্যাঁ, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। ম্যাডামের রাগটা কমবে কীভাবে, জানতে পারি?
উর্মি কল্লোলের দিকে ফিরে ঠোঁট ফোলালো, “কমবে না!”
ঊর্মির ঠোঁট ফোলানো দেখে কল্লোলের হাসি পেল আবারো। এত আদুরে কেন এই মেয়েটা!
ও মুচকি হেসে বলল,
“ওহ হো! তাহলে তো আমাকে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। আচ্ছা দেখছি কী করা যায়…”
ঊর্মি চোখ কুঁচকে বলল,
“আপনি ভাবছেন আমি এত সহজে মেনে নেব? হুহ্!”
কল্লোল ওর দিকে একটু ঝুঁকে এল,
“সেটা সময় বলবে, ম্যাডাম!”
ঊর্মি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কল্লোল এবার আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা টেনে রাখল আগের জায়গায়। একটু থেমে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো একবার,
“গুড নাইট, ঊর্মি!”
কল্লোল চলে গেল। ঊর্মি বসে রইল নিঃশব্দে।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটাও যেন পেছনে রেখে গেল একরাশ প্রশ্রয়।
বালিশের নিচে হাত দিল ও।
ভাঁজ করে রাখা কাগজটা বের করে আনল আবার।
নরম হাতে ছুঁয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর গলায় জমে থাকা কথাগুলো ঠেলে একটিমাত্র ফিসফিস আওয়াজ বের করল—
“এই লোক আসলে কী চায়?”
—-
সেদিন রাত, পরদিন সকাল, দুপুর, বিকেল… ঊর্মি আর দেখা পেল না কল্লোল নামক ওই ছায়ামানবটার। সে কোথায় হারালো কে জানে!
___________________________________
সেদিন রাতে ~
জাহাজের পেছনের ডেক, রাতের নীরবতা। সাগর তখন ধীরে ঢেউ তুলছে একের পর এক। নিশাত আর রুবেল ডেকের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখছে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিশাত বলল,
“এই জায়গাটা কেমন অদ্ভুত একটা শান্তি দিচ্ছে, তাই না? ঝড়টা না এলে কিন্তু আমরা জানতেই পারতাম না সমুদ্রের এই রূপ, কি বলো?”
রুবেল অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয়,
“শান্তি… হুঁ… একটা ছোট্ট ঘটনা হঠাৎ করেই জীবনের অনেক কিছুই বদলে দেয়।”
নিশাত হালকা হেসে বলল,
“তোমার কথাগুলো আজকাল বেশি দার্শনিক লাগছে, ব্যাপার কি?”
রুবেল আবারো বলে,
না, বাস্তবই বলছি। কিছু মানুষ থাকে না— যাদের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসটা এমনভাবে গড়ে ওঠে, যে তারা একটু চুপ হয়ে গেলেই আশপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে?
নিশাত চোখ সরিয়ে একবার ভাবে, তারপর আস্তে বলে,
“তুমি ঊর্মির কথা বলছো?”
রুবেল মুচকি হাসে, সরাসরি তাকায় না ওর দিকে,
“বললে তো তোমরা বলবে— ‘আমি আবার অত ভাবি কবে থেকে?’ তাই বলি না।”
নিশাত নরম স্বরে বলে,
“রুবেল, তুমি জানো… তুমি যা ভাবো, সেটা সব সময় মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারি…”
রুবেল মাথা নিচু করে সামান্য হাসে,
“যে বুঝবে বলে আশা করেছিলাম, সে তো বোঝেনা…”
নিশাত একটু থেমে বলে, “তুমি কি কষ্ট পাচ্ছো?”
রুবেল অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“কষ্ট…? নাহ…
সবাই তো সব পায় না। কেউ পাশে দাঁড়ায়, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে— পার্থক্য এটাই।
নিশাত আবার জিজ্ঞেস করে ওকে,
“ওই ক্যাপ্টেন কল্লোল আর ঊর্মি খুব কথা বলছে আজকাল। এতে কি তোমার খারাপ লাগছে?”
রুবেল চোখ সরিয়ে হালকা গলায় বলল,
“খারাপ লাগা বললে তো খুব ছোট করে ফেলা হয় ব্যাপারটাকে। কেউ কারো সাথে কথা বললেই যদি খারাপ লাগত— তাহলে তো শহরের সবাইকে আমার সহ্য করা লাগত।”
নিশাত ভ্রু কুঁচকে তাকায় এবার,
“তুমি কিন্তু এমন ছিলে না রুবেল… কেমন যেন কাঁটার মতো কথা বলো আজকাল।”
রুবেল মুচকি হাসে,
“আসলে কিছু বিষয়ে মানুষ মজা করতে করতে একসময় মরে যায় ভেতর থেকে। তখন হাসিও লাগে বিষের মতো।”
নিশাত চোখ সরিয়ে নিল,
“ঊর্মি কি তোমার খুব ক্লোজ বন্ধু ছিল?”
রুবেল গলা নিচু করে, গম্ভীর স্বরে বলল,
“বন্ধু ছিল। তবে আমি শুধু বন্ধু হতে চাইনি, জানো তো। কখনো চাইনি।”
নিশাত চোখ বড় করে তাকায় ওর দিকে,
“রুবেল…?”
রুবেল একটু হেসে চোখ সরিয়ে নেয়,
“কিছু কথা না বললেই ভালো। তবেই সম্পর্কগুলো টিকে থাকে, না?” তারপর একটু চুপ করে থেকে আবার বলে,
“তবে এটুকু বুঝেছি… কখনো কখনো মানুষ খুব সহজেই পুরোনো গল্প ছেড়ে নতুনে হারিয়ে যেতে জানে। পুরোনো গল্পগুলো তখন পড়ে না কেউ আর।”
নিশাত অবাক হয়ে তাকালো,
“তুমি কি বলছো… ওর আর ক্যাপ্টেন কল্লোলের ব্যাপারে কিছু…”
রুবেল ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“আমি কিছু বলিনি নিশাত। তুমি নিজেই বুঝে ফেললে…”
নিশাত একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে,
“রুবেল, আমি জানি তুমি নিজের মত করে অনেক কিছু বোঝো, অনুভব করো…
কিন্তু কখনো কখনো কোনো কিছু না পাওয়াতেই হয়তো আমাদের ভালো।”
রুবেল ওর দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়ে।
“হয়তো তাই।”
নিশাত একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি ভেতরে যাচ্ছি। বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে।”
রুবেল হালকা হাসি দিয়ে বলে,
“যাও।”
নিশাত ধীরে পেছনে হাঁটতে শুরু করে। ডেকের অস্পষ্ট আলো-ছায়ায় মিশে গিয়ে মিলিয়ে যায় ওর উপস্থিতি।
—
সাগরের গর্জন আবার ফিরে আসে কানে। বাতাসটা কেমন ঘন হয়ে গেছে যেন।
রুবেল ধাতব রেলিংয়ের গায়ে ভর করে দাঁড়ায়। পকেট থেকে গতকাল এক কেবিন ক্রুয়ের সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ধার করা গোটা পাঁচেক সিগারেটের একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে তুলে দেয়। লাইটার জ্বালাতে গিয়ে বাতাসের তোপে ব্যর্থ হয় কয়েকবার, শেষপর্যন্ত ক্ষীণ একটা শিখা জ্বালাতে সক্ষম হয় ও।
সিগারেটটা দু হাতে চেপে ধরে লম্বা এক টান দেয়।
কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে উর্ধ্বমুখে, তারপর ফিসফিস করে নিজে নিজে,
“কল্লোল সাহেব ভালোই হিরো সাজছেন… হুঁ? আর ঊর্মি সাহেবাও তো তাতে সুন্দরভাবেই তাল দিয়ে যাচ্ছেন…”
অন্ধকার সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে থাকে রুবেল, একটা ঠান্ডা, ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসি ফোটে ওর ঠোঁটে। সিগারেটে আরেকটা টান দেয় ও।
“তুমি ভাবছো তোমার গল্পে ঢেউ আসবে, আর তারপরেই তোমার সাহসী ক্যাপ্টেন এসে সব ঠিক করে দেবে?
আর আমি? আমি সেই গল্প থেকে চুপচাপ সরে যাব?
না, ঊর্মি… আমারও একটা অধ্যায় আছে গল্পে।
আর সেই অধ্যায় এককোণে পড়ে থাকবে না, ছড়িয়ে যাবে পুরো গল্পে… হয়তো তোমার অজান্তেই।”
রুবেল সিগারেটটা পায়ের নিচে ফেলে পিষে ফেলে।
“ঊর্মির আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন, ক্যাপ্টেন! মনে হচ্ছে বাঁচিয়ে এনেই ওর মনটা জিতে নিয়েছেন, তাই না?”
পকেট থেকে বের করে আরেকটা সিগারেট ধরায় ও। হঠাৎ ওর গলা আরও নিচু হয়, চোখের দৃষ্টি কঠিন, ঠান্ডা।
“কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখা উচিত, ক্যাপ্টেন— এই সমুদ্র যেমন শান্ত থাকে, তেমনই হঠাৎ করে গিলে ফেলতেও জানে… একবার ঢেউয়ের নিচে চাপা পড়ে গেলে, কে হিরো ছিল আর কে খলনায়ক… তা কেউ মনে রাখে না…”
To be continued…
#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ১৪
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে, সাগরের ঢেউয়েও যেন ছড়িয়ে আছে অন্যমনস্কতা। কমলা-বেগুনি আলো ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তজোড়া নীল জলে, ঠিক যেন কেউ আকাশের ক্যানভাসে তুলির শেষ আঁচড় টেনে দিয়েছে সযত্নে।
জাহাজের চারপাশে বাতাসটা হয়ে উঠেছে ঠান্ডা, একটু নাজুক। বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে লবণের গন্ধে ভেজা এক অভিমানী হাওয়া। সাগরের ঢেউ জাহাজের গা বেয়ে বেয়ে এগিয়ে আসে, আবার ফিরে যায় শব্দহীন এক তালের মতো।
সূর্যটা তখন প্রায় ডুবে যাচ্ছে, আকাশের এক কোণে ছড়িয়ে আছে আগুনরঙা আলো। সেই আলো পড়ছে পানির গায়ে, ঝিকিমিকি রুপালি বর্ণের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছে জাহাজের লৌহ শরীর।
সবকিছু কেমন স্থির। অথচ সেই স্থিরতার মাঝেই যেন ঢেউয়ের নিচে, বাতাসের ফাঁকে, রঙ বদলানো আকাশের ভেতরে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
জাহাজের করিডোরটা তখন সুনসান। কেউ নেই আশেপাশে। চারপাশের নোনা গন্ধে ভেজা হাওয়া কাঁপায় একলা মানবীর চুল। সাগর তাকে ঘিরে রেখেছে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে, আপন করে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কোনোরকম শব্দ না করে তার পাশে দাঁড়ায় আরেকজন। সে থামে একদম কাছে ঘেঁষে। হঠাৎ করে খুব কাছ থেকে কফির মিষ্টি সুঘ্রাণ নাকে যেতেই চমকে পাশ ফিরে চায় সেই মানবী।
“আপনি? কখন এলেন?”
“যখন আপনি নিশ্চিন্তে ডুবে ছিলেন ভাবনার মাঝে, ঠিক তখন।” তারপর একটা কফির মগ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “আপনার…”
মেয়েটা অবাক হয়ে তাকালো সেদিকে, “আমার? আপনি কী করে বুঝলেন আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছিল?”
সে হাসলো, কিছু বলল না।
মেয়েটা কফির কাপ হাতে নিয়ে আরেক দফা অবাক হল।
“আপনি তো ব্ল্যাক কফি পছন্দ করেন, তাহলে আমার জন্য আলাদা কেন?”
“আপনি পছন্দ করেন না তাই!”
“আমি ব্লাক কফি পছন্দ করি না, সেটা আপনি জানলেন কিভাবে?”
“যেভাবে আপনি জেনেছেন আমি পছন্দ করি…সেভাবে।”
মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে চোখ রাখে সমুদ্রের ধূসর জলে। সন্ধ্যার অন্ধকার আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছে দিনের উজ্জ্বল আলোটাকে।
“সবাই আপনাকে দেখছে আমার পাশে। অনেক কিছুই ভাবছে। আর আপনি কিছুই বলছেন না।” অভিযোগের সুরে বলে মেয়েটা।
“সবাই কী ভাবছে তাতে কিছুই যায় আসে না। আপনি কি ভাবছেন, দ্যাট ইজ ইম্পর্টেন্ট!” তারপর একটু থেমে আবার বলে, “আপনি কী ভাবছেন?”
“আমি… আমি আবার কী ভাববো?”
“সবাই যা বলছে, তা নিয়ে কিছু ভাবছেন না?”
“আমরা ফিরছি কবে?” মেয়েটা কফির মগ হাত বদল করার সাথে সাথে প্রসঙ্গটাও এমনভাবে বদল করলো যেন শুনতেই পায়নি আগের প্রশ্নটা।
“আগামী দু-তিন নাগাদ; আবহাওয়ার উপর নির্ভর করছে।” গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল সে।
“সাগরের উপর দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা উপভোগ করাটা যে এত মনোমুগ্ধকর- এটা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আপনার কেমন লাগে, দীর্ঘ সময় এই নীলের উপর কাটাতে?”
সে চোখ তুলে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকায়,
“প্রকৃতির এই বিশাল নীলাকাশ আর এই বিস্তৃত নীল জলরাশি… আমার একান্ত সঙ্গী। অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এখন আর বিশেষ কিছু মনে হয় না।” তারপর আবার বলে, “আপনার কেমন লাগছে?”
“আমার? আমার যে কেমন লাগছে সেটা নিজেও বুঝতে পারছি না! একটার পর একটা ঢেউ যখন এসে আছড়ে পড়ছে, সেই অদ্ভুত শব্দটা যে কি সুমধুর লাগছে আমার কাছে, জানেন?”
ওর চোখে তখন স্পষ্ট একরাশ মুগ্ধতা।
“একেকটা ঢেউ আসে, জোরে ধাক্কা দেয়, আবার সরে যায়… কিন্তু একটা অদ্ভুদ ধ্বনি রেখে যায়, না? ঠিক যেন কোনো নাম না-থাকা সুর।”
পাশের মানুষটা দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনছিল চুপচাপ। তারপর হঠাৎ মৃদু হেসে সে বলে,
“তার নাম আছে।”
মেয়েটা তাকাল তার দিকে, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিসের নাম?”
পাশের মানুষটা এবার চোখ ফিরিয়ে তাকায় ওর চোখে,
“এই শব্দটার।
সাগরের ঢেউ যখন বালির গায়ে, পাথরে কিংবা জাহাজের গায়ে এসে আছড়ে পড়ে, তখন যে ধ্বনি সৃষ্টি করে… সেই ধ্বনিটাকে এক কথায় বলে ‘কল্লোল’।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকল পাশের মানুষটার দিকে। চোখে যেন অদ্ভুত এক বিস্ময়।
তারপর ধীরে ধীরে মনে পড়ে ওর, প্রথম যেদিন এই মানুষটার সাথে ওর দেখা হয়েছিল, সেই প্রথম কথাবার্তায়, ওর কৌতূহলে একটা প্রশ্ন এসেছিল,
“আপনার নামের মানে কী?”
তখনও এই মানুষটা এমনই গম্ভীর গলায় বলেছিল,
“ঢেউ যখন কোনো কিছুর গায়ে আছড়ে পড়ে, তখন যে শব্দ হয়— সেটা-ই কল্লোল।”
ধীরে আসে, ধাক্কা দেয়, কিন্তু চলে যায় না— কোনো না কোনো জায়গায় তার ছাপ রেখে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য।
ওর মনে হলো, সেই দিনের সেই ব্যাখ্যা আজ নতুন করে বেজে উঠল ওর কানে।
ও চুপচাপ চুমুক দিল কফির মগে। প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা তরলের সাথে ওর ঠোঁটে এসে ধাক্কা লাগল একটা অদ্ভুত অনুভব।
এই মানুষটা হঠাৎ করে একদিন ওর জীবনে এসেছিল, তারপর ওর মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তারপর আবার একদিন হঠাৎ করেই চলে গিয়েছিল… কিন্তু তার ছাপ ও এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে মনের খুব গভীরে।
আর আজ— এই সাগরের বুকে দাঁড়িয়ে, এই নিঃশব্দ সন্ধ্যায়— সে মানুষটা আবার এসে দাঁড়িয়েছে ওর ঠিক পাশে।
ওর চোখে তখন সামুদ্রিক এক দ্বন্দ্ব। প্রশ্ন না করা প্রশ্ন, উত্তর না পাওয়া উত্তর।
ও মুখ ফিরিয়ে তাকাল না পাশের মানুষটার দিকে, কেবল ধীরে ধীরে বলল, “আপনি তো বলেছিলেন, ঢেউ আসে… ধাক্কা দেয়… তারপর ফিরে যায়…”
একটু থেমে, আরও নিচু স্বরে, যেন নিজের কাছেই বলছে এমন করে বলে, “আপনিও তো চলে গিয়েছিলেন। তবে ফিরে এলেন কেন?”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী মানুষটা এবার চোখ তুলে তাকাল ওর মুখের দিকে। কিছু বলল না।
তার চোখে তখন নীল সাগরের ছায়া। অথবা, নীল সমুদ্রে বহমান ঊর্মির।
একটা তীব্র ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল জাহাজের বগলে, যেন ওই কথাগুলো শোনার পর সমুদ্র নিজেই তার উত্তর দিতে চাইছে। সেই তরঙ্গের ধাক্কায় জাহাজটা সামান্য কাত হল একদিকে, ভারসাম্য হারিয়ে পাতলা শরীরটা পেছনদিকে হেলে পড়ার আগেই দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা দুহাতে আগলে নিল ওকে।
সেই ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল পলকা শরীরটা। ঢেউয়ের গর্জন আর বিস্তীর্ণ কালো জলের ঢেউবিলাসের মাঝে ওরা দুজন যেন একাকী, সময়ের গতিও যেন থমকে গেছে সেইসাথে।
সেই মানুষটা ওকে ওভাবে দুবাহুর মধ্যে আগলে রেখেই ফিসফিস করে বলল, “কেউ আসেনা আসলে শেষ পর্যন্ত, কেউ থাকেও না চিরকাল। কিন্তু ছেড়ে যাওয়া মানে শেষ না… আমরা সবাই এই ঢেউয়ের মতো, বারবার ফিরে আসি, ছুঁয়ে যাই, ছাপ রেখে যাই…”
কথাগুলো যেন একরাশ উষ্ণতা জাগিয়ে দিল ওর বুকের মধ্যিখানে। ওর চোখে তখন মৃদু ভেজা ভাব, কিছুক্ষণ স্থির থেকে, ও মানুষটার গলার শব্দটা মনে করল – যেন সাগরের গভীর থেকে উঠে আসা কোনো মধুর সুর।
ওর বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শান্তি শান্তি ভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল ঢেউয়ের মতো। কেমন যেন মনে
হলো— যে মানুষটা একদিন ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, সেই মানুষটাই আজ নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে,
“তুমি আমার সমুদ্রতীর। আমি যতবার ফিরে যাই, ঠিক ততবারই আবার ফিরে আসি… তোমার মাঝেই!”
ও নির্বিঘ্নে মাথা রাখল মানুষটার বুকের ওপর। বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গম্ভীর, রুক্ষ স্বভাবের মানুষটা তার চরিত্রের কঠিন আবরণ সড়িয়ে রেখে শব্দ করে চুমু খেল তার প্রশস্ত বুকের উপর মাথা রাখা মেয়েটার কপালে।
মেয়েটা চমকে উঠে শক্ত মুঠোয় পুড়ল মানুষটার সাদা ইউনিফর্মটার বুকের অংশ; চোখ বন্ধ করে ফেলল তড়িৎ গতিতে। মানুষটা হাসলো ওর এহেন কর্মকান্ডে, আলতো, নরম, প্রশ্রয় মাখানো হাসি।
ওদের এই নীরব, মিষ্টি, আদুরে মুহূর্তটার সাক্ষী হয়ে থাকল সন্ধ্যার গাঢ় নীলাকাশ আর এই বিশাল সমুদ্র। ঢেউয়ের গর্জনের সাথে দুই মন যেন মিলল একই বিন্দুতে, আর বেজে উঠল এক অমোঘ সুর, যে সুরের নাম — ‘জলতরঙ্গের সুর…’
______________________________
শো শো হাওয়া আর সমুদ্রের গর্জনে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা।
ঊর্মি তখনো দাঁড়িয়ে আছে কল্লোলের কাছ ঘেঁষে। দুজনই তাকিয়ে আছে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে। ওদের কারো মুখে কোনো কথা নেই, তবু একরাশ কথা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।
কল্লোল একহাতে জাহাজের রেলিং ধরে অন্য হাতে ধরে রেখেছে দুজনের কফির মগ।
“কী ভাবছেন, ঊর্মি?” খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করে কল্লোল।
উর্মি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ও যেন এখনো ডুবে আছে একটা ঘোরের মধ্যে।
“ভাবছি… আমি যেন ঠিক এখানেই থেকে যাই… এই ঢেউয়ের শব্দ, সমুদ্রের এই নোনাধরা গন্ধ, এই নীরবতা… আর আপনি…”
কল্লোল এবার আস্তে করে বলে,
“রাতটা একটু দীর্ঘ হোক আজ…”
ঊর্মি চোখ বুজে বড় করে একটা নিঃশ্বাস টানে। যেন নিঃশ্বাসের ভেতর দিয়েই সবটা টেনে নিতে চাইছে নিজের মধ্যে।
ঠিক সেই সময় পেছন থেকে জুতোর মসমস শব্দ শোনা গেল। ধাতব পাটাতনের উপর সেই পদচারণা যেন সময়কে কেটে ফেলল তীক্ষ্ণ রেখায়। শব্দটা খুব কাছে এগিয়ে আসার আগেই ঊর্মি ছিটকে দূরে সরে গেল কল্লোলের কাছ থেকে।
“Captain, an emergency update…”
কল্লোল ফিরে তাকালেন সেদিকে। একজন জুনিয়র অফিসার এসেছেন। কল্লোল এক মুহূর্তে বদলে গেলেন পুরোপুরি। এক লহমায় তার চোখে ফিরে এল সেই পরিচিত পেশাদার কঠোরতা। গলায় ফিরে এল সেই পুরনো কঠিন সুর।
“Yes?”
অফিসার এগিয়ে এলেন, হাতে ছোট একটা ডেটা-প্যাড।
“Unidentified vessel spotted near grid point 27-F. HQ is requesting immediate input.”
কল্লোল রিপোর্টটা হাত বাড়িয়ে নিলেন। মনোযোগের সাথে চোখ বুলালেন তাতে।
“Alright.Take initial evasive protocol. Hold the communication until I get to the control deck. I’ll be there in five minutes.”
“OK, sir.”
অফিসার স্যালুট ঠুকে চলে গেলেন নিঃশব্দে।
কল্লোল সেদিন থেকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ঊর্মির দিকে। গলার সুর হঠাৎ নরম হয়ে এল ওর,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
ঊর্মি একটু ইতস্তত করে মাথা হেলাল। ওর চোখে তখন স্পষ্ট অস্বস্তি, “উনি কি এভাবে দেখে ফেলেছেন আমাদেরকে?”
কল্লোল এক মুহূর্ত চুপ করে তাকায় ঊর্মির দিকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলে, “দেখলে কি যায় আসে?”
তারপর এক পা এগিয়ে এসে আরও নিচু স্বরে যোগ করে, “আপনি ভয় পাচ্ছেন?”
ঊর্মি চোখ সরিয়ে নিল ওর উপর থেকে,
“না, ভয় পাচ্ছি না। তবে আপনি তো এখন অন ডিউটিতে…”
কল্লোল এবার গম্ভীর হল, গলায় তার গভীরতা টের পাওয়া যায়, “I will handle, relax!”
তারপর আবার হালকা গলায় বলল, “আর উনি যদি কিছু দেখে থাকেনও— সেটা জাহাজের অফিশিয়াল রেকর্ডে থাকবে না, কথা দিচ্ছি।”
ঊর্মি মুখ ফিরিয়ে সাগরের দিকে তাকায়, কিছু বলে না।
কল্লোল এক ধাপ এগিয়ে এল, ফিসফিস করে বলল,
“আরেকটু হলেই তো পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি না
থাকলে—”
ঊর্মি চোখ কুঁচকে বলল, “আপনার কফিটা ফেলে দেব কিন্তু!”
কল্লোল হেসে ফেলল নরম স্বরে।
“কফি তো সেই কখন শেষ, মিস ঢেউ! তবে চাইলে এই মগদুটো ফেলতে পারেন!” হাতে ধরা মগ দুটোর দিকে ইশারা করলো ও।
তারপর আবার বলল,”আপনার অভিমান ঠিক আপনার কফির মতো— মিষ্টি, কিন্তু কড়া একটা টান আছে! উমমম…”
ঊর্মি তাকিয়ে থাকল ওর দিকে, মুখে রাগ রাগ ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করলেও ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ধরা পড়েই গেল।
কল্লোল এক মুহূর্ত থেমে মৃদু স্বরে বলল,
“আমি যাচ্ছি এখন। কিন্তু আপনি একা এই ডেকে থাকবেন না, ওকে?”
ঊর্মি মাথা নাড়ল।
কল্লোল পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।
কিন্তু হাঁটতে শুরু করে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো ও। পিছন ফিরে ঊর্মির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“…and Urmi, be careful. I already lost you once. Don’t make me go through that again.”
তারপর দ্রুত পা ফেলে মিলিয়ে গেল করিডোরের ওপাশে। ঊর্মি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই, চোখ আটকে রইল সেইদিকে, যেখানে একটু আগেও ছায়ামানবটা দাঁড়িয়ে ছিল। বুকের খুব গভীরে তখনই যেন আছড়ে পড়ল একটা তীব্র ঢেউ।
To be continued…