জলতরঙ্গের সুর পর্ব-২৩+২৪

0
5

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২৩
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

মেডিকেল ইউনিটের করিডোর দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে গেল কল্লোল। সোজা গিয়ে থামল ঊর্মির রুমের সামনে। দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকানোর চেষ্টা করতেই ভেতরের নার্স ওকে দেখে এগিয়ে এল।

“আমি ভেতরে যাচ্ছি,” ইতিমধ্যেই ও হাত রেখেছে দরজার হ্যান্ডেলে।

নার্স এক ধাপ এগিয়ে এসে ওর পথ আটকালেন।
“না, ক্যাপ্টেন। পেশেন্টের এখনো জ্ঞান ফেরেনি।অবজারভেশনে আছে, এই মুহূর্তে ভেতরে যাওয়া যাবে না।”

কল্লোল বিরক্ত গলায় বলল, “আমি শুধু একবার—”

নার্স এবার চোখ নামিয়ে কল্লোলের সাদা ইউনিফর্মের বুকের দিকে ইঙ্গিত করল। সেখানে শুকিয়ে আসা রক্তের খয়েরি দাগ স্পষ্ট।
“আর এভাবে তো একদমই না। এই অবস্থায় ভেতরে গেলে পেশেন্টের ইনফেকশনের রিস্ক হতে পারে।”

কল্লোল এক মুহূর্ত নার্সের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল,“আমি যদি ফ্রেশ হয়ে আসি?”

নার্স একটু থেমে নরম স্বরে বলল,
“তবুও এই মুহূর্তে নয়, ক্যাপ্টেন। ওর কন্ডিশন স্টেবল হলে আমি আপনাকে জানাবো।”

দরজার হ্যান্ডেল থেকে হাত সরিয়ে নিল কল্লোল, কিন্তু বন্ধ দরজার ভেতর দিয়ে ঊর্মির মুখের ওপর থেকে চোখ সরাল না। ওদিকে চোখ রেখেই চিন্তাযুক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,“জ্ঞান ফিরতে এত সময় লাগছে কেন?”

নার্স এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন,
“আঘাত আর শকের কারণে শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন। ভাইটালগুলো আমরা মনিটর করছি, এখনো ওর শরীর রিকভার করার চেষ্টা করছে।”

কল্লোল ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলো,
“কতক্ষণ নাগাদ জ্ঞান ফিরবে?”

নার্স একটু ইতস্তত করলেন, তারপর ধীরে বললেন,
“এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা, কারও ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় লাগতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে পেশেন্টের শরীর কত দ্রুত রেসপন্ড করে তার ওপর।”

নার্সের কথা শেষ হওয়ার পরও কল্লোলের দৃষ্টি স্থির রইল বন্ধ দরজার ওপারে, শব্দগুলো কান দিয়ে ঢুকে বুকের ভেতরের তৈরি করলো একেকটা অস্থির ঢেউ।

_____________________________

ভোরের আলো ফুটেছে। তবে জাহাজে চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত এই বিশেষ কেবিনে দিন-রাতের তফাৎ বোঝা যায় না। সারাক্ষণই ঘরের ভেতর জ্বলছে সাদা আলো।

মনিটরের স্ক্রিনে ছন্দময় ঢেউ। অক্সিজেন মাস্কের নিচে চলছে ক্ষীণ শ্বাস-প্রশ্বাস। বেডের পাশে চুপ করে বসে আছে এক পুরুষ, যার চোখের নিচে রাতভর জেগে থাকার চিহ্ন। প্রেয়সীর হাতটা সে নিয়ে রেখেছে নিজের হাতের মধ্যে। তার চোখ আধবোজা, ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি এক ঘোরে আবিষ্ট সে।

হঠাৎই তার আঙুলে হালকা টান পড়লো।
চমকে তাকাল সে। প্রেয়সীর চোখের পাতাগুলো সামান্য কাঁপছে। তারপর… কয়েকবার পিটপিট করে একটুখানি ফাঁক হলো চোখজোড়া।

সে নিচু হয়ে প্রেয়সীর কানের কাছে মুখ নিয়ে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে ফিসফিস করে ডাকলো,”ঊর্মি?”

ঊর্মির চোখের পাতাগুলো আবার কাঁপলো। অক্সিজেন মাস্কের নিচে ঠোঁট নড়ল অল্প— কিছু বলার মতো, কিন্তু শব্দ ফুটল না। চোখ খুললো একটু, অস্পষ্ট— দৃষ্টি মাথার ওপরের সাদা ছাদ বরাবর মিনিটখানেক স্থির থাকবার পর ধীরে ধীরে তা স্থির হলো কল্লোলের মুখের ওপর।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত।

সেই দৃষ্টিতে ভয় নেই এখন। আছে শুধু ক্লান্তি…
আর পরিচিত মুখটা চেনার অদ্ভুত চেষ্টা।

“ভয় নেই… আমি আছি,” ফিসফিস করল কল্লোল,
“তোমার ক্যাপ্টেন এসেছে লিটল বার্ড।”

ঊর্মি চোখ বন্ধ করলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু নোনতা জল।

কল্লোল অস্থির হলো। বেডের পাশে হাত বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ টানল বেডের অ্যাডজাস্টেবল হেডরেস্টে। বেডের মাথার অংশ ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলো, ঊর্মির শরীর একটু বসার ভঙ্গিতে এসে স্থির হলো।

চোখ মেলে তাকালো ঊর্মি। লাল হয়ে গেছে চোখজোড়া। কল্লোল উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম কন্ঠে বলল,”কাঁদছ কেন লিটল বার্ড? আমি এসেছি না? তোমাকে রেখে আর কখনো কোথাও যাব না, প্রমিস…”

প্রিয় পুরুষের আস্কারা পেয়ে কান্নার গতি বাড়ল মেয়েটার। কান্নার দমকে ফুলে উঠল পিঠ।

অসহায় বোধ করলো কল্লোল। হিতে বিপরীত হলো যে! কান্না কমার বদলে বেড়ে চলেছে! এভাবে কাঁদতে থাকলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে মেয়েটার। মেয়েটাকে থামাবে কি করে ও? এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হয় জানা নেই ওর।

উপায়ন্তর না পেয়ে মুখ নামিয়ে প্রেয়সীর এলোমেলো চুলের ভাঁজে শব্দ করে চুমু খেল ও। এতে খানিকটা কাজ হলো। তবে কান্না থামলেও ফোঁপানি বিদ্যমান এখনো। ক্যাপ্টেন আলতো করে ডাকলো,

“Little bird?”

ঊর্মি উত্তর দিল না। তার বদলে ক্যাপ্টেনের কোমরে নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করলো। মুখ গুজতে চাইল বুকের মধ্যে। তবে অক্সিজেন মাস্কটা বিশেষ সুবিধা করতে দিল না। কেনোলা লাগানো হাতটাতেও টান পড়ছে।

ক্যাপ্টেন খেয়াল করলো সেটা। নিজের কাছ থেকে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিল আস্তে করে। ঝুঁকে পরে চুমু খেলো কপাল ঢেকে রাখা সাদা ব্যান্ডেজের উপরে। ঊর্মি এখনো জানে না এটার ব্যাপারে। জানলে কি প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে।

ঊর্মির কপালে ভাঁজ পড়ল। ক্যাপ্টেন যে কপালে চুমু খেল সেটা অনুভব হলো না কেন? ওর কি বোধশক্তি চলে গেল? ঊর্মির মনে অদ্ভুত ভাবনা এলো।

কয়েক সেকেন্ড কপাল ভাঁজ করে থাকতেই ব্যান্ডেজে টান পড়লো। কাঁচা ক্ষততে টান লাগায় মুহূর্তের মধ্যে হুড়মুড় করে নেমে এলো তীব্র ব্যথার অনুভব।

“আহ্…” নিজের অজান্তেই কপালে হাত চলে গেল ওর। খিঁচে রাখা চোখেমুখে ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট।

“কী হলো ঊর্মি?” বলতে বলতে খেয়াল হলো ওর। কল্লোল এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলো।

“আমার মাথায় কী হয়েছে ক্যাপ্টেন?” জ্ঞান ফেরার পর প্রথমবারের মতো কথা বলল ঊর্মি।

কল্লোল চোখ খুললো,”কিছু না। একটা মাইনর ইনজুরি। Nothing serious.”

“ম-মাইনর ই-ইনজুরি? ক-কীভাবে? আমি তো জ্ঞান হারিয়েছিলাম, ত-তাহলে ই-ইনজুরি হবে কীভাবে?” কিছুক্ষণ থেমে হঠাৎ করে বলল, “র-র-রুবেল ক-ক-কী কি আ-আমাকে…” ভয়াবহ শঙ্কায় জর্জরিত হল নাজুক মন। ঊর্মি আর কিছু বলতে পারল না। তার আগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হলো ওর।

কল্লোল আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত ঊর্মির কাঁধে হাত রাখল,
“শান্ত হও, লিটল বার্ড! তুমি এখন এখানে আমার কাছে আছো, কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। শ্বাস নাও ধীরে ধীরে, আমি তোমার কাছেই আছি।”

ঊর্মির শরীর কাঁপতে শুরু করল, চোখ ফেটে ফেটে জল বেরোল, “ক-ক্যা-ক্যাপ্টেন… আমি… আমি…”
ও ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে ওর।

কল্লোল তাড়াতাড়ি ঊর্মির মাথার নিচের বালিশটা সোজা করল, আর আরেক হাত দিয়ে ওর কাঁধে আলতো চাপ দিল,”কথা বলো না, লিটল বার্ড! শান্ত থাকো প্লিজ! আমি ডক্টরকে ডাকছি…”

———-

নার্স অক্সিজেন মাস্কের স্ট্র্যাপটা ঠিক করে দিয়ে দেয়ালের পাশে লাগানো ফ্লো মিটার ঘুরিয়ে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়িয়ে দিল। অন্য নার্স মনিটরে চোখ রেখে হার্টবিটের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করছে।

সিনিয়র ডাক্তার কড়া সুরে ধমকালেন কল্লোলকে, “পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে সেটা আমাদেরকে ইনফর্ম করেননি কেন? তাছাড়া এতক্ষণ ধরে পেসেন্টের কাছে থাকা strictly not allowed. আপনাকে নিষেধ করা হয়েছিল না?”

কল্লোল জবাব দিল না।

ডাক্তার এবার বিরক্ত স্বরে বললেন,
“ক্যাপ্টেন, এতক্ষণ ধরে এখানে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। পেশেন্টের জন্য এটা চাপের কারণ হতে পারে। Please go outside.”

কল্লোল একবার ঊর্মির দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। ওই অবস্থাতেই মাথা দুপাশে নাড়িয়ে ইশারা করল, বলতে চাইলো ‘যেও না’।

মেয়েটার মানসিক অবস্থা এখন অতীব দুর্বল। কল্লোল ওর হাতটা শক্ত করে ধরে নরম গলায় বলল,“আমি তোমার কাছেই আছি, ঊর্মি। কিন্তু ডক্টর ঠিকই বলছেন, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি…”

ঊর্মি আবার মাথা নাড়ল, ‘না, যেতে হবে না।’
কল্লোল আলতো করে ওর কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
“শান্ত হও প্লিজ!”

ডাক্তার পেছনে থেকে তাড়া দিলেন,“Please, captain…”

কল্লোল শেষবার ঊর্মির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“আমি এখানেই আছি, খুব তাড়াতাড়ি আসব।”

কল্লোল দরজার দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে একবার ঘুরে তাকাল— ঊর্মির চোখ দুটো থমথমে, ভেজা। সেখানে শব্দহীন অনুরোধ— যেও না…

ও বের হতেই স্লাইডিং ডোর বন্ধ হয়ে গেল আস্তে করে।
ঘরের ভেতর হঠাৎ যেন আলোটা কেমন ম্লান হয়ে গেল।
ঊর্মির বুকের ভেতর কেমন ঠাণ্ডা একটা শূন্যতা নেমে এলো। চোখে জল জমে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবু ওর চোখ বারবার যাচ্ছে দরজার দিকে।

হার্ট মনিটরের বিট কিঞ্চিৎ দ্রুত হতে শুরু করল।
নার্স নরম গলায় বললেন, “মিস, প্লিজ রিল্যাক্স…”
কিন্তু ঊর্মির মাথা নাড়ছে— না, ক্যাপ্টেনকে ছাড়া কিছুতেই শান্ত হওয়া যাচ্ছে না।

অক্সিজেন মাস্কের নিচে শ্বাস ছোট ছোট হয়ে আসছে।
ওর আঙুলগুলো বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে
ধরেছে— যেন কোনো অদৃশ্য হাত ধরে রাখার চেষ্টা।

ডাক্তার এবং দুজন নার্স একে অপরের দিকে তাকালেন। একজন বললেন, “ক্যাপ্টেনকে ভেতরে আনতে হবে… নইলে ওকে শান্ত রাখা মুশকিল, স্যার।”

ডাক্তার সামান্য বিরক্ত স্বরে সম্মতি দিলেন, “Go.”

নার্স দ্রুত দরজার বাইরে গিয়ে ডাকল,“ক্যাপ্টেন!”

কল্লোল ঘুরে দাঁড়াতেই নার্স বললেন, “ও আপনাকে খুঁজছে… আপনাকে ছাড়া শান্ত হচ্ছে না।”

কল্লোলের চোখ এক মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। নার্সের সাথে দ্রুত কেবিনে ঢুকে এল ও।

ঊর্মি ওকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল— চোখে আতঙ্ক আর একরাশ স্বস্তি একসাথে মিশে আছে ওর। কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিল ও।

কল্লোল এক লাফে বেডের পাশে গিয়ে ওর হাত মুঠো করে ধরল, “আমি তো বলেছিলাম, আমি এখানেই আছি, লিটল বার্ড… তুমি এমন করছো কেন?”

ঊর্মি উত্তর দিল না— শুধু মুঠোটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল, যেন এক মুহূর্তের জন্যও হাতটা ছাড়তে চাইছে না। অক্সিজেন মাস্কের ভেতর দিয়ে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। মনিটরের দ্রুত বেজে ওঠা বিপ বিপ ধীরে ধীরে আবার নিয়মিত হলো।

ডাক্তার পেছন থেকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন— স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ক্যাপ্টেনকে সরানো এখন অসম্ভব।
নার্স হালকা গলায় বললেন, “স্টেবল হচ্ছে, স্যার।”

কল্লোল নরম কণ্ঠে বলল, “শান্ত হও… আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

ও হাত দিয়ে ঊর্মির এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিল।ঊর্মির চোখ আধবোজা, সেই দৃষ্টিতে স্বস্তি স্পষ্ট।

ডাক্তার কল্লোলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ক্যাপ্টেন, উনি আপনাকে আঁকড়ে ধরেছেন ঠিক আছে… কিন্তু আমাদের কাজ করতে হবে। কপালের সেলাই দেওয়া ক্ষতটা চেক না করলে ইনফেকশনের ঝুঁকি আছে।”

কল্লোল মাথা নাড়ল, “আপনি যা দরকার করুন।”

নার্স গ্লাভস পরে সাবধানে ব্যান্ডেজ খুলল। সাদা গজের ভেতর লালচে ছোপ দেখা যাচ্ছে। ব্যান্ডেজ তোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঊর্মি কুঁকড়ে উঠল। সেলাই পরীক্ষা করতে করতে ডাক্তার নরম গলায় বললেন, “একটু লাগবে…”

নার্স আস্তে আস্তে অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করল। তারপর আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ করা হলো।

ডাক্তার আবার কল্লোলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“উনি বেশ অস্থির। জাহাজ নোঙরের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে, আমরা পোর্টে পৌঁছালে ওনাকে ট্রান্সফার করব। তার আগে ওনাকে রেস্টে রাখা দরকার… কাল থেকে অনেক ধকল গেছে। সিডেটিভ দেব।”

সিডেটিভের অর্থ পরিষ্কার হলো না ঊর্মির কাছে।কল্লোলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো ও।

কল্লোল ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। ডাক্তার ওর সম্মতি পেয়ে নার্সকে ইশারা করলেন।

নার্স পেছন ফিরে সিরিঞ্জ রেডি করছেন। ঊর্মি কল্লোলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ওর চোখে অস্থিরতার ছাপ।

কল্লোল ঊর্মির দিকে একবার তাকালো। কিছু বলল না।
নার্স সিরিঞ্জ হাতে বেডের অপর পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঊর্মি নার্সের হাতের সিরিঞ্জ দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো।

পরপর মাথা ঘুরিয়ে কল্লোলের দিকে তাকিয়ে ওর হাত শক্ত করে খামচে ধরলো। দুদিকে অনবরত মাথা নেড়ে বলল, “ই-ইনজেকশন… ন-না…”

কল্লোলের চোখে দুশ্চিন্তা ঝলকালো। ও নরম কন্ঠে বলল, “কিচ্ছু হবে না… তুমি চোখ বন্ধ করো।”

ঊর্মি শুনলো না। চোখ বড় বড় করে কল্লোলের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে শুরু করল।
“ন-না… ন-না…” অনবরত দুপাশে মাথা নাড়ছে মেয়েটা। ইনজেকশনে প্রচুর ভীতি ওর।

নার্স কল্লোলকে ইশারা করলেন। ও ঊর্মির হাতটা ধরল শক্ত করে‌, চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল, “একটু ধৈর্য ধরো, ব্যথা লাগবে না…”

নার্স অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করলেন। ইনজেকশনের ঠান্ডা সুচ প্রবেশ করল বাহুর শিরায়।

ঊর্মি কেঁপে উঠলো, আরো জোরে খামচে ধরলো কল্লোলের হাতের কব্জি, “আ-আ-আহ…”

কল্লোল ওর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ভয় নেই… আর কিছু হবে না।”

মুহূর্তেই ইনজেকশন শেষ হলো, ঠান্ডা সুচ বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। নার্স ব্যান্ডেজ লাগালেন, ঊর্মি চোখ বন্ধ করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল, কল্লোলের হাতটা ছাড়ল না। কল্লোল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “দেখেছো? শেষ হয়ে গেছে… you are a brave girl.”

ঊর্মি এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ল, চোখের কোণে পানি জমেছে, নড়াচড়া করছে না আর।

কল্লোল হাত বাড়িয়ে ওর চোখের কোণ মুছে দিল। ওর চোখের পাতা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে। সিডেটিভ কাজ করতে শুরু করেছে— নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে। হাতের মুঠোয় থাকা কল্লোলের হাতটা এখনো এত শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই ওর ক্যাপ্টেন পালিয়ে যাবে।

কল্লোল ওর আরেক হাত দিয়ে ঊর্মির মাথায় হাত বুলাচ্ছে অনবরত।

গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ঊর্মি চোখ আধখোলা হলো, নিশ্চিত হতে চাইল ক্যাপ্টেন এখনো সঙ্গে আছে কি না। দেখে নিয়ে আবার ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল চোখজোড়া। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে রাজ্যে।

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২৪ [রোমান্টিক এলার্ট ‼️]
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

জাহাজের ডেকে সকালের আলো পড়ছে, নীল জলরাশির সঙ্গে মিশে ক্রমশ কেমন সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। নোঙ্গর ফেলার প্রস্তুতি ত্বরান্বিত। ক্রুরা নিজেদের নির্ধারিত অবস্থানে। লোহার চেইন, হুইন্ডল, কেবলগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে, প্রত্যেকটি অংশে রাখা হয়েছে সজাগ দৃষ্টি।

কল্লোল ক্রুদের একের পরের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে,
কেউ ভুল করলে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিয়ে তা ঠিক করে দিচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার মন মানসিকভাবে দু’ভাগে বিভক্ত— একদিকে দায়িত্ব, অন্যদিকে প্রেয়সীর দিকে অদৃশ্য টান।

ডেকের বাতাস ঠাণ্ডা, কিন্তু কল্লোলের পড়নের ইউনিফর্মে ভিজে আসা ঘাম ছাপ ফেলেছে। তার চোখ বারবার ডেকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, ক্রুদের কার্যক্রম মনিটর করছে। জাহাজের আকার বড়, কিন্তু এই মুহূর্তে মূল ডেকের প্রতিটি কোণ যেন কল্লোলের চোখে জীবন্ত।

কল্লোল আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস নিল।
প্রস্তুতি প্রায় শেষ। নোঙর শিগগিরই নামবে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ও আবার ফিরে যাবে ঊর্মির কাছে।

জাহাজ অবশেষে নোঙর করল।
ডেকে শেষ কিছু নির্দেশ দিয়ে কল্লোল দ্রুত কেবিনের দিকে রওনা হলো— মন ওর সেখানেই পড়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে।

__________________________________

কল্লোল সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল, এমন সময় করিডোরের মোড়ে দেখা হয়ে গেল নিশাত, তানিয়া আর মেহরিনের সঙ্গে।

তিনজনই ওকে দেখে উৎকণ্ঠিত মুখে এগিয়ে এল।
“আপনাকেই খুঁজছিলাম ক্যাপ্টেন। ঊর্মি কেমন আছে?” নিশাতের গলায় দুশ্চিন্তার ছাপ।

“জ্ঞান ফিরেছে, তবে শরীর দুর্বল। প্যানিক করছিল, ডাক্তার সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।” কল্লোল শান্ত উত্তর দিল।

তানিয়া দ্রুত বলল, “আমরা কি দেখা করতে পারি?”

“এখন তো ঘুমাচ্ছে। এখান থেকে হসপিটালে ট্রান্সফার করবেন ডাক্তাররা।”

পাশ থেকে মেহেরিন বলল, “ওর বাড়িতে একটা খবর দেয়ার দরকার ছিল কি?”

নিশাত বাধা দিল তাতে, “কিন্তু ঊর্মি তো আমাদের ট্রিপের কথাটা বাড়িতে জানায়নি বোধহয়!”

কল্লোল ভ্রু কুঁচকে নিশাতের দিকে তাকালো।
“তাহলে আপাতত জানানো যাবে না। অযথা চিন্তা বাড়বে।”

“কোন হসপিটালে শিফট করা হবে, ক্যাপ্টেন? আমরা কি থাকতে পারবো?”

কল্লোল মাথা নাড়ল, “নিকটস্থ নেভির হসপিটালে। থাকার প্রয়োজন নেই, তোমাদের ঝামেলা বাড়বে। আমি থাকবো ওর সাথে। Don’t worry.”

নিশাত আর তানিয়া একটু ইতস্তত করে মাথা নাড়ল, মেহেরিনও শান্ত মুখে মেনে নিল।

তানিয়া বলল, “কিন্তু… জাহাজ তো নোঙর করেছে, ফিরে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাই। ওকে এভাবে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না, ক্যাপ্টেন।”

কল্লোল একটু সময় নিল, “ওর প্রতি তোমাদের ভালোবাসাটা বুঝতে পারছি… কিন্তু চিন্তা করো না, ও ঠিকঠাক থাকবে। আমি আছি ওর পাশে। খুব তাড়াতাড়ি্ ঠিক হয়ে যাবে ও। এবার যেতে হবে— নোঙ্গর হয়েছে, কাজ শেষ করতে হবে। দেখা করবে বলছিলে, এসো… কিন্তু কথা বলতে পারবে না, ঘুমাচ্ছে তো!”

কল্লোল ওদের তিনজনকে নিয়ে ঊর্মির কেবিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“তোমরা ওর কথা এত ভাবছ, তার বিপরীতে রুবেল কীভাবে এতটা সাহস দেখালো? ঊর্মির সাথে রুবেলের সমস্যাটা কি?”

নিশাত, তানিয়া আর মেহেরিন একে অপরের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। কী বলবে বুঝতে পারল না ওরা।

শেষে নিশাত ধীরে বলল, “ক্যাপ্টেন, আমরা জানি না পুরো ব্যাপারটা ঠিক কী, তবে খুব সম্ভবত রুবেল ঊর্মিকে পছন্দ করে… আমাকে রুবেল একবার এরকমই কিছু বলেছিল।”

নিশাতের কথা শোনার সাথে সাথে কল্লোল দাঁড়িয়ে পড়লো। গভীর নিশ্বাস নিয়ে উথলে আসা রাগটাকে সামলানোর চেষ্টা করল। এই মুহূর্তে মাথা গরম করলে বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে যাবে।

কল্লোলকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ভীত হলো ওরা তিনজনই। কেউ কোন প্রশ্ন করার আগেই কল্লোল মুখ খুলল সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে, “উম… তোমাদের ট্রিপটা মেইনলি কোন জায়গার ছিল? তোমরা সেন্ট মার্টিন থেকে বোটে করে কোথায় যাচ্ছিলে সেদিন?”

প্রসঙ্গ এভাবে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়াতে বেশ ভালোই অবাক হলো ওরা। তবে অবাকের রেশ কাটিয়ে এবার উত্তর দিল মেহেরিন, “সেন্ট মার্টিন থেকে কিছুটা দূরে একটা শান্ত, নির্জন দ্বীপের কথা বলেছিল রুবেল। ওখানেই যাচ্ছিলাম আমরা।”

কল্লোলের ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনি। নির্জন দ্বীপ?

কল্লোল কোন প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই একজন নার্স এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে।

“ক্যাপ্টেন, ডক্টর আপনাকে ডেকেছেন।”

“ঊর্মি কি জেগে গেছে?” নার্সকে প্রশ্ন করল কল্লোল।

নার্স মাথা নাড়লেন, “না, এখনই তো জাগবে না। ডক্টর ট্রান্সফারের ব্যাপারে কথা বলার জন্য ডেকেছেন আপনাকে।”

“Okay. Let’s go.”

___________________________________

বিকেলের নরম আলো হালকা স্বচ্ছ জানালা দিয়ে এসে পড়েছে বেডের শেষ প্রান্তে। ঊর্মির চোখদুটো অল্প খুলে আবার বন্ধ হলো, আলোর তীব্রতা থেকে বাঁচতে ডান হাতের উল্টো পিঠ উঠে এলো চোখের উপর।

কিছু সময় পর হাত সরিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলল ও। চারপাশ লক্ষ্য করে দেখলো জায়গাটা নতুন- সম্ভবত হসপিটাল। কেবিন খালি, ডাক্তার বা নার্স কেউ নেই। ঊর্মি নিঃশব্দে চেষ্টা করল বালিশ থেকে মাথা একটু তুলে উঠে বসার, কিন্তু শরীর সায় দিল না।

“ঊর্মি?”

শব্দের উৎস অনুসরণ করে পেছন ফিরল ও।

“কখন উঠেছ?” বলতে বলতে কল্লোল এগিয়ে এলো বেডের দিকে।

“বসবে?”

ঊর্মি মাথা নাড়লো উপর নিচ।
কল্লোল ওর মাথার কাছে এসে এক হাত আলতো করে পিঠের নিচে রাখল, “ওঠ…আস্তে…”
সাবধানে আধবসা করে তুলে পিঠের পেছনে বালিশ গুঁজে দিল।

“এখন কেমন লাগছে?” দৃষ্টি ঊর্মির মুখে স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল ও।

ঊর্মি কয়েক সেকেন্ড চুপ রইল, তারপর বলল,
“ভালো… কিন্তু মনে হচ্ছিল আপনি ছিলেন না অনেকক্ষণ।”

কল্লোলের ঠোঁটে হাসি ফুটল, “আমি তো আছি, লিটল বার্ড… কোথাও যাইনি।”

ঊর্মি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কল্লোল আবার বলল, “পানি খাবে?”

মাথা নাড়ল ও। কল্লোল ওর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিয়ে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলো ওর ঠোঁটের কাছে। ঊর্মি ছোট ছোট চুমুক দিল তাতে। পানি খাওয়া শেষ হলে কল্লোল ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ হতে সাহায্য করল। বিছানায় এসে বসামাত্র দরজায় মৃদু শব্দ হলো।

ঊর্মি তখন বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে, পাশে বসা কল্লোলের চোখ ওর দিকে নিবদ্ধ। দরজায় শব্দ হওয়াতে দুজনই তাকালো সেদিকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন একজন নার্স, হাতে ট্রে আর কিছু মেডিকেল ইকুইপমেন্ট।

“গুড আফটারনুন, মিস ঊর্মি,” তারপর কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এক্সকিউজ মি… পেশেন্টের চেক-আপ করতে হবে,স্যার। আপনাকে কাইন্ডলি একটু বাইরে যেতে হবে।”

কল্লোল চোখের কোণা দিয়ে ঊর্মির দিকে তাকাল।
ঊর্মি সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়তে চাইল— ও যেন না যায়।

কল্লোল ওর হাতে আলতো করে চাপ দিল, নিচু স্বরে বলল,“আমি এখানেই আছি। দরজার ঠিক বাইরে।”

ঊর্মি কিছু বলতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে বলল না।
কল্লোল উঠে দাঁড়িয়ে পা ফেলে বেরিয়ে গেল দরজার বাইরে।

নার্স ট্রে নামিয়ে রাখলেন বেডসাইড টেবিলে।
স্টেথোস্কোপ কানে গলিয়ে কাছে এগিয়ে এলেন।

“শ্বাস নিন… গভীরভাবে…”
ঊর্মি চেষ্টা করল, কিন্তু বুক কেমন ভারী মনে হচ্ছে। নার্স বুঝতে পেরে আশ্বস্ত করলেন,“নরমালি শ্বাস নিন, ঠিক আছে।”

স্টেথোস্কোপ সরিয়ে প্রেশার চেক করে কপালের ব্যান্ডেজটা দেখলেন। ব্যান্ডেজটা সাবধানে খুলে নতুন গজ-ড্রেসিং করে দিলেন। ঊর্মি ব্যথায় চোখ কুঁচকাল।

“আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে, মিস। চিন্তা করবেন না, ইনফেকশনের ঝুঁকি নেই। সেলাই ক’দিন পর কেটে ফেলা হবে।”

ঊর্মি উত্তর দিল না। চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কল্লোলকে ছাড়া ভালো লাগছে না।

নার্স রেকর্ড নোট করে বললেন,
“শরীরের দুর্বলতার জন্য আরেকটা ফ্লুইড শুরু করছি। এতে দুর্বলতা কাটবে।”

স্ট্যান্ডে নতুন স্যালাইন ঝুলিয়ে ভিটামিনের একটা ডোজ মিশিয়ে লাইনের সাথে কানেক্ট করলেন। ঊর্মি নিঃশব্দে চোখ বুজল, সুঁইয়ের খোঁচা সহ্য করল বিছানার চাদর খামচে।

নার্স নরম স্বরে বললেন,
“টেক রেস্ট। স্যারকে পাঠাচ্ছি, বাইরে অপেক্ষা করছেন।”

“স্যার,” নার্স বেরিয়ে এসে কল্লোলকে জানাল, “সব ঠিক আছে। আপনি ভেতরে যেতে পারেন, তবে সাবধানে।খেয়াল রাখবেন, পেশেন্ট যেন উত্তেজিত না হন।”

কল্লোল সম্মতি জানিয়ে দরজার দিকে এগোল। দরজা ধীরে ধীরে খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল ঊর্মি চোখ বন্ধ করে আছে। নিঃশব্দে বেডের পাশে বসে কল্লোল ওর হাতের ওপর আলতো করে হাত রাখল।

“ঊর্মি?”

ঊর্মি চোখ খুলল।

“বোকা মেয়ে, তুমি আবার কেঁদেছ?” কল্লোল হাত বাড়িয়ে ওর চোখের কোণায় জমে থাকা পানিটা মুছে দিল সযত্নে।

ঊর্মি চোখ কুঁচকে ক্যানোলা লাগানো হাতটা দেখাল, “হাতে ব্যাথা…”

কল্লোল ওর হাতটায় ঠোঁট ছোঁয়ালো, “ক্যানোলার জন্য একটু ব্যথা লাগছে, ঠিক হয়ে যাবে সুইটহার্ট।”

ঊর্মি মৃদু হাসল। তারপর বলল, “নিশাতরা চলে গেছে?”

“হু, থাকতে চেয়েছিল, আমি নিষেধ করেছি।”

“আর রুবেল?”
প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে কল্লোলের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হওয়াটা স্পষ্ট দেখল ঊর্মি। চোয়াল শক্ত হয়েছে পুরুষটার।

“খবরদার, ওই বাস্টার্ডটার নাম উচ্চারণ করবে না তুমি। It’s my first and last warning.”

ঊর্মি এ নিয়ে দ্বিরুক্তি করল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“আমার মাথায় আঘাতটা কীভাবে হয়েছে সেদিন বলেলনি আপনি!

কল্লোল এক পলক মেয়েটার দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“দরজাটা খোলার সময় ধাক্কা লেগেছিল। তুমি দরজার পাশের মেঝেতে পড়েছিলে।”

ঊর্মি চুপচাপ কল্লোলের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কল্লোল ঝুঁকে এসে ওর কপালের উন্মুক্ত অংশে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করলো ঊর্মি। ওভাবেই বলল,
“আমি… আমি ভয় পেয়েছিলাম… ক্যাপ্টেন…”

“আমি জানি সুইটহার্ট। কিন্তু এখন তো সব ঠিক আছে, আমি আছি তোমার কাছে, তাই না?” কোমল কন্ঠে ওকে আশ্বস্ত করতে চাইল কল্লোল।

ঊর্মি চোখ খুলে উপর-নিচ মাথা নাড়লো দ্রুত গতিতে।
“সবসময় আমার কাছে থাকবেন তো?” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।

কল্লোল জবাব দিল না। তার বদলে পকেট থেকে চৌকোনাকৃতির একটা বক্স বের করল। বক্সের ঢাকনা খুলে বাড়িয়ে ধরল ঊর্মির দিকে।

“Will you marry me, my little bird?”

ঊর্মি বিষ্ময়ে অভিভূত হলো। চোখ বড় বড় হয়ে ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে গেল আপনাআপনি। শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো সেই মুহূর্তেই। কল্লোল বক্সটা টেবিলের ওপর রেখে ওর পিঠের পিছে বালিশ দিয়ে ধীরেসুস্থে উঠে বসালো।

“ক্যাপ্টেন…?”

“বলো, সুইটহার্ট!”

“আপনি এটা কখন আনলেন?” বক্সে জ্বলজ্বল করতে থাকা ডায়মন্ড রিংটার দিকে ইশারা করে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ঊর্মি।

হাসলো কল্লোল। ঊর্মি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো সেই হাসির দিকে। হাসলে পুরুষটাকে এত সুদর্শন লাগে কেন!
মনে হয় এই হাসির দিকে তাকিয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যাবে।

“তোমার পছন্দ হয়নি?” কল্লোলের কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভাঙলো ঊর্মির।

“হ-হয়েছে তো! খুউউউউউউউবব পছন্দ হয়েছে।”

কল্লোল হাত বাড়াল, “So will you marry me?”

“Yes!” ফিসফিসিয়ে জবাব দিল কল্লোলের প্রেয়সী, প্রায় না শোনার মত করেই। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিল কল্লোলের হাতের ওপর।

কল্লোল প্রেয়সীর নরম হাতখানা ধরলো উষ্ণ স্পর্শে। ঊর্মির হাত একটু একটু কাঁপছে, কল্লোল সযত্নে রিংটা পড়িয়ে দিল প্রেয়সীর অনামিকায়। পরপর ঠোঁট ছোঁয়ালো সেথায়। মৃদু তরঙ্গ প্রবাহিত হলো তার প্রেয়সীর শরীরজুড়ে।

ঊর্মি এতক্ষণ ধরে আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো। রিংটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মুগ্ধকন্ঠে বললো, “It’s beautiful!”

“Not more than you!”
কল্লোলের মোহগ্রস্ত স্বরে থমকে যেতে হল ওকে।
চোখ তুলে দেখল কল্লোল নেশালো চাহনিতে তাকিয়ে আছে ওর পানে। এই চাহনির অর্থ বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না ওকে। আগেও একবার এরকম চাহনির সাথে পরিচয় হয়েছে ওর। সেই স্মৃতি মনে পড়াতে ভেতর ভেতর খানিকটা সিঁটিয়ে গেল ও।

“Can I kiss you, little bird?” হাস্কি স্বরে জানতে চাইল কল্লোল।

ঊর্মির হৃৎপিণ্ডটা ধক্ করে উঠলো আচমকা। ও চোখ বড় করে কল্লোলের দিকে তাকালো। প্রথমবারের স্মৃতি ভেসে উঠল মানসপটে— কল্লোলের আকস্মিক ঘনিষ্ঠতা আর প্রথম ঘনিষ্ঠ স্পর্শের ভয়মিশ্রিত উত্তেজনা অস্থির করেছিল ওকে।

“Answer me, sweetheart!” কল্লোলের অধৈর্য কন্ঠস্বর ভাবনায় ছেদ ঘটালো।

সংকোচ থাকা সত্ত্বেও মৃদু কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে সম্মতি দিল ঊর্মি, “okay… but…”

কথা সম্পূর্ণ করার সুযোগ হলো না। তার আগেই অধৈর্য পুরুষ হামলা চালিয়েছে প্রেয়সীর তুলতুলে ঠোঁটের ওপর।

ঊর্মি হকচকিয়ে গেল। মার্বেল আকৃতির চোখ দুটো নিবদ্ধ করলো আপাতত চোখ বন্ধ করে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে থাকা অধৈর্য পুরুষটার উপর। প্রেয়সীর সম্মতি পেয়ে দিন-দুনিয়া ভুলে বসেছে সে। এটা একটা হসপিটালের কেবিন এবং যেকোনো সময় এখানে
যে কেউ চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে- এই জাতীয় কোন কিছুই তার মাথায় নেই আপাতত। নার্সের সতর্কবার্তাও সে ভুলে বসেছে বেমালুম।

কল্লোলের ইউনিফর্মের বুকের কাছটায় খামচে ধরলো‌ ঊর্মি। ওর নিঃশ্বাস যখন প্রায় বন্ধ হবার জোগাড় তখন কল্লোল ছাড়লো ওকে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো প্রেয়সীর নাজুক মুখপানে। সে বেচারির আজকেও একই অবস্থা হয়েছে- নিঃশ্বাস নিতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

কল্লোল ধীরে ধীরে সরে বসল ওর কাছ থেকে। ফিসফিসিয়ে বললো, “Calm down, sweetheart!”

ঊর্মি ধীরে চোখ খুলল, সামলাতে চেষ্টা করল বুকের অনিয়ন্ত্রিত ওঠা-নামা।

“আ-আ-আপনি খুব খ-খারাপ আ-আবরার!”
কোনোরকমে বলল ও।

কল্লোল হাসলো, “I know sweetheart!”

ঊর্মি রেগে মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।
“নির্লজ্জ লোক!”

কল্লোল হেসে ওর কাছে ঝুঁকল, কানে ফিসফিস করে বলল, “এখনই নির্লজ্জ বলছেন? নির্লজ্জতার কিছুই তো এখনো দেখালাম না, ম্যাডাম! তবে চিন্তা করবেন না, খুব তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দেব, নির্লজ্জতা ঠিক কাকে বলে…”

কেঁপে উঠল ঊর্মি। গলার ভেতরটা শুকিয়ে এলো। ও চোখ না ঘুরিয়েই কাঁপা কণ্ঠে বলল, “দূরে থাকুন… আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি না।”

কল্লোল হাসি চাপার চেষ্টা করল। মেয়েটার ভয় আর লজ্জার মিশ্র প্রতিক্রিয়া ওর কাছে অপূর্ব লাগছে।
“তুমি না চাইলে আমি কখনো জোর করব না, সুইটহার্ট।কিন্তু…” অদ্ভুত হাসল ও, “…যখন চাইবে, remember that, I don’t know to stop.”

হৃদস্পন্দন অস্থির হয়ে উঠল আবার। ঊর্মি সেদিনের স্মৃতি মনে করে থমকে গেল—
প্রথমবার যখন ওর ঠোঁটে অনবরত দাবি নিয়ে নেমে এসেছিল পুরুষটা, তখন সে সত্যিই থামেনি। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, বুক ধড়ফড় করছিল, অথচ এই পুরুষ যেন সমস্ত পৃথিবী ভুলে গিয়েছিল। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।

ওর গলা শুকিয়ে এল, হাতের আঙুল কাঁপতে শুরু করল। ফিসফিসিয়ে বলল,”চুপ করুন অসহ্য পুরুষ!”

কল্লোল হাসল প্রশান্তির সঙ্গে। নেশাভরা চোখে চেয়ে রইল প্রেয়সীর দিকে। হাত বাড়িয়ে আলতো করে প্রেয়সীর গাল ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল, “আমি সেই অসহ্য পুরুষ, যাকে ছাড়া তুমি এক মুহূর্তও থাকতে পারো না, my little bird!”

ঊর্মি চোখ বন্ধ করল, গাল জ্বলে উঠল আগুনের মতো। ভেতরটা কেমন করে উঠল অচেনা শিহরণে। সাঁঝের আলো তখন কেবিনজুড়ে মৃদু সোনালি ছায়া ফেলছে ধীরে ধীরে।

কেবিনের জানালা দিয়ে আসা সোনালি ছায়া ঊর্মির মুখে পড়ে অদ্ভুত দীপ্তি এনে দিল। কল্লোল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল— ওর চোখ বন্ধ, বুক ওঠা-নামা করছে দ্রুত ছন্দে, আর গালের লালাচে আভাটা যেন ওকে আরও অপরূপ করে তুলেছে।

কল্লোলের আঙুল আলতো করে গাল বেয়ে নামল, থেমে গেল চিবুকে এসে।
“ঊর্মি…” মোহময় কন্ঠে ডাকলো ও।

ঊর্মি ধীরে চোখ মেলে তাকাল ওর পানে। দৃষ্টি কাঁপছে ওর, কিন্তু তাতে অস্বীকারের কোনো চিহ্ন নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো— সাঝঁবেলার এই সোনালি আলো, নীরব কেবিন, আর ওরা দু’জন ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।

এই বিশেষ মুহূর্তটায় ওর চোখে চোখ রেখে কল্লোল মোহগ্রস্তের ন্যায় বলল,“তুমি আমার, শুধুই আমার… ঊর্মি!”

To be continued…