#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ২৯
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
কল্লোলের গার্ডিয়ান হিসেবে ঊর্মির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেন ওর ফুপি, রাহেলা চৌধুরী। একসময় ঢাকার নামকরা মহিলা কলেজের প্রফেসর ছিলেন তিনি। বয়স এখন পঞ্চাশের ঘরে হলেও কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আজও অপরিবর্তিত।
কল্লোলের বাবা-মা যখন এক দুর্ঘটনায় মারা যান, তখন ও সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। হঠাৎ এত বড় শূন্যতায় ভেঙে পড়া ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন রাহেলা চৌধুরী। নিজের দুই সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন ভাতিজাকে।
কলেজের দু’বছর ফুপির কাছে থেকে পড়াশোনা করে এইচএসসি শেষ করে কল্লোল। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। দেশের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছে ওকে নিয়ে যায় নেভির পথে।
আজও কল্লোলের জীবনে রাহেলা চৌধুরীর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কিংবা ব্যক্তিগত সংকটে, ফুপির কথাগুলোই ওকে ভরসা জুগিয়েছে বারবার।
_________________________________
সেদিন বিকেলে কল্লোল ঊর্মিকে নিয়ে গেল ধানমন্ডির পুরনো দোতলা বাড়িটায়। লাল ইটের দেয়ালে মানানসই সাদামাটা সাজসজ্জা, আভিজাত্য যেন ঠিকরে পড়ছে প্রতিটি কোণা থেকে।
দরজা খুলতেই একজন শান্ত মুখের নারী এগিয়ে এলেন। ধূসর শাড়ি আর কপালের ছোট্ট টিপটা যেন ফুটিয়ে তুলছে তার ব্যক্তিত্বকে।
“আসসালামুআলাইকুম, ফুপি।” কল্লোল হাসি মুখে সালাম দিল। রাহেলা চৌধুরী সালামের উত্তর দিলেন, তারপর দৃষ্টি থামল ঊর্মির দিকে।
ঊর্মিও সালাম দিল, “আসসালামুআলাইকুম…”
“ওয়াআলাইকুম আসসালাম, মা। ভেতরে এসো তোমরা…” রাহেলা চৌধুরী ওদেরকে ভেতরে আসতে বললেন।
তারপর লিভিং রুমের সোফায় বসতে বসতে বললেন, “কেমন আছো ঊর্মি? কল্লোল কিন্তু তোমার কথা আমাকে আগেই বলেছে…”
দেখতে গম্ভীর মনে হলেও কথাবার্তা শুনে ওনাকে ভালো লাগল ঊর্মির। ও হেসে জবাব দিল, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন ফুপি?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ!
কল্লোল পাশে থেকে মৃদু হাসল, “ফুপি, তোমার সাথে ঊর্মির পরিচয় করাতেই চেয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের একসাথে দেখা করানোর ইচ্ছা ছিল।”
রাহেলা চৌধুরী হাসলেন, “তোমার পছন্দের ওপর আমার বিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম তুমি যাকে পছন্দ করবে সে তোমার জন্য একদম পারফেক্ট হবে।” তারপর একটু থেমে বললেন, “তোমাদের দুজনকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে…”
ঊর্মি লজ্জা পেল এবার। ঠোঁটের কোণে খেলে গেল হালকা হাসির রেখা। কল্লোল পাশ থেকে তাকিয়ে দেখছিল ওর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি।
চা-নাশতা টেবিলে এলো। কল্লোল নিজের মতো নাস্তা খাচ্ছে, রাহেলার চোখ মাঝে মাঝেই আটকে যাচ্ছে ঊর্মির দিকে।
একটু পরে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঊর্মি, কল্লোলকে তুমি কেমন মানুষ বলে মনে করো?”
অপ্রস্তুত হয়ে গেল ঊর্মি। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নরম গলায় বলল, “আসলে… ওর বাহিরটা যতটা শক্ত দেখায়, ভেতরে ততটা নয়। অনেক কোমল, অনেক সংবেদনশীলও। তবে কাউকে সহজে বুঝতে দেয় না।”
রাহেলা মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন, “একদম ঠিক ধরেছো। ছোটবেলা থেকেই ওর এমন স্বভাব। ওর আব্বু-আম্মু চলে যাওয়ার পর তো আর কাউকে মন খুলে কিছুই বলতে চাইত না। বাইরে থেকে শক্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ একা।”
ঊর্মির চোখ নামিয়ে নিলো টেবিলের দিকে। বুকের ভেতর হালকা একটা ব্যথা টের পেল ও।
“আমি শুধু এটুকুই চাই,” রাহেলা এবার হাত বাড়িয়ে আলতো করে ওর হাতটা ধরলেন, “তুমি যেন ওকে আগলে রাখো। ওকে বোঝো, ওর পাশে থাকো। কল্লোল কারো কাছে খুব সহজে মন খোলে না… কিন্তু একবার যদি কাউকে আপন করে নেয়, তবে সারাজীবন সেই মানুষটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।”
ঊর্মির চোখ টলমল করে উঠল। গলা ভারী হয়ে আসলেও নিজেকে সামলে বলল,
“ফুপি, আবরারকে আমি কখনো একা হতে দেব না ইনশাআল্লাহ। আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সবটুকু দিয়ে ওর পাশে থাকব।”
কল্লোল নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল দুজনের দিকে। সেই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছিল— সব হারিয়ে ফেলার পরও হয়তো ভাগ্য ওকে আবার একটা অমূল্য সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছে।
রাহেলা মৃদু হেসে বললেন, “তোমার কাছে এটুকুই আমার চাওয়া। আল্লাহ্ তোমাদের দুজনের জীবন সুখে ভরিয়ে দিক।”
ঊর্মির বুকের ভেতর উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল। মনে মনে নীরব প্রতিজ্ঞা করল ও— যে মানুষটা পৃথিবীর সবকিছু হারিয়েও ওকে ভালোবেসেছে, তাকে আর কোনোদিন একা হতে দেবে না ও।
পাশ থেকে কল্লোল এবার হঠাৎ মুখ গোমড়া করে বলে উঠল, “তোমাদের ইমোশনাল কথাবার্তা শেষ হলে আমার সাথেও একটু কথাবার্তা বলো! আমার দিকে তো কেউ তাকাচ্ছোই না তোমরা…”
রাহেলা, ঊর্মি দুজনেই হেসে ফেলল এবার। রাহেলা কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাকে নিয়েই তো কথাবার্তা হচ্ছে এখানে…” তারপর ঊর্মিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ছোটবেলা থেকেই ছেলেটার এমন স্বভাব। মনোযোগ না পেলে একেবারে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।”
ঊর্মি হেসে মাথা নাড়ল, “বুঝতে পারছি ফুপি। এখনো একদম সেই রকমই আছে। সামান্য সময়ও যদি ওর দিকে না তাকাই, সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ শুরু হয়ে যায়।”
কল্লোল প্রতিবাদী ভঙ্গিতে বলল, “আরে, আমি নাকি এমন! তোমরা দুজন এভাবে জোট বেঁধে আমার বিরুদ্ধে অন্যায় অভিযোগ করছো! This is not fair!”
রাহেলা হাসতে হাসতে বললেন, Everything is fair when two women are there!”
কল্লোল দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল অসহায়ের মতো, “আজ আমার দলে কেউ নেই বলে…”
আবারো হেসে উঠলো ওরা দুজন। ঘর ভরে উঠল হাসি-ঠাট্টায়।
__________________________________
রাহেলা চৌধুরী ডিনার না করিয়ে ছাড়লেন না ওদের। ডিনার টেবিলে ঊর্মির দেখা হলো রাহেলা চৌধুরীর দুই ছেলে রায়হান এবং রাহিল আর কল্লোলের ফুপা জামাল সাহেবের সঙ্গে।
রায়হান এবং রাহিল – দুই ভাইয়ের চেহারায় মিল থাকলেও হলেও স্বভাবের দিক দিয়ে একেবারে ভিন্ন।
বড় ছেলে রায়হান শান্ত স্বভাবের, চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। অন্যদিকে ছোট ছেলে রাহিল চঞ্চল, খোলামেলা স্বভাবের। টেবিলে বসেই হেসে বলল,
“ভাবী, আপনি দেখি একেবারে চুপচাপ বসে আছেন। আমরা কি এতটাই বোরিং লাগছি নাকি?”
সম্বোধন শুনে ঊর্মি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। কল্লোল চোখ পাকিয়ে তাকালো রাহিলের দিকে। রাহিল হাসতে হাসতে বলল, “দুদিন পরে তো ভাবীই হবে। তাই আগে থেকে প্র্যাকটিস করছি… ভাবী আপনি কিছু মনে করেছেন?” শেষের কথাটা ঊর্মিকে উদ্দেশ্য করে।
ঊর্মি আস্তে করে মাথা নাড়ল। রাহেলা চৌধুরী খাবার সার্ভ করতে করতে বললেন, “বুঝলে ঊর্মি, আমার ছোট ছেলেটা কল্লোল আর রায়হান দুজনের থেকে একেবারে বিপরীত স্বভাবের। ওর এই দুষ্টুমি ছোটবেলা থেকে জ্বালিয়ে মারছে আমাকে…”
রাহিল পাশ থেকে সজোরে প্রতিবাদ করল, “আম্মু… এসব কি? প্রথম দিনেই তুমি ভাবীর সামনে আমার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিচ্ছো!”
কল্লোল ওর দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে বলল, “এটা কোন ব্যাপার না, ব্রাদার! তোমার মা জননী আমার প্রেস্টিজও পাংচার করেছে…”
রায়হান খেতে খেতে বলল, “এটা কিন্তু তুমি ঠিক করোনি আম্মু! রাহিলের কথা আলাদা কিন্তু কল্লোলের প্রেস্টিজটা আ্যট লিস্ট রাখ…”
“বউয়ের সামনে কিসের প্রেস্টিজ! দুদিন পরে বিয়ে, তখন এমনিতেই সবকিছু জানাশোনা হয়ে যাবে…”
ঊর্মি পানি খাচ্ছিল। আচমকা রাহেলা চৌধুরীর এমন কথা শুনে পানি তালুতে উঠে গেল। কাশতে কাশতে চোখে পানি চলে এসেছে ওর। ততক্ষণে কল্লোল খাওয়া থামিয়ে ওর পিঠে হাত ঘষছে, “আস্তে… ঊর্মি…!”
জামাল সাহেব স্ত্রীকে চোখ রাঙালেন। তারপর কল্লোলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “পানি দাও ওকে…”
ঊর্মি একটানা কাশছে, মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কল্লোল তাড়াতাড়ি গ্লাসটা ওর ঠোঁটের সামনে ধরল,
“একটু পানি খাও… আস্তে…”
রাহেলা চৌধুরী চিন্তিত হয়ে চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে এলেন, “ঊর্মি, ঠিক আছো মা?”
ঊর্মি পানি খেয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করল যে ঠিক আছে। কাশির দমকে চোখ ভিজে গেছে ওর।
রাহিল মজার ছলে বলল, “আম্মু, তুমি এক কথায় ভাবীকে একেবারে শক দিয়ে দিলে!”
রাহেলা ধমকের সুরে বললেন, “চুপ কর, পাজি ছেলে!”
রায়হান হেসে ঊর্মির দিকে তাকাল, “টেনশন নিয়েন না ভাবি… আম্মু মাঝে মাঝেই হঠাৎ এমন কথাবার্তা বলে বসে। আমাদেরকেও অনেকবার হার্ট অ্যাটাকের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।”
ঊর্মি লজ্জায় একেবারে গুমরে গেল এবার। মুখ নিচু করে চামচে ভাত নেড়েচেড়ে খেতে লাগল চুপচাপ।
কল্লোল ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “Don’t take these things seriously. মজা করছে ওরা…”
ঊর্মি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সামলে নিল নিজেকে। চারপাশে আবারও হাসি-ঠাট্টার আবহ তৈরি হলো, কিন্তু ঊর্মির ভেতরে লাজ আর অস্বস্তির মিশ্রণ রয়েই গেলো।
___________________________________
পরের দিনগুলো কাটল ব্যস্ততায়। শপিং থেকে শুরু করে নানান কাজে বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হল দু পরিবারের মানুষ। কল্লোল এই ছুটিতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ছুটি আরো প্রায় এক মাস আছে। এবার ছুটি শেষ হলে পরবর্তী ছুটি আবার কবে পাবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। তাই ওর সিদ্ধান্ততেই সমর্থন দিল সবাই।
ঊর্মি বাড়িতে এসেছে দুদিন হলো। এই দুদিন ধরে ইশা জ্বালিয়ে মারছে ওকে।
“বলো না আপু…”
“উফ্… কী বলব?”
“তুমি বিয়েতে রাজি হলে কীভাবে?”
“মানে কী? মানুষ যেভাবে বিয়েতে রাজি হয় সেভাবে! আমার ক্ষেত্রে আলাদা কী?”
“উমম… তাই তো… করোলা… গোমড়ামুখো… আরো কী কী জানি বলতে?”
“আ-আমি বলেছি? কাকে?”
“এখন যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো, তাকেই তো বলতে। মনে পড়ছে না?”
“ক-কে বলল আমি হাবুডুবু খাচ্ছি? তোর খালি যত্তসব ফালতু কথা…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি জানি! তলে তলে টেম্পু চালাও, আমরা বললেই হরতাল?”
“হরতাল না, অবরোধ! এত বকবক করিস কেন তুই?”
ঊর্মি বালিশ ছুঁড়ে মারল ইশার দিকে।
ইশা দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বালিশটা সামলে নিল, “আচ্ছা আচ্ছা, অবরোধ! কিন্তু আপু, কল্লোল ভাইয়ের নাম শুনতেই তোমার গাল দুটো যে লাল হয়ে গেছে তার কী করবে…?”
“আরে না না! গরম লাগছে তাই লাল হয়েছে মনে হয়।”
ইশা হো হো করে হেসে উঠল।
ঊর্মি থমকে গেল। তারপর রেগে বলল, “দেখ ইশা, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে কিন্তু…
ইশা দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আর কিছু বলব না। কিন্তু একটা কথা বলে যাচ্ছি— তোমাকে আমি কোনোদিন এত খুশি হতে দেখিনি, যতটা এখন দেখছি।”
ঊর্মি চুপ করে গেল মুহূর্তের জন্য, বুকের ভেতরে অদ্ভুত কাঁপন খেলে গেল। কিন্তু সেটা আড়াল করতে গম্ভীর গলায় বলল, “বেশি কথা বলিস না, ঘুমোতে দে। কালকে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে…”
ইশা মজা করে চোখ টিপল, “হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি ঘুমাও! ভাইয়া তোমার স্বপ্নে আসার জন্য ওয়েট করছে!”
ঊর্মি মুখ গোমড়া করে বালিশ টেনে মুখ ঢাকল,
“একদম চুপ, ইশা! আর একটা শব্দ করলে কিন্তু এই রুমে ঘুমাতে পারবি না…”
ইশা বালিশ আঁকড়ে হাসি চাপল, শব্দ করল না। ঘরের বাতি নিভে গেল, নীরবতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। লাজে ঊর্মির ঠোঁটের কোণে খেলে গেল অচেতন হাসি।
________________________________
একটা পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ি। দেয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়েছে, জানালাগুলো মরচে ধরা গ্রিল দিয়ে বন্ধ। চারপাশে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা, সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে উত্তর দিকের একটা ঘর থেকে আবছা আলোর সাথে ভেসে আসছে চাপা গোঙ্গানির শব্দ।
মেয়েগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখে, মুখে কাপড় বাঁধা। কোণার দিকে দাঁড়িয়ে তিনজন লোক নিচু গলায় কথাবার্তা বলছে, হাসাহাসি করছে। এরমধ্যে একজনের ফোন বাজতেই সে কলটা রিসিভ করে কথা বলল। কথা বলে সে বাকিদের জানালো,
“আজ রাতেই গাড়ি আসবে।”
“টাকার অঙ্কটা ঠিকঠাক না পেলে ছাড়ব না কিন্তু।”
“চিন্তা নেই, মালদার লোকেরা আসছে। ওরা সব মিটিয়ে দেবে।”
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার ভেদ করে ভেসে এল ভারী পায়ের শব্দ। শব্দটা থেমে থেমে এগোচ্ছে, যেন কেউ ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে হাঁটছে।
তিনজন লোক হঠাৎ চুপ করে গেল। শব্দটা শুনে সতর্ক হল ওরা। বোঝার চেষ্টা করল কিসের শব্দ। একজন টর্চ জ্বেলে দরজায় ফেলল।
আলোতে ধরা পড়ল একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ— আগুন জ্বলছে সে দৃষ্টিতে। দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ অবয়বটা অন্ধকার থেকে আবছা আলোয় এসে দৃশ্যমান হলো এবার।
সে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। চারদিকে তাকাল একবার, তারপর মেয়েগুলোর দিকে চোখ রাখল। গোঙ্গানির শব্দ যেন তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল।
তিনজনের ভেতর থেকে একজন সামনে এগিয়ে এলো, “এই কে তুই? এখানে ঢুকলি কিভাবে…?”
আবছা আলোয় ধরা পড়ল দীর্ঘদেহী অবয়বের ঠোঁটের বাঁকানো হাসিটা, “Your game is over Rubel.”
সামনে এগিয়ে আসা লোকটা পেছন ঘুরে অবাক হয়ে তাকালো সঙ্গী দুজনের দিকে।
“রুবেল? কে রুবেল?”
রুবেল ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। ওর ঠোঁটেও হাসি ফুটল, “আমার আস্তানায় এসে আমাকেই শাসাচ্ছেন?ইমপ্রেসিভ!”
দীর্ঘদেহী মানুষটাও দুকদম এগোলো।
“Don’t try to be oversmart. Get ready, তোমার খেল খতম আজকে…”
হাসতে হাসতে রুবেলের চোখমুখ শক্ত হলো হঠাৎ। পকেট থেকে কুচকুচে কালো রিভলভারটা বের করে হ্যামার টেনে সোজা তাক করলো মাথা বরাবর, “তার আগে নিজের খেল খতম হবার জন্য প্রস্তুত হোন, ক্যাপ্টেন…”
To be continued…
#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ৩০
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌
[রিয়াক্ট দিয়ে তারপর পড়া শুরু করুন]
একটা পরিত্যক্ত দোতলা বাড়ি। দেয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়েছে, জানালাগুলো মরচে ধরা গ্রিল দিয়ে বন্ধ। চারপাশে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা, সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে উত্তর দিকের একটা ঘর থেকে আবছা আলোর সাথে ভেসে আসছে চাপা গোঙ্গানির শব্দ।
মেয়েগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখে, মুখে কাপড় বাঁধা। কোণার দিকে দাঁড়িয়ে তিনজন লোক নিচু গলায় কথাবার্তা বলছে, হাসাহাসি করছে। এরমধ্যে একজনের ফোন বাজতেই সে কলটা রিসিভ করে কথা বলল। কথা বলে সে বাকিদের জানালো,
“আজ রাতেই গাড়ি আসবে।”
“টাকার অঙ্কটা ঠিকঠাক না পেলে ছাড়ব না কিন্তু।”
“চিন্তা নেই, মালদার লোকেরা আসছে। ওরা সব মিটিয়ে দেবে।”
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার ভেদ করে ভেসে এল ভারী পায়ের শব্দ। শব্দটা থেমে থেমে এগোচ্ছে, যেন কেউ ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে হাঁটছে।
তিনজন লোক হঠাৎ চুপ করে গেল। শব্দটা শুনে সতর্ক হল ওরা। বোঝার চেষ্টা করল কিসের শব্দ। একজন টর্চ জ্বেলে দরজায় ফেলল।
আলোতে ধরা পড়ল একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ— আগুন জ্বলছে সে দৃষ্টিতে। দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ অবয়বটা অন্ধকার থেকে আবছা আলোয় এসে দৃশ্যমান হলো এবার।
সে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। চারদিকে তাকাল একবার, তারপর মেয়েগুলোর দিকে চোখ রাখল। গোঙ্গানির শব্দ যেন তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল।
তিনজনের ভেতর থেকে একজন সামনে এগিয়ে এলো, “এই কে তুই? এখানে ঢুকলি কিভাবে…?”
আবছা আলোয় ধরা পড়ল দীর্ঘদেহী অবয়বের ঠোঁটের বাঁকানো হাসিটা, “Your game is over Rubel.”
সামনে এগিয়ে আসা লোকটা পেছন ঘুরে অবাক হয়ে তাকালো সঙ্গী দুজনের দিকে।
“রুবেল? কে রুবেল?”
রুবেল ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। ওর ঠোঁটেও হাসি ফুটল, “আমার আস্তানায় এসে আমাকেই শাসাচ্ছেন?ইমপ্রেসিভ!”
দীর্ঘদেহী মানুষটাও দুকদম এগোলো।
“Don’t try to be oversmart. Get ready, তোমার খেল খতম আজকে…”
হাসতে হাসতে রুবেলের চোখমুখ শক্ত হলো হঠাৎ। পকেট থেকে কুচকুচে কালো রিভলভারটা বের করে হ্যামার টেনে সোজা তাক করলো মাথা বরাবর, “তার আগে নিজের খেল খতম হবার জন্য প্রস্তুত হোন, ক্যাপ্টেন…”
“না-আ-আ-আ!!”
আচমকা আলো জ্বলে উঠল অন্ধকার ঘরে।
“আপু! এই আপু! কী হয়েছে তোমার?”
ঊর্মি হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলো। পরিচিত ঘর। পরিচিত বিছানা। কল্লোল নেই কোথাও।
ইশা আবার ডাকলো, “আপু? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
ঊর্মি জবাব না দিয়ে বালিশের পাশে হাতড়ালো। ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত ডায়াল করল পরিচিত নাম্বারটায়।
“এত রাতে কাকে ফোন দিচ্ছো!” ইশা অবাক হয়ে তাকালো।
ইশার কথা শেষ হতেই ফোনটা রিসিভ হলো। ঘুমন্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে,
— হ্যালো…
— আ-আ-আবরার…?
কল্লোলের ঘুম ছুটে গেল তৎক্ষণাৎ। দ্রুত উঠে বসলো ও।
— ঊর্মি…? কী হয়েছে সুইটহার্ট? এতো রাতে? Are you alright?
— আ-আবরার… আপনি ঠিকাছেন?
কল্লোল অবাক হলো এমন প্রশ্নে।
— আমি? হ্যাঁ তো! আমার কী হবে?
— আপনি কোথায়?
— আরে! এত রাতে কোথায় থাকবো! বাসায়…!
— আপনি সত্যিই ঠিক আছেন তো?
কল্লোল এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলল,
— তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছো ঊর্মি?
— হুঁ…
কল্লোল দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— আমি একদম ঠিক আছি লিটল বার্ড। তুমি চিন্তা করো না, ঠিক আছে? ঘুমাও! একা শুয়েছ?
— না, ইশা আছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে। ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট…
— শুনুন! আপনি সাবধানে থাকবেন, কারো সাথে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াবেন না। ঠিক আছে?
— ঠিক আছে ম্যাডাম! আর চিন্তা করতে হবে না…
একটু থেমে কল্লোল আবার বলল,
— ইশাকে একটু ফোনটা দাও তো ঊর্মি…
ঊর্মি ইশার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো।
— হ্যালো, ইশা?
— জ্বী, ভাইয়া!
— তোমার আপুর দিকে একটু খেয়াল রেখো তো। দুঃস্বপ্ন দেখেছে মনেহয়। আবার যদি ঘুম ভাঙ্গে, বুঝিয়ে শুনিয়ে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিও…
— ঠিক আছে ভাইয়া, খেয়াল রাখব। আল্লাহ হাফেজ!
— আল্লাহ হাফেজ!
ইশা ঊর্মিকে ফোনটা দিতেই কল্লোল নরম স্বরে ডাকল,
— সুইটহার্ট ?
— হুঁ…
— এখনো চিন্তা করছো?
— আমার ভালো লাগছে না আবরার… অস্থির লাগছে… বুকটা কাঁপছে এখনো…
— তুমি না গুড গার্ল? তুমি আমার কথা শোনো, শুয়ে পড়ো। কত রাত হয়েছে দেখেছো?
— এখন আর ঘুম আসবে না…
— কালকে হলুদের অনুষ্ঠান না? আজকে রাতে না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। পরশু তো দেখা হচ্ছেই ইনশাআল্লাহ…
— হুঁ, ইনশাআল্লাহ!
— শুয়েছ?
— হুঁ!
— গুড! চোখ বন্ধ করো…
— হুঁ…
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল।নিশ্চিন্ত হয়ে কলটা কেটে কল্লোল নিজেও এবার পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে।
__________________________________
বাড়ির উঠোন জুড়ে উৎসবের রঙ। গাছের ডালে ডালে ঝোলানো ফেইরি লাইট, একপাশে স্টেজ করা হয়েছে। খালাতো, ফুপাতো বোনেরা ঊর্মির চারপাশে জড়ো হয়ে হলুদ মাখাচ্ছে ওকে, হাসি-তামাশায় মুখর চারদিক। হলুদের গন্ধে, ফুলের মিষ্টি সুবাসে ভরে গেছে চারপাশ।
কিন্তু সেই ভিড়ের মাঝেই ঊর্মি বারবার অস্থির হয়ে উঠছে। ওর চোখে এক মুহূর্তের জন্য রুবেলের মুখ ভেসে উঠল— অন্ধকার জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সেই ষড়যন্ত্রের রাতের ছায়া। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ওর।
সে রাতে কল্লোলের সাথে রুবেলের ঝামেলা হয়েছে নিশ্চিত, এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই ওর। তাইতো রুবেলের নাম মনে পড়লেই অদ্ভুত একটা ভয়ের স্রোত নেমে আসে মেরুদন্ড বরাবর। তার মাঝে কাল রাতে আবার অমন ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটা কেন দেখল কে জানে।
অস্থিরতায় হাশফাশ করে উঠলো ও। গাল বেয়ে নামা ছোট্ট একটা ঘামবিন্দু মিশে গেল হলুদের সাথে। এসব হাসাহাসি, গানবাজনাও কর্কশ শোনাচ্ছে কানে। শাড়ি সামলে স্টেজ থেকে নামতে চাইলেই বাধা দিল ওর খালাতো বোন রিমা, “কিরে, কোথায় যাচ্ছিস ঊর্মি?”
“হলুদ দেওয়া তো শেষ। এখানে বসে থেকে কি করব? গরম লাগছে, ভেতরে যাচ্ছি…”
ঊর্মি আর দাঁড়ালো না। বাড়ির ভেতর গিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। বাইরের শব্দ এখনো ভেতরে আসছে, দরজা বন্ধ করে বিশেষ লাভ হয়নি।
ও টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিল। কিন্তু ফোনটা হাতে নিয়ে দোটানায় পড়ল।
“এখন কল দেওয়া কি ঠিক হবে? আবরার কী করছে কে জানে…”
কিন্তু অস্থিরতাটা যেন ডুবিয়ে দিল সমস্ত দ্বিধাকে। কল্লোলের নাম্বারে ডায়াল করল ও। দ্বিতীয়বার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
— হ্যালো… ঊর্মি?
ঊর্মি নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু কণ্ঠটা কেঁপে গেল ওর,
— আ-আবরার…
— কী হয়েছে ঊর্মি? তোমার গলা কেমন যেন শোনাচ্ছে?
— কিছু না। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন না! ভাল্লাগছে না আমার…
কল্লোল সোজা হয়ে বসল নিজের বিছানায়।
— কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
— না… কালকের স্বপ্নটা… বারবার মাথায় ঘুরছে। রুবেল আপনার দিকে রিভলবার তাক করেছিল আবরার। আমার… আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না… আপনি আমার কাছে তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ!
কল্লোল গভীর নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর নরম গলায় বলল,
— আমি তো কাল সকালেই আসছি লিটল বার্ড! তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ… রুবেল কিচ্ছু করতে পারবে না।
ঊর্মি চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। বুকের ধড়ফড়ানি কমছে না, তবু কল্লোলের ভরসার সুরে একটু যেন স্বস্তি পেল ও।
কল্লোল আবার বলল,
— তোমাকে হলুদের সাজে দেখতে ইচ্ছে করছে ঊর্মি!
ঊর্মির ঠোঁটে এবার হাসি ফুটল,
— একেবারে কাল দেখতে পাবেন! এর আগে কোন দেখাদেখি নেই…
— এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না ঊর্মি! I’m missing you badly. I’m missing your soft lips…
ঊর্মি আঁতকে উঠল,
— আ-আবরার! কীসব বলেন আপনি!
কল্লোল হাসলো,
— এখনই এত লজ্জা পেয়ো না, লিটল বার্ড! কালকে রাতের জন্যও কিছু তুলে রাখো…
ঊর্মি লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল,
— চুপ করুন অসভ্য লোক!
— Get ready for tomorrow night sweetheart. চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করো, অসভ্যতার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে যাবে…
ঊর্মির আপাদমস্তক কেঁপে উঠল ওর এমন ধীর কন্ঠস্বর শুনে। ওকে কখনো এমন ভাবে কথা বলতে শোনেনি ঊর্মি। কল্লোল এরমধ্যে আবার বলল,
— আজ যা ঘুমানোর ঘুমিয়ে নাও লিটল বার্ড। কাল থেকে ওসব ঘুম-টুমের জন্য সময় পাবেনা কিন্তু…
ঊর্মি খট করে ফোনটা কেটে দিলো। কল্লোলের এমন বেহায়া কথাবার্তা শুনে লজ্জায় ওর কান গরম হয়ে গেছে।
কল্লোল ওর রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় চেহারাটা কল্পনা করে একা একাই হাসলো। বড্ড তৃপ্তির সে হাসি! প্রেয়সীকে স্ত্রী হিসেবে পেতে যাওয়ার খুশি। তবে এই খুশিতে বাগড়া দিতে মোবাইলটা ওই মুহূর্তে তারস্বরে বেজে উঠল।ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখতেই ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল ওর।
অফিশিয়াল নাম্বার! ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো ওপাশ থেকে,
— Captain, we know you are on leave, but right now the team needs you. A critical operation has to be conducted, and it’s urgent.
কল্লোল চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। বুকের ভেতর ঝড়ের মতো বয়ে গেল একটাই চিন্তা— কালই তো ঊর্মির সাথে ওর বিয়ে। ঊর্মি… ঊর্মি অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য। ঊর্মির চোখদুটো ভেসে উঠল মানসপটে।
ও ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল,
— Tomorrow… it’s my wedding.
ফোনের ওপাশে নীরব কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার সেই দৃঢ় কণ্ঠস্বর,
— Captain, we are very sorry. But we need you…
কল্লোল আয়নার দিকে তাকাল। ইউনিফর্ম আলমারিতে ভাঁজ করা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কণ্ঠস্বরটা ওর গায়ে সেটা চাপিয়ে দিলো। শপথের ভার যেন এবার অন্যরকম অনুভব হলো ওর।
ও গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
— Give me some time. I need… to think.
ওপাশ থেকে উত্তর এল সংক্ষিপ্ত,
— You don’t have much time, Sir.
লাইনটা কেটে গেল। মোবাইলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কল্লোল চুপচাপ বিছানায় বসে রইল। অপারেশন শব্দটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু মনের ভেতর বারবার ভেসে আসছে ঊর্মির মুখটা।
কিছুক্ষণ পর ও ধীরে ধীরে কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘেঁটে ফুপির নাম্বারটায় কল দিল। কল ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল ওপাশ থেকে,
— হ্যাঁ, কল্লোল বলো…
কল্লোল গলা ভার করে বলল,
— ফুপি… একটা কথা ছিল।
— কী কথা?
কল্লোল কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। শব্দ যেন গলায় আটকে গেছে ওর। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— বিয়েটা… কয়েকদিন পেছানো যায় কি? আমাকে হঠাৎ করেই একটা মিশনে যেতে হবে।
ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর রাহেলা চৌধুরী কড়া স্বরে বলে উঠলেন,
— কী বলছো তুমি? সবরকম প্রস্তুতি হয়ে গেছে। তাছাড়া উর্মির বাড়ির লোকেরা যদি আগের দিন রাতে শোনে যে আমরা বিয়েটা পেছাতে চাইছি, কী মনে করবে তারা!!”
কল্লোল নিঃশ্বাস ছেড়ে নিচু গলায় বলল,
— আমি জানি ফুপি… but it’s emergency. নেভি থেকে…
রাহেলা চৌধুরীর গলায় এবার একরাশ হতাশা,
— তুমি সবসময় দায়িত্বকেই আগে রাখো, এটা আমি জানি কল্লোল। কিন্তু এইবার তো তোমার নিজের জীবন, তোমার ঘর বাঁধার সময়। ওরা যদি এটা শোনে, ভাববে না তুমি সিরিয়াস নও? ঊর্মির মনের অবস্থাটা কী হবে, ভেবে দেখেছো?”
কল্লোল চুপ করে রইল। ফোনের ওপাশের প্রতিটা শব্দ যেন ওর কানে দগদগে শলাকার মতো বিঁধছে।
ও মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ফুপি… I feel helpless. একদিকে আমার দায়িত্ব, আমার ওপর ইউনিটের ভরসা। আরেকদিকে… ঊর্মি। ওকে কথা দিয়েছি, আমাদের সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে কাল…
কণ্ঠে কাঁপন ধরল ওর,
— আমি চাই না ঊর্মির মনে হোক আমি ওকে অবহেলা করছি। কিন্তু কর্তব্যের ডাকও তো এড়াতে পারি না। আমি যদি না যাই, টিমের কী হবে জানি না।
ফুপির গলায় দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল,
— কল্লোল, তুমি সবসময়ই দায়িত্বশীল। আমি জানি, দেশের জন্য নিজের সুখ ত্যাগ করতেও তুমি রাজি। কিন্তু… এবারের ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম একটা সেনসেটিভ বিষয়… ঊর্মি এটা মানতে পারবে না কল্লোল…
কল্লোল ফোনটা কানে চেপে ধরে চোখ বুজল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে ওর,
— আমি কী করব, ফুপি? কী করলে দু’দিক একসাথে সামলানো যাবে?
ওপাশে রাহেলা চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
— তুমি ডিপার্টমেন্টের কাছে রিকয়েস্ট করো দু-তিন দিন সময় দেয়ার জন্য। এরমধ্যে বিয়ের ব্যাপারটা আর ঊর্মিকেও মোটামুটি গুছিয়ে উঠতে পারবে। তারপর নাহয় যেও…
— আমি… আমি চেষ্টা করব, ফুপি।
ফোন কেটে দিয়ে অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল ও। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ঊর্মির হাসি, আর একইসাথে ডেকে উঠছে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন— দায়িত্বের কঠিন ডাক।
To be continued…