জলতরঙ্গের সুর পর্ব-৩৭+৩৮

0
5

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ৩৭
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

অপারেশন শেষ হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে। হাসপাতালের সাদা দেয়াল আর মনিটরের বিট-বিট শব্দে ভরা ঘরটায় এখনো অচেতন ক্যাপ্টেন। রাহেলা চৌধুরী হসপিটালে পৌঁছেছেন কিছুক্ষণ আগেই।

কল্লোলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হসপিটালে আনার সাথে সাথে ওটিতে নেওয়া হয়েছিল। তার পরপরই কর্তব্যরত অফিসার রিসেপশনে তথ্য নিলেন –

“Patient: Captain Abrar Imtiaz Kallol. Status: Critical. Family informed?”

অন্যজন কাগজ ঘেঁটে দেখল, “Next of kin: Aunt’s name listed. No spouse mentioned.”

অফিসার ভ্রু কুঁচকালেন, “Spouse not updated?”

“Negative, Sir. Records say he’s unmarried.”

কাগজের কলামে স্পষ্টভাবে লেখা—
Marital Status: Single.

অফিশিয়াল কাগজপত্রে ক্যাপ্টেন আবরার ইমতিয়াজ কল্লোল এখনো অব্দি অবিবাহিত। ছুটিতে হুটহাট বিয়ে করে, বিয়ের মাত্র দু’দিনের মাথায় সরাসরি মিশনে যোগদানের কারণে তার ম্যারিটাল ডিটেইলস আপডেট করা সম্ভব হয়নি।

কেউ জানে না, মাত্র কয়েকদিন আগে ক্যাপ্টেনের জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী হয়তো এই মুহূর্তে ক্লাসরুমে বসে আছে, কিংবা বন্ধুদের আড্ডায়। প্রিয় মানুষটার দুঃসংবাদটাও তার কাছে পৌঁছায়নি এখনো।

তার বদলে সংবাদ পৌঁছেছে কল্লোলের ফুপি রাহেলা চৌধুরীর কাছে। রাহেলা চৌধুরী তৎক্ষণাৎ রওনা হয়েছেন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। রওনা হয়েছেন একা, ঊর্মিকে খবরটা দেননি। মেহেদির রঙ ওঠার আগেই যে মেয়েটা বুকে পাথর চেপে স্বামীকে বিদায় দিয়েছে, এরইমধ্যে তাকে আবার স্বামীর আকস্মিক এই দূর্ঘটনার কথা জানিয়ে আরো মানসিক যন্ত্রণায় ফেলতে চাননি তিনি।

তাই একাই রওনা হয়েছেন আহত ভাইপোকে দেখতে। হাসপাতালে পৌঁছার পর চিকিৎসকরা তাকে জানালেন— অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে, তবে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীর দুর্বল। রাহেলা চৌধুরী ডাক্তারকে অনুরোধ করলেন কালকের মধ্যে কল্লোলেকে রিলিজ করে বাসায় নেওয়া যাবে কিনা।

ডাক্তার বললেন, জ্ঞান ফেরার পর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সেটা বলা সম্ভব, তার আগে নয়। রাহেলা চৌধুরী কল্লোলের সাথে দেখা করতে পারেননি এখনো।

হাসপাতালের করিডোর নিস্তব্ধ। ফিনাইল আর স্যাভলনের গন্ধ উপেক্ষা করে রাহেলা চৌধুরী ধীরে ধীরে হাঁটলেন কল্লোলের কেবিনের দিকে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই আপাতত, কল্লোলের জ্ঞান এখনো ফেরেনি।

কাঁচের পুরু দেওয়ালের ওপাশে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল রাহেলা চৌধুরীর।
বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছেলেটা কেমন নিঃসার হয়ে শুয়ে আছে। বাম কাঁধ থেকে বুক পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে মোটা ব্যান্ডেজটা উঁকি দিচ্ছে সবুজ চাদরের তল থেকে।

হাতের শিরায় স্যালাইন চলছে, মুখটা ফ্যাকাশে, চোখ দুটো বন্ধ। পাশের মনিটরে সবুজ রেখা ওঠানামা করছে অনবরত, বিপ… বিপ… বিপ… শব্দটা যেন রাহেলা চৌধুরীর হৃদস্পন্দনকে আরও তীব্র করে তুলছে।

রাহেলা কাঁচ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখে জল এসে ভিজিয়ে দিল দৃষ্টি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন তিনি, আর তিন ইঞ্চির তফাতে কী থেকে কী হয়ে যেত। ছোট্ট থেকে কল্লোলকে কখনো ভাইয়ের ছেলে মনে করেননি তিনি। নিজের দুই ছেলের মতো একই আদরে বড় করেছেন। সেই ছেলেটাকে আজ এই অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারছেন না তিনি।

কিন্তু এর মাঝেই প্রশ্নটা মাথা নাড়াচাড়া দিল—
ঊর্মিকে কি জানানো উচিত ছিল? মেয়েটা পরে যখন শুনবে তখন…?

চোখের সামনে ভেসে উঠল বউ সাজে মেয়েটার লাজুক মুখখানা। মেহেদির রঙ হাতে এখনো লেগে আছে বোধহয়, এদিকে তার স্বামী সদ্য জীবন-মৃত্যুর মাঝখান থেকে লড়ে এসে নিঃসার হয়ে শুয়ে আছে এখানে।

রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“কি করবো আমি? এখনই যদি জানাই, মেয়েটা সহ্য করতে পারবে? বিয়ের মাত্র কদিন হলো…? এখনও ঠিকমতো সংসার শুরুই করেনি ছেলেমেয়ে দুটো। এরমধ্যে আবার যদি…”

ভাবনা যেন ঘূর্ণির মতো টেনে নিচ্ছে তাকে। ডাক্তারদের কথাগুলো মনে পড়ে গেল— অস্ত্রোপচার সফল, তবে পরপর দুটো গুলিতে অনেকটা ব্লাড লস হয়েছে।

রাহেলা চোখ বন্ধ করে কাঁচে কপাল ঠেকালেন। বুকের ভেতর কোথাও যেন তীব্র একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। এরকম একটা সংবাদ ঊর্মির অগোচরে রাখাটা কি সত্যিই সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে?

আইসিইউর কাঁচের ওপাশে নিস্তব্ধ শুয়ে থাকা কল্লোলের দিকে তাকিয়ে রাহেলার মনে হলো, উত্তরটা সহজ নয়।

________________________________

ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে বসে আছে ঊর্মি, কিন্তু মন একেবারেই অন্যমনস্ক ওর। কথোপকথনের মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ থেমে যাচ্ছে ও, যেন কথা বলতে বলতেই হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও।

তুলি খেয়াল করল, “ঊর্মি, তুই এত চুপচাপ কেন রে? শরীর খারাপ নাকি?”

ঊর্মি মাথা নাড়ল, “না রে… শরীর ঠিক আছে।”
কণ্ঠস্বরটাও তেমন জোরালো নয় ওর।

হঠাৎই বুকের ভেতর ধক করে উঠল ঊর্মির। অকারণেই হাঁসফাঁস করে উঠলো আচমকা। কাল রাতের স্বপ্নটা মানসপটে ঝলকে উঠলো একবার। ঊর্মি উঠে দাঁড়ালো।

“আমি বাসায় যাচ্ছি, তোরা থাক।”

তুলি আবার বলল, “বাসায় যাবি কেন? আর ক্লাস করবি না?”

“নাহ্! ভাল্লাগছে না আমার, গেলাম…”

কোনো কারণ নেই, কোনো খবরও নেই— কিন্তু ঊর্মির মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। খুব খারাপ কিছু একটা‌। শেষ রাত থেকে ঘুম হয়নি ওর। জরুরি একটা আসাইনমেন্ট জমা দেবার জন্য আজ ক্লাসে আসা। নাহলে আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না ওর।

“আবরার… আপনি ঠিক আছেন তো?”
মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে গেট পেরিয়ে রিকশায় উঠল ও। ভাল্লাগছে না, কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। আবরারের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছুই ভালো লাগছে না।

রিকশায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে রইল ঊর্মি। মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কোনো সুতোর টান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই মানুষটার কাছে, যাকে এখন ও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, অথচ অনুভব করছে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

_______________________________

কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই রাহেলা চৌধুরী এগিয়ে এলেন। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কল্লোলের জ্ঞান ফিরেছে? এখন দেখা করতে পারব ডক্টর?”

“জ্ঞান ফিরেছে, যেতে পারবেন তবে বেশিক্ষণ নয়। Not more than five minutes. খেয়াল রাখবেন বেশি কথা যেন না বলে।”

“Thank you.”

বুটের শব্দ তুলে করিডোর ধরে ডাক্তার চলে গেলে রাহেলা কেবিনে ঢুকলেন। কল্লোলের চোখজোড়া বন্ধ। রাহেলা কল্লোলের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রাখলেন। কল্লোল সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাল।

“ফুপি…?”

রাহেলা চৌধুরী অশ্রুসজল চোখে ভাইপোর কপালে চুমু খেলেন। ডান হাত‌ বাড়িয়ে কল্লোল ছোটবেলার মত ফুপির হাত ধরল। তারপর হাতের পিঠে চুমু খেল।

“কাঁদছ কেন তুমি?”

রাহেলা কথা বললেন না। হাত বাড়িয়ে গালের পানি মুছেলেন। কল্লোল আবার জিজ্ঞেস করল, “ঊর্মি কোথায়? ওকেও এনেছো? মেয়েটা এমনিতেই অল্পতে অস্থির হয়ে যায়…”

“ওকে জানাইনি…”

কল্লোল প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে স্বস্তি পেল।

“না জানিয়েই ভালো করেছ। শুনলেই পাগলামি করবে। থাকুক, বোলো না…”

বলতে বলতেই রাহেলার ফোন বাজলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলেন ঊর্মির কল। রাহেলা ফোনটা ঘুরিয়ে কল্লোলকে দেখালেন। হাসলো কল্লোল।

“লাউডে দাও, কয়েকদিন ধরে বউয়ের কন্ঠ শুনি না…”

রাহেলা কল্লোলের দিকে এক নজর তাকিয়ে কলটা রিসিভ করে লাউডে দিলেন। সাথেসাথেই ঊর্মির অস্থির কন্ঠ ভেসে এলো ওপাশ থেকে, “ফুপি…?”

“হ্যাঁ মা, বলো! কী করছো তুমি? ক্লাসে গেছো আজকে?”

“গেছিলাম ফুপি, চলে এসেছি! ভাল্লাগছে না…”

কল্লোলের কপালে ভাঁজ পড়ল। গিয়ে আবার চলে এসেছে কেন? কিছু হয়েছে কি? কল্লোল ফুপিকে ইশারা করলো ঊর্মিকে জিজ্ঞেস করার জন্য।

“ভাল্লাগছে না কেন, আম্মু? কী হয়েছে?”

ঊর্মি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলল, “আপনার ছেলে কল দিচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। আমি কল দিলেও ঢুকছে না। কালকে রাত থেকেই আমার ভাল্লাগছে না ফুপি…” বলতে বলতেই ঊর্মির গলা ভাঙলো। কান্নার দাপটে শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলো।

প্রেয়সীর কান্নায় অস্থির হয়ে উঠলো কল্লোল। উঠে বসতে চাইল তৎক্ষণাৎ। রাহেলা চৌধুরী চোখ পাকালেন। কল্লোল অসহায় চোখে চাইলো ফুপির পানে। প্রাণপাখিটা এভাবে কান্নাকাটি করলে ও শান্ত থাকবে কী করে!

রাহেলা তখন ঊর্মিকে বুঝ দিচ্ছেন, “এভাবে কেউ কাঁদে বোকা মেয়ে! কল্লোল কাজে গেছে না, বলো? ব্যস্ততায় বোধহয় কল করতে পারছে না। তুমি চিন্তা কোরো না মা, ও ঠিক আছে। তোমার সাথে খুব তাড়াতাড়িই যোগাযোগ করবে।”

কল্লোলের অস্থির অস্থির লাগছে। ভাল্লাগছে না। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে শক্ত করে বুকের মধ্যিখানে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে। রাহেলা আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ফোন রাখলেন। কল্লোল পুরোটা সময় চাতক পাখির মতো চেয়ে রইলো ফোনের দিকে।

“ফুপি, এই ক’দিন ঊর্মি বেশি কান্নাকাটি করেছে?”

“মন খারাপ, তবে কান্নাকাটি করেনি। তোমার কদিন কথা বলছো না তাই…”

কল্লোল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওদের কথাবার্তার মাঝেই নার্স এলো।

“ম্যাডাম, সরি, বাট পেটেন্টের কাছে আর থাকা যাবে না…”

“ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।”

কল্লোল নার্সের কাছে ওর ফোন কোথায় জিজ্ঞেস করল। নার্স ফোন আনার জন্য বেরিয়ে গেলে রাহেলা চৌধুরীও কল্লোলের মাথায় হাত বুলিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।

______________________________

— হ্যালো…?

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না।

— লিটল বার্ড…?

এবারেও উত্তর এলো না। তার বদলে ফোপানোর শব্দ ভেসে এলো। ফোনের এপাশের ব্যক্তিটির চিত্ত অস্থির হলো তাতে। সে অধৈর্য কন্ঠে আবারো ডাকলো,

— ঊর্মি, সুইটহার্ট? কাঁদছ তুমি? কথা বলো, হানি, প্লিজ…

ওপাশ থেকে জবাব এল টুকরো টুকরো ভাঙা কণ্ঠে,
— আ-আপনি খুব খারাপ। আমি ক-কথা বলবো না আপনার সাথে।

কল্লোল চোখ বন্ধ করে ফেলল। আস্তে করে ডাকলো,
— সুইটহার্ট…

ওপাশ থেকে ফোপানোর শব্দ ব্যতিত কোনো শব্দ নেই।

— আমার সুইটহার্ট কি বেশি রাগ করেছে? আমি ব্যস্ত ছিলাম সোনা…

— আমার কাছে কবে আসবেন আপনি? আমার আর ভালো লাগছে না, আবরার। আপনি আজকেই আমার কাছে আসবেন, ব্যস! আমি কিচ্ছু জানিনা। আপনি না এলে কিন্তু আমি চলে আসব…

ঊর্মি একনাগাড়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। মাঝপথে থেমে গেল মনিটরের অনবরত বিপ… বিপ… শব্দে। শব্দটা আস্তে আস্তে জোরালো হচ্ছে বোধহয়। ঊর্মি বুঝতে পারল না কী হচ্ছে।

— আবরার? আবরার, শুনছেন?

— হ্যাঁ হানি, শুনছি তো, বলো…

নার্স দরজা ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাহিরে। মনিটরের জোরালো শব্দটা হতেই ভেতরে ঢুকে এলো। ফোনের ওপাশ থেকে তখন ঊর্মির অস্থির কন্ঠ ভেসে আসছে,

— আপনি কোথায়, আবরার? কিসের শব্দ এটা?

কল্লোল ঠোঁট নাড়ল, শব্দ বেরোল না। বাম কাঁধের ব্যথাটা হঠাৎ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বুক পর্যন্ত। চোখের সামনে ঝাপসা অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। গলা শুকিয়ে এসেছে, নিঃশ্বাসটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠছে।

নার্স ভেতরে ঢুকেই মনিটরের দিকে তাকালো। মনিটরে হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠল, তারপর একটু পরেই নামতে শুরু করল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। নার্স চাপা গলায় বলল, “স্যার, ফোনটা রাখুন প্লিজ… প্রেশার ফল করছে।”

কল্লোল চেষ্টা করল কিছু বলতে, কিন্তু ঠোঁট নড়ল মাত্র। ফোনের ওপাশ থেকে ঊর্মির কণ্ঠ আরও অস্থির হয়ে উঠেছে ততক্ষণে,

— আবরার? আপনি কথা বলছেন না কেন? কী হয়েছে আপনার? কার প্রেশার ফল করছে? আবরার!

নার্স দ্রুত এগিয়ে এসে কল্লোলের হাত থেকে আলগোছে ফোনটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। ফোনের ওপাশ থেকে তখনও ঊর্মির চিৎকার ভেসে আসছে,

— আবরার! প্লিজ কিছু বলুন! আমি ভয় পাচ্ছি… আবরার…!

মনিটরের শব্দটা ততক্ষণে আরও দ্রুত, আরও তীব্র—
বিপ… বিপ… বিপ…

নার্স দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক সেট করল মুখে, এক হাতে মনিটর চেক করতে করতে‌ অন্য হাতে বেডের পাশে থাকা ইমার্জেন্সি বোতাম চাপল,
— Doctor! Patient’s blood pressure dropping rapidly!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দরজার ওপাশে বুটের শব্দ হলো। দুজন নার্স ও ডক্টর দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন। এক মুহূর্তে ঘরটা ভরে গেল তাড়াহুড়ো আর যন্ত্রের বীভৎস শব্দে।

কল্লোলের বুক উঠছে–নামছে অনিয়মিতভাবে। চোখ আধখোলা, ঠোঁট কাঁপছে, যেন কিছু বলতে চাইছে ও। নার্স কাছে ঝুঁকল, কিন্তু শোনা গেল না কিছুই—শুধু নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ল ওর, “ঊর্মি…”

মনিটরের শব্দটা হঠাৎ ছন্দ হারাল।
বিপ… বিপ… বি———প…

ডক্টর দ্রুত মনিটরের পাশে এলেন। চোখ একবার স্ক্রিনে, একবার কল্লোলের মুখে।

“Set up ECG. Increase high-flow oxygen — now!”

“Yes, Doctor!”

দুজন নার্স তৎপর হলো তৎক্ষণাৎ। একজন কল্লোলের হাতে ক্যানোলা ঠিক করছে, অন্যজন ইনফিউশন সেটের গতি বাড়াচ্ছে। বাতাসে অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধটা আরও ঘন হলো।

“Heart rate’s irregular, Doctor!”
নার্সের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

“Prepare adrenaline, 1 ml — stat!”

“Copy that!”

ডক্টর কল্লোলের বুকের উপর দু’আঙুল রেখে নিচু গলায় বললেন, “Captain, can you hear me? Stay with us. You’re not alone, soldier.”

ক্যাপ্টেনের চোখ আধখোলা, ঠোঁটে অস্পষ্ট নড়ন। মনে হলো কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু গলার স্বর বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনিটরের রেখাটা আবার কাঁপল—একটা, দুটো, তারপর সামান্য উঠল নামল।

টেবিলের উপরে রাখা ফোনটার স্ক্রিনে এখনো ঊর্মির নাম জ্বলজ্বল করছে।

— আবরার, আমি ভয় পাচ্ছি… আপনি কথা বলুন না প্লিজ… আবরার, আপনি কি করছেন? ঠিক আছেন আপনি…?

“BP responding, Doctor. Pulse is coming back.”

ডক্টর নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর বললেন, “Alright. Keep the monitor on. Continue IV fluids. Reduce external stressors. No incoming calls for the next few hours.”

“Understood, sir.”

টেবিলের উপর রাখা ফোনটা নিঃশব্দে স্ক্রিনে ম্লান আলো জ্বলে নিভে গেল— কল কেটে গেছে। ঘরের ভেতর ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা ফিরে এলো। ডক্টর বললেন, “He’s stable… for now. But we’re not out of danger yet.”

বাইরে তখন হাসপাতালের করিডোরে আলো নরম হয়ে এসেছে। কেউ জানে না, টেবিলের উপর সেই নেভা ফোনের ওপাশে একটা মেয়ের চোখ ভিজে আছে বাঁধনহারা নোনা অশ্রুতে, অনবরত সে ফিসফিস করে বলছে—

“আবরার, শুধু একবার বলুন আপনি ভালো আছেন…”

———–

ডক্টর কয়েক মিনিট পর ঘরের দরজা ঠেলে বাইরে বেরোলেন। মুখে ক্লান্তি, কিন্তু চোখজুড়ে দৃঢ়তার ছাপ বিদ্যমান। রাহেলা চৌধুরী ছুটে এলেন,
“ডক্টর, আমার ছেলেটা ঠিক আছে তো? হঠাৎ এমন হলো কেন?

ডক্টর শান্ত গলায় বললেন, “ভয় পাবেন না, আপাতত স্ট্যাবল আছে। তবে শরীর খুব দুর্বল, আর… মানসিক দিক থেকেও ওর ওপর চাপটা অনেক বেশি।”

“মানসিক চাপ?” রাহেলা অবাক হয়ে শুধালেন।

“জি, অস্ত্রোপচারের পর শরীর যখন রিকভারি ফেজে থাকে, তখন সামান্য মানসিক উত্তেজনাতেও হার্ট রেট ও প্রেসার অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করতে পারে। বিশেষ করে দুটো গুলি লেগেছিল বাম কাঁধে— সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীরের রক্তচাপ এখনো পুরোপুরি নরমাল হয়নি। এই সময় ফোনে কথা বলছিলেন, তাই একটু ইমোশনাল রিঅ্যাকশন হয়তো ট্রিগার করেছে।

রাহেলা নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। চোখে জলের রেখা চিকচিক করছে তার।

ডক্টর আবার বললেন, “এই সময়টা একদম শান্ত রাখতে হবে। কোনো ধরনের মানসিক উত্তেজনা যেন না হয়। ফোন, খবর— সব কিছু বন্ধ রাখুন এখন।”

রাহেলা ফিসফিস করে বললেন, “ও ঊর্মির সঙ্গে কথা বলছিল, তাই না?”

ডক্টর একবার তাকিয়ে ধীরে মাথা ঝুকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, সম্ভবত তাই। ওনার রক্তচাপ তখনই হঠাৎ কমে যায়। মানসিকভাবে যার সঙ্গে উনি সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত, তার কণ্ঠ শুনেই শরীর রেসপন্স করেছে।”

রাহেলা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভেতরের কেবিনে তখন কল্লোল আবার নিঃশব্দে ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কপালে মৃদু মৃদু ঘাম চিকচিক করছে। নার্স মনিটর চেক করছে শান্তভাবে।

গভীর ঘুমে রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ক্যাপ্টেনের ঠোঁটের কোণে একটুখানি নড়ন—
“হানি…”

ঊর্মি ফোনটা কানে চেপে বসে আছে, কিন্তু ওপাশে কোনো সাড়া নেই। শুধু মেশিনের বীপ-শব্দের মতো কিছু ভেসে আসে মাঝে মাঝে, যেন কোনো হাসপাতালের শব্দ। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় ওর।

— আবরার? আবরার, কিছু বলুন না…

কথা বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে আসে। পরের মুহূর্তেই লাইনটা কেটে যায়। ওর হাত কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন কে হাসপাতালে? কী হয়েছে ওর? ঊর্মি অস্থির হয়ে কাঁপা হাতে আবার ডায়াল করল,

— “The number you have dialed is currently unavailable…”

To be continued…

#জলতরঙ্গের_সুর
পর্ব – ৩৮
লেখা – আসফিয়া রহমান
অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ❌

ঊর্মি ফোনটা কানে চেপে বসে আছে, কিন্তু ওপাশে কোনো সাড়া নেই। শুধু মেশিনের বিপ-শব্দের মতো কিছু ভেসে আসে মাঝে মাঝে, যেন কোনো হাসপাতালের শব্দ। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় ওর।

— আবরার? আবরার, কিছু বলুন না…

কথা বলতে বলতে গলাটা ভারী হয়ে আসে। পরের মুহূর্তেই লাইনটা কেটে যায়। ওর হাত কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন কে হাসপাতালে? কী হয়েছে ওর? ঊর্মি অস্থির হয়ে কাঁপা হাতে আবার ডায়াল করল, — “The number you have dialed is currently unavailable…”

উর্মি কিছুক্ষণ বোবা হয়ে বসে থাকল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল ওর। ফোনটা এখনো কানে ধরা, মাথাটা হঠাৎ করেই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী করবে, কী করা উচিত— কিচ্ছু মাথায় আসছে না মেয়েটার।

ওর বুক কাঁপছে। মনিটরের সেই ভয়ংকর শব্দটা যেন এখনো কানে বাজছে— বিপ… বিপ… বি——প…

উর্মি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, ঘরজুড়ে পায়চারি শুরু করল অস্থিরভাবে। চোখে জল টলমল করছে।
“না… না, এমন হতেই পারে না… ও ঠিক আছে… নিশ্চয় ঠিক আছে… কিচ্ছু হবে না ওর। এইতো এক্ষুনি আমার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলছিল…”

ও তাড়াতাড়ি কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে আরেকটা নাম ট্যাপ করল — “রাহেলা ফুপি”

রাহেলা চৌধুরী তখন ডাক্তারের সাথে কথা বলে সদ্য বেরিয়েছেন। মুখে ক্লান্ত স্বস্তির ছাপ তার— মাত্র কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার জানিয়েছেন, “Patient is stable now.”

ফোন বেজে উঠতেই তিনি চমকে তাকালেন।
“উর্মি?”

কলটা কি ধরবেন? ধরে কি জবাব দেবেন মেয়েটাকে?
শেষ পর্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে রাহেলা কলটা রিসিভ করলেন।

— হ্যাঁ উর্মি, বলো মা।

ওপাশ থেকে কান্নায় ভেজা কণ্ঠ এলো,
— ফ-ফুপি… ফুপি, আ-আবরার… আবরার আমার সাথে কথা বলছিল… হ-ঠাৎ করে কীসের একটা শব্দ হলো, মনিটরের শব্দের মতো, তারপর ফোনটা কেটে গেল! ফুপি, আমার মনে হচ্ছে ও হসপিটালে। আমি ডাক্তারদের গলা শুনেছি, ফুপি। কী হয়েছে ওর? ঠিক আছে তো ও?

ঊর্মির কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলেন রাহেলা। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেললেন। গলার স্বর স্থির রাখার চেষ্টা করতে করতে বললেন,
— উর্মি, শান্ত হও মা। আমি কল্লোলের কাছে আছি। আমি এইমাত্র ডাক্তারদের সাথে কথা বলে বের হচ্ছি। ডক্টর বলছে প্রেসার হঠাৎ ড্রপ করেছিল, কিন্তু এখন স্টেবল।

ওপাশ থেকে তাড়াহুড়ো গলায়, কাঁদো কাঁদো স্বরে ঊর্মি জিজ্ঞেস করল,
— কী হয়েছে ওর, ফুপি? শুধু শুধু একজন সুস্থ মানুষের প্রেসার ড্রপ করবে কেন? আপনি ওখানে কখন গেছেন, আমাকে জানাননি কেন?

রাহেলা চৌধুরী ফোনটা কানে চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। করিডোরের উজ্জ্বল সাদা আলোয় তাঁর মুখটা অদ্ভুত ফ্যাকাসে লাগছে। ধীর কণ্ঠে বললেন,
— আমি ভাবছিলাম, আগে ওকে একটু দেখে নেই… তারপর তোমাকে বলব। তুমি শুনলেই অস্থির হয়ে পড়তে। তাই…

— আপনি ভুল করেছেন, ফুপি!

ঊর্মির কান্নাভেজা গলাটা তীব্র শোনালো,
— আপনি জানেন, আমি রাত থেকে ঘুমাইনি? দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমাতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে, কিছু একটা হয়েছে ওর! আর এখন আপনি বলছেন ও হসপিটালে! আপনি কেমন করে লুকালেন আমার কাছ থেকে এটা?

রাহেলা কিছুক্ষণ নীরব। তারপর নিঃশব্দে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন,
— কল্লোলের কাঁধে দুটো গুলি লেগেছে… ঊর্মি। তোমাকে জানালে তুমি ভেঙে পড়তে।

ঊর্মি কেঁদেই যাচ্ছিল। রাহেলার ফিসফিসে কন্ঠস্বরে কথাটা শুনে থমকে গেল সে কান্না। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা— তারপর শুকনো হয়ে আসা খড়খড়ে গলাটা দিয়ে খুব কষ্ট কয়েকটা শব্দ বের করল ও,
— ক… কী বললেন আপনি, ফুপি? গ-গু-গুলি ম-মানে…?

রাহেলা চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন, যেন ফোনের ওপাশের অবস্থাটা ওনার আগে থেকেই জানা। ঠিক এই জন্যই তো মেয়েটাকে জানাননি তিনি।
— তুমি চিন্তা করো না, মা। দুটো গুলি কাঁধের মাংসে লেগেছে, খুব ভেতরে যায়নি। ডাক্তার বলেছে… vital organs untouched. এখন অবসারভেশনে আছে।

— আমি… আমি এখনই আসব, ফুপি। আপনি বলুন, কোন হাসপাতালে ও? আমি এখনই বের হচ্ছি…
কথার ফাঁকে ফাঁকে হাঁপাচ্ছে মেয়েটা।

রাহেলা চোখ বুজে আবারো মাথা নাড়লেন।
না, এখন না… এখন ওকে আসতে দেয়া যাবে না।
— না উর্মি, এখন না। ডাক্তার strict order দিয়েছে— ওকে কোনোরকম ইমোশনাল স্ট্রেস দেওয়া যাবে না এখন। ওর হার্টরেট হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছিল। তুমি এলে ও নিজেকে সামলাতে পারবে না। আর তুমি নিজেও এখন অস্থির হয়ে আছো।

ঊর্মি অসহায় কণ্ঠে বলল,
— কিন্তু আমি তো ওর স্ত্রী, ফুপি… আমি যেতে পারব না কেন? ও জেগে উঠলে যদি আমাকে খোঁজে? আমার তো মন মানছে না ফুপি…

উর্মির কণ্ঠ ভেঙে এল,
— আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম, ফুপি… হঠাৎ সব চুপ হয়ে গেল। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম…

রাহেলা চৌধুরী আস্তে করে বললেন,
— আমি জানি মা। ওর অবস্থা এমনিতেই দুর্বল। এখন ওকে ফোন ধরতে দিচ্ছে না। আমি এখানেই আছি, তুমি চিন্তা কোরো না।

উর্মি ঠোঁট কামড়ে বসে রইল বিছানায়। চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ল। ওর কানে যেন এখনো মনিটরের সেই ছন্দহারা শব্দটা বাজছে…

বি——প… বি——প…

________________________________

সন্ধ্যার পর কল্লোলের ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই ছোটবেলার মতো ফুপিকে খুঁজল। নার্স তৎক্ষণাৎ রাহেলাকে খবর দিল। রাহেলা চৌধুরী দ্রুত ভাইপোর কেবিনে ঢুকলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সময় তার মুখে চাপা স্বস্তির ছাপ।

কল্লোল শুকনো গলায় ডাকলো, “ফুপি…”

রাহেলা বিছানার পাশে গিয়ে বসে হাত রাখলেন ওর কপালে। ঠাণ্ডা আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে কল্লোল হাসল, চোখ বন্ধ করে বলল, “বুকের বদলে কাঁধে দুটো গুলি… আমার ভাগ্যটা খারাপ না কিন্তু, তাই না ফুপি?”

রাহেলা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। চোখে জল এসেছে। তবুও স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “ভাগ্য ভালোই বলব। আরও তিন ইঞ্চি নিচে গেলে অবস্থা আলাদা হতো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এখন শুধু বিশ্রাম নিতে হবে, ওষুধ নিতে হবে, সবরকম ভাবনাচিন্তা বাদ।

কল্লোল কিছু বলতে চাইল, কিন্তু হঠাৎ চোখ সরু করে তাকাল ফুপির দিকে, “ঊর্মিকে বলেছ?

প্রশ্নটার সঙ্গে বাতাসটা যেন ভারী হয়ে গেল। রাহেলা এক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে গেলেন। তারপর গভীর নিঃশ্বাস নিলেন, “ও নিজে থেকেই টের পেয়েছে, কল্লোল। ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলছিল তখন। শব্দ শুনে বুঝে ফেলেছিল তুমি হসপিটালে।

কল্লোলের দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “বেশি কান্নাকাটি করেছে?”

রাহেলা হাতটা ওর মাথায় রাখলেন। এক নজর তাকিয়ে ওর চোখের ভেতর দিয়ে সব কিছু পড়ে ফেললেন যেন। তারপর খুব নরম স্বরে বললেন, “এখানে আসতে চাইছিল, আমি বুঝিয়ে বলেছি। তুমি এখন এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। ওর সাথে পরে কথা হবে।”

কল্লোল নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। ওর চোখে ক্লান্তি, তবুও কোথাও যেন একটা অপরাধবোধের ছায়া লেগে আছে।
“ও ভয় পেয়েছে, ফুপি… তখন হঠাৎ করেই কথার মাঝখানে…”

রাহেলা চুপচাপ শুনছিলেন। আলতো করে বললেন,
“জানি, ডাক্তার বুঝিয়ে বলেছে আমাকে…”

একটু থামলেন রাহেলা, গলার স্বর নরম করে আবার বললেন, “ঊর্মির জায়গায় আমি থাকলে আমিও একইরকম ভয় পেতাম, কল্লোল। তুমি জানো না, তোমার ফোনটা বন্ধ পাওয়ার পর ও কীভাবে অস্থির হয়েছিল।”

রাহেলা চৌধুরী এক দম ফেললেন, “জীবনসঙ্গী হিসেবে তুমি ঊর্মির মতো একটা মেয়েকে পেয়েছ, এদিক থেকে তুমি অনেক ভাগ্যবান, কল্লোল। সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি রেস্ট করো। আমি আছি, ও-ও আছে।”

একটু নীরবতা নেমে এলো ঘরে। বাইরে করিডোরে নার্সের পায়ের শব্দ, মনিটরের বিটবিট আওয়াজ মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা তৈরি করছে। রাহেলা ওর কপালে হাত বুলিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, কল্লোল আস্তে করে বলল, “ফুপি, ওর সাথে একবার কথা বলি?”

রাহেলা থেমে গেলেন। তার চোখে মায়া আর ক্লান্ত মমতা, মুখে দ্বিধার রেখা, “এখনই? ডাক্তার বলেছে আজ বেশি কথা বলা যাবে না। শরীরটা একটু স্থির হোক, তারপর…”

তবুও কল্লোলের কন্ঠে একরাশ আকুতি, “শুধু একটু ফুপি। শুধু ওর কণ্ঠটা একটু শুনব…”

রাহেলা চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে। তারপর নিঃশব্দে ফোনটা বের করে দিলেন ওর হাতে, “বেশিক্ষণ না কিন্তু! ডাক্তার নিষেধ করেছে।”

ফোনটা হাতে নিতে নিতে কল্লোল মাথা নাড়ল। ওর ঠোঁটের কোনায় ছোট্ট একটা হাসির রেখা। ফোনটা হাতে নিয়ে ঊর্মির নাম্বারে ডায়াল করল ও।

কলটা কানেক্ট হলো। ওপাশে প্রথমে নিঃশব্দ… তারপর খুব ধীর একটা গলা,
— হ্যালো… ফুপি?

রাহেলা কল্লোলকে ইশারা করে বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। রাহেলা বেরিয়ে যেতেই কল্লোল আস্তে করে ডাকলো,
— ঊর্মি…

বাইরে বেরিয়ে রাহেলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, “আল্লাহ, এদের দুজনকে তুমি একসাথে রেখো সবসময়…”

ওপাশে এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। তারপর হঠাৎ গলার ভেতর জমে থাকা কান্নার শব্দটা চাপা দিতে দিতে ঊর্মি খুব আস্তে করে বলল,
— আবরার… তুমি… কথা বলতে পারছো?

কল্লোলের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ঊর্মির মুখের তুমি ডাকটা শুনে মনে হলো যেন এই ছোট্ট শব্দটুকুই পৃথিবীর সব ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর। ঠোঁটের কোণের হাসিটা ধরে রেখে কল্লোল ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
— ভয় পেয়েছিলে খুব?

ঊর্মি জবাব দিল না। তার বদলে জিজ্ঞেস করল,
— তুমি ঠিক আছো তো, আবরার?
ওর কণ্ঠটা যেন কাচের মতো ভঙ্গুর, একটু জোরে বললে ভেঙে যাবে।

কল্লোল চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। গলার ভেতর যেন কাঁটার মতো কিছু একটা আটকে আছে, তবুও শান্ত গলায় বলল,
— এখন ঠিক আছি, হানি। তুমি এত টেনশন কোরো না।

ওপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। তারপর খুব আস্তে করে ঊর্মি বলল,
— I miss you Abrar. I… I can’t take this anymore.

গলার ভেতর জমে থাকা অবরুদ্ধ সবটুকু আবেগ যেন একসাথে বেরিয়ে এলো। শব্দগুলো কাঁপছে, যেন বুকের ভেতর থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে প্রতিটি বর্ণ।

কল্লোলের ঠোঁটে হাসিটা জমাট বেঁধে গেল। বুকের বাঁ পাশটা পুড়ল প্রেম অনলে।
— I miss you too, honey… more than you can ever imagine.

কল্লোলের গলা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা যেন একটা অদৃশ্য চাপা কান্নায় ভারী হয়ে আছে। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
— তুমি ভেঙে পড়ো না, হানি… সবকিছু পার করে আমি তোমার কাছে ফিরব, খুব শিগগিরই।

ওপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ, মাঝে মাঝে ফোপানোর শব্দ আসছে। ঊর্মি ফিসফিস করে বলল,
— Please come back, Abrar. Please…

কল্লোল চোখ বন্ধ করে থাকল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তবুও ওর ঠোঁটের কোণে একটুকরো ম্লান হাসি,
— আসব… আসব তো, সোনা। তুমি একটু স্ট্রং হও, প্লিজ! আর কান্নাকাটি কোরো না, কেমন? তোমার কান্নার শব্দটা এই বুকে এসে লাগে…”

ওপাশে যেন নিঃশ্বাসও থমকে গেল। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। তারপর ঊর্মির গলায় কাঁপা ফিসফিসে স্বর,
— আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আবরার। সবকিছু এত হঠাৎ হলো যে আমি… আমি একা একা সামলাতে পারছি না।

কল্লোলের চোখ বুজে এলো। ঠোঁটের কোণে হাসিটা আর ধরে রাখতে পারল না, গলাটা নরম হয়ে এলো ওর,
— তুমি একা নও, হানি। আমি আছি তো। এই যে দেখো, আমি তোমার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের শব্দ আলাদা করে শুনতে পাচ্ছি।

একটু থেমে নিজেকে সামলে নিল ও,
— তুমি যদি শক্ত থাকো, আমিও শক্ত থাকতে পারব। তোমার কান্নার শব্দটা… এই বুকের ভেতর আগুন ধরায়।

ওপাশে আবার ফুপিয়ে ওঠা কান্নার শব্দ। তারপর খুব ধীরে, হালকা কণ্ঠে ঊর্মি বলল,
— আমি অপেক্ষা করব… তারাতাড়ি ফেরো, আবরার।

কল্লোলের ঠোঁট কেঁপে উঠল। ফোনটা কানের কাছে চেপে রেখে গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে খুব নরম স্বরে বলল,
— ফিরব, হানি… ফিরব। তুমি কেঁদো না।

ঠিক সেই সময় দরজার ওপাশ থেকে ঠকঠক শব্দের সাথে নার্সের কড়া গলা ভেসে এলো, “Sir, it’s your rest time.”

কল্লোল ফোনটা কানের কাছে চেপে শেষবারের মতো ফিসফিস করে বলল,
— ভালোবাসি, ঊর্মি…

ওপাশে নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে কাঁপা স্বরে উত্তর এলো,
— আমিও…

To be continued…