চিরন্তিনী পর্ব-০২

0
7

#চিরন্তিনী
পর্ব – ০২


তোহার আত্মচিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো। নাড়ে টান পড়তেই তলপেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো মাটিতে। ব্যাথায় খিঁচিয়ে এলো শরীর। মিতুল প্যান্ট পড়া শেষ হতেই ছুটে এলো দরজার সামনে। খালি গায়ে এখনো লিপস্টিকের ছাপ। সেটা দেখে আরো অস্থির হয়ে উঠলো। মিতুল দ্রুত শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরলো। টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলো ঘরের ভেতরে। দরজায় খিল টেনে অনুনয়ের সুরে বললো,

– দেখো, অনিচ্ছাকৃত ভুল এটা। প্লিজ চুপ করো, ভুলে যাও। তুমি জানো আমি এমন নই?

ঘৃনায় সারা গা গুলিয়ে এলো তোহার। ছাড়াতে চাইলো মিতুলের হাত থেকে। কিন্তু সক্ষম হলো না। খাটের কোনে দাঁড়িয়ে আছে তামান্না। তার চুলগুলো এলোমেলো, উস্কোখুস্কো। মুখে ভয়ের ছায়া। তোহা সেদিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। ত্রস্ত পায়ে হেটে এলো তামান্না। বড় বোনের পাশ এসে বসতেই খপ করে তার চুলের মুঠি ধরলো তোহা। সর্বোচ্চ জোর নিয়ে টেনে হিচড়ে মাটিতে ফেললো। পর পর কয়েকটা থাপ্পড় মেরে ঠোঁট ফাঁটিয়ে দিলো। মুখে অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললো,

– বে/শ্যা! পতিতা গিরি করবি তো আমার সংসারে কেনো আসলি? একবার ও ভাবলি না, এটা আমার সংসার!

মিতুলের দিকে ইশারা করে বললো,

– ও তো বেজন্মা, জারজ! বংশের ধারা আছে। কুত্তার মতো যেখানে সেখানে মুখ লাগায়। তাই বলে তুই কেনো এমন করলি। তোর বাপ- মা তো শিক্ষিত, ভদ্র। নাকি নিজেকে সামলাতে পারিস নি। তো বেসামাল যখন হইলিই, একটা অবিবাহিত ছেলের কাছে গিয়ে হইতি।

মিতুল এগিয়ে এসে তামান্নাকে ছাড়িয়ে নিলো। মাথা নিচু করে বলল,

– আচ্ছা, থামো। যা হয়েছে এই পর্যন্ত। এগুলো ভুলে যাও।

চমকে তাকায় তামান্না। কিছু বলতে গিয়েও মিতুলের ইশারায় থেমে যায়। ফোঁস ফোঁস করে উঠলো তোহা। ঘৃণা ছুড়ে বললো,

– ভুলে যাবো? কি ভুলে যাবো? এই যে তুই একটা চরিত্রহীন, বেজন্মা, বে/শ্যার ছেলে? ওরে কি করবি? রক্ষিতা হিসেবে রেখে দিবি? যখন মন চায় ভোগ করবি?

ক্ষেপে গেলো মিতুল। অন্যদিকে তাকিয়ে রাগ সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো। খবরদার, এ নিয়া কোনো টু শব্দটাও করবা না। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। টুকটাক ভুল সবারই হয়। খালি খালি সম্পর্ক নষ্ট কোরো না। আর এই ঘটনা যদি কেউ জানে, তাহলে তুমি আর তোমার বোন – দুজনের জন্যই খারাপ হবে।

মিতুল শার্ট আর লুঙ্গি হাতে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। দম বন্ধ হয়ে পড়ে রইলো তোহা। মাটিয়ে লুটিয়ে অনুভূতি হীনের মতো বসে রইলো। তামান্না ঠোঁটের রক্ত মুছে খাট থেকে ওড়না হাতে নিলো। ঘরের বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে অশ্রুসিক্ত চোখে সেদিকে তাকায় তোহা। ভাঙা স্বরে বলে উঠে,

– তোর বুক কাঁপলো না? কি করে করলি এতো বড় বেইমানি?

এতোক্ষণে বোনের দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তামান্না। ঠোঁট এলিয়ে ক্রুর হাসলো। আয়েশ করে খাটে বসে বললো,

– এখানে আমার কি দোষ? তুই তোর স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পারিস নি বলেই আমার কাছে এসেছে। আমি তাকে সামলেছি, তোর খুশি হওয়া উচিত। নাহলে তো বাইরের মেয়ের কাছে যেতো। শেষে সতীনের সংসার করতে হতো। কিন্তু আমি তো তোর বোন!

ভাবলেশহীন ভাবে জঘন্য এ কথা গুলো বলে দিলো তামান্না। পেট উগড়ে বমি আসছে তোহার। দুঃখে বুকের ভেতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কিছু বললো না আর। তাকিয়ে রইলো পাথরের মতো। একাকী ঘরটাতে লুটিয়ে পড়লো তোহা। তার এতো শখের সংসার, শখের স্বামী, প্রশান্তিদায়ক ঘর – সব নাপাক করে ফেলেছে। এলোমেলো বিছানার দিকে তাকাতেই কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অন্তর ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। মাথা কাজ করছে না। কি করবে সে? কাকে বলবে? আর কি – ইবা বলবে? বললেও তাতে তার কি লাভ হবে? বাবা- মায়ের কাছেও তো যাওয়ার মুখ নেই। তারা আগেই সাবধান করেছিলো। কিন্তু তোহা শোনেনি, শুনলে আজ এমন হতো না।

এই ঘরটাতে থাকতে আরো কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না, দমবন্ধ লাগছে। পেটের ব্যাথা আজ হার মেনেছে অন্তর্দহনের কাছে। সে তলপেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘরের বাইরে। বারান্দার পিড়ির উপর বসে খুটির সাথে হেলান দিলো। পুকুর থেকে গোসলের আওয়াজ আসছে। তোহা চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। খানিকক্ষণ পর লুঙ্গী পড়ে উঠোনে প্রবেশ করলো মিতুল। ভেঁজা গামছা এবং তোয়ালে মেলে দিলো দড়িতে। তোহার দিকে এক পলক তাকিয়ে ঢুকে গেলো ঘরের মধ্যে। দরজায় হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে তামান্না। সেদিকে চেয়ে মিতুল নিজেও হাসলো। পিছু ঘুরে তোহাকে দেখে তামান্নার সাথে দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয়। বলে,

– খেয়াল রেখো ওর দিকে। কাউকে কিছু জানালেই আমায় জানাবে। যা ব্যবস্থা করার, তা আমি করবো।

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো সে। হেলতে দুলতে ঢুকে গেলো মিতুনের ঘরে। উপরের চাদর টা কাঁধে নিয়ে বিছানা গুছিয়ে দিলো। টিটকারি মেরে বললো,

– তোমার বউকে এখন আসতে বলো। গুছিয়ে দিয়েছি।

চলে গেলো তামান্না। তোহা শক্ত হয়ে বসে রইলো। পেছনে না তাকালেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তামান্না আবারো তার ঘরে ঢুকেছে।

ঘড়ির কাঁটা আট’টাকে ছুঁয়েছে। মিতুল বাড়িতে নেই, বাজারে গিয়েছে। তামান্না টিভি দেখতে ব্যস্ত। সারাবাড়ি কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হলেও তোহার নিকট সবকিছু অমাবস্যার অন্ধকার। বিকাল থেকে একই স্থানে বসে আছে । একটু পর পর উঠোন, আমগাছ, তার ঘর সবকিছুতে চোখ বুলাচ্ছে আর ভাবছে। আদৌ কি সে সংসার করতে পারবে আর? মিতুলের মা মাত্রই উঠোনে প্রবেশ করেছে। হাতে মিষ্টির প্যাকেট এবং প্লেট। তোহাকে এই রাতের বেলা খোলা বারান্দায় দেখেই রেগে গেলেন। বললেন,

– কি অবস্থা? এই রাতে উঠোনে বসে আছো কেনো?

তোহা মলিন দৃষ্টিতে তাকায়। ক্ষীণ স্বরে বলে,

– এমনিই! এখানে ভালো লাগছে।

ধমক মারলেন তিনি। বললেন,

– ভালো লাগার ঠ্যালায় দিশা পাচ্ছো না? বিপদে পড়লেই বুঝবা। ওঠো, ঘরে যাও।

থেমে মিষ্টি এবং প্লেটের দিকে ইশারা করে বললো,

– ও বাড়ি থেকে মিষ্টি দিছে। আর তোমার জন্য মাইমুনার মা রাতের খাবার পাঠাইছে। আসো, ঘরে আসো।

চলে গেলেন তিনি। তোহা সেদিকে তাকিয়ে রইলো আনমনে। খানিকক্ষণ পর কিছু ভেবে উঠে বসলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো শাশুড়ীর ঘরের দিকে। খাটের উপর বসে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমাকে প্লেট টা দেন মা। খিদে পেয়েছে।

বড্ড তৃপ্তি করে খেলো তোহা। প্লেটের ভাতের পরেও আরো দু – বার নিয়েছে। খাওয়ার পর মলিন কন্ঠে আবদার করে বললো,

– আমি একটু এখানে ঘুমাই, মা?

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তোহার শাশুড়ী। তোহা তার ঘরে কেনো যাচ্ছে না? কিছু কি ঘটেছে মিতুলের সাথে। ভেবেও বুঝতে পারলেন না তিনি। ছেলে আসলে জানা যাবে। বললেন,

– ঘুমাও!

তোহা ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে। গায়ে পাতলা একটা কাথা দিয়ে কাত হয়ে চোখ বন্ধ করলো। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বাধলো ঝামেলা। মিলন মাতব্বর গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার সামনে। ভেতরে ছেলের বউ শুয়ে আছে। পাশে বসে আছে স্ত্রী আলেয়া। তিনিও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ঘুমন্ত মেয়েটাকে ওঠাতেও বিবেকে বাঁধছে। একবার সাহস করে বলেই উঠলেন,

– আপনি নাহয় আজ শিমুলের কাছে ঘুমান।

সাথে সাথেই চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ করলো মিলন। নিভে গেলেন আলেয়া। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন ঘরের বাইরে। মিতুলের দরজার সামনে গিয়ে আস্তেধীরে বললো,

– তোর সাথে কি বউয়ের ঝগড়া হইছে? ও আমার ঘরে ঘুমায় কেনো?

চমকে উঠলো মিতুল। ভেবেছিলো মাকে বলে সে ঘরেই ঘুমিয়েছে তোহা। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে সে কিছুই জানে না। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হলো। বললো,

– হয়তো এমনিই ঘুমিয়েছে। আমি আনছি।

এই বলে মায়ের ঘরে গিয়ে কোলে তুলে নিলো ঘুমন্ত তোহাকে। আলগোছে যেনো ঘুম না ভাঙে, সেভাবে শুইয়ে দিলো খাটে। এরপর নিজেও শুয়ে পড়লো লাইট নিভিয়ে।


সকালে ঘুম থেকে উঠেই মুখের সামনে মিতুলকে দেখলো তোহা। সাথে সাথে ভেতর থেকে ঘৃণা উগড়ে এলো। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। থামলো রান্নাঘরে গিয়ে। সাতটা বেজে গেছে প্রায়।

আজকে শিমুল খুব তাড়াতাড়ি উঠেছে। কাউকে কিছু বলার জন্য সারারাত ছটফট করেছে। তোহাকে একাকী রান্নাঘরে দেখেই বেরিয়ে এলো। চাপা স্বরে ডেকে বললো,

– ভাবী, একটু ঘরে আসো তো।

তোহা শিমুলের দরজায় তাকালো। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। ঘরে ঢুকে ভাবলেশহীন ভাবে খাটে বসলো। বললো,

– বলো..

বাইরে তাকিয়ে কেউ আছে কিনা তা একবার দেখে নিলো শিমুল। এরপর গম্ভীর আওয়াজে বলল,

– কাল মাঝরাতে তামান্নাকে তোমাদের ঘর থেকে বের হতে দেখেছি। তুমি তো ঘরেই ছিলে, এসব দেখোনি? আর এখনো ওকে বাড়িতে কেনো রেখেছো? সংসার টা ভাঙতে চাও?

তোহা শব্দ করে হাসলো। বললো,

– কোন সংসার? আদৌ কি কিছু আছে আমার।

শিমুল অবাক হয়ে তোহাকে দেখলো। মানসিক বিকারগস্ত মানুষের ন্যায় তোহা আচরণ করছে। উদগ্রীব হয়ে বললো,

– কি হয়েছে ভাবী? আমায় বলো।

হঠাৎই রেগে গেলো তোহা। শিমুলের শার্ট খামচে ধরে বললো,

– কেনো তুমি জানো না? আমায় জিজ্ঞেস করছো কেনো? তোমার বাপ- দাদা কারই বা চরিত্র ভালো ছিলো? তাদেরই তো রক্ত তোমার ভাই। সে কি করে চরিত্রবান হবে?

পরক্ষণেই হেসে দিয়ে কান্না করে দিলো। বললো,

– কিইবা আর করার? প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে তো আর তোমার ভাইকে সন্তুষ্ট করতে পারি নি। তাই সে রক্ষিতা রেখেছে। পারমানেন্ট রক্ষিতা! আমি কি করবো বলতে পারো? আমার কি করা উচিত?

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো শিমুল। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই ক্ষুব্ধ পায়ে ভেতরে ঢুকলো মিতুল। কোনো কথা না বলেই চুলের মুঠি ধরলো তোহার। সে যে সাড়ে সাত মাসের অন্তস্বত্তা তা বেমালুম ভুলেই বসলো। টেনে হিচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

– শিমুল কি তোর লাং নাকি? কিছু হইতে না হইতেই ওর সাথে ঘরে ঢুকিস কেনো? কি করছিলি এতোক্ষণ? কখন গেছো ওই ঘরে? রাতে, আমি ঘুমানোর পর? নষ্টা! আসলেই কি তোর পেটের বাচ্চা টা আমার? নাকি শিমুলের……..

চলবে?