চিরন্তিনী পর্ব-০৩

0
3

#চিরন্তনী
পর্ব- ০৩

“আমাকে এতোটা নৃশংস ভাবে কেনো ঠকাইলা? ’

তোহা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো। তাতে নেই রাগ, ক্ষোভ, অভিমান। শুধু রয়েছে জিজ্ঞাসা, জানার আকাঙ্ক্ষা। ঘাড়ের কালসিটে দাগ ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সকালে মারার দাগ পূর্বে লাল হয়ে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে গেছে। উঠোনের পূর্ব পাশে বিশাল একটা পুকুর। স্বচ্ছ, পরিস্কার পানির ভেতরে চাষ করা হয়েছে তেলাপিয়া। খুব বেশি নয়, শুধু চাষের মাছ খাওয়ার জন্যই এমনটা করেছেন মাতব্বর। তোহা ঘাটের নিচের সিঁড়িতে মূর্তির ন্যায় বসে আছে। খাওয়া- নাওয়া সবই যেনো মিছে। মিতুল তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
বস্তুত মায়ের জোরাজুরিতেই এখানে আসা। আলেয়া বেগম বাড়ির ঘটনায় বাকরুদ্ধ। বড় ছেলে বলছে – তোহার সাথে শিমুলের অবৈধ সম্পর্ক। এমনকি বাচ্চা স্বীকার করতেই অপরাগ সে। আবার হাতে হাতে সকাল বেলা শিমুলের ঘর থেকে টেনে বের করেছে তোহাকে। এদিকে শিমুল বলছে – মিতুলের সাথে তামান্নার অবৈধ সম্পর্ক। সেই ঘটনা ঢাকতে তাকে দোষারোপ করছে। মধ্যখানে তোহা নিস্তব্ধ। মার খেয়ে অবচেতনের মতো পড়ে ছিলো খুটিতে হেলান দিয়ে। শেষে রেগে মেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে শিমুল। সেই কাল আটটার দিকে খেয়েছে মেয়েটা। সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা, অথচ আজ পুরো দিন টা না খেয়ে আছে। কিছু হয়ে গেলে দোষ তাদেরই হবে। এজন্যই বড় ছেলেকে পাঠিয়েছেন তোহাকে নিয়ে।

মিতুল চোরাচোখে অন্যদিকে তাকায়। উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবেই। তোহা শান্ত, কোমল, স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। বললো,

– তোমার তো দোষ না। দোষ তোমার রক্তে, বংশে। আমি মেনে নিছি। কিন্তু এই তোমার সস্তা, নিকৃষ্ট চরিত্রটা আমার সামনে বের করার কি খুব দরকার ছিলো? আমাকে আগেই ডিভোর্স দিয়ে দিতা। তারপর যা খুশি করতা, যা কিছু! আমি সহ্য করে নিতাম।

তোহার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না মিতুল। বরং ধমক মেরে বললো,

– তোর এইসব ঢঙের কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করে না। খিদা লাগলে খেতে আসিস।

তোহা মলিন হাসলো। সেই হাসিতে বিভ্রান্ত হয়ে গেলো মিতুল। কিন্তু চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না। তোহা পূর্বের মতো নির্বিকার হয়ে বললো,

– তুমি নিজেও জানো শিমুলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরেও আমার চরিত্রে দাগ লাগালে কেনো? আর আমাকেও না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তোমার ভাই! আমার তো কলঙ্কের অভাব নেই, কিন্তু সে তো অবিবাহিত। এভাবে প্রতিবেশীদের ঘটা করে না জানালেও পারতে। সেই তোমার ভাইয়ের বদনামই হলো। ভাবীর সাথে প্রেম!

মিতুল আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। এখানে থাকলে তার মাথা খারাপ করে ফেলবে তোহা। শেষে উত্তেজিত হয়ে আবারও গায়ে হাত তুলে ফেলবে। এমনিতেও সকালে মারার পরে মিতুল নিজেও ভয়ে ছিলো। না জানি মরে টরে যায়। শেষে সে কেস- মামলায় পড়বে।

মিতুল চলে যাওয়ার প্রায় আধ ঘন্টা পরে তামান্না এলো পুকুর পাড়ে। তোহা পূর্বের মতোই নির্বিকার চিত্তে বসে আছে নিস্তব্ধ, নিশ্চল বারিধার দিকে চেয়ে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিকে এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুকুরের অপর পাশে বড় বড় আম গাছ। সেই গাছের অনির্দিষ্ট শাখা-প্রশাখা থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এ বাড়ির কুকুরটা আজ চারদিন ধরে সন্ধ্যা হলেই কাঁদে। সে কি ভয়ংকর কান্নার সুর! তোহার আত্মা কেঁপে উঠতো। কিন্তু আজ আর তা করে না। এতোদিন এই ডাকের কারন না বুঝলেও এখন সবটা পরিস্কার। গুরুজন রা বলে, কুকুরের কান্না বিরাট বিপদ বয়ে আনে। এনেছেই তো। তোহার সাজানো সংসারটা আজ শেষ। মাত্র দশ মাসের সংসার। বছর ও হয় নি এখনো। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঠিক আড়াই মাসের সময় সে গর্ভবতী হয়। এরপর এ বাড়িতে আসলো, ছোট ছোট হাতে সংসার টা গুছিয়ে নিলো। ঠিক ছয় মাসের সময় জানতে পারলো সে সাড়ে তিন মাসের অন্তঃসত্তা। দেখতে দেখতে গর্ভের বয়স আজ সাড়ে সাত মাস। কিন্তু তার সংসারের সময় ফুরিয়ে গেলো।

– পেটের টাকে মারবি নাকি? খাচ্ছিস না কেনো?

তোহা চমকে উঠে পেছনে তাকায়। তামান্নার অবয়ব চোখে পরতেই ঘৃণায় সারা শরীর কেঁপে ওঠে। রাগ বাড়তে থাকে তরতর করে। কিন্তু সে কিছুই করবে না। নিজেকে অতি কষ্টে সংযত করে বসে রইলো। তামান্না পুণরায় বলে ওঠে,

– রাগ হচ্ছে? আমারো হয়। প্রচুর! তুই তোর জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলি। লাঙ নিয়া পালাইছিস তুই, আর লেখাপড়া বন্ধ হইছে আমার। আসামীর মতো একপ্রকার ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে ছিলাম। একবার ও খোঁজ নিছিস? তুই তো ঠিকই স্বামী নিয়া মস্তিতে ছিলি। আমার ফোনটা পর্যন্ত নিয়ে গেছিলো আব্বু। সাদমান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারি নাই। একসময় শুনলাম সে দিশার সাথে সম্পর্কে জড়াইছে। আমার তখন কষ্ট হয় নাই? সব তোর জন্য হইছে। যার জন্য আমার জীবনটা শেষ, তারে কিভাবে সুখে- শান্তিতে সংসার করতে দেই? আর তাছাড়াও, মিতুল ভাই আমারে অনেক পছন্দ করে। করবে নাই বা কেনো? তোর মতো তো আর আমার গায়ের রঙ চাপা না।

তোহা শব্দ করে হেঁসে উঠলো। তাচ্ছিল্য করে বলল,

– তোর আমার স্বামীর সাথে সংসার করার অনেক সাধ, তাই না? তো, ঠিক আছে। এই সাধ আমি পূরণ করবো। বড় বোন হয়ে যেখানে – সেখানে ছেলেদের সাথে তো আর বে/শ্যাগিরি করতে দিতে পারি না!

তামান্না চোখ মুখ শক্ত করে তাকালো। তোহা হাসছে! কিভাবে? তাকে তো কাঁদাতে চায় সে। কিন্তু তাও পারছে না। বিরক্ত হয়ে কোনো কথা না বলেই বাড়ির দিকে চলে গেলো। তামান্নাকেও পাঠিয়েছিলেন আলেয়া। নিজের ভালো মানুষী টা সকলের সামনে দেখানোর কারনে তোহাকে সাধতে গেছিলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলো। এরপর আরো ঘন্টা খানেক পর তোহার শাশুড়ী আলেয়া বেগম গেলেন। অতি আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি যেতেই উঠে এলেন তোহা। শাশুড়ীর ঘরে বসে পেট ভরে ভাত খেলো। এরপর শক্ত কন্ঠে বললো,

– আমি আজকের রাত টা আপনার কাছেই ঘুমাবো। আব্বাকে বলবেন বারান্দায় শুতে।

এরপর নয়টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। আলেয়ার রীতিনীতি বোঝা গেলো না। সে আদৌ রেগে আছে নাকি কষ্ট পাচ্ছে এসব ও প্রকাশ করছেন না। শুধু অপেক্ষায় আছেন তোহার মা – বাবার জন্য। তাদেরকে খবর দেওয়া হয়েছে। কাল আসবেন বলেছেন। এদিকে আশেপাশের দু- চার জন প্রতিবেশী সকালে চেঁচামেচির কারনে এসেছিলেন উঠোনে। পুরো ঘটনা জানেন তারা। কিন্তু এখন আর সেই দু চারজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে নি। পুরো এলাকা ছাপিয়েছে। বাজারে,হাটে বসে সবাই মজা উড়াচ্ছেন এই বলে যে মাতব্বরের ছেলে- বউয়ের চরিত্র বলে কথা। শালী- দুলাভাই, দেবর- ভাবীর মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক থাকা টা অস্বাভাবিক না।

এদিকে সামনাসামনি এসে সম্মানের সাথে বলছেন, এগুলো মেনে নেওয়া যায় না। এর বিচার করতেই হবে। আপনার বাড়িতে ঘটেছে বলে সব ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামীকাল তোহার বাবা-মা এলে এ বাড়ির উঠোনে চার – পাঁচ জন গনমান্য মানুষের সামনে সালিশ বসবে।


সকালে ঠিক নয়টায় ঘুম ভাঙলো তোহার। আঘাতের যন্ত্রণায় গায়ে জ্বর উঠেছে প্রবলভাবে। সারামুখ লাল হয়ে গেছে তার প্রভাবে। মাঝরাতে ছেলে বউয়ের গায়ের কাপুনিতে ভয় পেয়ে গেছিলেন আলেয়া। কয়েকবার জলপট্টি দিয়ে, গায়ে মোটা কাঁথা দিয়ে তারপর একটু ঘুমিয়েছেন। বাড়িতে এ যাবৎ কয়েকবার লোক এসেছেন। সালিশের সময় ছিলো সকাল আট টা। কিন্তু তোহার ঘুমের কারনে তারা বিরক্ত হয়েছেন। সময় পরিবর্তন করে শেষে দশটায় দেওয়া হয়েছে।

শরীর টা জ্বরে কাঁপছে। সারা গা বিষ হয়ে আছে যন্ত্রণায়। পেটের মধ্য টা যেনো পাথর হয়ে গেছে। কাল লাথি মেরেছিলো মিতুল। চোখ খুলে মা কে সামনে দেখেই থমকে গেলো তোহা। কবিতা বেগম স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। সে দৃষ্টিতে রাগ, ঘৃণা, মায়া- মমতা, অভিমান সকল কিছুর মিশ্রিত রুপ। এসেছেন সেই সাত টার সময়। তোহার বাবা আসেননি। রাগে, দুঃখে নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছেন। এতো লজ্জা কি করে সইবেন তিনি? কিভাবে একজন শিক্ষক হয়ে মাথা নিচু করে এলাকার সবার সামনে দাঁড়াবেন? লোকে তো থু থু দেবে। কিন্তু কবিতা তা পারে নি। নাড়ীর টানে, মেয়েদের রক্ষায় ঠিকই ছুটে এসেছেন। তিনি তোহাকে কিচ্ছু বললেন না। যা শোনার বা বলার তা তামান্নাই জানিয়েছে সকালে। তোহা নিজেও চুপ রইলো। কি বলবে সে মায়ের কাছে? এই যে তার বোনই সংসার ভেঙেছে। সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিস্তব্ধ মূর্তির ন্যায় বসে রইলেন ঘরের কোণে।

বেলা প্রায় দশটা। উঠোনের এক কোনে রাখা হয়েছে আট টা চেয়ার। আমগাছের ছায়ায় রাখা সে চেয়ার গুলোতে বসে আছে এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতব্বর, একজন শিক্ষক, একজন ইমাম, ও কাজি। সাথে মিতুল নিজেও দাম্ভীকতার সাথে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। পাশের চেয়ারটা খালি। এটা রাখা হয়েছিলো তোহার বাবার জন্য। উঠোনের এক পাশে মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোহা। পাশে শিমুল ও তার শাশুড়ী। তার বিপরীত পার্শ্বে আছে তামান্না এবং কবিতা বেগম। দূরে দোরগোড়ায় বসে আছেন প্রতিবেশী দুই মহিলা।

আজকের সালিশি করবেন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি সর্বপ্রথম আলেয়া বেগমকে প্রশ্ন ছুড়লেন। বললেন,

– কি গো মাতারী? ঘরের মধ্যে তো সবসময়ই তুমি থাকো। তুমিই প্রথম ঘটনা টা বলো। কার দোষ, কার গুণ সেগুলাও বলো।

আলেয়া বড় ছেলের দিকে চাইলেন। শান্ত গলায় উত্তর দিয়ে বললেন,

– আমার পোলা শহর থেকে আসার পর পরই এই মেয়ের জন্য পাগল হয়। ওর পাগলামি তে সম্বন্ধ নিয়া গেলেও তা মাস্টারসাহেব মানে নাই। পড়ে মেয়ে নিয়া পলাইছে। এরপর বউ নিয়া বাড়ি আসলো। প্রথম প্রথম বউ রে মানতে পারি নাই মন থেকে। কিন্তু পরে ছেলে – বউ য়ের মায়া- মহব্বত দেইখা মন গললো। সংসারের প্রতি তোহার টান, তোহার প্রতি মিতুলের টান, এসবের কথা ভাবলে এখন কার ঘটনা গুলো সব দুঃস্বপ্ন মনে হয়। আমার সামনে সন্দেহ জনক কিছুই ঘটে নাই। তবে, কিছু তো একটা হইছেই। শয়তানের ফ্যাড়ে পইরা কেউ তো কিছু করছেই। কোন অলক্ষীর নজর লাগলো আমার সংসারে, আল্লাহ’ই জানে।

অলক্ষী বলার সঙ্গে সঙ্গে তামান্না আলেয়ার দিকে চাইলেন। মুহুর্তেই চোখাচোখি হলো দুজনের। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে ভড়কে গেলো তামান্না। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে তাকালো মিতুলের দিকে। তার মা কি তামান্না কে সন্দেহ করে নাকি? এমন হলে বিয়ের পর সংসার করবে কিভাবে? আলেয়ার উত্তর শুনে চেয়ারম্যান অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন,

– ধুরো! ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ থাকো, অথচ দেবরের সাথে ভাবীর অবৈধ সম্পর্ক হয়, শালীর সাথে দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক হয় – এইসব ব্যাপারে কিছুই জানো না? পাগল পাইছো আমাগো?

কিছু বললেন না আলেয়া। চুপ করে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। চেয়ারম্যানের ব্যবহার ভালো লাগছে না। কিভাবে এই ব্যবহার করতে পারেন তার সাথে। তাও স্বামী নিশ্চুপ।

এ পর্যায়ে মাথা নিচু করে কাপতে থাকা দূর্বল শরীর টার দিকে চাইলেন চেয়ারম্যান। জিজ্ঞেস করলেন,

– তোমার কি গায়ে জ্বর?

তোহা মাথা নাড়ালো। চেয়ারম্যান তাকে চেয়ার দিতে বললেন। তোহা বসলো তাতে।

– স্বামী কি মারছে?

তোহা আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। মিতুলের দিকে তাকালো চেয়ারম্যান। মুহুর্তে’ই হুঙ্কার ছেড়ে মিতুল বললো,

– মাথা ঠিক রাখতে পারি নাই কাকা। আপনি আমার জায়গায় হইলে কি করতেন?

চলবে?