চিরন্তিনী পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
1

#চিরন্তিনী
শেষ পর্ব


‘ আমাদের মধ্যে কি কখনো বাজে, অশ্লীল, আপত্তিকর কোনো সম্পর্ক ছিলো?’

তোহার শীতল কন্ঠের প্রশ্নে চমকে উঠলো শিমুল। খাটের পাশে বসে ছিলো এতোক্ষণ। জ্ঞানহীন তোহাকে সুস্থ করার প্রয়াসে জলপট্টি এনেছিলো। তার শরীরে অস্বাভাবিক মাত্রায় জ্বর। এই অবস্থায় এতোটা জ্বর হলে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আকস্মিক এই প্রশ্নে সে ভীত হয়। তোহার দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে শুধায়,

– এসব কি বলছো তুমি?

– আমার গর্ভের বাচ্চা যদি তোমার না-ই হয়, তাহলে স্বীকার করেছো কেনো?

– তুমি দেখেছিলে না, ওরা কিভাবে অপমান করছিলো? বারবার দোষ দিচ্ছিলো তোমায়- আমায়!

তোহা মলিন হাসলো। শিমুল তাকে এনে নিজের বিছানায় শুইয়েছে। এটা দেখতে ঘৃণা আরো বাড়লো। কম্পন রত শরীর নিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেললো মাটিতে। তাচ্ছিল্য করে বললো,

– শুধু দোষ’ই দিচ্ছিলো। কিন্তু তুমি তো পুরোটা স্বীকার ই করে নিলে। আমায় অপমান করলে, আমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করলে পুরো গ্রামের মানুষের সামনে। আদৌ কি তুমি এটাই চেয়েছিলে? যাতে সকলের অপমানে আমি কোনঠাসা হয়ে তোমার কাছে ফিরি।

শিমুল অবাক নয়নে তোহাকে দেখলো। বললো,

– আমি তোমার ক্ষতি চাইবো?

তোহা হাসলো। সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শিমুলের উপর। বললো,

– চাইতেও পারো। আজকাল পুরাতন প্রেম হয়তো জেগে উঠেছে। তাই আমার দূর্ভোগের সময় আমাকেই শেষ করে দিলে। কি ভেবেছো? এই বদনাম রটিয়ে আমাকে তুমি পাবে? জীবনেও না। আসলেই আমি বোকা। এতো এতো নিকৃষ্ট মানুষ কে আপন করেছি যে জীবনে আর কোনো ভুল করা বাদ নেই।

শিমুলের চোখ জ্বলছে, ক্ষোভ বাড়ছে। পুরোনো স্মৃতি গুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নিজেকে এতোটা তুচ্ছ মনে হয় নি কখনো। আসলেই কি সে এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যতার যোগ্য।

-পুরোনো প্রেম! যেটা কখনো ভুলিই নি, সেটা নতুন করে জেগে ওঠার কি আছে? আমাকে তোমার স্বার্থপর মনে হয়। কিন্তু একবার বলো তো, কোন স্বার্থ টা আমি পেয়েছি? তুমি কি হয়েছো আমার? বছরের পর পর পাগলের মতো তোমার পিছু ঘুরলাম, অথচ শেষে গিয়ে প্রেমে পড়লে আমার বড় ভাইয়ের। তাকে বিয়ে করে আমার কাছে এসে থাকছো। কিন্তু কখনো এসব নিয়ে কিছু বলেছি আমি? সবার সামনে স্বাভাবিক থেকেছি, যন্ত্রণায় একা একা ছটফট করেছি।

থেমে শান্ত কন্ঠে বললো,

– আমি চাইলেই ভাইয়ার কাছে তোমায় নিয়ে অনেক কিছু বলতে পারতাম। আমার সাথে তোমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো, আমরা প্রেম করতাম – এসব মিথ্যে বলে নিমিষেই ভাইয়ার মন বিষিয়ে তুলতে পারতাম। তোমাকে নিজের করতে পারতাম। কিন্তু করি নি। কারন আমি স্বার্থপর না। কিন্তু এখন বলেছি। সকলের সামনে মিথ্যে বলেছি। কারন আমি ছাড়া তোমার গতি নেই। বাঁচতে পারবে না। অন্তত তোমার এই চরিত্রহীন স্বামীর তুলনায় আমি যোগ্য। তাই তুমি আমার৷ আমার কাছেই থাকবে। এটাই ফাইনাল। নাহলে….

তোহা শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,

– নাহলে কি?

– তোমাকে পাওয়ার জন্য যদি আকাশসম মিথ্যে বলতে হয়, তাও আমি বলবো। কিন্তু এবারে আর তোমায় হাতছাড়া করছি না।

কতটা সাবলীল স্বীকারোক্তি। তোহা অবাক হলো। বললো,

– চরিত্রহীন স্বামীর থেকে বাঁচাতে, তুমি আমাকেই চরিত্রহীন তকমা লাগিয়ে দিলে!

শিমুল উত্তর দিলো না। বড় বড় পা ফেলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তোহা ফোলা পেটের উপর হাত বুলিয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে। ভেতর থেকে হুট করেই নড়ে উঠলো। পেটের এক পাশ টা সামান্য উঁচু হয়ে আবার দেবে গেলো। আহা! কি আনন্দের মুহুর্ত! তার সন্তান নড়ছে। হয়তো এমন করুন সময়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে বলছে, ‘ মা, আমি আছি তো। তুমি ভেঙে পড়ো না। ’

কিন্তু তোহা তো ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। এতোটা অপমান, অসম্মান,অবহেলা কি করে সইবে? বাঁচতে পারবে না আর। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। সকলের ঘৃণা, তাচ্ছিল্য নিয়ে বেঁচে থাকবে কি করে? কিছু একটা ভেবে পেটের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁ দে উঠলো সে।

খানিক্ষণ কেঁদে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। চোখের পানি মুছে ধীর গতিতে হেঁটে গেলো নিজের ঘরে। হ্যাঁ, তার ঘর। তার স্বামীর ঘর। দরজা চাপানো দেখে তোহার বুক টা ধক্ করে উঠলো। এখন যাওয়া কি ঠিক হবে? যদি ভেতরে তামান্না আর মিতুল থাকে, তাহলে তা সহ্য করবে কিভাবে? নাহ! এই যন্ত্রণা দ্বিতীয় বার সহ্য করতে পারবে না তোহা। দাঁড়িয়ে রইলো ওখানেই। কিছুক্ষণ ভেবে আলতো হাতে ঠেলে খুলে ফেললো দরজা। শব্দ পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মিতুল। তোহা কে দেখে কোনো প্রকার শব্দ করলো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। ঘটনা গুলো কুড়ে কুড়ে যাচ্ছে। শালিসের পর থেকে কেনো যেনো কিছুই ভালো লাগছে না। যা হচ্ছে সব ভুল হচ্ছে। এসব অদ্ভুত অনুভূতি শরীর টাকে ঘন্টার মধ্যে নিস্তেজ করে দিয়েছে।

মিতুল খালি গায়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ঘরে কোনো আলো নেই। শুধুমাত্র একটা জানালা খোলা। সেখান থেকেই চিরচির করে আলো ঢুকছে। তোহা এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। থমথমে মূর্তির ন্যায় মুখখানি তার। তাতে নেই কোনো ভালো লাগা বা খারাপ লাগার ছোয়া। যেনো কোনো অনুভূতিই নেই।
নিরব, নিস্তেজ ভঙ্গিতে খাটে বসলো। মিতুলের পাশে শুয়ে কাত হয়ে তার দিকে ফিরলো। পূর্বের ন্যায় পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। থমকে গেলো মিতুল। কেপে উঠলো তার হৃৎপিন্ড। শক্ত হয়ে শুয়ে রইলো অন্যদিকে ফিরে।

– একটা সুন্দর সংসারের সাধ যার থাকে, তার কপালেই সংসার জোটে না।

এই কথার প্রেক্ষিতে মিতুল নিরব রইলো। তার নিরবতা পেয়ে তোহা বলে উঠলো,

– আমার কথা ভেবে তোমার হাসি পায় না? কত টা বোকা আমি! নিজের বোন ঠকালো, যার হাতে মরার ভয় না করে পালিয়েছি সেই স্বামী ঠকালো। যাকে বড় ভাই এর মতো মনে করতাম সেই দেবর ও ঠকালো। যাকে আমি স্বচ্ছ হৃদয়ে ভাই ভাবতাম, তার মনে আমার জন্য লালসা ছিলো৷ কতটা বিশ্রী ব্যাপার! গ্রামের মহিলারা না জানি কবে আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে বাইরে বের করে। মুখের উপর থু থু মারে।

চোখ বন্ধ করে নিলো মিতুল। ঘুরে তাকালো তোহার দিকে। জড়িয়ে ধরলো দু হাতে। সান্নিধ্যে স্বামীর বুকে মাথা রাখলো তোহা। হু হু করে কেঁদে উঠলো।বললো,

– তুমি কি আমায় কখনোই ভালোবাসোনি? কিভাবে পারলে এতো লোকের সামনে চরিত্রহীন বলতে? নিজের সন্তান কে পর্যন্ত অস্বীকার করেছো। কি করে?

মিতুল আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তোহাকে। গমগমে স্বরে বললো,

– ঘটনা এতোদুরে তো তুমিই ঘটিয়েছো। বলেছিলাম ভুল করেছি, ক্ষমাও চেয়েছি। একটু সহ্য করে নিলে কি এমন হতো?

তোহা মলিন হাসলো। বললো,

– হ্যাঁ , আমারই তো ভুল!

_____
স্ত্রীকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো মিতুল। কিন্তু তোহা ঘুমায়নি। সে তাকিয়ে আছে স্বামীর মুখপানে। সারাদিন না খেয়ে আছে বাড়ির সবাই। আকস্মিক এমন ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেছে বাড়ির নিয়ম। স্তব্ধ হয়ে গেছে আলেয়া। হয়তো রান্না ও বসায়নি এখনো। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়েছে। তোহা ধীর পায়ে মিতুল কে রেখে বেরিয়ে এলো বাইরে। রান্না ঘরে পিরিতে বসে আলু কাটছে আলেয়া। চোখে তার অশ্রু। সব সময়ে কঠোর চিত্তে থাকা শাশুড়ী আজ তার জন্যেই কাঁদছেন। ছেলে – বউয়ের মধ্যে কার পক্ষ নিবেন, এই ভেবে ক্লান্ত প্রায়। তোহা রান্নাঘরে ঢুকলো। আলেয়া তাকালেই সে হেসে ফেলে। চেয়ার টেনে বসে শান্ত কন্ঠে বললো,

– রান্না এখনো বসান নি মা? এদিকে বাড়ির সবাই না খেয়ে।

আলেয়া ক্ষুদ্ধ চোখে তাকালেন। ঝাড়ি মেরে বললেন,

– কে খেলো, কে খেলো না এসব ভেবে তোমার কি? সংসার তো হারিয়েছোই।

– সে নাহয় হারালাম। তাই বলে আপনারা না খেয়ে থাকবেন?

উত্তর দিলো না আলেয়া। নতমুখী হয়ে আলুর খোসা ছাড়াতে লাগলো। তোহা উঠোনের দিকে তাকালো। গোটা বিশেক মোরগ মুরগী ধান খাচ্ছে। এর মধ্যের সব থেকে বড় মোরগ টা চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। আনমনেই বলে উঠলো,

– বড় মোরগ টা তো আপনার খুব আদরের। আমি যদি এটা খেতে চাই, তাহলে দিবেন? খেতে ইচ্ছে করছে হুট করেই।

আলেয়া অবাক নেত্রে তাকালো। খানিকক্ষণ ভেবে বললো,

– ইচ্ছা করলে খাও।

চোখ দুটো চকচক করে উঠলো তোহার। বললো,

– তাহলে ধরে দিন।

আলেয়া উঠে দাঁড়ালেন। এপাশে চাল ছিটিয়ে দিয়ে দু মিনিটের মধ্যে ধরে ফেললেন মোরগ টা। তোহার হাতে দিয়ে বললো,

– রান্না করে দেবো?

– নাহ! আমিই রাধি।

কিছুক্ষণ পর পুণরায় আলেয়া কে ডাকলো তোহা। বললো,

– মা, একটু পোলাও ও রাধি। মোরগ টার সাথে ভালো লাগবে খেতে।

সায় দিলেন আলেয়া। তোহাকে পোলাও রাধতে দিয়ে মোরগ টা জবাই করলেন। কেটে, ধুয়ে, মসলা বেটে তারপর তোহার পাশে দিলেন। মনের মতো করে রাধুক মেয়েটা।

____
আসরের আজান দিয়েছে মাত্র। এতোক্ষণে কয়েক বার হাঁক ছেড়েছে মিতুলের বাবা। আসর গড়িয়ে গেছে অথচ খাবার জোটেনি। স্ত্রীকে ডেকে ধমকানোর পর যখন তিনি জানালেন তোহা মোরগ-পোলাও রাধছে, তখন চুপ করে গেলেন। তারও প্রায় আধ ঘন্টা পর শাশুড়ীর ঘরের মাটিতে পাটি বিছিয়ে খাবার বাড়লো তোহা। আলেয়া কে বলল,

– চলুন মা,কদিন ই বা আছি। আজ নাহয় এক সাথেই খাই।

আলেয়া অবাক হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। একে একে ডেকে আনলেন সবাইকে। মিতুল,তার বাবা, তামান্না, আলেয়া সবাইকে দেখলেও শিমুল অনুপস্থিত। তোহা কাউকে খেতে দিলো না। অপেক্ষা করতে লাগলো। খানিকক্ষণ পর শিমুল ও এলো। সবাইকে দেখে ভীষণ খুশি হলো তোহা। যথেষ্ট যত্নের সাথে বেড়ে দিলো খাবার। তাদের এক পাশে চেয়ারে বসে সেও দু লোকমা মুখে নিলো পোলাও। কিন্তু মাংস আর ছুলো না। আলেয়া অবাক হয়। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,

– তুমিই তো মোরগ টা খেতে চাইলা। এখন কেনো খাচ্ছো না?

মলিন দৃষ্টিতে শাশুড়ীর দিকে তাকায়। বলে,

– শখের কোন জিনিসটা পেয়েছি আমি? এতো আশা করে খেতে চাইলাম, অথচ এখন দেখেই গা গোলাচ্ছে। রাতে খাবো, আপনারা খেয়ে নেন।

এই বলে চেয়ার ছেড়ে ধীর পায়ে বাইরে বের হলো তোহা। ঘরের দরজায় বিশাল একটা তালা ঝুলিয়ে দিলো। কথা বলার ফাঁকে সেসব খেয়াল করলো না কেউই। তোহা রান্নাঘরে গেলো। কেরোসিনের বড় বোতল টা এনে ধীরে ধীরে বাড়ির চারপাশে এবং চালে ঢাললো। দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সাথে চেঁচামেচিও। তোহা অদ্ভুত ভাবে জোরে হেসে উঠলো। যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
হাতের মশাল টা জ্বালিয়ে ঘর জ্বালাতে গিয়েও থেমে গেলো। ক্ষোভ নিয়ে ফেলে দিলো উঠোনে। এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। কিছু একটা মনে করে আবারো গেলো মশালের কাছে। শক্ত হাতে ছুড়ে মারলো রান্নাঘরের চালে। এই ঘরের পাশেই তোহার শাশুড়ীর ঘর। ফলস্বরূপ আগুনের তাপ এবং ধোঁয়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে হুরহুর করে ঢুকছে। সেই ধোঁয়ায় ঘরের ভেতরে ছটফট করতে থাকা মানুষ গুলো আরো নেতিয়ে পড়লো। শিমুল বিষের প্রক্রিয়ায় অস্থির হয়ে উঠলো। যন্ত্রণাময় শরীর নিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা চালালেও ব্যর্থ হলো। পরবর্তীতে এগিয়ে গেলো জানালার দিকে। একটা শিক ভাঙতেই বাইরে থেকে বটি দিয়ে কোপ মারলো তোহা। দুটো আঙুল কেঁটে ছিটকে বাইরে পড়লো। যন্ত্রণায় হাত ঝাড়তে ঝাড়তে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। সে দৃশ্য দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে বেড়ার এক কোনায় বসে পড়লো তামান্না। চিৎকার করতে পারছে না সে। গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে।

আরো পাঁচ মিনিট দরজা- বেড়া ভাঙার জন্য ভেতরের সবাই ধস্তাধস্তি করলো। কিন্তু পারলো না। ভয়ংকর বিষের প্রভাবে শরীর নেতিয়ে পড়েছে। যখন সকলে মাটিতে পড়ে প্রাণ টুকু যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো, তখন ঘরের তালা খোলে তোহা। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় শশুরের দিকে। তার চোখে মুখে দয়া ভিক্ষা চাওয়ার অভিব্যক্তি। হয়তো বলতে চাইছেন, তার কি দোষ। মিতুলের শাস্তি সে কেনো পাবে?

কিন্তু তোহা একটুও গললো না। সে তার কাছে গিয়ে বসলো। হিংস্র কন্ঠে বললো,

– ভাবছেন, আপনাকে কেনো বিষ খাওয়ালাম? কারন আপনি দুইটা কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছেন। এই সব নষ্টামি তো আপনার থেকেই শিখেছে।

আগুন ছড়িয়ে গেছে এ ঘরেও। চাল ছেয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু নড়তে পারছে না কেউই। সবাই শুয়ে আছে অবলীলায়, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে। তোহা মিতুলের কাছে গেলো। দুহাতে তার গাল ছুয়ে কপালে চুমু দিলো। শান্ত কন্ঠে বললো,

– আমিই যখন সংসার করতে পারলাম না, তখন তোমাকে অন্য কারোর সাথে কিভাবে সংসার করতে দেই? বলো।

মিতুল রক্তবমি করে ফেলেছে। হয়তো একটু বেশিই মাংস খেয়ে ফেলেছিলো। নিভুনিভু চোখে তাকালো দুরে থাকা তামান্নার দিকে। বেড়ায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে সে। হিংস্র হয়ে উঠলো তোহা। পা দিয়ে চেপে ধরলো তামান্নার মুখ। দু দুটো লাত্থি মারলো বুকে। হিংস্র কন্ঠে বললো,

– আমার স্বামীকে নিয়ে সংসার করার বড্ড সাধ ছিলো তোর। তাই না? খা****!!!!!

অশ্রাব্য গালি দিয়ে আরো দুটো লাত্থি মারলো মুখের উপর। নিস্তেজ হয়ে পড়লো তামান্না। শিমুল তাকিয়ে আছে বিস্ফোরিত চোখে। নড়তে না পারলেও বাঁচার বহু প্রয়াস তার। তা দেখে তোহা হাসলো। বললো,

– বিষ তো কম দেই নি। দু মিনিটের মধ্যে মরার কথা ছিলো। কিন্তু এখনো মরিস নি কেনো?

আলেয়া বেগম মাংসের পেয়ালার দিকে তাকিয়ে আছেন। তোহা তার সামনে গিয়ে খুব কাঁদলো। হাত ধরে বললো,

– আপনাকে কেনো বিষ খাইয়েছি, জানেন মা? বেঁচে থাকলে স্বামী- সন্তান হারিয়ে অনেক কষ্টে থাকবেন। প্রতি নিয়ত কাঁদবেন। তার থেকে ছেলেদের সাথেই চলে যান।

মাতব্বর বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে প্রচুর। আশেপাশের সকলে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। আগুন লেগেছে। কয়েকজন মিলে গেট ভেঙে উঠোনে এসে বারংবার ডাকলেও সারা পায় নি কোনো। মূল দরজা ও তালা দেওয়া। এর মানে ভেতরে কেউ নেই। কিন্তু আগুন প্রতি সেকেন্ডে ছড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশে কারেন্টের তার এবং বৈদ্যুতিক খুটি আছে। দু একটা বাড়ি এবং শুকনো খড়ের গাদা ও রয়েছে। একবার আগুন ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ বিপদ। শেষে তারা সকলে মিলে আগুন নেভানোর কাজে নেমে পড়লো। বালতি দিয়ে আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে এক পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস আসে। আগুন নেভাতে গিয়ে ঘরের তালা ভাঙতে বাধ্য হয়। উপরের চালা এবং বেড়ায় আগুন লাগলেও ভেতরের প্রায় সকল জিনিস পত্রই অক্ষত। হয়তো আরেকটু দেরী হলে এসব কিছুও পুড়ে কয়লা হয়ে যেতো। আগুন নেভানো প্রায় শেষের দিকে। আশেপাশের লোক জন ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখার জন্য জনে জনে ঢুকছে। এক পর্যায়ে পৌছে গেলো আলেয়ার ঘরের সামনে। ভেতরের দৃশ্য দেখে থমকে যায় তারা। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঘরের মাঁচার শক্ত একটা খুটিতে ঝুলে আছে আট মাসের অন্তঃসত্তা তোহা। আর তার আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো পাঁচটা লাশ। তাদের পাশে মাংস এবং পোলাও এর প্লেট। এলাকার লোকজন এমন করুণ দৃশ্য দেখে বাকহারা হয়ে গেছে। তবে সন্দেহের রেশ থেকেই গেলো।

হয় চরিত্রহীন ছেলেবউকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে, তারপর নিজেরা বিষ খেয়েছে। নাহয় সকলকে খাবারের সাথে বিষ খাইয়ে নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। হয়তো দ্বিতীয় টাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

সমাপ্ত…..