আমার সঞ্চারী পর্ব-০১

0
2

#আমার_সঞ্চারী
সূচনা পর্ব
#শ্রীমতি_প্রজ্ঞা_মঞ্জরী (লেখিকা)

“মেয়েরা তো লজ্জাশীলা, শালীন হয় জানতাম;তুমি ঠিক কোন ধাতু দিয়ে তৈরি বলতে পারো? মান-অপমান বোধ কি বিন্দুমাত্র নেই তোমার?এতো বেহায়া মেয়ে মানুষ হয় কি করে?” এক নাগাড়ে কথাগুলো বললো সাহিল।

সামনেই অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য ১৮-র কোঠায় পা দেওয়া সঞ্চারী। এতোগুলো কথা মুখ বুজে হজম করে নিচ্ছে সে। কারণ সে জানে, প্রতিবাদ করে লাভ হবেনা। এখানে তাকে সমর্থন করে কথা বলার মতো কেউ নেই।

“বিশ্বাস করুন আমি এখানে আসতে চাইনি।জান্নাতি আপু আমায় খুব করে অনুরোধ করায় আমি এসেছি;নতুবা এখানে আশার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিলো না।” ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে ওঠে সঞ্চারী।

আশেপাশের লোকেদের মধ্যে ইতমধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে।
“আরে কম বয়সী মেয়ে,আবেগটা বেশি এজন্যই হয়তো ছেলেটার পিছু-ই ছাড়ছে না।”

“পরিবারের লোকজন কেমন কে জানে!আমার বাড়ির মেয়ে হলে চাপকে সোজা করে দিতাম।”
এমন আরো অনেক কথা শোনা ভেসে এলো আশপাশ থেকে।

লোকেদের এমন মন্তব্য কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অপমানে সঞ্চারীর কান গরম হয়ে উঠলো,কেউ যেন গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে তার কানে। মাথাটা এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে জান্নাতিকে খুঁজতে লাগলো সঞ্চারী।

“তোমার বিন্দুমাত্র লজ্জা থাকলে এই মূহুর্তে আমার চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যাও।”

সাহিলের কথায় সঞ্চারীর মনে হলো এতো অপমান বোধহয় তাকে কেউ কখনো করেনি। ঠিক যেমন ভাবে এই মানুষটার মতো করে সে কাউকে কখনো ভালোবাসেনি।

সঞ্চারী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না,দৌঁড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেলো সে।

বাইরে এসে অঝোরে কাঁদতে লাগলো সঞ্চারী;পার্কিং এরিয়াতে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে।রাগে-দুঃখে-অপমানে নিজের পড়নের জামাটা খামচে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো সঞ্চারী। এক পর্যায়ে নিজের দু’হাত দিয়ে নিজের গালেই থাপড়াতে শুরু করলো সে।

“আপনি কেন আমার হলেন না সাহিল?কেন আমায় ভালোবাসলেন না?কি কমতি ছিলো আমার মাঝে?আপনি বলেছিলেন আমার বয়স কম, আমি ইমম্যাচিয়্যুর কিন্তু আমার তো বয়স বাড়তো। আমিও জান্নাতি আপুর মতো ম্যাচিউর হয়ে উঠতাম।কেন আমায় একটু সময় দিলেন না আপনি?কেন আমার ভালোবাসাকে ইনফ্যাচুয়েশান বলে দূরে সরে গেলেন?”
করুণ আর্তনাদ সঞ্চারীর।

প্রকৃতিও বোধহয় এই নিঃস্ব, ভালোবাসায় কাতর রমণীর অশ্রু সহ্য করতে পারলো না।নিজের মতো করে সেও বিলাপ করে উঠলো; আকাশ কাঁপিয়ে মেঘেদের গর্জন শোনা গেল,সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি। মূহুর্তের ব্যবধানে ক্রন্দরত রমণীর চোখের জল আর তুমুল বর্ষণের ফোঁটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল।

“সঞ্চারী কোথায় সাহিল?”
কিয়ৎক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই বিব্রতকর মূহুর্তের কথা ভাবছিলো সাহিল,জান্নাতির প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গলো তার।

“তোমায় বারণ করেছিলাম ওকে এখানে আনতে জান্নাতি,তবুও কেন…”

“কেন? ওকে দেখে কি মনের মধ্যের সুপ্ত অনুভূতিরা বেরিয়ে আসতে চায় সাহিল?”
জান্নাতি দৃষ্টি স্বাভাবিক রেখেই প্রশ্ন করলো সাহিলকে।

জান্নাতির প্রশ্নে থতমত খেলো সাহিল। মেয়েটা তার থেকে গুণে গুণে ৯ বছরের ছোট;তার প্রতি কোনো ধরনের প্রেমময় আবেগ অনুভূতি রাখা সাহিল পাটোয়ারি -র মতো পুরুষেকে মানায় না।

“তোমার অবান্তর প্রশ্নে আমায় প্রশ্নবিদ্ধ করা বন্ধ করো জান্নাতি। আর তোমার বোন একটু আগেই বেরিয়ে গেছে;কোথায় গেছে আমি জানিনা।” বরাবরের ন্যায় গম্ভির কণ্ঠে বলে ওঠে সাহিল।

“মানে?রাত কয়টা বাজে দেখেছো সাহিল?বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে;এর মাঝে মেয়েটা বেরিয়ে গেছে তুমি ওকে যেতে দিলে কি করে?হাউ কুড ইয়্যু বি সো ইরেসপনসিবল সাহিল?” কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলে উঠলো জান্নাতি।
পার্স থেকে নিজের ফোনটা বের করে সঞ্চারীর নাম্বারে ডায়েল করলো কিন্তু ফোনটা বেজে উঠলো পাশে সেই টবিলটায় যেখানে সে সঞ্চারীকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো। জান্নাতির চোখে-মুখে আতংক।

“মেয়েটা আমার সাথে আসতে চায়নি,জোর করে নিয়ে এসেছিলাম আমার সাথে। এখন ওর কিছু হয়ে গেলে মামা কে কি জবাব দেব আমি বলতে পারো?”

সাহিলকে নির্বিকার দেখে জান্নাতি আবার বলে উঠলো,
“তুমি তো এতোটা ইরেসপনসিবল নও সাহিল। বাচ্চা একটা মেয়ে সঞ্চারী,ওর এতোটুকু খেয়াল রাখতে পারলে না?”
“ড্রাইভার কে কল করো,দেখো বাড়ি চলে গেছে কিনা।” নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো সাহিল।

জান্নাতি ড্রাইভারকে কল দিবে তার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো;চেয়ে দেখলো ড্রাইভারের কল দেখে জান্নাতি বলে উঠলো,
“ড্রাইভারের কল।”

“রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দাও।”

তড়িৎ গতিতে উপর-নিচ মাথা নেড়ে জান্নাতি কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ড্রাইভার সজল বলে উঠলো,” জান্নাতি আপা জলদি আসেন, সঞ্চারী আপা পার্কিং এরিয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।”
জান্নাতি কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই কল কেটে গেলো।

সাহিলের দিকে তাকিয়ে জান্নাতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই জান্নাতিকে উপেক্ষা করে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো সাহিল। তার পিছু পিছু জান্নাতিও দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো।

পার্কিং এরিয়ায় আসতেই সাহিল দেখলো ড্রাইভার সঞ্চারীকে হাত ধরে তোলার চেষ্টা করছে।

“স্টে এওয়ে, দূরে সরো ওর থেকে।” চিল্লিয়ে বলে উঠলো সাহিল।
দৌঁড়ে গিয়ে সঞ্চারীর পাশে বসে ওর হাতটা ধরে পালস চেক করলো।
“আপনাদের আসতে দেরি হচ্ছিলো তাই আমি ওনাকে গাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছিলাম।” নিচু গলায় বলে উঠলো সজল।

“ওকে হসপিটালে নিতে হবে, গাড়ি স্টার্ট দাও কুইক।” বলেই সঞ্চারীকে পাঁজাকোলে করে নিলো সাহিল।

“এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? গাড়ি স্টার্ট দিতে বলেছি আমি।”
সাহিলের এমন বাণীতে দৌঁড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো সজল।

সাহিল সঞ্চারীকে ব্যাকসিটে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথাটা নিজের উরুর উপর রাখলো।
“জান্নাতি সময় নষ্ট করো না।গাড়িতে ওঠো;ফাস্ট।”

জান্নাতি যেন সাহিলের এমন রূপে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কথা না বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠলো জান্নাতি।

“সিটি হসপিটাল যাবে।” বলেই সঞ্চারীর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষতে থাকে সাহিল।অনেক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মেয়েটার।

একটু পরেই নিজের কোল থেকে সঞ্চারীর মাথাটা উঠায় সাহিল। অবচেতন সঞ্চারীকে সোজা করে বসিয়ে জান্নাতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ওর মাথাটা তোমার কোলে নাও”
জান্নাতি তাই-ই করে;বৃষ্টিতে সেও ভিজে গেছে অনেকটাই।
সাহিল এবার জান্নাতিকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে সঞ্চারীর পা থেকে জুতোজোড়া খুলে নিজের কোলে নেয়।সঞ্চারীর ঠান্ডা হয়ে আসা পা দুটোকে হাতের তালুর সাহায্যে ঘষে গরম করার চেষ্টা চালায় সাহিল।

সাহিলের একের পর এক কান্ডে জান্নাতি যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে বেশি প্রশান্তি পাচ্ছে এটা ভেবে যে সাহিল সঞ্চারীর কেয়ার করছে;অথচ তার খারাপ লাগার কথা ছিলো।

জান্নাতি সাহিলের বাগদত্তা। পারিবারিক ভাবে গত মাসেই তাদের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। সাহিলের সাথে আজ ডিনারে আসার কথা ছিলো জান্নাতির।একা সাহিলের সাথে ডিনারে আসা তার কাছে অস্বস্তিকর লাগছিলো,তাই মামার বাড়ি গিয়ে জোর করে সঞ্চারীকে নিয়ে আসে সে। মেয়েটাকে জান্নাতি অনেক অনুরোধ করে রাজি করিয়েছিলো।এখানে আসার পর তো নরমালই ছিলো সব। সঞ্চারী কে রেখে কিচ্ছুক্ষণের জন্য ওয়াশরুমে গিয়েছিলো জান্নাতি;মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে কি এমন হলো যে মেয়েটা বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে!আর এভাবে অজ্ঞানই বা হলো কি করে? প্রশ্ন গুলো মস্তিকে ঘুরপাক খেতে লাগলো জান্নাতির।

“এসি বন্ধ করো। সামনের গ্লাস দুটো খুলে দেও।” সাহিলের কণ্ঠে বাস্তবে ফিরে জান্নাতি।

সাহিলের কথা মতো এসি অফ করে সামনে গ্লাস দুটো খুলে দেয় ড্রাইভার।

কিচ্ছুক্ষণের ব্যবধানেই হসপিটালে পৌঁছায় তাদের গাড়ি। নিজের গা থেকে স্যুটটা খুলে সঞ্চারীকে পড়িয়ে আবারো পাঁজাকোলে করে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায় সাহিল।

চলবে???