My First Crush Part-25+26

0
266

#My_First_Crush
#পর্ব-২৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

(রাইয়ানের জন্মদিনের রাত)
একে একে সব অতিথিকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে দরজা বন্ধ করলো হৃদি। পেছনে তাকিয়ে দেখলো সোফার উপরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে রাইয়ান। হৃদি ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত তখন অনেক। ঘড়ির কাটার শব্দ খুব ভারী ঠেকতে লাগলো হৃদির কাছে৷ যার একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া জানান দিয়ে যাচ্ছে হৃদির ফুরিয়ে আসা সময়ের। হৃদি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ঘুমন্ত রাইয়ানের সামনে৷ হাটু গেড়ে বসে পড়লো সেখানেই৷ আজকের পর থেকে হয়তো এই প্রিয় দৃশ্য আর কখনো দেখা হবে না তার। হৃদির চোখে পানি এসে পড়লো। কিন্তু সে কাঁদতে চাইলো না। প্রাণপণে চোখের পানি আটকে রাখার চেষ্টা করলো সে। পাশে দৃষ্টি নিয়ে সংযত করলো নিজেকে। রাইয়ানের মুখের দিকে বিষন্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। যেমনটি সে তাকিয়েছিল ডিজনি ওয়ার্ল্ডে। যখন ফায়ারওয়ার্ক্সের রং বেরংয়ের রশ্মিতে বিমোহিত হয়ে রাইয়ান তাকিয়েছিল রাতের উজ্জ্বল আকাশের দিকে। হৃদির দৃষ্টিতে তখন ছিল এক সমুদ্র অসহায়ত্ব। বুকের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছিল এক অবুঝ শূণ্যতা। হৃদির চোখে সত্যি সত্যিই পানি চলে এলো এবার। হৃদি চেষ্টা করলো যাতে কোন শব্দ না হয়। রাইয়ানকে যে আজ অনেক ঘুমাতে হবে। হৃদি মুখ নাড়িয়ে এক আকাশ আক্ষেপ নিয়ে নিঃশব্দে বলল,

‘রাইয়ান, আমি কেন তোমার পছন্দের হলাম না?’

কথাটা বলতে বলতেই হৃদির গাল বেয়ে বেদনার এক ফোটা বেয়ে পড়লো। অশ্রু চোখে নিয়ে রাইয়ানের দিকে তাকিয়েই রইলো হৃদি। যে তাকিয়ে থাকার হয় না কখনো শেষ। কিছু সময় যেন এভাবেই কাটলো। একসময় নাক টেনে চোখের পানিতে লাগাম টেনে হৃদি উঠে দাঁড়ালো। পড়ে থাকা সোফার কুশনগুলো একটা একটা করে ঠিক করে রাখলো। পুরো বাড়ির এলোমেলা অবস্থা। সাজ সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। হাত দিয়ে সেই সবকিছু উঠাতে লাগলো হৃদি। টেবিলটাও সাফ করে ফেললো। ময়লা সব একটা কালো পলিথিনে ভরে রেখে দিলো ডাস্টবিনে। মেঝে ঝাড়ু দিয়ে একটা ন্যাকরা নিলো হাতে। বাসার প্রত্যেকটা জিনিস আবেগের সাথে মুছে মুছে পরিষ্কার করতে লাগলো। প্রতিদিনকার এই কাজটা করতে গিয়েই আজ হৃদির বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো। গলগল করে বেরোতে লাগলো চোখ দিয়ে নোনাধারা। এই সব কিছুর সাথে জড়িত স্মৃতিগুলো ভাসতে লাগলো মনে। একটি সংসারে ছোট ছোট প্রাণহীন জড় বস্তুগুলোও একটা সময় কতটা মায়ার হয়ে যায় না আমাদের! এই সবকিছু আজ হৃদি ছেড়ে যাবে। এই বাড়িতে হৃদির সময় হয়তো ছিল এতটুকুই। একটি স্বল্প সময়ের সংসার। হৃদি ওদের বেডরুমে চলে গেলো। রাইয়ানের সাথে জড়িত সমস্ত স্মৃতিগুলো চোখে জড়ো হলো তার। বিছানার দিকে তাকাতেই হৃদির মনে পড়লো বিয়ের প্রথম রাতে তার আর রাইয়ানের ধাক্কা লেগে একসাথে বিছানায় পড়ে যাওয়া, সোফার উপরে মিঁয়োকে প্রথম দেখার পর রাইয়ানের সাথে তার কথা বলা, কবাটের সামনে দাঁড়িয়ে রাইয়ানের মেরুন রঙের শার্ট নিয়ে মুখ ফোলানো, বারান্দায় রাইয়ানের শার্ট নিয়ে হৃদির নেচে বেড়ানো, সব….সব যেন হৃদি পরিষ্কার দেখতে পেলো। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই নিজের জিনিসপত্র লাগেজে গুছিয়ে ফেললো হৃদি। একটা ড্রেস নিয়ে বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসলো। লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বেরোবার আগে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো চারপাশ। স্টাডি রুমের সামনে চোখ পরতেই মনে পড়লো সেখানে তার সাথে রাইয়ানের খুনসুটি মুহুর্তগুলো, লিভিং রুমে এসেই চোখে ভাসলো সোফার চতুর্দিকে তাদের সেই ছোটাছুটির দৃশ্য। একটা নিরব ব্যাথা চিনচিন করে বাড়তে লাগলো হৃদির বুকে। হৃদি এসে লাগেজ নিয়ে আবারো দাঁড়ায় রাইয়ানের সামনে। সময় কমে আসছে কিন্তু হৃদির পা চলতে চায় না। থেমে যেতে চায় এখানেই। হৃদি নিজেকে বোঝায়। দূর্বল হতে বারণ করে। কিন্তু মন কি আর মানে? একসময় আর না পেরে হৃদি পেছনে ঘুরে চলে যেতে নেয়। হঠাৎ ই বাঁধা পরে তার জামায়। থমকে দাঁড়ায় হৃদি। মনের মধ্যে এক ইতিবাচক ভাবনা কড়া নারে। হৃদি আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে। দেখতে পায় তার জামা সোফার কোনায় আটকা পরেছে। যেমনটা ভেবেছিল তেমন কিছু নয়। হৃদির চোখ বেয়ে আবারো পানি ঝরে পড়ে। মলিন একটা হাসি দিয়ে চলে আসে হৃদি। বাসা থেকে বের হবার পূর্বে আরো একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় ভেতরটা। এক অদৃশ্য মায়ার বন্ধন তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু হৃদি আর ধরা দেয় না।
___________________________________________________

হৃদির বন্ধ হয়ে থাকা কফিশপের সামনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেন। যদিও এই কফিশপটি এখন আর হৃদির নেই। খুব শীঘ্রই সম্ভবত এই জায়গায় একটা বুটিক শপ খোলা হবে৷ কিন্তু তবুও এই জায়গাটা দিয়ে যখনই অ্যালেন যায় তার পা থমকে যায়। হৃদির কফিশপের নিত্যদিনকার দৃশ্য চোখে ভাসে৷ বুকে চিনচিনে একধরনের ব্যাথা অনুভূত হয়। যেই ব্যাথার ওষুধ সম্পর্কে অ্যালেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। অ্যালেনের মনে পড়ে শেষ যেদিন হৃদি তার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল হৃদি। আর হয়তো শেষ বারের মতো বিদায় জানাতেও। অ্যালেন সেদিন কিছুই বলতে পারছিল না। হৃদির পাশেই কাঠের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে ছিল। হৃদি পাশ থেকে বলছিল,
‘তুমি খুবই ভালো একটা ছেলে অ্যালেন। তোমার সাথে যেদিন থেকেই আমার পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকেই তুমি আমার অনেক অনেক সাহায্য করেছো। যেকোন সমস্যাতেই তোমাকে পাশে পেয়েছি। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। এতদিন আমাকে এতো সাহায্য করার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ অ্যালেন। তোমার কথা আমার সবসময় মনে থাকবে।’
অ্যালেন আস্তে করে বলল, ‘আমার জন্যই কি এই সবকিছু হলো হৃদি? আমাকে পারলে মাফ করে দিও। আমি যদি জানতাম যে ঐ বিষয়ে তুমি কিছুই জানো না তাহলে হয়তো এভাবে ডিভোর্সের কথাটা বলে ফেলতাম না।’
হৃদি স্মিত হেসে বলল, ‘তুমি কেন মাফ চাইছো অ্যালেন? তুমি তো আমার উপকারই করেছো। নয়তো আর কতদিন এভাবে মিথ্যার মধ্যে আমি বাঁচতাম কে জানে! তোমার জন্যই তো আমি সত্যিটা জানতে পারলাম। আর সবকিছু ঠিক করারও একটা সুযোগ পেলাম।’
‘তুমি কি সত্যি সত্যিই চলে যাবে?’
হৃদি কিছুই বলে না। অ্যালেন বলে,
‘না গেলে হয় না?’
অ্যালেনের কন্ঠে ব্যাকুলতা ঝরে পড়ে। হৃদি তাকায় অ্যালেনের দিকে। অ্যালেনের চোখে স্পষ্ট আবেগ। যেই আবেগের সাথে পরিচিত হৃদিও। কারো জন্য তারও দৃষ্টি যে এভাবেই ব্যাকুল হয়। হৃদি আস্তে করে মাথা নাড়ে। বলে,
‘আমি তোমার অনুভূতিকে সম্মান করি। কিন্তু তোমাকে শুধু আমি আমার একটা ভালো বন্ধুর মতোই মনে করি অ্যালেন। এর থেকে বেশি কখনো সম্ভব নয়। আমি জানি তুমি আমার কথায় আঘাত পাচ্ছো। আমিও পেয়েছিলাম। যখন আমার সামনেও আমার জীবনের সত্য ধরা দিয়েছিল। আমার কি মনে হয় জানো? তোমার আর আমার অবস্থা অনেকটা একই। আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের ভালোবাসে না।’

হৃদির শেষের কথায় একধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠে। অ্যালেনের দিকে তাকায় সে। তারপর বলে,
‘আমি তোমার জন্য দোয়া করবো অ্যালেন, যাতে আমার মতো বাজে অসুখটা তোমার না হয়। তুমি যেন আমাকে ভুলে যেতে পারো।’

অ্যালেন চুপ করে থাকে। হৃদি উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে অ্যালেন। বাসায় কিছু কাজ আছে। আমি যাই। তুমি ভালো থেকো।’

হৃদি চলে যেতে নেয়। অ্যালেন পেছন থেকে ডেকে বলে,
‘হৃদি, তুমি কোথায় যাবে?’
হৃদি একটু সময় নিয়ে বলে, ‘অ্যালেন, আমি বলতে চাই না।’
অ্যালেন আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না। হৃদি আবারো চলে যেতে নিলে ডাক দেয়, ‘হৃদি!’
হৃদি পেছনে ফিরে তাকায়। অ্যালেন বলল, ‘একবার হাসবে!’
হৃদি তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি করে হাসে। তারপর চলে যায়৷ অ্যালেন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ে কিভাবে হৃদিকে প্রথম দেখাতেই তার ঘুমন্ত অনুভূতিগুলো জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। কতোটা প্রগাঢ় ছিল তার অনুভূতিগুলো। জীবনে প্রথম কোন মেয়ের প্রতি এরকম অনুভূতি হওয়ায় তাকে একদম রাণী বানিয়ে রাখতে ইচ্ছে করতো অ্যালেনের। একদম স্পেশাল! হৃদির ছোট ছোট সাহায্য করতেও কতটা ভালো লাগতো তার। আর তার মুখের হাসিটা…..! যেটা দেখার জন্য অ্যালেন নিজেকে বিলীন করে দিতেও রাজী ছিল। এর জন্যই কিভাবে সে হৃদির জন্মদিনে রাত বারোটা বাজার সাথে সাথেই এতো গভীর রাতে অতো দূর থেকে এসে তাদের বারান্দার সামনের আকাশে একটার পর একটা ফায়ারওয়ার্ক্স ফুটিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল শুধু হৃদিকে একটু খুশি করা। আর এর জন্যই যখন সে একবার হৃদিকে দেখলো কফিশপ বন্ধ রেখে ভেতরে উদাস হয়ে বসে থাকতে সেদিনও বাইরে থেকে হৃদির দিকে নজর রাখছিল অ্যালেন। হৃদি যখন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে গিয়ে বেঞ্চিতে বিষন্ন মন নিয়ে বসে রইলো তখনও অ্যালেন শুধুমাত্র হৃদিকে খুশি করার জন্যই ওমন গরমের মধ্যে মসকাট কস্টিউম পরে হাস্যকর মুভমেন্ট করছিল। এমনকি হৃদির ভাষা শেখার জন্যও কিভাবে অ্যালেন একা একা বাসায় বাংলা কিছু বাক্য বলার ট্রাই করতো। এই সবকিছুর পেছনেই ছিল হৃদির প্রতি অ্যালেনের আন্তরিক অকৃত্রিম অনুভূতি। সত্যিই এই পৃথিবীতে যে যাকে ভালোবাসে তার ভালোবাসা পাবার মতো ওমন ভাগ্যবান সবাই হয় না।

হৃদির যাওয়ার পানে অসহায়ত্ব চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অ্যালেনের মুখে একটা ফ্যাকাসে হাসি ভেসে উঠে।
___________________________________________________

জিশান একটা কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে। সকাল সকাল মাথাটা ভিষণ ভার হয়ে আছে তার। কফিতে চুমুক দিতেই একটা শান্তি অনুভব হয়। জিশান কফি খেতে খেতে বারান্দা দিয়ে নিচে তাকায়। রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে একটা গ্রুপ যাচ্ছে। সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জিশানের চোখ যায় পাশের বারান্দার দিকে। হঠাৎ ই জেরিনের কথা মনে পড়ে তার। সত্যি বলতে জেরিন বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর আবারো জীবনটা কেমন যেন আগের মতো পানসে হয়ে গেছে। কোন ডিফারেন্ট কিছু নেই। সব বোরিং। জেরিন থাকাকালীন প্রতিদিনকার নিত্য নতুন সেই রোমাঞ্চকর ব্যাপারগুলোই যেন জীবনের ছন্দ ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও জিশানের মনে হয় সে বোধ হয় জেরিনকে মিস করছে। জিশানের মনে পড়ে জেরিনের চলে যাবার দিন জেরিন কিভাবে কোন কথা না বলে জিশানের দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। যেই দৃষ্টির মানে তখন বুঝতে না পরলেও এখন পুরো পরিষ্কার জিশানের কাছে। মেয়েটা বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে একদম খাঁটি। যেই ব্যাপারটা আসলেও মুগ্ধ করে জিশানকে। হৃদি আর রাইয়ানের সম্পর্ক নিয়ে জিশান সবকিছুই জানতো। কিন্তু রাইয়ানের ব্যাপারটা সেও লুকিয়ে রেখেছে। যার জন্য এই অপরাধের ভাগীদার অনেকটা সেও।

রাইয়ানের কথা মনে পড়তেও জিশানের মন খারাপ হয়। হৃদি চলে যাবার আজ তিন মাস। ছেলেটা একপ্রকার অন্যরকমই হয়ে গেছে যেন। আগের চাইতেও বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। মুখে কোন হাসি নেই। কারো সাথে বেশি কথা বলে না। ফ্লোরিডার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে সে হৃদিকে খুঁজেনি। যেখানে বিন্দুমাত্রও হৃদির যোগসূত্র থাকা কোন মানুষের কথা জেনেছে সেখানেই ছুটে গেছে। কিন্তু কোথাও হৃদি নেই। একটা ঘুম ভাঙা স্বপ্নের মতোই যেন উধাও হয়ে গেছে রাইয়ানের জীবন থেকে। জিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এমন সময় তার ফোনে একটা কল আসে। সেখান থেকেই জানতে পারে জেরিনের ঠিকানা। যেটা রাইয়ান তাকে খুঁজে বের করে দিতে বলেছিল। জিশান তাড়াতাড়ি রাইয়ানকে ফোন দেয়।
___________________________________________________

জেরিন আছে মিনেসোটাতে। তার বাবা মার কাছেই। হৃদি কফিশপ বিক্রি করে ফেলার পর ফ্লোরিডা ছেড়ে সে ফিরে যায় সেখানেই। বলতে গেলে হৃদির জন্যই সে এতদিন এখানে ছিল। যেহেতু এখন হৃদিই নেই তাই জেরিনও ফিরে আসে তার আসল ঠিকানায়। জেরিন মিনেসোটাতে আছে জেনে তৎক্ষনাৎ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাইয়ান। এই পর্যন্ত কারো কাছেই হৃদির সম্পর্কে কোন কিছু জানতে পারেনি রাইয়ান। বাদ আছে শুধু জেরিনই। জেরিন হৃদির বেস্ট ফ্রেন্ড। হয়তো সে জানে হৃদি কোথায়! রাইয়ানের বুকে আশা বাঁধে। বিন্দুমাত্র বিলক্ষণও সহ্য হয় না তার। তাই তো! ফ্লাইট ছত্রিশ ঘন্টার জন্য লেট জেনে এতোটা পথ গাড়ি ড্রাইভ করেই এগিয়ে চলে রাইয়ান। এই তিনটা মাস সে কিভাবে কাটিয়েছে এটা শুধু রাইয়ানই জানে। প্রতিটা মুহুর্ত যন্ত্রণায় কেটেছে তার। রাতে ঘুম হয় না। ঘুমোলেই স্বপ্নে শুধু হৃদিকে দেখতে পায়। মনে হয় এই যেন হৃদি তার পাশেই আছে। এরপর তাকে ধরতে গেলেই ভেঙে যায় স্বপ্ন। চলে আসে বাস্তবতায়। যেখানে হৃদি ছাড়া শূন্য তার জীবন। বুকটা হাহাকার করে উঠে রাইয়ানের। যেমনটা হয়ে ছিল হৃদির রুমে কাটানো সেই রাতটাতেও। সেদিনও ঠিক এভাবেই হৃদি পাশে বসে আছে মনে করে ধরতে গিয়েই দেখে হৃদি নেই। সেটা নিতান্তই তার এক স্বপ্ন। অ্যাপার্টমেন্টেও রাইয়ানের শান্তি লাগে না। প্রতিটি কোণায় কোণায় শুধু হৃদির সাথে জড়িত স্মৃতিগুলো ভাসতে থাকে চোখে। দূরে গিয়েও আরো বেশি যেন রাইয়ানের মাথায় আটকে আছে হৃদি। মাঝে মাঝে মনে হয় হৃদির কন্ঠও যেন সে শুনতে পাচ্ছে। রাইয়ান সারাদিন বাসায় বসে বসে তার ফোনে হৃদির সেই ভিডিওটা দেখতে থাকে। যেটা জগিং করতে গিয়ে একবার নিজের ফোনে তুলেছিল রাইয়ান। রাইয়ানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। কিন্তু নিজেকে সামলায় সে। রাস্তা যে পরিষ্কার দেখতে হবে তাকে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মিনেসোটায় পৌছাতে চায় রাইয়ান।

ফ্লোরিডা থেকে মিনেসোটায় ড্রাইভ করে যেতে সময় লাগে পুরো চব্বিশ ঘণ্টা। এই এতোটা পথই পুরো ড্রাইভ করে যায় রাইয়ান। মিনেসোটায় পৌছাতে পৌছাতে রাইয়ানের পরেরদিন সকাল গড়িয়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ায় সে। ঠিকানা অনুযায়ী এই বিল্ডিংয়েরই চার তলায় থাকে জেরিন। রাইয়ান সেখানে গিয়েও দেখে জেরিনের দরজা লক। পাশের নেইবারের থেকে জানতে পারে প্রতিদিনই এই সময় বাসায় থাকে না জেরিন। কখন আসে ঠিক নেই। রাইয়ান আবার নিচে গিয়ে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করতে থাকে। জেরিন আসে দুপুরেরও অনেক পর। রাইয়ানকে বিল্ডিংয়ের সামনে পার্কিং জোনে দেখে অবাক হয়। জেরিনকে দেখে রাইয়ান তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। জেরিন ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে, ‘তুমি এখানে?’
রাইয়ান আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে জেরিনের দিকে। দম না নিয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘জেরিন, হৃদি কোথায় আছে তুমি জানো?’
রাইয়ানের এখানে আসা পছন্দ হয় না জেরিনের। আর রাইয়ানকে তো তার আগে থেকেই পছন্দ না। জেরিন বিরক্তির সাথে মুখ বাঁকিয়ে খোঁচা মেরে বলে,
‘কেন? তুমি না এটাই চাইছিলে? এখন তো এটাই হয়েছে। চলে গেছে হৃদি তোমার জীবন থেকে৷ তোমাকে বিন্দুমাত্রও কোন ঝামেলা না দিয়ে। এখন হ্যাপি হও। সেলিব্রেট করো। হৃদির খোঁজ করতে এসেছো কেন? হৃদির বাবা মার ওঁর জন্য রেখে যাওয়া সমস্ত সেভিংস দিয়ে ঐ কফিশপটি তৈরি করেছিল হৃদি। তোমার জন্য তো সেটাও বিক্রি করে দিলো। এতটুকুতেও হয়নি নাকি আরো সুযোগ নিতে চাও ওঁর!’
‘আমি জানি তুমি এখন আমার উপর অনেক রাগ। আমার ভুলের উপলব্ধি আমার আছে। হয়তো এখন আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলতেও পারবো না। তুমি প্লিজ আমাকে একটু হৃদির খোঁজ বলো। আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি জেরিন। প্লিজ!’
রাইয়ানের কথার ধরনে জেরিন এবার একটু দমে যায়। সে যতদূর জানে রাইয়ান একটু দাম্ভিক, নাকউঁচু টাইপের। কারো কাছে এভাবে অনুরোধ করা তো দূর একবারের বেশি দুবার কাউকে কিছু বলবে না। আর সেখানে রাইয়ান এভাবে হাতজোড় করবে তা ভাবনারও বাইরে। এবার যেন রাইয়ানকে একটু লক্ষ করেও দেখে জেরিন। এই কয়েক মাসে অনেকটাই শুকিয়ে গেছে সে। সব সময় ফিট ফাট থাকা ছেলেটার মুখে এখন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখে চাপা বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। জেরিনের ইচ্ছে ছিল আরো কঠিন কঠিন কিছু কথা বলার। কিন্তু রাইয়ানের অবস্থা দেখে বলতে পারে না। জেরিন গলার তেজ কমিয়ে আনে। বলে,
‘হৃদি কোথায় গেছে আমি জানি না। আমি অনেকবারই জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু হৃদি এ ব্যাপারে কাউকেই কিছু জানায়নি। সরি!’
কথাটা বলেই রাইয়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে জেরিন। রাইয়ান কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। জেরিন ভেতরে চলে যায়। রাইয়ানের আশাভঙ্গ হয়। বুকের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। রাইয়ান অন্যমনষ্ক পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়ির দরজায় হাত রাখে। কিন্তু মন সায় দেয় না তার। রাইয়ান গাড়ির দরজা খুলেও আবার বন্ধ করে ফেলে। চলে যায় বিল্ডিংয়ের ভেতর। চার তলায় উঠে জেরিনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপতে থাকে। কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলতেই জেরিনের ভ্রু আবারো সংকুচিত হয়। বলে উঠে, ‘তুমি আবারো এসেছো কেন? আমি বললাম তো আমি কিছু জানি না। তুমি ফিরে যাও।’
রাইয়ান কিছু বলার আগেই জেরিন দরজা বন্ধ করতে নেয়। কিন্তু তার আগেই ভেতর থেকে ডাকতে ডাকতে দৌঁড়ে রাইয়ানের কাছে ছুটে আসে মিঁয়ো। মিঁয়োকে দেখে রাইয়ানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ঝট করে মিঁয়োকে কোলে তুলে নেয় সে। বিস্ময় নিয়ে তাকায় জেরিনের দিকে। বলে,
‘তুমি মিথ্যা বলছো জেরিন। তুমি নিশ্চয়ই জানো হৃদি কোথায়। নয়তো মিঁয়ো তোমার কাছে থাকতো না।’
জেরিন দ্রুত রাইয়ানের থেকে মিঁয়োকে কেড়ে নেয়। রাইয়ানের মুখের উপরেই তাড়াতাড়ি দরজা আটকিয়ে দেয় সে। রাইয়ান বলে উঠে,
‘জেরিন তুমি যতক্ষণ না বলবে হৃদি কোথায় আমি কিন্তু এখান থেকে যাবো না?’

জেরিন কিছু না শুনতে চেয়ে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখে। কিছুটা ঘাবড়ে গেছে সে। অনেকক্ষণ পর জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে রাস্তার ধারে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান। পর্দা থেকে সরে এসে জেরিন বিছানার উপরে বসে। হৃদির কথা হুট করেই আজ বড্ড মনে পড়তে থাকে জেরিনের। মনে পড়ে কিভাবে হৃদি জেরিনকে ধরে কেঁদেছিল যখন সে জেরিনকে সব জানায়। মনে পড়ে জেরিনের ফ্লোরিডা ছেড়ে চলে আসার আগে হৃদির সাথে হওয়া তার শেষ কথোপকথন। যখন হৃদির দিকে এক মনোযোগে তাকিয়ে থেকে থেকে জেরিন বলেছিল,
‘হৃদি, তুই অনেক বোকা।’
হৃদি ফিচেল হেসে বলে, ‘এ আর নতুন কি! তুই তো আমাকে সবসময় এই কথাটা বলিস।’
হৃদির হাসিটা জেরিনের খুব বাঁধে। চোখে বিষন্নতা, মুখে জোর করে টানা হাসি। এরকম হাসি যেন আরো মন খারাপ বাড়িয়ে দেয়। হৃদি বলে,
‘তোর মনে আছে জেরিন, ইউনিভার্সিটিতে যখন আমি রেগিংয়ে ফিমেল সিনিয়রদের দ্বারা বুলি হয়েছিলাম তখনও তুই আমাকে বলেছিলি ‘তুমি এতো বোকা কেন? প্রটেস্ট করতে পারো না!’ এটাই কিন্তু ছিল তোর সাথে আমার প্রথম কথা। তারপর থেকে তুই কিভাবে সবসময় আমার পাশে থাকতি। আমাকে কেউ বুলি করলে তার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিতি। অবস্থাই পুরো খারাপ করে ফেলতি তার।’
জেরিন ছল ছল চোখেই ঈষৎ হেসে ফেলে। বলে,
‘তাহলে কি করবো? তুই ছিলিই এতো ভালো। সবসময় আমার খেয়াল রাখতি। আমি একটু বেশি জেদি বলে অন্য কারো মতো আমাকে ভুল বুঝে কখনো চলে যাসনি। আমার একবার খুব জ্বরের কারণে তুই কিভাবে আমার সারারাত খেয়াল রেখেছিলি, আমার সব অ্যাসাইনমেন্ট একা হাতে করে রেখেছিলি, এমনকি নিজের টাকার ব্যাংক ভেঙে কিভাবে একবার তুই আমার সেমিস্টার ফি দিয়েছিলি সেগুলো কি আমার মনে নেই! তুই এতো সরল মনের কেন হতে গেলি হৃদি? সরল মানুষগুলোর জন্য পৃথিবীটা যে সরল হয় না। পদে পদে শুধু আঘাতই পেতে হয়।’
হৃদির চোখেও পানি এসে পড়েছিল। নাক টেনে একটু হেসে হৃদি বলল, ‘তুই আমার এতো চিন্তা করছিস কেন? আমি ঠিকই থাকবো। কফিশপের লাভ লসের চিন্তাও করতে হবে না। একদম কেয়ার ফ্রি একটা লাইফ। তোরও তো ভালো হলো, তোকে আর এই কাস্টমার ফাঁকা কফিশপে থাকতে হবে না। এখন নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে তুই একটা ভালো কিছু করতে পারবি। তোর কি মনে হয় আমি জানি না যে তুই আমাকে সাহায্য করার জন্যই এই কফিশপে ইন্টারেস্ট দেখানোর নাটক করে থেকে গিয়েছিলি! ধন্যবাদ জেরিন। তুই সবসময় আমার পাশে থেকেছিস। তোকে আমি খুব মিস করবো।’
জেরিন এবার বাচ্চাদের মতো পুরোই কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে হৃদিকে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে জেরিনের চোখে পানি এসে পড়ে জেরিন টের পায় না। সময় অনেকটা কেটে গেছে। জেরিন উঠে আবারো জানালার কাছে গিয়ে দেখে রাইয়ান এখনও দাঁড়িয়ে আছে। জেরিন কি করবে বুঝে পায় না। জেরিনের বাবা মা এক আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ায় জেরিন আজ বাসায় একা। জেরিন মিঁয়োকে খাবার খেতে দেয়। দেখতে দেখতে রাত হয়ে আসে। মিনোসোটার ঠান্ডা ভয়াবহ। এসময় রাত হলেই তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাঙ্কের নিচে। হাঁড় কাঁপুনি ঠান্ডায় রুম হিটার ছাড়া ঘরের মধ্যেও অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। আর সেদিকে রাইয়ান আছে বাইরে। জেরিন ভাবে এখন অন্তত রাইয়ান চলে যাবে। কিন্তু দেখে রাইয়ানের যাবার কোন নাম নেই। রাইয়ানের গায়ে শুধু একটা জ্যাকেট। আর কোন ভারী সোয়েটারও নেই। শীতে লোমকূপে পর্যন্ত হিমায়িত বাতাস ঢুকতে থাকে। নিঃশাসেও যেন অনুভূত হয় নাক ছিদ্র করে ফেলার মতো ঠান্ডা। রাইয়ান দু হাত দিয়ে ডলে নিজেকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করে। গাড়িতে গিয়ে বসে জানালা উঠিয়ে দেয়। এতক্ষণের ভয়ংকর ঠান্ডাটা একটু কমলেও খুব একটা সুবিধে হয় না। রাত গভীর হতে থাকে। জেরিন একটু পর পর জানালা দিয়ে দেখে রাইয়ান গেলো কিনা। কিন্তু না, রাইয়ান যাচ্ছে না। একসময় জেরিনও ঘুমিয়ে পড়ে। সারা রাত সেখানেই ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কাটিয়ে দেয় রাইয়ান। জেরিনের যখন ঘুম ভাঙে তখন পুরো সকাল। ঘুম থেকে উঠে সে বেমালুম ভুলে যায় রাইয়ানের কথা। দাঁত ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে একপর্যায়ে তার মনে পড়ে রাইয়ানকে। সে ভাবে এতক্ষণে তো নিশ্চয়ই চলে গেছে। তবুও কৌতূহল দমাতে দৌড়ে চলে যায় জানালার কাছে। দেখতে পায় গাড়ির সামনে উসকোখুসকো মুখে এখনও দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান। তার মুখের অবস্থাই বলে দিচ্ছে তার রাত ভরে এখানে থাকার কথা। শক্ত মনের জেরিনেরও এবার মন নড়ে যায়। সে একটা সোয়েটার পরে বিল্ডিং থেকে নেমে আসে। জেরিনকে তার দিকে আসতে দেখে রাইয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রাইয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে জেরিন আস্তে আস্তে বলে,
‘হৃদি যদি জানতো তুমি ওঁর জন্য এতোটা করছো তা হলে ওঁ ভীষণ খুশি হতো।’
এই বলে রাইয়ানের হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেয় জেরিন। চলে যেতে নিয়েও আবার থেমে যায়। পেছনে ঘুরে ডাকে, ‘রাইয়ান!’
রাইয়ান জেরিনের দিকে তাকায়। জেরিন মুখের রেখা টেনে বলে, ‘হৃদিকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’
জেরিন চলে যায়। তার দেওয়া কাগজটা মেলে রাইয়ান দেখে সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
‘বাংলাদেশ।’

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-২৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

একটা বৃহদাকার বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। তার হাতে একটা লিস্টের কাগজ। নজর সেদিকেই। হৃদি কাগজের পাতা উল্টানোর মধ্যেই একটা পাহাড়ি বাচ্চা মেয়ে এসে হৃদির জামার ওড়না ধরে টানতে লাগলো। হৃদি কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকালো। ঈষৎ ঝুঁকে মেয়েটিকে হেসে ইশারা করলো, ‘কি?’
মেয়েটি তার নিজস্ব ভাষায় হৃদিকে কিছু একটা বলল। হৃদি ঠিকমতো বুঝতে পারলো না। পাহাড়ি মানুষের ভাষাগুলো বুঝতে হৃদির ভারি অসুবিধা হচ্ছে। হৃদি কিছু বুঝতে পারছে না দেখে মেয়েটি হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝালো। এবার হৃদি বুঝতে পারলো মেয়েটি আসলে তাকে গাছ থেকে তার প্লাস্টিকের বলটা নামিয়ে দিতে বলছে। যেটা খেলতে গিয়ে বেঁধে গিয়েছে গাছের পাতার ঝোঁপে। হৃদি বলটি নামিয়ে মেয়েটির হাতে দিলো। ঈষৎ হেসে মেয়েটির চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো। সেই সময়ে মুনিয়া এসে হৃদিকে বলল, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো? জাহিদ ভাই তোমাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছে। লিস্টের সব কাজ দিনের মধ্যেই শেষ করতে বলেছে।’

হৃদি মাথা নেড়ে সায় দিলো। মুনিয়া চলে গেলে ফোনটা চেক করে সময়টা দেখে নিলো একবার। এখনো অনেকগুলো প্যাকেট বাকি। এগুলো সব বিতরণ করতে হবে। আর কয়টা ঘর বাকি আছে সেটা গণনা করার জন্য হৃদি এগিয়ে গেলো। পায়ে পায়ে বেজে তার জুতোর ফিতা গেলো খুলে। মুখে ঈষৎ বিরক্তিসূচক শব্দ করলো হৃদি। ওড়নাটা হাত দিয়ে সামলে পা থেকে জুতো খুলে হাতে নিলো। ফিতাটা আবার জায়গা মতো বসিয়ে পড়ে নিলো পায়ে। জাহিদ এগিয়ে এসে বলল,
‘কি খবর হৃদি? তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? এখনো তো সব কাজ শেষ হয়নি!’
হৃদি বলল, ‘একটা বাচ্চা পড়ে ব্যাথা পেয়েছিল জাহিদ ভাই। এজন্য ওকে ধরে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। সেকারণেই একটু দেরি হয়ে গেলো।’
মুনিয়া আড়ালে একটা মুখ ভেংচি দিলো। সবসময় মেয়েটা বেশি বেশি আদিখ্যেতা দেখায়। এখন ওর জন্য সবাইকে দেরি করতে হবে।
হৃদি বলল, ‘সরি জাহিদ ভাই!’
জাহিদ বলল, ‘না না ঠিক আছে। এখন কি কি বাকি আছে সেগুলো বলো। এখান থেকে পরদিন আবার আরেকটা লোকালয়ে যেতে হবে। তিন দিনের বেশি সময় আমি আর লাগাতে চাই না। ঠিক আছে?’
হৃদি আর মুনিয়া দুজনেই মাথা নাড়লো। ওদের গ্রুপের আরো কয়েকজন এসে যোগ দিল সেখানে। হৃদি তাদের সাথেই এগিয়ে গেলো।
___________________________________________________

হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ট্রলিতে করে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো রাইয়ান। তার গায়ে একটা ধূসর রঙের জ্যাকেট। চোখে সানগ্লাস। মুখ ক্লিনশেভ। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই একটা ভ্যাপসা গরম গায়ে ধাক্কা দিলো রাইয়ানের। এতো ভীড়! রাইয়ান আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বোধ হবার পর এই প্রথম বাংলাদেশে আসা হলো তার।একটা রাজনৈতিক নেতার আজ দেশে ফেরার কথা বলে পুরো এয়ারপোর্টের বাইরে গিজগিজ করছে মানুষে। দূর্ভাগ্যক্রমে সেই ভীড়ের মধ্যে পা পড়লো রাইয়ানের। বের হবার কোন পথ খুঁজে পেলো না। মানুষের ধাক্কায় আপনাআপনিই ঠেলতে ঠেলতে চলে এলো একদম রাস্তায়। একটা ব্যাগ কাঁধে আর লাগেজ টেনে নিয়ে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রইলো রাইয়ান। এমন সময় একটা বাস আসতে দেখে উঠে পড়লো সেটাতেই। উঠেই পড়লো আরেক বিপত্তিতে। একটা বাসে যে এতো যাত্রী উঠতে পারে তা রাইয়ানের ধারণারও বাইরে। বসার একটা সিটও খালি নেই। দাঁড়িয়েও আছে অনেক মানুষ। আর এদিকে বাস থামিয়ে একের পর এক যাত্রী উঠিয়েই যাচ্ছে কন্ট্রাক্টর। বাসের প্রথমে দাঁড়িয়েও ঠেলতে ঠেলতে একদম পেছনে চলে গেলো রাইয়ান। চাপা পড়লো মানুষের মাঝে। একটু নড়ারও জায়গা নেই। একেকজনের গায়ের সাথে একদম লেপ্টে আছে সে। আর বোগলের ঘামের দুর্গন্ধ! রাইয়ানের মনে হলো এই বুঝি পেট থেকে সব বেরিয়ে আসবে। সেই অবস্থাতেই বাসের ঝাঁকুনিতে একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে পড়তে লাগলো রাইয়ান। অতিষ্ট হয়ে রাইয়ান একসময় চেঁচিয়েই উঠলো,
‘এই বাস থামাও।’

বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো রাইয়ান। উপর থেকে তার ব্যাগগুলো ছুঁড়ে মারা হলো নিচে। রাইয়ান অবাক হওয়ার মতো তাকিয়ে রইলো। কন্ট্রাক্টর বিরক্তি মুখ নিয়ে বাসের দরজায় ধাক্কা দিলে বাস চলে গেলো। রাস্তা থেকে ব্যাগগুলো তুলে ঝাড়া দিয়ে নিলো রাইয়ান। কাঁধে নিয়ে আবারো চলতে শুরু করলো। জায়গাটা একটা বাজারের মতো। চারদিকে অনেক দোকানপাট আর খাবারের হোটেল। ফুটপাত জুড়েও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ভ্যানগাড়ি। আর এতো এতো মানুষ! হাঁটতে গেলে কাঁধে কাঁধে ধাক্কা লেগে চলে যায়। রাইয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। স্বল্প জনসংখ্যার ফ্লোরিডায় থাকা রাইয়ানের মনে হলো বাংলাদেশের সব মানুষ কি ঢাকাতেই থাকে? গরমে ঘামে ভিজে নেয়ে একাকার হয়ে গেলো রাইয়ান। তার মনে হলো সে চুলোর উপর বসে আছে। এতো গরম কিভাবে হতে পারে! তার ফর্সা মুখ একদম লাল হয়ে রইলো। রাইয়ান এগোতে লাগলো। রাস্তাঘাট অপরিষ্কার। ফেলা দেওয়া প্যাকেট, বোতল আরো অন্যন্যাদি সব রাস্তার মধ্যেই পড়ে আছে। জায়গায় জায়গায় কফ থুথু ফেলা। দেখে দেখে হাঁটতে হাঁটতে রাইয়ানের মুখের অবস্থার বারোটা বেজে গেলো। রাস্তার একপাশে দেখলো আবর্জনার স্তুপ। গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার মতো। নাক কুঁচকে এগোতে লাগলো রাইয়ান। একটা বাসের পাশ দিয়ে যেতেই জানালা দিয়ে একটা মহিলা গড়গড় করে রাস্তায় বমি করে দিলো। একটুর জন্য বেঁচে গেলো রাইয়ান। তারও বমির মতো মুখ উল্টে এলো। রাইয়ানের মুখ করুণ হয়ে উঠলো। ভাবতে লাগলো এ কোথায় এসে পড়েছে সে?

অবশেষে একটা খালি সিএনজি দেখে তার কাছে এগিয়ে গেলো রাইয়ান। ঠিকানা বলে সিএনজি ঠিক করে উঠতেই যাবে শো করে তার পাশ দিয়ে একজন দৌড়ে গেলো। রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে হাতের দিকে তাকাতেই দেখে তার কাঁধ ব্যাগটা নেই। রাইয়ানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সামনে তাকিয়ে সেই চোরকে উদ্দেশ্য করে রাইয়ান ‘এই, এই’ বলে চেঁচাতে লাগলো। একটা চায়ের দোকানের সামনে দেখলো দুজন পুলিশ বসা। রাইয়ান গিয়ে তাদেরকে বলল, ‘আমার ব্যাগটা ঐ লোকটা নিয়ে গেছে। প্লিজ কিছু করুন।’
পুলিশদের মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। ভুঁড়িওয়ালা পুলিশটা আস্তে ধীরে পাশের জনকে বলল,
‘যা গিয়ে দেখতো।’
সেই পুলিশ একটু দৌড়ে আগালো। আগের পুলিশ রাইয়ানকে এককাপ চা দিতে বলল। রাইয়ান বিভ্রান্তি মুখ নিয়ে বসে চা খেতে লাগলো। তার দৃষ্টি রইলো রাস্তার দিকেই। কিছুক্ষণ বাদে দৌড়ে যাওয়া পুলিশটা ফিরে এসে বলল, ‘চিপায় চইল্যা গেছে স্যার। আর ধরা যাইতো না।’
আগের পুলিশটা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল,
‘ভাগছে।’
রাইয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাদের সামনে দিয়ে চোর দৌড়ে চলে গেলো আর তারা এখানে আরামে বসে আছে। আবার তেমন চেষ্টাও করছে না। রাইয়ান যেখানে থাকে সেখানে তো গাড়ি চালাতে চালাতে স্পিড একটু বেড়ে গেলেও পেছন পেছন পুলিশের গাড়ি এসে পরে। রাইয়ান অবাক স্বরে বলল,
‘আপনারা গাড়ি নিয়ে ঐ চোরের পিছু নিচ্ছেন না কেন?’
সেই পুলিশটা থু করে রাস্তায় গলার কফ ফেলে বললেন,
‘ঐটা আর পাওয়া যাবো না। ঐটায় এখন কোন গলিতে ঢুইকা পড়ছে তার ঠিকাছে! তা, কি ছিল ব্যাগে? টাকা পয়সা অনেক ছিল নাকি?’
‘জ্বি না। আমার জামা কাপড় ছিল শুধু।’
‘জামা কাপড়ের জন্য ওমন উতলা হইয়া উঠছেন! কি মিঁঞা আপনি!’
‘আমার সব ব্রান্ডেড জামা কাপড়!’
‘আচ্ছা যান, এখন ওগুলা মাথা থিকা ঝাইরা ফেলান। ভালো হইছে আপনি আবার ঐ চোরের পিছু নিতে যান নাই। এদের আবার গ্যাং থাকে। একলা পাইলে ছুরি ঢুকায়ে পেট ফুটা করে দেয়।’
রাইয়ান আঁতকে উঠলো। কি সাংঘাতিক! ভুঁড়িওয়ালা পুলিশটা তার ভুঁড়ির উপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘আচ্ছা আমরা এখন উঠি। চায়ের বিলডা দিয়া দিয়েন।’
রাইয়ান ভোঁতা মুখ করে চায়ের বিল দিতে গেলো। টাকা দিতে গিয়ে দেখলো তারা এতক্ষণ যে মালাই চা খেলো সেই চায়ের উপর দোকানদার টিস্যু দিয়ে কৌশলে দুধের সর বানাচ্ছে। এবার মাথায় সত্যি সত্যিই একটা চক্কর দিয়ে উঠলো রাইয়ানের।
___________________________________________________

(রাইয়ান)
হৃদি বাংলাদেশে এসেছিল তার ফুপির বাসায়। ফুপির সাথে তাদের কোন যোগাযোগ না থাকলেও হৃদির মায়ের পুরনো টেলিফোনবুকে তার ফুপির একটা নাম্বার ছিল। যেটা হারিয়ে ফেলেছিল হৃদির মা। হৃদির বাবা মায়ের মৃত্যুর পর একদিন বাড়ি ঠিক করতে গিয়ে সেই ফোনবুকটা হাতে আসে হৃদির। কিন্তু কখনো সেই নাম্বারে ফোন দেওয়া হয়নি তার। যত্ন করেই রেখে দিয়েছিল শুধু। এরপর বাংলাদেশে আসার কথা ভেবেই সাহস করেই সেই নাম্বারটায় ফোন দেয় হৃদি। ফোন রিসিভ করে তার ফুপির ছেলে। অনেক বছর পর হৃদির কথা হয় তাদের একমাত্র অবশিষ্ট আত্মিয়ের সাথে। সেখান থেকেই হৃদি জানতে পারে তার ফুপিও আর বেঁচে নেই। দেঢ় বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা গেছেন। তবে জীবিত থাকতে তিনি সবসময় তার সন্তানদের বলে গিয়েছেন যদি কখনো তার ভাইয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয় তবে অবশ্যই যেন তারা যত্ন করে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখেন। হৃদির ফুপির পালিয়ে বিয়ে করার পর একপ্রকার অভাবের মধ্যেই ছিলেন তারা। তার স্বামীও তখন ছিল পুরো বেকার। তখন হৃদির বাবাই হৃদির দাদার থেকে লুকিয়ে বোনকে বিদেশ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। সে কথা ভুলেনি হৃদির ফুপি। এরপর তার স্বামীর ছোট একটা চাকরি হয়। হৃদির দাদা মারা যাবার পরও কিছুদিন যোগাযোগ ছিল তাদের। কিন্তু এরপর ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলায় আর ফোন নাম্বারও হারিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগের পথ ছিন্ন হয়ে যায়। যা এতদিন পর আবারও সম্ভব হয়। তাদের সাথে যোগাযোগ করেই হৃদি বাংলাদেশে আসে। তারা থাকে মালিবাগে। সবারই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সবাই নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত।কিছুদিন তাদের সাথেই থেকে ফুফাতো ভাইয়ের সাহায্যে হৃদি একটা বড় এনজিওতে ছোট খাটো একটা চাকরি পায়। বাংলাদেশে এসে হৃদি বুঝতে পারে এদেশে চাকরি পাওয়া আসলে কতটা কঠিন৷ তবুও নিজের আমেরিকার গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট আর ইংরেজি ভাষার দক্ষতার জোরেই এই চাকরিটা পেতে সক্ষম হয় হৃদি। বিশ হাজার টাকা বেতন। হৃদির একার জন্য অবশ্য এতটুকুই যথেষ্ট। এনজিওতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে হৃদি।

এ সব তথ্যই খুঁজে বের করি আমি। জেরিন আমাকে টেক্সট করে হৃদির ফুফাতো ভাইয়ের ঠিকানাটা দিয়েছিল। এর চেয়ে বেশি জানা ছিলো না জেরিনেরও।
সেই ঠিকানা মোতাবেক আমি পৌঁছাই হৃদির কাজিনের বাসায়। সবকিছু একটু জটিল বলে তাদের থেকে হৃদির খবর বের করতে একটু বেগ পেতে হয় আমার। তবে অবশেষে সব খবরই পেতে সক্ষম হই। তাদের থেকেই জানতে পারি হৃদি এই মুহুর্তে আছে সিলেটে। অফিস থেকে একটা ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে কয়েকদিনের জন্য তাকে যেতে হয়েছে। কিছুদিন পর ফিরে আসবে। কিন্তু সেই কদিনের জন্য আর তর সয় না আমার। মন তো চায় এক্ষুণি ছুটে যাই হৃদির কাছে। তার সামনাসামনি হই। দুচোখ ভরে তাকে দেখি। বহুদিন পর আমার কর্ণ গহ্বরেও পৌঁছাক হৃদির মিষ্টি কণ্ঠ। যার জন্য এতদিন ধরে চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি আমি।

আমি সেদিনই সিলেটের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। কিন্তু সিলেটে গিয়ে বুঝতে পারি এখনো হৃদি অবধি পৌঁছাতে আমার অনেকটা পথ বাকি। কারণ এতো বড় শহরে হৃদি কোথায় আছে আমি জানে না। সে রাতটা অজ্ঞাত থেকেই কাটাতে হয় আমাকে। সারা রাত ঘুম আসে না। বিছানায় এদিক ওদিক করে নির্ঘুম সময় কাটাতে থাকি হোটেলের বদ্ধ কামরায়। অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ মনে হয়। একসময় সকাল হয়। আমি বেরিয়ে পড়ি হৃদিকে খোঁজার অভিযানে। টাকা দিয়ে এ ব্যাপারে একটা দক্ষ লোক ঠিক করি। হৃদির অফিসের থেকে খবর বের করে জানতে পারি কোন একটি পাহাড়ি এলাকাতেই আছে তারা। গাড়ি দিয়ে সারাদিন ছুটতে থাকি এদিক ওদিক। তবুও হৃদি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। প্রতিটা মুহুর্তে এতোটা অসহায় বোধ হতে থাকে! একই শহরে দুজন আছি। অথচ তার নাগাল পাচ্ছি না। মানুষের পর মানুষ ধরে ঘুরে ঘুরে অবশেষে সঠিক অবস্থানটা জানতে পারি। তখন শেষ বিকেল। হৃদি আর বাকিরা যে বাসা নিয়ে আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই আমি। হৃদি তখন সেখানে ছিল না। একটা বাচ্চা ছেলে হৃদি পর্যন্ত আমাকে পৌঁছাতে আমার সাথে যায়। আমার বুকের মধ্যে ধকধক করতে থাকে। একেকটা সেকেন্ডও ঘন্টার মতো মনে হয়। বাচ্চাটার পেছনে পেছনে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠি আমি। বাচ্চাটি হাত দিয়ে সামনে ইশারা করেই চলে যায়। সামনে তাকাতেই আমি থমকে যাই। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের ধোঁয়াশার সামনে একটা সরু গাছের নিচে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। তার পরনে সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ। বাতাসে পিঠ জুড়ানো খোলা চুলের সাথে সাথে ওড়নাটাও মৃদু মৃদু উড়ছে। আমার কল্পনা নয়। সব বাস্তব। আমার চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে হৃদি। আমার মনে হলো আমার হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেছে। গলার কাছটায় জমে আসছে সমস্ত আবেগ। থমকে আসে পুরো পৃথিবী। এমন সময় হৃদি আনমনে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখ পড়ে আমার দিকে। একটা ধাক্কার মতো খায় সে। নিজের চোখকে হয়তো বিশ্বাস হয় না। গলা দিয়ে নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বের হয়,
‘রাইয়ান!’
আমি ঝড়ের বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরি হৃদিকে। অনেকদিন বাদে যেন দম নেবার স্বাদ পাই। অশান্ত মনকে প্রশান্তি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবেই যেন নিজের শরীরে প্রাণ ফিরে পাই আমি।

চলবে,