#অঙ্গজা
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|পর্ব ২|
-“বাবু, আমি কী সর্বনাশ করলাম এডা! তোর লাগি এমন বউ আনলাম, বড়ো-ছোট মানে না। কুকাম কইরা একটারে পয়দা করছে, আমি জানতে পারায় আমারে গালাগাল করতাছে। কইতাছে এই বাড়িতে আমার অধিকার নাই, দুইদিন পর বাড়িত্তে বাইর কইরা দিব। আমি এখন কই যামু রে? কী কপাল কইরা এমন বউ আনছিলাম!”
শাশুড়ি মায়ের হায় হায় দেখে আমি এখনও চুপ। শুকনো মুখে তাকিয়ে আছি মাহতাবের দিকে। বাড়ি আসতে না আসতেই এসব শুনল। ওর রাগ বেশি, তারও বেশি ধৈর্য। এখন মাহতাবই শেষ ভরসা। মাহতাব, তুমিও কি মায়ের কথায় আমাকে অবিশ্বাস করবে?
মাহতাব নিশ্চুপ সব শুনল। এরপর বাড়ির ভেতরে এলো। এসে সোজা আমার কোল থেকে সোনাইকে নিজের কোলে তুলে নিল। ঠোঁটের উপরিভাগ সামান্য কালচে দাগ পড়েছে। মাহতাব সেদিকে তাকিয়ে আমাকে বলল,
-“তুমি কিছু বলবে না, অঙ্গজা?”
মাহতাবের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললাম,
-“কিছু বলার নেই সত্যি।”
মাহতাব সামনের সোফায় বসল। মা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। মাহতাব একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। আমাকে বলল,
-“প্রতিটি গল্পের দুটো দিক থাকে, দুটো বিপরীত পক্ষের। মা নিজেরটা বলেছে, আমি তোমারটা শুনতে চাই। একদিক শুনে জাজ করব না আমি। হয়তো মাটিতে ফেলে রাখা সংখ্যাটিকে তুমি সিক্স দেখছ, মা নাইন। এর মানে এই নয় একজন ভুল, অপরজন ঠিক। দুজনের দিক ভিন্ন। অঙ্গজা, তুমি কি বলবে না কিছু?”
আমার ছলছল করা চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি মুছে নিলাম তা। তারপর লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললাম,
-“মা বলেছে, তোমাকে আবার বিয়ে করাবে।”
মাহতাব সামান্য হাসল,
-“এটুকুই?”
আমি মাথা দু-দিকে নেড়ে নেতিবাচকতা প্রকাশ করলাম। মাহতাব এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বয়স একত্রিশের কোঠায় পা রেখেছে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে কী করে করি বলো তো?”
মা বললেন,
-“বাবু, তোর বউ এখন তোর কান ভাঙাইবো।”
মাহতাব মুচকি হেসে বলল,
-“তুমি এখানে বসো মা। দেখি কীভাবে কান ভাঙায়? ঠিক আছে?”
মা মাহতাবের পাশে বসলেন। মাহতাব আমাকে বলল,
-“এরপর?”
-“মা আমার মেয়েকে ছুঁয়ে দেখে না। মেয়েটা আজ খাটে থেকে পড়ে গিয়ে কান্না করছিল, মা তা-ও একবার দেখেনি।”
মাহতাব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে থামতে দেখে বলল,
-“এরপর?”
-“মাকে প্রশ্ন করি—কেন মা এমন করেন?”
-“মা কী বলল?”
-“মা বললেন, ও নাকি আপনাদের রক্ত না। আমি কোথায় কী করে এসে, মানে ওকে জন্ম দিয়েছি, মানে ওর বাবা অন্য কেউ…”
আমার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, গলা ভিজে আসছিল। মাহতাব মেয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মায়ের দিকে ঘুরে মাকে বলল,
-“মা, এসব সত্য?”
মা আমতাআমতা করে বললেন,
-“ভুল নাকি? দেখ, এই মাইয়ার থোতমাডা দেখ। তোর মতো কোনদিক দিয়া হইছে? না চেহারার সাইজ না গায়ের রঙ। যে কেউ দেইখাই বলে দেবে, এর বাপ তুই না।”
মাহতাব চোখ বুঁজে ফেলল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
-“তারমানে তুমি স্বীকার করছ, তুমি এসব বলেছ?”
-“হ কইছি। যা সত্য তাই কইছি। এখন তুইও কি আমারে বাড়িত্তে বাইর কইরা দিবি, বাবু? চম্পা ভাবি আমারে কইছিলো, এই বউ তোরে তাবিজ-টাবিজ করি রাখছে। এখন বুঝতে পারতাছি আমি।”
মা কাঁদতে লাগলেন। মাহতাব মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মেয়ের ডান হাতটা উঠিয়ে মায়ের মুখে ছুঁয়ে কান্না মুছে দিতে লাগল। মা ছ্যাঁত করে উঠে সরে গেলেন। বললেন,
-“এটা কী করতাছোস? এই বেজন্মারে দিয়া ছোঁয়াবিনা না আমারে। পাপ লাগবো আমার।”
মাহতাব সরে দাঁড়ালেন। আমার মুখোমুখি হয়ে বললেন,
-“তুমি মাকে সরি বলো।”
আমি বিস্মিত মুখে বলি,
-“কেন?”
-“তাকে অধিকার চেনানোর জন্য।”
আমি দম নিলাম। চোখের পানি মুছে মায়ের কাছে অধিকারের প্রসঙ্গের জন্য মাফ চাইলাম। মা বোধহয় সামান্য হাসলেন। আমার অসম্ভব খারাপ লাগল বিষয়টা। আর সেই মুহূর্তে মাহতাব বলে উঠল,
-“আটটা কুড়ি বাজে, অঙ্গজা। ৯টার মধ্যে তোমার, আমার আর সোনাইয়ের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে ফেলো। আমরা বেরোব।”
আমি বুঝতে না পেরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মা অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন মাহতাবের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী কস এডি? কোনে যাবি?”
মাহতাব মুচকি হাসলেন মায়ের দিকে তাকিয়ে। বললেন,
-“আমি কারো প্রতি অবিচার করব না, মা। এখানে থাকলে রোজ-রোজ তোমার আর আমার বউয়ের ঝগড়া-ঝাঁটি হবে। মনের ভেতর একবার সন্দেহের উৎপত্তি হয়ে গেলে, কখনই আর বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। তুমিও আমার বউকে বিশ্বাস করতে পারবে না আর। আমি চাই না যেই মেয়েটা নিজের সব কিছু ছেড়ে আমার কাছে এসেছে, সেই মেয়েটাকে কষ্টে রাখতে। পৃথিবীর সমস্ত কষ্টকে আমি শূন্যে পৌঁছাব আমার বউয়ের জন্য। কষ্টটা যদি তোমার তরফ থেকে আসে, আমি ঢাল হতে পারব না সব ক্ষেত্রে। মাতৃআজ্ঞা পালন করতে করতে হয়তো মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলব। তাই তোমাদের আলাদা থাকাই ভালো। তোমার জন্য তোমার পরিবার আছে, আমি আছি। আমার বউ আর মেয়ের জন্য কেবল আমি আছি। আপাতত চাইছি, সবাই ভালো থাকুক।”
মাহতাবের এত সব কথার মাঝে আমি আটকে রইলাম তার বার বার বলা ‘আমার বউ’ কথাটিতে। মা চিল্লিয়ে উঠলেন,
-“আব্বা, যাইস না। আমি কাইল তোরে হুজুরে কাছে নিয়া যামু। চম্পা ভাবি কাইলও আমারে কইছিলো, বউ তোরে তাবিজ করছে। আমি বিশ্বাস করি নাই তখন। কিন্তু এখন বুঝতাছি। আল্লাহ! আমার কী সর্বনাশ হইলো! আব্বা, কাইল না। এখনই চল। তোরে হুজুরের কাছে নিয়া যামু।”
মাহতাব বলল,
-“মা, আমার স্ত্রীর চরিত্র ও সন্তানের জন্মে প্রশ্ন তুলে তুমি আমায় বুঝিয়েছ—আমি স্বামী ও বাবা হিসেবে কতটা ব্যর্থ। সেখানে কীভাবে একজন আদর্শ ছেলে হিসেবে তোমার আঁচলে বাঁধা পড়ি বলো তো?”
মা অশ্রুসিক্ত নয়নে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কী যেন একটা ভেবে তেড়ে আসতে নিলেন আমার দিকে। বিরবির করে বলছেন,
-“হারামজাদি, আমার এত শখের সংসার নষ্ট করতে আইছিস তুই। আগে থেকেই ভাবিরা কয়ছিল বউ কখনও মাইয়া হয় না। আগে থেকেই টাইটে রাখতে হয়, নাইলে মাথায় চইড়া নাচোন শুরু করে। তারপর একসময় সংসার ভাঙে। আমার পোলাডা! একটা ছাড়া দুইটা কথা কইতো না আমার উপরে। সে আমারে কথা শুনায় তোর লাগি। তোরে..”
মা এগিয়ে এসে আমার চুলের মুঠি ধরতে এলেন। ওপাশ থেকে মাহতাব এসে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। মা হিঁসহিঁস করতে করতে বললেন,
-“বাবু, পথ ছাড়। সামনেত্তে সর।”
মাহতাব কঠিন গলায় আমাকে আদেশ করল,
-“৫ মিনিট। যা প্রয়োজন গোছাও।”
মা বললেন,
-“কোত্থাও যাইবি না তুই। এই মা*রে যাইতে ক। ওরে আমার বাড়িত্তে বাইর হইতে ক।”
মাহতাবের গলা আরও গম্ভীর হলো,
-“অঙ্গজা, তোমায় যেতে বলেছি না রুমে? যাও।”
আমি চলে এলাম। রুমের ভেতর থেকেও মা-ছেলের কথা শুনতে পেলাম। মা বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছেন, মাহতাব তা শুনছে। যখনই মা আমাকে, আমার পরিবার তুলে গাল দিতে যাচ্ছে, তখনই মাহতাব বলে উঠছে,
-“মা, যা বলছ একটু ভেবে চিন্তে বোলো। পরের বাড়ির মেয়েকে কিছু বলার আগে একবার ভেবে দেখো, তোমার ঘরেও একটা মেয়ে আছে। তোমার ঘরের মেয়েকেও একদিন পরের ঘরে যেতে হবে।”
আমি কাপড় গুছিয়ে বের হলাম। পাশের বাড়ি থেকে এলো রাহা। ও-বাড়ির মেয়ে প্রিয়া আর ও একই ক্লাসে পড়ে। গ্রুপস্টাডির জন্য বোধহয় গিয়েছিল। ফিরে এসে আমাদের এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে ও বিস্ময় নিয়ে বলল,
-“কই যাচ্ছ তোমরা?”
মাহতাব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“মায়ের খেয়াল রাখিস, কেমন?”
আমার হাতের লাগেজ দেখে বোধহয় কিছু ধরতে পারল রাহা। কেঁদে ফেলে বলল,
-“যেয়ো না!”
মাহতাব বলল,
-“তোর ভাবি আর ভাতিজির থাকার উপযুক্ত স্থান এটা না, রাহা। তুই চাস না ওরা সুখে থাকুক?”
রাহা আমাদের আর আটকালো না। মা-ও আটকালেন না। মাহতাব আমার কোল থেকে ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল, ওকে বুকে জড়িয়ে অন্য হাতে লাগেজটা নিয়ে বলল,
-“এসো।”
ও বেরিয়ে গেল। আর আমি সদরের চৌকাঠে আটকে গেলাম। আমার জন্য এই বাড়ি ছাড়া এতটাও সোজা না। বাড়ির বউ সারাদিন যেখানেই থাকুক, দিনশেষে তাকে ঘরে ফিরতে হয়, ঘরে বাঁধা পড়তে হয়। আমার সাড়ে তিনবছরের একটু একটু করে সাজানো সংসার! আমি কীভাবে ছাড়ি?
একবার পিছে ঘুরে সোফায় মুখ কালো করে নতমুখী হয়ে বসে থাকা শাশুড়ি মা ও কান্না করতে থাকা ননদকে দেখলাম। একটু পর বাবা ফিরবেন। এসে বলবেন, ‘আম্মু এককাপ চা দিয়ে যাও তো দেখি।’
আমার আর চা নিয়ে যাওয়া হবে না। আমার আর চায়ের বাহানায় বাবার সাথে ঘন্টা খানেকের আলাপন হবে না। এ-বাড়িতে সবচেয়ে বেশি কথা তো বাবার সাথেই বলি। মানুষটাকে বলে যাওয়া উচিত নয় কি?
মাহতাব তাড়া দিলো,
-“অঙ্গজা, এসো! দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি চৌকাঠ পেরোলাম। কিন্তু এই রাতের নয়টা বাজে, আমাকে আর আমার আড়াই মাসের বাচ্চা সন্তানকে নিয়ে মাহতাব যাবেই বা কোথায়? ব্যথিত চোখে যখন ওর দিকে তাকালাম, চোখের প্রগাঢ় পলক ফেলে মাহতাব আমায় আশ্বাস দিলো,
-“আমি আছি।”
বাতাসেরা যেন একত্রে গান গেয়ে উঠল, “পুরো পৃথিবী তোমার বিপরীতে থাকলেও, আমাকে তুমি পাশে পাবে।”
চলবে?