অতল গহ্বরে নীরবতা পর্ব-৪৩+৪৪

0
82

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪৩

ঘাটের লোকগুলোর দিকে এগিয়ে এলো সেই একদল লোক। তাদের মাঝ থেকে বেড়িয়ে এলো শিহাব আর ওর বাবা তোফায়েল আহমেদ। শিহাব বলতে লাগলো,
“বিশটা জোগাড় হয়ে গেছে। টাকা কিন্তু ঠিকমতো চাই।”

অপরপাশের লোকটা বিচ্ছিরি দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আরে ভাইসাহেব মা*ল আগে দেখে নিমু না।”

তোফায়েল সাহেব নাকমুখ কুচকে বললেন,
“এতো দেখার কি আছে? তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে যাও। বলা তো যায় না কখন কে দেখে ফেলে।”

“এতো ভয় করলে কিভাবে হবে স্যার? এখন তো খেলার টস হয়েছে মাত্র ব্যাটিং ফিল্ডিং তো এখনো বাকি স্যার।”

বলেই রায়ান আড়াল থেকে বেড়িয়ে মাথার উপর থেকে হুডির টুপি সরিয়ে তোফায়েল সাহেবের সামনে দাঁড়ালো।

তোফায়েল আহমেদ মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রায়ানের উপস্থিতি যেন তার বুকের পাঁজরে একধরনের অদৃশ্য ছুরির আঘাত করল। আশপাশের লোকগুলো থমকে দাঁড়িয়ে রায়ানের দিকে তাকালো, যেন তাদের মধ্যে কেউই এই দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিল। রায়ানের দলের সবাই ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো। শিহাব তাড়াতাড়ি বন্দুক বের করে তাক করলো। রায়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো শিহাবের দিকে। শিহাব ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,
“আমাদের কাজ আমাদের করতে দে রায়ান। এখান থেকে চলে যা।”

শিহাবের কথায় হো হো করে হাসতে লাগলো রায়ান। শিহাব একটা ঢোক গিললো। রায়ান মুহুর্তেই চোখমুখ শক্ত করে বলল,
“আর কত নিচে নামবি। না*রী ব্যব*সা শুরু করেছিস। আর স্যার আপনি না এতো বড় প্রতিষ্ঠানের টিচার। টিচার হয়ে এতো ন*গন্য কাজ আপনি কিভাবে করতে পারেন। একবারও বিবেকে বাঁধলো না।”

শিহাব একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
“ওরা তো তোর কেউ হয় না। তোর এত মাথা ব্যথা কিসের। তোর বউকেও তো ছেড়ে দিছি।”

রায়ান চোখ বুজে নিজের রাগ কন্টোল করার বৃথা চেষ্টা করে হিসহিসিয়ে বলল,
“আনিসাকে তাহলে কেন মারলি?”

শিহাব কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়ান ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“জানিস মেয়েটা তোকে কতটা ভালোবেসেছিলো? তা তুই কিভাবে জানবি? আমারি ভুল তোকে বলা। তুই তো মেয়েদের মন নিয়ে খেলে তাদের…. ছিহ।”

বলেই একদলা থুতু ফেলল রায়ান। শিহাবের দিকে তাকালে ঘৃণায় গা শিরশির করছে তার। শিহাব বলে উঠলো,
“ভালো তো ভার্চুয়াল ছিলি হুদাই মাঠে নামতে গেলি কেন?”

রায়ান বাঁকা হেসে বলল,
“মাঠে তো আমি আগে থেকেই আছি চান্দু। একবার সোনাপাখি তুমি ফাঁদে পা দেও। তখনি আমি খপ করে ধরবো তোমায়। এ অপেক্ষায় ছিলাম বলে দেখা দেই নি।”

তোফায়েল সাহেব বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এতো কথা না বলে শেষ করে দে ওকে।”

শিহাব বাবার কথায় যেইনা গুলি চালাতে নিবে তখনি রায়ান এক লাথি বসায় শিহাব পায়ে

শিহাব হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, তার বন্দুকটি হাতছাড়া হয়ে দূরে গড়িয়ে গেল। আশেপাশের লোকজন থমকে দাঁড়িয়ে গেল, কেউই এমন কিছু আশা করেনি। রায়ান ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“তোর মতো ঘৃণ্য লোকের অস্ত্র হাতে থাকার কোনো অধিকার নেই।”

তোফায়েল সাহেব কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, তার চোখে আতঙ্কের ছাপ। রায়ানের দলের একজন দ্রুত বন্দুকটি তুলে নিল এবং নিরাপদ দূরত্বে রাখল। শিহাব মাটিতে পড়ে কাশতে কাশতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু রায়ানের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে তার সাহস গুটিয়ে গেল।

রায়ান এবার তোফায়েল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু আপনি আজ প্রমাণ করে দিলেন, শিক্ষার অভাব থাকলে না হয় অপরাধ হয়, আর শিক্ষার অপব্যবহার হলে মানুষ পশুর থেকেও খারাপ হতে পারে।”

তোফায়েল সাহেব মুখ শক্ত করে বললেন,
“তুমি জানো না তুমি কার সাথে কথা বলছ। তোমার জন্য এটা শেষবারের মতো সাবধানতা।”

রায়ান হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“আমি কার সাথে কথা বলছি তা খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু আপনি জানেন না আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনার সমস্ত অপরাধের প্রমাণ এখন আমার হাতে। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

শিহাব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“তুই কিছুই করতে পারবি না। আমরা যা ইচ্ছা তাই করব। এটা আমাদের এলাকা, এখানে আইনও আমাদের হাতে।”

রায়ান সামনে এগিয়ে গিয়ে শিহাবের মুখোমুখি দাঁড়াল। তার চোখে দৃঢ়তা ও চ্যালেঞ্জের ঝলকানি।
“তোর এলাকা? খুব শীঘ্রই দেখবি কীভাবে এই এলাকায় সত্যিকারের আইন কাজ করে। আর তোদের মতো লোকেদের জায়গা কোথায় সেটা তো জানিসই।”

ঠিক তখনই রায়ানের পকেটের ওয়াকি-টকিতে এক সিগন্যাল ভেসে এল। ওপার থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ বলল,
“অপারেশন শুরু করা হয়েছে। দল পাঠানো হয়েছে।”

এই ঘোষণা শুনে তোফায়েল সাহেব আর শিহাবের মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রায়ান তাদের দিকে তাকিয়ে শেষবার বলল,
“এবার খেলাটা আমি শেষ করব।”

বলেই রায়ান বন্দুক তাক করলো তোফায়েল সাহেবের দিকে। তোফায়েল সাহেব ঢোক গিললো। শিহাব আশেপাশে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের বন্দুক কেড়ে নিয়ে গুলি করলো রায়ানের দিকে। শিহাব গুলি করার আগেই রায়ান ঠাস করে পিছনে ঘুরে শিহাবের কপাল বরাবর গুলি করে দিলো। মুহূর্তে সবাই থমকে পরলো। শিহাব লুটিয়ে পরলো মাটিতে। দুই দলের মাঝে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। রায়ান বাঁকা হেসে তোফায়েল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খেলা শেষ, তোফায়েল সাহেব। এবার আপনার পালা।”

তোফায়েল সাহেব আতঙ্কে পিছু হটতে লাগলেন। তার চোখে আতঙ্ক ও ক্ষোভের মিশ্র প্রতিচ্ছবি। রায়ান তাকে লক্ষ্য করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আপনার মতো মানুষ এই সমাজের সবচেয়ে বড় বিষ। নিজের লোভ আর ক্ষমতার নেশায় সবকিছু বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু আজ, এই বিষ আমি উপড়ে ফেলব।”

ততক্ষণে রায়ানের দলের বাকিরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। তোফায়েল সাহেবের সহযোগীরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছে। পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। রায়ানের নির্দেশে তার দলের একজন তোফায়েল সাহেবকে পাকড়াও করল।

“তোমার মতো মানুষের জন্যই আমার বোন আনিসার মতো নিরীহ মেয়েরা ভুগতে বাধ্য হয়,” রায়ান বলল, তার কণ্ঠে তীব্র ঘৃণার ছাপ। “তোমার মতো মানুষদের শাস্তি হওয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে না পারে।”

তোফায়েল সাহেব ভীত কণ্ঠে বললেন,
“তুমি ভুল করছ, রায়ান। এটা শুধু ব্যবসা। তুমি যদি আমাদের সাথে থাকো, অনেক কিছু পেতে পারো।”

রায়ান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল,
“তোদের এই অপমানজনক প্রস্তাব আমার কাছে মূল্যহীন। আমার জীবন, আমার বোনের সম্মান, আর এই সমাজ সবকিছু তোর মতো মানুষের হাত থেকে রক্ষা করতেই আমি লড়ছি।”

রায়ানের কথার মাঝেই একটা গুলি ছুটে এলো রায়ানের দিকে। রায়ান খেয়াল করেনি সেটা। ফাহাদ দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে চেচিয়ে উঠলো। ফাহাদ গুলি বের করে লোকটার ইনকাউন্টার করে দিলো। রায়ান সরে যাওয়ার আগেই গুলিটা তার বাহুতে এসে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গেই রক্ত ঝরতে শুরু করল, কিন্তু সে তার স্থিরতা হারালো না। ব্যথা অনুভব করলেও, নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। চোখ বুজে বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস টানলো। শরীরে এক ধরনের কাঁপনি সৃষ্টি হলো। রায়ান চোখ খুলে দেখলো তোফায়েলকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে।

ফাহাদ দ্রুত রায়ানের কাছে ছুটে এসে বলল,
“রায়ান! তুমি ঠিক আছো?”

রায়ান একটি হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“এটা সামান্য। শত্রুরা যা করতে চেয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি আমরা এড়াতে পেরেছি।”

ফাহাদ গম্ভীর মুখে আশপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করল। তোফায়েল সাহেব এবং তার দলের লোকজনকে পুলিশ ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। রায়ানের দলের বাকিরাও তাদের দায়িত্ব পালন করছে, যাতে আর কোনো বিপত্তি না হয়।

রায়ান নিজের হাতে কাটা জখমটা চেপে ধরে বলল,
“ফাহাদ ভাই, আনিসার মতো আর কোনো মেয়েকে যেন এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না হয়। এটা আমাদের শেষ করতে হবে। তোফায়েল সাহেব এবং তার সমস্ত অপকর্মের সমাপ্তি এখানেই হবে।”

ফাহাদ মাথা নত করে বলল,
“আমি অত্যন্ত দুঃখিত আমি তোমার নিরাপত্তা দিতে পারিনা। আমি ব্যর্থ। সত্যিই আমি ব্যর্থ।”

রায়ানের কেমন যেন লাগছে। তবুও মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“আরে ফাহাদ ভাই চিল। এমন কিছুই হয়নি তো আমার। আপনি দয়া করে নিজেকে দোষী ভাববেন না। আপনি যে গোপনে এতটা সাহায্য করেছেন এটাই অনেক। শিহাবকে তো ওর শাস্তি দিয়ে দিয়েছি। এখন বাকি গল্প আপনার হাতে।”

ফাহাদ রায়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল,
“রায়ান তুমি কথা বাদ দেও তো এখন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলো তো। রক্ত পরছে তো তোমার।”

রায়ান আলতো হেসে বলল,
“দাঁড়ান ভাই এখনো একটা কাজ আছে আমার।”

ফাহাদ ভ্রুকুচকে বলল,
”এখন আবার কি কাজ? কোনো কাজ করতে হবেনা। হাসপাতালে চলো তো তুমি।”

রায়ান মুচকি হেসে ফাহাদের উত্তর না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। শিহাবের লাশের কাছে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তাকালো শিহাবের র*ক্তাক্ত মুখের দিকে। আলতো হেসে বলল,
“খুব শখ ছিলো না তোর আমার বউকে একদিনের জন্য বিয়ে করা। এখন কেমন লাগছে ময়না। ভালো লাগছে তাই না। ভালো লাগতেই হবে। রায়ানের দেওয়া ভালোবাসা সবসময়ই ভালোই হয়।”

রায়ান হাত দিয়ে শিহাবের হাত ধরলো। তাকিয়ে বলল,
“ইশ খুব খারাপ লাগছে জানিস। তোর এই সুন্দর হাতের অসুন্দর আঙুল যেগুলো দিয়ে আমার বউকে ধরেছিলি সেগুলো ছাড়াই তোকে কিয়ামতের দিন উঠতে হবে।”

বলেই হাসতে লাগলো সে। হাতের ব্যথা নিয়েই বেশ কষ্ট করে পকেট থেকে একটা ছু*রি বের করে পরপর টা*ন বসালো শিহাবের আঙুলে। ফাহাদ অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো। শুধুমাত্র বউয়ের হাত ধরার জন্য এতটা শাস্তি। ভাবতেই এক ঢোক গিলল ফাহাদ। রায়ান উঠে দাঁড়ালো। চোখে কেন যেন অন্ধকার দেখতে লাগলো সে। মাথা ঘুরছে ভনভন করে। পরে যেতে নিবে তখনি ফাহাদ শক্ত হাতে রায়ানকে ধরে ফেলল।

চেচিয়ে বলে উঠলো,
“রাফি তাড়াতাড়ি আয়। রায়ান জ্ঞান হারিয়েছে। হাসপাতালে নিতে হবে ওকে।”

———————–

ঘুমের মাঝেই হুট করে আতকে উঠলো আমায়রা। চোখের সামনে রায়ানে হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠলো। কখন যে চোখটা লেগে এসেছিলো বুঝতে পারেনি সে। অজানা আতঙ্কে বুকটা কাঁপছে তার। কেন এমন হচ্ছে জানা নেই তার। বেড সাইট টেবিল হাতরে পানি বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো সে। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। সে কি একবার কল করবে রায়ানকে।

#চলবে

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪৪

আমায়রা আর না ভেবে কল দিলো রায়ানের নাম্বারে। কিন্তু রায়ান কল রিসিভ করছে না। আমায়রার অস্থিরতা যেন ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। চারপাশে ফজরের আযানের সুর ভেসে উঠলো। আমায়রা নিজের মনকে শান্ত করার জন্য ওয়াশরুমে গেল ওযু করতে। ওযু করে নামাজে বসে পরলো সে।

————————

রায়ানের জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে হাসপাতের বিছানায় আবিষ্কার করলো। হাত ব্যথায় নাড়াতে পারছেনা।

খানিকক্ষণ পরেই রুমে ফাহাদ আসলো। ফাহাদ আসতেই রায়ান মুচকি হেসে উঠে বসতে নিবে তখনি ফাহাদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“উঠতে হবেনা রায়ান। এখন কেমন লাগছে?”

রায়ান তাও উঠে হেলান দিয়ে বসলো। ফাহাদও সাহায্য করলো ওকে। নরম গলায় বলল,
“আগের থেকে আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ওইদিকের কি খবর?”

ফাহাদ রায়ানের বেডের পাশের টুলটা টেনে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তোফায়েল সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই রাফি সেখানেই তাকে সুট করে দেয়। আর স্পটেই মারা যায় উনি। এতক্ষনে হয়তো নিউজ হয়ে গেছে।”

রায়ানের চোখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সকাল ছয়টা বিশ মিনিট। রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালোই হয়েছে ঝামেলা শেষ। ভাই আমার চট্টগ্রাম যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

“কিন্তু তুমি তো এখনো সুস্থ না রায়ান। একটু না হয় রেস্ট নিয়ে নেও।”

রায়ান আলতো হেসে বলল,
“যোদ্ধাদের বেশি রেস্ট নেওয়া মানায় না ফাহাদ ভাই। আর আমার অফিসে জরুরি মিটিং আছে বলেই যাচ্ছি। সকালের মিটিং না হয় বিকালে হবে। একেবারে কাজ শেষ করে রেস্ট নিবো। তাছাড়া এতক্ষন তো রেস্টই নিলাম।”

রায়ান ফাহাদের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ফেলল। রায়ান যে কথা শোনার মানুষ না সে জানে। ফাহাদ চলে গেল সব ব্যবস্থা করতে।

রায়ান আশপাশ তাকিয়ে নিজের ফোন খুঁজতে লাগলো। তখনি ফাহাদ আবারো ফিরে এলো। রায়ানের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল,
“কেউ তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কল দিয়ে কথা বলে নেও।”

রায়ান কপাল কুচকে তাকিয়ে ফোনটা নিলো। ফাহাদ হাসতে হাসতে চলে গেল। রায়ান ফোন ওপেন করে নিজেও হাসলো। যমরানী সেভ করা নাম্বারটা থেকে এগারো বার কল করা হয়েছে । রায়ান দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজ মনেই বলল,
“যমরানী তো দেখি যমরাজকে মিস করছে।”

রায়ান নিজের গলা ঠিক করে কল করলো আমায়রাকে। দুবার রিং হতেই রিসিভ হলো। রায়ান হাসলো। আদুরে গলায় বলে উঠলো,
“বাহ বউ তুমি আমাকে এতটা মিস করবে জানা ছিলো না তো আমার। আগে বললে আমি আর তোমাকে ছেড়ে আসতামই না।”

আমায়রা বিরক্ত হলো। কোথায় মানুষটার জন্য এতক্ষন টেনশনে বাঁচছিলো না। আর এই লোক ফোন ধরেই বাজে বকা শুরু করে দিয়েছে। আমায়রা গাল ফুলিয়ে বলল,
“আপনি রাখেন তো আপনার বাজেকথা। পৌঁছে গিয়েছেন?ঠিক আছেন তো?”

রায়ান আলতো হেসে ব্যান্ডেজ করা হাতটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম পৌঁছে গিয়েছি। ঠিক আছি আমি। কেন বলো তো?”

আমায়রা ধীর গলায় বলল,
“না এমনি।”

রায়ান দুষ্টু হেসে বলল,
“গাল ফুলিয়ে রাখলে একদম বাচ্চাদের মতো লাগে তোমাকে। মনে হয় চুমু….!”

কট কেটে দিয়েছে আমায়রা। রায়ান সেদিকে তাকিয়ে জোরেই হেসে দিলো।

ফাহাদ ফিরে এসে রায়ানকে হাসতে দেখে বলল,
“কি মসাই এতো হাসছো কেন?”

রায়ান হেসেই বলল,
“কিছু না ভাই, ব্যবস্থা হয়েছে!”

ফাহাদ ছোট্ট করে বলল,
“হুম”

——————

আবির ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। অর্ধেক রাত এসাইনমেন্ট করেছে আর বাকি রাত রায়ানের রহস্য নিয়ে ভেবেছে। শেষ রাতের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো। ফোন হাতরে বালিশের নিচ থেকে নিয়ে দেখলো সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। রায়ান তো খবরের খবর দেখতে বলেছিলো। বেড থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে টিভি দেখতে যাবে বলে ভাবলো। দরজা অব্দি যেতে থেমে গেল সে। না টিভিতে দেখা যাবে না। এতে সবাই সন্দেহ করে যদি। বিশেষ করে আমায়রা। আমায়রা তো আর সবকিছু জানেনা। এসব ভেবে ফোনেই খবর দেখতে লাগলো।

খবর দেখে আবিরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তোফায়েল সাহেব আর তার ছেলে না*রী পা*চার করতে গিয়ে আটক। পালাতে গিয়ে পুলিশ তাদের আটকাতে না পেরে হাতাহাতির হয়। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এবং স্পটেই তারা মারা যায়। আবির আরো অবাক হলো ফাহাদকে দেখে। দেখেই সে চিনে গেছে এটা তো আহাদের বড় ভাই।

আবির আর দেড়ি না করে কল করলো রায়ানের নাম্বারে। রিসিভ হচ্ছেনা দেখে অস্থির হয়ে পরলো আবির। অস্থিরতা নিয়ে রুমের মাঝে পাইচারি করতে লাগলো আবির। আবারো কল করলো রায়ানের নাম্বারে।

রায়ান প্রাইভেট কারের পিছনের সিটে বসে চোখ বুজে ছিলো সে। ফোন ভাইব্রেট হতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো রায়ান। পকেট থেকে ফোন বের করতেই ফোনে জ্বলজ্বল করে উঠলো গাধা লিখে সেভ করা নামটা।

রায়ান একরাশ বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করে কানে রাখতেই আবির অস্থির গলায় বলে উঠলো,
“ভাই শিহাব আর ওর বাপকে কি তুমি?”

রায়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,
“চুপ যা হারাম*জাদা। আমি একটা ভালো ভদ্র ছেলে। আমি কি পারি কিছু করতে বল তুই!”

আবির বিরক্তিতে দুপা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে নাকমুখ কুচকে বলল,
“ভাই বলো না একটু। আমি এমনিতেই অস্থিরতা নিয়ে শুতে পারছি না, ঘুমাতে পারছিনা, খেতে পারছিনা।”

রায়ান দাঁত বের করে হেসে বলল,
“হাগতে পারিস?”

আবির অবাক হয়ে বলল,
“এহহ”

রায়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ঢং দেখে বাঁচি না। মনে হয় কিছু বুঝেনা ছোট বাচ্চা। যা সকালে দেড়ি করে উঠেছিস এমনিতেই। এখন হাগতে গিয়ে তোর মাথার গু সব বাথরুমে রেখে আয়।”

আবিরের এবার নিজের চুল নিজের ছিড়তে মন চাইছে। কি জিজ্ঞাসা করলো আর এই বিটকেল, হিটলারের নানাতো শশুর কোন দিকে নিয়ে গেল? এই ব্যাটা ছাড়া আর কেউ এটা করতেই পারেনা।

রায়ান বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
“কথা না বলে চুপ করে থাকার জন্য ফোন দিলে আমি রাখলাম। এখন আমার তোর ফাজলামি শোনার কোনো ইচ্ছে নেই।”

বলেই কল কেটে দিলো রায়ান। আবির হা হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। সে ফাজলামি করছিলো না বিটকেলটা বাদরামো করছিলো।

——————

আমায়রা মেজাজ খারাপ করে ফোনটা পাশে ছুঁড়ে রাখলো। রায়ানের এই বাজে মজা তার সহ্য হচ্ছে না। এত সিরিয়াস একটা মুহূর্তে এমন ঠাট্টা কি কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? তবুও, মনের গভীরে কোথাও যেন একটা স্বস্তির ছোঁয়া পেল সে রায়ান ঠিক আছে শুনে।

আমায়রা একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে রুম ত্যাগ করে রান্নাঘরে গেল। নাইমা আর শাহানারা বেগম নাস্তা বানাছিলো। আমায়রা হাসি মুখে নাইমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আম্মু কোথায় আপু?”

নাইমা হাতের কাজ করতে করতে বলল,
“আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ তাই এখনো শুয়ে আছে। নূর উঠে আবার সোফায় এসে শুয়েছে। তুমি বরং ওকে একটু ফ্রেশ করিয়ে দেও।”

আমায়রা হাসি মুখে হাত নাড়িয়ে নাইমার কথায় সম্মতি দিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বসার ঘরের দিকে রওনা হলো।

শাহানারা বেগম চোখমুখ কুচকে বললেন,
“এমন ভাব করে মনে হয় ঘরের মেয়ে। এলো কোনো কাজ কামে হাত না দিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেল। বড় বউ তুমি পারোও বটে এভাবে ছাড় দেও কেন? এখন সংসারে কাম করবে নাতো কখন করবে!”

নাইমা আলতো হাসি দিয়ে খুনতি নাড়িয়ে বলল,
“চাচি আমিই ওকে নূরের কাছে যেতে বলেছিলাম বলেই ও গিয়েছে। কাজ করতে বললেই ও করতো হাসি মুখে। আর এখন করবে কেন, কেবল বিয়ে করে এসেছে। আর ও আমার ছোট বোনের মতো। থাক না আমি তো করছিই।”

শাহানারা বেগম বিরক্তি নিয়েই বলল,
“কি বাপু বুঝিনা। দেখ বাপু জা কখনো বোন হয় না।”

নাইমা আবারো আলতো হেসে বলল,
“চাইলেই হয় চাচি।”

নাইমা এবার শাহানারা বেগমের মুখোমুখি হয়ে বলল,
“হুদাই ঝামেলা করার কি আছে চাচি। আপন ভাবলেই আপন করা যায়। মেয়েটা আমাকে কিন্তু আপন করতে চাইছে। আমিও চাই ওকে আপন করতে। আপনি দয়া করে উল্টোপাল্টা কথা বলবেন না।”

শাহানারা বেগম রাগে গিজগিজ করতে করতে চলে গেল রান্নাঘর ছেড়ে।

নাইমা সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল। এটা নতুন নয়। শাহানারা বেগম সুযোগ পেলেই এমন করে। অবশ্য নাইমা তেমন একটা পাত্তা দেয়না।

——————-

আমায়রা বসার ঘরে এসে দেখল নূর সোফায় আরাম করে ঘুমোচ্ছে। তার গায়ে হালকা একটা কম্বল দেওয়া, যা হয়তো নাইমা দিয়েছে। আমায়রা কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে নূরের চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“কিউটি ওঠো, মুখটা ধুয়ে নাও। নাস্তা করতে হবে তো।”

নূর ঘুমঘুম চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে আমায়রাকে দেখে মুচকি হেসে আমায়রার একহাত জড়িয়ে আবারো চোখ বুজলো।

আমায়রা আলতো হেসে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“উঠো কিউটি, আম্মু তাছাড়া বকবে তো।”

নূর খানিকটা ভেবে বলল,
“উঠবো কিন্তু আমাকে চকলেট দিতে হবে।”

আমায়রা হেসে নূরকে কোলে তুলে গায়ে টুক করে চুমু খেয়ে বলল,
“আচ্ছা তবে বেশি না একটা।”

নূর দাঁত বের করে হেসে গলা জড়িয়ে ধরলো।

#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। বেশি বেশি রিয়েক্ট কমেন্ট করবেন।)