অতল গহ্বরে নীরবতা পর্ব-৪৫

0
82

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪৫

নূরকে ফ্রেশ করিয়ে নূরকে নিয়ে রুমে আসতেই ফোনটা বেজে উঠলো তার। আমায়রা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইশরা কল করেছে। আমায়রা কল রিসিভ করে কানে নিতেই ইশরা হুড়মুড়িয়ে বলতে লাগলো,
“শুনেছিস কি হয়েছে?”

আমায়রা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কি হয়েছে আবার?”

ইশরা অস্থিরতা নিয়েই বলল,
“খবর দেখ তাড়াতাড়ি। ভার্সিটিতে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে আর তুই এখনো কিছু জানিসই না।”

ইশরার কথায় আমায়রা কুচকে যাওয়া কপাল আরো কুচকে গেল। কল কেটে দ্রুত খবর দেখতে লাগলো সে। খবর দেখে চক্ষুচড়ক গাছ তার। সে কল্পনাও করেনি তোফায়েল সাহেবও এতটা খারাপ। শিহাব তো খারাপই এটা তো সে জানেই। পরক্ষনেই কি যেন ভেবে আমায়রা ধপ করে বেডে বসে পরলো। তার মনের মাঝে কিছু প্রশ্ন তীব্র বেগে আন্দোলন শুরু করেছে। কেন যেন রায়ানকে সন্দেহ হচ্ছে। তবে কি? না না একি ভাবছে সে। নিজের মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালো।

——————–

কেটে গেছে একটা দিন আবির হেলেদুলে রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। কোনোমতে ক্লাস শেষ হতেই বের হয়ে পরলো সে। সেদিনের পরে আর কল রিসিভ করেনি রায়ান। আবিরও চেষ্টা করেনি। কাজ শেষে নিজেই কল করবে।

আবির বড় রাস্তার ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছিলো। পাশের পার্কের দিকে চোখ পরতেই কপাল কুচকে এলো তার। এ তো কাবিল স্যারের অসভ্য মাইয়া। এ এখানে এমন করে কান্না করছে কেন?

আবির কি যেন ভেবে এগিয়ে গেল। মেয়েটার গায়ে এখনো কলেজ ড্রেস। আবির রোজার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সরু চোখে ওরদিকে তাকালো। রোজা এখনো খেয়াল করেনি। সে এখনো টিস্যুতে নাকমুখ মুছতেই ব্যস্ত। আবির বেশকিছুক্ষণ সরু চোখে ওকে পর্যবেক্ষণ করে থমথমে গলায় বলল,
“তুমি আবার কান্না করতেও পারো! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তর্ক ছাড়া কিছুই পারোনা।”

রোজা একপলক আবিরের দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মন দিলো।

আবির চোখ পিটপিট করলো একি মাইয়া তো তারে পাত্তাই দিলোনা। আবির ধপ করে ব্যাগ নিয়ে রোজার থেকে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসে পরলো। বসে নিজ মনেই বিরবির করতে লাগলো।

খানিকক্ষণের নিরবতা ভেঙে রোজা আবিরের দিকে ঘুরে বলে উঠলো,
“আচ্ছা বলুন তো কলেজের প্রথম যে পরীক্ষা হয়েছিলো সেটায় ফেল করলে কিছু হয়?”

আবির কপাল কুচকে তাকালো রোজার দিকে। কি বলছে মেয়েটা এগুলো?

রোজা আবারো বলে উঠলো,
“কি হলো বলছেন না কেন?”

আবির কিছুটা থতমত খেয়েই বলল,
“না কিছু হয় না।”

রোজা গাল ফুলিয়ে বলল,
“এটাই তো। আমি বুঝতেছি, আপনিও বুঝতেছেন, সবাই বুঝতেছে শুধুমাত্র আমার বাবা বুঝতেছেনা। এখন কি করবো আপনিই বলুন!”

আবির বিষয়টা কিছু হলেও বুঝতে পারলো। তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,
“পরবর্তীতে ভালো করে ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়ে দেও।”

রোজা বিরক্তি নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পারলে না পড়বো। আমার পড়তে ভালো লাগেনা।”

আবির হেসে বলল,
“ওইটা কারোই ভালো লাগেনা।”

রোজা নাকমুখ খিচালো।

আবির মনে মনে বলল,
“বাপে টিচার আর মাইয়া কয় পড়তে ভালো লাগে না। এমন মনে হয় যেন যাতে কোনো প্যাঁচ নাই যতসব।”

রোজা বলে উঠলো,
“আপনার নাম কি বলুন তো?”

আবির সরু চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নাম যাইনা কাম কি?”

রোজা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“নাম জিজ্ঞাসা করছি তাতে এমন করার কি আছে বুঝলাম না তো?”

আবির ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কইতাম না।”

রোজা অবাক হলো। নাম জিজ্ঞাসা করলে এমন করার কি আছে? আবির চলে যেতে নিবে তখনি রোজা পিছন থেকে ডেকে বলল,
“গাধা আবির”

আবিরের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। গাধা তো তাকে কাবিল স্যার আর রায়ান ছাড়া কেউ ডাকেনা। আবির পিছু ঘুরে তাকাতেই রোজা মুখ ভেংচি কেটে অন্যদিকে হাঁটতে লাগলো। আবির অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো রোজার যাওয়ার দিকে।

—————————-

রায়ান আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে। সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে আমায়রা রায়ান এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। চারপাশে কুয়াশা পড়েছে। আমায়রা নরম গলায় দূরের কুয়াশার দিকে চোখ রেখে বলল,
“শিহাব আর তার বাবাকে আপনি মেরেছেন তাই না।”

রায়ানও দূরের কুয়াশা মাখা আস্তরণে চোখ রেখে বাঁকা হাসলো। যা আমায়রার চোখ এড়ালো না। আমায়রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“হাতে কি ব্যথা সেখানেই পেয়েছেন?”

রায়ান আলতো হেসে আমায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাহ এটাও খেয়াল করে ফেলেছো দেখি। সে যাইহোক আজ একটা কথা বলবো মেনে চলার চেষ্টা করে। আর কাছের সবাইকেও সতর্ক করবে।”

আমায়রা কপাল কুচকে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান বলতে লাগলো,
“অপরিচিত কারো সাথে কখনোই ভিডিও কলে কথা বলতে যাবেনা। একদম পরিচিত ছাড়াও না। কারণ এখন ভিডিও কল রিসিভ করার পরপরই ভিডিও ক্লিপ নিয়ে বিভিন্ন খারাপ ভিডিও এর সাথে এডিট করা হয়। যা দিয়ে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেল করা হয়। এ বিষয়টায় সতর্ক থাকবে।”

রায়ান কিছুটা দম নিয়ে আবারো বলে উঠলো,
“আনিসার ভালোবাসা ছিলো শিহাব। শিহাব ওর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় ওর ভিডিও ক্লিপ নিয়ে খারাপ ভিডিও তে এডিট করে ওকে ব্ল্যাকমেল করতো। বাকিটুকু তো তুমি জানোই।”

আমায়রা অবাক হলো সে ভাবতেও পারেনি আনিসা শিহাবকে ভালোবাসতো।

রায়ান এবার আমায়রার দিকে ফিরে বলল,
“এখানে একটু দাঁড়াও একটা কাজ আছে।”

আমায়রা কপাল কুচকে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান মুচকি হেসে চলে গেল রুমে।

খানিকবাদেই রুম থেকে বারান্দায় এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো আমায়রার সামনে। হাতের আংটির বক্সটা উঁচু করে আমায়রার চোখে চোখ রেখে বলতে লাগলো,
“কিভাবে কি শুরু করতে হয় জানি না বউ। তবুও এই অগোছালোটাকেই গুছিয়ে মনের অতল গহ্বরে রেখে দিও প্রিয়। নীরবতার মাঝেও হাজারো রকমভাবে নিজেকে মনে অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। কিন্তু প্রকাশ করলে মনের অস্থিরতা কমে। তাই আমি নিজের মনের অস্থিরতা কমাতে মন খুলে কিছু কথা বলতে চাই।”

আমায়রা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে রায়ানের চোখের দিকে। রায়ান দমে আবারো বলতে লাগলো,
“যমরাজের যমরানী হয়ে তোমায় রাখতে চাই মনের অতল গহ্বরে। যেখান থেকে কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেনা। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। প্রথম অনুভূতি, যাকে দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম। আমার হৃদয় আমার কথা না শুনে তোমাকে দেখে ধুকপুক করেছে। আমার চোখ আমার কথা না শুনে তাকিয়ে থেকেছে তোমার দিকে অপলকভাবে। মানুষ বলে দূরত্ব নাকি দূরত্ব বাড়ায়। কথাটা আমি রায়ান মানিনা। কারণ আমি যে দূরে গিয়েই বুঝতে পেরেছি আমার অনুভূতি কতটা প্রখর। আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। হ্যাঁ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার ঝগড়া করারকে ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমার গাল ফুলিয়ে রাখা মিষ্টি মুখটা। তুমি যেমনি তেমনি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমার প্রয়োজন। গভীরভাবে প্রয়োজন। তুমি কি ভালোবাসবে এই অগোছালো, জেদী, রাগী প্রেমিক পুরুষকে।”

আমায়রা পুরোপুরি থ মেরে গেছে রায়ানের কথাগুলো শুনে। তার চোখের পলক পড়ছে না। রায়ানের চোখে এক ধরনের অদ্ভুত দীপ্তি, যা তাকে আরও বেশি আবেগপ্রবণ করে তুলছে। রায়ান তার উত্তর পাওয়ার জন্য গভীরভাবে তাকিয়ে আছে।

আমায়রা হুট করেই রায়ানের সামনে বসে রায়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রায়ান আচমকা এমন হওয়ায় কিছুটা পিছিয়ে গেল। নিজেকে সামলাতে না পেরে আমায়রাকে বুকে নিয়েই ঠাস করে মেঝেতে পরে গেল। হাতে একটু লাগলেও সে সেদিকে পাত্তা দিলো না। আমায়রা কান্না করে দিয়েছে। ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
“আমিও নিজের অজান্তেই কখন যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা। তবে আপনি আমার অভ্যাস হয়ে গেছেন। এখন আর রাতে আপনার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না। আপনার সাথে ঝগড়া না করলে আমার অস্থির লাগে। যদি এটা ভালোবাসা হয় তাহলে আমি আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আমি চাই পান্ডা হয়ে আমার জীবনের সকল বাঁশ এভাবেই আপনি খেয়ে আমাকে ভালোবেসে যান।”

আমায়রার কথায় হো হো করে হেসে দিলো রায়ান। আমায়রাও হেসে দিলো। আমায়রা উঠে দাঁড়ালো। রায়ানও উঠে দাঁড়িয়ে আমায়রার তর্জনীতে আংটিটা পড়িয়ে চুমু খেল আমায়রার নরম হাতে। আমায়রা আলতো হাসলো।

হুট করেই রায়ান কোলে তুলে নিলো আমায়রাকে। আমায়রা অবাক হয়ে বলল,
“একি করছেন আপনার তো হাতে ব্যথা!”

রায়ান বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার মতো চুনোপুটিকে তুলতে এই রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরীর হাতে লাগবেনা।”

আমায়রা গাল ফুলিয়ে ফেলল। রায়ান হেসে আমায়রাকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে শুয়ে পরলো। কিছুক্ষণ পর ধীর কন্ঠে রায়ান বলল,
“আমার না চুমু খেতে মন চাইছে বউ। আমি কি তোমাকে চুমু দিতে পারি।”

আমায়রা রায়ানের কথায় অবাক হলো। এই ব্যাটা আবার জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো কবে থেকে? হুটহাটই তো ব্যাটা চুমু খায়। এখন আবার জিজ্ঞাসা করে কেন? ”

রায়ান আমায়রা দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“পুরোটা আমায়রাকে আমার নামে লিখে নিতে চাই। রায়ানময় করে দিতে চাই তোমায়।”

রায়ানের কথা বুঝতে পেরে আমায়রা মুখ লাল হয়ে গেল লজ্জায়। রায়ান বুকে মুখ গুজে ধীর কন্ঠে আমায়রা বলে উঠলো,
“আমি কি না করেছি, আপনি তো অনেক আগেই সেই অধিকার নিয়ে নিয়েছেন!”

আমায়রার কথায় রায়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। আমায়রা কপালে গভীর একটা চুমু খেল রায়ান। আমায়রা চোখ বুজে অনুভব করলো রায়ানে উষ্ণ স্পর্শ।

মৃদু কুয়াশার মধ্যেই তাদের ভালোবাসার গল্প আরও গভীর হয়ে উঠলো, যেখানে শব্দের চেয়ে অনুভূতিগুলো ছিলো অনেক বেশি শক্তিশালী। অনুভূতির অতল গহ্বরে তারা ডুবে যেতে লাগলো নিরবে।

———————–

আবির, বন্যা, রায়ান, আমায়রা একটা রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে নখ খাচ্ছে অনবরত। কি হব না হবে এই ভেবেই সবাই চিন্তিত। দুই টেবিল পরেই অনুভব আর সুরাইয়া বসে কথা বলছে। আবির নিজের অস্থিরতা দমাতে না পেরে বলে উঠলো,
“এতো কাহিনীর কি আছে বুঝিনা বাপু? আমারে কোনো মাইয়া পছন্দ করলে তারে আমি নিয়ে তখনি ভেগে গিয়ে বিয়ে করে আসতাম।”

রায়ান বিরক্ত হলো আবিরের কথায়। বিরক্তি নিয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই জন্য মাইয়ারা তোরে পাত্তাই দেয়না।”

আবির মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“তুমি তো বলবাই তুমি তো তোমার বউরে পাইয়া গেছ না।”

রায়ান সরু চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তো তুইও খুঁজে বিয়া করে নে। আমি তো না করিনি।”

#চলবে