#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪৬ (অন্তিম পর্ব)
আমায়রা রায়ানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আপনি চুপ থাকতে পারেনা!”
রায়ান আমায়রাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এতো রাগ করো কেন বউ? আমি ভয় পাই তো।”
আমায়রা মুখ বাঁকালো।
অনুভব সুরাইয়ার দিকে না তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“আমি কখনো তোমাকে বন্যার জায়গায় রাখতে পারবোনা। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো তোমাকে তোমার জায়গায় রেখে ভালো রাখার। আমি নিজের জীবনকে সুযোগ দিতে চাই। তুমি যদি এই কন্ডিশন মেনে আমাকে বিয়ে করতে চাও তাহলে আমার আপত্তি নেই।”
সুরাইয়া হাসলো। অনুভবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। বিয়ের পরে যদি আপনি আমার প্রেমে না পড়েন তাহলে আমার নাম আমি পাল্টে দিবো এটা আমার প্রমিস।”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সুরাইয়া। অনুভব হাসলো।
অনুভব আর সুরাইয়া রায়ানদের কাছে যেতেই আবির চোখ দিয়ে ইশারা করলো সুরাইয়াকে। সুরাইয়া ইশারায় হ্যাঁবোধক সম্মতি দিতেই সবাই মিলিয়ে লাফিয়ে উঠলো। আমায়রা তো সুরাইয়াকে জড়িয়ে ধরলো। রায়ান সরু চোখে তাকালো সেদিকে। রাকিব এসে সবাইকে হাসিমুখে দেখে বুঝে গেল সব। রাকিব হাসিমুখে বলল,
“তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করি কি বলো সবাই?”
সবাই আরো হৈহৈ করতে লাগলো। অনুভব সবার এমন পাগলামো দেখে বেশ অবাক হলো। সবাই কতটা করছে তাকে ভালো রাখার জন্য। সবার কথা ভেবে না হয় জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিবে সে। নিজের প্রথম ভালোবাসাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবে।
ওদের কথাবার্তার মাঝেই কোথায় থেকে যেন রোজা দৌড়ে এলো। সুরাইয়ারকে জড়িয়ে ধরে তাকালো অনুভবের দিকে। সুরাইয়াকে ছেড়ে কোমরে হাত রেখে অনুভবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“কি স্যার অবশেষে তো আমার সইকেই বিয়ে করছেন?”
অনুভব মাথার চুলে হাত রেখে হাসলো।
আবির অবাক হয়ে বলল,
“একি তুমি এখানে কি করছো?”
রোজা তাকালো আবিরের দিকে। সেও অবাক হলো। সাথে সবাই ও অবাক নয়নে রোজা আর আবিরের দিকে তাকালো। রোজা ভ্রুকুচকে বলল,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
আবির মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি তো এখানে থাকবোই। আমার ভাই বোন যেখানে সেখানেই আমি।আমার বোনকে সই সই করো আর তার ভাইদের চিনো না, ঢং।”
রোজা অবাক হয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই গাধাটা তোর ভাই?”
আবির রোজার কোথায় তেতে উঠে বলল,
“ওই টাকলার মাইয়া মুখ সামলে কথা বল তুই গাধা। অংকের টিচারের মাইয়া হয়ে অংকে ফেল করে এখন আমারে গাধা কইতে আইছে।”
রোজা আঙুল তুলে বলল,
“আপনি মুখ সামলে কথা বলেন। আপনাকে ভালো ভাবায় আমার ভুল। আমি তো আপনাকে…!”
রায়ান দুইজনকে থামাতে বলল,
“চুপ, একদম চুপ।”
রায়ানের ধমকে দুইজনই চুপ হয়ে গাল ফুলিয়ে চেয়ারে বসলো। খানিকবাদে রায়ান আবিরের কানে কানে বলল,
“কিরে চান্দু ভালোই তো চলছে দেখি!”
আবির কপাল কুচকে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি চলছে?”
রায়ান দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“আরে ভাই আমার ঝগড়া যে প্রেমের পূর্ব লক্ষণ।”
আবিরের কুচকে যাওয়া কপাল আরো কুচকে গেল। চোখ ছোট ছোট করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানে ভাই এগুলো তুমি কি বলছো?”
রায়ান আবারো ঠোঁট কামড়ে হেসে আবির দিকে ফিরে আবিরের শার্টের কলার ঠিক করে নরম গলায় বলল,
“তোর বোঝার এখনো বয়স হয়নি। বুঝবি বুঝবি সব বুঝবি কিছুদিন যাক সব বুঝবি।”
আবির আবারো মনে মনে রায়ানকে বকতে লাগলো। এই এক কথা রায়ানের। আবির বরাবরই বিরক্ত রায়ানের এই কথায়। আবির গাল ফুলিয়ে রাখলো। রায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
★★
কেটে গেছে পাঁচটা মাস। আজ অনুভব আর সুরাইয়া, রায়ান আর আমায়রার বিয়ে। পরিবারের সবার ইচ্ছেই আমায়রা আর রায়ানের বিয়েটা ধুমধাম করে দেওয়ার জন্য অনুভব আর সুরাইয়ার সাথেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমায়রাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠছিলো। কিন্তু রায়ান যেতে দেয়নি। সে তার বউকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। তার তো বিয়ে করা বউ। সে কেন বউকে শশুরবাড়ি রেখে আসবে। সবার সামনেই রায়ান বলে উঠেছিলো,
“আমার বউ আমার কাছে থাকবে। বউকে যদি দূরে রাখতে হয় তাহলে এই অনুষ্ঠানেরই দরকার নেই।”
রায়ানের এমন সোজাসাপ্টা কথায় সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি করলেও রায়ানের কথায় সম্মতি দিয়ে নূরও জোর গলায় বলেছিলো,
“বার্বি ডল এই বাড়িতেই থাকবে।”
আমায়রা বেশ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলো।
বিকাল থেকে রায়ান ঘুর ঘুর করছে তাহসানের রুমের সামনে। কারণ সেখানেই আমায়রাকে বউ সাজানো হচ্ছে। পাইচারি করছে আর বুকে হাত দিয়ে বলল,
“বউকে বউ সাজে দেখার জন্য এতো লাফালাফি করছিস কেন বদ হৃদপিন্ড। থাম এবার, না হয় কিন্তু তোর খবর আছে বলে দিলাম। বউকে বউ রূপের দেখার আগেই আমারে মারবি নাকি। দেখ তোর জন্য যদি আমি মরি তখন ভুত হয়ে বউয়ের সাথে থাকবো তখন তুই কবরে বসে পোকার কামড় খাস।”
নাইমা আমায়রাকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পড়িয়ে, হালকা কাজের সোনার গহনা, খোঁপায় লাল টকটকে গোলাপ, লাল ওড়না, হালকা মেকআপ, সবকিছুই রায়ানের কথা মতো সাজিয়েছে। মেয়েকে বেশ সুন্দর লাগছে। নেহা আর নূর হা হয়ে দেখছে আমায়রাকে। আমায়রা লজ্জা পেল ওদের এমন তাকানোতে। লজ্জা পাওয়াতে আমায়রাকে যেন আরো সুন্দর লাগছে। নূর হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো,
“বার্বি ডল আজকে তো তোমাকে বউ পুতুলের মতো লাগছে।”
রায়ান দরজার পাশ থেকে শুনে আর থাকতে না পেরে ঢুকে পরলো রুমে। আমায়রা দিকে তাকিয়ে থমকে গেল সে। সে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার বউকে যে এতো সুন্দর লাগবে সে কল্পনাও করেনি। নাইমা আর নেহা মিটমিট করে হেসে নূরকে নিয়ে সরে পড়লো আস্তে করে। ওরা যেতেই রায়ান খট করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আজ আমায়রার বেশ লজ্জা লাগছে। চোখ তুলেই তাকাতে পারছেনা সে। রায়ান দ্রুত পায়ে আমায়রার কাছে গিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমায়রা বিড়াল ছানার মতো রায়ানের বুকে মাথা গুজে রইলো। রায়ানের পারফিউমের তীব্র সুগন্ধ নাকে এসে বারি খাচ্ছে আমায়রার। রায়ান বিরবিরিয়ে বলতে লাগলো,
“ভালোবাসি বউ”
আমায়রা আলতো হেসে বলল,
“আমিও আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি যমরাজ।”
আমায়রার কথায় রায়ানও হেসে উঠলো।
রায়ান আমায়রাকে ছেড়ে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে আমায়রাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
“মাশাআল্লাহ এই তো রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরীর একমাত্র যমরানী আমায়রা ইশতিয়াক চৌধুরী।”
আমায়রা লজ্জা মিশ্রিত হেসে আড় চোখে তাকালো রায়ানের দিকে। হালকা বাদামি রঙে সেরোয়ানিতে বেশ সুদর্শন লাগছে রায়ানকে। আমায়রা একপলক তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
“আপনাকেও মাশাআল্লাহ অনেক সুদর্শন লাগছে।”
রায়ান মুচকি হেসে বুকে হাত রেখে বলল,
“বউ যখন বলেছে, তারমানে রায়ান আজ তোমাকে সত্যিই সুদর্শন লাগছে। কি যে করবো আমি খুশিতে পাগল পাগল লাগছে আমার।”
রায়ানের কথায় আমায়রা আবারো লাজুক হাসলো।
——————-
অনুভব বেশ নার্ভাস আজকের দিনটা নিয়ে সে কি পারবে মেয়েটা ভালো রাখতে। তখনি তার রুমে আজিজ সাহেব এসে বললেন,
“তুমি পারবে আমি জানি।”
অনুভব ঘুরে তাকালো। বাবার হাসি মুখ দেখে তার অস্থিরতা কিছুটা কমলো। আমেনা বেগম ওদের তাড়া দিয়ে গেল। আজিজ সাহেব ছেলেকে ঠিক করিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পরলো ওকে নিয়ে। রায়ানদের বাড়িতেই বিয়ে হবে।
————
রায়ান আমায়রাকে রেখে আবিরকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু আবিরকে বাড়ির ভিতরে না দেখে সোজা বাগানে চলে গেল সে। বাগানে আবিরকে অবাক হয়ে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা রোজার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুচকে এলো রায়ানের। রায়ান তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ে শুনতে লাগলো। রোজা আবিরের সামনে একটা লাল গোলাপ নিয়ে বলতে লাগলো,
“দেখুন আমি সোজাসাপ্টা মানুষ। মনে যা আসে তাই করে দিই । এতো ভাবনা চিন্তা করে নিজেকে ডিপ্রেশনে ফেলি না। আমি সোজা কথা বলতে চাই আমি আপনাকে ভালোবাসি। কেমনে ভালোবাসায় পরলাম? কিভাবে কি তা আমি জানিনা তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি। রাছি থাকলে বলেন না হয় বাবার কাছে নালিশ দিবো আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন।”
আবির অবাক এই মাইয়া কয় কি? প্রোপজ করছে না হুমকি দিচ্ছে আল্লাহ ভালো জানে।
তখন আবিরের ফোনে মেসেজ এলো। আবির মেসেজ দেখে আরো অবাক রায়ান মেসেজ করেছে।
“ওর কথায় সম্মতি দে হারাম*জাদা। এতো টাইম লাগে কেন। মাইয়া হয়ে তোরে প্রোপজ করে তাও তুই গাধার মতো তাকিয়ে থাকিস ছেহ..!”
আবির তাড়াতাড়ি রোজার হাত থেকে ফুল নিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি টাকলা স্যারের মাইয়া।”
রোজা ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“কিহ বললি তুই আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।”
বলেই দৌড়ানি দিলো আবিরকে। ওদের এই অবস্থা দেখে হাসতে লাগলো রায়ান।
—————–
সুরাইয়া বউ সেজে বাসর ঘরে বসে আছে। অবশেষে তাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। অনুভব ধীরপায়ে সুরাইয়ার পাশে বসে বলতে লাগলো,
“আজ থেকে তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার। আমি চেষ্টা রাখবো তোমাকে আমার সবটা দিয়ে ভালো রাখার। তুমি থাকবে তো আমার পাশে।”
সুরাইয়া মুচকি হেসে অনুভবের কাধে মাথা রেখে ধীর গলায় বলল,
“সারাজীবন আমি আপনার পাশে থাকবো ইনশাআল্লাহ। মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবেনা।”
অনুভব হাসলো সুরাইয়ার কথায়।
অন্যদিকে রায়ান আর আমায়রা বিয়ের সাজ নিয়েই বারান্দার দোলনায় বসে আছে। আমায়রা রায়ানের বুকে মাথা রেখে আছে আর রায়ান আমায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রায়ান বলে উঠলো,
“বউ”
আমায়রা ধীর গলায় চোখ বুজে রেখেই জবাব দিলো,
“হুম বলুন”
রায়ান অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“আমার মনে রানী হয়ে এভাবেই থেকে যেও আমার মনে অতল গহ্বরে। যেখানে খালি নিরবে তোমার নামই প্রতিধ্বনিত হয় বারবার।”
আমায়রা মুচকি হেসে বলল,
“আপনি যত্ন করে রেখে দিন না। আমি থেকে যাবো সারাজীবন আপনার মনের রানী হয়ে।”
রায়ান মুচকি হেসে আমায়রার কপালে দীর্ঘ এক চুমু খেল। আমায়রা চোখ বুজে তা অনুভব করলো।
পরিশেষে ভালো থাকুক ভালোবাসা।
#সমাপ্ত