অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-১৪+১৫

0
144

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৪

সময় বহমান। রাতের শেষে দিন আসে আলো নিয়ে। কাজল চৌধুরী ভীষণ খুশি। বিয়ের বাজার শুরু করে দেওয়ার আদেশ দিলেন তিনি। চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে। যেনতেন আয়োজনে হবে না। সবায়কে শত উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ দিয়ে তিনি নিজের ঘরে এলেন। বাবাকে বুঝাতে পারবে না আফজাল চৌধুরী জানতেন। তাই মাকে বুঝাতে চাইলেন। হাজার হোক মা তো। ছেলের সুখ বুঝবে না? মা ঘরে আসতেয় তিনিও মায়ের ঘরে গেলেন। মাকে অনেক কিছু বললেন। কাজ হলো না। শেষে মায়ের পা ধরলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলেন কাজল চৌধুরী। আফজাল চৌধুরী অসহায় হয়ে বললেন,
-তোমার মেয়েকে কেউ সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করলে সহ্য করতে পারতে মা? তাহনাও তো মেয়ে মা। ওরে নিজের মেয়ে ভেবে ওর স্বপ্ন ভেঙে দিও না।
কাজল চৌধুরী কঠোর স্বরে বললেন,
-ওমন মেয়ে আমি পেটে ধরিনি।
আফজাল চৌধুরী বিমূঢ়। আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। অথচ সেদিন তিনি কাঁদলেন। শেষ কান্না। এরপর আর কখনো কাঁদেনি।

তাহনাকে ফোনে জানানো হয়েছে বিয়ের কথা। ঢাকা থেকে ছুটে এসেছে মেয়েটা। দেখা হওয়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়লো তানহা। আফজাল চৌধুরী চুপ থাকলেন। কি বলবে বুঝতে পারলো না। তানহার সহ্য হলো না তার চুপ থাকা। চিৎকার করে বলল,
-কথা বলছো না কেন? বলো? আমার কি হবে? বলো? কেন এমন করলে?
আফজাল চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের পরিস্থিতি তানহাকে বুঝানো অসম্ভব। তাহনা কিছুটা শান্ত হলে আফজাল চৌধুরী বললেন,
-তাহনা আমার কিছু করার নেই। বাড়ি থেকে মানছে না কোনমতেয় কিন্তু..
আফজাল চৌধুরী থেমে গেলেন। তানহা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আফজাল ইতস্তত করলো। কিভাবে বলবে কথাটা? সম্পর্কের শুরুর দিকেয় তাহনা বলে দিয়েছিল তার দ্বারা এটা কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যে তাদের প্রতিকূলে। উপায় নেই এছাড়া। তাই সাহস করে বলে দিলেন,
-আর কোন উপায় নেই তানহা। একমাত্র উপায় পালিয়ে যাওয়া। তুমি রাজি থাকলে তাই হবে। আমি জানি তুমি আমাকে বলেছো তুমি কখনো পালাবে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আর কিছু বলার নেই আমার। এখন ডিসিশন তোমার তানহা। হয় আমার হাত ধরে বের হবে নাহয়…!
আর কথা বাড়ালেন না আফজাল চৌধুরী। থেমে গেলেন। তানহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তানহা বলে উঠলো,
-আ..মি পারবো না।
আফজাল চৌধুরী অসহায় চোখে তাকালেন প্রেয়সীর দিকে। তাহনা আর কিছু না বলে ছুটে চলে গেলো। আফজাল চৌধুরী চুপ করে বসে থাকলেন। কিই বা করার আছে আর তার?

পরেরদিন তাহনা সাহস করে কাজল চৌধুরীর কাছে এলেন। তাকে বললেন তাদের ভালোবাসার কথা। যে কঠোর কাজলের মন ছেলের কান্নায় নরম হয়নি পর মেয়ের কান্নায় তার কি আসে যায়? স্পষ্ট করে বলে দিলেন,
-আফজালের বিয়ে রাইমার সাথেয় হবে।
শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে খোটা দিলেন অনেক। আর সবশেষে! তার মায়ের চরিত্র নিয়েও কথা তুললো। শুধু তুলেয় থামলো না। তাকেও দেওয়া হলো চরিত্রহীন উপাধি। অপমানে চৌধুরী নিবাস থেকে বের হয়ে গেলো তাহনা।
মায়ের উপর অভিমান থাকলেও রাগ তার ছিল না। বাবা আদর করে মানুষ করেছে দুই ভাইবোনকে। অভিযোগ করার সুযোগ দেয়নি। তাই মাকে কখনো তাদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য অভিযোগ করেনি। কিন্তু আজ করলো। তার মা সংসার রেখে চলে গিয়েছে বলে সেও যাবে! এটা কেমন লজিক? তানহা কেঁদে কেঁদে বলল,
-তুমি কি নি ষ্ঠুর মা! কীভাবে দুটো পুতুল রেখে চলে গেলে? আজ তুমি থাকলে কেউ সাহস করতো এভাবে বলার? বলো মা! আমার চরিত্রে দাগ লাগতো না মা।

তাহনার পাগলামি বাড়লো। কিন্তু আফজাল চৌধুরীর চৌধুরী নিবাসের বাইরো পা দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা হলো। লোকমুখে শুনলো তাহনার অবস্থা ভালো নয়। মানসিক রোগীদের মতো ব্যবহার করছে। কিন্তু হায়! তার কিছু করার নেই। এরপরের গল্প গুলো সবার জানা তাই না? চৌধুরী বাড়িতে নতুন বউ আসবে আর মধ্যবিত্ত বাবার একমাত্র মেয়েটা নেতিয়ে যাবে কিংবা সামলে উঠবে।

অতীত ভাবনা থেকে বের হলেন আফজাল চৌধুরী। তার মাথায় প্রশ্ন এলো কুঞ্জ এসব কি করে জানে? তিনি তড়িৎ উঠে দাঁড়ালেন। ছুটে গেলেন দোতালায়। মেয়ের মাকে খুঁজতে। দেখলেন মেয়ের মা মেয়ের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। তিনি ডাকলেন,
-রাইমা!
রাইমা চৌধুরী পিছনে ফিরলেন না। ডাকের সাড়া দিলেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি রইলেন। আফজাল চৌধুরী দরাজ স্বরে বললেন,
-কুঞ্জ কি করে অতীতের সব জানে? তুমি বলেছো?
-নাহ।
-তাহলে?
রাইমা চৌধুরী রহস্যময় ভাবে হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন,
-আমি বলিনি কুঞ্জকে। কে বলেছে জানিনা কিংবা জানতে চাইনি। পৃথিবীর বুকে কত রহস্য। এটাও রহস্য থাকুক। মেয়ে কিভাবে এত তথ্য সংগ্রহ করেছে মেয়ে একায় জানুক।
আফজাল চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাইমার দিকে। মেয়েটা এভাবে কথা বলছে কেন? আগে কখনো বলেনি তো। আজ কি হলো? আশ্চর্য! সচারাচর প্রশ্ন করেন না তিনি। কিন্তু আজ করলেন,
-কি হয়েছে তোমার? এভাবে কথা বলছো কেন?
রাইমা খানিক চমকালেন। পরক্ষণেই হেসে বললেন,
-কার আমার? কি হবে? কিছু হয় নি।
-তাহলে এভাবে কথা বলছো কেন?
-কিভাবে বলছি?
-অদ্ভুত ভাবে।
রাইমা হাসলেন। মনেমনে কি জেন ভবালেন। তারপর বললেন,
-আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?
আফজাল চৌধুরী তাকালেন তার দিকে। রাইমা কখনো এভাবে আবদার করেনি। তিনও সুযোগ দেয়নি বোধহয়। মেয়েটার চোখ দুটো কেমন হাসছে। আলতোভাবে বললেন,
-করো।
রাইমা হাসলেন। এটা না পাওয়ার হাসি। জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনার কখনো মনে হয়েছিল আপনার ভালোবাসার মানুষটা এখন অনুক দূর?
-হয়েছিল।
-তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল আপনার?
আফজাল চৌধুরী হাসলেন। বললেন,
-ভয়ংকর কষ্ট।
রাইমাও হাসলো। তারপর আবার বললো,
-ধরুন আপনার ভালোবাসার মানুষটি অন্যায় করেছে। খুব বড় অন্যায়। আপনি ক্ষমা করতে পারছেন না। তখন কেমন লাগবে?
-একই উত্তর।
রাইমা চৌধুরী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। বাঁকা হেসে বললেন,
-ভয়ংকর কষ্টের জন্য প্রস্তুতি নেন তবে। আফজাল চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন,
-মানে কি?
রাইমা পুনরায় রহস্যময় ভাবে হাসলেন। বিরবির করে বললেন,
-আমার আর কোন আফসোস নেই জানেন। কষ্ট আমি একা পাবো না। আপনিও পাবেন। সেই সাথে পাবেন আর এক নরক যন্ত্রণা!

কুঞ্জ সবে চুলায় পানির হাড়িটি বসিয়েছে। এরই মাঝে তাহনা এসে পানির হাড়িটি ফেলে দিলো। কুঞ্জ শান্ত ভাবে তাকালো শাশুড়ির দিকে। কোন কথা বলল না। তানহা হিসহিসিয়ে বলল,
-আমার সাথে নাকি তোমার হিসাব বাকি। করো সে হিসাব। হিসাব নিকাশ না চুকিয়ে আমার রান্নাঘরে ঢুকেছো কোন সাহসে। তোমাকে আমি মানি না মেয়ে। আর না কখনো মানবো।
কুঞ্জ হাসলো। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য নেই। রাগ নেই, নেই উপহাস। মৃদুস্বরে বলল,
-কেন মানবেন না? আমার দাদি আপনাকে মানেনি বলে?
তানহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কুঞ্জের দিকে। কড়া কন্ঠে বলল,
-হ্যাঁ, তাই।
-তাহলে আপনার আর কাজল চৌধুরীর মাঝে পার্থক্য কোথায়?
তাহনা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। উপহাসের সুরে বলল,
-তোমাকে চরিত্রহীন বলিনি আমি। আর না তোমার মা তুলে কথা বলেছি।
কুঞ্জ হাসলো। বলল,
-মিথ্যা হয়ে গেলো না কথাটা?
তাহনা দরাজ স্বরে বলল,
-কি বলতে চাইছো তুমি।
এবার তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেলো কুঞ্জের ঠোঁটে। বলল,
-হাসপাতালে আমায় কি কি বলেছে আপনি জানেন। ওটাকে বোধহয় চরিত্রে ফুল দেওয়া বলে। আর আমার মা নিয়ে কথা বলতে আপনি পারবেন না। তাই বলেননি। পারলে ঠিকি বলতেন। বাবা নিয়ে কিন্তু বলেছেন।
হাসি বিস্তৃত হলো কুঞ্জের মুখে। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
-আমার শরীরে বেইমানের রক্ত বয়। বলেননি? তাহলে বলুন আমার দাদির আর আপনার মাঝে পার্থক্য কোথায়?
তাহনা ক্ষেপে গেলেন। বললেন,
-তোর শরীরে বেইমানের রক্ত বয় বলেয় বলেছি।
কুঞ্জের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
-আপনার মা তুলে কথাটা বলে তাহলে দাদি ভুল করেনি তো। আমার শরীরে বইলে আপনার শরীরেও তো বয় নাকি? তাহলে দাদি ভুল বলেছে কখন?
কুঞ্জ থামলো। দম নিয়ে বলল,
-আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আব্বু আপনার মতো একজনকে ভালোবাসে। ছিহ!
তাহনার রাগ আকাশ ছুঁলো। ঠাস করে থা প্পড় পড়লো কুঞ্জের গালে। মায়ের থেকে পাওয়া অপরূপ চেহারাখানা লাল রঙ ধারণ করলো। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ফর্সা গালটায় এঁকে দিয়েছে কেউ লাল আলপনা!

#চলবে…?

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৫

এভাবে থা প্পর দেওয়ার পরও শান্ত থাকলো কুঞ্জ। কুঞ্জের চেহারার লাল আভা শান্ত চোখ দেখে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হলো মিসেস তানহার। তবে অনুভূতিটি কিসের বুঝতে পারলো না। কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে আবার জমে থাকা রাগ বাড়তে চাইলো। একদিন গ্রামে দেখেছিল চৌধুরী বাড়ির বড় বউকে। ভীষণ সুন্দর। কুঞ্জ যেন তার প্রতিরূপ। না না প্রতিরূপ বললে ভুল হবে। রাইমার থেকেও বেশি রূপবতী কুঞ্জ। মেয়েটার দিকে একবার ভালো করে তাকালো তানহা। ফুটফুটে চেহারা। গালে লাল ছোপ ছোপ দাগ। চোখে দুটো খুব বড় নয় আবার ছোটও নয়। মাঝারি আকারের চোখ জোড়ায় ঘন পাপড়ি। নয়নযুগল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া চুল গুলো বেনি করে রাখা। তানহার দৃষ্টি পরখ করে কুঞ্জ শীতল স্বরে বলল,
-আপনি আমার ফুপিদের চিনেন?
তানহা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এই সময়ে এটা কেমন প্রশ্ন। তিনি থতমত খেয়ে গেলেন। কিছু বালার পূর্বে কুঞ্জ বলল,
-চেনার কথা। আমার ফুপিরা ভীষণ নরম। প্রতিবাদ করার সাহস তাদের নেই। নিরিহ প্রকৃতির। আমার দাদার বোনরাও ছিল তেমন। আপনার চেনার কথা সবাইকে।
তাহনা এবারও চুপ থাকলো। কুঞ্জ হেসে বলল,
-আমার বড় ফুপি আপনার জন্য কান্না করেছিল তাই না? দাদি আপনাকে মানছিল না বলে।
তাহনা চোখ বড় বড় করে তাকালেন কুঞ্জের দিকে। কুঞ্জ হাসলো। বলে উঠলো,
-চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা বড় হয় কড়া নিয়মে। বাড়ির পুরুষদের কথা শুনে। তারা নরম প্রকৃতির হয়। আমার ছোট বোন আছে একটা। কুহুও তেমন। আমার দাদিকে আবার এরমাঝে গণ্য করে তাচ্ছিল্য করবেন না। দাদি কিন্তু চৌধুরী বাড়ির মেয়ে নয়। বরং বউ। যাইহোক সবার মাঝে ভিন্ন শুধু আমি। চুপ থাকা, মেনে নেওয়া স্বাভাবে নেই আমার। নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা আমি রাখি। আপনি আমার বড় এবং শাশুড়ি বলে কিছু বলছি না তাই বলে আমাকে দুর্বল ভাববেন না। নেক্সট টাইম আমি ভুলে যাব আপনি কে!
কুঞ্জের হিম শীতল কণ্ঠ শুনে মিসেস তাহনা কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলেন। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন। হিসহিসিয়ে বললেন,
-তুমি, তুমি কিভাবে সব জানো? বলো। কে বলেছে তোমাকে এসব?
কুঞ্জ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পাতিলে পুনরায় পানি নিয়ে চুলায় বসালো। রহস্য করে বললো,
-গল্প শুনবেন? চলুন আপনাকে গল্প শোনায়।

পেঁয়াজ, মরিচ কাটতে বসলো কুঞ্জ। একপলক তাকালো তানহার দিকে। শুরু করলো,

মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন পর অর্কের সাথে পরিচয় হয়। প্রথম দেখা রেস্টুরেন্টে। অর্কের এক বন্ধুর সাথে আমার বান্ধবী রিন্তির প্রেম। অর্ককে সেদিন ওর বন্ধু নিয়ে গিয়েছিল রেস্টুরেন্টে। তেমনি আমাকেও আমার বান্ধবী নিয়ে যায়। ওদের দুজনকে স্পেস দেওয়ার জন্য আমরা দুজন উঠে যাই। প্রথম থেকেয় অর্ক অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। পরে রাস্তায় যাওয়ার পর কথা হয়। সেদিন অর্ক হুট করে জিজ্ঞেস করেছিল,
-তোমার বাড়ি টাঙ্গাইলের সখিপুরে না?
কুঞ্জ অবাক হয়ে বলল,
-আপনি কিভাবে জানেন?
-দেখেছিলাম। চৌধুরী বাড়ির ছেলেদের সাথে।
কুঞ্জ ফিক করে হেসে বলল,
-আমিও ও বাড়ির মেয়ে
-নুহাস, পূর্বের বোন?
-হ্যাঁ। ভ্রূ বাঁকিয়ে চানতে চায়,
– আপনি ওদেরও চিনেন?
-আমার নানুবাসা তোমাদের ওদিকে। ওখানে দেখেছিলাম । তোমার ভাইদের তো এলাকার ছেলেপেলে ভয় পায়। তাই চিনি আরকি।
কুঞ্জ চোখ ছোট করে বুঝতে চাইলো অর্ক কি বুঝাতে চাইছে। এরপর কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে বলল,
-আমার ভাইরা এমনি এমনি কাউকে কিছু করে না।
অর্ক হেসে ফেললো কুঞ্জের রিয়াকশন দেখে। হাসতে হাসতে বলল,
-ওমা আমি কখন বললাম তোমার ভাইরা এমনি এমনি মারপিট করে।
-আপনার কথার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তাই মনে করেন।
-যদি করি কি করবে?
কুঞ্জ শান্ত স্বরে বলল,
-আপনি কি মনে করবেন না করবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কেন কিছু করবো। আমি শুধু এতটুকুই বলবো আমার ভাইরা যথেষ্ট ভদ্র। কোন কারণ ছাড়া কাউকে হেনস্তা করার মতো ছেলে আমার ভাইরা নয়।
কুঞ্জ থামলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। পুনরায় বলল,
-আমার ভাইদের নিয়ে আপনার যেমন মনোভাব থাকুক না কেন আমাকে বলতে আসবেন না। আমার ভাইদের বিরুদ্ধে একটা খারাপ কথা বললে আপনাকে দেখে নিব আমি।
পরক্ষণেই বাঁকা হেসে বলল,
-আমাকে আমার ভাইদের থেকে কম ভাববেন না৷ আমার ভাইদের সাথে আমিও কারাতে শিখেছি।
আর কিছু না বলে কুঞ্জ হাঁটা শুরু করে। বান্ধবীকে কল করে বলে দেয় সে চলে যাচ্ছে। রাগ হয় কুঞ্জের। কত বড় সাহস তার ভাইদের গুন্ডার সাথে তুলনা করে!

অপরদিকে অর্ক মুচকি হাসে। আপনমনে বলে,
-আপনার মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি বহু আগে কুঞ্জলতা। আপনাকে আমার চাই। এতদিন হাজার বায়না ধরে নানুবাসায় যেতে হতো আপনাকে একপালক দেখার জন্য। এখন শুধু পলাশী থেকে শাহবাগে আসতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে আমার করে নিব দেখে নিয়েন।

এরপর থেকে প্রায় দেখা হতো অর্ক আর কুঞ্জের। প্রথম প্রথম কো-ইনসিডেন্স ভাবলেও পরে কুঞ্জ বুঝে যায় যে এসব অর্কের পরিকল্পনা। অর্ক ইচ্ছে করেয় আসে শাহবাগে। এরপর একদিন তার বান্ধবীকে ম্যানেজ করে নিয়ে যায় রমনা বটমূলে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। কুঞ্জ, তিশা, সোহানা, সাবিহা, রিন্তি, রিহান, আকাশ, মিহাদ সবায় মিলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। রিন্তি অনেক জোড়াজুড়ি করে বলে তারা রমনা বটমূলে যাবে। তাই ঠিক হয়। মেয়েরা সবাই লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে সাথে লাল ব্লাউজ। আর ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে; পাঞ্জাবির মাঝে লাল সুতার কাজ। রিন্তি অর্ককে ড্রেসকোড জানিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী অর্ক সাদা পাঞ্জাবি পড়ে আসে রমনা বটমূলে।

রোববার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব। আর এ উৎসব উদযাপনে বরাবরের মতো এবারও সেজেছে রমনার বটমূল। বৈশাখী উৎসবকে বর্ণিল করে তুলতে আয়োজকরা আয়োজন করেছে প্রতিবারের ন্যায় গান নাচের আসর। রমনা বটমূলে রিকশা করে পৌঁছায় আটজনের দলটি। ভিতর থেকে ভেসে আসছে গানের সুরেলা সুর,

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।’

অস্তাচল গেইট দিয়ে রমনা বটমূলে প্রবেশ করে ওরা। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর রিন্তি বলে উঠে মেলার শেষ দিকে যেতে। অবাক হয় ওরা। ওদিকে কেন যাব? অনেক কষ্টে, ভুলভাল বুঝিয়ে রিন্তি ওদের নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে অর্ককে দেখতে পায় ওরা। অর্কে কুঞ্জের অপেক্ষায় ছিল। কুঞ্জ আসতেই ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বেলি ফুলের মালা ও কাঠগোলাপের গুচ্ছ এগিয়ে দেয়। মুখে বলে,
‘শীতের সকালে কুয়াশার আবরণ ভেদ করে এক লাল রাঙা চাদর পরিহিতা এক মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। রৌদ্রস্নাত এক দুপুরে তেজস্বী এক নারীর প্রতিবাদী রূপ দেখে মায়ায় জড়ালাম। এরপর এক সোনারাঙা বিকেলে সেই রমণীর প্রেমে পড়লাম। সেই স্নিগ্ধ মেয়েটি তুমি। তুমি আমার মনের রাণী হবে? আমার মনোরাজ্য নিজের আধিপত্য গড়ে নিবে?’
অর্ক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় কুঞ্জের দিকে। কুঞ্জের বন্ধুরাও তাকিয়ে আছে তার উত্তরের আশায়। কুঞ্জ মৃদু
হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
-সব বুঝলাম কিন্তু আমি প্রেমে আগ্রহী নই এবং আপনার প্রতি আমার কোন অনুভূতিও নেই। সো আ’ম সরি।
আর কিছু না বলে কুঞ্জ সরে আসে সেখান থেকে। বাকিরাও ছোটে কুঞ্জের পিছন পিছন। শ্যামলিকা গেট দিয়ে রমনা বটমূল থেকে বের হয়ে যায় কুঞ্জ ও তার বন্ধুরা। অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অর্কের বন্ধুরা ওকে সান্ত্বনা দেয়। অর্ক বিরবির করে বলে,
-ধূর শা লা প্রথমবার প্রপোজ করলাম তাতেয় রিজেক্ট! কি পোড়া কপাল!

এরপর প্রায় প্রতিদিন শাহবাগের মোড়ে দেখা যেতে লাগলো অর্ককে। কুঞ্জের টিউশনের টাইম জেনে দিয়েছিল রিন্তির কাছ থেকে। সেই সময় দাঁড়িয়ে থাকতো। কথা বলতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কুঞ্জ ইগনোর করতো। একদিন রেগে গিয়ে কুঞ্জের হাত ধরে অর্ক। সাথে সাথে গর্জে উঠে কুঞ্জ,
-আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
সেদিনও অর্ককে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় কুঞ্জ। বেশ কয়েকবার সরি বলে। কিন্তু কুঞ্জের মন গলে না। এরপর একদিন……

#চলবে…?