অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৩

0
189

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাত বাড়ছে। চারদিকে সুনশান নিরবতা। আকাশে কাস্তের মতো বাঁকানো এক ফালি চাঁদ। আঁধারে ঢকা কাজলদিঘীর পাড়। চাঁদের ঈষৎ আলোয় বাগানের গাছ গুলো ছায়া দেখে মনে হয় অতিপ্রাকৃত বস্তু। মৃদু বাতাসে গাছের ডালপালার মর্মর শব্দ বুকে কাঁপন ধরায়। ভয় হয়। আফজাল চৌধুরী বারান্দায় বসে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন আলো আঁধারে ঘেরা বাইরের থমথমে পরিবেশের দিকে। দৃষ্টিতে তার উদাসীনতা। গভীর ভাবনায় নিমিত্ত তার মন। মেয়েকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে আরো কতশত ভাবনা বিচরণ করলো তার মনে। মানসপটে ভেসে উঠলো হাজারো সুখস্মৃতি। হারিয়ে গেলেন তিনি বহু বছর আগ ঘটা ঘটনা গুলোর ভাজে। ভাবতে ভাবতে সময় গড়ালো। ঘড়ি বেজে উঠলো ঢং ঢং করে। তিনি চমকে বাস্তবে ফিরলেন। ক’টা বাজে দেখলেন না। তবে রাতের গভীরতাকে আন্দাজ করে ভেবে নিলেন দশটা বাজে। বারান্দা থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিলেন। অতঃপর ঘর ছেড়ে বের হলেন ড্রাইনিং রুমের উদ্দেশ্য।

চৌধুরী নিবাসের কঠোর নিয়ম ঠিক রাত দশটায় সকলকে খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকতে হবে। যত গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাক না কেন রাতের খাবার একসাথে খেতে হবে। এই নিয়মের হেরফের খুব একটা হয় না। আফজাল চৌধুরী খাবার টেবিলে বসে সূক্ষ্ম চোখে লক্ষ্য করছেন সবকিছু। তার দুই ভাই বসে আছে। বাড়ির তিন বধূ টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। সামনের চেয়ার গুলো ফাঁকা। একটা বাচ্চাও খাবার খেতে নামছে নাহ! আফজাল চৌধুরী আনমনে হাসলেন। চৌধুরী নিবাসের নিয়ম কানুন সাধারণত তার ভয়ে মানে সবাই। তার ছোট দুই ভাই এখনো তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। খুব ছোটবেলা থেকে তার কড়া শাসনে বড় হওয়ায় এখনো ভয় পায়। এই ভয় তার বধ্য করে রাখে ভাইদের। চৌধুরী বংশের পরবর্তী প্রজন্মের বড় সন্তান তার মেয়ে; কুঞ্জারি চৌধুরী। মেয়েটা বাবার সব গুণ আয়ত্ত করে ফেলেছে। তবে বাবার মতো করে নয়। অন্যভাবে! ছোট ভাই-বোন গুলো তার বাধ্য। তবে ভয় দিয়ে নয় ভালোবাসা দিয়ে ভাই-বোনদের মন জয় করে নিয়েছে কুঞ্জ। তার ভাই-বোন গুলো তার সামনে খোলা বইয়ের মতো। কুঞ্জ চাইলেই পড়তে পারে ওদের মনের কথা।

‘ভালোবাসা’ শব্দটা আপেক্ষিক। একে বর্ণনা করার নিদিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। মানুষ তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ভালোবাসার সংজ্ঞা দেয়। যাকে তুমি আগলে রাখো, যার কষ্টতে তোমার শ্বাস আটকে আসে তাকে তুমি ভালোবাসো আবার তোমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষটার সুখের জন্য তুমি দু’হাত তুলে দোয়া করো; এর নামও ভালোবাসা। ভালোবাসার কোনো সমীকরণ হয় না। ভালোবাসা কিছু বিক্ষিপ্ত অনুভূতির নাম যা তুমি অনুভব করবে হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা মানুষকে বাধ্য বানায়। তুমি যাকে ভালোবাসো তার যেকোনো কথা তোমার শুনতে ইচ্ছে হয়। ঠিক তেমনি নুহাস,পূর্ব, কুহু তিনজনই বড় বোনের কথা মতো চলে। তাদের এই আনুগত্যে ভয় নেই বরং মিশে আছে ভালোবাসা।

আফজাল চৌধুরী ধরে নিলেন বড় বোনের কথা মান্য করে খাবার টেবিলে তারা আসেনি। তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। একই সুরে প্রশ্ন করলেন,
-ছেলেমেয়েরা কোথায়? খেতে আসেনি কেনো?
নওরীন সবার সামনে প্লেট এগিয়ে দিচ্ছিলো। আলতো স্বরে বললেন,
-ওরা সবায় খেয়ে নিয়েছে ভাইজান। আপনি খান।
-আজকে এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে গেলো সবার?
পাপিয়া হেসে বলল,
-ওরা তো দশটায় টেবিলে এসেছিল ভাইজান। আপনি আজকে আসলেন না। তাই খেয়ে চলে গেলো।
আফজাল চৌধুরী অবাক হলেন। দশটায় টেবিলে এসেছিলো মানে? ক’টা বাজে এখন। দ্রুত দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলেন এগারোটা পার হয়ে গেছে আরো বারো মিনিট আগে। তিনি আশ্চর্য বোধ করলেন। এতো সময় নিয়ে ভাবনায় মশগুল ছিলেন! আনমনে হেসে ভাবলেন তার তৈরি করা নিয়ম তিনি নিজেই ভেঙেছেনআজ। খাবার টেবিলে পিয়া মাছ ভাজার বাটিটা রেখে রাইমা বললেন,
-ছোট, মেঝো তোরাও বস। খেয়ে নে।
-তুমিও বসো বড় আপা।
পাপিয়া বলে উঠলেন। রাইমা ঝায়েদের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। সেই হাসির আর্থ সব মায়ের জানা। রাইমার হাসি পাপিয়া ও নওরীনের কানেকানে বলে গেলো,
-আমার মেয়েটা এখনো খায়নি রে। আমি কি করে খাই?

সবে সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আঁধার কেটে যাচ্ছে ধরনী থেকে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত পরিবেশ। হাসনাহেনা, বেলি সহ বেশ কিছু ফুলের ঘ্রাণ এসে প্রবেশ করছে নাসারন্ধ্রে। কুঞ্জ বারান্দা থেকে ঘরে আসলো। ব্যাগ গোছানো হয়নি এখনো। কি নিবে আর কি নিবেনা বুঝতে পারছে না। প্রথমত আম্মু গুছিয়ে দেয় সব সময়। এবার আম্মুকে এখনো বলায় হয়নি আজকে চলে যাবে সে। দ্বিতীয়ত খুব সম্ভবত এবার গিয়ে দুই থেকে তিন দিন হলে থাকবে। তারপর চলে যাবে নতুন ঠিকানায়। সেখানে থাকতে কি নিতে হবে তা নিয়েও তার আছে বিস্তর বিভ্রান্তি। আপন মনে ভাবলো কতক্ষণ। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলো না। একবার ভাবলো মানুষটাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললেই হয়। ফোন হাতেও নিল কল কারার জন্য। কিন্তু সময় দেখে থেমে গেলো। এত সকালে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করার কোনে মানে হয় না। আবার নিজের মনে ভাবতে বসলো।

আফজাল চৌধুরীর পুরনো অভ্যাস ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করেন। সাকালের চাও পান করেন বাগানে বসে। চৌধুরী নিবাসের ফুল বাগানের পাশেই তৈরি করা হয়েছে বসার জায়গা। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি চারটি চেয়ার এবং মাঝে একটা গোল টেবিল। প্রতিদিনের মতো আজও নামাজ শেষে তিনি বাগানে হাঁটাহাঁটি করলেন। তারপর একটি চেয়ার বসলেন। কিছু সময় বসে থাকার পর তার বুকে ব্যাথ শুরু হলো। নাহ! শারীরিক কোনো অসুখের ব্যাথা নয়। মনের ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তিনি চোখ তুলে তাকালেন মেয়ের বারান্দার দিকে। মেয়েকে দেখা গেলো না। মেয়ে কি আজ ঘুম থেকে উঠেনি? সেটা তো হওয়ার কথা নয়। খুব ছোটবেলা থেকে কুঞ্জারির ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে নিয়েছে। সকালে বাবার সাথে বাগানে বসে চা খাওয়াও তার অভ্যাস। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এই অভ্যাস তাকে বদলাতে হয়েছে ঠিকই। তবে বাড়ি আসলে সে ফিরে যায় পুরনো স্বভাবে। মেয়ে বারান্দা থেকে চোখ সড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আফজাল চৌধুরী। তখনই চা দিয়ে গেলো পাপিয়া। এলো না কুঞ্জারি। মেয়ের প্রতি জমা হলো এক দাম্ভিক বাবার ছেলেমানুষী অভিমান!

বারান্দা ছাড়াও ঘরের বা পাশের জানালা দিয়েও দেখা যায় বাগানে অর্ধেক অংশ। সেই অংশে পরে বসার জায়গাটাও। বারান্দায় না এসে জানালা দিয়ে বাবাকে দেখলো কুঞ্জ। অভিমান তারও হয়েছিল। বাবা তাকে ভুলে গেলো? বাবা তার বারান্দায় তাকাতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো কুঞ্জারির। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে শুধু বলল, ‘আ’ম সরি আব্বু। ভেরি সরি।’ ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকালো কুঞ্জ। জানালার পাশে বসে পড়লো। রুদ্ধ স্বরে বলল,
-আ’ম হেল্পলেস আব্বু। একই ভুল বারবার করা সাজে না। ভুলের মাশুল কাউকে না কাউকে দিতে তো হতোয় বলো। আমিই নাহয় দিলাম সে মাশুল। তবুও কারো অনুভূতিতে আঘাত না লাগুক।
কিছু সময় চুপ করে থাকলো। তারপর আলতো হেসে বলল,
-আপনি বরাবরই স্বার্থপর আব্বু। সেইকালে দেখেছিলেন নিজের পরিবারের স্বার্থ। এবার দেখছেন আদরের মেয়ের স্বার্থ! এতো স্বার্থপর হলে হয় আব্বু?
চোখ মুছে ফললো কুঞ্জারি। এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। অনেক অনেক কাজ বাকি। অনেক মানুষের ভুল ভাঙা বাকি। বাস্তবতা চেনানো বাকি। এতো সহজে হেরে যাওয়ার পাত্রী কুঞ্জারি চৌধুরী নয়। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-সব ভুল ভ্রান্তির শেষ আমি করবোই আব্বু। কষ্ট আমার যতই হোক। শুরু টা যেহেতু তুমি করলে শেষটা তো আমাকেই করতে হয়। তোমরা করা দোষের শাস্তি অন্য কাউকে কিভাবে দেই? যার দোষ বলতে শুধু একটায়; ভুল বসত তোমার মেয়েকে ভালোবাসা!

এলোমেলো হাতে লাগেজ গুছিয়ে নিলো কুঞ্জ। কিছুক্ষণ বাদে ঘরিতে দশটা বাজবে। এগারোটার দিকে সখিপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য সৌদিয়া বাস রওয়ানা দেয়। লাগেজসহ নিচে নামতেই রইমা ছুটে এলেন। করুণ স্বরে বললেন,
-লাগেজ নিয়ে বের হয়েছো কেন? কোথায় যাচ্ছ?
তার কন্ঠে স্পষ্ট আতঙ্ক। কালকের পর থেকে ভয়ে ভয়ে আছেন তিনি। কখন না স্বামী বিয়ের কথা আগায় আর মেয়ে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যায়। মেয়েকে লাগেজ হাতে বের হতে দেখেই তার মন অশান্ত হয়ে গেলো। কুঞ্জ মা’কে কিছু বলবে তার আগেয় তিনি এগিয়ে গেলেন সোফায় বসে পেপার পড়তে থাকা স্বামীর সমনে। অসহায় আর রাগের মিশ্রিত স্বরে বললেন,
-আপনি না দাবি করেন মেয়েকে সবথেকে বেশি ভালোবাসেন আপনি। এই তার নমুনা? মেয়েটা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে শান্তি পাবেন?
মেয়েকে লাগেজ হাতে নিয়ে নামতে দেখেও ভরকে যাননি আফজাল চৌধুরী। প্রথম কারণ তিনি জানতেন মেয়ে আজকে হলে ফিরবে। পরের সপ্তাহ থেকে তার পরীক্ষা শুরু। দ্বিতীয় কারণ তিনি বিয়ের কথা কালকের পর আর তুলননি। তাই রাগ করে মেয়ের বাড়ি ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তিনি স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকালেন। উত্তর দিলেন না। উত্তর কুঞ্জারি দিয়ে দিলো,
-তেমন কিছু নয় আম্মু। আমার পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে। তাই ফিরে যাচ্ছি। চিন্তা করো না।
রাইমা চৌধুরী আশ্বস্ত হলেন। মেয়ে তার মিথ্যা বলে না।

বড় বোনের সাথে প্রতিবার যায় নুহাস আর পূর্ব। বোনকে বের হতে দেখেয় গাড়ি বের করতে ছুটলো নুহাস।
-গাড়ি বের করো না নুহাস। আমি বাসে যাব।
বোনের শীতল স্বরে থমকে দাঁড়ালো নুহাস। মুখফুটে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আফজাল চৌধুরী বা অন্য কেউ জোর করলো না গাড়িতে যাওয়ার জন্য। পূর্ব বলে উঠলো,
-তোমায় সখিপুর অবধি রেখে আসি বড় আপা। আমি বাইক বের করছি। তুমি আসো।
কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেলো পূর্ব। কুঞ্জারির লাগেজ নিয়ে হাঁটা দিলে নুহাস। সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালো কুঞ্জ। মৃদুস্বরে বলল,
-আসছি। দোয়া করবেন।
কথা বললো না আফজাল চৌধুরী। মুখ তুলে তাকালেন না। অভিমান তাকে ঘিরে রাখলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চৌধুরী নিবাস থেকে বের হলো কুঞ্জারি।

বাড়ি থেকে বের হয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে কাজলদিঘীর পাড়ে আসলো কুঞ্জ। সিঁড়িতে বসে পা ডোবালো পানিতে। কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো স্বচ্ছ জলে। ছলছল করে উঠলো দুই নয়ন। দাদির ভালোবাসা তার অন্য ভাইবোনেরা না পেলেও সে পেয়েছে। দাদি তাকে ভালোবাসতো খুব। নিজের পছন্দের ফুলের নামটাও দিয়েছে তাকে। কুঞ্জ ফিসফিস করে উঠলো,
-ছোটবেলায় তোমার আদর আমায় ফিসফিস করে বলতো পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল নারী তুমি যে নি*ষ্ঠুরতা জানে না। অথচ হঠাৎ আমি এক গল্প থেকে জানলাম মায়াবী তুমিটাও নাকি নি*ষ্ঠুর। মা হিসেবে তুমি হলে পা*ষাণ। তোমার নি*ষ্ঠুরতা একজনকে উদভ্রান্ত করলো, অন্যজনকে করলো কঠোর। আর একজন বিনাদোষে পেলো প্রেমহীন সংসার। তুমি এতো নি*ষ্ঠুর না হলেও পারতে দাদি। তাহলে আমার গল্পটা অন্যরকম হতো।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো কুঞ্জারি। পুনর্জন্মে তার বিশ্বাস নেই। মৃত্যুর পর আত্মা পৃথিবীতে ঘোরাফেরা করে এটাও বিশ্বার করে না সে। তবুও কল্পনা করলো দাদি যদি এখন তার কথা গুলো শুনতো কেমন রিয়েক্ট করতো? অনুশোচনা করতো? কান্না করে তাকে বলত, তোমার নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল কুঞ্জ। নিজেকে অন্যের ভুলের শাস্তি দিও না। আনমনে হাসলে কুঞ্জ!

#চলবে…?