#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
১৯)
শর্মিলি আহমেদ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছেন। মানুষের মনের উপর কোনো জোর চলে না। কোনো ভয়,ভীতি দেখিয়েও মনকে ফেরেনো যায় না। যতক্ষণ না একজন মানুষের নিজের বিবেক, বুদ্ধি আর বিবেচনা দিয়ে বুঝতে না পারে কোনটা অন্যায় আর কোনটা ন্যায়।
তিনি রীমাকে কথা দিয়েছেন সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কিভাবে?
তিনি কি পেরেছেন শাওনের বাবা আলতাফ আহমেদকে পাপ কর্ম থেকে ফিরাতে! পারেননি তো! ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন বাসন্তির কাছ থেকে কিন্তু অন্য নারী লোভ থেকে তো ফিরেতে পারেননি।
মৃত্যুর পূর্বেও তো লোকটা ঠিকই নারী মাংসের লোভী ছিলেন।
শাওনের শরীরে যদি ওর বাবা আলতাফ আহমেদের রক্ত থাকে, তাহলে মা শর্মিলি আহমেদের রক্তও তো থাকার কথা। শর্মিলি আহমেদ আজ পর্যন্ত নীতি বিবর্জিত কোনো কাজ করেননি। তাঁর আত্মবিশ্বাস তিনি নিজের ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
শর্মিলি আহমেদ সীমাকে অপমান করবেন, অসম্মান করবেন, অপদস্ত করবেন। কখন? যদি তাঁর ছেলে ফিরে আসতে চায়।
শাওন বিবেকার তাড়নায় হলেও তখনই ফিরে আসতে চাইবে, যখন দেখবে রীমা আসলেই নিষ্পাপ একটা মেয়ে। তাকে ঠকানো ঠিক হবে না। তাই তিনি জেনে হোক বা না জেনে হোক রীমাকে শাওনের সাথে স্বাভাবিক আচরন করতে বলেছেন।
শর্মিলি আহমেদের সাথে তাঁর সন্তানদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ছেলেরা খুব অনায়াসে নিজের মনের কথা মায়ের কাছে খুলে বলতে পারে। স্বামীকে হারিয়ে তিনি ছেলেদেরকে আঁকড়ে ছিলেন আজীবন। ছেলেরাও মায়ের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে।
এবার ঢাকা আসার পর থেকে নানান অজুহাত দেখিয়ে শাওন তার মায়ের থেকে দূরে দূরে আছে। শর্মিলি আহমেদও ছেলেকে একটু সময় দিয়েছেন। নিজের বিবেক দিয়ে যেন সে ঠিক ভুল বুঝতে পারে।
সুরাইয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার একটা উদ্দেশ্য শর্মিলি আহমেদের আছে। তিনি শাওনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন। একটা পাপের রেশ কত বছর টানতে হয়। সুরাইয়া তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আজ অফিস থেকে শাওন ফিরতেই মা এসে হাসি মুখে পাশে দাঁড়ালেন। উদ্দেশ্য সবার অলক্ষ্যে ছেলের সাথে একটু সময় কাটাবেন।
” এত দেরি হইলো যে বাবা? ভাবছি তোমারে নিয়ে একটু বের হবো। সুরাইয়ার জন্য কিছু নতুন কাপড় লাগব। রীমা ব্যস্ত। রুপাইটার জ্বর এসেছে।”
” চলো মা। তুমি রেডি অই নাও। আমরা চা বাইরেই খাব।”
পাঁচ মিনিটের মধ্যে শর্মিলি আহমেদ রেডি হয়ে এলেন।
তিনি ঢাকার রাস্তায় বের হওয়া পছন্দ করেন না। এত যানযট তাঁর পছন্দ না। আজও বের হতেন না। সুরাইয়ার জন্য তেমন কাপড়ের প্রয়োজনও নেই। তিনি শুধু একান্তে শাওনের সাথে কথা বলে জানতে চাইবেন, শাওন আসলে কি চায়! সে যদি সত্যি সীমার ছলনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে তাহলে চেষ্টা করে, সিনক্রিয়েট করে জল ঘোলা ছাড়া আর কিছুই হবে না।
বরং সম্পর্কের মাঝে কেবল তিক্ততাই বাড়বে। আর যদি স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসতে চায়, তবে সীমাকে সাইজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
শাওন মাকে নিয়ে এলো বাসার পাশে একটা রেস্টুরেন্টে। অনেক বছর পর এভাবে একা একা মায়ের সাথে বের হয়েছে। শাওনের বেশ ভালো লাগছে। সে কিশোরবেলা যেন ফিরে এসেছে। একটা সময় শাওন পরীক্ষা দিতে গেলে মা সাথে করে নিয়ে যেতেন। পরীক্ষা শেষ হলে মা ছেলে কোনো একটা হোটেলে বসে খেয়ে নিতেন।
এর পর আর মায়ের সাথে একা কোথাও বসে খাওয়া হয়নি। হয় মা যেতে চাইতেন না। না হয় গেলেও খেতে চাইতেন না।
শাওন মায়ের মুখোমুখি বসে জানতে চাইল,
” কী খাইবা মা?”
” একটা বড় রসগোল্লা আর এককাপ চা খাব।”
” আর কিছু না?”
” তোর মনে আছে, রসগোল্লা তোর ছোটবেলায় কত পছন্দের আছিল।”
” ছোটবেলা বলছ কেন মা? আমি এখনো সুযোগ পেলে রসগোল্লা খাই।”
” তাহলে আইজ মা ছেলে রসগোল্লা খেতে খেতে গল্প করব।”
” মা আমি জানি তুমি আমারে কিছু বলবার জন্য এখানে ডাকি আনছ!”
” আব্বারে! আমার চাইর সন্তানের মইধ্য তুমি আমার সবচাইতে প্রিয়। তোমারে মানুষ কইরতে আমার অনেক কষ্ট কইরতে অইছে। তোমার জন্মের পর কেউ কয় নাই আমি বাঁচমু। আমার মন বলছিল, এমন লক্ষ্মী পোলারে ছাইড়া আমি মরতেই পারি না।”
” এভাবে বলিও না মা। নিজের অপরাধী লাগে। তুমি আরও শত বছর বাঁচবা মা। তোমার নাতী রুপাইর বিয়া খাইতে অইব না তোমারে।”
” আব্বারে! আমি তোমার চাইতে রীমারে কোনো অংশে কম পছন্দ করি না। কেন এত পছন্দ করি জানো?”
” জানি!”
” না, জানো না। রীমা খুব সরল মাইয়্যা। আজকালকার যুগে এমন সরল মাইয়্যা তুমি কোথাও খুঁইজা পাইবা না। এমন মাইয়্যারে ভালো না বেসে পারা যায় না।”
” মা রীমাকে আমিও ভালোবাসি।”
” জানি বাবা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাই হইছে ভালোবাসার। এখানে কোনো ফাঁক থাকলে,দুজনকেই সমান কষ্ট পাইতে অয়। সবচেয়ে বড় কতা অইছে, সন্তানের মাকে শুধু ভালোবাসলেই অয় না। তারে সম্মান করতে অয়। শ্রদ্ধা করতে অয়। সবসময় পাশে থাকতে অয়। সাহস দিতে অয়।”
” মা! আমারে তুমি মাফ কইরা দাও।”
” আমি মাফ করলে তো অইব না বাপ। তোমারে আগে নিজের ভুল বুঝতে অইব। তারপর নিজেই নিজের কাছে তওবা করে নিজে নিজে ফিরে আসতে অইব।”
” আমি ফিরে আসতে চাইলেও সীমা আমাকে ছাড়ব না মা। সে আইজও আমার অফিসে গেছে। সে তোমাকে ফোন করবে। রীমারে সব জানাইব। তুমি আমার মা। নিজের সন্তানরে ক্ষমা কইরা দিলেও রীমা আমারে ক্ষমা করব না মা। হে রুপাইরে নিয়ে আমার কাছ থেকে দূরে চইলা যাইব।”
” এসব নিয়ে তোমারে চিন্তা করতে অইব না। আগে কও তুমি সত্যি সত্যি এই সম্পর্ক থেকে বের অইতে চাও তো!”
” মা তুমি বারবার সম্পর্ক বলছ কেন? আমার কোনো দোষ ছিল না মা। আমি সীমার পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছি মা। আমি এবার মুক্তি চাই।”
শাওনের কথা শেষ না হতেই শর্মিলি আহমেদ চোয়াল শক্ত করে ফেললেন,
” খবরদার মিথ্যা বলবা না। তুমি ছোট্ট খোকা নও যে কেউ তোমারে ফাঁদে ফেলব। যাই করেছ সেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে করেছ। সবচেয়ে বড় কথা তুমি এই ফাঁদ থেকে বের হইতে চাইতাছ।”
” হ মা। তবে দয়া কইরা আমারে ক্ষমা কইরা দাও।”
” না শাওন! তুমি আমার ছেলে সেই কারণে ভাইব না আমি তোমারে ক্ষমা করুম। তোমারে শাস্তি পাইতেই অইব।তবে তুমি ছোট্ট শিশু নও আবার কিশোরও নও যে তোমারে আমি বকব, মারব হাত খরচের টাকা বন্ধ কইরা দিব। তোমার বয়স অনুযায়ী তুমি শাস্তি পাবা।
মায়ের রূঢ়তা দেখে শাওনের চোখ ছলছল করে উঠল। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
” মা, আমি ভুল করছি, আমারে তুমি মাফ কইরা দাও।”
” ভুল করলে মাফ করা যায়, পাপ করলে নয়। তুমি ভুল করনি, তুমি পাপ করছ। তোমাকে শাস্তি পাইতেই হবে।”
” মা, আমারে তুমি শাস্তি দাও। তবুও রীমারে কিছু জানতে দিও না।”
” আমি সেটাই বলতে চাইছি। রীমা যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে, তুমি কতটা পাপ করেছে। তাহলে মেয়েটা সহ্য করতে পারব না। বিশ্বাস হারানোর যে অনলে আমি আজও পুইড়া মরছি, সে যন্ত্রণায় আমি রীমাকে পুইড়া মরতে দেব না।”
” মা রীমা অনেকটাই জানে। আমি ভয় পাচ্ছি। রীমার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।”
” জানে, সীমার সাথে তোমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেটার গভঅরতা কতটা ছিল সেটা জানে না।”
চলবে….