অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
261

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

২৩. (অতীত)

মাথার উপর শ্রাবণের কালো মেঘ, আকাশের তীব্র গর্জন শেষে সকাল হতেই নেমেছিল এই ঘন বর্ষা। বৃষ্টি পুরো পুরি থামেনি এখনো তবে এই বিকেল হতে হতে কিছুটা কমেছে। যদিও এই সময় বেলা বুঝবার জো নেই। চারিপাশে ভিজে মাটির মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ, কাদা কাদা হয়ে আছে মাটি। বর্ষণে নাকি গাছ পালা প্রাণ ফিরে পায় তবে সবুজের মাঝে এ কেমন বিষণ্ণতা? এই উদাস প্রকৃতিতে গায়ে হিম ধরা বাতাস বইছে খনে খনে।

সামনে ছোট্ট কবরটার পাশে বেলি ফুলের গাছ লাগানো, ফুল আসতে আসতে এখনো বোধহয় অনেক সময়! তার ভাইটা হওয়ার আগে তার মায়ের বেলি ফুলের ঘ্রাণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ হয়েছিল বলেই ছোট্ট নীলাম্বরী কবরটার পাশে বেলির চারা রোপণ করে ছিলো। এখন না তার ভাই আছে আর না মা আছে বলে মনে হয়, এই সম্মোধন সে ভুলতে চলেছে— হয়ত ভুলেই গিয়েছে। আপাদত গাছটার আশেপাশে এখন পানি জমে আছে।

টুইটুম্বর বিকেলে হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে নীলাম্বরী, থাকার জায়গা পরিবর্তন করেছে মাস খানেক আগে। যদিও আসার সময় বার বার পিছনে ফিরে চেয়েছিল। কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো কেউ তার পিছু নিয়েছিল তখন…

তার গায়ের হলুদ জামাটা তার শরীর অস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। এমন জুবুথুবু অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশ অনেক্ষণ ধরেই ভিজছে সে। যেই কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়েছে সেই কদম গাছ বেয়ে টুপটুপ করে পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার কপাল, কদমতলার ফোঁটাটুকু বেয়ে কপাল ছুঁয়ে নেমে গেলো তার গলা হয়ে। নীলাম্বরীর লোম দাঁড়িয়ে গেলো, সারা শরীরে শির শির অনুভুতি হলো ঠান্ডায় তবুও সে অনড় হয়ে রইলো। সকালে তার বাবা বেরিয়েছিলো আজ ফিরবে বলে মনে হয় না। যাওয়ার সময় তার বাবার সাথে কিছু বাক্য আদান প্রদান হয়েছিল কেবল।
সকাল প্রায় নয়টা, দুজন টেবিলের দুই মাথায় বসে নাস্তা সারছিলো তখনই তার বাবা অর্ধেক নাস্তা সেরে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নেয়। পানির গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়ে দাড়িয়ে পড়লেন, ততক্ষণে নীলাম্বরীর মনোযোগ তার বাবার দিকে।

“তুমি কোথাও যাচ্ছো, বাবা?”

“বাবা একটু কাজে বের হচ্ছি, আসতে সময় লাগতে পারে।”

নীলাম্বরী শব্দ করে প্লেটের উপর চামচ রেখে তার বাবার দিকে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। তার বাবা কোথায় কি কাজে বেরোচ্ছে সে খুবই ভালো করে জানে। ঘোর আপত্তির সত্বেও নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে সে বললো,

“ডাক্তাররা আশা ভরসা দিতে পারছে না বাবা, তাহলে তুমি কেনো এসব করছো?! মানুষটা বিছানায় মেশিনের মাধ্যমে পড়ে আছে শুধু…”

তার বাবা তাকে বাক্য সমাপ্ত করার সুযোগ না দিয়ে মেয়েকে নরম আদুরে স্বরে বোঝালেন,
“মনোবল জোর রাখা খারাপ কিছু না আর এসব বলতে নেই, যতই হোক তোমার মা হয় উনি!”

তখন কামিনী টেবিলের খালি প্লেট গুলো নিয়ে যেতে এসেছিলো, সেও জানে এটা নীলাম্বরীর বাবার জন্য কতটা সেনসেটিভ টপিক তাই নীলাম্বরীকে ইশারায় কথা বন্ধ রাখার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন। তবে নীলাম্বরী অমান্য করে। সে চোয়াল শক্ত করে নেয়,

“উনি আমার মা হওয়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে বাবা, আমি তাকে আমার কোনো স্মৃতিতেই খুঁজে পাই না।”
নীলাম্বরীর কথায় তিনি তির্যক দৃষ্টি ফেললেন, বোঝাই যাচ্ছে এমন কথা তিনি বেশ অপছন্দ করেছেন। নীলাম্বরীর ডিফেন্ড করে কামিনী এগিয়ে এসে কিছু বলবে তার আগেই হাত উচু করে তিনি কামিনীকে থামিয়ে দিলেন। পরক্ষণে বেশ কয়েকবার ভারী নিশ্বাস ফেলে কিছুটা কঠোর হলেন এবার।

“তুমি চাইলেই তোমার জেনেটিক স্ট্রাকচার বলদাতে পারো না, যখন তোমার মা আমাদের মাঝে ছিলেন তখন সকল দ্বায়িত্ব নিখুঁত ভাবে পালন করেছিলেন।”

নিখুঁত শব্দটা শুনে নীলাম্বরী চোঁখ বড় বড় করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তার মা কখনো আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ছিলো না। মানসিক ভাবেও তাকে অসুস্থ বলা চলে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে নীলাম্বরী গলা উচুঁ করে কর্কশ স্বরে বললো,
“উনি তো আমাদের কারো পরোয়া করেননি যখন___”

তিনি আর না শুনতে চেয়ে নীলাম্বরী কে থামিয়ে দিয়ে কড়া ভাষা শোনালেন,
“আমি আর বাকিটুকু অনিচ্ছুক। নাস্তাটা শেষ করে নাও, আমি উঠছি।”
কথাটুকু বলা মাত্রই তিনি মেয়ের প্রতি নরম হয়ে যান আবার। মেয়ের মাথায় হাত রেখে কপালে চুমু খেয়েই নিরবে বিদায় নেন। চমকপ্রদ হয়ে অশ্রু ভরা চোখে নীলাম্বরী শুধু তার বাবার দিকে চেয়ে রইলো। একটা জড় বস্তুর পিছনে সময় ব্যায় করতে করতে তিনি তার মেয়েটাকে সময় দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন। অথচ তার বাবা জানেন ই না যে সে তার চোখের সামনে তার ছোট ভাইটার নির্মম মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারেনি।
নীলাম্বরী হয়ত তার মায়ের মতো, প্যাথেটিক। হয়ত তার জীবনের সময় গুলোও মধুর হতে পারতো যদি তিনি আত্মকেন্দ্রিক না হতেন। আসাড় হয়ে থাকা নীলাম্বরীর কর্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো, পরপর আরেক ফোঁটা…

এতখানি সময় ধরে ভিজে জবজবে সে। অতিরিক্ত ভেজার কারণে চোখ লাল হয়ে আছে, নাকে অসহনীয় পিট পিট করছে তবুও তোয়াক্কা না করে সে নাক টানলো। হাতে থাকা ছোট কাচের কৌটা টা নিচে রেখে মাটির দিকে হাত বাড়িয়ে ছোট ছোট করে মাটি উঠিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগলো। নিপুণ হাতে অতি মনোযোগ সহকারে মাটি খুড়ার কাজ করলো সে। মোটামুটি ছোট খাটো একটা গর্ত খুড়া শেষে সে ছোট কাচের কৌটার দিকে চেয়ে রইলো। ভিতরে তার জমানো কিছু কাগজের পাখি, সেই কাগজ গুলোয় হিমাদ্রীর সাথে বন্ধুত্বের শুরু থেকে অন্ত অব্দি যতবার সাক্ষাৎ হয়েছিল ততবার নিয়ে তার এক লাইন অনুভূতি লিখা।
এগুলো এখন বড়ই মূল্যহীন!
তবে কাঁচের কৌটায় একটা নীল রঙের খাম ভরা, সেই খামের দিকে নীলাম্বরী অনুভূতি শূন্য হয়ে চেয়ে রইল। দু হাত ভরে মাটি তুলে ধীরে ধীরে কাঁচের কৌটাটা চাপা দিয়ে ঢেকে দিলো। কাজ শেষ হওয়া মাত্রই কর্দমাক্ত হাত জামাই মুছে নিলো। বেলা গড়িয়েছে সাথে বৃষ্টিও বেড়েছে মনে হয়। সে মাথা উচু করে আকাশের দিকে চেয়ে কয়েক ফোটা পানি উপলব্ধি করলো। অতঃপর ফিরে যেতে পা বাড়ালো, তবে যেতে যেতে খামে টানা ইতি কথা শেষ বারের মতো মনে মনে আওরালো—

“শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ হিমাদ্রী, যদি পরবর্তীতে কখনো দেখা হয় তবে আমরা আর বন্ধু পরিচয় নিয়ে নয় কেবল পারিবারিক শত্রুর পরিচয় দিয়ে দেখা করবো।

ইতি,
কাশফি।”

শেষ বারের মতো হিমাদ্রীর চিঠিতে নীলাম্বরী লিখার অদম্য ইচ্ছে চাপিয়ে সমাপ্তি টানলো সে।

মাস খানেক আগে ভিলা ছেড়ে অন্য শহরে অবস্থিত তার বাবার এই ফার্মহাউসে এসেছিলো তারা। শহরটা ঠান্ডা রকমের, আগেরটার তুলনার কিছুটা কোলাহল মুক্ত, শান্তিপ্রিয়। এখানকার বেশির ভাগ লোকদের জীবনযাপন বর্ণনায় গ্রামীণ জীবন যাপনের মতোই বলা যায়। এই উচু ভূমিতে বেশ কয়েকটা টিলা দেখেছিলো সে, এছাড়া পাহাড়ি গাছগাছালি আর ফলমূলও আছে শুনেছে। এতে অবশ্যই নীলাম্বরীর কোনো আপত্তি নেই, থাকলেও সে আপত্তি রাখে না। তবে ইদানিং বাজে ধরনের অনুভূতি হয় তার, রাস্তায় বের হলেই মনে হয় কেউ চেয়ে আছে, খুবই প্রখর ভাবে। এই যে বৃষ্টির মাঝে এলোমেলো হয়ে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে এখনো মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে। তবে প্রতিদিনের মতোই সে ভাবলো কে তার পিছু নিবে? তাই নিছকই ভ্রম বলে উড়িয়ে দিলো সে।
যতক্ষনে সে বাসার গেইটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে ততক্ষণে বৃষ্টি প্রায় থেমে গিয়েছে, অন্ধকার নেমে চারপাশে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। তাদের প্রতিবেশী একজন বৃদ্ধা মহিলা, যার কোনো সন্তান সন্ততি নেই— থাকলেও মায়ের খেয়াল রাখেনি এমন। তার স্বামী বোধহয় ভালো পরিমাণ সম্পদ তার নামে লিখে গিয়েছেন, তাই শুয়ে বসে খেলেই দিন চলে যায়।
নীলাম্বরী মহিলাটা কে দেখা মাত্র হাসি অফার করলো বিপরীতে বৃদ্ধাও হাসলেন। সে স্বাভাবিক ভাবে গেইটে কোড চেপে গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে এলো। প্রথমত গেইটে কোনো গার্ড না দেখতে পেয়েই বিচলিত সে। পরক্ষণে নামাজ পড়তে গিয়েছে তা ভেবে নেয়।

নীলাম্বরী গেইট পেরিয়ে আসতেই অদূরের আধারে কিছু সন্দিহান উপলব্ধি করলো। চোখ ছোট ছোট করে স্পষ্ট কালো কিছু দেখতে পেয়ে থমকে দাড়ায়। মনে সাহস জুটিয়ে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতেই দেখলো গায়ে গার্ডের পোশাক, লোকটা উপর হয়ে পড়ে আছে। সে একবার দুই বার ডেকে সাড়া না পাওয়ায় লোকটার গায়ে হাত রেখে একটু ঝুঁকে দেখতেই আতকে উঠলো। তাকিয়ে তার পা রক্তের ওপর টের পেয়ে জমে গেলো যেনো!
গার্ডের বুকের বুলেটের আঘাত হতে এখনো রক্ত বের হচ্ছে শুধু জমিনে পড়ে আছে তার নিথর দেহ।

হতবম্ব নীলাম্বরী মুখে হাত দিয়ে তার চিতকার চেপে ধরলো, তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোঁখ ভরা অশ্রু নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে সরে দাড়াতেই আরো একটি নিথর দেহ একই রকম উপুড় অবস্থায় মাটিতে দেখতে পেলো। নীলাম্বরীর গা গুলিয়ে এলো, দুর হতে নাকে রক্তের গন্ধ এলো। কোনো রকম নিঃশব্দে বাসার নিকট অব্দি যেতে যেতে সে আরো কয়েকটা লাশ পড়ে থাকতে দেখলো। চোখে ভয় নিয়ে সে ঝোপের আড়ালে হেঁটে হেঁটে বাসার সামনে উকি দিয়ে একটা ধূসর রঙের গাড়ি দেখতে পেলো। নাম্বার প্লেট দেখে কিছুক্ষণ সূক্ষ্ম নজরে পরখ করতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো,
মনে পড়ে গেলো পিচ ঢালা রাস্তায় মিশে যাওয়া তার সাত মাসের ভাইয়ের কথা, তার মায়ের ছি’লে থেত’লে যাওয়া দেহ, সেই নির্মম দিনের কথা!
সেদিন হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হওয়ার আগে উপলব্ধি করতে পেরেছিল সেই গাড়িটার ধূসর রঙের টয়োটা গাড়ি ছিল, স্পষ্টত দেখেছিলো নাম্বার প্লেট যা তার সামনে থাকা গাড়িটার অনুরূপ!
00062783B

নীলাম্বরীর সারা দেহ কাঁপতে কাঁপতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে বারবার। তার মাথা ফাকা ফাকা মনে হচ্ছে। কে সে? যে তার পরিবারের সুখ কেড়ে নিয়েছিলো?! আতঙ্কিত নীলাম্বরী আসেপাশে চোঁখ বুলিয়ে একটা নিথর দেহ দেখা মাত্রই সেটার পকেট হাতিয়ে ফোন বের করে আনে। পরপর কম্পিত হাতে একটা নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়, প্রথম কয়েকবার রিং হওয়ায় নীলাম্বরী অধৈর্য্য হয়ে পড়লো। মনে মনে প্রার্থনা করলো যেনো তার বাবা ফোন উঠায়, শেষবার রিং হতেই কল রিসিভ করে ওপর পাশ থেকে শোনালো,

“কাদের, এই সময় কল কেনো করেছো? বাসায় কোনো ঝামেলা হয়েছে কি?”

নীলাম্বরী কাপা কাপা স্বরে “বাবা” বলে থেমে যায়, আবার ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো — “কাদের কে মেরে ফেলেছে, সবাইকে মেরে ফেলেছে বাবা!”

নীলাম্বরীর বাবা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন অনেক বড় বিপদ হয়েছে, কেননা বাড়িতে তিনি বার বার কল করেছিলেন কিন্তু রিসিভ হচ্ছিলো না। তিনি গাড়িতেই ছিলেন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন তবে তার মেয়ের কথা কানে আসা মাত্রই তিনি আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। তবুও নীলাম্বরী কে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললেন শান্ত হতে,

“তুমি কি বাসার বাইরে?”
নীলাম্বরী ভয়ে ভয়ে ‘হ্যাঁ’ বললো। তিনি শুকনো ঢোক গিলে মেয়েকে বুঝিয়ে বললেন,

“বাবা আসছি তোমার কাছে, খুব দ্রুতই আসছি। তুমি যথাসম্ভব লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করো। ঠিক আছে?”
তার কথা শেষ হওয়া মাত্রই ফোনের ওপর পাশ থেকে গুলির শব্দ শোনা গেলো, তৎক্ষণাৎ তার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। তার মেয়েটা ঠিক আছে তো? এর পরপরই ফোনটা কেটে যায়, তিনি নীলাম্বরী কে আবার কল করতে গেলেই সংযোগ সম্ভব হচ্ছে না শুনতে পান।

এদিকে গুলির শব্দে নীলাম্বরীর হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে পড়েছে। সে দ্রুত ফোনটা নিচে থেকে তুলে চেক করতে লাগলো তার আগেই একজন মহিলার চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলো। নীলাম্বরীর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা আর কেউ নয় ছোট মা মানে কামিনীর কন্ঠ। তার বুকের ভিতর অসহনীয় ধড়ফড় আরম্ভ হলো, অতঙ্ক জেঁকে বসলো। এক দৌড়ে বাসায় প্রবেশ করে স্টাফদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেও নিজেকে যথা সম্ভব সামাল দিয়ে নেয়। এত রক্ত দেখে তার ভীষণ বমি পাচ্ছে। সে গুটি গুটি পায়ে প্রথমে রান্নাঘর তারপর কামিনীর ঘরটা দেখে নিলো। তাকে কোথাও না পেয়ে উপরের তলায় নিজের রুমটায় পা বাড়ালো…

দ্বিতীয় তলায় পা রাখতেই কামিনীর গোঙানির শব্দ আরো স্পষ্ট হলো। শব্দটা শুনে এতো অমনোযোগী হয়ে উঠেছিলো যে সে সামনে কাউকে লক্ষ্য করলো না। সে রুমে প্রবেশ করার পূর্বেই কর্কশ স্বরে কেউ যেনো ডাকলো তাকে— “মায়াহরিণী!”

তৎক্ষণাৎ নীলাম্বরীর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে আসে, এটা ঠিক কোনো অভিশপ্ত নামের মতন। এক ফোঁটা ঘাম তার কপাল বয়ে নামলো, পরপর গায়ে হুলের মতো কাঁটা ফুটলো। ভেজা শরীর অনেকখানি শুকিয়েছিলো প্রায় তবে এখন আবার ঘাম ছেড়েছে। জুতোর ঠক ঠক শব্দ শোনা মাত্রই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। সে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই তার অনিষ্ঠকারীকে দেখতে পেলো।

লোকটা Lean রকমের, লম্বা চওড়া তবে কিছুটা ঝুঁকে থাকে, শক্ত চোয়াল, মোটামুটি পেশল শরীর। লোকটার একজোড়া শ্যাওলা রঙের চোঁখ তার দিকে প্রখর ভাবে চেয়ে আছে, তার হাতে ব’ন্দু’ক। চোখে মুখে অলুক্ষণে —সিনিস্টার একটা হাসি ঝোলানো, ঠিক যেনো নরক থেকে সদ্য পৃথিবীতে এই শয়তানের প্রবেশ হয়েছে! তবে এই চেহারা এক প্রকার চেনা, পরিচিত নীলাম্বরীর মানে কাশফির কাছে।
নীলাম্বরী মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো,

এদিকে লোকটা মাথা কাত করে সশব্দে হেঁসে আবার আগের সন্মোধনে ডাকলো! ডেকে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলে ততক্ষণে নীলাম্বরীর টনক নড়লো যেনো। সে শুকনো ঢোক গিলে দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে দরজার হাতল ঘুরিয়ে লক করে দিলো। লোকটা দ্রুত গতিতে দৌড়ে আসলো তবে নীলাম্বরী তার আগেই রুমে এসে পড়েছিলো। সে ‘মায়াহরিণী’ বলে বার বার চেচালো আর লাথি দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করলো কিন্তু নীলাম্বরী মুখ চেপে কান্না করতে করতে দরজা ধরেই দাড়িয়ে রইলো। বহু কষ্টে কাপা কাপা পায়ে দরজা থেকে সরে সে দৌড় দিয়ে কামিনীর কাছে এসে পড়লো।

কামিনী নিচে পড়ে আছে, সে এখন আর গোঙাচ্ছে না, তার নিশ্বাসও কমে এসেছে। নীলাম্বরী গলায় কান্নার দলা পাকিয়েছে তবুও সে ভাঙ্গা স্বরে কামিনী কে ডাকলো কিন্তু কোনো রেসপন্স এলো না। এদিকে দরজার বাইরে হতে আবার বিদঘুটে সেই শব্দ এলো,

“তুমি কিন্তু ভালো করছো না মায়াহরিণী!”

নীলাম্বরীর তনুমণ কেঁপে উঠল, সে মুখ চেপে অশ্রুর বাধ ছাড়লো। আতঙ্কে তার সারা দেহ কাঁপছে, ভয়ে মুখ থেকে শব্দ বের হলো না। মস্তিষ্কে এখনো লোকটার প্রতিচ্ছবি জলজ্যান্ত হয়ে ভাসছে। সে মনে করতে চায়না লোকটার ছবি, সে দেখতে অনেকটা কৌশিক মির্জার অবয়ব যেনো!

নীলাম্বরী ততক্ষণে মাথার চুল খামচে ধরে চোঁখ বুঝে নেয়, মনে মনে প্রার্থনা করলো যেনো এই স্বপ্ন ভেঙে যাক। আর পারছে না সে নিতে!
নীলাম্বরী তার ড্রায়ার থেকে ছোট্ট ফোনটা বের করে ইমারজেন্সি নাম্বার ডায়াল করলো কিন্তু কোনো নেটওয়ার্ক পেলো না। হতাশ আর ভয়ে সে এবার শব্দ করে কাঁদলো কিছুক্ষণ, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ মৃত এখন। কেনো লোকটা এমন করেছে? কিসের শত্রুতা নীলাম্বরী কিছুই জানে না!
নীলাম্বরী চোঁখ মুখ মুছে কামিনী কে সোজা করে নিলো তারপর অদক্ষ হাতে তার পেটের গুলি বের করে নিলো। রক্ত দেখে তার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে সে তার তিনটা ওড়না নিয়ে কামিনীর পেটে ভালো করে বাঁধতে লাগলো, অন্তত রক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও কমবে। ততক্ষণে বাইরে থেকে লোকটার জুতোর শব্দ আর এলো না।
নীলাম্বরী এট্যাচড বাথরুমে ঢুকে ভালো করে হাত ধুয়ে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে সে হাঁটু বুকে জড়িয়ে ধরে কামিনীর পাশে এসে বসলো। হাত বাড়িয়ে আবার পালস চেক করলো, হার্ট রেট অনেক কমে এসেছে। এখনই কামিনীকে দ্রুতই হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। তার বাবা কতটুকুই বা এসেছে সে কিছুই জানে না। এভাবে আধা ঘণ্টা চলে গেলো নীলাম্বরী একই রকম ভাবে বসে রইলো। চোখে মুখে অশ্রু আর বৃষ্টির ফোঁটা লেপ্টে একাকার!
সে উঠে গিয়ে জানালার বাইরে চোঁখ রাখলো, তার অশ্রু থেমে নেই। অদো কি কেউ তাদের বাঁচাতে আসবে?

ততক্ষণে কিসের শব্দ হলো যেনো, তবে অমনোযোগী নীলাম্বরী বোধহয় শুনেও শুনলো না। পরক্ষণে দরজার হাতল ঘোরানোর শব্দ শোনা মাত্রই তার শিরদাঁড়া বেয়ে হিম শীতল শিহরণ বেয়ে গেলো। কক্ষে ঠক ঠক জুতোর শব্দ শুনে মাথা ঘুরে এলো যেনো তার। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে লোকটার দেখা মিললো, ওই শ্যাওলা রঙের চোখ জোড়ায় যেনো সকল অশুভ শক্তি নিহিত রয়েছে।

সে ভাবলো দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়বে কিন্তু তার আগেই লোকটা তার হাত ধরে কাছে টেনে নিলো। তৎক্ষণাৎ সে ছুটে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলো, তার নখ দিয়ে লোকটার মুখে আঁচড় দিলো এতে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে তার হাত দুটো পিছনে চেপে ধরে তার চোয়াল লোকটার হাতে শক্ত করে ধরলো। এই বিদঘুটে শ্যাওলা রঙের চোঁখ জোড়া দিয়ে যেনো তাকে সাবাড় করে ফেলবে। নীলাম্বরী ভাঙ্গা স্বরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার আকুল আবেদন জানালো কিন্তু লোকটা শুনলো না বরং তার দিকে ঝুঁকে বিশ্রী ভাবে হেঁসে ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বললো,

“মায়াহরিণী তুমি বড্ড জা’লিয়েছো!”

নিজের তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ আর কান্না ভেসে এলো কানে, লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। তারপর তার শরীর যেনো অবশ হয়ে এলো, কতক্ষনের জন্য সে অনুভূতিহীন হয়ে ছিলো জানা নেই। শরীরে লোকটার হাতের উপস্থিতি পেলো তবে চোখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। চেয়েও কিছু বলতে পারলো না।

সে কি মা’রা গিয়েছে?!
ম’রে গিয়ে হয়ত ভালোই করেছে।

নীলাম্বরী একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে, এরপর অন্ধকারে সপে দেয় নিজেকে। কানে শেষ একটা কথা ভেসে এলো কেবল,

“বাবা চলে এসেছি, কাশফি। আর ভয় নেই।”

***

কৌশিক মির্জা নিজের কেবিনে বসে ইন্টারকমে তার এসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলে শেষ করার পর পরই তার ফোন হাতে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল করে, কিছুক্ষন পর কল রিসিভ করা মাত্রই কৌশিক মির্জা বললো,

“গত সপ্তাহে কোম্পানি যে প্রজেক্ট লঞ্চ করেছিলো তার দায়িত্বে যে ছিলো তার ফুল ডিটেইলস চাই।”

এই বলেই সে তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দেয়। ফোনে ভাইব্রেট করে দিগন্তের আপকামিং মেসেজ শো করলো,

“হাবিব কে তোমার বেজমেন্টে রেখে এসেছি, গত সপ্তাহের শিপিং থেকে কিছু বড় বড় অস্ত্র আর দামী জিনিস সে সরিয়েছিলো।”

কৌশিক মির্জা ওয়েস্ট কোট আর শার্ট ঠিকঠাক করে, চেয়ার থেকে সুটটা হাতে নিয়ে বের হবে এর আগেই ইন্টারকম বেজে উঠলো। কৌশিক মির্জা চোঁখ মুখ শক্ত করে কানে ধরতেই রিসিপশনিস্টের মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“স্যার একজন আমাদের প্রচুর বিরক্ত করছে আর বলছে আপনার সাথে সাক্ষাৎ না করা ছাড়া সে বের হবে না।”

কৌশিক মির্জা বিরক্ত ছিলো, এমন হেঁয়ালি কথা শুনে রেগে ফেটে পড়ার উপক্রম যেনো। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“এসব নতুন কি? তোমাকে কি আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় কে আপয়েন্টম্যান্ট ছাড়া এসেছে না এসেছে সেটা বলার জন্য রেখেছি?!”

মেয়েটা ভয় পেলো বোধহয় সে কাপা কাপা স্বরে আবার বললো,
“স্যার তিনি মহিলা, নাম কাশফি বলছেন।”

কৌশিকের মেয়েটাকে আচ্ছা মতন ঝাড়ি দিতে ইচ্ছে করলো কিন্তু কাশফির নাম শোনা মাত্রই সে স্তম্ভিত আর নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কপাল কুঁচকে ভাবতে নেয়, এই সময় কাশফি এখানে কি করছে?! সে তৎক্ষণাৎ নিজেকে শান্ত হতে উপলব্ধি করলো, কণ্ঠ গম্ভীর রেখে বললো,
“ম্যাডাম কে আসতে দাও।”

রিসিপশনিস্ট থ হয়ে গেলো বোধহয় তাই লাইন কাটার শব্দ ও কানে পৌঁছালো না। ততক্ষণে কাশফি কত নাম্বার ফ্লোর জেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়লো।
কান থেকে ইন্টারকম রেখে কৌশিক সুটটা আবার চেয়ারের উপর রেখে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে দিগন্তের উদ্দ্যেশ্যে টাইপ করলো,
“কাজে ফেঁসে গেছি তুই না হয় হাবিবের বন্দোবস্ত কর।”

কৌশিক হাতের ফাইলটা খুলে চোঁখ বুলালো, তার হাঁটু অনবরত নাড়িয়ে যাচ্ছে তবে ভিতর ভিতর কাশফির দেখা মিলার অধীর অপেক্ষায় সে। দুই মিনিটের মাথায় কাঁচের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো, কৌশিক ফাইল থেকে মাথা তুলে চাইলো না সে তো কেবল কাশফির বাক্য বিনিময়ের অপেক্ষায়। ম্যাডামের হুট করেই আগমনের কারণ তার বুঝে আসলো না ঠিক।

কাশফি ক্ষিপ্র গতিতে কৌশিকের হাতের ফাইল টেনে নিচে ছুড়ে ফেলে, চোয়াল শক্ত করে চোঁখ বড় বড় করে দাত কড়মড় করে বললো—
“কবে থেকে চিনেন আমায়? কেনো আমার পিছনে পড়ে আছেন?!”

কৌশিক প্রথমে তির্যক দৃষ্টিতে চাইলেও পরে নির্বিঘ্নে শ্রাগ করে জানালো,
“আমি আপনাকে পছন্দ করি কাশফি, ইটস আল নিউরোট্রানসমিটার এন্ড ডোমাপিন।”

কাশফি এমনিতেই রেগে ছিলো কালকের স্বপ্ন নিয়ে তার উপর এমন ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথায় ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা আরো বিরক্ত লাগছে তার। সে টেবিলের উপর এক হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে আঙ্গুল তুলে চেচালো,
“ইউ আর ফাকড আপ! ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা একদমই করবেন না!!”

কৌশিকের দৃষ্টি ততক্ষণে তার মুখ হতে তার হাতে এলো, তার এক হাতে নখের আঁচড় বসে জখম হয়ে আছে। কৌশিক চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে পরখ করা শেষে খট করে তার হাত ধরে নেয়,

“এটার মানে কি?”
কাশফি তার হাতের নখের আঁচড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো। দুঃস্বপ্ন শেষে রাত চারটায় যখন তার ঘুম ভেঙে যায় তখন নিজের অনেকটুকু ক্ষতি সাধন করে ফেলেছিলো সে। বাবার করা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঔষুধটাও খেতে ভুলে গিয়েছিলো। কৌশিকের প্রখর দৃষ্টি এখনো তার উপরে হওয়ায় সে অমতা অমতা করে বলে,

“None of your business.”

“I’m taking it as my business.”
কৌশিকের গম্ভীর স্বর ডমিনেটিং স্বরে পরিবর্তিত হওয়া মাত্রই কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে।

“এমন অভিনয় কেনো করছেন?”

“কেমন অভিনয়?”

“Like you care…”
কৌশিক কাশফি কে কিছু বলেনা। তার ইন্টারকম প্রেস করে কানে দিয়ে বললো— “এন্টিসেপ্টিক আর ফার্স্ট এইড নিয়ে আমার কেবিনে নিয়ে আসো।”

সে ফোন কান থেকে নামানোর পরপরই একজন পুরুষ এসিস্ট্যান্ট এসে ফার্স্ট এইড আর এন্টিসেপটিক দিয়ে চলে যায়। কাশফি হতবম্ব হয়ে দেখলো শুধু কৌশিক তার হাতে ডিসইনফ্যাক্ট করার জন্য স্প্রে নিবে তার আগেই কাশফি টেনে তার হাত সরিয়ে নেয়।

“আমি আপনার পেশেন্ট না কৌশিক! আপনার কাছে উত্তর চাইতে এসেছি, জবাব দিলেই আমার কাজ শেষ।”

কৌশিক যেনো কাশফির কথা কানেই নিলো না। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো,
“বসুন কাশফি, আমি সব উত্তর দেবো।”

“আমাকে কাশফি নামে ডাকবেন না।”

“বউ হয়ে যান মিসেস মির্জা বলে ডাকবো।”
কথায় কথায় লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য কাশফি চোঁখ বাঁকা করে তাকিয়ে মিন মিন করে কৌশিকে গালি দিলো বোধহয়। সবাই ঈশিতা ডাকতে পারলে সে কেনো কাশফি বলে সম্মোধন করে তাকে? কৌশিক দেখেও না দেখার ভান করে কাশফিকে বসতে বললো, তারপর সে কাশফির হাতটা নিয়ে ডিসইনফ্যাক্ট করার জন্য স্প্রে করলো। আস্তে আস্তে ক্ষতটুকু তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে ক্রিমের পাতলা প্রলেপ লাগিয়ে দিলো।
কাশফি এতক্ষণ যেনো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো, কৌশিকের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই গমগমে সুরে জিজ্ঞেস করলো,

“এবার বলুন আপনি আমাকে আগে থেকে চেনেন বলেই কি আমার পিছনে কোনো উদ্দ্যেশ্য নিয়ে পড়ে আছেন?”

কৌশিক অবিশ্বাস্য নজর রেখে হালকা হাসলো,
“তুমি এসব নিজে থেকেই অনুমান করে আমাকে স্বীকার করতে বলছো?”

“সোজা সুজি কথা বলুন কৌশিক।”

কৌশিক হাত দুটো একত্র করে মুষ্টিতে পুরে তার থুতনির নিচে রাখলো, এরপর ভারী নিশ্বাস ফেলে কাশফির দিকে এক নাগাড়ে চাইলো। কেন জানি কাশফি তার নির্জীব চোখে আটকে গেলো, হাজার চেষ্টা করেও সে এই ছাই রঙের চোঁখ আর শেওলা রঙের চোখের কোনো মিল খুঁজে পেলো না। কৌশিকের গড়ন মাস্কিউলিন বলা যায়, তার মুখ দেখে অনুভূতি বোঝার দায়। কৌশিক সর্বদা নিজের আইস কোল্ড সেলফ আর স্টোন ফেইস মেইনটেইন করে চলে। তীক্ষ্ণ চোয়াল, পরিপাটি ধরনের মানুষ সে। তবে শেওলা চোখের লোকটা আর কৌশিক কিভাবে এক হলো?
হতে পারে তার কল্পনা শুধুই?

এতো বিদঘুটে জিনিস তার কল্পনা হতে পারে ভাবতেই পারেনা। নিজের শরীরে অন্যকরো হাত ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসছে।

“পাঁচ বছর আগে যদি আপনার অস্তিত্ব আমার নজরে আসতো তবে আমি কখনো আপনাকে আমার অগোচরে হতে দিতাম না, কাশফি।”

কৌশিকের কথা তার কাছে যুক্তি যুক্ত মনে হলো। কথা শেষ হওয়া মাত্রই কাশফি মাথা নেড়ে উঠে দাড়ায়, কেবিন ত্যাগ করার আগে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়,
“আমার থেকে দূরে থাকবেন কৌশিক, প্লিজ!”

কৌশিক এক নাগাড়ে তার প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইলো। যেই গতিতে কেবিনে প্রবেশ করেছিল সেই গতিতে প্রস্থান ও করেছে সে।

“সম্ভব হবে না, কাশফি।“

***

মুখ ভার করে কাশফি বাসায় পৌঁছেই মানুষ জনের আনাগোনা শুনতে পেলো, তার বাবা হেঁসে হেসে কথা বলছেন করো সাথে। সে ভিতরে ঢুকে প্রথমেই বসার রুমে নতুন কিছু মুখ দেখতে পেলো সাথে জোভান শিকদারের দেখা ও মিললো। বুঝতে বাকি রইলো না যে, তার বিয়ের কথা পাকাপাকি করা হচ্ছে হয়ত। জোভান তার দিকে চাওয়া মাত্রই হাসলো, তবে বিপরীতে কাশফি হাসতে অক্ষম হলো, কিছু বলতেও পারলো না।
তার গলায় যেন অদৃশ্য কোনো পাথর আটকে আছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না।

সে সালাম দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো, তার বাবা এগিয়ে এসে বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে জোভানের সাথে কথা বলে নিও। তোমাদের বিয়ে হতে চলছে তাই ফ্রি হলেই ভালো হয়।”

কাশফির চেহারার রঙ ততক্ষণে উড়ে গিয়েছে, সে সম্পূর্ন মূর্তি মানব বনে গিয়েছে যেনো। তবুও মাথা নেড়ে সে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের কামরার উদ্দ্যেশে হাঁটতে শুরু করলো।

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৪)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

কোনো অমূল্য ভাস্কর্যের মতো স্টিয়ারিংয়ে রাখা পেশল শিরান্বিত হাত আর শক্ত চোয়ালে থাকা কোল্ড ফেইসের পুরুষ অবয়ব মাথায় পরিভ্রমণ করতে থাকলো। অথচ সে স্টিয়ারিংয়ে বসা জোভানের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়েই এসব ভাবতে মশগুল ছিলো, এত থার্ড ক্লাস কবে থেকে হলো সে?

“তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না?”
জোভানের থমথমে গলা শুনে কাশফির হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেলো যেনো। সে বড় বড় চোঁখে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাঁকি দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো,

“না তো? এমন কেনো মনে হলো আপনার?”

জোভান যেনো কাশফির কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না। এতে কাশফির নিজের কাছেই খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিজেকে চরম রকমের সস্তা মনে হলো, বাগদত্তা সাথে নিয়ে বসে তো স্বাভাবিক সুষ্ঠ মানুষ আনমনা হতে পারে না।

এদিকে সে কেবলই এক ভাবনায় মশগুল, যেমন তার স্বপ্নে দেখা কোনো চেহারাই ঘুম থেকে ওঠার পর তার মনে আসে না এমন কি শেওলা চোখের লোকটার চেহারাও সে একদিনে ভুলতে চলেছে। তার কি আদো কোনো মেডিক্যাল কন্ডিশন আছে? আর মিল তো সেদিন পেলো না তাহলে কি করে লোকটা কৌশিক মির্জা হয়? স্বপ্নে কেনো লোকটা কে কৌশিক মির্জা মনে হয়েছিল? উত্তর সে নিজে দিতেই চরম ব্যর্থ। ভাবনার মাঝে ইনিয়ে বিনিয়ে কৌশিক মির্জার আনাগোনা হাজার বার হয়, যাকে নিয়ে ভাবতে চায় না তাকে নিয়ে কেনো এমন বাড়াবাড়ি ধরনের চিন্তা তার?!
মনে মনে সে বার বার বোঝালো, আজ হোক কাল কৌশিক থেকে সরে দাঁড়ানোই উত্তম। কৌশিক আর সে চম্বুকের দুই বিপরীত মেরুর মতো।

“তোমার কি আনকম্ফর্টেবল ফিল হচ্ছে? হলে বলো প্লিজ।”
জোভানের গলার স্বরের কিছু একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো কাশফি। পাশে বসা লোকটা তার দুটো কাজিন আর কাশফিকে নিয়ে বাদ বাকি বিয়ের শপিংয়ে বেরিয়েছিল। যাবতীয় কেনাকানা শেষ হওয়া মাত্রই হুট করে তার কাজিনরা তাদের একা রেখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। কেনো বিদায় নিয়েছে তা কাশফি আগে আন্দাজ না করতে পারলেও পরে দুই আর দুই মিলিয়ে নিয়েছে। জোভান একান্ত, ব্যক্তিগত টাইম স্পেন্ড করতে চেয়েছিল তাই এসব প্রি প্ল্যানিং করে রেখেছিল।

“না না তেমন কিছু না। আমি আসলে কথা কম বলি আপনি বলুন আমি না হয় শুনি।”

কাশফি হাত নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সেরে হালকা হাসার চেষ্টা করলো, এদিকে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে রাস্তা হতে একবার কাশফির দিকে চেয়ে জোভান তপ্ত নিশ্বাস ফেললো,

“তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই যা বলার আমি বলেছি তুমি তো কিছুই বলো নি।”

“আমি দুঃখিত।”

“সমস্যা নেই, আরে তুমি সরি কেনো বলছো? আচ্ছা কথা স্টার্ট না হয় তুমি কর।”
কাশফি মুখ খুলে কি বলবে খুঁজে না পেয়ে মুখ বন্ধ করে নেয়, কি জিজ্ঞেস করা যায় ভাবতে ভাবতে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ উদয় হয়, পরক্ষণে মুখ কালো করে ফেললো যা দেখে জোভান সহজ হওয়ার জন্য আবার বললো,

“আচ্ছা যাও আমিই বলছি, তোমার পছন্দের কোনো জায়গা আছে? আই মিন ঘোরাঘুরির জন্য।”

“আমি তেমন একটা ঘুরিনি কখনো।”

জোভান চমকালো বোধহয়, আশ্চর্য্যন্বিত দৃষ্টি ফেলে আবার শুধলো,
“কখনো না?!”

“না।”

“কোনো সমস্যা ছিল নাকি তুমি ঘরকুনে?”

“বাবা একা অতদূর যেতে আপত্তি করেছিলেন আর তাছাড়া কখনো বাবার সময়ও হয়ে ওঠেনি।”

জোভান জিভ দিয়ে হালকা ঠোঁট ভিজিটর নিলো,
“তুমি কি ঘুরতে যেতে চাও?”

“অবশ্যই! কে না চাইবে?”— কাশফির চোঁখে মুখে ঝলক ফুটলো, সে থেমে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি তো মনে হয় ঘুরতে ভালোবাসেন না?”

কাশফিকে নিজ থেকে কথা বলতে দেখে জোভানের বেশ প্রফুল্ল মনে হলো,
“এখন তেমন একটা সময় হয়ে উঠে না তবে আমি সময় পেলেই প্রকৃতি বিলাসে ছুটে যাই। আচ্ছা তোমাকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তবে তুমি কোথায় ঘুরবে?”

“সিলেট।”

“স্পেসিফিক্যালি তোমার কি কোনো হবি আছে?”

“তেমন কিছু নেই তবে টুকটাক বই পড়ি।”

“কবিতা পড়?”

“মাঝে মাঝে…”
হুট করেই তাদের কথোপকথন কেমন যেন শুন্য শুন্য শোনালো, এরপর একটা অকওয়ার্ড সাইলেন্স কাজ করলো। জোভান মাথার পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা ভেবে সেই নিরবতা মিটিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বললো,

“আমার খুব পছন্দের কবিতার নাম ‘অনামিকা’ । একবার হলেও পড়ার অনুরোধ রইলো।”

“আপনি বললেন যেহেতু অবশ্যই পড়বো।”

“তুমি আমাকে তুমি করেই ডাকতে পারো।”

কাশফির হাসি মুছে গেলো, তবুও হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আমি চেষ্টা করবো।”

কাশফির মুখের হাঁসিটাও যেন দ্বিধান্বিত হয়ে এলো। চেয়েও কথা বলার মতো কিছুই পেলো না। এদিকে হাঁস ফাঁস করতে থাকা জোভান কিছু একটা বলতে নিয়েও ঢোক গিলে কথাটুকু নিজের মাঝেই রেখে দেয়। যেতে যেতে রেইল ওয়ের সামনে এসে গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারাত্বক জ্যামে আটকা পড়লো।

বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে কাশফি কাঁচ উঠানো গ্লাস কিছুটা নামিয়ে মাথা তুলে সিগনাল দেখে নিলো, ট্রেন আসতে তেমন সময় নেই। এই জান জটের মাঝে বাইরের ভ্যাপসা গরম গায়ে লাগলো কাশফির, অতিষ্ঠ হয়ে মাথা নামিয়ে এদিক সেদিক ফিরে যেই আবার গাড়ির গ্লাস তুলবে তার পূর্বেই তার গরমের মাঝে শিরশির অনুভূতি হলো, তৎক্ষণাৎ শিরদাড়া বেয়ে এক সূক্ষ্ম শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। কাশফি হাত মুঠ করে নেয়, দমকা হওয়ার বেগে মাথা পাশে ফিরিয়ে নিতেই লক্ষ্য করলো একটা কালো মার্সিডিজ তাদের গাড়ি হতে দুই ইঞ্চি দুরত্বে থেমেছে।
পরক্ষণে মার্সিডিজের গ্লাস হালকা নামানো হলে তার সাক্ষাৎ হলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা স্থির ধূসর চোখ জোড়ায়। দৃষ্টিতে স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপণ করে তাকে ঝ’ল’সে রাখ করে দেওয়ার মতো চাহনি ছিল এই শান্ত, ধূসর চোঁখ জোড়ায়।
তার সর্বাঙ্গ কেপে উঠলো, চোঁখ জোড়া দেখে তার চিনতে বাকি রইলো না কে? কিছুক্ষণের মধ্যেই বুকের ভিতরে উথাল পাতাল শুরু করলো, হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার।
কাশফি জানে, এই দৃষ্টি যতটুকু শান্ত দেখাচ্ছে ঠিক তার বিপরীত, ঘন ঘন শ্বাস ফেলে কাশফি গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিলো। কিন্তু তবুও নার্ভাসনেস কমার নাম নেই, তাই জোর পূর্বক নিজের মনোযোগ জোভানের রাখার চেষ্টা করছিল কিন্তু বরাবরই সে ব্যার্থ হলো।
তার চাকুর মতো দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে সে আজও হিমশিম খায়।

আধা ঘণ্টা পর জোভানের গাড়ি তার বাসার সামনে এসে থামলো, কাশফি নরম হেসে বাসায় আসার কথা বললে জোভান না করে দিলো।

“চা নাস্তা না নিলেও আপনি বাবার সাথে দেখা করে যান।”

“তোমার হাতের চা খেতে বোধ হয় বেশি দিন ঈশিতা, তাই আজ চললাম।”
কাশফি বোধহয় একটু ইতস্তত বোধ করলো তবুও মুখে হাসি রেখে বিদায় নিয়ে তার দরজার দিকে পা বাড়ালো। জোভান তখনও হাঁসফাঁস করছিল, কিছু বলার দরকার কিন্তু সে বলতে বরাবরই ব্যার্থ। কাশফি বেল চাপতে নিলে সে জোর গলায় কাশফিকে ডাকলো, কাশফি আশ্চর্য্য হয়ে তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকালো,

“ঈশিতা, তুমি আমার ‘অনামিকা’ হবে?”

“জ্বি?…”
কাশফি আরেক দফায় চমকালো বোধহয়, অক্ষিপট পিট পিট করে ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

“জবাব নাহয় কবিতা পড়েই দিও।”
কাশফিকে জবাব দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে সে গাড়িতে উঠে দ্রুত প্রস্থান করলো শুধু পড়ে রইলো হতবম্ব কাশফি।

***

অনামিকা
কাজী নজরুল ইসলাম

‘ কোন নামে ডাকব তোমায়
নাম-না-জানা- অনামিকা
জলে স্থলে গগনে-তলে
তোমার মধুর না যে লিখা।
গীষ্মে কনক-চাঁপার ফুলে
তোমার নামের আভাস দুলে
ছড়িয়ে আছে বকুল মূলে
তোমার নাম হে নিকা।

বর্ষা বলে অশ্রুজলের মানিনী সে বিরহিনী।
আকাশ বলে, তরিতে লতা, ধরিত্রী কয় চাতকিনী।
আষাঢ় মেঘে রাখলো ঢাকি
নাম যে তোমার কাজল আঁখি
শ্রাবণ বলে, যুঁই বেলা কি?
কেকা বলে মালবিকা।
শারদ-প্রাতে কমল বনে তোমার নামে মধু পিয়ে

বানীদেবীর বীণার সুরে ভ্রমর বেড়ায় গুনগুনিয়ে!
তোমার নামের মিল মিলিয়ে
ঝিল ওঠে গো ঝিলমিলিয়ে
আশ্বিণ কয়, তার যে বিয়ে
গায়ে হলুদ শেফালিকা।

নদীর তীরে বেনুর সুরে তোমার নামের মায়া ঘনায়,
করুণা আকাশ গ’লে তোমার নাম ঝরে নীহার কণায়
আমন ধানের মঞ্জরীতে
নাম গাঁথা যে ছন্দ গীতে
হৈমন্তী ঝিম্ নিশীতে
তারায় জ্বলে নামের শিখা।

ছায়া পথের কহেলিকায় তোমার নামের রেণু মাখা,
ম্লান মাধুরী ইন্দুলেখায় তোমার নামের তিলক আঁকা।
মোর নামে হয়ে উদাস
ধুমল হোলো বিমল আকাশ
কাঁদে শীতের হিমেল বাতাস
কোথায় সুদূর নীহারিকা।

তোমার নামের শত-নোরী বনভূমির গলায় দোলে
জপ শুনেছি তোমার নামের মুহহুমুর্হু বোলে।
দুলালচাঁপার পাতার কোলে
তোমার নামের মুকুল দোলে
কুষ্ণচুড়া, হেনা বলে
চির চেনা সে রাধিকা।

বিশ্ব রমা সৃষ্টি জুড়ে তোমার নামের আরাধনা
জড়িয়ে তোমার নামাবলী-হৃদয় করে যোগসাধনা।
তোমার নামের আবেগ নিয়া
সিন্ধু উঠে হিল্লোলিয়া
সমীরনে মর্মরিয়া
ফেরে তোমার নাম -গীতিকা। ’

***

সন্ধ্যার পরপর মুখ কালো করে কাশফি পড়াচোর কায়েস লাঠি নিয়ে পড়তে বসিয়েছে। এমনিতেই কৌশিকের জন্য নিজের উপর রাগ জমে আছে তার, আর এদিকে কায়েসের একবার কলম পড়ে যাচ্ছে একবার রাবার হারিয়ে ফেলছে এবার পেন্সিল ভেঙে ফেলছে দেখে কাশফির মেজাজ তুঙ্গে উঠেছে। সে কায়েস কে চেঁচিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নিচে থেকে কথা বলার শব্দ শুনতে পেলো, উকি মেরে নিচে তাকাতেই মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ মানুষকে তার বাবার সাথে কথা বলতে দেখলো। লোকটা কে দেখা মাত্র চিনতে অসুবিধা হলো না, ইনি মেয়রের বাবা তোফায়েল আহমেদ মির্জা, মানে তিনি কৌশিকের বাবা। কিন্তু এখানে কেনো এসেছেন?!

সন্দেহ নিয়ে কাশফি এবার মনোযোগ দিয়ে তোফায়েল মির্জার কথা বার্তা শুনতে লাগলো, তার কথার ধাচ ভঙ্গি অনেকটা কৌশিকের মতোই। তবে যখন তিনি কাশফির বাবাকে মেয়ে আয়ত্তে আনার কথা কথা বললেন তৎক্ষণাৎ কাশফির মেজাজ গরম হয়ে এলো, তোফায়েল মির্জা আর কিছু বলার আগেই দোতলার রুম থেকে কাশফি ঝাঁঝালো আওয়াজ এলো—

“আপনার পুত্রকে আমার গলা থেকে নামিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন। আপনার ঘাড়ত্যাড়া ছেলে আমার পিছনে কুকুরের মতো পড়ে আছে সেটা আমার মান সম্মানের লাগার বিষয়।”

মেয়ের কথার ভঙ্গি ধরে অতিকুর রহমান কঠোর হয়ে বললেন,
“কাশফি আমি দেখছি!!!”

কিন্তু কাশফি আজ আর থামলো না, সে আবার আগের মত করে বললো,
“ভুলভাল জিনিস মনে পুষবেন না, দরজা আপনার ঠিক সামনে।”

এদিকে তোফায়েল মির্জা চোঁখ গরম করে মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে পড়লেন, রাগে ফেটে পড়ার উপক্রম তার। কিন্তু ঘরে বিয়ের আমেজ তাই আতিকুল ইসলাম কোনো সমস্যা চান না তাই ভদ্রতার খাতিরে বললেন,
“আমার মেয়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। আমাদের বাসায় এসেছেন অবশ্যই কিছু খেয়ে যাবেন, আজ খিচুড়ি রান্না হয়েছে আপনি বসুন আমি আনছি।”

আতিকুর রহমান তোফায়েল মির্জার জবাবের অপেক্ষা করলেন না, তিনি পা বাড়ানোর আগেই কাসফি থমথমে গলায় বললো,
“বাদ দাও বাবা, খিচুড়িতে ইদুর পড়েছে। বড়লোকের গলায় এসব নামবে না।”

আতিকুর রহমান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মেয়েকে অগ্রাহ্য করে আবার বললো,
“আপনি বরং বসুন আমি চা করে দিচ্ছি।”

“চা পাতা শেষ হয়ে গিয়েছে বাবা।”

তোফায়েল মির্জা ততক্ষণে আর দাঁড়ালেন না, গমগমে সুরে তেজী হয়ে বললেন,
“ভারী বেয়াদপ তোমার মেয়ে!”

কাশফিও থামলো না, তোফায়েল মির্জা বেরোনোর আগেই বললো,
“সেটা আপনার যোগ্য পুত্র বুঝে যদি আমাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দেয় তবেই হলো।”

***

“তুই না ছেলেটারে দেখেই বিরক্ত হতি?”

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অলস পায়ে হেঁটে চলছে চারজন, তবে তরীর কথার উত্তর দিতে কাশফির হিমশিম খেতে হলো। কেবল ঈশান মূলত আছে ফোন নিয়ে, দিন দুনিয়ার খবর না রাখলেও চলে। কেবল কাশফির বিয়ের কথা শুনে সে হ্যাবলার মতো হেঁসে উত্তর দিয়েছিল— “দাওয়াত দিয়েছিস ভালো কথা কোনো গিফট নিতে পারবো না।”

সংশয় নিয়ে তাকিয়ে থাকা তরীর উত্তর ফারাবী মুখ বাকা করে দিলো,
“তার কি আবার পছন্দ আছে নাকি? তার তো অভ্যাস যাকে দেখবে তাকে নাক সিটকাবে।”

তাদের দুজনের মতামত উপেক্ষা করে কাশফি বললো —
“বাবার পছন্দ মানে আমার পছন্দ, তাছাড়া আমার তেমন কাউকে পছন্দ ছিল না যে আমি বিরোধিতা করতে যাবো।”

“কেনো কৌশিক মির্জা কে কি বিবেচনায় রাখলি না?”

তরীর কথা শোনা মাত্রই কাশফির লোম দাঁড়িয়ে গেলো, খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে,
“বিবেচনায় রাখার মতো সে কেউ ছিল না।”

কিন্তু তরী নাছোড় বান্দা তাই কোমরে হাত দিয়ে কাশফির পথ রুখে দাড়ায়,
“কম বেশি সবাই জানে কৌশিক মির্জা কেনো ক্যাম্পাসে নজরদারি রাখে। বলতো কি লুকাচ্ছিস তুই?”

“আমার জন্য সে মানুষ হিসাবে সে খুবই নির্দয় ধরনের, রাজনীতিতেও জড়িত তাই তাকে এড়িয়ে চলতে চাই, ব্যাস এইটুকুই।”

তরী আর কথা বাড়ায় কেবল মাথা নাড়ায়, কাশফি বুঝতে পারলো না সে বিশ্বাস করেছে কিনা। তরী কিছুক্ষণ পর দ্বিধাগ্রস্থ হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“মহিন কি আসছে?”

“কথা হয়নি আমার।”
তরী আবারও মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেলো, তরী আর মাহিনের ঝামেলার পর থেকে কাশফি এমনিতেও তার সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখেনি। এখন তরীর মনের অবস্থা সে বুঝলো না তবে আর ঘটলো না।

তাদের মাঝে নিরবতা কাটলো তখন যখন একটা বলিষ্ঠ হাত হুট করে কাসফির হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরলো, কড়া ম্যানলি পারফিউমের ঘ্রাণ আর জোর দেখে যা বোঝার কাশফি বুঝে নিলো। ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে তার রাগী স্বরে হাস্কি কন্ঠ শোনালো,

“কাল বাবা আতিকুর রহমানের বাড়ি গিয়েছেন, তোমাকে দেখেছিলেন?”

কাশফি হতবাক বনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল পরক্ষণে হুস ফিরে পেতেই দেখলো আশপাশের সবাই তাকেই দেখছে। তাই পরিস্থিতির সামাল দিয়ে মোচড়ামুচড়ি না করেই শান্ত কণ্ঠে বললো,

“তাতে আপনার কি?!”
কৌশিক এবার যেনো রেগে আগুন কাশফিকে নিজের একেবারে কাছে টেনে তার নরম গাল শক্ত করে চেপে ধরলো ফলে কাশফি তৎক্ষণাৎ চোঁখ কুচকে বন্ধ করে ককিয়ে উঠে।
“প্রশ্ন করছি ঠিক ঠাক জবাব দাও!”

কৌশিকের কণ্ঠে তেজ আর দেখে সে থমকালো না বরং তার দুই হাত দিয়ে কৌশিকের হাত খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আমাকে ছাড়ুন, সবাই দেখছে!”

“আমার বাবা তোমাকে দেখেছিল? তুমি তার সামনে এসেছিলে?”

কৌশিকের তুমি সম্মোধন তার বড্ড অচেনা তবে সে কথা বাড়ালো না তাই ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“দেখেন নি।”

“তাহলে কথা কিভাবে শুনলেন?”

“আমি উপরে ছিলাম”
এবার কৌশিকের হাত আলগা হয়। তবুও সে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি কাশফির দিকে রেখেই বললো— “তুমি বাবার সামনে কক্ষনো যাবে না।”

কাশফি দ্রুত সরে গিয়ে কৌশিক কে রাগানোর জন্য গা জ্বালা হাসি দিয়ে বলল,
“আপনার বাবা থেকে আমাকে কেনো লুকাতে চাইছেন মিস্টার মির্জা?”

কিন্তু কৌশিক রাগলো না, বরং গম্ভীর স্বরে বলল,
“কল মি কৌশিক। মিস্টার মির্জা আমার দাদা ছিলেন আমি না।”

কাশফি বিশ্রী রকমের একটা গালি দিয়ে চলে যেতে চাইলে কৌশিক তার হাত ধরে ফেলে, এতে কাশফি চোয়াল শক্ত করে শক্ত করে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ছাড়ুন!!!”

“জোভান কে না করে দাও!”
মুহূর্তেই কাশফি থমকে যায় যেনো। চৌকিত হয়ে সে বড় বড় চোখ করে একটা হিউমরলেস হাসি দিলো,

“বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আগেই, দুইদিন পর আমি তার ঘরণী হবো আর আপনি কোথাকার কে হয়ে নিজের মতামত রাখলেন?!”

“বড্ড জ্বালাতন করছো কাশফি। কথা দিলাম একবার বিয়ে করে নিই তোমার ব্যবস্থা নিজ হাতে করব।”

“ছিঃ আপনাকে বিয়ে কে করবে?”

“ছিঃ নয় ডার্লিং জ্বি হবে ওটা।”

“আর যাই হোক আমার বিয়ে জোভানের সাথেই হবে, এবার অন্তত বিরক্ত করা ছেড়ে দিন!”

“সুইটহার্ট, আমার এসবে তুমি মোটেও বিরক্ত হও না কাশফি, বরং তুমি বিরক্ত হতে চাও কিন্তু পারো না। এম আই রাইট?!”
কৌশিকের কথায় কাশফি শুকনো ঢোক গিললো, তার হাত পা ঘামাচ্ছে প্রচুর। আর এভাবে মানুষজন তার দিকে তাকিয়ে আছে এতে সে আরো নার্ভাস। সে মুখ শক্ত করে ঝাঁঝালো গলায় বললো,

“কত বার বলেছি আমায় ঈশিতা ডাকবেন, ঈশিতা!”

“এইযে, কি সুন্দর আমার কথা এড়িয়ে চললে তুমি!”

“ছাড়ুন!”

কিন্তু উল্টো কৌশিক তাকে কাছে টেনে তার তর্জনী দিয়ে কাশফির চিবুক উপরে তুলে কপালে প্রলম্বিত চুমু আকে, ততক্ষণে পরিবেশ ভয়ঙ্কর রকমের শান্ত।

“কাশফি, বিয়ে তুমি আমাকে করছো আর ঘরণী ও আমার হবে, দেখে নিও!”

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৫)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

“Are you having second thoughts.”
ইয়ারিংয়ের লুপ কানে লাগতে গিয়ে তার হাত থেমে যায়, আয়নার মধ্যে দৃষ্টি রেখেই উৎসুক হয়ে থাকা তরীর দিকে চাইলো। আসলেই তো তার এই বিয়ে নিয়ে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে অন্যত্র পালিয়ে যেতে কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। অন্তত সে তার বাবাকে মাথা হেট করে অপরাধীর ন্যায় শাস্তি দিতে চায় না।
হালকা কাজের ফিকে গোলাপি রঙের একটা ড্রেসের সাথে কানের দুল আর জুতো মিলিয়ে সে শেষবার নিজেকে আয়নায় দেখে নেয়। আজ তার এনগেজমেন্ট পার্টি, সুমন শিকদারের বড় পরিবার আর বেশ রমরমা ব্যাবসা। তাছাড়া জোভান বেশ নামকরা পার্সোনালিটি হওয়ায় আয়োজন ছোট করে করতে চাইলেও ফ্যামিলি ছাড়াও কিছুসংখ্যক লোকজনের ভিড় জমেছে বেশ। এটা নিয়েও তার মাঝে নার্ভাসনেস কাজ করছে প্রচুর।

“একটু বাইরে যাবি? আমার না একটু একা থাকা প্রয়োজন।”
কাশফির শুকনো কণ্ঠে তরী আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কেবল মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। কাশফি হেরফের না করে পার্স থেকে ফোন বের করে থ্যারাপিস্টের কাছে কল লাগলো। ডক্টর খান তখন বাসায় ফিরছেন মাত্র, কাশফির কল দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলেন।

“কোনো সমস্যা ঈশিতা?”

কাশফি চোঁখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে আজ জেনেই ছাড়বে তাই গড়গড় করে সব বলে দিলো,
“সে সফট বয়, আমাকে প্রচুর ভালোবসে কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসতে পারছি না। তার সাথে নিজের চলা ফেরা বড্ড বেমানান মনে হয়।”

ডক্টর খান বোধহয় চমকালেন, তিনি কিছুক্ষণ কোনো শব্দও করলেন না। কাশফির মনে হলো ডক্টর খান তার কথায় বিরক্ত হয়ে কেটে দিয়েছেন কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে ডক্টর খানের বিস্ফোরিত কণ্ঠ কানে এলো কিছুক্ষনেই,
“তুমি এসব তোমার এনগেজমেন্টের আগে বলছো?”

ডক্টর খান থেমে গিয়ে নিজেকে শান্ত করে আবার বললেন,
“তুমি যদি প্রেসারাইজড ফিল করো তবে লেট মি হেল্প ইউ বাই টকিং উইথ ইউর ফাদার।”

কাশফি অতি দ্রুত না জানিয়ে দিলো,
“না না প্লিজ এমন করবেন না, আমি চাই আমার ফিয়ন্সের সাথে মানিয়ে চলতে, প্লিজ আমাকে হেল্প করুন!”

“ওকে”
তিনি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
“তার প্রতি তোমার অনুভূতি কেমন?”

“তাকে নিরাশ করতে চাই না আমি তাছাড়া আর কিছুই ফিল হয় না।”

“সে তোমার প্রতি কেমন?”

“আমাকে জানতে ভীষণ আগ্রহী, ক্যারিং আর অনেক বছর আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করেন।”

ডক্টর খান গম্ভীর হয়ে রইলেন,
“দেখো ঈশিতা সাইকোলজির ভাষায় বলা যায় তোমার ইনার চাইল্ডটা ভালবাসা না পেতে পেতে অভ্যস্ত তাই সে এতখানি ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছে না। তার প্রতি তোমার দয়া হয় কারণ সে তোমাকে ভালোবেসেছে।”

“এসব ঠিক হওয়ার কি কোনো সুযোগ নেই?!”

“নেই বলবো না এটা অনেক লম্বা প্রসেস। যদি তুমি চাও তার সাথে থাকতে তাহলে ইউ হ্যাভ টু ফিগার আউট ফার্স্ট অ্যান্ড দেন টেইক থিংস স্লোলি (you have to figure out first and then take things slowly)।”

কাশফি কেবল শুনে গেলো, আর কিছুই বললো না। এদিকে ডক্টর খান তাকে চুপ থাকতে দেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করার জন্য ছেড়ে দিলেন। কাশফি তার মেয়ের মতই কেবল তার পেশেন্ট বলা যায় না। কল কেটে সে থ মেরে বসে রইলো, তার ভিতর নিরব ঝড় বয়ে চলছে।
ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়েছে অনেকটুকু ততক্ষণে দরজায় করাঘাত পড়লো।

“ঈশিতা, তুমি কি রেডি?”
কাশফি দরজার দিকে মাথা তুলে চেয়ে নিশ্চুপ রইলো কেবল। তার বাগদত্তা তাকে নরম স্বরে ডাকছে তবে তার তো বেরুতেই ইচ্ছে করছে না কিন্তু এখন তো আর সিদ্ধান্ত বদলানোর সময় না। কেনো এমন হতে হলো? কেনো সবকিছু তার গলায় আটকে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। নিজের মনের অবস্থা উপেক্ষা করে সে বর্তমান পরিস্হিতির উপর নজর দিলো। ফুল লেন্থ মিররের সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখে নিলো কয়েকবার, তারপর দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দরজা খুলে দাড়ালো।

কাশফিকে দেখা মাত্রই জোভানের মুখে অন্যরকম ঝলক, উপচে পড়া খুশি যাকে বলে। তৎক্ষণাৎ কাশফির ভিতরে খারাপ লাগা কাজ করলো। সে কি আসলে জোভানের মতো নরম মানুষটাকে ঠকাচ্ছে? এসব কি সিম্প্যাথি ছাড়া আর কিছুই না।
নিজেকে নিজের চোখে নিচু রকমের মনে হলো তার।

এদিকে জোভান কাশফির হাতে হাত রেখে নরম ভঙ্গিমায় ধরলো তার হাত, সে কাশফিকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এলো যেখানে মানুষজন কেবল তাদের অপেক্ষায়। কাশফির জন্য এতো গুলো চোঁখ এড়ানো সম্ভব হলো না, তার হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে তার পদক্ষেপ ও কেমন নড়বড়ে হয়ে এলো। তবুও নিজেকে কাম আর কালেক্টেড দেখিয়ে সে ড্রেস হালকা উচু করে ধরলো তারপর একটা একটা সিঁড়ি পেরিয়ে এলো। তার প্রতি পদে জোভানের সতর্ক দৃষ্টি আটকে ছিলো। এদিকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে না আসতেই করতালিতে মুখরিত হলো ভবন।
কিন্তু ততক্ষণে হতবাক বনে মূর্তির মতো খাড়া হয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকা কাশফির কানে তখন কোনো শব্দ এলো না, তার মস্তিষ্ক আগত বার্তাও সে অগ্রাহ্য করলো। টেম্পারেচার নাতিশীতোষ্ণ হওয়ার সত্বেও তার কপাল বেয়ে ঘামের ফোটা টুপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। চোখে মুখে তার স্পষ্টত আতঙ্ক, সারা শরীর কাঁপছে। যা দেখে জোবান কিছুটা ঘাবড়ে যায়।

“ঈশিতা তুমি কি ঠিক আছো?”
কাশফি জোভানের দিকে চাইলো না কেবল আগের দৃষ্টিতে চেয়ে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো। কৌতুহলী জোভান সেদিকে লক্ষ্য করে দেখলো কাশফির বাবা দাড়িয়ে আছে তাই সে আর কিছুই বললো না।
কিন্তু জোভান আতিকুর রহমানের পিছনে যে মেয়রের সাথে কৌশিক মির্জা দাড়ানো সেটাই দেখলো না।

অতঃপর জোভান হাঁটু গেটে বসে হাসি মুখে তাকে রিং পরিয়ে দিলো, এরপর উঠে দাড়িয়ে কাশফির হাতের অনামিকায় চুমু খেয়ে সেই হাত নিজের দুই হাতের মাঝে নিলো।
“ঈশিতা, তুমি কি আমার অনামিকা হবে?”

করতালি শব্দে বোধহয় কাশফি শুনলো না, নয়ত সে খেয়ালই রাখেনি। সে একরাশ ভয় নিয়ে, বাকশুণ্য হয়ে জোভানের পিছনে দাড়ানো কৌশিক মির্জার দিকেই চেয়ে রইলো। ফরমাল গেটআপে আর শক্ত মুখে বাঁকা হাসি রেখে কৌশিক মির্জা তার হাতের গ্লাস কিছুটা উপরে তুলে কংগ্রেটস জানানোর ভঙ্গিমা করলো।
তৎক্ষণাৎ কাশফি আরো ঘাবড়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে জোভানের দিকে তাকালো, তার এই মুহূর্তে হাত মুখ ধোয়ার প্রয়োজন। সব কেমন কাটার মতো লাগছে তার কাছে।

“আমার প্রচুর নার্ভাস লাগছে আমি কি উপরে চলে যেতে পারি?”
কাশফি দ্বিতীয়বারের মতো জোভানের প্রশ্ন এড়িয়ে চলায় জোভানের মনক্ষুন্ন হলো কিছুটা তবুও সে কাশফির কাঁপতে থাকা ঘর্মাক্ত হাত দেখেই তাকে উপরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

***

ভারী গয়না, লাল শাড়িতে সাজিয়ে বিয়ের আগ মুহূর্তেও নিজেকে সে এমন প্রশ্ন করতে বাধ্য, কেনো তার এত ভয় করছে কেনো?! যেখানে ছয়দিন আগেও লোকটা তাকে অবাক করে দিয়ে তার এনগেজমেন্টে এসেছিলো সেটা তাকে কাঁপিয়ে তুলেছে তবে কি ভালোয় ভালোয় সব হয়ে যাবে? হয়ত হ্যাঁ হয়ত না।
ফোনে শব্দ করে নোটিফিকেশন আসা মাত্রই ডিসপ্লেতে জোভানের ম্যাসেজটা জ্বলজ্বল করতে থাকলো,

“তোমাকে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।”
কাশফির কোনো অনুভূতি কাজ করলো না। সে একদৃষ্টিতে বড় জানালার বাইরে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিজেকে আশ্বস্থ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললো। মিনিট খানেক বাদেই তাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার বান্ধবীরা আর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয় এলো, সেও অনুভূতি শুন্য পা বাড়ালো।
মনে মনে বারবার আওড়ালো জোভানের নাম, নিজেকে কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলো আজ থেকে তার নাম জুড়ে যাবে জোভান শিকদারের সাথে।

বিয়ের আসরে মানুষ ভর্তি, চারপাশে হইহুল্লোড়, গান বাজনা। সবাই নতুন বউকে দেখতে ব্যাস্ত। এদিকে কাশফিকে স্টেজে বসানো মাত্রই কয়েক দফা গুলিগোলার শব্দে চারপাশ শান্ত হয়ে পিনপতন নীরবতা কাজ করলো, বেশ রমরমা পরিবেশ এখন নিস্তব্ধ।
স্নিগ্ধ হওয়ার মতি গতি উল্টে গেছে, বিপরীতে একপ্রকার শিরশির করে দেহ খান কাপিয়ে বইছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস উত্তরে প্রবহমান, ছিল হট্টগোল চারপাশ। কিছুক্ষণ আগেও বেজে চলেছিল সানাই, গান, বাজনা। জনমানবশুন্য শিকদার বাড়ির বিবাহ আয়োজনে রাস্তা ঘাট বেশ রমরমা, উত্তপ্ত পরিবেশ চারপাশ কিন্তু একজন মানুষের আগমনে যেন সব নেতিয়ে পড়েছে। সে কি..

কাশফি আতকে উঠে, তার বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো, যে জিনিসের ভয় ছিলো তাই কি হতে চলছে?
চোখের পলকেই পরিপাটি বেশভূষায় একদল সুঠামদেহী দল হাতে রিভলভার, পিস্তল আর শটগান নিয়ে ভিতরে ঢুকে কাশফির সামনে এসে দাড়ালো, কাশফির একজন চাচা চেচিয়ে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ তার দিকে বন্দুক তাক করা হয়, ভদ্রলোক সাহস হারিয়ে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যান।

বরযাত্রী চলে এসেছে তবে বর এখনও পৌঁছায় নি, এই মুহূর্তে সব অন্ধকার দেখা কাশফির একমাত্র ভরসা জায়গা বাবা মনে হলো। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও তার বাবাকে সে দেখতে পেলো না। বিদ্যুতের বেগে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে কৌশিক কাশফির সামনে এসে একটা হাসি দিল। তার শক্ত পেশল হাত দিয়ে আলতো করে কাশফির চোয়াল ধরে গম্ভীর সরে বললো,
“আমার আর তোমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আতিকুর রহমান আর জোভান শিকদার ফিরছে না ডার্লিং।”

কাশফি চোঁখ বড় বড় করে মানুষটাকে চাইলো, আশ্চর্য্য হয়ে হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে বোধহয়। তবুও নিজেকে অটুট রেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঝাঁঝালো শব্দ প্রয়োগ করলো,
“ঠিক কেমন ধরনের অমানুষ আপনি?!”

কৌশিকের কোনো জবাব এলো না সে একজন গার্ড কে ইশারা করা মাত্রই সে মাথা নেড়ে ঘুমন্ত কায়েসকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। হতবম্ব কাশফি এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো, তার চেঁচামেচি করে আহাজারি করাও কাজে আসলো না বরং কৌশিক মির্জা শক্ত মুখে কাজীকে বললো কাজ শুরু করে দিতে।
মাথা নেড়ে কাজী সাহেব ভয়ে ভয়ে পাঠ করতে শুরু করলেন, কাশফির আহাজারীতেও থামলেন না এদিকে কাশফির চাচা চাচী তাকে বোঝানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কিন্তু সে থামলো না। কাজী যখন কাশফির পুরো নাম উচ্চারণ করবেন তখন কৌশিক শুধুই ‘কাশফি’ বলে সম্পন্ন করতে বলল। কাশফি চোঁখে অশ্রু নিয়ে কৌশিক কে অভিশাপ ছুড়লো, পাঁচ বছর আগে খুন করতে দেখতে পাওয়া নিকৃষ্ট মানুষ নাকি তার স্বামী।

“যদি ঘৃণা থেকেও বেশি কিছু প্রকাশ করার জন্য কোনো জঘন্য শব্দ থাকতো তবে তা আমি আপনার জন্যই আমার অনুভূতি প্রকাশ করতাম।”

কৌশিক কিছুই বললো না, সে তার মুখ কাশফির থেকে হালকা দুরত্বে রেখে তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে হাস্কি কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“আমি পৃথিবীর একজন সবচেয়ে জঘন্য পুরুষ,
কৌশিক মির্জা আমার একান্ত নিরুপমা, কাশফিতে মত্ত।”

বন্দুক হাতে গম্ভীর মুখে থাকা কৌশিক থেমে গিয়ে চট করে কাশফির অনামিকা হতে জোভানের দেওয়া আংটি খুলে ফেলে আরেকটা হীরের আংটি পরিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বললো অবশেষে,
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

***

— তাদের অতীতের কাহিনী এখানে সমাপ্ত —

#চলবে…