অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-২৬+২৭

0
272

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৬)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী
(কঠোর ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

একসময় কিশোর কৌশিক শাহরিয়ার মৃন্ময় মির্জা মায়ের আঁচলে বড় হয়েছিল, ভীষণ রকমের মা ভক্ত ছেলে ছিলো সে, তার মা যা বলতো তাই, মায়ের কথার এক এক চুল অনড় হয়নি কখনো। একবার নখ কামড়াতে থাকা দুই বেনীওয়ালি লং নীল স্কার্টের একটা মেয়েকে তার মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়েছিল সেই হতে সে মেয়েটার নাম রেখেছিলো নীলাম্বরী।
নীলাম্বরী লোনার ছিল, খুব একটা করো সাথে মিশত না তার বান্ধবীটাও ছিল ভুতের মতো সেও করো সাথে মিশতে চাইতো না— আসলে সবাই তাদের এড়িয়ে চলতো। তাছাড়া পুষ্প কুঞ্জের বাচ্চা গুলো ছিল ইতর রকমের, তারা দুর্নাম রটিয়ে ছিলো যে এই বান্ধবী দুইজন নাকি কালো জাদু করতো। অথচ তাদের একেক জনের একেক ধরনের সমস্যার কারণেই তারা এমন ধরনের হয়ে উঠেছিল।
যখন নীলাম্বরীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তখন মনে হয়েছিল নীলাম্বরী ফ্যাচ ফ্যাচ্ করে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই পারে না। ধীরে ধীরে কৌশিকের সাথে তার বন্ধুত্ব হওয়ার পর নীলাম্বরীর তিনটি জিনিসের প্রতি দুর্বল জানতে পেরেছিল। পিয়ানো, ব্যালেট নৃত্য আর বাবার প্রতি নীলাম্বরীর অনুরাগ সুগভীর। ধীরে ধীরে নীলাম্বরীর প্রতি সে ঝুঁকে গেলো। এরপর নীলাম্বরী নামক মরণঘাতী নেশায় আটকে গেলো। তার মতো মানুষের কোনো দুর্বলতা ছিল না কেবল একজন ছাড়া,

“সে আমার ভক্তি আমার উপাসনা। সে আমার নীলাম্বরী।”

সেই নীলাম্বরীকে একবার খুইয়ে আবার পাওয়ার আকাঙ্খা সে বহু আগেই ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুশোচনা নীলাম্বরীকে না খোঁজা, সে যদি খুঁজতো তবেই সে নীলাম্বরীকে পেতে এত দেরি করতো না। ভাগ্য সহায় ছিল তাই পাঁচ বছর আগে একটা বিদঘুটে পরিস্থিতির মাঝে তাদের আবার দেখা হলো…
ঠিক তাদের যেভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল।
একটা মৃত্যু
একটা দুর্ঘটনা
তিনটা জীবনের ইতি
অতপর তাদের দেখা।

নীলাম্বরী যখন হারিয়ে গেলো তখন তার জীবন ছিল ফিকে ফিকে, রঙহীন। নাছোড় বান্দা সে তাই তো এখনো কাশফির মাঝে সে তার নীলাম্বরী কে খুজে পেতে চায়, হয়ত কোনো না কোনো দিন তার নীলাম্বরী সবটা মনে করে স্নিগ্ধ ভালোবাসা হয়ে ধরা দিবে। তার মতো অধমও একমাত্র বহুল কাঙ্ক্ষিত নারীর প্রতি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে। হয়ত কোনো এক দিন নীলাম্বরী তার জীবনের সকল কালো অধ্যায় পেরিয়ে আধার রজনীতে জোনাকি হয়ে তার সঙ্গ দিবে,
হয়ত।

সে মেইল চেক করে মুখভঙ্গি নিরপেক্ষ রেখে কেবল মাথা পাশে ফিরিয়ে তার ম্যাডামকে দেখে নিলো, মিসেস মির্জা আনমনা নখ দিয়ে নখ খোঁচাতে খোঁচাতে কিছু দৃঢ় রকমের চিন্তা ভাবনায় মশগুল। ছোট মাথায় হরেক রকমের খিচুড়ি পাকাচ্ছে বোধহয়। কপালে চিন্তার গাঢ় ছাপ, ঠোঁট গোল করে কড়া বিরক্তির ভঙ্গিতে রেখে সে একটা নিশ্বাস ফেলে মেরুদন্ড সোজা করে নেয়, আবার কিছু একটা ভাবতে ভাবতে মেরুদন্ড অসোজা ভঙ্গিতে এনে চোঁখ ছোট ছোট করে নেয়।

“এতো জোর দিয়ে কি ভাবছো?”

পাংশুটে মূখে কাশফি চোরা চোখে একবার কৌশিককে দেখে নিলো তারপর মাথা নেড়ে রুক্ষ কণ্ঠে বললো,
“আপনি সোজাসুজি বলে দিন, আমার থেকে আপনার কি চাই?”

কৌশিক নিরলস, ভাবুক ভঙ্গিতে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত দিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে কিছুটা হেলান দিয়ে বসলো। তার প্রাণহীন ধূসর চোঁখ জোড়ার মাদক দৃষ্টি পরিভ্রমণ করলো শাড়িতে জড়ানো ব্যক্তিগত নারীর মুখ হতে হিলে থাকা পা জোড়ায়। কি যেনো নাম?
কে বলেছে নীলাম্বরী পুরোপুরি বদলে গিয়েছে? সে আজও কাউকে বিশ্বাস করতে অজস্রবার ভাবতে নেয়। ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগতে হারিয়ে পারিপাশ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যায়। বোকা মেয়ে!

পাশাপাশি বসা ভাবুক কাশফি এখন আপাদত বিমূঢ়। প্রলয়ঙ্করী, গ্রাসকারী, ধূসর রঙের চোখের ভয়ংকর মাদক চাহনিতে সে আটকে গেলো, মনের ভিতর কিসের যেনো ছটফটানি, উত্তেজনা। তার হাঁটুদয় অনবরত ঝাঁকি দিয়ে চলছে সে। ততক্ষণে সে গুছিয়ে রাখা কথা গুলিয়ে ফেলেছে।

“তোমার এখনো মনে হয় আমি তোমার থেকে কিছু চাই?”

“তা নয়ত কি?”

“আজ বিলম্বিত বাসর বলেই কি যা চাইবো তা দিবে?”

কৌশিকের কণ্ঠে স্পষ্টত ধৃষ্টতা দেখে কাশফি থমকে যায়, কোনো পাল্টা জবাব না দিয়ে মাথা তৎক্ষণাৎ অন্যপাশে ফিরিয়ে নেয়। সে জানে তার যেকোনো বাক্যই হোক, কৌশিক ভালো করেই জব্দ করবে, তাই কথা বাড়ালো না। পৌঁছাতে পৌঁছাতে শেষ বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের দেখা মিললো পথে। তাদের গাড়ি এসে থেমলো মির্জা বাড়ির গেইটে সামনে, ড্রাইভার হাত বের করে কার্ড দেখিয়ে কোড চাপতেই গেইট খুলে গেলো। দুই ধারে খচিত ভাস্কর্য্যে সজ্জিত লোহার সিকিউরিটি গেইট খুলে সামনে এলো একটা বড় ঝর্না, আশেপাশে সবুজে সজ্জিত নানান জাতের ফুলের গাছগাছালি আর মাঝখানে ছোট্ট একটা পুকুর যেখানে জাপানিজ কই প্রজাতির বিচরণ। বিশাল মির্জা বাড়ির সামনে গাড়ি এগোতে এগোতে দেখা মিললো একটা ছোট্ট চোঁখ ধাঁধানো সজ্জিত কৃত্রিম লেকের।
কাশফির নজর অনড়, এতো স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সে স্তম্ভিত হয়ে স্তব্দ প্রায়, তবে খানিকটা পর খেয়ালে আসলো যে ছোট খাটো পাঁচ ফুট গড়নের একটা অল্প বয়স্ক মেয়ে জিন্স শার্ট পরে মির্জা নিবাসের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে, গাড়িটা দেখা মাত্রই নিমিষেই মেয়েটার অস্থিরতা কেটে ঠোঁটের ভাজে হাসি খেললো।

কৌশিক গাড়ি থেকে বের হতে না হতেই মেয়েটা জাপটে ধরলো। এতক্ষণ স্থির দৃষ্টি ফেলে কাশফি দেখেই চলছিল তবে কৌশিক হেসে মেয়েটাকে ধরা মাত্রই তার চোঁখ ছোট হয়ে কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। বিয়ে হতে না হতেই কৌশিক মির্জা রঙ বদলালো নাকি। কিন্তু কাশফির সন্দেহ মুছতে সময় লাগলো না।

“ভাইয়া… ভাবী কোথায়?”
কৌশিক চোখের ইশারায় গাড়ির দিকে তাকানো মাত্রই মেয়েটা ধৈ ধৈ করে গাড়ি পর্যন্ত এসে একই রকম ভাবে কাশফি কেও ঝাপটে ধরলো, এদিকে অপ্রস্তুত কাশফি গাড়ি থেকে নেমে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। টাল সামলাতে হিমশিম খেয়ে অনেকটা পিছনে হেলে পড়লো।

“লিয়া, সাবধানে!”
কৌশিকের গম্ভীর স্বরের সতর্ক বাক্য লিয়া কানেই তুললো না বরং সে কাশফির দিকে চেয়ে এক কপাট দাত দেখিয়ে বললো,
“আমি ক্যামেলিয়া, তোমার একমাত্র ননদ।”

অবাক কাশফিকে সামাল দিতে ততক্ষণে কৌশিক লিয়াকে টেনে সরিয়ে কাশফিকে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে ধরলো। কাশফি দেরী করলো না সেই হাত খপ করে ধরে বেরিয়ে পড়লো, তারপর কৌশিক অন্যপাশের দরজা খুলে কায়েসকে কোলে নিয়ে দাড়ালো। পরপর নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়ির ভিতর থেকে ফরমাল ড্রেসকোডে থাকা কিছু পরিচারিকা এসে তাদের লাগেজ ভিতরে নিয়ে যেতে লাগলো।

“ভাইয়া ভাবী কি ভয় পেয়েছে?”
লিয়ার ভোতা মুখ দেখে কৌশিক কে কিছু বলতে না দিয়ে কাশফি নিজেই বললো,
“না, আমি ঈশিতা।”

তৎক্ষণাৎ হেঁসে লিয়া কাশফির বাহু জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে হাটা ধরলো।

“তোমার ব্যাপারে তো আমরা সেই কবে থেকে জানি, আর ভাইয়া তো তোমাকে বিয়ে করবে বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। ”
দুই জোড়া পা ভিতরে প্রবেশ করার আগেই ভিতর থেকে ব্যাস্ত পায়ে কাব্য বেরিয়ে আসলো, কাশফির চোখে চোখ পড়া মাত্রই ভদ্রতামূলক একটা সালাম দিয়ে সে কৌশিকের কাছে গিয়ে দাড়ায়,

“বেরুচ্ছিস নাকি?”

“অফিসে বসতে হবে ভাই, আমি আসছি।”
মুখ শক্ত করে কাব্য এগিয়ে আসলো, কৌশিক কেবল তাকে দেখে মাথা নাড়লো। কাব্য জানে তার মায়ের স্বভাব তাই আগেই বিদায় নিয়ে ঝামেলা মুক্ত হওয়ার জন্য অফিসে ছুটছে।
বাড়ির ভিতর এসে কাশফির নভার্সনেস আরো বেড়ে গেলো, সোফায় দক্ষ হাতে শাড়ি আর ছিমছাম সাজে একজন মহিলা পরিচারিকাকে শক্ত কণ্ঠে কি কি যেনো নির্দেশ দিচ্ছিলেন তবে কাশফিকে দেখতে পেয়ে তিনি হাতের ঝাড়া দিয়ে পরিচারিকা কে যেতে নির্দেশ দিলেন। তার পাশেই একজন পুরুষ প্লাস পাওয়ারের কালো ফ্রেমের চশমা পরে সোফায় বসে মোটা একটা ফাইল পড়ছেন, তার চোঁখে মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট।
মহিলাটা হেঁটে এসে কাশফির সামনে দাড়িয়ে একবার তার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে নিলো। কৌশিক তত্পর, বউয়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাড়িয়ে তৎক্ষণাৎ তীব্র অধিকারবোধ দেখিয়ে খালি হাত কাশফির পিঠে রেখে বললো,
“উনি মাধবী, আমার ছোট মা।”

কাশফি মাধবীর চোখে চোখ রেখে সম্মানসূচক সালাম দিলো কেবল। এদিকে কৌশিক শক্ত চোয়ালে মাধবীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বিপরীতে চোঁখ ছোট ছোট করে মুখ শক্ত করে গম্ভীর হয়ে বললো,
“ছোট মা। মিট মাই ইকুয়াল, মাই বিলাভড ওয়াইফ মিসেস মির্জা।”

মাধবী কোনো কথা বললো না, মানুষকে যেখানে সেখানে হেনস্থা করা তার একটা বাজে স্বভাব। স্বভাবত মাধবী এমনই। কৌশিকের বড় ভাইয়ের বউ বিদেশি বলে তাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত মেয়র অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়েছেন। চতুর মাধবী কৌশিকের কথার ধাঁচ ধরে সন্তপর্নে দৃষ্টি নামিয়ে ভোতা মুখে অভিবাদন জানালো তারপর আগের ন্যায় সোফায় বসে পড়লো যেনো কিছুই হয়নি। কাশফি ভ্রু কুঁচকে শুধু দেখেই গেলো, অদ্ভুত!

***

কখনো ভেবেছেন ব্যাক ব্রাশ করা ভেজা চুল মুছতে মুছতে শক্ত চোয়ালের ধূসর চোখের মানুষটা শাওয়ার সেরে কোমরের খুব নিচে টাওয়াল পেঁচিয়ে স্লো মোশনে হেঁটে এসির পাওয়ার অন করে আপনার দিকে এগিয়ে আসবে, কিন্তু আপনি থমকে তার বিন্দু বিন্দু পানি জমে থাকা পেশল বুকের দিকে বেহায়ার মতো চেয়ে রয়ে কেবল বুকের মাঝে জমে থাকা পানির ফোটার ভি কাট এবডোমেন হয়ে স্কালপ্টেড এবস গড়িয়ে পড়া লক্ষ্য করতে এতটাই মগ্ন থাকবেন যে তার কাছে আসাটা পর্যন্ত টের পাবেন না।

“শাড়ি পাল্টে নাও কাশফি, গরম পড়ছে।”

এমন কিছু কাশফিও কখনো ভাবেনি। তার বুকের ভিতর বিরাজমান অস্থিরতা আর ভয়াবহ অ্যাড্রেনালিন রাশ তরঙ্গের বেগে সারা শরীরে প্রবাহিত হলো, তবুও সে কৌশিকের মুখের দিকে মাথা তুলে চাইলো না। সেই সাধ্য তার নেই! কেবল কৌশিকের চৌকশ এড্যাম অ্যাপলের দিকে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখলো।

“নাকি তুমি আমার আশায় ছিলে মিসেস মির্জা? Let’s be honest!”
তার হাস্কি কণ্ঠে ক্ষমতার প্রাবল্য, সিনিষ্টার রকমের ধূর্ত আমোদ। বাকহীন কাশফি মাথা তুলে তার স্বামীর পুরুষালি চোয়ালে খেলে উঠা ঠোঁটের ভাজের সূক্ষ্ম, চতুর, কার্মুক হাসি দেখে নিলো। কাশফির অস্থিরতা সীমা অতিক্রম করেছে যেনো, হুট করে এতো গরম কেনো লাগছে তার?! চোখ বন্ধ করে খুলে আবার মুখ শক্ত করে নেয়, কৌশিক কে সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগটা সে দিলো না।

“ফালতু কথা বলবেন না!”

“Are you nervous, sweetheart?”

“কী?— অবশ্যই না।”
কাশফির অমতা অমতা করে বলা কথায় কৌশিক মাথা ঝাঁকি দিয়ে বুক নেড়ে শব্দ করে হাসলো, আর সেই হাসির শব্দেই কাশফির ভিতর তোলপাড়। কি এমন ছিল সেই হাসিতে? কোনো হাজার বছর পুরোনো ওয়াইনের রিচ টেস্ট যেনো,
Sinful,
Intoxicated…

কৌশিকের মুখের কোণে দুর্লভ হাসি কমলো না। সে অল্প অল্প করে হেঁটে এগিয়ে আসলো কাশফির কাছাকাছি, তার মিন্ট ফ্লেভারের গরম নিশ্বাস ছেয়ে গেলো কাশফির মুখমন্ডল।

“Don’t worry, যতদিন না তুমি আমাকে নিজ থেকে ডাকছো আমিও কিছু করছিনা।”

কৌশিকের তীরের মতো মারাত্বক চাউনিতে কাশফি খুন হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সুযোগ বুঝে কৌশিক আঙ্গুল দিয়ে কাশফির মুখ তুলে তার চোঁখে চোখ মিলিয়ে নিলো। সন্তপর্নে কাশফির চুল তার আঙ্গুল দিয়ে পিছনে সরিয়ে দিয়ে কানের কাছটায় ঠোঁট এনে হাস্কি স্বরের নিচু গলায় উচ্চারণ করলো,

“Not until you beg for it, sweetheart.”
কঠোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে কাশফিকে অনুভূতির তুষার ঝড়ে ঠেলে সে কাশফির কোমর ধরে কাছে টেনে নেয়, যেনো নিজের মাঝে আড়াল করতে পারলেই হলো। পেশল শক্ত হাতে তার নরম গাল উচু করে ধরে ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট মিলিয়ে সিক্ত করে নিলো। শুধা শুষে নিতে ব্যাস্ত কৌশিকের হাত সেখানে থেমে নেই বারবার কাছে টেনে নিয়ে উপর নিচে এলোমেলো ভাবে পরিভ্রমণ করছে। বিক্ষিপ্ত রকমের অনুভূতির সাগরে তার মন আর মস্তিষ্কের সংঘর্ষ চলছে। অনুভূতির গভীরতায় হাবুডুবু খেয়ে নিজের অজান্তেই কাশফির হাত কৌশিকের কলার আর মাথার পিছনে চলে গেল। চোখে মুখে ধৃষ্টতার ছাপ রেখে দাঁত চেপে তার ওষ্ঠ নিজের কাছে টেনে নেয়। তার নারী তনুমন বেসামাল করে কৌশিক মিলিত ঠোঁট আলগা করে তার ঠোঁটের কোণ উচু করে বাঁকা হাসি হাসলো।

“মনে রেখো, কাশফি।”

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে কাশফি আর এক মুহুর্তও দাড়ালো না। মুখ বেজার করে কম্পিত হাতে পুরো কাভার্ড খুঁজে শাড়ি ছাড়া অন্য কিছুই পেলো না। এক পাশে কৌশিকের অল্প কয়েকটা সুট, শার্ট আর অন্যপাশে সুতির শাড়ি। কাশফি খুঁজতে খুঁজতে একটা সেলোয়ার কামিজ পর্যন্ত পেলো না, শাড়ি পরতে পরতে সে বিরক্ত। এই কয়েকদিন কম তো পরে নি।
ততক্ষণে কৌশিক গ্রে ট্রাউজার আর শার্ট পরে রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে কর্মরত। তাকে দেখামাত্র তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। তখন তো বড় মুখে বলেছিল করো সামনে শাড়ি পড়তে বারণ! কাশফি একবার ভাবলো কৌশিককে রুম থেকে বের হওয়ার কথা বলবে পরক্ষণে আবার ভাবলো ‘কৌশিক মির্জাকে যা বলি তা কি সে শোনার মানুষ?’ লজ্জার কবলে পড়ে মুখ থেকে টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। পরক্ষণে মুখ বেঁকিয়ে শাড়ি হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

কৌশিক ততক্ষণে কাজ সেরে পকেটের ফোন বের করে কম্পিউটারের সাথে কানেক্ট করে নেয়। নিখুঁত হাতে গাঢ় মনোযোগী হয়ে সে কোডিং এ মনোনিবেশ করলো। অতঃপর কাজ শেষ হওয়া মাত্রই মুখে রহস্যময় হাঁসি ঝুলিয়ে একটা ক্লিক করার সাথে সাথেই কিছু ইমেইল আর টেক্সট মেসেজ সো করলো। সেখানে জোভানের আবেগ আপ্লুত মেসেজ দেখে কৌশিক শক্ত মুখে ডিলিট ক্লিক করতে গিয়েও করলো না। লাস্ট টেক্সট মেসেজ ছিলো কাশফির বন্ধু বান্ধবীদের থেকে পাওয়া আর লাস্ট ইমেইল ডক্টর খানের উদ্দ্যেশ্যে লিখা,

“From: ishitaimroz*@gmail.com
To: yahiyakhan*@gmail.com

ডক্টর ইয়াহিয়া খান,
আপনার ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী আমি নিজের উপর কোন রকম চাপ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছি। আশানুরূপ আমার মেন্টাল হেলথ বেশ ভালোই চলছে তাই আমি আমার নেক্সট সেশনেই হিপনোথ্যারাপির (hypnotherapy) প্রসেস শুরু করতে চাই। এই মাসে আপনার স্ক্যাজওলে(schedule) আমাকে রাখতে ভুলবেন না। আমি শীঘ্রই ফিক্সড ডেট আর টাইম মেইল করে পাঠাবো।

Warm Regards,
Ishita Imroz”

কৌশিক অনেকক্ষণ কিছু একটা ভাবলো তারপর পকেট থেকে ডক্টর খানের কার্ড বের করে ডাস্টবিনের ঝুড়িতে ফেলে দিলো। যা হওয়ার সে হ্যান্ডেল করবে, তাছাড়া সেও জানতে চায় তার বউ কতদূর যেতে পারে। ফোন পকেটে রেখে উঠে দাড়িয়ে পা বাড়ায় রুমের দিকের সেলফে। কিছু বই সরিয়ে কোড চেপে হিডেন লকার খুললো। লকারের ভিতরে কালো একটা ফাইলে বোল্ড লেটারে লিখা,
‘Ariana Mehnaaz Kashfi’
কৌশিক সেই ফাইলের উপর তার ল্যাপটপ রেখে আবার লক করে আড়াল করে ফেললো।

ততক্ষণে কাশফি মেকআপ মুছে, অর্নামেন্ট খুলে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। তার পরনে কলিজা কালারের একটা শাড়ি, কৌশিক দেখে যতটা উপভোগ করলো ততটা বিরক্ত ও হলো। তার মতো মানুষের সাথে কথায় কথায় ঘাড়ত্যারামী বড্ড বেমানান।

“ভীষণ অবাধ্য হয়েছো তুমি!”
আচমকা কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কাশফির লোম দাঁড়িয়ে গেলো। নিজের দিকে চেয়ে ভ্রু উচু করে খানিকটা বিরক্ত বোধ করলো।

“আশ্চর্য, আমি তো শাড়ি ছাড়া তো আর কিছুই দেখতে পাইনি!”

“এতো বড় ক্লোসেটে আমি মাত্র গুটি কয়েকটা শাড়ি রেখেছি, অথচ টপস জিন্স, শার্ট, কামিজ কিছুই তুমি দেখলে না?”

“ক্লোসেট? আমি তো কাভার্ড থেকে নিয়েছি…”

কৌশিক দুই আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষে, তাকে চোখ দিয়ে শাসিয়ে দিলো। তার রুমের ইন্টারকমে নাম্বার চেপে কাঠকাঠ নির্দেশ দিলো দুটো ডিনার প্লেট তাদের রুমে নিয়ে আসতে। শোনা মাত্র কাশফি বিমূঢ়, এসব তার ঘরের মানুষ দেখলে কি বলবে তাদের। তাছাড়া কৌশিকের সাথে একরুমে এতক্ষণ ছিল সেটাই ঢের, এতটা অস্বস্তি নিয়ে কি থাকা যায়! তাই তরিখড়ি করে বললো,

“আমি নিচে সবার সাথে ডিনার করবো!”

কৌশিক তার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
“শাড়ি পরে? অসম্ভব!”

“আমি পাল্টে নিচ্ছি।”

দ্বিতীয়বার অবাধ্য হওয়ার কৌশিক বাজে রকমের চটে গেলো। পা বাড়িয়ে কাশফির পারসোনাল স্পেসটুকু ঘুচিয়ে থমথমে গলায় উচ্চারণ করলো,
“এখন আমি তোমাকে শাড়িতে দেখতে চাই তাই চুপচাপ বাধ্য বউয়ের মতো আমার কাছে এসে বসো!”

“পারবো না!”

“কিছুক্ষণ আগে শুধু ডেমো দেখিয়েছি। কথার বাইরে গেলে আমিও তবে আজ রাত কন্ট্রোল করতে পারবো না!”

কাশফি থতমত খেয়ে গেল, কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই তার মুখ লাল হয়ে তার সাহস কিছুটা নেতিয়ে গেলো। পানি থেকে তোলা মাছের ন্যায় ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে তার মুখ হা হয়ে আসলো। কৌশিক ইতর মির্জার মুখে যেদিন লাগাম হবে সেদিন সে নিজেও কৌশিকের বাধ্য হয়ে যাবে, যে দুটো জিনিসই অ স ম্ভ ব!
তেতো হয়ে তার নরম গলায় জোর দিকে আঙুল নিচের দিকে ইশারা করে বললো,
“আপনি আমার সাথে নয়, নীচে ঘুমাবেন!”

“আমার বেডে, আমি ঘুমাবো। তোমার পারমিশন কে চাইলো?”

“সোফা তো আছে নাকি? এছাড়া রুমের অভাব তো পড়ে নি!”

“আমি নিচে, সোফায়, বেডে কিংবা রুমের বাইরে ঘুমালেও তুমি আমার সাথে ঘুমাবে সেটা নিশ্চিত থেকো।”

দাঁত কড়মড় করে কাশফি বিনাবাক্যে তৎক্ষণাৎ কৌশিকের পাশে বসে পড়লো। তাদের ডিনার রুমে আনা হলে কাশফী পাংশুটে মূখে দ্রুত ডিনার সেরে ব্রাশ করে বেডের মাঝ বরাবর শুয়ে পড়লো। কৌশিকও নাছোড়বান্দা নিজের কথার হেরফের হলো না। সে কাশফির নরম দেহে নিজের শক্ত, ভারী, পেশল, পাকা পোক্ত গড়নের শরীর এলিয়ে দিয়ে কাশফি কে কাছে টেনে শুয়ে পড়লো।
বিচলিত হয়ে গেলো কাশফি, রাগে চিৎকার করে কুনুই দিয়ে গুতো দিতে গেলেও কৌশিকের শক্ত বুকে কোনো ব্যথাই লাগলো না। শিক্ষা হওয়া মাত্র তীব্র বিরক্ত নিয়ে সে ফাঁকফোকর পেয়ে কৌশিক থেকে এক হাত দূরে অন্য পাশ হয়ে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।

***

কৌশিকের রুমের বড় জানালার পর্দা ভেদ করে সকালের সোনালী আলো এসে পড়লো বিছানায়, সকালের আদুরে মিষ্টি রোদ্দুরে রুমটা ঝলমল করছে। এলোমেলো হয়ে থাকা বিছানায় শক্ত দেহের ভাজে নরম দেহ গুটিশুটি মেরে আঁটসাঁট হয়ে আছে। পুরুষালি বলিষ্ঠ বাহু বেষ্টিত করে রেখেছে মসৃণ নগ্ন কোমর, ঘুমন্ত অবস্থায়ও তার তীব্র অধিকারবোধ। ভারী শরীর এলিয়ে রমণীর গলার ভাজে মাথা রেখে বড়বড় শ্বাস ফেলে ঘ্রাণ শুষে নিলো, শাড়ির আঁচলের অবস্থান কিছুটা উপরে তো বাকিটা ঝুলছে।
তলপেটের নীচে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে কাশফি পিটপিট করে চোখ খুললো, ঘুম পুরোপুরি ছুটতেও সময় নিলো না। কৌশিকের এক হাত কোমরে মোটামুটি ডিসেন্টলি অবস্থায় থাকলেও অন্যহাতের অবস্থান তার বুকে, হাতের অবস্থান বর্ণনায় বলা চলে এমন ভাবে তার বুকের উপর রেখেছে যেনো তার মহা মূল্যবান জিনিস করো হাতে না লাগার জন্য এতো সতর্কতা। কৌশিকের কোমর পর্যন্ত নগ্ন হয়ে আছে পরনে কেবল গ্রে ট্রাউজার ছাড়া আর কিছুই নেই।
হতবিহ্বল কাশফির শিরদাঁড়া বেয়ে হিম শীতল শিহরণ বয়ে গেলো, সারা শিরশির অনুভূত হলো। বুঝতে পারলো তার দেহ অস্বাভাবিক রকমের কাপছে, বুকের ওঠানামা বেগাতিক। তার গলায় কৌশিকের নাক আর উষ্ণ নিঃশ্বাসের বিচরণে ওষ্ঠদয় কেঁপে তার মাঝে ভয়াবহ ঝড় তুলে দিলো। নিজের অস্থিরতা বিবেচনায় না নিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছুটা সরে আসার চেষ্টা করায় কৌশিক আগের ন্যায় রয়ে আরো শক্ত করে ঝাপটে ধরলো। ততক্ষণে আবার সেই শক্ত উষ্ণ কিছুর অনুভূতি আবার হলো, সে বার বার সরতে চাওয়াও একই ঘটনা ঘটলো। বিরক্ত হয়ে কৌশিককে ডেকে তুলার আগেই বুঝেতে বাকি রইলো না কাশফির। উপলব্ধি হওয়া মাত্রই নিশ্বাস আটকে রণমূর্তি ন্যায় সটান হয়ে রইলো। ততক্ষণে কৌশিকেরও ঘুম ছুটে গিয়েছে, নিজের অবস্থান দেখে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বরং কাশফির দিকে চেয়ে তার পুরুষালি সকালের ঘুমু ঘুমু কর্কশ স্বরে বললো,

“সকালে এমন ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
কাশফি আড়ষ্ট হয়ে রইলো, তার গালে গলায় লজ্জার ছাপ। কৌশিক সোজা হয়ে বসে গলা খাকরি দিয়ে আবার ভারী গলায় বললো,

“ইটস ন্যাচারাল টু রিয়াক্ট —”

“থামুন প্লিজ!!!”
কাশফি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়লো। তার পর চোয়াল শক্ত করে কৌশিকের দিকে চেয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
“আমি আর শুনতে চাই না!”

কৌশিক মাথা নেড়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো, কিছুক্ষণ আগের লজ্জা জনক পরিস্থিতি এবার কাশফি নিজের চোখেই দেখে নিলো। বিব্রত পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে মুহূর্তেই মাথা অন্য পাশে ফিরিয়ে তড়িৎ গতিতে ক্লোজেটে ঢুকে পড়লো। ঢুকার আগে আবার কৌশিকের আমোদিত গলার ভারী স্বর শোনা গেলো,

“Blame yourself, sweetheart. এই পরিস্থিতির জন্য একান্ত তুমি দায়ী।”

কাশফি নিজের কপাল চাপড়ে দুই হাতে চোখ মুখ ঢেকে নিলো। কি অসভ্য,
বেহায়া কোথাকার!!!

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২৭)
#প্রোপীতা_নিউমী

ক্যাফে ব্লু হ্যাভেনের পার্কিং এরিয়ায় সাদা টয়োটা থামতেই হনহনিয়ে রঙ চটা টিশার্ট, উসখো খুশকো চুলে ড্রাইভিং সিট হয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসলো জোভান শিকদার। কালি পড়া চোখে রক্ত জমে আছে, রাগে গজগজ করতে করতে লা থি মেরে খুললো ক্যাফের দরজা। মুষ্ঠিমেয় হাতে চোখ বুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে টেবিলগুলো দেখে খুঁজে নিলো তাকে,

নীল পাঞ্জাবি পরে পায়ের উপর পা তুলে ভদ্র কাদায় কফির কাপে চুমুক দিলো কৌশিক মির্জা। তার পাশে মাউথ এন্ড ইয়ার পিস লাগিয়ে লেভিন সোজা দাঁড়িয়ে হাতের প্যাড ঘেঁটে কৌশিককে কিছু বলতে ব্যস্ত তবে তার ইন্দ্রিয় সজাগ। কিছু একটা আন্দাজ করা মাত্রই সে প্যাড থেকে মাথা তুলে জোভানের চোখে চোখ ফেললো। তারপর খুব দ্রুত অনিমেষ নেত্রে লেভিনের ভাবভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলো, তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে জোভানকে দুইদিন আগের কথা মনে করিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ জোভানের গায়ের ঘায়ে নুন লাগার মতো মনে হলো।

তার আর কাশফির বিয়ের দিন সে আর তার পরিবার বাসা হতে ঠিকই রওনা হয়েছিলেন কিন্তু গাড়ি ভুল জায়গায় এসে দাঁড়ায়, বিয়ের আসরে কনে দেখে সে থতমত খেয়ে গেলো পরে গ্যাঞ্জাম বেঁধে যাওয়ায় বুঝতে বাকি রইল না যে সেখানকার বর অন্যকেউ ছিল। বরযাত্রীর গাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা বিপত্তি বাঁধলো, বরের গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে উধাও, এদিকে বরের গাড়ির ড্রাইভার যে ছিল সে গাড়ি চালিয়েছিল বলে অস্বীকার জানালো। পরে জানতে পারলো ড্রাইভার অন্যকেউ নয় কৌশিকের রাইট হ্যান্ড লেভিন আফসার ছিল বলেই ছলে কৌশলে সকলের অগোচরে এত সুন্দর করে কার্য সাধন করেছে। কিন্তু তখন অতি বিলম্বে অঘটন ঘটে গিয়েছিল তবুও মনের জোরে জোভান পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে বিশ মিনিটে এসে পৌঁছায়, ভেন্যু তে হাজির হয়ে সব কিছু এলোমেলো দেখে সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো।
সেইদিন বহুবার কাশফির নাম্বারে কল করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। শরীর এতটাই খারাপ হয়েছিল যে তার হাত পা অবশ হয়ে এসেছিল। অসুস্থ, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সে পরের দিন কাশফির বাড়িতে গিয়ে খালি বাড়িটায় শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা আতিকুর রহমানকে পেল কেবল।

লেভিন খানিকটা ঝুঁকে কৌশিকের কানে কিছু একটা বলেই অতি দ্রুত প্রস্থান করলো তবে যাওয়ার পূর্বেও জোভানের উদ্দ্যেশ্যে তার মুখের হাঁসি আরো প্রকট করে নিলো। কৌশিক তার ফোন পাঞ্জাবির পকেটে রেখে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়, তারপর মাথা না তুলেই আবার কফির কাপে চুমুক বসায়। এদিকে জোভান ফুঁসতে ফুঁসতে এসে কৌশিকের টেবিলে এসে জোরে শব্দ করে হাত রেখে চ্যাচালো,
“খুব শখ না তোর আমার জিনিসে বাড়াবাড়ি ধরনের আগ্রহ রাখার?!”

উপস্থিত ক্যাফের সকলেই ঘাড় ঘুরিয়ে মনোযোগ কৌশিকের টেবিলে রাখলো, ক্যাফের ভিতরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা তবুও কৌশিক সুধীর এবং নিরূদ্বেগ। তাকে কেবল কফির কাপের রিমে আঙ্গুল ঘুরাতে দেখা গেলো। এতে জোভানের মেজাজ আরো বিগড়ালো, নিমিষেই হাত দিয়ে এক ঝাটায় টেবিল হতে কাপ আঁচড়ে ফেলে ভেঙে টুকরো করে ফেললো।

“ওই অ’জা’ত, কথা কি কানে যাচ্ছে না?”

কৌশিকের কান খাড়া হয়ে এলো, মাথার রগ ফুলতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হাত জোড়া মুষ্ঠিমেয় করে তির্যক দৃষ্টি ফেলে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারায় বসার জন্য দেখলো। তারপর কৌশিকের নিচু স্বরের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বসে কথা বল জোভান শিকদার।”

জোভান শুনলো না বরং আরো কয়েকটা গালি গালাজ করে ক্ষান্ত হলো।
“শু য়ো রের বা’চ্চা কি করেছিস ঈশিতার সাথে? কোথায় আটকে রেখেছিস?!”

কথা গায়ে মাখলো না সে। ভাবলেশহীন ভাবে শ্রাগ করে জবাব দিল কৌশিক,
“আমার নতুন বউ যেহেতু আমার সাথে নেই অবশ্যই আমার বাড়িতে থাকবে, Where is your common sense?”

“তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিস, আবার সাহস কি করে হয় বউ বলার?! তোকে আমি খুন করবো খুন!”

একটা তপ্ত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো কৌশিকের, চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তির ভাবভঙ্গি প্রগাঢ় করে নিলো। তারপর বুকে হাত ভাঁজ করে নিয়ে বিরস কণ্ঠে বললো,

“মিসেস মির্জাকে কবে থেকে চিনিস? তিন দিন? তিন মাস? তিনবছর? কিন্তু আমার আর তার সম্পর্ক এক যুগের চেয়েও পূর্বের। তাহলে বল তুই কে রে? কেনো কানের কাছে প্যান প্যান করছিস?!”

ক্রুদ্ধ হয়ে তেজস্বী গলায় উত্তর দিলো জোভান,
“আমি কে?! ঈশিতাকে আমি ভালোবাসি, সেও আমাকে পছন্দ করে!”

“আতিকুর রহমান তোকে পছন্দ করেছিল আর ঈশিতা তার বাবা বাবার বাধ্য মেয়ে বলেই টু শব্দ করেনি।”

“তোর বলা একটা কথাও আমার বিশ্বাস হয়না কৌশিক। শি হেইটস ইউ এন্ড আই নিড টু টক উইথ হার!”

জোভানের জোরালো ডিমান্ডেও কৌশিক অনড় রইলো। চোয়াল শক্ত করে বিরক্তিমায় চোখ উল্টে নেয় তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একটা কল রেকর্ডিং অন করলো। জোভান ভ্রু কুঁচকে বিচলিত হলো, রাগে আরো কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই ফোনে তাদের এঙ্গেজমেন্টের দিনের কাশফির আর ডক্টর খানের কথোপকথন শোনালো। পুরো কথপোকথনে কাশফিকে বেশ নার্ভাস আর গিল্টি শোনালো। কথপোকথন কি নিয়ে সেটা বুঝার পরপরই জোভান স্তব্ধ, শুন্য চোখে শুধুই শুনে গেলো। তার বুক চিরে হাহাকার আর বেদনা অক্ষিপটে ভাসা ভাসা প্রকাশ পেলো কেবল। পুরোটা রেকর্ডিং শোনার পর জোভান বিপর্যস্ত অবস্থায় বসে পড়লো চেয়ারে। মাথা নিচু করে চুল খামচে ধরতে ধরতে ভাবলো দরদ না দেখিয়ে মেয়েটা যদি তাকে জানাতো তবে কষ্ট কম হতো বোধহয়।

“She was meant to be mine. Now and always.”
আঙ্গুল তুলে প্রমাণ সহযোগে প্রকট অধিকার দেখিয়ে কৌশিক ক্ষ্যান্ত এবং পুরোদমে সন্তুষ্ট।

নির্দয় কৌশিকের কোনো খারাপ লাগা কাজ করলো না, বরং সে বুক ফুলিয়ে একটা তৃপ্তির হাসি দিলো। বের হতে উঠে দাড়িয়ে পড়লো তারপর ফোন পকেটে ঢুকাতে যাবে তার আগেই একটা মেসেজ দেখলো স্ক্রিনে। মেসেজ শো করতেই সে একটা ছবিতে সে রেস্টুরেন্টে বসা এক উদ্ভট দেখতে পুরুষ আর কাশফিকে দেখতে পেলো।
চোয়াল শক্ত করে কৌশিক বেরিয়ে পড়লো, ব্যাস্ত গতিতে গাড়িতে উঠে দ্রুত কল লাগিয়ে তার অ্যাসিসটেন্টকে শুধু এক বাক্যে বললো সে অফিসে আসছে তার মিটিং অ্যারেঞ্জ করতে।

তার পাশে রোবটের ন্যায় বসা লেভিন প্যাডে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছিল। কৌশিক চোখ বন্ধ করে মাথা পিছনে এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সোজা হয়ে রইলো। তার স্কাল্পটেড পুরুষালি তীক্ষ্ণ চোয়াল শক্ত করে নেয় পরপর কনুই হাঁটুতে রেখে হাতদুটো জড়ো অবস্থায় মুষ্ঠিমেয় করে চিবুকের নিচে তুলে ভাবুক ভঙ্গিমায় ধরলো।

“লেভিন, আমাকে এই মুহূর্তে লোকটার ব্যাপারে সব ডিটেইলস বলো।”

লেভিন প্যাড থেকে মাথা না তুলেই তার বলিষ্ঠ রুক্ষ কণ্ঠে গড়গড় করে বলে গেলো,
“রবার্টের আসল নাম মিনহাজ করিম। সে একজন সরকারি গুপ্তচর ছিলো, মোটা অংকের টাকা খাওয়ায় বরখাস্ত করা হয়েছিল তাকে। তারপর থেকে রবার্ট প্রাইভেট গুপ্তচর হিসাবে নিয়োজিত আছে। তার কাজ ভালো তবে বর্তমানে ডিমান্ড খুবই কম। তার বাবা মা জীবিত নেই, স্ত্রী ছিল তবে সে তার এক ধনী ক্লায়েন্টের সাথে পরকীয়ার লিপ্ত হয়ে তাকে তালাক দিয়ে সেই ক্লায়েন্টকে বিয়ে করে নেয়। মিসেস মির্জা আজ সকালে সেখানে মূলত আপনার প্রাইভেট স্কুলগুলোর ডোনেশন আর শেয়ারস নিয়ে যাবতীয় তথ্য জানতে রবার্টকে হায়ার করেছেন।”

কৌশিক চোখ বন্ধ করে মাথা নড়লো,
“তোমার ম্যাডাম তাকে কত টাকায় সাইন করেছেন?”

“এক লাখ। Command me boss, রবার্টকে তুলে নিতে দেরি হবেনা।”

কৌশিক ডিসমিস ভঙ্গিতে হাত তুলে মাথা নাড়লো। একটা গেইম যদি শুরুতেই শেষ করে দেওয়া হয় তবে মজা কিসের? উত্তেজনা কাজ করুক সে তো আছেই। এমনিতেই কাশফিকে দমানো সম্ভব না। অতীত যে করেই হোক কাশফি জানবে, আজ হোক কাল। সে চায় তার বউ সন্ধান করুক, যতদূর চায় সে যাবে সমস্যা নেই। তবে তাকে আড়ালে রেখে নয়, তাকে আর নেমসিস রেখে নয়।

“আমি তোমার ম্যাডামের শুভাকাঙ্ক্ষী, আশা করি সে যে কাজ করছে সেই কাজে সফল হোক।”

***

কোনো রকম রুমে প্রবেশ করে গায়ের ওড়না ফেলে এসি অন করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো কাশফি। এই খা খা রোদ্দুরে রিক্সা করে আসা যাওয়ায় ঘেমে নেয়ে আর গলা শুকিয়ে চৌচির। গরমে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে, এদিকে চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্লান্ত সে। কম কথা বলার দরুন খুব একটা মানুষের সাথে মিশতে অনিচ্ছুক সে। আর আজ তো বিরক্তিই চলে এসেছিল। কিছুক্ষণ আগে কাজের সূত্রে এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে রবার্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।

সেখানে গিয়ে প্রচুর উদ্ভট রকমের একজন লোক দেখতে পেলো সে, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে বোধহয়। দুই কানে, কানের লতিতে, নাকে, চোখের ভ্রূদ্বয়ে পিয়ার্সিং করা তার। চুলে ব্লন্ড সেড করার জন্য ব্লিচ করেছিল বোধহয় কিন্তু ব্লন্ডের পরিবর্তে চুল গুলোতে ঝাড়ুর মতো রং হয়ে আছে। বয়সের সাথে তার পোশাক আশাক বড্ড বেমানান। কাশফি টেবিলের সামনে এসে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললো,
“রবার্ট?”

সাথে সাথেই লোকটা তাকিয়ে কেমন অদ্ভুত হাসি হাসলো,
“ওয়ান এন্ড অনলি, বিউটিফুল। আর তুমি?”

“আমি সামিয়া।”
ফট ফট করে মিথ্যা কথা বলতে কাশফির এক মুহুর্ত ও লাগলো না।

“কিছু অর্ডার করিনি কারণ আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, প্লিজ।”

কাশফি মাথার ঘোমটা আরো কিছুটা টেনে ব্যাগ টেবিলে রেখে বসতে বসতে বললো,
“আমি খেতে বসিনি রবার্ট, মূল কথায় আসি। আমি কৌশিক মির্জার শেয়ারস নিয়ে ডিটেইলস জানতে চাই।”

“এমপির ছেলে কৌশিক মির্জা?”

“জ্বি।”

“কেনো?”

প্রশ্ন করার ধরন দেখে কাশফি আরো বিরক্ত, মেজাজ খারাপ করে লাভ হবে না তাই চোখ পাকিয়ে থমথমে গলায় জানালো,
“ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করার প্লেসে আপনি নেই মিস্টার রবার্ট।”

“My, My, আমি আসলেই জানতে ইচ্ছুক এতো সুন্দর মেয়ে কৌশিক মির্জা নিয়ে কেনো ইন্টারেস্টেড!”

“Stay out of my business.”

“ক্লায়েন্টের সাথে সিভিলভাবে কথা বলতে চাইছি, এসব জানতে হবে। হোপ ইউ এঞ্জেইজ উইথ মি।”

কাশফি মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ বের করে, তারপর মুখ বেজার করে গম্ভীর গলায় বানোয়াট মিথ্যা সত্য সাজিয়ে বললো,
“সে আমার এক্স, but we are over the phase.”

“আসলেই…?”

“So over, রবার্ট। এখন কাজের বিষয়ে আসি?”

“অবশ্যই।”

“গত ১০ বছরে কৌশিক মির্জার যতগুলো প্রাইভেট স্কুলের ডোনেশন আর শেয়ার্স কিনেছে তার সকল তথ্য আমার চাই। বিশেষ করে পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী নামের প্রাইভেট স্কুল নিয়ে আমি আগ্রহী। তাছাড়া আপনাকে আমি পঞ্চাশ হাজারে সাইন আপ করছি, কোনো এডভ্যান্স ছাড়া।”

“মাত্র পঞ্চাশ হাজার? আমি কি অত সস্তা?!”

“দেখুন রবার্ট, You need me more than I need you.”

কাশফির স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড জবাবে রবার্ট থতমত খেয়ে গেলো। অপমানে কড়া কিছু একটা বলবে তার আগেই কাশফি আবার বললো,
“হ্যাঁ নাকি না? আমি অপেক্ষা করছি, আপনি কাজ করতে অনিচ্ছুক হলে আমার আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করা বাকি।”

পরিস্থিতি বুঝে রবার্ট অপমান গিলে নেয়, তবে মুখে আগের মতো বাজে হাসি টেনে বললো,
“ঠিকাছে কিন্তু কৌশিক মির্জার টেষ্ট বলে কথা, তাই আমি তোমাকে জানতে আগ্রহী। কী বলো?”

কাশফি সজোরে টেবিলে দুম করে হাত রেখে উঠে পড়ে, তারপর দাঁত কড়মড় করে চোখ দিয়ে শাসিয়ে দিলো,

“এক লাখ টাকা আপনার, পরিবর্তে আপনি আমার কোনো পারসোনাল জিনিসে ইন্টারফেয়ার করবেন না এবং কৌশিক মির্জা যেনো এসবের কিছুই জানতে না পারে। শেষ বারের মতো প্রস্তাব রাখছি!”

“ঠিক আছে।”

“উঠছি, আশা করি শীগ্রই সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করে কল করবেন।”

“এটা আমার কার্ড আর আমার পার্সোনাল নাম্বার যদি…”

“রবার্ট লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, নিজেকে সংযত রাখার। প্রয়োজনে কল দিবেন নতুবা ডিস্টার্ব করবেন না, আপনি অবশ্যই চান না এই ছোট ক্যারিয়ারে আরেকটা নতুন অভিযোগ যুক্ত হোক!”

কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে না নিতেই তার দরজায় টোকা পড়লো, সে প্রথমে ভাবলো কায়েস কিন্তু দরজা খুলে দেখলো একজন মহিলা স্টাফ এসে তাকে নিচে যেতে বলে চলে গেলো। ওড়না ঠিকঠাক গায়ে দিয়ে নীচে নামতেই মাধবীর পাশে একজন মধ্যবয়সী মহিলা আর অন্যজন স্ট্রেইট চুলে স্লিভলেস টপস্ পরা মেয়েকে দেখতে পেলো। মেয়েটার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, ওয়েস্টার্ন কালচার মেইনটেইন করা অত্যাধুনিক এপিয়ারেন্স তার। মাধবী কাশফিকে দেখেই পরিচয় করিয়ে দিলেন তার বোন মালতী আর তার বোনের মেয়ে অনামিকার সাথে।
অনামিকা তার দিকে চাইলো না বরং এমন একটা ভঙ্গি করলো যেনো সে এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিমন্ত্রিত। মাধবী কাশফির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে রান্নাঘরে আসতে বললো, পিছন পিছন কাশফিও এসে পৌঁছালো কিচেন রুমে।

“আমি যখন এই বাড়িতে নতুন এসেছিলাম তখন আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দিয়ে বাইশ পদের রান্না একা করিয়েছেন।”

কাশফি ঘাবড়ে গেলো। এই গরমে ক্লান্ত হয়ে আবার এসব ঝামেলার কাজ ধরবে? মাথা নত করে মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো। আগে রান্নাবান্না করেনি এমন নয়, প্রায়ই করতো তবে তাদের বাসার মানুষজনের জন্য দুই পদই যথেষ্ট ছিল। কায়েস বাহানাবাজি করে যা খেতো আর তার বাবার যেকোনো সবজি হলেই চলতো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আবার মাধবীর কথা শুনলো,

“ঘরে মেহমান এসেছে তাই আমি চাইছি আজকের রান্না তোমার হাতেই হোক। কি কি পদ তৈরি করবে রিম্পির কাছে আমি লিস্ট করে দিচ্ছি।”

***

যেখানে কৌশিকের ফিরার কথা সন্ধ্যায় সেখানে কৌশিক দুপুরের আগেই হাজির হলো। তার বাবার সাথে কথা বলার পর থেকেই মেজাজ তুঙ্গে আছে। সে শক্ত মুখে তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে কামরায় কাশফিকে খুঁজে না পেয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কক্ষ থেকে বের হয়ে একজন মহিলা স্টাফ কে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে জানায়,
“ম্যাডাম তো রান্নাঘরে।”

কৌশিক সতর্ক হয়ে গেলো। তেতে উঠে কড়া গলায় বলল,
“রান্নাঘরে মানে কি?!”

“মাধবী ম্যাডামের বোন মালতী আর বোন ঝি অনামিকা এসেছে তাই ম্যাডামকে বলেছেন রান্না করার জন্য।”

“আশ্চর্য! আমার বউ রান্না করবে আর তোমরা কি করবে? ড্রামা দেখবে?!”

ভয় আড়ষ্ট হয়ে মহিলা স্টাফ মিনমিনে কণ্ঠে বললো,
“স্যার মাধবী ম্যাডাম সাহায্য করতে মানা করেছেন।”

কৌশিক কপালে আঙ্গুল ডলে বিশ্রী একটা গালি দিলো। শুধুমাত্র কাশফি যাতে একাকী বোধ না করে ভেবেই সে এখানে এসেছিল কিন্তু এখন বুঝতে পারছে কেনো মেয়র এখানে থাকতে অনিচ্ছুক ছিল। তার পারিবারিক ভবনের মতো এমন একটা জায়গা যে কারো জন্যই টক্সিক।

রাগে ফেটে পড়ার উপক্রম কৌশিকের। বড় বড় কদম ফেলে গিয়ে রান্না ঘরে পৌঁছালো, যতটা রাগ নিয়ে কড়া ভাষায় কাশফির সাথে কথা বলার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে এসেছিল সেটা কাশফির ঘেমে নেয়ে লাল হয়ে থাকা মুখ দেখা মাত্রই পানির মতো গলে গেলো। তবে সে দমলো না, এই দৃশ্য সুচের মতো ফুডলো তার নিকট।

“নাসরিন!”
আচমকা রাশভারী ভয়ার্ত কন্ঠের ডাকে কাশফি আতকে উঠে সামনে তাকাতেই কৌশিকের মুখশ্রীর পরিদর্শন করলো। মারাত্বক রকমের চটেছে বুঝাচ্ছে।

“এক্ষুনি তোমার ম্যাডামের জন্য একটা ফ্যানের ব্যাবস্থা করো।”

শপিং ব্যাগ হাতে বোন আর বোন ঝিকে নিয়ে মাত্রই ফিরেছে মাধবী, আকস্মিক সামনে পড়ে কৌশিককে দেখা মাত্রই তার গায়ে কাঁটা বিধলো যেনো। বাঘের কবলে পড়ে যেমন বোধবুদ্ধি হারিয়ে নির্বাক হয়ে রয়, মাধবীর দশাও এক হলো।
তাদের আমোদ ফুর্তি দেখে কৌশিকের চোয়াল শক্ত হয়ে এসে তৎক্ষণাৎ শিরা উপশিরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার বাম চোখের কোণ লাফিয়ে উঠলো, চোখজোড়া ছোট ছোট করে তিরীক্ষ চাহনি ফেলে তিনজনের মুখপানে তাকিয়ে চাইলো। প্রাণহীন ধূসর নজর যদি ছু রি চালাতে জানতো তবে র ক্তে র বন্যা বয়ে যেত। কৌশিকের চোখ স্থির তবে দৃষ্টি হিংস্র, অনামিকার দিকে চেয়ে মন্থর গতিতে প্রতি পদ কিয়ালকুলেটেড স্টেপে হেঁটে এসে বরাবর মাধবীর সম্মুখে এসে থামলো। তার ধূসর চোখে গ্রাসকারি জ্বলন্ত দহণ নিয়ে চওড়া হয়ে কেবল মাধবীর উদ্দ্যেশে বললো,

“আমার বড্ড শখের নারী ঈশিতা ইমরোজ কাশফি, সে এমন মারা’ত্ব’ক আবিষ্ট শখ যার জন্য আমি খু ন হতে এমনকি খু ন করতেও রাজি। আর শখের মূল্য তুমি ভালোই বুঝো ছোটমা। তাই না?!”

মাধবী বিমূঢ়, তার গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ, ভয়ে কন্ঠনালী কম্পিত হলো বোধহয়। কৌশিকের শান্ত দৃষ্টি তাকে আরেক দফায় নাড়িয়ে দিলো। কি এমন প্রয়োজন ছিল তার বোনের কথায় এসে মেয়েটাকে দিয়ে রান্না করানোর?!
কৌশিকের রাগ আগুনের দেদীপ্যমান শিখা। আগুনের মতো সে নিজেও জ্বলে অন্যকেও জ্বালায়। আর মাধবী তো আগুনের প্রথম স্ফুলিঙ্গের আভাস পেলো মাত্র, নিঃশেষ হয়ে ছাই হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

হনহনিয়ে কৌশিক রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথেই নাসরিন সামনে হাজির হয়ে কৌশিকের হাতে একটা কিচেন এপ্রোন তুলে দিলো। কৌশিক পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে তার উপর উপর এপ্রোন বেঁধে কাশফির পাশে গিয়ে দাঁড়িলো। তারপর কাশফির হাত থেকে ছুরি নিয়ে নিপুণ হাতে পেঁয়াজ ডাইস করে কেটে নিতে লাগলো। ক্লান্ত কাশফি বাধা না দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে প্যান চুলোয় বসিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিতে যাবে তার পূর্বে ঝড়ের বেগে কৌশিক গ্যাস অফ করে তাকে অপ্রস্তুত টেনে নিয়ে তুলে কিচেন কাউন্টার টপে বসিয়ে দিলো। পরপর অনিমেষ নেত্রে কাশফীর মাথা কিছুটা কাছে টেনে সে টুপ করে চুমু খেয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,

“এতক্ষণ যথেষ্ঠ কাজ করে ফেলেছো, এখন তোমার স্বামী তোমার অ্যাটেনশন চায়, কাশফি। So, be my good wife and eyes on me!”

#চলবে…