অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-৩২+৩৩

0
270

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৩২)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

সৌরভ সরকার, Rowan Lucas এর একজন বিজনেস পার্টনার। তার তিনজন স্ত্রী ছিলেন, প্রথমজনকে তিনি বিত্ত, প্রাচুর্য আর সম্পত্তির জন্য বিয়ে করেন আর সম্পদ হাসিলের পর তাকে ছেড়ে দেন। দ্বিতীয় জনকে ক্ষমতার জন্য বিয়ে করেন ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই সৌরভ দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেরে ফেললেন। পরবর্তীতে তৃতীয় জনকে তিনি বিজনেস প্রপোজাল নিয়ে বিয়ে করেন। তার তৃতীয় স্ত্রী একজন অল্প বয়সী সুন্দর তরূণী, তৃতীয় স্ত্রী আবার আদর্শ সোসাইটি ওয়াইফ স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে চলা ফেরা করে তাছাড়া সৌরভ সরকারের প্রতিদিন নতুন কোনো মহিলার সাথে ফুর্তিবাজি নিয়েও তার মাথা ব্যথা নেই তাই সৌরভ সরকার তার তৃতীয় স্ত্রী নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট।

এতো গুলো বিয়ে সৌরভ সরকারের কোনো ওয়ারিশ নেই, কিন্তু কেনো?
বহু আগে কয়েকবার শোনা গিয়েছিল তাকে মানুষজন paedophile বলে একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তিনি ১৩, ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল এক সময়, এমনকি কিশোরী সহ বাচ্চাদের গুম করার অভিযোগে তুলেছিলেন একজন এডভোকড। তা কতটুকু সত্য মিথ্যা তা জানা যায় নি তবে পরবর্তীতে সেই এডভোকড তার নিজ বাসায় অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনায় সপরিবারে মৃত্যুবরণ করেন।

সৌরভ সরকারের বয়স চল্লিশ ঊর্ধ্ব কিন্তু তাকে দেখে বয়স বোঝার দায়। কখনো শুনেছেন শয়তানদের বয়স বাড়তে? শয়তান দীর্ঘায়ু লাভের আশায় পাপ করে যায় কিন্তু তবুও তার মতলব হতে চ্যুত হয়না।

সাধারণত জেন্টেলম্যান ক্লাবে আসা হলে সৌরভ সরকার ড্রাইভার আর দুটো গার্ড নিয়ে আসেন, বাকি জায়গায় তিনি সিকিউরিটি কঠোর রাখলেও এই নাইট ক্লাব গুলোতে তিনি বরাবর কম সিকিউরিটি নিয়ে চলা ফেরা করেন। গাড়ি থেকে নেমে তিনি বাউন্সারদের দিকে চেয়ে মেকি হাসলেন তারপর নিজের ভি আই পি মেম্বারশিপ কার্ড দেখালেন। তার দুজন গার্ডকে বাহিরে দাড় করিয়ে রেখে একাই ভিতরে প্রবেশ করলেন ক্লাবে। ক্লাবের সামনে ওয়াইন সেলার, এক পাশে আমোদ ফুর্তি করার জন্য জায়গা আর ক্লাবের ভিতরের দিকে স্ট্রি/পা/র্সদের কিংবা হু/কা/রদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা ভি আই পি মেম্বারদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা।
সৌরভ সরকার বড় ওয়াইন বারে বসে বারটেন্ডার কে একটা ডার্টি মার্টিনি দেওয়ার জন্য অর্ডার করলেন। ক্লাবের মহিলা ম্যানেজার তাকে দেখে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসলো তারপর প্রলোভনসঙ্কুল হাসি হেসে বিদেশীদের মতো দুইগালে চুমু দিয়ে বললো,

“ডার্লিং, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবেই না।”

ক্লাব ম্যানেজার রাহার দৃষ্টি সম্মোহিনী অঙ্গভঙ্গি কামুক, বলা যায় তারা ওল্ড ফ্লেম(Old flame), একসময় রাহা তারই স্পেশাল একটা ক্লায়েন্ট ছিল। ঘরে প্রথম স্ত্রীকে রেখে তিনি রাহার কাছে দিন রাত পড়ে থাকার রেকর্ড করেছিলেন। সৌরভ রাহার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নেন তারপর অতি আদুরে গলায় বললেন,

“কাম অন রাহা, তোমাকে কি করে ভুলি। এখন ফটফট একটা সুখবর দাও তো!”

সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে সৌরভ সরকারের আদুরে গলা গা ঘিনঘিনকর মনে হতে পারে কিন্তু রাহা তো মেরুদন্ডহীন রাহা। সৌরভ সরকারের মতো সেও পুরোপুরি Gutter Trash, নর্দ/মার কী/ট!

“সু খবর তো আছেই, আগে বলো আমাকে কি গিফট দিবে?”

সৌরভ সরকার কুৎসিত হাসি হেসে তার পকেট থেকে কার্ড বের করে রাহার বুকের খাঁ/জে গুঁজে দিলো,
“আমার Amex ব্ল্যাক কার্ড, যা ইচ্ছে নিতে পারবে তুমি।”

রাহার অক্ষিপট এইচডি লাইটের মতো জ্বলে উঠলো, খুশিতে আত্মহারা হয়ে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,

“কাল নতুন একজন মেয়ে আসছে, তার বয়স চৌদ্দ বছর বয়স। আমি সেই মেয়েকে তোমার জন্য বরাদ্দ করেছি। তুমিই প্রথমে তাকে ছোঁবে।”

সৌরভ সরকার ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো, যেনো সে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো হাতে। অদম্য আগ্রহ দেখিয়ে চাপা স্বরে বললো,
“আমি কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না রাহা।”

“অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় তাছাড়া তোমার জন্য আজ স্পেশাল একজন কে রাখা, বয়স বেশি নয় মাত্র ২৩ বছর, মাথা নষ্ট করা ফিগারের।”

“আসলে?”

“অফ কোর্স ডার্লিং আমি তোমার জন্য তো যাকে তাকে চুজ করতে পারি না। You are my special, remembar?”

“তাকে পাঁচ মিনিটে আমার রুমে চাই!”

সৌরভ সরকার আর দাঁড়ালেন না। তড়বড় করে ভি আই পি এরিয়ায় ঢুকে তার পারসোনাল রুমে প্রবেশ করলো তারপর লেদার সোফায় বসে সাগ্রহে অপেক্ষা করলেন নতুন যুবতীর। সৌরভ সরকার আগে থেকেই কা/ম লা/ল/সায় মত্ত তাই তর মোটেই সইছিল না। তবুও তিনি মনস্থির করে উত্তেজনা কিছুটা দমানোর আসায় রুমের সোফার সামনে থাকা টেবিল হতে দামী ওয়াইনের বোতল নিয়ে ওয়াইন গ্লাসে ঢাললেন। যখনই তৃপ্তি নিয়ে গ্লাসে প্রথম চুমুক বসাবেন তখনই আগমন ঘটলো প্রায় উ/লঙ্গো পোশাক পরিধান করা এক নারীর, গায়ে কেবল অন্তর্বাসের মতো ছোট কাপড়ে ল/জ্জা/স্থান কোনরকম ঢাকা।
সৌরভ সরকারের দৃষ্টি আটকে গেলো এমন সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে, সে প্রতিদিন নতুন করে বিমোহিত হয় নারী দে’হে’র লো’ভ সামলে নেওয়া তার পক্ষে বড্ড দু’ষ্কর। গোলাপি ঠোঁট কামড়ে আকর্ষণীয় সেই নারী রুমে প্রবেশ করে পোলের সামনে এসে দাড়ালো, আলোর আরো সন্নিকটে হওয়ায় এবার তার চেহারা স্পষ্ট হলো।

এটা তো সেই যুবতী যে কাশফির সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিল তারপর কাশফির বই তুলে হাসি মুখে বিনা বাক্যে প্রস্থান করেছিল। যুবতী প্রলোভনসঙ্কুল হেঁসে পোল ড্যান্স করার জন্য পোল ধরলো তারপর চোখ টিপে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে অ/শা/লীন রকমের নাচ নেচে এক পর্যায়ে সৌরভ সরকারের কোলে এসে বসলো।

“তুমি কি আরো স্পেশাল কিছু চাও ডার্লিং?”
যুবতীর ফিসফিস করা কণ্ঠে সৌরভ সরকার প্রবল রকমের উত্তে/জি/ত, যুবতীর সারা অঙ্গ হা/তা/হা/তি করে গলায় নাক ডুবিয়ে দিলো।

“তোমার নাম যেনো কি?”

“তেজস্বিনী।”

“নামটাও তোমার মতো, পুরাই আগুন। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলে তো!”

“আমি আজ কেবল তোমার জন্যই উন্মুক্ত, Show me your best, ডার্লিং।”
এমন ভয়ঙ্কর প্রলুব্ধকর আহ্বানে উত্তেজনার ঢেউ জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হলো। সৌরভ সরকার হিং’স্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো কা/ম/জ আহার গ্রহণ করতে।

***

কর্নারের একটা রুম হতে র/ক্তা/ক্ত লোহার মোটা শি/ক/ল নিয়ে বেরিয়ে এলো কালো জ্যাকেটের কালো ক্যাপ পরা, মুখে স্কালের ছবি আঁকা কৌশিক। একই রকমের মুখে মাথার খুলির চিত্র আঁকা আর একই রকম ড্রেস কোডে থাকা লেভিন আর দুইজন গার্ড তৎক্ষণাৎ তার সামনে এসে দাড়ালো। যেনো তাদের এই গেটআপ নিয়ে এমন পোশাক পরার মূল উদ্দ্যেশ্যই হলো মানুষের চোখ ঠকানো, বিভ্রম করা। একই রকম এটায়ারে থাকা সবকটাকে দেখতে একটা মানুষেরই নানান প্রতিবিম্ব বলে মনে হচ্ছে। আদো এমন মরীচিকা তৈরি করা সম্ভব?
হয়ত
কৌশিকের জন্য সব সম্ভব।

“বস, লা/শ/গুলোর ঠিকানা লাগিয়ে আমি যথাসময়ে দিগন্ত চৌধুরীর গাড়িতে থাকবো, ইফ ইউ নিড এনিথিং জাস্ট কল মি।”

“There will no change of plan Levin.”
লেভিন মাথা নেড়ে গার্ডসহ রুমের ভিতর ঢুকে পড়ল আর কৌশিক লোহার মোটা হাতলটা কোনরকম মুছে রাহার লকারে রেখে দিলো।

সব কাজ সেরে কৌশিক মির্জা ভদ্র কায়দায় বসলো তার ইউজুয়াল জায়গায়। তারপর হাতের করে গুণে গুণে কিসের হিসাব করতে শুরু করলো। ক্লাবের এই এরিয়া কিছুটা আলাদা, এই জায়গাটার ছোট্ট একটা বুথের মতো জায়গায় টেবিল সাজানো এই টেবিল কেবল কৌশিক মির্জার জন্য রিসার্ভড করা, একেবারে তার মতো নিষ্প্রাণ আর স্তব্ধ। তার ক্যালকুলেশনের ব্যাঘাত ঘটিয়ে গ্লাসে নক করে প্রবেশ করলো তেজস্বিনী। পরনে কিছুক্ষণ আগের Revealing dress টার পরিবর্তে জিন্স আর হুডি গায়ে জড়ানো। হুডির ক্যাপটা উপরে তোলা আর চোখে সান গ্লাস, রাতের বেলায় সান গ্লাস পরার যৌক্তিকতা কি?!

সে চেয়ার টেনে কৌশিকের বিপরীতে বসলো,
“সৌরভ সরকার টাল মাটাল হয়ে গাড়িতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তার ড্রাইভারকেও ড্রিঙ্কস সার্ভ করা হয়েছিল।”

“ম্যানেজার রাহা নিজ হাতে সার্ভ করেছে তো?”

“হ্যাঁ।”

“পারফেক্ট।”
কৌশিক মাথা নেড়ে নগদ দুই বান্ডিল টাকা তেজস্বিনীর দিকে ঠেলে চেয়ার থেকে উঠে পড়তে উদ্যত হয়। কিন্তু তেজস্বিনী বেশ ব্যাকুল কণ্ঠে কৌশিক কে থামিয়ে দেয়।

“আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে কৌশিক মির্জা। কিন্তু আপনি এখনো বললেন না যে আমি তার সাথে ঠিক কখন দেখা করছি?”

“শীগ্রই দেখা করবে।”

তেজস্বিনীর অশ্রু অনবরত গড়িয়ে পড়তে লাগলো সে গ্লাস খুলে টেবিলে রাখলো তারপর অবাধ্য অশ্রু ছেড়ে মুক্ত করে দিলো। তার ভাঙ্গা কন্ঠে বিপর্যস্ত অবস্থায় বললো,
“প্লিজ, কৌশিক হেঁয়ালি করবেন না। আমার দশ বছরের অনুশোচনা, ক্ষমা না চেয়ে মরতে চাই না আমি!”

“তোমার দশ বছরের অনুশোচনা আর তার সারা জীবনের কলঙ্ক, তুমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য কখনো ছিলেই না।”

তেজস্বিনীর ভিতর আরেকদফা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো, সে চাপা আর্তনাদে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো। তবে এই জীবনে কি আর ক্ষমা চাওয়া হবে না তার? সে কি ক্ষমা করবে তাকে?!
কৌশিক দেখেও বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না সে ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে এক অচেনা গাড়িতে উঠে পড়লো। পিছনের সিটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো সৌরভ সরকার। কৌশিক মেকি হাসি হেসে নিচু কণ্ঠে ঘেমে নেয়ে এক হয়ে থাকা ড্রাইভারের মাথায় ব/ন্দু/ক ঠেকিয়ে বললো,

“মনে কর, তুই তোর সাহেব কে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিস, অর্ধ মাতাল অবস্থায় স্পিড নরমাল রেখে তুই গাড়ি চালাচ্ছিস কিন্তু হাই রোডে গিয়ে হলো গড়বড় তারপর একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেলো, ইশ!!!”
কৌশিকের কথায় ড্রাইভার জ্ঞান শুন্য হয়ে হতবম্ব বনে রইলো, কৌশিক ইশারায় জানালো গাড়ি চালাতে।

ড্রাইভার কম্পমান হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে মাথা নেড়ে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করলো। কৌশিক নিশ্চুপ, নিজের চারপাশ শান্ত রকমের বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছে। এদিকে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সৌরভ সরকার। ভয়ে তটস্থ ড্রাইভারের দৃষ্টিতে কোনরকম গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, গাড়িতে পিনপতন নীরবতা।
দেড় ঘণ্টার মাথায় তারা হাই রোডের কাছাকাছি। ড্রাইভার আরেকবার ঢোক গিললো, এই ঢুলুঢুলু অবস্থায় গাড়ি হাই রোডে তোলা মানে আসন্ন বিপদ আরো দ্রুত অগ্রগামী।

সৌরভ সরকার আধো আধো চোখ খুলতেই প্রথমে গাড়ির অস্বচ্ছ হেডলাইনার দেখেতে পেলো। ভীষণ রকমের ক্লান্ত লাগছে, হাত পা অচল হয়ে আছে, নাড়াতে পর্যন্ত পারছেনা। সে পিট পিট করে চেয়েও চোখে বেশ ঝাপসা দেখলো, মাথা ঝিম ধরে আছে। তারপর সে চোখ জোড়া বন্ধ অবস্থায় হেলান দেওয়া মাথা তুলে সোজা করে নিয়ে ড্রাইভারের উদ্দ্যেশ্যে জড়ানো গলায় টেনে টেনে কণ্ঠে জোর খাটিয়ে বললো,
“দ্রুত গাড়ি টান, বাসায় ফিরে একটা ঘুম দিব। কাল আবার পার্টি অফিস যেতে হবে।”

ড্রাইভারের হা না কিছু না শুনে সে চোখ মেললো, প্রথমে আবছা আবছা আলোয় বেশ অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো তারপর খুবই মন্থর গতিতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা মুখে স্কাল আঁকা একজন কে দেখে হকচকিয়ে গেলো।

“ঘুম ভালো হলো তো সৌরভ সরকার?”
কৌশিকের ভয়ঙ্কর কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সৌরভ স্তম্ভিত বনে গেলো, হতবম্বের মতো কৌশিকের হাত অনুসরণ করে বুঝতে পেলো ড্রাইভারের মাথায় ব/ন্দু/ক ঠে/কি/য়ে রেখেছে সে।

“দশ বছর আগে কিনান মির্জার সাথে একটা চৌদ্দ বছরের মেয়েকে অপহরণ করার প্ল্যান মনে আছে?”
সৌরভ সরকারের মুখ হা হয়ে এলো তার জিভ ভার ভার লাগছে। এতটা বিস্মিত হলো যে টু শব্দও তার গলা দিয়ে বের হলোনা।

“কিনান মির্জার মতলব ছিল সেই বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের কা/ম/জ স্বার্থে ব্যবহার করা, তার যৌন চাহিদা মিটিয়ে মেয়েটাকে অন্য বিদেশী ক্লায়েন্টের কাছে বিকিয়ে দেওয়া। আর এসবে পুরো দমে সাহায্য কে করেছিল বলতো?”
কৌশিকের কথা শুনে সৌরভ সরকারের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম, হাত পা পর্যন্ত নাড়তে পারছে না সে। এমতাবস্থায় নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় সে দেখছে না, তাই সাফাই গাইতে অস্পষ্ট স্বরে ব্যাক্ত করলো,

“কিনান মির্জা আমাকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছিল। নয়ত আমি তো ওইটুকু মেয়েটাকেই চিনতাম না!”

কৌশিক ক্রুর হাসি হাসলো তারপর হাসি থামিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো,
“কিন্তু তোর প্রস্তাব ছিল মেয়েটাকে কিনান মির্জা ভোগ করার পর তুই ভোগ করবি।”

সৌরভ সরকারের চোখ জোড়া অক্ষিকোটর হয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম, মুহূর্তেই তার মুখ খানা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
কৌশিক চোয়াল শক্ত করে জানালার বাইরে চোখ রাখলো। সৌরভ সরকার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আরেকদফা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে গেলো।
তার গাড়ির পাশাপাশি চলছে দিগন্ত চৌধুরীর গাড়ি, ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করা দিগন্ত তার দিকে উপহাস করার মতো হাসি হেসে ড্রামাটিক ওয়েতে হাত নাড়িয়ে যেনো শেষ বিদায় জানালো। দিগন্তের পাশের সিটে লেভিন মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে।

“যে বাচ্চা মেয়েটা তোদের টার্গেট ছিল সে আমার বর্তমান ওয়াইফ।”
ড্রাইভার ততক্ষণে নিশ্চল, তার কোনো বিশেষ হেলদোল নেই। গাড়ি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আঁকাবাকা হয়ে চলছে, বেঁহুশ রকমের হয়ে পড়েছে ড্রাইভার। সৌরভ সরকার চেয়েও চিৎকার করে ড্রাইভার কে কিছু বলতে পারলো না।

এদিকে দিগন্তের গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খোলা মাত্রই কৌশিক তার সাথের দরজা পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে খুলে দিলো তারপর একটা সিনিষ্টার রকমের অশুভ হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো,
“A sinner is born to kill another sinner. Your time’s up; now say goodbye.”

তারপর মুহূর্তেই কৌশিক মির্জা সুদক্ষ এক ঝাঁপে গিয়ে দিগন্তের গাড়ির খোলা প্যাসেঞ্জার সিটে পড়ল। কিছুক্ষণের মাথায় তার গাড়ি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিছুটা ঘুরে গিয়ে পাশের আরেকটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলো তারপর একটা নিকটবর্তী বড় ট্রাকের আবছা হেডলাইটের আলো এসে পড়লো তার গাড়ির উপর। তিন সেকেন্ডের মাথায় মৃত্যু জেনে সৌরভ সরকার সম্পূর্ন প্যারালাইজড হয়ে গেলো, কেবল অনিমেষনেত্রে তার অন্তিম লগ্ন দেখতে লাগলো।

নিশুতি রাতের অন্ধকারে ঠিক তিন সেকেন্ডের মাথায় হাইওয়েতে চলমান দশ চাকার এক ট্রাক সৌরভ সরকারের গাড়ির উপর দিয়ে চলে গেলো। কৌশিক একটা প্রশান্তির হাসি হাসলো।

***

কৌশিক রক্তাক্ত শার্ট খুলে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে সে উদোম গায়ে দাড়িয়ে আছে, কোমরে জড়ানো প্যান্ট তার উপরে বক্সার ব্রিফ Calvin Klein এর ওয়েস্ট ব্যান্ড স্পষ্টত। কাশফি মূর্তির মতো দাড়িয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো, কিছুক্ষণ আগে সে কৌশিকের গায়ে কার রক্ত জিজ্ঞেস করায় কৌশিক কোনো উত্তর দেয়নি এরপর থেকেই কৌশিক কেমন এক শান্ত রকমের আচরণ করছে যা কাশফির কোনো ক্রমেই বোধগম্য হচ্ছে না।

“তুমি পুষ্পকুঞ্জের খোঁজে ছিলে?”
কৌশিককে আচমকা নিজের এতো কাছাকাছি দেখে কাশফি শিউরে উঠে। তৎক্ষণাৎ নজর সরিয়ে কৌশিকের তির্যক দৃষ্টি লুকিয়ে চুরিয়ে, মাথা নেড়ে নিচু গলায় অস্ফুট স্বরে বললো,
“আমি আগেও জানিয়েছিলাম।”

“আগে?!— ইট মিনস পাস্ট, আমার পিছনে পিছনে না গিয়ে অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারতে!”

“আপনাকে জানালে আপনি যেতে দিতেন?”

“না!”
কাশফি হতবম্ব, ভেবেছিল সে হ্যাঁ বলবে কিন্তু পরিবর্তে বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সে থতমত খেয়ে যায়। তবুও সাহস জুটিয়ে ভ্রূ উচু করে বললো,

“উত্তর এখানেই কৌশিক।”

“তবুও আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল!”

“আমার অনুমতি নেওয়া নিয়ে আপনার এতো মাতামাতি কেনো হতে হবে? কেনো এতো কন্ট্রোলিং হতে হবে আপনাকে?!”

“যখন আমি বিছানায় কন্ট্রোলিং বিহেভ করি তখন তো বেশ উপভোগ করো, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে রেসপন্স করো তাহলে এখন কেনো সমস্যা হচ্ছে!”

“আশ্চর্য এসব এখানে কেনো টানছেন। আমি বোঝাতে চেয়েছি আপনি অধিকার বোধ দেখাতে পারেন অথচ আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেও প্রয়োজন বোধ করেন না।”

কৌশিক একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর আঙ্গুল দিয়ে কাশফির চিবুক ছুঁয়ে উপরে তুলে তার চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললো,
“এসব আমার রক্ত না তবে আমি কোনো নির্দোষ কে মারিনি, কাশফি। যাকে মেরেছি সে না ম/র/লে আরো দশজন নির্দোষ ম/র/তো।”

কাশফির মুখ হা হয়ে আসলো, উদ্বিগ্ন হয়ে অস্থির কণ্ঠে শুধলো,
“যদি এসবে আপনি ফেঁসে যান?! আপনার কী ভয় হয়না?”

কাশফির অশান্ত অবস্থা আর উদ্বিগ্নতা বুঝে কৌশিক হাসলো। তবুও কণ্ঠে গম্ভীরতা রেখে জানালো,
“তোমার স্বামী অখদ্যে নয় কাশফি, নেক্সট টাইম যেখানে যাবে আমাকে বলে বের হবে।”

“আর তারপর আপনি মুখের উপর না করে দিবেন।”

“তোমাকে না করার সাধ্য আমার নেই।”

কাশফির বুক ধক করে উঠল, একটা হার্ট বিট মিস হলো বুঝি। অবিশ্বাস্য লাগলো তার, তাই নিভু নিভু কণ্ঠে কৌশিক কে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি তাহলে আমার সব কথা রাখবেন?”

“যতক্ষণ না এতে তোমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে!”

“আমার বিশ্বাস হয়না কৌশিক।

“একজন রাজার পাশে তার রানীর প্রয়োজন কাশফি, যখন আমি বলেছি ‘তুমি যদি আমার হাত ধরে পাশে থাকো তবে রাজ্য আর সিংহাসন দেওয়ার দায়িত্ব আমার’ তখন আমি তোমাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিইনি। তাছাড়া তোমার ছেড়ে যাওয়ার কোনো অপশন নেই।”

“আপনার রানী হওয়া মানে কি আমার অতীত বিসর্জন দেওয়া?!”

প্রখর অন্তর্দৃষ্টি কৌশিকের, নিজেকে কাম এন্ড কম্পোজড রেখে কাশফির গা ঘেষে দাড়ায় তারপর লহু গলায় তার হাস্কি ভয়েসে ব্যক্ত করলো,

“আমার রানী হওয়া মানে ক্ষমতা তোমার মুঠোয় থাকা, মানে আমার ইকুয়্যাল, আদার হাফ হওয়া। All You have to do is ask me…”

কাশফি এক নাগাড়ে চেয়ে থাকলো, কৌশিকের মুখে কেনো হাসির রেশ মিলে কিনা দেখার উদ্দ্যেশ্যে কিন্তু কৌশিক কে বেশ সিনসিয়ার এবং সিরিয়াস দেখে কাশফি নিশ্চিত হলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিনমিন করে বললো,
“তবে জেনে রাখুন আমি সিটি হসপিটালে এক টিচারের খোঁজে যাবো, যাওয়া জরুরি।”

কৌশিকের ঠোঁটে তৎক্ষণাৎ একটা শুদ্ধতম খাদহীন হাসি দেখা দিলো। চোখে মুখে তৃপ্তির রেশ নিয়ে সে কাশফির কোমর ধরে কাছে টেনে নেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো তারপর পরমোত্কৃষ্ট প্রেমিকের মতো প্রেমিকার কপালে সুদীর্ঘ প্রগাঢ় চুম্বন আঁকলো।

“আই লাভ ইউ টু, ওয়াইফী।”
দমকা হওয়ার মতো কৌশিকের বাক্যখানা তার ভিতরটা এলোমেলো করে অনুভূতির বানে ভাসিয়ে দিলো। বজ্রপাতের বেগে শিরদাঁড়া বেয়ে হিম হিম শিহরণ বয়ে গেলো। টের পেলো কৌশিকও, তার ম্যাডামের হাত আদুরে ভঙ্গিমায় তার পিঠে জড়ানো।

আবেশে কাশফি চোখ বুঝে নেয়। এই অনুভুতির দাম অমূল্য, আবেগপ্রবণতার গভীরতা অন্তহীন, এই আলতো হাতের স্পর্শ বেশ আপন মনে হয়। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়ায় একান্ত নিজের একটা অধিকার কাজ করে। কাশফি লোভাতুর হয়ে কৌশিকের গায়ের পুরুষালি সুভাস টেনে নিয়ে তার প্রশস্থ বুকে মুখ গুঁজে।

তাদের মাঝে কোনো শব্দ আদান প্রদান বিহীন এই মুহুর্ত এভাবে চললো…

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৩৩)
#প্রোপীতা_নিউমী

“তুমি ঈশিতা, কৌশিকের ওয়াইফ না?“
কাশফি চোখ পিট পিট করে চায় অপরূপা নারীটির দিকে, তুলোর মতো সফেদ কায়া, কমলা, লাল সোনালী মিশেল চুল , ছোট খাটো গড়ন। দেখে বয়স কুড়ির বেশি মনে হলো না তার। মেয়েটা দেখতে বিদেশিনী হয়েও এতো ফ্লুয়েন্টলী বাংলা বলায় কাশফি হা করে চেয়ে রইলো শুধু, এত্ত সুন্দর ও কেউ হতে পারে? এতো অপরূপা?!
মেয়েটা মুখের হাসি উজ্জ্বল রেখে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“কৌশিক বেয়াদপটা আমার কথা বলে নি তাই না?”

কাশফির ভালোলাগা এক সেকেন্ডেই উবে গেলো, মুখ বেজার হয়ে কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ দেখা দিলো। এই কথার অর্থটা কি? ভাবতে ভাবতে ভ্রুদয় কুচকে সে মেয়েটার প্রতি তেতো হয়ে উঠলো তবুও কণ্ঠ নিরপেক্ষ রেখে মুখে টানটান মেকি হাসি হেসে শুধলো,
“জ্বি আমিই মিসেস মির্জা, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।”

কাশফির স্ত্রী অধিকার দেখিয়ে কথার ছলেও মেয়েটার জ্বলজ্বলে হাসির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হলো না সে কপাট দাত দেখিয়ে হো হো করে হেসে দুবার কপাল চাপড়ে বললো,

“Oh oh, so dumb of me! এনিওয়ে আমি নুসাইফা, লেভিনের ওয়াইফ বাট তুমি আমাকে ইফাও ডাকতে পারো।”
এরপর ইফা এদিক সেদিক ফিরে তাকিয়ে দেখা মাত্রই তার হাসি উবে গেল। ভাবুক হয়ে মিনমিনে স্বরে বললো— “ওদের তো সাথেই এনেছিলাম।”

সে গলা উঁচু করে দুজন ছেলের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ এলো না পরক্ষণে বাহির থেকে দুজন বাচ্চার ঝগড়া ঝাটির কণ্ঠ শুনে ইফা বিরক্তির শব্দ উচ্চারণ করে, তারপর কাশফির দিকে ফিরে ম্লান হাসলো,

“আমার বাচ্চাগুলো হয়েছে এদের বাপের বাপ, আমাকে বিরক্ত করা ছাড়া এদের কাজ নেই। আমি পড়েছি মহা জ্বালায় এগুলোকে নিয়ে বের হতেই পারি না!”

কাশফি তখনও থতমত খেয়ে দাড়িয়ে ছিল, লেভিনের মতো দামড়ার বাচ্চা কাচ্চা থাকতেই পারে কিন্তু এইটুকু মেয়ের দুইদুটো ছেলে আছে তা ভাবা তো দুর এমন বাচ্চা মেয়েকে লেভিন বিয়ে কি করে করলো এটা ভাবতে ভাবতে কাশফি চোখ উল্টে ফেলার উপক্রম।

“বাবা এটা এক্ষুনি এটা মুখ থেকে ফেলো! ফুল কি খাওয়ায় জিনিস?!”

***

সকাল — ১০

From: [email protected]
To: [email protected]

লেভিন আফসার,
তোমার কি বাড়ি ঘর নেই? সেই যে দেড় ঘণ্টা আগে তোমার বউ আমার বাসায় এসে আমার বউয়ের সাথে গল্প জুড়েছে সেই খবর কি আছে তোমার? আমি যে আমার তোমার ম্যাডামের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে পারবো না সেটা তোমার উপলব্ধি করা উচিত ছিল। এখন, কাইন্ডলি তোমার বউ, বাচ্চাকে আমার ঘর থেকে নিয়ে যাও।

তোমার বস,
কৌশিক মির্জা।

***

কাশফি লেভিনের দুটো জিরোক্স কপির দিকে চেয়ে দেখলো, দুটোই দেখতে তাদের বাবার মতো অথচ তাদের মা কত্ত সুন্দর একটাও কি মায়ের মতো হতে পারলো না?! বড্ড খারাপ লাগলো কাশফির।

“লেভিনের ওয়াইফ হওয়া কঠিন জিনিস তাই না!”
কাশফির মুখ ফসকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো কথাটা। কথাটা বলা মাত্রই সে চোখ বড় বড় করে বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইলো কিন্তু প্রতুত্তরে ইফা শব্দ করে হেসে উঠে বললো —
“সেটা অবশ্যই ঠিক।”
এরপর হাসি থামিয়ে আবার রসাত্মক হয়ে বললো,
“তবে তোমাকেও বলতে পারি, কৌশিক মির্জার ওয়াইফ হওয়া দম আটকে যাওয়ার মতো ব্যাপার।”

“আসলে আপনি এত্ত সুন্দর, এতো ইয়াং আমি আপনাকে লেভিনের ওয়াইফ ভাবতেই পারি না।”

“ওহ ডার্লিং, থ্যাংকস। তুমি আমাকে তুমি করেও ডাকতে পারো। আমি হয়ত তোমার থেকে চার — পাঁচ বছরের বড়।”

কাশফি গুণে গুণে হিসেব করলো, তার বয়স ২৩, কৌশিকের ৩০ হবে কিন্তু লেভিন কৌশিকের চাইতেও বছর ছয়েক বড় হবে হয়ত। কাশফির মুখ হা হয়ে এলো, দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“Don’t mind me asking but তোমার আর লেভিনের বয়সের পার্থক্য কত হবে?”

“বারো বছর।”
কাশফি হতবম্ব বনে গেলো। এতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার থেকে তার স্বামী নাকি ১২ বছর বড়, তাও যেই সেই মানুষ না, মানুষটা হলো লেভিন আফসার। এমন বিরক্তির প্রজাতির মানুষ পরীর মতো মেয়ের একমাত্র স্বামী এবং তার দুই বাচ্চার বাবা, ভাবা যায়?!

***

সকাল — ১০:১৫

From: [email protected]
To: [email protected]

বস,
আমি কাজে, আপনি যদিও ছুটি কাটাচ্ছেন কিন্তু আপনি আমার কোনো ছুটি বরাদ্দ করেন নি। তাই আমি এই বিষয়ে কিছুই করতে পারবো না।

সিনসিয়ারলি আপনার,
লেভিন আফসার।

***

“লেভিন আমার বডিগার্ড ছিল।”
হা করে থেকে বাতাস খেয়ে কাশফির নাকে মুখে কাশি উঠে গেলো। শক খেতে খেতে কোমায় চলে যাওয়ার মতো অবস্থা, একটা ১২ বছর বড় মানুষ তাও পারসোনাল বডি গার্ড কিভাবে এই টুকু মেয়েকে বিয়ে করে নিলো?!

নিজেকে সামলে নিয়ে কাশফি অবিশ্বাস্য স্বরে চোখ বড় বড় করে বললো,
“তোমার বাবা লেভিনকে কোনো রকম আপ্যায়ন করেন নি?”

কাশফির কথা আর এক্সপ্রেশন দুটোর উপরই ইফা হাসলো, পেট ধরে উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে তার দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা,

“লেভিন তো বাবার চোখে ধুলো ছিটিয়ে বিয়ে করেছে!”

“কি বলো?! আসলেই?”
কাশফির চমকপ্রদ কণ্ঠে ইফা মাথা নাড়লো। কাশফির বলা একটা শব্দ অস্পষ্ট স্বরে বলে বলে ইফার ছোট ছেলে লেক এসে কাশফির কাছে গিয়ে বসলো।

“নয়ত কৌশিকের মতো মানুষ লেভিনকে রাইট হ্যান্ড ম্যান করার আদো কোনো কারণ আছে?”

“তাও ঠিক দুটোই সাইকোপ্যাথ টাইপের তবুও কিভাবে সম্ভব?!”
কাশফির হতচৌকিত অভিব্যক্তির জবাবে ইফা দুর্বোধ্য হেসে গেলো শুধুই। তারপর সময় নিয়ে বললো,

“যদি কৌশিক মির্জাকে মস্তিষ্ক ধরা হয় আর দিগন্ত চৌধুরীকে মেরুদন্ড তবে তাদের নার্ভ সিস্টেম হলো লেভিন আফসার। মানে এদের একটা ছাড়া আরেকটা কল্পনা করা যায় না।”

(Note: স্বল্প কথায় দেহের মেরুদণ্ডের ভিতর থাকা মেরু রজ্জু আর নার্ভ সিষ্টেম রিলেটেড আর মূলত এসব হয়ে বার্তা মস্তিষ্কের পৌঁছানোর পরই কাজ সাধন হয়।)

***

সকাল — ১০:৩০

From: [email protected]
To: [email protected]

লেভিন আফসার,
তোমাকে পুরো দিনের ছুটি দেওয়া হলো লেভিন এসে নিজের বউকে নিয়ে যাও

তোমার বস
কৌশিক মির্জা।

***

“তুমি দিগন্ত চৌধুরীকে চিনো?”

আধ খাওয়া চায়ের কাপ একপাশে রেখেই ইফা উত্তর দিলো,
“দিগন্ত আমার কাজিন হয়।”

লেক তার আইপ্যাড এ ছোট ছোট অক্ষরে তার নাম লিখে কাশফিকে দেখলো। কাশফি লেকের প্রশংসা করে হেঁসে গালে চুমু দিলে সে লাল হয়ে গেলো। লেকের বড় ভাই এতক্ষণ এদিক ওদিক ছুটে দুষ্টুমি করে মায়ের পাশে এসে বসলো মাত্র।
কিছুক্ষণ পর লেক আবার আইপ্যাড নিয়ে কাশফির কাছে দৌড়ে এসে আধো আধো বুলিতে বললো —

“আমার আম্মুর নাম বুশরা শাহরিন আর আব্বুর নাম লেভিন আফসার।”
কাশফি প্রথমে শুনে কোনো রিয়েক্ট করলো না হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কিন্তু পরক্ষণে চট করে ধরলো মাথায়।
স্তব্ধ হয়ে নামটার দিকে আবার চোখ বুলিয়ে সে জমে গেলো যেনো। এই নামটা তো হিমাদ্রীর…

ইফা তার বড়ছেলের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে শাসনোর সুরে বলল,
“আব্বু এদিকে এসো!”

“আমি কিছু খাবো না! তোমার কথাও শুনবো না!”

“বাঁদরামি বেশি করলে বাপের কাছে রেখে আসবো দুটো কে!”

“তোমার নাম বুশরা শাহরিন চৌধুরী?”
কাশফির এমন আচমকা প্রশ্নে ইফা কিছুটা আশ্চর্য হয় তবে পরবর্তীতে হেসে কেবল মাথা নাড়ায়। এদিকে লেক কাশফির চুমুর জন্য গাল বাড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত। কাশফির সাথে রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“কিস করবা না?”

ততক্ষণে নূসাইফা আর কাশফির কথার ফাঁকে আগমন ঘটলো লেভিনের তাই কাশফি কিছুটা দমে গেলো। কিন্তু মনে মনে খটকা রয়েই গেল। তবে হিমাদ্রী কি লেভিন…?!

লেভিনের দিকে সে তাকিয়ে বিরক্তিমায় চোখ কুচকে মনে মনে আওড়ালো ‘ছিঃ মোটেও নয়’।

***

সকাল — ১১:০০

From: [email protected]
To: [email protected]

বস,
আমি এসেছিলাম ইফা আর আমার বাচ্চাদের নিতে কিন্তু ইফা আমার লেককে কোলে ধরিয়ে সামলাতে বলে আবার ম্যাডামের সাথে কথা জুড়িয়ে দিয়েছেন। আমার কোনো করণীয় ছিল না।

সিনসিয়ারলি আপনার,
লেভিন আফসার

***

“তোমার আর কৌশিকের পরিচয় হলো কিভাবে?”
কাশফি এতক্ষণ হিমাদ্রীর ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল যে কথাটা কানে আসতেও বেশ সময় নিলো। সে চোখ পিট পিট করে পাঁচ বছর আগের কথা ভাবে, ভাবতে ভাবতে তার লোম দাঁড়িয়ে গা গুলিয়ে আসলো। তবুও অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় অনিশ্চিত কণ্ঠে থেমে থেমে বললো,

“একটা ফিউনারেল এর মাধ্যমে…”
ইফার এতে কোনো বিশেষ হেলদোল দেখা দিলো না যেনো সে আগে থেকেই এমন একটা উত্তর এক্সপেক্ট করেছিল। সে শ্রাগ করে বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,

“এদের সবকটার রোম্যান্স হিস্টোরি খুবই বাজে, কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমাদের কিভাবে দেখা হয়েছিল তখন আমি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে চলি।”

“সে যেহেতু তোমার গার্ড ছিল তোমাদের দেখা তো ফরমালি হওয়ার কথা…”

“মোটেই না, সে আমাকে কিডন্যাপ করার কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল।”

কাশফির চোখ বড় বড় হয়ে অক্ষিকোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা যেনো। সে এক হাত তুলে ইফার উদ্দ্যেশে থামিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করে করুন স্বরে বললো —
“প্লীজ তুমি কিছুক্ষনের জন্য চুপ যাও, দোহাই লাগে!!!”

তারপর গলা চওড়া করে উচ্চস্বরে এক স্টাফ কে ডেকে বললো—

“প্লীজ আমার জন্য একটা আইস প্যাক নিয়ে এসো!”

***

সকাল — ১১:১৫
From: [email protected]
To: [email protected]

লেভিন আফসার,
তোমার বউয়ের এমন কর্মকাণ্ডে আমি ভীষণ বিরক্ত আর তুমি কাল ওভার টাইম করছো,

তোমার উপর চরম অসন্তুষ্ট তোমার বস,
কৌশিক মির্জা

***

ঘণ্টাখানেক কাশফির সাথে কথাবার্তার পর ইফা উঠলো, কাশফি বারবার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে দিলো। এভাবে স্বল্প পরিচিত কাউকে এমন প্রশ্ন করতে সে সাহস পাচ্ছে না তবে হিমাদ্রীর পরিচয় তো জানা জরুরী। এসব ভাবতে ভাবতে ইফা কাশফির থেকে বিদায় চলে যাবে তার পূর্বেই হুট করে কাশফি ইফার হাত চেপে ধরলো তারপর শুকনো ঢোক গিলে কুণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার কি লেভিনের আগে কোনো সিরিয়াস রিলেসন ছিল?!”
কাশফির কথা শুনে ইফা মুখের হাসি বিলীন করে দেয়। এমন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত দেখায় ইফা কে, তবুও সে কাশফির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“এক্সকিউজ মী?!”

“দেখো! I’m sorry but I really need to know, তুমি বিজনেস টাইকুনের মেয়ে বুশরা শাহরিন চৌধুরী। নয় বছর আগে তোমার সাথে যার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছিল সে কে ছিল?”

“ঈশিতা, দেখো পাস্ট তো পাস্টই এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?! আমি উঠছি।”

ইফার শব্দের কঠোরতার কাশফি তোয়াক্কা করলো না বরং সে অনুগ্রহ পূর্বক কাতর কন্ঠে বললো,
“প্লিজ আমার জানার খুবই দরকার। আজ না জানলে হয়ত আর কোনোদিন জানা হবে না, প্লিজ।”

ইফার চেহারা কেমন অবিশ্বাস্য দেখলো যেনো সে বিশ্বাসই করতে পারলো না। সে চোখ ছোট ছোট করে কাশফির উদ্দ্যেশ্যে বললো,
“ঈশিতা, তুমি কি মজা করছো?”

“এইসব নিয়ে আমি মজা কেনো করবো?”
কাশফির জবাবে ইফা বেশ চমকপ্রদ এবং বিস্মিত হলো।

***

ইফার সাথে কথা শেষে কাশফি ফিরলো একটা পঁয়তাল্লিশে। আসার পর থেকেই কেমন চিন্তানিমগ্ন, উত্কণ্ঠিত মনে হলো কৌশিকের। নরমালি তাদের মাঝে যেটুকু কথা হয় সেটুকু কথায় কাশফির রেসপন্স ছিল “হুঁ, হা, না, হুম” ধরনের। কৌশিক কথা বাড়ালো না, বিকেলে তার এসিস্ট্যান্টের কল এলো, বিজনেস ট্রিপে তাকে কাল সিলেট যেতে হবে। এদিকে ছুটি নিয়েছিল স্ত্রীর সাথে সময় কাটানোর জন্য কিন্তু তার স্ত্রী তো পর্দা করার মুডে আছে বোধহয়।

গমগমে সুরে গম্ভীর স্বরে বললো,
“কাল ভোর ছয়টায় আমি বিজনেস ট্রিপে সিলেট যাচ্ছি।”

“আমার সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে?”
কৌশিকের খুব ইচ্ছা করলো একটা ঝাড়ি দিতে, কিন্তু আফসোস ঝাড়ি দিলে পরে নিজের খারাপ লাগবে। তাই বিষণ্ণ মুখে কাঠ কাঠ জবাবে জানালো,
“লাগবে না।”

এদিকে ইফার সাথে কথা হওয়ার পর থেকেই কাশফির সবকিছুই কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হলো। কৌশিকের সাথে হওয়া প্রতিটা সাক্ষাৎ প্রতিটা কথায় প্যাঁচ ছিলো কিন্তু সে কৌশিকের জটিল মাথার প্যাঁচ খুলতে অক্ষম ছিল। এতো সত্য মিথ্যের ফাঁকে সে বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলেছে। নিজেকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া দরকার, তার অনেক কিছুই ভাবার — জানার দরকার। এই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম আর বিরতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো কাশফি।

“বাবা ফোন করেছিল, তিনি আমাকে আর কায়েসকে দেখতে চাইছেন। আপনি যেহেতু ট্রিপে যাবেন আমি বাবার কাছে গিয়ে থেকে আসি।”

“তোমার আগে থেকেই প্ল্যান ছিলো?”

“না আপনি চলে যাচ্ছেন তাই প্ল্যান করে নিলাম।”

“আমি যদি না যেতাম তবে?”

“তবে শুধু বাবাকে গিয়ে দেখে আসতাম।”

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো তারপর শক্ত দুহাত দিয়ে কাশফির মুখ হাতে নিয়ে চোখ কিঞ্চিৎ ছোট করে নিলো। আজ বহুদিন পর কৌশিকের চোখে চোখ রাখতে তার ভয় করলো, এই ধূসর দৃষ্টি তার চোখের ভাষা বুঝতে মহির, সুদক্ষ!

“কৌশিক মির্জার থেকেও শক্ত তোমার কলিজা মিসেস মির্জা!”

#চলবে…