অদৃষ্টের মৃগতৃষ্ণা পর্ব-৮+৯

0
266

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৮)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

৮.

কৌশিক মির্জা একটা জ্বলজ্যান্ত আতঙ্ক তবে অন্যদিক বিবেচনায় সে কাশফির অনুরত, আসক্ত, প্রেমনিষ্ঠ একজন স্বামী।
কাশফি ভাবে কৌশিক তাকে ম্যানুপুলেট করার ক্ষমতা রাখে না অথচ এইমাত্র নিখুঁত ভাবে সে কাশফির আতঙ্ককে নিজের ভাবনা দিয়ে ঢেকে দিল তা বিন্দুমাত্র টের পেলো কি? বোকা কাশফি কিছু বুঝতেই পারলো না।

কৌশিক বেশ শান্ত মেজাজে লম্বা লম্বা পা ফেলে তার কামরায় ঢুকেই ফিতায় বাঁধা গোলাপ আর বেলি ফুলের মালা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে। মন চাইছে যে এই ফুল তার স্ত্রীর কক্ষে রেখে গিয়েছে তাকে মাটিতে পুঁ’তে ফে’ল’তে। কিন্তু শ্বশুড়বাড়িতে নিয়ন্ত্রণ হারানো যাবে না, ভুলেও না, এমনিতেই শ্বশুর মশাই তার উপর নাখোশ।
তার রূমের বিছানা অক্ষত অবস্থায় আছে, এ্যাসট্রে তে ছয় সাতটা শেষ করা সিগারেট পড়ে আছে। নির্ঘুম রাত কাটানো তার জন্য নতুন কিছু নয়।
এতক্ষন জলের ন্যায় শান্ত হয়ে ছিল ঠিক কিন্তু তার ভিতরে তীব্র দ্বন্ধ চলছে। পকেট থেকে একটা খাম বের করে সে টেবিলে ছুড়ে ফেলে নিজে সোফায় বসে পড়ল। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয় চিঠিটার পানে। চিঠিতে মেনস পারফিউমের ঘ্রাণ যেন কৌশিকের মন মেজাজ আরো বিগড়ে দিচ্ছে।

সকালে কাশফির ঘরে গিয়েছিল জোভানের পরানো এনগেজমেন্ট রিংটা খুঁজে বের করে আনার উদ্দেশ্যে। কাশফিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললে সে খারাপ লাগা আর দায়িত্ববোধ থেকে ধেই ধেই করে জোভানকে নিজ হাতে ফিরিতে দিতে যাবে এরপর তিন বছরের ব্যার্থ একপাক্ষিক প্রেমিক জোভান সিকদার ইমোশনাল হয়ে ক্লিশে লাইন, কবিতা শুনিয়ে একটা ট্রাজেডি লিখে ফেলবে। তার চেয়ে ঢের ভালো কৌশিক এই কাজ নিজে করুক, উটকো ঝামেলা নাহয় সেই বিদায় করুক।

জোভান কাশফির বাগদত্তা ছিল, তিন বছর ধরে মেয়ের পিছে পড়ে থাকার আবেগ আপ্লুত হয়ে আতিকুর রহমান সিকদার বাড়ীর বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। কিন্তু সেই বিয়ে কৌশিক হতে দেয়নি। পুরোটা সময় শান্তশিষ্ঠ থাকা কৌশিক ঠিক বিয়ের আগের রাতে চাল চেলে বসে। কাশফিকে বিয়ে করার জন্য কৌশিক আরো আগেই আতিকুর রহমানকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নাকচ করে ঠিকই জোভানকে বাছাই করছিলেন।

কিছুক্ষণ আগে কাশফির জানালার ধারে মকমল কাপড়ের ফিতায় মোড়ানো একগুচ্ছ গোলাপ আর হাতে বানানো একটা বেলী ফুলের মালার সাথে এই চিঠি পেয়েছে। তখন থেকেই মাথায় রক্ত চড়ে বসেছে। স্বার্থপর কৌশিক মির্জা নিজের জিনিস নিয়ে সদা সচেতন, অন্য কারো ভাগ বসানো তার পছন্দ না আর সেই দৃষ্টিকোন হতে কাশফি তো তার একমাত্র বউ, তাকে নিয়ে মানুষের এত কিসের মাতামাতি? বিক্ষিপ্ত মন মেজাজে ভাবলো কিভাবে জোভান সিকদার থেকে কাশফিকে আলাদা রাখা যায়।
তবে কৌশিক মনের ভিতর খচখচ থেমে নেই, অজানা শঙ্কা মাথায় চিঠির দিকে আরেকবার চেয়ে নিজের মনের ঘোর বিরোধীতা করে চিঠিখানা খুললো। আর ব্যাস প্রথম লাইন পড়েই তার মেজাজ তুঙ্গে ওঠে

“ আমার না হওয়া প্রিয়তমা,
অপরাহ্নের সোনালী আলোয় রুমঝুম ঘুঙুর পায়ে
দেখেছিলাম এক ঘনকেশী। শুভ্র পদ্ম হাতে খিলখিয়ে হেসেছিল রমণী। তনে জড়িয়েছিল ফিরোজ রঙের শাড়ি আর হাতে কাচের চুড়ি। আহা! সেইদিন বড্ড ইচ্ছে হয়েছিল তার খোঁপার বেলী ফুল হতে।
তার নরম কদম ঘরের বাইরে পড়ার অপেক্ষায় ছিল আমার উৎসুক নয়ন। তবে রমণীর চোঁখ জোড়া ছিল দীঘির জলের ন্যায় শান্ত আর তার জন্য আমার নয়ন হয়ে উঠলো সাগরের উথাল পাতাল ঢেউ। ছারখার করেছিল আমার তনুমন। কে জানত বৈশাখ মাসে আমার সর্বনাশ দেখা হয়ে যাবে?
আজ চৌঠা কার্তিক, আবহাওয়া আমার চিত্তের মতো অশান্ত, নীল আকাশে তুলোর মতো কালো মেঘের বিচরণ, ঠাণ্ডা বাতাসের আনাগোনায় চারিপাশ।
তোমার অপেক্ষায় পার করেছি তিন তিনটা বৈশাখ কিন্তু তোমাকে ছোঁয়ার সাধনা আমার আজও অপূর্ন! যে প্রেমিকার চোখে নেই ভলোবাসা সে প্রেমিকা হয় নাকি?! জানা নেই তবে তোমার ঠাই আমার মনে। একপাক্ষিক ভালোবাসা গুলো কষ্টের শুনেছো কিন্তু আমি জানি প্রেমিকার ভলোবাসা কখনো পাবো না জেনেও তাকে ভালোবাসার কষ্ট কতটা যন্ত্রনাদায়ক।
আমার প্রেম হারায় নি ঠিক কিন্তু আমি দুর্ভাগা ক্ষমতার কাছে প্রেমিকা হারিয়ে ফেলেছি। সর্বদা তোমার চিঠির অপেক্ষায়, আমার প্রাণপ্রিয়া ঈশু।

ইতি,
তোমার ভালোবাসার অযোগ্য পুরুষ
জোভান শিকদার ”

কৌশিক একটা বিষয় মাইন্ডে সেট করে নেয় যে, কাশফিকে নিজের দৃষ্টির আড়াল বা অন্য কারো দৃষ্টির সামনে আনা যাবে না। উহু, কোন ক্রমেই না।

সে র’ক্ত চোঁখে চিঠির পনে চেয়ে শক্ত হাতে তা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। পকেট থেকে লাইটার আর সি’গা’রেট বের করে লাইটার দিয়ে চিঠিতে আগুন ধরিয়ে তার সিগারেট জ্বালিয়ে নেয় তারপর জ্বলন্ত কাগজটা ডাষ্টবিনে ফুলগুলোর সাথে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই ফুল আর চিঠিটার অস্তিত্ব জ্ব’লে পুড়ে রাখ হয়ে গেলো। ডাস্টবিনের তলায় ছাই ছাড়া আর অন্যকিছুর দেখা মিললো না।

নিকোটিনের দীর্ঘ ধোয়া টেনে চক্ষু বন্ধ করে নেয়, ক্রোধের উপর নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই, শশুরবাড়ি হওয়ার দরুন রাগ ঝাড়তেও পারছেনা। আতিকুর রহমানের মেয়ের জামাই বলে একটা প্রেস্টিজ আছে কিনা!
নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ল্যাপটপ হাতে নেয়, আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে অন্যহাত দিয়ে দিগন্ত চৌধুরীর পরিশিষ্ট মেইলটা দেখে নেয়।

দিগন্ত চৌধুরী তার বেশ পুরনো আর বিশ্বস্ত একজন বিজনেজ পার্টনার। রাশিয়ান একাডেমীর অস্ত্রাগারের উপর প্রশিক্ষিত স্কিলড একজন Ex- assassin,
বর্তমানে সে কৌশিকের মতোই ইভান মির্জাদের IM Gun Manufacturering Co. এর একজন শেয়ার হোল্ডার। লাস্ট মেইলে দিগন্ত একজনের ছবি পাঠিয়ে ছোট করে বার্তা লিখেছে—

“সৌরভ সরকারের এর পাঠানো একজন গুপ্তচর, এজ ইউজোয়াল স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তার টার্গেট আমাদের একজন ছিল কিন্তু ব্যাড লাক। বিবাহিত জীবনের গিফট হিসেবে পরবর্তী ব্যবস্থা তোকে নিতে দিলাম। আর বিয়ে উপলক্ষে কাশফিকে আমার পক্ষ থেকে এক বুক সমবেদনা দিতে ভুলবি না।
Location: Hide-Out Basement

দিগন্ত চৌধুরী ”

কৌশিক ভোঁতা মুখে মেইল থেকে বের হয়ে ল্যাপটপ অফ করে রাখে। হাতের সিগারেটের ধোঁয়া টেনে, নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে গুজলো। বা পাশের পকেট থেকে ছোট একটা আংটির বক্স খুলে নিজের সামনে ধরলো। ফোন কেউ ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই কৌশিক সময় নিয়ে রাশভারী কন্ঠে বলল—

“কেমন আছিস জোভান সিকদার?”

***

কাশফি গোসল সেরে রূম থেকে বের হয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কৌশিকের কামরায় উকি দিয়ে বড়সর বিষম খেলো যেন। কৌশিকের কোলে কায়েস কে হেঁসে খেলে কথা বলতে দেখে চরম অবাক হয়। কায়েস তেমন কারো সাথে মিশেনা আর কৌশিক তো বাচ্চা কাচ্চার ঝুঁট ঝামেলা পছন্দই করেনা। চোঁখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আবার রুমে ঢুকতেই দেখে তার পড়ার টেবিলে ট্রেতে অমলেট আর টেস্ট রাখা। সে তাড়াহুড়া করে অমলেট আর টেস্ট খেতে গিয়ে বাধায় আরেক বিপত্তি। আনমনা হয়ে খেয়ে গলায় খাবার আটকে ফেলে এরপর পানি খেতে গিয়ে পানি নাকে মুখে উঠে গিয়েছে। এবার কাশতে কাশতে দিশে হারা হওয়ার উপক্রম যেনো। সে এতটা থতমত কবে খেয়েছে মনে পড়ছে না।

কাশফি নিজেকে ধাতস্থ করার পর শাড়ি দেখে তার মাথায় বাজ পড়ল যেনো। অফ হোয়াইট মধ্যে সোনালী কাজের ভারী কাতান শাড়ি আর লাল রঙের কাজ করা একটা ব্লাউজ। এমনিতেই শাড়ি পড়া ঝামেলার কাজ তার উপর কাতান দেখে কাশফির চোখ মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে এলো। কৌশিক এতই যখন এই শাড়ী পছন্দ করেছেন সে নিজে পরলো না কেন?
ভাবনার মাঝে মনে পড়ে গেলো পাশের বাসার মোহনা ভাবীর কথা, তিনি মানুষের কথায় বাম হাত, ডান হাত মারেন। আস্ত বাচাল মহিলা হলেও শাড়ী দারুন পরায়।
একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে মোহনা ভাবীকে কল দেওয়ার জন্য ফোন ড্রেসিং টেবিলের সামনে পেয়ে হাতে নিতেই দেখে ফোনের ডিসপ্লে তে ফারাবী, তরী আর ঈশান কল আর মেসেজ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। তবে সর্বপ্রথম চোখে পড়ল যাকে টর্চ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না এমন এক ব্যক্তির মেসেজ। মাহিন সুন্দর একটা গা’লি দিয়ে লিখেছে —
“কিরে ফার্মের আধ’ম’রা মুরগির বাচ্চা, বিয়ে করবি না, করবি না, বলে বিয়ে করে আমাদের আড়ালে বাসরও সেরে নিলি?”

ফারাবী— “তুই ম’রে থাক আমি বরং তোদের বাসায় আসছি তোর চল্লিশা খেতে।”

তরী — “দুলাভাই কৌশিকের বিড়াল মিউ মিউ করে এসেছিল তোকে পেয়ে গেলে জায়গা বরাবর একটা কি’ক মারবি, আজীবনের জন্য বউ বা’চ্চা দেখার শখ মিটে যাবে।”

ঈশান— “ট্রিট দে!”

কাশফি চোঁখ উল্টিয়ে বিড়বিড় করে সব দোষ কৌশিকের ঘাড়ে চেপে ধই ধই করে শাড়ি ব্লাউজ নিয়ে রূম থেকে বেরিয়ে পড়ল।

***

শক্ত খোলসের কৌশিক নিজের মুখের গম্ভিরতা টেনে কাজে মনোনিবেশ করলো। খুবই আলতো হাতে একটার উপর আরেকটা রাখা জুয়েলারি বক্স গুলো নামিয়ে আলগোছে এক একটা জুয়েলারি বক্স খুলে ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। তার ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবমূর্তি খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না। কিছুটা দূর হতে ফ্লোরে হিলের ঠকঠক শব্দ প্রতিধ্বনিত হতেই সে পিছনে ফিরে তাকায়। বউকে দেখেই তব্দা খেয়ে যায়। তার ওষ্ঠদ্বয় কিছুটা ফাঁক হয়ে চোখ বড় বড় হয়ে আসে। তার ম্যাডাম ম্যাডাম রাজ্যের বিরক্তি মুখে এঁকে কাতানের কুচি ধরে বেশ সাবধানে এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন, লাল রঙের ফুল হাতার ব্লাউজ পরনে। কৌশিকের মাথায় যেন ঝিম ধরে এলো, শাড়িটা নেওয়ার সময় শুধু একটা কথাই মাথায় আসছিল যে সাদা রঙের ফুল কাশফির ভীষণ পছন্দের। কিন্তু যেমনটা সুন্দর লাগবে ভেবেছে তার চাইতে হাজার গুন সুন্দর লাগছে তার বউকে।

কাশফি আড়চোখে এক বার দুইবার কৌশিককে চেয়েছে কেবল, মুখ খুললে এই লোক অসভ্যের মতো ভিত্তিহীন কথাবার্তা শুরু করবেন। কথায় কথা বাড়বে তাই কাশফি চুপ করে রইল।
তার লাগেজের সাথে একটা ছোট লাগেজ দাড় করানো দেখে ভ্রু কুঁচকায়, এতক্ষন তার দিকে তাঁকিয়ে থাকা কৌশিক সহজবোধ্য করে বলে,

“ওটা কায়েসের লাগেজ, তাকে বলেছি সে এখান থেকে যা যা নিতে চায় নিতে পারে সেখানে অলরেডি তার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।”

কাশফি ভরকে গেলো যেন, কায়েসের কথা সে ভাবছিল না এমন নয় তবে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিল না। কিন্তু ভাইকে নিজের সাথে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা শুনে সমাজের মানুষ হাসাহাসি করবে, দুর্নাম রটবে যা কাশফি চাইছে না। সে বিষয়টা অগ্রাহ্য করে বিরক্ত প্রকাশ বলে,
“আর আপনি আমাকে বা আমার বাবাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না?!”

কৌশিক এক ভ্রু উচুঁ করে বলে,
“বাবা জানেন আর তোমাকে তো মাত্রই বললাম।”

“এসব শুনে মানুষ কি বলবে?!”

দৃষ্টি কাজে মগ্ন কৌশিক বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“মানুষের বলাবলির তোয়াক্কা আমি করি না। তাছাড়া তোমার বাবা অসুস্থ, উপস্থিত কায়েসের গার্ডিয়ান বলতে তুমিই আছো। সবদিক বিবেচনায় আমার যা ভালো মনে হয়েছে তাই করলাম।”

কৌশিকের ধারণা যে সম্পূর্ন যৌক্তিক তা কাশফির কাছে ভালো ঠেকলো না, লোকটার বাছ বিচারের সামনে মাঝে মাঝে নিজেকে নবালেগ মনে হয়। ঠিক এমনভাবে কাশফি তো ভেবেই দেখেনি। মনে মনে নিজেকে বকে গুষ্ঠি উদ্ধার করে কাশফি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়, মোটা চোকার নেকলেস গুলো দেখেই তার বিরক্ত লাগছে। কাশফি বরাবরই স্বাচ্ছন্দ্য আর আরামপ্রিয় মানবী।
ভাবনায় উবে থাকা কাশফির পিঠে হঠাৎ ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে যেন শীতল র’ক্তে’রস্রোত বয়ে গেল তার শিরায়। কৌশিকের মাস্কিউলিন ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্রে বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাসের ন্যায় মনে হলো।

কাশফি ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় কৌশিকের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ রাখতেই দেখে কৌশিকও ঠিক তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।
কশফির কৃশতনু দেহ কৌশিকের প্রশস্থ বুকের বলিষ্ঠ শরীরের ভিতরে গুটিয়ে গিয়েছে যেন। হিল পরিহিতা কাশফির উচ্চতা কৌশিকের কাধ ছুঁইছুঁই।
শক্ত শিরান্বিত হাত সন্তপর্নে কাশফির অর্ধভেজা চুলের গোছ পিঠ থেকে সরিয়ে দেয়, তার উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ে পিঠে। অমসৃণ লম্বা তর্জনী দিয়ে কাশফির ব্লাউজের ফিতে স্পর্শ করল। তৎক্ষণাৎ কাশফি শিউরে উঠলো। সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ার মতো বেগে তার নারী চিত্তে অস্থিরতা, স্নায়বিক উদ্দীপনা কাজ করছে। ক্রমবর্ধমান গতিতে শ্বাস প্রশ্বাসের পরিবর্তন হলো, বক্ষঃস্থলে দ্রিম দ্রিম শব্দ সুর তুললো, নিশ্বাসের শব্দে ধরা দিল তাল আর লয়।
দুইজন একে অপর থেকে দৃষ্টি নড়বড় করতে অনিচ্ছুক।

“এক ফুলের বাঁধা ফিতেটা লুজ মনে হচ্ছে কাশফি…”
কৌশিক গলা নিচে নামিয়ে থেমে থেমে বলে, যেন সে কড়াভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কাশফি দুই ফুলের ফিতা করতে জানে না। দুই ফুল বাঁধলে প্রতিবার গিট্টু বাঁধিয়ে ফেলে। কৌশিক অপলক চেয়ে আবার তেজস্বী কণ্ঠে অনুরোধ পূর্বক শুধলো —
“মে আই?”

কাশফির ঠিক বোধগম্য হলো না কিসের জন্য তার স্বামী তার অনুমতি নিচ্ছে, থোড়াই তার ধ্যান জ্ঞান কাজ করছে এই মুহূর্তে। কাশফির কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে কৌশিক ফেঁসফেঁসে কন্ঠে স্বর নিচু করে ডাকলো — “কাশফি!”
এত মোহনীয় ডাকে কাশফি আরেক দফায় কেঁপে উঠলো, উৎসুক চোঁখে চেয়ে একেবারে হালকা ভাবে মাথা নাড়ালো। কেন নাড়ালো, কি বুঝে নাড়ালো সে হয়ত মাথায় রাখেনি।
মনমতো জবাব পেয়ে কৌশিক এক টানে ব্লাউজের পিঠের দিকটায় ফিতা খুলে ফেললো। এতে কাশফির শরীর আকষ্মিক ঝাকুনি দিয়ে উঠে তার দম আটকে এলো যেন। কৌশিকের সম্পূর্ন অভিনিবেশ ফিতার দুই ফুল বাঁধায় দিলো, বাঁধা শেষে আবার কাশফির চোঁখে চোখ রেখে মাথায় প্রলম্বিত চুমু দিলো।
কাশফির নিজেকে কেমন উন্মাদ উন্মাদ মনে হলো, তার ভিতরটা অশান্ত, অজানা কিছুর জন্য খা খা করছে। মুহুর্তেই কাশফিকে স্তম্ভিত করে কৌশিকের বড়সর বলিষ্ঠ হাত আলতোভাবে তার গলা ধরে অন্যটা তার শাড়ী ভেদ করে কোমরে চলে গেলো। কৌশিকের কন্ঠনালি বের হয়ে আসে অস্পষ্ট গুঁজন যা কাশফির কর্ণকুহরে আসা মাত্রই তার থরথর করে কাঁপতে থাকা তনুমনে যেন সুনামির ঢেউ খেলালো। বেসামাল কৌশিকের বাঁধ সেই কবেই ভেঙেছে।

কাশফির প্রতিস্পন্দন বুঝে কৌশিক এক ধাপ এগিয়ে গেলো, টুপ করে সে কাসফির গ্রীবায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। পরপর কাশফির গলায় রাখা হাতটার আঙুল পালস পয়েন্ট খুঁজে নিল।
কৌশিক ঠিক ভেবেছিল, কাশফির স্পন্দন বেগতিক মাত্রার। নিজের কাজে তৃপ্তি পেয়ে সে কাশফির গলায় নাক ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে নিচুস্বরে আওড়ালো —

“ আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছো? তোমার তোলপাড় করা স্পন্দনের অনুরূপ। তুমি যতই পালিয়ে বেড়াও কাশফি আমাদের মধ্যকার আকর্ষণ তুমি স্বীকার করতে বাধ্য, আমরা একে অপরের পরিপূরক কাশফি…”

কাশফির তলপেটে তার হাত শক্ত করে গলায় তার অধর ছোঁয়ালো। ঘনঘন শ্বাস টেনে এবার তার ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে কাশফির কৃশতসু গলায় ঠোট বসিয়ে শুষে নিলো, যেন কোন অমৃত সুধা লুকানো সেথায়। অপ্রস্তুত কাশফিকে সম্পূর্ন কাবু করে শক্ত এক কামড় বসায়, শব্দ করে চিকন স্বরে কঁকিয়ে উঠলো।
কাশফি নিজের করা শব্দে লজ্জিত হয়ে হাত মুখে চেপে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে নেয়। কামড়ানো স্থানে উষ্ণ জিভের স্পর্শ পেয়ে তার নাসাপথ হয়ে একটা নিচু ‘হুম’ বেরিয়ে এলো। কৌশিক কাশফির গলা ছেড়ে দিয়ে কামড়ানো জায়গায় অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে কিঞ্চিৎ হাসে। তখনও পেটে কৌশিকের আঙ্গুলের বেসামাল স্পর্শে টালমাটাল কাশফি, পরপর কৌশিকের চাপা স্বরে গুরুগম্ভীর কন্ঠ কর্নকুহুরে পৌঁছালো,

“এসব ভারী গহনা গাটি থেকেও তোমার স্বামীর দেওয়া প্রথম চিহ্ন অলঙ্কার হিসাবে তোমার গলায় দুর্দান্ত লাগছে, ভয়ংকর সুন্দর মিসেস মির্জা!”

কাশফি তড়িৎ বেগে চোঁখ জোড়া খুলে আয়নার নিজের প্রতিবিম্ব দেখতেই তীক্ষ্ণ শব্দে চেচিয়ে উঠে। তেতো হয়ে সরে যেতে চাইলে কৌশিক হাতের বন্ধন আরো দৃঢ় করে, ফলে কাশফি একচুলও ছাড় না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিকের দিকে তাকায়।

“কৌশিক ছাড়ুন!”

কাশফির ঠোঁটের দিকে চেয়ে থাকা কৌশিক সঙ্গে সঙ্গে ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিলো — “না”

“আপনি লাজ লজ্জা গঙ্গা যমুনায় ভাসিয়ে দিতে পারেন কিন্তু—”
কাশফির কথা সম্পুর্ন হওয়ার আগেই ঝড়ের বেগে কাশফির অধর নিজের অধরের মাঝে প্রবেশ করালো। কৌশিকের মিন্ট আর মৃদু সি’গা’রে’টের ঘ্রাণ মিশে গেলো তার শ্বাস প্রশ্বাসে। তার স্বামীর পুরুষালী সুগন্ধির সাথে মিশ্রিত মাস্কি(musky) ঘ্রাণ গাঢ় অলিঙ্গণ করলো তাকে।
পুরুষের কোলনের(cologne) সুবাস এতো মোহনীয় কেন হয় নাকি শুধু কৌশিকেই টাই সে লক্ষ্য করেছে?
কেটে গেলো অনেক সময়,
কাশফির দম বন্ধ হওয়ায় উপক্রম, ঠিক তখনই কৌশিক তার কোমল ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দেয়। চোখ চেপে বন্ধ করে কাশফি তার বুকের উঠা নামা কমাতে ব্যাস্ত।

ঠিক তখনই ডোর ফ্রেম হয়ে রুমের বাইরে থেকে কাশফির বান্ধবী ফারাবীর চঞ্চল স্বর শোনা গেল—
“ নাউজুবিল্লাহ!!!”

কাশফি বিহ্বল হয়ে পিছনে ফিরতেই দেখে হা করে থাকা তরীর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। ছিটকে সরে যেতে নিলে কৌশিকের শক্ত হাতে আটকা পড়ে কোন রকম মুখ লুকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো— “কৌশিক!”

তড়িঘড়ি করে ঈশান বলে— “দুলাভাই কন্টিনিউ প্লিজ!”

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (৯)
#লেখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

৯.

“আপনারা আমার ওয়াইফকে সাজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে কি পারবেন?”
কৌশিক মির্জার আড়ালে উসখুস করতে থাকা নতমস্থক কাশফির কানে কথাগুলো পৌঁছাতেই সে এক আকষ্মিক ঝাঁকি দিয়ে মাথা উপরে উঠিয়ে নিলো।
বাহ!!! কি সুন্দর নিঃসংশয় হয়ে কথা বলছে যেন কিছুই ঘটেনি। কাশফির নিজেকে চাপড়াতে ইচ্ছে করলো, কৌশিকের আদো কি লাজ লজ্জা আছে? ভদ্রতা রেখে কোথায় সে তাদের কথা বলতে দিয়ে বেরিয়ে পড়বে তা না।

কৌশিক তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ন ভড়কে যাওয়া কাশফির দিকে দৃষ্টি পাত করে, পরপর তার ঠোঁটের হাঁসি প্রশস্থ করে কিঞ্চিৎ আদুরে গলায় বলল —

“আসলে আমার ম্যাডাম সব কিছু একটু সময় নিয়ে করতে পছন্দ করেন।”
বিষম খেয়ে কাশফির ভ্রু জোড়া ততক্ষনে কপালে উঠে গিয়েছে, লজ্জায় তার কান ঝা ঝা করছে। কেউ মাটি খুঁড়ে দিতে পারলে সে একবার ঢুকে এই জীবনে কৌশিক মির্জার স্ত্রী থাকা অবস্হায় আর বের হওয়ায় নাম মুখে নিতো না। রক্তিম আভা গাল হতে ধীরে ধীরে গলায় ছড়িয়েছে, আজ সকাল থেকে লজ্জা পেতে পেতে মিইয়ে পড়েছে।
সকালে কার মুখ দেখেছিল ভাবতেই গা জ্ব’লে উঠে।
অফ কোর্স, কৌশিক দ্যা গ্রেট মির্জার মুখ সর্বপ্রথম পরিদর্শন করেছিল।

নাস্তানাবুদ ঈশান দম আটকে কেশে উঠলো, ফারাবীর মুখ পানি হতে তুলে নেওয়া মাছের ন্যায় একবার খুলে বন্ধ হয়ে আবার খুলছে বার বার। কৌশিকের সৌজন্যমূলক হাসি দেখে বাইরে দাঁড়ানো বিমূঢ় ঈশান যা বুঝবার বুঝে নেয়। সে মাথা ঘুরিয়ে হা করে থাকা ফারাবীর পিঠে হালকা করে চাপড়ে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া লাগায়। তরী কিছু বলার আগেই ইতস্তত হয়ে সরে গিয়েছে।

ততক্ষনে কৌশিকের হাত আলগা হয়ে আসলো দেখে কাশফি ছো মেরে সরে দাড়িয়ে দাঁত কড়মড় করে আঙ্গুল তুলে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“এভাবে চললে তো দেখছি আমার মান ইজ্জত আপনি আশেপাশের গ্রাম গঞ্জে বিলি করে দিতেও ভাববেন না।”

কৌশিক চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে নেয়, নিজেকে নির্ঝঁঝাট রেখে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তুমি ওভার ড্রামাটিক আচরণ করছো মিসেস মির্জা।”

কশফি তেতো হয়ে তার তর্জনী দিয়ে কৌশিকের বুকের মাঝ বরাবর খোঁচা দেয়,
“আপনি এক্ষুনি আমার রুম থেকে বের হবেন।” — নিজের কণ্ঠে আরো জোর দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে নিজেকে কঠোর দেখিয়ে বলে — “রাইট নাও!”

কৌশিক ভাবলেশহীন, নিজের শক্ত আঙ্গুলের গিট পরখ করে হাত একবার বন্ধ করে আবার খুলে যেনো বিশেষ কোনো ব্যায়ামে মনোনিবেশ করেছে। কাশফি তার কড়মড় করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কৌশিকের নির্বিঘ্ন কন্ঠ শোনালো,
“বসে পড়ো মিসেস মির্জা, তোমাকে সাজানো বাকি।”

কাশিফ থ বনে গেলো, কৌশিকের পাল্লায় পড়ে কি বলার ছিল সেটাই গুলিয়ে ফেলেছে । শব্দ করে এক হাত মুখের উপর ফেলে তীব্র বিরক্ত প্রকাশ করে চাপা স্বরে গঙ্গালো। এতক্ষন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে অথচ মানুষটা তার কথা কানেই তুললো না। সে মনে মনে প্রার্থনা করল— ‘আল্লাহ আমাকে ধৈর্য্য শক্তি দিন আর না হয় কৌশিক মির্জা নামক জিবটাকে শায়েস্তা করার শক্তি দান করুন।’

মুখ দিয়ে একটা লম্বা প্রশ্বাস টেনে শ্বাস বের করে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে কোমরে হাত দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাড়ালো। পরপর চোখ গরম করে আঙ্গুল তুলে দরজার বাইরে তাক করলো,

“অনেক করেছেন আপনি কৌশিক আজকের জন্য ইনাফ। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমাকে ঝামেলামুক্ত করে বাকিটুকু একা সেজে শেষ করতে দিন!!! ”

কৌশিক এক ভ্রু উচুঁ করে, মাথা কিঞ্চিৎ কাত করে। তার ধারালো চোয়াল শক্ত করে নিলো। কাশফির দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাড়ায়, কণ্ঠে গভীরতা এনে স্বর শক্ত রেখে বলে,

“বরংবার তুমি আমার অবাধ্য হচ্ছো আবার তর্কও করছ!”

কৌশিকের আশঙ্কণীয় বাক্যে কাশফির মনে সুপ্ত ভয় জন্ম নিলো। আগের বার কৌশিককে রাগানোর আগে প্রস্তুতি নিয়েও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। এমন মোটেও নয় যে সে কৌশিককে ভয় পায় না। বুঝ হওয়ার পর থেকেই সে ভয়কে ইনিয়ে বিনিয়ে কাবু করে নিতে সক্ষম। কিন্তু কৌশিক কে বোঝার দায়, মানুষটার মুড আবহাওয়ার চেয়েও দ্রুত বদলায়। নাকি সে কৌশিক মির্জাকে বুঝতে অক্ষম, আল্লাহ মালুম!

কাশফি চোখ পিট পিট করে, গলা পরিষ্কার করে নেয়। মুখে জোরপূর্বক একটা হাসি টেনে বলে,
“আপনাকে সাজানোর সুযোগ দিয়েছিলাম আপনি সেই সুযোগ এর দুর্ব্যবহার করেছেন।”

“দুর্ব্যবহার?!”
কৌশিকের আক্রশপূর্ন কণ্ঠ বাঘের থাবার ন্যায় আক্রমণাত্মক মনে হলো কাশফির কর্ণে।

“বলার টার্ম টা হাইলি অফেন্সিভ !”
অগ্নিমূর্তি বনে থাকা কৌশিক মাথা কিঞ্চিৎ কাত করে একটা অবিশ্বাস্য হাসি হাসলো, যা কাশফির কাছে সংকটময় হয়ে ঠেকলো। সে ঢোক গিলে কৌশিকের মুষ্টিমেয় হাত পর্যবেক্ষণ করে নিলো, শক্ত শিরান্বিত হাত ফুলে ফেঁপে উঠেছে, কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। কাশফি অমতা অমতা করে বলে,

“আমি সেটা বোঝাতে চাইনি!”

“আমি তোমার স্বামী হই, পরপুরুষ না। যখন আমি বলেছি তোমার প্রতিটা লোমকূপের উপর আমার অধিকার আছে তখন আমি মজা করছিলাম না। লেট মি রিপিট ফর ইউ!”

কাশফি নিজের ভালো বুঝে ক্রোধান্মত্ত কৌশিকের থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য এক পা পিছু নিতেই কৌশিকের শক্ত পুরুষালী হাত তার বাহু ধরে আটকে নেয়। এক টানে সে কৌশিকের বুকে আছড়ে পড়ে, পরপর কৌশিকের রুদ্ধ গরম নিশ্বাস তার বদন ছেয়ে গেলো। আবার পুরুষালী শরীরের ক্লোনের ঘ্রাণ তাকে জেঁকে ধরলো, চেনা মিন্ট আর সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা প্রলুব্ধকর ঘ্রান পেয়ে তার নারী সত্তা জেগে উঠলো।
কই আগে তো কখনো সে কৌশিকের এত তুচ্ছ জিনিস খেয়াল করে নি?
তুচ্ছ? যদি তুচ্ছ হতো তাহলে তাকে জব্দ করলো কি করে?! নিজেকে আবার প্রশ্ন করল সে।

পরপর ক্ষুব্ধ কৌশিকের রাশভারী কন্ঠ তার কর্নকূহরে পৌঁছালো,
“If I meant you are mine, You Are All Fückîñg Mine and mine alone, Period!”

কাশফি কৌশিকের বুকের দিকে চেয়ে তখনো, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে এলো, চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজেকে বাক শক্তিহীন মনে হলো। নিজের এফোঁড় ওফোঁড় করা মনকে বিশ্বাস করানোর জন্য হাতের তালুতে একটা চিমটি কাটলো। না আসলেই সে স্বপ্ন দেখছে না।

অধর্য্য হয়ে থাকা কৌশিক আলতো হাতে কাশফির চিবুক উপরে তুলে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল—
“যখন আমি তোমার সাথে কথা বলছি তোমার নজর আর সম্পূর্ন মনোযোগ আমার দিকে থাকা উচিত মিসেস মির্জা।”

কাশফি বিষম খেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে, কৌশিক মির্জা কোন স্বার্থ ছাড়া তাকে বিয়ে করবে এমন রূপকথা সে বিশ্বাস কখনোই করবে না। অতঃপর মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে বসল,
“আপনি গুহার মানুষদের মতো আচরণ করেছেন কেন?”

কাশফিকে শিউরে দিয়ে কৌশিক অরসাত্মক হাঁসি হাসলো, আবার দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে তার প্রখর চিজেল চোয়াল শক্ত করে নেয়। কেবল মৌন রয়ে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে, কাশফি কেমন একটা মিইয়ে যায়। ধীরে ধীরে কৌশিকের হয়ে আগত তাপ তার মাঝে সঞ্চারিত হয়ে তাকেও উদ্দীপ্ত করছে যেন।

“ সময়টা শুধু পাঁচ বছরের নয়, এত লম্বা সময়ের হিসাব তুমি রাখোনি মিসেস মির্জা। তবে এটা জেনে রাখো তুমি কিছু ধারণা করার আগে থেকেই তুমি কৌশিক মির্জার ছিলে।”
কাশফির শ্বাস আটকে আসে, সদ্য ফোঁটা ফুলের ন্যায় পুলকিত হয় তার মন। পরক্ষণে ভাবে অন্তত কৌশিক মির্জা থেকে এসব অনাকাঙ্খিত। নিজেকে সামাল দিয়ে সে কৌশিক কে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলে এক চুলও নাড়াতে পারে না বরং তার মনে হচ্ছে এটা মানুষ নয় পাথরের তৈরি দেওয়াল।
ক্ষোভে আর লজ্জায় নিজ থেকেই সরে এসে রাগ ঝেড়ে বলে,
“বু’ল’শিট কৌশিক! আমি কোন প্রোপার্টি নয় যে আপনার হবো, জোর বিয়ে করে হক চাওয়ার বিষয়টা বেমানান।”

কৌশিক মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে সাফ সাফ জানায়,
“তুমি আমার প্রোপার্টি না তুমি অমূল্য কেউ, যার স্থান আমার সন্নিকটে, আমার সাথে, সবটা আমি জুড়ে আর আমার একান্ত জিনিসে অন্যকেউ দৃষ্টিপাত করবে সেটা আমার পছন্দ না। তাছাড়া তোমার তিন কবুল আমার কানে স্পষ্ট এসেছিল।”

কাশফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয় কৌশিকের দিকে, আসলেই সত্যি বলছে কিনা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে সে। কৌশিকের ছলনাহীন আবির্ভাব আর চোখে মুখে অকৃত্রিমতা তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে নিলো। ভাবনার অন্ত একটাই কৌশিক মির্জা নিজের বাইরে কাউকে নিয়ে ভাবতে জানে না।
মানুষ মরীচিকার পিছনে ধাওয়া করতে পছন্দ করে, সত্য থেকেও মিথ্যা কে প্রায়োরিটি বেশি দেয়। কাশফির বেলায় ঠিক তাই ঘটলো। ভলোবাসা আর বিচ্ছেদ দুটো একে অপরের বিপরীত সূত্র। তার জীবনের অস্পষ্ট কিছু অনিশ্চয়তা সে উপলব্ধি করতে পারে আর এসবে কাউকে জড়ানো আর বিশ্বাস করা নেহাতই বোকামি।

সে বিশ্বাস করল না তবে অবিশ্বাসও করল না, দ্বিধা নিয়ে আর মুখ খুললো না, কথায় কথা বাড়বে।

স্মৃতিচরণ করতেই জোভান নামটা মাথায় এলো, লোকটা তাকে পছন্দ করত কিন্তু কাশফি কাউকে নিজের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করতে জানে না, পারে না। বাবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে জোভানের সাথে বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু বিয়ের দিন না জোভান আসলো আর না তাদের পরিবারের কেউ। তখন থেকেই জোভানের প্রতি তার সুপ্ত রাগ। আশেপাশে কানা ঘুষা চললো, মানুষ বদনাম রটানোর পূর্ব মুহুর্তেই কৌশিক হাজির হয় তবে বীর বেশে নয়, একটা ত্রাস সৃষ্টি করতে এসেছিল বোধয়। হুমকির উপর তাকে বিয়ে করে নেয়।

কৌশিক কাশফির দুই গালে আলতো হাত রেখে অতীতের পাতা থেকে তাকে বর্তমানে টেনে আনলো। কাশফি চোখ ঝাপটায়, নিজেকে কৌশিকের সন্নিবেশে আবিষ্কার করে একটা ঢোক গিলতে নেয়। কিন্তু মনে হচ্ছে তার গলা ধরে আসছে, মানুষটার সামনে তার নার্ভ সিস্টেম পর্যন্ত এলোমেলো হয়ে যায়, মাথায় কি কি আজগুবি জিনিস আঁকাবুকি করে। তার ভিতর বড়সর সমস্যা দেখা দিয়েছে হয়ত। নিজের আউলা ঝাউলা ভাবনা ভেদ করে কৌশিকের পুরু হাস্কি গলা শোনালো কানে—
“তাই মাথায় বিদ্রোহ আর কু’বু’দ্ধি না চেপে নিজের স্বামীর যত্ন নিতে শিখ। আলাদা বিষয় যে কাল রাত ছাড়া পেয়েছিলে কিন্তু আর নয় বিয়ে করেছি বউ নিয়ে না ঘুমালে আমার বিবেক আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।”

বিব্রত হয়ে কাশফি মাথা ঘুরিয়ে নেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো যে, কৌশিক যেই দিন থেকে তাকে জবুথবু করা ছেড়ে দিবে সেইদিন কৌশিকের নাম পাল্টে ফেলবে। কাশফি ঘন ঘন শ্বাস টেনে হিস হিস শব্দ করে বলে,
“আপনি একটা যা তা কৌশিক!”

উল্টো কৌশিক তার কথার ধার না ঘেঁষে একটা বাকা হাঁসি দিয়ে নরম গাল ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলে,
“বার বার মানা করার সত্বেও তুমি আমার কথার বিরুদ্ধে যেতে চাইছো, বলো তো কি শাস্তি দেওয়া যায়?”

কৌশিক তার চাপা দাড়িতে হাত রেখে কিছুক্ষণ ভাবতে নেয়। ভোঁতা মুখী কাশফি তার বিরুদ্ধে বাক্য ছুড়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলে,

“কৌশিক —”

“শাস্তি হলো তোমার সবার সামনে কোলে করে গাড়িতে তুলব আর কোলে করে বের করব আর আমার বিপক্ষে কিছু বলার সাহস নিয়ে তোমার মিষ্টি তুলতুলে ঠোঁট জোড়া যদি খুলে তাহলে ২৪ ঘণ্টার জন্য আমার কোলে তুমি নিজেকে দেখবে।”

হতবম্ব কাশফি জোর গলায় কিছু বলতে নেয়,
“আপনি কিভাবে—?”

“বাহাত্তর ঘণ্টা আমার কোলে আর নিজের উপর আমি কোন প্রকার নিয়ন্ত্রিত রাখবো না মিসেস মির্জা।”
কথা সম্পূর্ন করার আগেই কৌশিকের কাঠ কাঠ কণ্ঠ শুনে সে আতকে উঠে মুখ কুঁচকে ফেলে। দ্রুত দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে ফটফট করে বলে,

“ওকে, ওকে, কৌশিক! আমি আর কিছু বলছিনা, আই প্রমিস!”

কৌশিক তার ঠোটের কোনে হাসি রেখে গলা নামিয়ে বলল,
“গুড গার্ল”
কাশফি মনে মনে তাকে অনুকরণ করে ভাঙ্গলো। গুড গার্ল না, কৌশিকের তারছেড়া মাথার মুন্ডু!

“আর শোনো…”
বিরস মুখে কাশফি কৌশিকের মুখ পানে চাইলো। কৌশিক বিশুদ্ধ রকমের অল্প তবে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। যেন সে নিজের হাসি কমানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে আছে। কৌশিক সন্তপর্নে কাশফির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফেঁসফেঁসে কণ্ঠে গলা নামিয়ে বলল,
“আর আমি অসমাপ্ত কাজ ফেলে রাখতে পছন্দ করি না, জান।”

কাশফি লক্ষ্য করল কৌশিকের শার্প জ-লাইনের নিচে দৃশ্যমান এ্যাডাম অ্যাপেল ওঠানামা করছে। সে কি কিছু নিয়ে নার্ভাস, তারও কি উদ্বিগ্নতা কাজ করে?
কাশফি কিছু বলার আগেই কৌশিকের ঠোঁট তার ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে গেলো। আনমনে কাশফির হাত কৌশিকের বুকে পাঞ্জাবির অংশ খাঁমচে ধরে। শক্ত পোক্ত হাত ঘিরে ধরে কাশফির মাথার পিছনের অংশ, অরেক হাত কড়া অধিকারবোধ নিয়ে বেষ্টিত করে তার কোমর। সেই পরিচিত ক্লোন, মিন্ট আর স্মোকের সুবাস। কৌশিক কাশফির জন্য একটা রিফ্রেশমেন্ট বটে, নিজের প্রতিটা নিশ্বাসের মাঝে কৌশিকের অস্তিত্ব পাচ্ছে সে। প্রভাবশালী হাতের প্রতিটা কাঁপিয়ে তোলা স্পর্শ, জিভের স্ট্রোক, যেন সময় নিয়ে আরধিত করেছিল সে কশফিকে, খুবই ধীরে সুস্থে,
প্রতি ক্ষণ উপভোগ করে।

কৌশিক বেশ সময় নিয়ে কাশফিকে ছেড়ে তার মুখ গুঁজে কাশফির গলায়। নিজের বেগতিক শ্বাস নিয়ন্ত্রণে ব্যাস্ত কাশফি আপত্তি করেনি।

হালকা চাপা গোঙানির আওয়াজে কৌশিক হাস্কি কন্ঠে বলে—
“তোমার চেরি ব্লোসম আর ভ্যানিলার সুবাস দুইদিনে আমার সেলফ কন্ট্রোলকে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিলো, কাশফি। তুমি শীতের সকালের মিষ্টি রোদের ন্যায়, নামে মাত্র মিষ্টি কিন্তু তেজ ঠিক একই, আমার সানশাইন।”

মূর্তি হয়ে থাকা কাশফির গলা থেকে মাথা তুলে কৌশিক। কাশফির কপালে কপাল ঠেকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসা কন্ঠে বলল,

“তুমি যেই বাতাসে শ্বাস নাও সেই বাতাস কেবল আমার হোক, কাশফি!”
কৌশিকের বলার চাহনিতে এমন কিছু একটা ছিল যা তার ভিতরটা দুলিয়ে সায় দেয়।

কৌশিক কিছুটা সরে জুয়েলারী আর বাদ বাকি অর্নামেন্টর পরিয়ে কাশফিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। এতটা আলতো করে ধরছে যেন এদিক সেদিক হলেই সে ব্যাথা পাবে। কাশফির বুঝে আসছেনা কিছুই। কোন ক্রমেই তার মাথায় জট পাকা সমীকরণ মিলছে না।
একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের উদ্দ্যেশ্য মনে করিয়ে দিলো, কৌশিকের ক্ষমতা আর কৌশিক কে কাজে লাগানো।

আর কিছু নয়।

সত্যি কি আর কিছু নয়। উত্তর দিতে কাশফি অনিচ্ছুক।

সম্পূর্ন কাশফির মাঝে অভিনিবেশ করা কৌশিক কাশফির চুল পিছনের দিকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে এক নাগাড়ে চেয়ে আছে। অতঃপর অস্ফুট স্বরে “মাশা’আল্লাহ” বলে কপালে গাঢ় চুম্বন আঁকে।

***

কুনুই টেবিলে রেখে দুই হাত জড়ো করে মুষ্ঠীতে মাথার ভার রেখে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে বসে আছেন আতিকুর রহমান। স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখেন,

এক আর্ট গ্যালারিতে তার আর চারুলতার দেখা হয়েছিল। চারুলতা ধনী পরিবারের মেয়ে ছিল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার সত্ত্বেও ভালোবেসে বিসর্জন দিয়েছিল সবকিছু। এত ভালোবাসার মাঝে সব পাল্টে যায়, চারুলতা ড্রা’গ এডিক্টেড হয়ে পড়ে।

তাদের প্রথম সন্তান ঈশিতা ইমরোজ কাশফি, আনেক্সপেক্টেড ছিল। তবে ভালোবাসার কমতি ছিল না। ধীরে ধীরে চারুলতা কাশফির প্রতি বেশ উদাসীন হয়ে গেলো। প্রায়ই কাশফিকে কেয়ার টেকারের কাছে রেখে সে দুই তিনদিন উধাও হয়ে যেত। ফুর্তি করে ক্লাবে রাত কাটানো যেন তার রুটিন হয়ে উঠলো। এক মধ্যরাতে আতিকুর রহমানের কাছে ফোন আসে যে তার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে, তাকে পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আতিকুর রহমানের মাথায় যেন বাজ পড়লো, সে কোন রকম এসে পৌঁছে খবর পায় ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ায় কাশফির নিশ্বাস আসছে না, বেঁচে ফিরার চান্স খুবই কম। জন্মের পরপর তার মেয়ে তার পৃথিবী হয়ে উঠে, বাবা হিসাবে এমন কিছু মানতে পারেন নি। খোঁজ নিয়ে চারুলতাকে মাতাল অবস্থায় অন্যপুরুষের অ্যাপার্টমেন্টে দেখে মুখে তালাক দিয়ে বসেন কিন্তু পরে আবার ফিরিয়ে নেন।

এতকিছুর মধ্যে তার একমাত্র সন্তান কাশফি তার বাবা মায়ের সম্পর্কের বিষাক্ততা, তিক্ততা সহ্য করতে না পেরে ভুল পথ বেছে নেয়। আতিকুর রহমানের শূন্যতা আর অনুশোচনা এই জীবনের চিরসঙ্গী।
যেমন কিছুক্ষণ আগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে কৌশিক মির্জা।

“কাশফিকে আজ আমি যথাস্থানে নিয়ে যাবো, যেখানে তার থাকার প্রয়োজন — আমার কাছে, আমার পাশে। আপনার অতীত নিয়ে পড়ে থাকার মতো জঘণ্য একটা সিদ্ধান্ত অনেক গুলো জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আপনাকে বিশ্বাস করে আবরার কবীর চরম ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রহমান সাহেব।”

তিনি ডুকরে কেঁদে উঠেন। না পেলেন একুল না অকুল। পরিশেষে তিনি সব হারালেন।

সব!

***

কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই তার লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেহায়া মন যেন কৌশিকের বাহু ধরে ঝুলছে এখনো। আসলেই কি কৌশিক তাকে পছন্দ করে? নাকি আবার কোন মাইন্ড গেইম খেলছে। ফারাবীর বকবক শুনে সে কিঞ্চিৎ হাসলো। সোফায় ঈশান বাকিদের জন্য আনা ফল আর নাস্তা সাবাড় করছে। তাদের মাঝে কায়েস বসে বসে কাজু বাদাম খাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর কাশফিকে একটা একটা খাইয়ে দিচ্ছে। কাশফির আনমনা ভাব তরী ঠিকই খেয়াল করলো,

“ঈশি, তুই ঠিক আছিস?”
কাশফি মাথা নেড়ে বোঝায় সে ঠিক আছে।
আসলে সে ঠিক নেই তার মন মেজাজ একে অপরের প্রতি বিক্ষিপ্ত আচরণ করছে, একপ্রকার সংশয়িত পর্যায়ে থেকে সে পাগল প্রায়।

“কৌশিক মির্জা নিজেকে তোর উপরে চাপিয়ে দেয়নি তো?”

“নাহ, তেমন কিছু না।” — কাশফি কপালে হাত ঘষে একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
“আসলে ভীষণ কম্প্লিকেসিতে ভুগছি।”

তরী একটা হাঁসি দিয়ে কাশফির পাশে বসে তার কাঁধ জাপটে ধরে বলে,
“ভয় পাওয়ার দরকার নেই ঈশি, আমরা তোর পাশেই আছি।”
ফারাবী উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। পরক্ষণে সে আবার দুষ্টু হাঁসি হেসে কাশফির পাশে বসে। আশেপাশে তাঁকিয়ে সে ফুসুর ফুসুর করে বলে,

“আচ্ছা, তোদের মাঝে কতদূর গড়িয়েছে?”

কাশফি প্রথমে বিষম খেয়ে গেলো ঘটনা সামাল দিয়ে কাশফির পিঠে চাপড় দেয়,

“কেনো দিগন্ত ভাইকে খবর দিয়ে দেখাতে বলব নাকি?”
তরী ভ্রু নাচিয়ে বলে, তার কথায় ফারাবীর মুখ ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে যায়। তাদের মাঝে আর কিছু বলে উঠার আগে কাশফির ডাক পড়ে যায়।

কৌশিকের দ্বিতীয়বার “কাশফি” ডাকের সাথে সাথেই কাশফি উঠে পৌঁছানোর জন্য দৌড় লাগায়। এখানে পৌঁছে সে আবার কি না কি বলে বিব্রত করে ছাড়ে!

শাড়ির কুচি ধরে হন্তদন্ত হয়ে কৌশিকের কামরায় আসতেই দেখে কৌশিক হাতে ওয়াচ পরে নিচ্ছে। কৌশিক তার দিকে না ফিরেই বলে,

“আধা ঘণ্টার মধ্যে ড্রাইভার এসে পড়েবে, তুমি রেডি?”

কাশফি হালকা করে ‘হুঁ’ বলে ব্যাস্ত কৌশিকের দিকে তাকায়। তারপর নিঃশব্দে তার কামরার দিকে পা বাড়ায়। কামরায় ফিরতে গিয়ে আবার কিছু একটা মনে করে উপরের দিকে মাথা তুলে, চিলেকোঠার ঘরে ছোট একটা তালা ঝুলছে।
হনহন করে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে, আলমারির ড্রায়ার থেকে একটা চাবি বের করে চিলেকোঠার ঘরে পা বাড়ায়। সেদিকটায় কিছুটা অন্ধকার, কেউ তেমন একটা যায় না। সে পা টিপে টিপে দরজার সামনে এসে চাবি ঢোকায় তলায়, মৃদু শব্দ করে তালা খুলে যায়, আঙ্গুলের হালকা ধাক্কা দিতেই ক্যাট ক্যাট শব্দে দরজা ফাঁক হয়ে যায়।
স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ভেতরটায় কেমন এক ভ্যাপসা গন্ধ। কাশফি ইদুরের ভয়ে হাত মুঠ করে রেখেছে। কোন রকম এগিয়ে এসে খাটের তলা থেকে ধুলো ঝেড়ে ব্রিফকেসটা বের করে নেয়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লক খুলে খুব পুরনো একটা জার্নাল বের করে নেয়।
এর উপর তিড়িং বিড়িং অক্ষরে লিখা একটা নাম,

“আরিয়ানা”

নামের নিচে কয়েকটা ফুল আঁকা। কাশফি জার্নালের কভার ফু দিয়ে ময়লা উড়িয়ে আবার হাত দিয়ে মুছে।

প্রথমবার যখন সে এসেছিল তখন গন্ধে আর ভয়ে নিজের কক্ষে ফিরেই বমি করে ভাসিয়েছিল। বহু বছর আগে দ্বিতীয়বার জার্নালটা হাতে নিয়ে শুধূ দুটো পেইজ পড়েছিল, ঠিক পড়েছিল নয় চোখ বুলিয়েছিল।

পেইজ নং ২৪৩, ২৪৪
পাশাপাশি দুটো পেইজ। প্রথম এক লাইন পরে তার মাথা ঘুরিয়ে গিয়েছিল, তার রাতের দুঃস্বপ্ন গুলো আক্রমণাত্মক হয়ে ফিরেছিল। তখন ডক্টর ইয়াহিয়া খান তাকে কিছু ঔষুধ, ব্যায়াম আর অতীত নিয়ে চিন্তা করতে কঠোর ভাবে মানা করে দেন। এরপর আর আশা হয়নি।

আজ বহুবছর পর তৃতীয়বারের মতো সাহস জুটিয়ে এসেছে। কাশফি ঢোক গিলে কাপা কাপা হাতে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নেয়। নিজেকে হাজার বার আশ্বস্থ করতে করতে কাঙ্ক্ষিত পৃষ্ঠায় চোখ পড়তেই তার হাত থেমে যায়। পুরোটা লিখা পড়ে তার মাঝে শীতল ঝড় বয়ে যায়। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট। ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাসের মিলিয়ে পড়া শব্দ।
কপাল গড়িয়ে টুপ করে এক ফোঁটা ঘাম পড়ল মাটিতে,
অনুসরণ করল ঘামের দ্বিতীয় ফোঁটা।

টিউবলাইটের আবছা আলো জার্নালের ভাঁজে পড়েছে, মোটা কালিতে পেইজ নং লিখা,
243 Page

অগোছালো হাতের কালো কালিতে লিখা শব্দগুলো—

“আমি মারা যেতে চাই কারণ আমার আত্মার মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে। ঈশিতার পরিণতির জন্য শুধুই আমি দায়ী, তার থেকে শেষ মুহূর্তে ক্ষমা চাওয়া হলো না। কি নিষ্টুর আমি! আমার বাবা আমাকে বাঁচাতে প্রতি নিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন কিন্তু তিনি কি জানেন? যে ব্যাক্তি মারা যেতে চায় তাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো পীড়াদায়ক আর কিছু না।”

244 Page

“আমি না হয় সবার কষ্ট কমিয়ে দিলাম।”

#চলবে…