অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা পর্ব-২০+২১+২২

0
286

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২০)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

জানালার পাশে ছোট্ট একটা গোল টেবিলে বসে অনিমেষ নেত্রে চেয়ে আছে ক্যাম্পাসের বাইরের দিকটায়। দুই চারটা চুল তার মুখের উপর এসে পড়েছে। রাস্তায় একটা কালো গাড়ি আসা মাত্রই সে তার সূক্ষ্ম নজর গাড়িতে দেয় পরক্ষণে হতাশ হয়ে যায়, এটা সেই কালো গাড়ি নয়। সকালে গোসল দেরীতে করায় তার চুল কিছুটা ভেজা ছিল তাই খোলাই রেখেছে।
আজ ঠিক একসপ্তাহ হতে চলল,
অজানা শঙ্কায় তার মন কু গাইছে, হঠাৎ কোন দিন না কোন দিন লোকটা তার পিছনে এসে দাড়িয়ে নিখুঁত অভিনয় করে বলবে — ‘কাশফি, হোয়াট আ কো ইনসিডেন্ট’
কাশফি আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ হাতের প্লাস্টিক কাপ নাড়াচ্ছে নয়ত অলস গতিতে স্ট্র মুখে দিয়ে টেনে লেমনেইড টুকু পান করছে। তার দুই বান্ধবী গোল টেবিলের উপরে রাখা ছোট গোলাপের বুকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত।

“Roses are red
Violets are blue
Don’t know when
I fell in love with you
এটা গম্ভীর শান্ত স্বভাবের মেয়ের জন্য যে আমাকে ইগনোর করে চলে।”

টকটকে লাল গোলাপের বুকেতে এমন ক্লিশে টাইপ টাইপের লাইন লিখা দেখে তরী নাক সিটকায় আর অন্যদিকে ফারাবী আবেগকম্পিত। একই সময়ে তরী আর ফারাবী একসাথে দুই বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া দেখলো।

“ছিঃ… Ewww”
“Awww, how sweet!”
তারা দুইজন দুজনের রিয়্যাকশন দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তরী চোঁখ পাকিয়ে শাসানোর সুরে বলে—
“Are you gushing over this?!”

তরীর চোঁখে মুখে বিতৃষ্ণা দেখেও ফারাবী শ্রাগ করে বলে—
“তো কি হয়েছে, I like that!”

“Grow up Farabi…”

“How mean of you!”
ফারাবীর কণ্ঠে ন্যাকামি টের পাওয়া মাত্রই তরী চোঁখ গরম করে ওয়ার্ন করার সুরে বলে —
“Don’t start!”

এতক্ষণ নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করা কাশফি তাদের দুইজন কে একে অপরের গলায় ঝুলে ঝগড়া করতে দেখে চোখ উল্টে ফোঁস করে মুখ দিতে শ্বাস ফেলে। টেবিলে জোরে হাত রেখে নিচুস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠে—
“ফুল আমাকে দিয়েছে তোদের এতো মাতামাতি কিসের রে?!”

বলেই কাশফি কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে পুনরায় চিন্তায় উবে গেলো। জোভান শিকদার নাছোড়বান্দা, পাত্তা না পাওয়ার পরও কেমন জানি পিছনে লেগে আছে। এসব নিয়ে সে কম বিরক্ত নয় তবে আপাতত চিন্তার কোন কারণ দেখছে না। তার চিন্তার কারণ একটাই, তির্যক আর নির্জীব দৃষ্টির হিং’স্র পুরুষ।

“আচ্ছা ছেলেটা কি তোকে প্রোপোজ করে ছিল?”
ফারাবীর কথায় কাশফি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পূর্বের অবস্থানে থেকেই মাথা নাড়ায়,

“আমি তাকে কথা বলার কোনো সুযোগ দিলেই তো!”

ফারাবী আরো কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তাদের টেবিলে কাশফির ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। ডিসপ্লে তে আননোন নাম্বার দেখে কাশফি ভ্রু কুঁচকে নেয়, পরক্ষণে নাম্বারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই তার ভ্রু কপালে উঠে যায়, তৎক্ষণাৎ তার বুকে কাপন ধরে। ঠিক আননোন নাম্বার বলা যায় না, বলা চলে খুবই পরিচিত নাম্বার কেবল কন্টাক্ট লিস্টে সেভ করা হয়নি। মোবাইল হাতে সে ডিসপ্লে থেকে চোঁখ সরিয়ে আসেপাশে চোঁখ বুলিয়ে দেখলো, তবে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কৌশিক মির্জার ছায়ার সন্ধান ও পেলো না।

এদিকে ফোন ভাইব্রেট হতে হতে কেটে গেলো দেখে কাশফি স্বস্থির নিশ্বাস ফেলতে নিলেই আবার ভাইব্রেট করে ইনকামিং কল শো করছে। কাশফি চোঁখ বন্ধ করে মুখ জটিল করে নেয়। টেবিল থেকে উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে,

“আমার busy schedule থেকে সময় বের করে আপনাকে কল করার সময় থাকে কিন্তু আপনার কি রিসিভ করার সময় নেই ম্যাডাম?”

কৌশিকের পুরুষালী হাস্কী কণ্ঠে তীব্র অধিকারবোধ স্পষ্টত। কাশফি হকচকিয়ে যায়, ঠিক কি জবাব দিবে ভাবতে পায় না। ভাবতে ভাবতে কৌশিক আবার বলে উঠে,

“কেমন আছি জিজ্ঞেস করবেন না কাশফি।”

“কল কেনো দিয়েছেন?”

“আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য কল দিয়েছি।”
কাশফি হতবিহ্বল বনে যায়, পরক্ষণে নিজেকে সামলে কৌশিকের উদ্দ্যেশে বলে — “হেঁয়ালি করবেন না!”

অপর পাশে কৌশিকের কণ্ঠে যেনো হাঁসির আভা পাওয়া গেলো, কণ্ঠে আরো গম্ভীরতা এনে বলল,
“All right, Let’s get to the point.”

কাশফিও আইঢাই না করে ফট করে উত্তর দিলো,
“I’m all ears”

বেশ কিছুদিন কৌশিক নিরবতা পালন করে রইল, যেনো সন্তপর্নে এবং আলগোছে সময় গুনছে। অতঃপর একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে অত্যন্ত রাশভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলো—

“জোভান শিকদার এই মুহূর্তে আপনার ক্যাম্পাসেই আছে।“

কাশফি আশ্চর্য্য বনে পিছনে ফিরে চাইতে গেলে কৌশিক ঝাঁঝালো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল— “তার দিকে ফিরে তাকে আশকারা দিবেন না, কাশফি।”

কাশফি নিজের সাফাই দিয়ে ছোট্ট করে বলে ‘জ্বি তাকাইনি’
কৌশিক নিজের কণ্ঠ খাদে নামিয়ে, কর্কশ স্বরে বললো,

“আমি চাই আপনি ফুলগুলো ডাস্টবিনে ফেলে এখনই ক্লাসে ফিরে যাবেন, রাইট ফাকিং নাও!”

কাশফি মনে শঙ্কা তবে কণ্ঠে জোর এনে জিজ্ঞেস করেন,
“আপনি চাইলেই কি মানতে হবে?!”

শরীর কাঁপিয়ে হেঁসে উঠে কৌশিক, যেনো হাস্যরসিক কোন আসরে জমিয়ে মজা নিচ্ছেন। পরক্ষণে হাঁসি থামিয়ে রাশভারী কণ্ঠ নামিয়ে শুধলো,
“আমার অবাধ্য হয়ে বিপদ টেনে নেওয়ার মতো বোকা তুমি নয়।”

কাশফি খট করে কল কেটে দেয়। ফিরে এসে তার বান্ধবীদয়ের প্রশ্নোত্বক দৃষ্টি উপেক্ষা করে চেয়ার থেকে ব্যাগ তুলে কাঁধে নেয় তারপর গোলাপের বুকেটা টেবিল থেকে তুলে হাঁটতে শুরু করে, তার পিছন পিছন তার বান্ধবীরা ছুটছে। ক্যান্টিনের বাইরের ডাস্টবিনের সামনে এসে চোয়াল শক্ত করে অনিমেষেই ফুলের বুকেটা ফেলে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে।

যতসব উটকো ঝামেলা তার!

***

সেই দিন রাতে কাশফি রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলো, খেয়ে দেয়ে টেবিল গুছিয়ে নিতেই হঠাৎ বেলের আওয়াজ শুনে দৌঁড়ে দরজা খুলে। দরজার সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা বিরক্ত হয়, পরক্ষণে নিচে একটা কালো রাপিং পেপারে মোড়ানো ছোটবক্স দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিভ্রান্ত হয়ে আসেপাশে তাঁকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। কাউকে দেখতে না পেয়ে হাঁটু গেটে বসলো বক্সটার সামনে। সংশয়াপন্ন হাতে বক্সের উপরে আটকানো ট্যাগটায় সে নিজের নাম দেখতে পেলো শুধু — “Kashfi”

তৎক্ষণাৎ তার কৌশিক মির্জার কথা মনে পড়ে যায়, কিন্তু নিজের ভাবনা কে ভুল মনে করে নেয়। সে ভয়ে ভয়ে রেপিং পেপার ছিঁড়ে বক্স খুলে কিছু পাঞ্চ ক্লিপ, হিট প্রটেক্টর আর একটা ব্লো ড্রায়ার সাথে একটা নোট। কাশফি নোটটা তুলে নিলো। ব্যাক কার্ডে বোল্ড গোল্ডেন অক্ষরে এলোমেলো হাতের লিখা—
“আপনার কলেজ ক্যাম্পাসে আনুমানিক তেত্রিশ হাজার স্টুডেন্টের আনাগোনা অথচ তাদের কাউকে আপনার চুল দেখার পারমিশন আমি দিই নি। এখন থেকে কলেজে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে ব্লো ড্রায় দিয়ে চুল শুকিয়ে নিবেন, ম্যাডাম। ভেজা চুল ছেড়ে রেখে কাউকে বেসামাল করবেন না, আমি কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।”

মুহূর্তেই কাশফির পুরো গাল চেরির মতো লাল বনে গেলো। শুন্য মস্তিষ্কে হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইলো কেবল। দুরু দুরু বুকে ভাবতে উদ্যত হয়,
অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?!

গভীর রকম করে ভাবতেই তার গলা ঢুকিয়ে আসে, লাজ রাঙা মুখ শক্ত করে গলায় ঝুলন্ত ওড়না হাতে মুঠ করে ধরে চোঁখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়,
“আপনি এতো অসভ্য কেনো কৌশিক!”

নিজেকে সামলে সে ঠোঁট কামড়ে নেয়, তার পেটের ভিতরে কেমন জানি সুড়সুড়ি লাগছে। এসব ভাবনার অন্ত ঘটাতে সে নিজের হাতে চিমটি কাটে। বক্স কোলে তুলে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে হুট করেই থমকে দাড়ায়। কেনো জানি বাইরে এক বার চোখ বুলানোর জন্য মন খচখচ করছে। নিজের মনকে বোঝানোর জন্য সে দরজার ফাঁকে মাথা বের করে, অতঃপর চোখ ছোট ছোট করে আরো ভালো করে সামনে পরখ করে হতচকিত হয়ে যায়।
কিছুটা দূরে একটা কালো SUV দাঁড় করানো তার পাশেই একটা সুঠাম দেহের ছায়ামূর্তি পিঠ গাড়ীতে ঠেকিয়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে আর তার পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে উড়ে যাচ্ছে নিকোটিনের ধোয়া । সে ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা সিগারেট মুখে চেপে ধোঁয়া টেনে নিয়ে কিছুক্ষন পর ধোঁয়াটুকু নাক দিয়ে ছেড়ে দিলো।

তার নজর ঠিক কোনদিকে বুঝতে পেরে কাশফির কাধ চওড়া হয়ে এলো। কালো আর গোল্ডেন মানে এলিগেন্ট আর পারফেক্ট আর এই পারফেক্ট কৌশিক মির্জা যাই করুক না কেনো তার কাকের ঠ্যাং এর মতো হাতের লেখা পরিবর্তন করতে অক্ষম। তার আগেই বুঝে নেওয়ার উচিত ছিল যে এটা অন্য কেউ নয় কৌশিক মির্জা তার জন্য পাঠিয়েছে।

সে এলোমেলো হাতের লেখা আবার দেখে নেয়, এতো বাজে হাতের লিখা কারো হয় নাকি?
চুল ভেজা ছিল দেখে অফ পিরিয়ডে দশ মিনিটের জন্য চুল ছেড়ে দিয়েছিল। তেমন কেউ না দেখলেও কৌশিকের বাজপাখির মতো নজরের আড়াল হওয়ার সাধ্য কি তার আছে?

নেই।

রুমে এসে পৌঁছাতেই তার ফোনে টুংটাং মেসেজের শব্দ শোনা যায়। বক্সটা পড়ার টেবিলে রেখে ফোনে মেসেজ দেখে নেয়,
“ধন্যবাদ না হয় আমি নিয়ে নিলাম তবে বলুন তো আপনার এই সুন্দর হাঁসিটা দেখতে পাওয়ার জন্য কি প্রতিদিন বাজে হাতের হ্যান্ডনোট লিখতে হবে?”

মেসেজ টা দেখতেই তার উজ্জ্বল গাল আবার লাল বর্ণের হয়ে উঠে, সে কি আদো হেসেছিল?
নিজেকে একটা কড়া ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেনো হেসেছে সে? মনে মনে লজ্জা পেয়ে সে নিজেকে কঠিন করে মেসেজের উত্তর দিলো,
“এতো বাজে হাতের লিখা পড়ে দৃষ্টিশক্তির অপচয় করতে অনিচ্ছুক।”

তৎক্ষণাৎ এর ছোট্ট জবাব এলো — “Rude!“

কাশফি দেখেই বেরিয়ে পড়লো, ফোন টেবিলে রাখার পরপরই তার মাথায় চট করে ধরলো যে সে আজ কৌশিক মির্জার সাথে নিজ থেকে কথা বলেছে। তার তো কৌশিক মির্জা কে ঘৃনা করার কথা!
নিজের কাণ্ডে নিজে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো।

#চলবে…

#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২১)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

২১.

“চরম পর্যায়ের বোকা ঈশিতা ইমরোজ কাশফি,
আশা করি তোমার মস্তিষ্ক বর্তমান আর অতীত নিয়ে গুলিয়ে ফেলেছে। তবে কি জানো? অতীত আর বর্তমানের মাঝে খুবই সূক্ষ্ম একটা প্যারানরমাল লাইন থাকে। জোর গলায় বলছি সেই লাইন খোঁজার সাধ্য তোমার নেই। বাজে রকমের একটা গোলক ধাঁধায় ফেঁসে আছো আজ বহু বছর অথচ আঁচ করতে পারছো না যে তোমার বোর্ডের দাবার চাল অন্য কেউ তোমাকে বানিয়ে চালছে, বড্ড আফসোস হয়। মুখোশের আড়ালে একজন তোমায় পুতুলের মতো যেমন ইচ্ছে তেমন করে নাচাচ্ছে। নেহাতই বোকা তুমি ঈশিতা।

ইতি,
তোমার ভাগ্যে নিয়ে উপহাস করা অগুন্তুক”

ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার পর ফোনে এমন একটা উদ্ভট ইমেইল পেয়ে কাশফির চোঁখ ছানাবড়া। ভয় হানা দিয়ে উথালপাতাল করে তুললো তার ভিতর। নিজের ব্যাপারে খুবই কনসার্ন সে! তবে কি অগুন্তুক তার অতীত সম্পর্কে অবগত?
নিজের ইমেইল ডক্টর ইয়াহিয়া খান ছাড়া আর কাউকে দেয় নি সে, তবে কি কেউ মজার ছলে এমন করেছে? নিজের করা প্রশ্নে সে নিজেই বিরক্ত। আদো কি কেউ মজার ছলে এসব করবে!
প্রেরকের ইমেইল এড্রেস নামহীন। কাশফি হতাশার শ্বাস ফেলে ফোন ব্যাগে ভরে নেয় তবে তার মনের ভয় দিন দিন বেড়েই চলছে। বিগত তিন চারটে রাত হতে সে স্বপ্নে নীল শাড়ি পরিহিতা কিশোরী নীলাম্বরী কে দেখেছে, ম’র্মা’ন্তিক নীলাম্বরীর ক’রু’ন চিত্র। নীল শাড়িতে তাজা র’ক্তে’র ফোঁটা নিয়ে নীলাম্বরী তার কাছে যেনো প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল বারবার। নীলাম্বরীর মলিন মুখ যত বার দেখছে ততবারই যেনো তার আত্মা কেঁপে উঠে, গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যায়। কি এমন হয়েছিল কাশফির সাথে যে সে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন করেছিল? নীলাম্বরী কি আদো কাশফি ছিলো?
হোক না হোক কিন্তু নীলাম্বরী ঠিক কতটুকু বেদনার শিকার ছিলো?

ইদানিং ক্যাম্পাসের মানুষ জন তার দিকে বাঁকা নজর দেয়। কানাঘুষা করা লোকজন কৌশিক মির্জা আর তার নাম জোরপূর্বক জুড়ে দিয়েছে। তবে আজ কাশফি এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে হেঁটে চলল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ সে পাশ্ববর্তী শহরের উদ্দ্যেশে রওনা হবে, এই মুহূর্তে এসব জটলা খোলার উপায় একটাই!

কাশফি লম্বা লম্বা কদম ফেলে তার জন্য দাড়িয়ে থাকা রিক্সায় চড়ে বসলো। দাঁত কেলিয়ে দাড়িয়ে থাকা রিক্সা চালক কে ইশারায় জানালো চলতে। বাসায় ফিরতে পনেরো মিনিটের মতো সময় লাগলো, সে বাসায় প্রবেশমাত্রই ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে একজন কে কল লাগলো। ফোন রিসিভ হওয়ার পর দুই পক্ষ অভিবাদন পর্ব চুকিয়ে জানালো,
“আজ বিকালের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখবেন, ধন্যবাদ।

কাশফি ফোন কান থেকে নামিয়ে কিছু একটা টাইপ করে নেয়। কাজ শেষে কায়েসের কামরায় ঢুকে আলমারি থেকে ছোট্ট একটা ব্যাগ খুঁজে বের করে। ব্যাগে কয়েসের জামা কাপড়, ব্রাশ টুথপেস্ট আর দুটো বই ঢুকিয়ে সে হতবম্ব কায়েস কে নিয়ে বাসা লক করে বেরিয়ে পড়লো। তাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে এসে রাস্তার মাথায় একটা বাড়ির গেইটের সামনে দাড়ানো মাত্রই গেইট ঠেলে হাঁপাতে থাকা ফারাবী এসে দাঁড়ায়।

“ভিতরে এসে বোস!”

“সময় নেই রে, অন্যকোন দিন। আন্টি আঙ্কেল কে সালাম দিস।”

“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

“কাজে।”
কাশফির ছোট্ট উত্তরে ফারাবী বুঝে নেয় সে বলতে অনিচ্ছুক। ফারাবী মাথা দুলিয়ে কায়েসকে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু কায়েস মুখ কালো করে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। কাশফি হাঁটু গেটে বসলো কায়েসের সামনে,

“বুবু আমি তোমার সাথে যাবো!”

“অনেক ভিড় সেখানে, পা ব্যাথা করবে কিন্তু!”

“তুমি বাম ডলে দিলে চলে যাবে।”
কায়েস নাছোড়বান্দা, মাথা নেড়ে জানালো যাই হয়ে যাক সে তো যাবেই! কাশফি উপায়ন্তর না পেয়ে কায়েসের ছোট্ট হাতদুটো মুঠ করে ধরে হালকা হাসলো,

“ওয়াটার গান নিয়ে আসবো, হবে তো?!”

***

কাশফি চেম্বারে বসে একহাতে স্ট্রেচ বল অন্যহাত দিয়ে পেপার ওয়েট ঘুরাচ্ছে। সামনে ষাট ঊর্ধ্ব পাকা দাড়ি গোঁফে ভর্তি মুখ আর টাক মাথায় টুপি পরা ডক্টর ইয়াহিয়া খান। আতিকুর রহমানের ভালো বন্ধু হওয়ার দরুন কাশফি তার পরিচিত। গম্ভীর মুখে তিনি কাশফি কে পরখ করলেন এবং খানিকটা বিচলিত না হয়ে পারলেন না। কাশফির স্বপ্নের বর্ণনা শুনে তিনি এতক্ষণ চুপ ছিলেন কিন্তু পরক্ষণে এই মেয়ে যা চেয়ে বসলো তাতেই তিনি বাকরুদ্ধ। অহরহ ক্লায়েন্ট আসে তার কাছে, তাদের কিছুজন কে দেখলে চট করে ধরা যায় যে সে মানসিক চাপে আছে এছাড়া তার আ’ত্ম’ঘা’তি হওয়ার চান্স বেশি। কিছু কিছু কাশফির মতো গম্ভীর, তাদের বুঝতে সময় নিতে হয়।

“তুমি তবে কি হিপনোথ্যারাপি নিয়ে নিশ্চিত?”

“অনিশ্চিত হলে আধাঘন্টা ধৈর্য্য সহযোগে বসতাম না অবশ্যই।”

কাশফির নির্লিপ্ততায় ইয়াহিয়া খান বিরক্ত বোধ করেন, তিনি আবার বোঝানোর জন্য বলেন,
“দেখো ঈশিতা, এটা তোমার জন্য ক্ষতিকর।”

“I have made up my mind.”

“এসব তোমার বাবা জানেন?”

“ডক্টর খান, আমার বয়স ২২ বছর, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মতো উপযুক্ত আমি।”

ডক্টর খান নেড়ে চেড়ে বসলেন, তিনি একবার মুখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেললেন। নিজেকে প্রস্তুত করে তিনি মুখে জড়তা রেখে বললেন,
“ঈশিতা, এটা ক্রিটিক্যাল বিষয়। আমি জানি না তুমি কি…”

ডক্টর খানের অসম্পূর্ণ কথা শুনে কাশফি ভ্রু কুঁচকে ফেলে, কিছুটা কনফিউসন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আমি ঠিক বুঝতে পারিনি!”

“Are you s’uicidal?!”
ডক্টর খানের কথায় কাশফি বিহবল হয়ে গেলো। সে দ্রুত মাথা নেড়ে জানালো— “অবশ্যই না।”

উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি মাথা নেড়ে কাশফি কে কাউচে বসতে বলেন। তবে আড়চোখে রাশভারী কণ্ঠে বলতে ভুললেন না,
“Don’t make me regret this!”

তিনি হাতের রিমোট দিয়ে তার কামরার ব্লাইন্ডস অফ করে অন্ধকার করে দিলেন। ড্রায়ার থেকে মোমবাতি দুটো বের করে জ্বালিয়ে নেন।

“চোঁখ বন্ধ করে রিল্যাক্স করো ঈশিতা। ধরে নাও তুমি অচিন মানুষ নীলাম্বরী, তোমার আলাদা জগতে তুমি ধীরে ধীরে পদার্পণ করছো….”

***

অতীত: ‘শোনো নীলাম্বরী!’

রিনঝিন নূপুরের শব্দে মুখরিত ভিলার পিছনের দিকটায়, খানিক পর পর চুড়ির ঝংকার তুলছে ভিলার শেষ মাথার কক্ষটায়। বিরস, নির্জীব এই ভিলার কেবল এই একটি কামরাই যেনো প্রতি নিয়ত রঙিন স্বপ্ন বুনে। গানের গুনগুন শোনা মাত্রই গৃহ পরিচারিকা কামিনী হেঁসে সেই কামরার দরজা ভিজিয়ে দেখে নেয় কিশোরী নীলাম্বরী কে।
আজ সে তার মায়ের মুক্তোর নেকলেস, মুক্তোর কানের দুল আর নীল শাড়িতে সাজিয়েছে নিজেকে। কামিনীর চোঁখ তৎক্ষণাৎ ভিজে এলো, কিশোরী নীলাম্বরীকে শাড়িতে বেশ মানিয়েছে, ঠিক তার মায়ের মতো।
কামিনী ভাবলেন, হয়ত মেয়েটা নিজের মন ভালো করার জন্য সাজছে। এই টুকু মেয়ে কড়া নিয়মে থাকে সদা, বলতে গেলে তেমন একটা বের হয় না। তাছাড়া ছোট সাহেব নিজের গাড়ি করেই তাকে পুষ্পকুঞ্জ একাডেমীতে ছেড়ে আসেন আবার সাপ্তাহিক ছুটিতে নিয়েও আসেন, সেখানেও প্রতি নিয়ত মেয়ের খবরাখবর নিয়ে থাকেন। এর বাইরে মেয়েটা সর্বদা ঘর বন্ধী হয়ে থাকে।
তবে কিছু একটা ভাবতেই মুহূর্তের মধ্যে কামিনীর মুখের হাসি উবে গেলো। নীলাম্বরী ড্রেসারে বসে চোখে কাজল লাগানো শেষ করে কামিনীকে দেখা মাত্রই মুক্তো ঝরানো হাঁসি হাসলো।

“ছোট মা, তুমি কবে এলে? কোন প্রয়োজন?”

“এই মাত্রই এলাম।”
কামিনী হালকা হেঁসে ড্রেসার থেকে কাঠের চিরুনি নিয়ে নীলাম্বরীর গোছের চুল ধরে নিয়ে আলতো হাতে আঁচড়াতে লাগলো,

“কোথাও যাওয়া হচ্ছে নাকি?”
নীলাম্বরী লাজুক হাসি দিয়ে নিজের অবয়ব দেখলো কেবল, এত উজ্জ্বল কেনো লাগছে নীল শাড়িতে? উনার পছন্দের রঙ বলে?
বেনামী একটা পুরুষের প্রেমে পড়েছে সে! ভয়ঙ্কর প্রেম। সেই শখের পুরুষ জানিয়েছিল যে আজ সকল লুকোচুরি বাদ দিয়ে তার কিশোরী কে নিজের নাম জানাবে। কিন্তু তার বাবা যে সেই বাড়ির লোকদের ঘৃ’না করতেন তা জানা ছিলো না তার। তারা কে? তার বাবা তাদের কেনো ঘৃনা করেন কিছুই জানে না সে। যখন সপ্তাহখানেক আগে তার বাবা তাদের একসাথে দেখেছেন তখন থেকেই বাড়িতে তার কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেদিন হতে বাড়ি থেকে সে এক পাও বের করতে পারেনি।

নীলাম্বরীর চোখে মুখে চাকচিক্যতা আর লাজুকতা দেখে কামিনীর হাত ততক্ষণে থেমে গিয়েছে, তার মুখের মধ্যে কোনরকম ঝুলন্ত হাঁসিটাও নিঃশেষ। যা বোঝার বুঝে নেয় কামিনী, সে ধপ করে হাঁটু গেটে নীলাম্বরীর সামনে বসে পড়লো। হুট করে দুহাতে নীলাম্বরীর মুখ ধরায় নীলাম্বরী নিরুত্তর এবং খানিকটা অবাক হয়ে কামিনীর দিকে তাকিয়ে রইলো,

“তোমার বাবা কাজে বেরিয়েছেন, কাল ছাড়া ফিরবেন না। তুমি ঘর থেকে এক পা বের করলেই সর্বনাশ!”

বাবার কথা তোলায় নীলাম্বরী কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়, ঘর্মাক্ত হাতের তালু শাড়ির আঁচলে মুছে জোরপূর্বক হেঁসে কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বললো,
“বাবা জানবে না ছোট মা।”

“তুমি ভুল করেছো, বাচ্চা একটা মেয়ে তুমি। তোমার তো এখনো ভালো খারাপ বোঝার বয়সই হয়নি।”

কামিনীর জোরালো কণ্ঠে কিছুটা কঠোরতার রেশ টের পেয়ে নীলাম্বরীর চোঁখে পানি টলমল করছে। এই তো ভয় ছিলো, শেষ পর্যন্ত কি সে কামনার পুরুষের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে কিনা। তার মুখে থাকা কামিনীর দুই হাত সে আগলে ধরে আকুল অনুরোধ জানায়,

“একটা বার তাকে দেখতে চাই ছোট মা, প্রতিজ্ঞা করলাম বাবা ফেরার পূর্বেই ফিরে আসবো।”

কামিনী মাথা নেড়ে না বোঝালেন। এবার চোখ মুখ শক্ত করে কঠোর হলেন আরো কিছুটা,
“তারা ক্রুর, নির্দয়! কি করে তুমি তার থেকে অনুভূতি কামনা করো?”

নীলাম্বরী গলার স্বর ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“আমি হয়ত নিরব সম্পর্কের মায়া ছাড়তে পারিনি।”

সোনালী বিকেলে কালো চাদরে মুখখানা ভালো করে ঢেকে দুরু দুরু বুকে হেঁটে কোনরকম সেগুন বাগিচা পার হলো সে। ভিলা থেকে এতখানি দুর এসেও ভীতি এখনো কমে নি। তার কোমল মনের ছোট মা তার কথা ফেলতে পারেনি। তাই তাকে যাওয়ার জন্য অনুমতি ঠিক দিয়েছে তবে সন্ধ্যার আগেই ফেরার কঠোর নির্দেশ জারি করেছেন। ভিলার কঠোর সিকিউরিটি পেরিয়ে আসতেও তার ছোট মা সাহায্য করেছে।
তার ভাবনা ছেদ করে, হঠাৎ একটা কালো গাড়ির তার ঠিক সামনে এসে থামে, ঘটনার আকস্মিকতায় নীলাম্বরীর চোঁখ বড় বড় করে মুখ হা হয়ে আসে। তার পা জোড়া জোরে সোরে কাঁপছে, ভয়ে তার হৃদপিণ্ডের বেগতিক উঠানামা বেড়েই চললো। কালো গাড়িটার ড্রাইভিং সিটের গ্লাসটা রোল ডাউন হতেই মোটা ফ্রেমের গ্লাস চোখে আর হুডি পরনে একটা তরুণকে দেখতে পেলো। নীলাম্বরী কপাল কুঁচকে নেয়, পালানোর প্রস্তুতি নিবে তার পূর্বেই লোকটা তার দিকে না তাকিয়েই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো উঠে বসতে। নীলাম্বরী চোঁখ কুঁচকে কর্কশ শব্দে সুধলো,

“এক্সকিউজ মী?”

লোকটা তির্যক চোখে তাকিয়ে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরলো। নীলাম্বরীর ক্ষনিকের জন্য জুড়ানো সাহসটুকু যেনো নিমিষেই ত্যাগ করলো। হুডি পরনের লোকটা রাগী ষাড়ের মতো এবার গাড়ি থেকে নেমে জোরে শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে নীলাম্বরীর দিকে ধেয়ে আসলো, নীলাম্বরী ভয়ে পিছনে ছুটবে তার আগেই সে তার বাহু চেপে ধরে নীলাম্বরীর মুখের সামনে একটা ইনভাইটেশন কার্ড ধরে,

“ইনভাইটেশন কার্ড ছাড়া ভিতরে যাওয়ার উপায় নেই, বাচ্চা। জানতে না?!”

নীলাম্বরী হতাশ মুখে চেয়ে রইল, তাহলে কি সে এই লোকটার সাথে যাবে? সে একবার ইনভাইটেশন কার্ড আরেকবার লোকটা কে দেখে নেয়। তবে প্রিয় কে দেখার জন্য না হয় এই রিস্কটুকু নেওয়া… কিন্তু নীলাম্বরী সতর্ক ছিল, তাই নিজের মনের দ্বিধা টুকু নিয়ে চলতে অনিচ্ছুক।

“কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে যেতে চাইবেন কেনো?”

গ্লাস পরা লোকটার হাত তার বাহু হতে আলগা হয়ে আসলো খানিকটা, তার চোখে মুখ জুড়ে গেলো কালো বিষন্নতায়। নিজের উত্তর নিরপেক্ষ রেখে সে গম্ভীর স্বরে আওড়ালো,

“স্বচক্ষে দেখে বিবেচনা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছি তোমায়, নয়ত আমার মতো মরীচিকায় হাতড়ে বেড়াবে।”

সে প্রবল এক ধা’ক্কায় নীলাম্বরী কে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো। ব্যথায় নীলাম্বরী চোঁখ বুঝে নেয়। লোকটা তোয়াক্কা না করে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো, স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিয়ে রেয়ার ভিউ মিররে চোঁখ ফেলে নীলাম্বরীকে শেষ বারের মতো ওয়ার্নিং দিতে ভুললো না সে।

গাড়ির রাস্তা টুকু নীলাম্বরীর নীরবতায় কাটলো, বুকে ভয় নিয়ে বাকিটুকু পথ পাড়ি দিয়ে চললো। তবে মনে মনে বাবার কাছে হাতে নাতে ধরা পড়ার ভয় কাটাতে অক্ষম হলো সে। কেবল প্রেমিকের নাম শুনতে মরিয়া হয়ে থাকা নীলাম্বরীর জানা ছিলো না যে সে ঠিক কেমন অনুষ্ঠান এট্যেন্ড করতে চলছিল….

#চলবে…

#
#অদৃষ্টের_মৃগতৃষ্ণা (২২)
#লিখনীতে_প্রোপীতা_নিউমী

(অতীত)
দুপাশে সারি সারি মেহগনি আর সেগুন বাগিচা পেরিয়ে বিশাল এই এস্টেট জুড়ে ড্যানডেলিওনস ফিল্ডে এই আধুনিক ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়িটার দেখা মেলে, ঠিক কোনো কল্পনার রাজপ্রাসাদের কম নয়। একসময় এই বাড়ির বৃদ্ধার পিতামহ জমিদার ছিলেন তাই একে জমিদার বাড়ি বলেও চেনেন অনেকে। বাড়ির বড় বলরুমটায় আজ হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা, মানুষের মুখে মুখে বলাবলি চলছে যে কিছু মুহূর্তের মধ্যেই বৃদ্ধা তার নিজ ক্ষমতা থেকে সরে দাড়িয়ে জমিদারের যোগ্য নাতিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তোরখোড় করে বিশাল আয়োজন করেছেন। জমিদারের বড্ড আদরের নাতি কিনা। ইমপোর্ট এক্সপোর্ট আর শিপিং ছাড়াও স্থাপত্যশিল্প আর হোটেল চেইন এর বড় ব্যাবসা তাদের, অত অঢেল সম্পদ!
এইটুকু তথ্য নীলাম্বরী চশমা পরা লোকটার কাছ হতে পেয়েছে।

নীলাম্বরী শাড়ির লম্বা আঁচল ফেলে চশমা পড়া লোকটার পায়ের তালে তাল মিলিয়ে হেঁটে হেঁটে বিশাল আয়তাকার বলরুম পর্যবেক্ষনে ব্যাস্ত। বাইরে অত মানুষজন না থাকলেও বলরুম ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে তারা খানিকটা দেরী করে ফেলেছে। মানুষ জন হাতে গ্লাস নিয়ে চিটচ্যাট করছে নতুবা ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনায় নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে লোকটার সাথে ধাক্কা লেগে নীলাম্বরী থমকে দাড়ায়। অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে নাক ডলে মাথা উচু করে লোকটার চোখে চোখ রাখতেই দেখতে পেলো চশমা পরা লোকটা তার দিকে নিজের বাহু কিঞ্চিৎ উচুঁ করে বাড়িয়ে রাখলো। নীলাম্বরী ভ্রূদ্বয় কুঁচকে সেদিকে চেয়ে বসলো,

“আমার বাহুতে বাহু জড়িয়ে ধরো।”

“কিহ?— কেনো!”

লোকটা চোয়াল শক্ত রেখেই তার মধ্যমা দিয়ে চশমা নাকের উপর ঠেলে নীলাম্বরীর দিকে তির্যক দৃষ্টি রেখে কিছুটা ঝুঁকে তার দিকে। বিব্রত নীলাম্বরী চোঁখ পিট পিট করে চেয়ে এক পা পিছনে নিবে তার পূর্বে লোকটা বিরক্তির সুরে বলে উঠে,

“তুমি আমার ডেট হয়ে এসেছো রিমেম্বার? So drop your juvenile act!”

নীলাম্বরী আগের ন্যায় বিব্রত অবস্থায় থেকেই তার অনিশ্চিত হাত বাড়িয়ে লোকটার বাহুতে রাখে। এতে লোকটা আরো বিরক্ত হয়ে বাহু থেকে নীলাম্বরীর হাত ঝাঁটা দিয়ে ফেলে নীলাম্বরীর শাড়ির আঁচল দিয়ে পিঠ ঢেকে আলতো হাতে তার কোমর ধরে কাছে টেনে নিলো। নিজের পজিশন চেক করে সে একবার তাকিয়ে লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে থাকা নীলাম্বরীকে দেখে নিলো,

“রিল্যাক্স ফিল করতে বাধা নেই, Atleast you aren’t my type.”

নীলাম্বরীর কান দিয়ে ধোয়া বের হওয়ার উপক্রম তবুও সে মাথা নেড়ে কাঁধ চওড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই নীল শাড়িতে তাকে কোন কিশোরী নয় বরং পরিণত একটা নারী মনে হচ্ছে। সে নিজেকে এই পরিস্থিতি থেকে ডাইভার্ট করতে লোকটা কে জিজ্ঞেস করলো,

“আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে আমি আপনার কে?”

“তোমার টু শব্দ করার প্রয়োজন নেই, তুমি এতকাল যেমন নির্বাক ছিলে তেমনই নির্বাক ভূমিকা পালন করবে আজও।”

সূক্ষ্ম অপমান গায়ে না মেখে নীলাম্বরী আবার শুধলো,
“এটলিস্ট আপনার নাম জানতে পারি কি?”

“ইউ ক্যান কল মি বিস্ট ফর নাও।”

নীলাম্বরী থতমত খেয়ে যায়, আদো কেউ কারো পরিচয় বিস্ট বলে দিতে পারে? বড্ড অদ্ভুত! সে অত ভাবান্তর না ঘটিয়ে চশমা পরনে লোকটা — বিস্টের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটা শুরু করলো।

বলরুমের মধ্যখানে একটা বড় পিয়ানোতে হাত চালিয়ে পিয়ানো বাদক সুর তুলছে, তার পাশেই একজন ভায়োলিন কাঁধে রেখে ভায়োলিন বাও দিয়ে নরম সুর ভাজছে। ক্লাসিক নোট আর মাইল্ড টোনের ধ্বনি কানে আসা মাত্রই একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ গড়ে উঠেতে বাধ্য শ্রোতার মনে। নীলাম্বরী হাইটের কারণে দেখতে না পেলেও উপলব্ধি করলো বেশ। যেনো বসন্তের ঝরা পাতায় দাড়িয়ে একজন প্রেমিক আকুল অনুরোধ জানাচ্ছে। পিয়ানো আর বায়োলিনের শব্দ বন্ধ হতেই সামনে একজন বৃদ্ধা গ্লাস উপরে উঠিয়ে তাতে চামচ দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।

“আপনারা সবাই হয়ত জানেন বার্ধক্য জনিত কারনে আমি আর কোম্পানির দেখাশোনা করতে পারছি না। তাছাড়া আমার নাতির বিশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে তাই আমি আর দেরি না করে আমার নাতিকে আপনাদের নতুন ডিরেক্টর ঘোষণা করছি।”
ততক্ষণে করতালিতে মুখরিত হলো বলরুমটা। অনেকে প্রশংসা ও করলো বৃদ্ধার নাতির তা শুনে বৃদ্ধার মুখে ঝলক দেখা দিলো। গর্বিত স্বরে বৃদ্ধা হেসে আবার বলল,

“আরেকটা বিষয় হলো, আমরা চৌধুরী গ্রুপের সাথে খুব শীগ্রই পার্টনার হতে চলছি। কেননা চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বুশরা শাহরিন চৌধুরী আমাদের বাড়ির নতুন সদস্য হতে চলছে। তাই দেরি না করে আমার বংশের সিংহ আর তার বাগদত্তা কে স্বাগতম জানানো হোক।”

চোখে একরাশ আগ্রহ নিয়ে অবুঝ নীলাম্বরী বাকি সবার মতো হাত তালি দিয়ে সিঁড়ির দিকে চেয়ে রইল আর বিস্ট মুখ গোমড়া করে তার দিকে চেয়ে রইল কেবল। পরক্ষণে সে গম্ভীর গলায় মিনমিন করে নীলাম্বরীর উদ্দেশ্যে বললো — “It will be getting worst.”

ততক্ষণে বোঝার আগেই নীলাম্বরীর পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছে যেনো। শুন্য চোখে কেবল সিঁড়ির মাথায় নজর গেঁথে রইলো তার। লোকজনের করতালি শোনার পরিবর্তে তার কানে কেবল ভো ভো শব্দ এলো কিছুক্ষণ। তার বুকের বেগতিক উঠানামা আর মাথা হতে গরম কিছু বের হচ্ছে তা বুঝে এলো কেবল। সিঁড়ির উপর হতে ছাই রঙা চোখের হিমাদ্রী শক্ত মুখে নেমে আসছে, তার পাশেই রূপকথার রাজকন্যার মতো দেখতে একটা মেয়ে হিমাদ্রীর বাহুতে নিজের অলঙ্কৃত বাহু জড়িয়ে ধরে নেমে আসছে।
পাথর বনে থাকা নীলাম্বরীর চোঁখ পর্যবেক্ষণ করে ঠিকই মেয়েটার অনামিকায় থাকা চকচক করা হিরের আংটি খুঁজে নিলো। তার নেতিয়ে যাওয়া শরীর হতে ঘাম ছাড়ার মুহূর্ত মধ্যেই জায়গাটায় প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করলো তার। তার ভিতরটা গুলিয়ে আসছে যেনো আকস্মিক খুবই নোংরা ধরনের কালো চাদর তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সিঁড়ি হতে নেমে হিমাদ্রী মেয়েটার — তার বাগদত্তার অনামিকায় চুমু খেলো।

চোখের কোনায় জমে থাকা পানি চোঁখ ঝাপটে বিলীন করতে নেয় কিশোরী নীলাম্বরী, সে আর দাড়ালো না, তার বুকের ভিতর অস্বাভাবিক মোচড় উপলব্ধি করেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হেঁটে আসলো। মাথায় তার একটা ভাবনা ঘুরছে, বয়সে ঈম্যাচিউর ছিলো বলেই কি সে এতোকাল একজন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ছিল?!
হিমাদ্রীর থেকেও নিজের উপর ঘৃনা ক্ষোভ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। হিমাদ্রীর আসল নাম জানার কোন ইচ্ছে অবশিষ্ঠ রইলো না। উপলদ্ধি হলো বটে, সে বাবার কথা না শুনে বিশাল ভুল করে ফেলেছে!
এস্টেট হতে বেরিয়ে রাস্তা পেরোনোর আগেই বিস্ট এসে তার পথ রুখে দাড়ায়।

“বাস্তবতা দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম, দেখা শেষ গাড়িতে উঠো।”

নীলাম্বরী চোয়াল শক্ত করে দাতে দাত চেপে ভেজা ঘন পাপড়ি দিয়ে চোঁখ লাল করে চায়,
“আমি একা যেতে পারবো, পথ ছাড়ুন।”

“গাড়িতে উঠো!”

নীলাম্বরী রাগ না দমাতে পেরে বিস্টের বুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“সমস্যা কি? যেতে দিচ্ছেন না কেনো?!”

বিপরীতে বিস্ট চশমা মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে নাকের উপরে ঠেলে শক্ত হাত নীলাম্বরীর কাঁধে রেখে নিচু স্বরে বলল,
“গাড়িতে উঠে বসো।”
লোকটার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দই যেনো তার কাছে থ্রেটেনিং মনে হলো। বিষণ্ণ হয়ে ভারী পদে বিস্টের পিছু পিছু গাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। বিস্ট গাড়ি আন লক করার পর পরই নীলাম্বরী দরজা খুলে ঢুকে পড়ল। বাকিটা পথ সে জানালার বাইরে তাকিয়ে, নিজেকে নিশ্চুপ আর আড়ালে রেখে বেশ গুটিশুটি মেরে বসে রইলো। মনে মনে কেবল লম্বা পথ টুকু শেষ হওয়ার প্রার্থনা করলো।

অন্ধকার পথে বিছানো শুকনো পাতায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ, দুর হতে ভেসে আসছে ঝি ঝি পোকার ডাক। কিছুক্ষণ পর এক পাশের খাল হতে টুপ করে ব্যাঙের ডুব দেওয়ার শব্দ এলো, পরপর কানে এলো ব্যাঙের ডাক। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ বরাবরই নীলাম্বরীর প্রিয়, দুই এক বৃষ্টির ফোঁটা নামানো কাঁচ হয়ে তার মুখ ছুঁয়ে দিলো। প্রলম্বিত শ্বাসে বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে সে গাড়ির নামানো কাঁচটুকু উপরে উঠিয়ে দিলো। এখন ভালোলাগা টুকুও তার গ্রহণ করতে ইচ্ছে করছে না।

“এইটুকু মেয়ে তুমি ভালোবাসা বোঝো?”

ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা উপহাস করে বললো বোধহয়, জবাবে নীলাম্বরী নির্বাক ভূমিকা পালন করে অপলক গাড়ির কাঁচের বাইরে চেয়ে রইলো। আসলেই সে এসবের কিছুই বুঝে না। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তার, আর কিছুই না। হয়ত এসব ঘটেছে কারণ তার ঘরে বাবা আছে মা আছে তবে তাকে সময় দেওয়ার মতো কেউ নেই, একটা মাত্র ভাই ছিল তার ঠাইও হলো মাটির তলায়।

ভিলার গেইটে পৌঁছাতেই নীলাম্বরী নামিয়ে দেওয়ার জন্য বলবে তার আগেই তাদের দারোয়ান গেইট খুলে দেয়। নীলাম্বরী বড় বড় চোখে চেয়ে ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নিলো। তবে কি তার বাবা জেনে গিয়েছে সব? গেইট পেরিয়ে গাড়ি থামে ঠিক ভিলার সামনে, সেখানে শুভ্র চাদর জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তার বাবা। নীলাম্বরী শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে ঝিম ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। নেমে তার বাবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস টুকু নেই। ঠিক কবে বাবার আদেশ অমান্য করেছিল মনে পড়ছে না তার। দুরু দুরু বুকে গাড়ি থেকে নেমে কম্পমান হাতে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো। এদিকে বিস্ট কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তিনি বিস্টের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে যেনো ইশারায় ধন্যবাদ জানালেন।
“তুমি আসতে পারো।”

বিস্ট নীলাম্বরীর দিকে সূক্ষ্ম নজরে চেয়ে গাড়িতে উঠে গেলো, যেনো সে শাসিয়ে এমন গা’ধার মতো কাজ না করার আদেশ দিয়ে গেলো। তার গাড়ি প্রস্থান মাত্রই নীলাম্বরী ছোট ছোট পায়ে হেঁটে এসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তার বাবার বিষণ্ণ চোখে চোখ রাখলো। তার বাবা তার গায়ে কখনো হাত তুলেনি, তার বাবা আজ হাত তুলবে ভাবতেই তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

“এদিকে এসো!”

একবার সম্মোধনে নীলাম্বরীর তনু মন কেঁপে উঠলো। সে মাথা নত করে বাবার ঠিক বরাবর এসে দাড়ায়। তবে তার বাবা অভাবনীয় কিছু করে বসলেন। তিনি নীলাম্বরীর মাথায় হাত রেখে কণ্ঠ নরম করে বললেন,

“ভূল করে শিক্ষা যদি অর্জন করে থাকো তবে আমি সফল। বাবা কোনো দিন তোমার খারাপ চাইনি, মনে রাখবে, Blood is thicker than water. ”

টুপ করে নীলাম্বরীর কর্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, এতটা বিশ্বাস তার বাবার আর সে কিনা বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়েছে। কিসের জন্য? একটা অপক্ক আবেগের বশে? এতটা কেয়ারলেস কি করে হলো সে? আর না ভেবে সে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে জড়িয়ে ধরলো। এখানে তার ভরসা, তার বাবা সময় না দিতে পারলেও এই বুকই তার আশ্রয়স্থল, তার ভিটেমাটি। বাবার বুকে ঢলে পড়ে কান্নার বাঁধ ভাঙলো। অতপর কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো,

“ওয়াদা করছি বাবা তোমার কথার বাইরে এক পা ও অনড় হবো না। তুমি যেহেতু চেয়েছেন আমি পুষ্পকুঞ্জ একাডেমী ছেড়ে দিই, আমি আজই ছেড়ে দিতে প্রস্তুত বাবা।”

***

কাশফি ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় চোঁখ খুলে বসে পড়লো। বাকি পাঁচ মিনিট সময় নিলো তার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে। পাঁচ মিনিট পর নিশ্চিত হলো যে সে বর্তমানে অবস্থান করছে অতীতে নয়। ডক্টর খান এতক্ষণ তাকে এডজাস্ট হওয়ার সময় দিচ্ছিলো, সে তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়া মাত্রই সে গড়গড় করে পানি পান করে শেষ করে নেয়। ডক্টর খান তার দুই হাত নিজের দুই হাতে নিয়ে কাশফির চোখের সামনে তুলে ধরলো,
“আমি এই সেশন তাই বন্ধ রাখতে বলেছি ঈশিতা।”

কাশফির হাতের নখ গুলো কিছুটা বড় ছিল, হাতের মুঠোয় এতটা শক্ত করে আকড়ে ধরেছিলো যে তার প্রতিটা নখ উল্টে গিয়েছে। হাতের তালু লাল হয়ে নখের দাগও বসে আছে। পরিস্থিতির সামাল দিতে কাশফি দ্রুত হাত সরিয়ে আশ্বস্থ দিয়ে বলল,
“একটু ভয় পেয়েছিলাম বোধহয় আর কিছুই না।”

ডক্টর খান তার কথায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করলেন। তিনি মাথা নেড়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এভাবে যদি ব্রেইনের উপর প্রেশার দাও তবে ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

ডক্টর খান কাশফির আর কোনো বাড়তি কথা কনকূহুরে নিলেন না। তিনি উঠে দাড়িয়ে পড়লেন,

“তোমার স্বপ্নটা কেমন ছিলো?”

“কেবল ঘটনা কেন্দ্রিক, ভুতুড়ে কিছু নয়।”

ডক্টর খান মাথা নেড়ে কিছু একটা ভেবে বললেন,
“তুমি ঘুমানোর পূর্বে আমার প্রেসক্রাইব করা ঘুমানোর ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে বলব দোয়া পাঠ করে ঘুমাবে।”

“কেনো?”

“এমন স্বপ্নের অর্থ আমার নিকট ‘calm before the storm’ হয়ে ঠেকছে।”

কাশফি গভীর চিন্তায় ডুব দেয়। এইতো কয়েকদিন আগের দেখা স্বপ্ন সে এনালাইসিস করতে ন্যায়,
“স্বপ্ন যদি অতীত হয় তবে কল্পনা কি বাস্তবতা হয়ে দুঃস্বপ্ন দেখাতে সক্ষম?”

ডক্টর খানের কপালে বলিরেখা প্রগাঢ় হয়ে চিন্তার ছাপ দেখা দিলো।
“আমাকে বুঝিয়ে বলো ঈশিতা।”

“এই স্বপ্নগুলো আমার অতীত ছিল। বর্তমানে এমন একজন মানুষ আছে যাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, সে কি আমার অতীতে আসলেই ছিল নাকি কল্পনা মাত্র?”

“তোমার স্বপ্ন গুলো পুরোপুরি অতীত নয় এবং কল্পনা ও নয় ঈশিতা, আমি বলবো নিজের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করা বন্ধ করো।”

***

ব্যাস্ত সড়কের পাশে কাশফি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শূন্যে একদিকে চেয়ে আছে, এমতাবস্থায় কেউ তার যদি তার কাছ থেকে ছিনতাই করে পালায় তবুও তার টের পেতে পেতে খানিক সময় লাগবে বোধহয়। মাথায় তার নানান চিন্তা, কে সেই হিমাদ্রী? কেনো এত রহস্য তাকে ঘিরে? কেনই বা সে এত কাছের হয়ে উঠেছিল? তবে কি কারণে নীলাম্বরীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ছিল? বিস্ট কে? কেনো তার সাহায্য করেছিলো? তার মা —চারুলতা কোথায় ছিলো? সে কি তাদের সাথে থাকতো?
কুচকুচে কালো মার্সিডিজ তার গা ঘেঁষে থামতেই এসব আকাশ কুসুম ভাবনার অন্তু ঘটে। রিয়্যাক্ট করার কোনো সময় পেলো না সে, গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে পরিপাটি হয়ে থাকা কৌশিক মির্জা বেরিয়ে এলো। তাকে দেখা মাত্রই এক দফা বিষম খেয়ে গেলো। কপালে চিন্তার ভাঁজ আর চোখে বিস্ময় নিয়েও নির্বিকার চিত্তে চেয়ে রইল কাশফি।
তাহলে কৌশিক মির্জাকে কি অফিসিয়ালি তার স্টকার বলা যায়?

ইন করা নেভি ব্লু শার্ট আর অফ হোয়াইট প্যান্ট পরিহিত কৌশিক বেশ পরিপাটি বেশভূষায় আছে। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ, শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা, এর ফাঁকে সানগ্লাস আটকানো। সামনাসামনি দাড়িয়ে থাকায় তার হতে আগত কড়া কোলন আর ম্যানলি ঘ্রাণ কাশফির নাকে শুড়শুড়ি দিচ্ছে যেনো। ততক্ষণে উপলব্ধি করতে দেরি হলেও কৌশিক মির্জাকে নিজের কাছাকাছি পাওয়া মাত্রই তার গলা শুকিয়ে গেলো যেনো, সরে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত পেলো না। পরপর শোনালো কৌশিকের পুরুষালী কণ্ঠ,

“গাড়িতে উঠে বসুন কাশফি, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

কাশফির তৎক্ষণাৎ বিস্টের কথা মনে আসলো, এমন ডমিনেটিং আচরণ ছিলো তারও। তবে কি বিস্ট কৌশিক মির্জা? কোনো ভাবে কি কৌশিক মির্জা তার অতীত নিয়ে জড়িত? কাশফি সংশয়ী হয়ে গেলো।

“আপনি আমার পার্সোনাল ড্রাইবার না, যেভাবে এসেছি সেভাবে যেতেও পারবো আমি।”
কৌশিক নিজের মুখ অবয়ব অপরিবর্তিত রেখেই চোঁখ কিঞ্চিৎ ছোট ছোট করে একটা ভারী শ্বাস ফেলে। কৌশিক কণ্ঠ খাদে নামিয়ে সাবলীল ভাবে বললো,
“আপনাকে আমি সোজা কথায় বলে দেখতে চেয়েছি কাশফি না শোনার দায় কি আপনি নিবেন?”

কাশফি ভ্রু কুঁচকে চোঁখ পিট পিট করে চেয়ে শুধলো,
“কিসের দায়?!”

“আমি যদি আপনাকে কোলে তুলে গাড়িতে বসাই তার দায়…”

কৌশিকের নির্বিকার কণ্ঠে কাশফির ঝাঁঝালো জবাব আসতে সময় নিলো না,
“আমি মারাত্বক চড় দিতে জানি।”

“আপনার একটা চড় আমার পনেরো মিনিটের ফ্রেঞ্চ কিস, Deal!”

কাশফি থতমত খেয়ে যায়, নির্বাক হয়ে চেয়ে কনফার্ম হয়ে নেয় যে সে যা শুনেছে তাই ঠিক কিনা। পরক্ষণে বাজ খাই কণ্ঠে থেমে থেমে তো তো করে বলে,
“আপনি, আপনি — এতো অসভ্য! ছিঃ!”

“চাইছি দমিয়ে রাখতে কিন্তু পাঁচ বছর পরও একজন পুরুষ মানুষ হয়ে ধৈর্য্য ধরা কঠোর পরিশ্রমের কাজ।”

***

আতিকুর রহমান ব্যালকনিতেই ছিলেন, মেয়েটা ঠিক দুপুরে ডক্টর খানের কাছে গিয়েছিল কিন্তু সন্ধ্যা নামলো এখনো ফেরেনি। তিনি স্কুল থেকে ফিরে কায়েস কে ফারাবীর বাসায় থেকে এনেছেন। তার পাশে চেয়ার ঘেঁষে কায়েস বসে বসে রঙ পেন্সিল দিয়ে যোগ করছে, পেন্সিল দিয়ে লিখতে লিখতে সে বিরক্ত। অবশ্যই বিরক্ত হওয়ার কারণ তিনি খুঁজে পান না, কারণ কায়েস পড়তে বসে সর্বোচ্চ পনেরো মিনিটের জন্য। এই নিয়ে আতিকুর রহমান যোগ আর বিয়োগ চিন্হ কোনটা সেটা বুঝাতে বুঝাতে সময় পার করেছেন কিন্তু বাচ্চাটা বারবার যোগ করতে গিয়ে বিয়োগ আর বিয়োগ করতে গিয়ে যোগ করছে।
আজ তার পরিচিত একজনের সাথে সাক্ষাৎ সে বেশ আগে থেকেই জোভান শিকদারের বাবার সাথে কাজ করছেন সেই থেকে তাদের ব্যাপারে বেশ ভালো কিছুই জানতে পেরেছেন। সুমন শিকদারের সাথে যতবার কথা হয়েছে ততবারই মনে হয়েছে কি আময়িক মানুষটা।

মেয়ের জন্য এত ভালো সমন্ধ এসেছে শুনে চেনা পরিচিত অনেকেই বলছে কথা আগে বাড়ানোর জন্য। কিন্তু তার তো মেয়েটাকে পড়ানোর ইচ্ছে।

“বাবা বুবু বলেছে ওয়াটার গান আনবে ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো মনে আছে কিনা?”

আতিকুর রহমান চোখ গরম করে ছেলের দিকে তাকান, নিজের রক্ত না হলেও তিনি কখনো তাকে কাশফির থেকে আলাদা করেন নি।

“তোমার বুবু ওয়াটার গান নিয়ে আসলে তাকে বিনা বাক্যে বের করে দিবো।”

কায়েস ততক্ষণে মুখ কালো করে ফেলে,
“কেনো? এটা ওর বাসা!”

“পানি ধরে ভাই বোন দুটো জ্বর বাঁধবে তাই না? তোমাকেও বের করে দিবো।”

কায়েস এর ঘোর বিরোধিতা করলো, এতে আতিকুর রহমান চোঁখ পাকিয়ে আরো কিছু বলার আগেই একটা কালো গাড়ি তাদের বাসার সামনে থামতে লক্ষ্য করলেন। তিনি সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। গাড়িটি থামা মাত্রই ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে কৌশিক মির্জা বেরিয়ে আসার পরই তার ভয় গাঢ় হয়, সে ঘুরে গিয়ে ওপর পাশের দরজা খুলে দেয়, পরপর হাতে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে কাশফিকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। আতিকুর রহমান ততক্ষণে মুখ বেজার করে নিলেন।

কায়েস বুবু বলে চিৎকার করায় কাশফি উপরে উপরে তাকানো মাত্রই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। সে আর দাড়িয়ে না থেকে কৌশিক মির্জাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দরজার সামনে এসে বেল চাপলো। বেলের শব্দে আতিকুর রহমান সময় নিয়ে দরজা খুললেন। ভয়ে ভয়ে থাকা কাশফি দুই হাতের তালু একসাথে ঘষে তার বাবার চোঁখে চোঁখ রাখলো,

“বাবা, কৌশিক মির্জা আর আমার মধ্যে কোনো কিছুই নেই, সে বিরক্ত আমাকে করার জন্য…”

আতিকুর রহমান হাত উপরে উঠিয়ে থামিয়ে দিয়ে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে দরজা হতে সরে দাঁড়ালেন। মিনিট খানেক অতিবাহিত হওয়ার পর রাশভারী গলায় বললেন,
“তোমার জন্য একটা ভালো পাত্র এসেছে, তোমাকে তার ভীষণ পছন্দ। ভালো ফ্যামিলির ছেলে, তার কোনো বাজে স্বভাব নেই। আমার মতে এমন পাত্র ছেড়ে দেওয়া নেহাতই বোকামি, তার নাম জোভান শিকদার। আমি চাইছি তুমি আমাকে তোমার সিদ্ধান্ত জানাও, সময় নিতে চাইলে সমস্যা নেই।”

কাশফির পাশ দিয়ে ততক্ষণে যেনো হিম শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। পিলে চমকে তার মুখ হলদে হয়ে এলো যেনো। জোভান কে নিয়ে এমন ভাবনা সে কল্পনা ও করতে পারে না। কিন্তু এমন তো নয় যে তার বাবা তাকে সন্দেহ করছে। মুহূর্তেই তার অতীতে করা ভুলের কথা মনে পড়ে যায়। তার বাবা তার খারাপ কখনোই চাইবে না, মনেমনে আওড়ালো তার বাবার বলা ইংরেজি প্রবাদটা — ‘Blood is thicker than water’
অতঃপর সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়,
“আসলে এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি তবে তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা।”

আতিকুর রহমান মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হলেন এবং আশ্বস্থ হয়ে কিঞ্চিৎ হেসে কেবল মাথায় হাত বুলালেন। তার পাশে মাথা তুলে দেখতে থাকা অবুঝ কায়েস হয়ত কিছুই বুঝলো না। আতিকুর রহমান তাকে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন। এদিকে কাশফি কোনো এক অজানা কারণে চেয়েও আশ্বস্থ করতে পারছিলো না নিজেকে। সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে।
অজানা শঙ্কা বেড়েই চলছে তার মনের কোনো, তবুও নিজেকে বুঝ দিলো যা করছেন তার বাবা তার জন্য উত্তম কিছুই করছেন…
যতক্ষণ না অধম নিজে এসে অধার ছেয়ে তাকে লাল রঙে রাঙায়।
চলবে।