অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
696

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#অন্তিম_পর্ব (প্রথমাংশ)
#তাশরিন_মোহেরা

আজ বাতাসটা একটু বেড়েছে। আর রাতের বাতাস সচরাচর বেশ ঠান্ডা হয়। তুলনামূলক ভারী একটা শাড়ি আর একগুচ্ছ গহনা পড়েও রাতের ঠান্ডা বাতাসে আংশিক কেঁপে উঠলাম। আমাকে ক্ষীণ শিউরে উঠতে দেখে মুখর বললো,

‘ঠান্ডা লাগছে? জানালা বন্ধ করে দেবো?’

কিন্তু জানালা বন্ধ করলে যে রাতের আকাশটা আর দেখা হবে না। আজ আমাদের বিবাহ পরবর্তী প্রথম রাত। মুখর রুমে প্রবেশ করার আগেই আমি তার বিছানার উপর বসে ভয়ে কাঁপছিলাম। ভয় করাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কেননা বিয়ে নামক বন্ধনটা আমায় এমন একজনের সাথে শক্তভাবে বেঁধে দিয়েছে যাকে পাওয়ার আশা করাটাও একসময় কিনা আমার জন্য অসম্ভব ছিলো। আজ তারই ঘরে, তারই বিছানায় বসে তারই আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। দরজার ছিটকিনি আটকানোর শব্দ শুনে রীতিমতো ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসি। মুখর এই মুহুর্তে আমার পাশ ঘেঁষে বসলে আমি কি করবো? আচ্ছা? আমার ভয়টা কি একটু বেশিই দৃশ্যমান হয়ে আমায় পেতনির মতো দেখাচ্ছে? মুখরের যদি আমায় পছন্দ না হয়? তবে কি বিয়ের দিনই তালাক দিয়ে আমায় ঘরছাড়া করবে? আয় হায়! আব্বাটাও যে আজ রাতে কুমিল্লার ট্রেনে উঠবে। মুখর যদি আমায় রাস্তায় বের করে দেয় তবে তো ফুটপাতেই আমার রাতটা কাটাতে হবে!

হঠাৎ মুখরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম তাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তবে তার এই শ্রান্ত মুখশ্রীতেও ঝরছে ভীষণ মায়া। হায়, আমার স্বামীটার প্রেমে আরো একবার ডুবে গেলাম। স্বামী? সামনে দাঁড়ানো সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষটা আমার স্বামী? এটুকু ভাবতেই চোখটা নামিয়ে ফেললাম সাথে সাথে। লজ্জা লাগছে আমার খুব! এ লজ্জাটা ঢেকে রাখবো কই!
মুখর আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসলো আমার মুখোমুখি। আমার খানিক অদ্ভুত লাগলো। বেডরুমে এমন একটা খালি চেয়ার থাকাটা কেমন বেমানান। আমাকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে মুখর যেন আমার প্রশ্নটা বুঝলো। বললো,

‘চেয়ারটা ঝামেলা লাগছে, তাই তো?’

আমিও মাথা দুলিয়ে বুঝিয়েছি আসলেই চেয়ারটা একটা উটকো ঝামেলা। মুখর মুচকি হাসলো। এরপর খোলা জানালার পর্দাটা সরিয়ে বললো,

‘এই চেয়ারটা আমি রেখেছি প্রতিরাতে এভাবে জোৎস্নাবিলাস করার জন্যে। দেখুন, কি সুন্দর আলো পড়েছে চাঁদের।’

আমি একটু এগিয়ে জানালার বাইরে উঁকি দেই আকাশে। আসলেই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি! চাঁদটা তার সম্পূর্ণ আলোটুকুই ছড়িয়ে দিচ্ছে রাতের পৃথিবীতে। কি অমায়িক লাগছে পরিবেশটা। আমার চোখটা চিকচিক করে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বললাম,

‘অদ্ভুত সুন্দর!’

পাছে মুখরের ধরা গলা শোনা গেল। সে বলছে,

‘হ্যাঁ সত্যিই! অপরূপা যাকে বলে।’

আমি পাশ ফিরে দেখলাম ছেলেটা গালে এক হাত দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একেবারে পলকহীন হয়ে! আমার সে কি ভীষণ লজ্জা লাগলো। আর তখনই আমার ঠান্ডা লেগে যাওয়ায় মুখর জানালা বন্ধ করতে উদ্যত হলো। আমি মুখরের হাতটা খপ করে ধরে অনুরোধের সুরে বললাম,

‘বন্ধ করবেন না, মুখর সাহেব। চাঁদ দেখবো!’

মুখর আবারো হাসলো। আর এই হাসিটা যেন বুকে তীরের মতো বিঁধে প্রতিবার! আমি হৃদপিণ্ডের ধ্বক ধ্বক করাটা থামাতে আবারো চোখ দিলাম আকাশে। তখনই পেছন হতে গরম কিছু অনুভব করলাম। মুখর পেছন হতে একটা চাদর বিছিয়ে দিলো আমার গায়ে। আমিও ঠান্ডায় জমে যাওয়ায় চাদরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলাম গায়ে। এরপর দুজনেই খানিকক্ষণ পরিষ্কার আকাশটার দিকে চেয়ে রইলাম। চাঁদের আলোটা যেন মোহিত করে ফেললো দুজনকেই। আমি আড়চোখে একবার আমার পাশে বসা মুখরকে দেখলাম। এতোদিন ভাবতাম চাঁদের আলোয় শুধুমাত্র মেয়েদের সুন্দর লাগে। কিন্তু এখন তো দেখছি চাঁদের আলোয় মুখরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে আমার। সে বারবার হাত দুটো জোর করে তাতে ফুঁ দিচ্ছে খানিক পর পর। আমি বুঝতে পারলাম ছেলেটারও ঠান্ডা লাগছে। আমি চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,

‘আমাকে সাহস দিও, চাঁদমামা!’

সাতপাঁচ না ভেবে আমি মুখরের বাহুতে হালকা চিমটি কেটে তাকে আমার দিকে ফেরালাম। ইশারায় বললাম একটু কাছে আসতে। সেও চেয়ারটা আমার কাছাকাছি নিয়ে এলো। তখনই আমি চাদরের অর্ধেকটা তার পিঠেও জড়িয়ে দিলাম। সে প্রথমদিকে হালকা অবাক হলেও পরে আমার কান্ডে মিটিমিটি হাসলো। আমিও লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। মুখরের বাহুর সাথে আমার বাহুটা হালকা স্পর্শ করছে। আমাদের হাতগুলো স্পর্শ করছে ক্ষীণ। মুখর যেন এ সুযোগটাকেই কাজে লাগালো। তার বাম হাতটা গলিয়ে আমার ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে হাতটা চেপে ধরলো আলতো করে। আমি একটু শিউরে উঠলেও তার সাথে তাল মিলিয়ে চেপে ধরি তার হাতখানা। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। মুখরের হাত ধরাটা আজ প্রথম নয়। কিন্তু তারপরও যেন লজ্জায় চোখ মেলাতে পারছিলাম না তার দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনটা আমার ঐ খোলা আকাশটাতে উড়োউড়ি করছে। এই আকাশ, এই চাঁদ, এই পরিবেশকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে জানাতে খেই হারিয়ে ফেলি আমি। অজান্তে ঠোঁটদ্বয় জুড়ে চওড়া হাসি ফুটলো আমার। অবাক হয়ে উপভোগ করছি চারপাশটা। তখনই মুখর হঠাৎ হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তার দিকে তাকাতেই দেখলাম সে ওপাশে ফিরে বসে আমায় বলছে,

‘মিস.তিথিয়া! ওভাবে হাসবেন না যে!’

আমার খুব অপমানবোধ হলো। ছেলেটা এই নিয়ে তিন তিনবার আমায় হাসতে বারণ করেছে। হাসার কি অধিকার নেই আমার? আমার হাসিটা কি এতোটাই বাজে? ফোনটা হাতে নিয়ে ক্রিনে তাকিয়ে পরপর কিছুক্ষণ হাসলাম। হাসিটা আসলেই বাজে আমার! মনটা খারাপ করে মুখরকে বললাম,

‘আমি যে খুব বাজে হাসি, তা আমি জানি মুখর সাহেব। তাই বারবার হাসতে নিষেধ করে আমায় লজ্জা দেবেন না, প্লিজ।’

মুখর ডাগরডাগর চোখ নিয়ে আমার দিকে ফিরলো। আমিও কষ্ট পাওয়ার ভান করে মুখটা নিচু করে ফেললাম। ভালোবাসার মানুষের কাছে অপমান হওয়ার চাইতে কষ্টের আর কিছুই নেই! মুখর হঠাৎ আমার কাছে এসে আমার মুখটা দু’হাতে তুলে ধরলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘আমি ওভাবে বলিনি তো, মিস.তিথিয়া। আপনার হাসিটা আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলে, আমার ভেতরের সবটা এলোমেলো করে দেয়। এই অসম্ভব সুন্দর হাসিটা আমি বেশিক্ষণ দেখে থাকতে পারি না বলেই এমনটা বলেছি।’

আমার মনটা এখনো ভরলো না। আমি বললাম,

‘তার মানে আমি খারাপ ভাবে হাসি বলেই আপনি বেশিক্ষণ আমার হাসি দেখতে পারেননা, তাই তো!’

মুখর হঠাৎই কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। তড়িৎ দাঁড়িয়ে তার দু’হাত নেড়ে আমায় বোঝাতে শুরু করলো,

‘ব্যাপারটা তেমন নয়, মিস.তিথিয়া! আসলে আপনার হাসিটা ঠিক…ঠিক কিসের সাথে তুলনা করা যায়? উমম..হ্যাঁ, আপনি হাসলেই আপনার ঠোঁট দুটো থেকে মুক্তো ঝরে! যা আমি সচোক্ষে দেখে থাকতে পারি না। এ কারণেই আমি কথাগুলো বলেছি! খুব জটিল বানিয়ে ফেলেছি, তাই না?’

তার এমন অস্থিরতা দেখে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। তাই ফিক করে হেসে দিলাম আমি। মুখর মুচকি হেসে কপাল চুলকে নিলো। আমার সামনে বসে বললো,

‘আপনি মন খারাপ করেননি তো, মিস.তিথিয়া?’

আমি মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

‘হ্যাঁ, করেছি। খুব মন খারাপ করেছি।’

সে প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি তার দিকে ঝুঁকে বললাম,

‘আমায় এতো মিস. মিস. করেছেন কেন বলুন তো! আমি তো এখন মিসেস. হয়ে গেছি। মিসেস. মুখর!’

মুখর আচমকা হতবাক হয়ে গেল। এরপর থুতনিতে ডান হাতটা রেখে চিন্তিত হওয়ার ভাব করে বললো,

‘তাই তো! আপনি তো এখন বিবাহিত। ইশ! আপনাকে দেখতে যা পিচ্চি পিচ্চি লাগছে, কেউ বলবেই না আপনার বিয়ে হয়ে গেছে!’

তার কথায় আমি নিজের দিকে একটাবার তাকালাম। ছেলেটা কথাচ্ছলে আমায় উপহাস করছে তা আমি বেশ বুঝেছি। তাই কিছুটা রাগ হলো আমার। বিয়ের প্রথম দিনই এমন অপমান? ঈষৎ রাগ নিয়ে বললাম,

‘হ্যাঁ, অন্তত আপনার মতো জিরাফ নই!’

মুখর আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,

‘জ্বি, জ্বি? কি বললেন, মিস.তিথিয়া?’

আমি তার চোখের দিকে চোখ মিলিয়ে বললাম,

‘জিরাফ বলেছি, জি-রা-ফ!’

এটুকু বলার পর দেখলাম মুখর পাশে থাকা জগ থেকে পানি ঢাললো। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসলো। আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। আমিও দু’হাত ভাঁজ করে বলে উঠলাম,

‘কি? পানি মারবেন তো? মারুন দেখি!’

এই বলে চোখ বন্ধ করে মুখটা এগিয়ে দিলাম। ঠিক তখনই কপালে নরম কিছুর স্পর্শ পেলাম। চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে দেখলাম মুখর আবারো মিটমিট করে হাসছে। আমি হালকা কপাল ঢলে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সে মুহূর্তে আবারো মুখর আমার কপালের কাছে এসে একটা চুমু খেল। আমি চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছি মুখরের পানে। সে এবার আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘এখন থেকে আমার কাছে সাবধানে মুখ এগিয়ে দেবেন, বুঝলেন?’

আমি লজ্জায় মুখ ঢাকলাম তার বুকের মাঝে। ঠিক তখন পুরো শহর সাক্ষী হয়ে রইলো একটা নিঝুম এবং সুন্দরতম রাতের!
.

ক’দিন পর,

মুখরের বিয়ে হয়েছে শুনে বরিশাল থেকে আন্টির কিছু আত্নীয় এসেছে। আত্নীয় বলতে বেশিরভাগই মধ্যবয়সী মহিলারা এসেছে। এদের মতে, এরা মুখরকে খুব ছোটবেলায় দেখেছে। সেই ছোট্ট মুখর যে আজ বড় হয়ে বিয়ে করে নিয়েছে এ কথা তাদের ভাবনার বাইরে। মুখর আজ অফিস না গিয়ে তাদের আড্ডায় ফেঁসে গেছে। আমিও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম রান্নাঘরে। তাদের আড্ডার মূল বিষয়ই হলো মুখর। বাচ্চা ছেলেটা ছোট থেকে বেশ দুরন্ত আর দেখতে রাজপুত্রের মতো। তারউপর ছেলের ভালো চাকরি আছে দেখে মহিলারা আন্টিকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আমি রান্নাঘরে এসেছি তাদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে যেতে। তবে যাওয়ার মাঝপথে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথোপকথন শুনে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। কিছু মহিলা সেথায় বলছে,

‘কি গো আমেনা, তোমার এমন সোনার টুকরো ছেলেকে এ কেমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে? এ ছেলের তো একটা পরীর মতো বউ হওয়ার কথা! নাহ, তোমাকে কতো বলছি আমার জান্নাতকে তোমার ছেলের বউ করে ঘরে তোলো। ঘরটা রাজপ্রাসাদ করে রাখতো এই মেয়ে! কি বাহার তার রূপের!’

এরপর এক মহিলা অন্য মহিলার অনুকরণ করে এমন হাজারটা মেয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলো বিবাহিত এক পুরুষের জন্য! কথাগুলো শুনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। ভাঙা একটা মন নিয়ে চুলোর ধারে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আসলেই যে আমি মুখরের যোগ্য নই! না আছে রূপের বাহার আর নাই বা কোনো যোগ্যতা! কি করে তবে আমি এই ঘরটাকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাখবো?
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেলাম। নিজেকে সংযত করে চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে দিলাম। পেছন ফিরে দেখলাম মুখর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তার ঠোঁট জুড়ে বিষদ হাসি। আজকাল সারাক্ষণই সে এমন চওড়া হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়েই রাখে। আমিও জোরপূর্বক হাসলাম কিছুটা। সে আমার কাছে এসে পেছন হতে আমার কাঁধে মাথা রাখলো আলতো করে। আমি তাড়া দিয়ে বললাম,

‘আহহা, এখন যদি কেউ দেখে ফেলে?’

মুখর আমার কথাটা উপেক্ষা করে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। লজ্জায় আমি মিইয়ে গেলাম তড়িৎ। চায়ে চাপাতা দিয়ে আনমনে বললাম,

‘মুখর সাহেব!’

সেও ছোট করে বললো,

‘হুম?’

আমি চায়ের দিকে চেয়ে বললাম,

‘আমি আপনার জীবনে না এলে আপনি একটা ফুটফুটে মেয়েকে নিজের বউ করে আনতে পারতেন, তাই না?’

সে আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। এতে আমি আরেকটু বাড়িয়ে বললাম,

‘যে মেয়ে আপনার ঘরকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাখতো! আপনাদের দুজনকে বেশ মানাতো। আপনি খুব সুখী হতেন, ঠিক বলেছি না?’

মুখর তখন আমার কোমড় ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝটপট উত্তর দিলো,

‘না, আমি সুখী হতাম না।’

সে আমার পাশে এসে প্লেটে বিস্কিট সাজাতে সাজাতে বললো,

‘আমি শুধুমাত্র মিস.তিথিয়াকে পেলেই সুখী। অন্য কেউ তো আর মিস.তিথিয়া নয়, তাই না?’

আমার চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। মনটা কি ভীষণ রকমের খুশি হয়ে উঠলো। মন, মস্তিষ্ক দুটোই বিড়বিড় করলো, ‘মানুষটা একান্তই আমার!’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#অন্তিম_পর্ব (শেষাংশ)
#তাশরিন_মোহেরা

মুখর আর আমার বিয়ে হয়েছে আজ দেড় মাস হলো। কিন্তু এখনো মুগ্ধ আমাকে ভাবী ডাকতে অভ্যস্ত হলো না। তার মুখে ‘ম্যাম’ ডাকটা যতটা না সুন্দর তার চাইতে দ্বিগুণ সুন্দর হলো ‘ভাবী’ ডাকটা। তবে এই ক’দিনে তার সাথে আমার বন্ধুত্বটা আরো গাঢ় হয়েছে। সে আপনি থেকে তুমি’তে নেমেছে আর আমি নেমেছি তুই’তে। প্রথমদিকে যদিও কিছুটা অস্বস্তিবোধ কাজ করতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আন্টি গতকাল বরিশাল ফিরে গেছেন। আমি, মুখর, মুগ্ধ প্রত্যেকেই জোর করেছি এখানে আরো ক’টা দিন থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আন্টির নাকি বরিশালেই স্বস্তি মেলে। ইশ! কথার ফাঁকে আবারো মা না ডেকে আন্টি ডেকে ফেললাম। দুঃখিত!
মুখরদের বাসার বাগানটা আমার খুব পছন্দের। তবে এখন পছন্দটা আরো বেড়েছে। কেননা মুখর আমাদের বিয়ের পরই এখানে একটা ছোট বেলিফুলের চারা লাগিয়েছে। বেলিফুল বরাবরের মতোই আমার খুব পছন্দের। আর আমার স্বামীটা যে আমার পছন্দের এতো কদর করে তা নিয়ে আমি বেশ সন্তুষ্ট! বাগানটাতে এসে বেলিফুলের চারাটায় পানি দিচ্ছি। এমন সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ায় মুগ্ধ। আমায় বলে,

‘বেলিফুল খুব সুন্দর, তাই না ম্যা- না ভাবী!’

আমি গাছটাতে পানি দিতে দিতে হালকা হাসলাম। মাথা দুলিয়ে বললাম,

‘সত্যিই খুব সুন্দর!’

চারাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছি আমি। বেলিফুলের প্রতি মায়াটা আমি পেয়েছি আমার আব্বা থেকে। ফুলের প্রতি তার অদ্ভুত এক ভালোবাসা ছিল। যার কারণে তিনি চারপাশের মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছেন। চারপাশের নীতি অনুযায়ী, ছেলে হয়ে ফুলের প্রতি অতিরিক্ত মায়া থাকাটা হাস্যকর! ছেলেদের ফুল নিয়ে ঘাটাঘাটি করার অধিকার নেই। ফুল নিয়ে ভালোবাসা জন্মানোটা মেয়েদের অভ্যাস। কিন্তু আমার আব্বাটা চারপাশ নিয়ে তেমন একটা ধার কখনোই ধারতেন না। ‘লোকে কি বলবে!’ এই চিন্তাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি তার পছন্দের সবকিছুকেই বেশ সযত্নে রাখতেন। ঠিক যেমনটা সযত্নে রেখেছেন আমার মা’কে! আর এই যত্নটা-ই যে কবে মায়ের বিরক্তির কারণ হয়ে গেল তিনি বুঝতেই পারেননি। আব্বার অতিরিক্ত স্বভাবটা-ই যেন আব্বাকে অন্যের কাছে খারাপ বানিয়ে দিয়েছে। আব্বাকে ভীষণ মনে পড়ছে আমার! যদিও তিনি প্রতিদিনই ফোন দিয়ে আমার খোঁজ খবর নেন। কুমিল্লায় আব্বা ভালোই আছেন। তবে আমার যে আব্বাকে চোখের সামনে দেখার জন্যে মন কাঁদছে! মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখতে মন চাইছে।

মুগ্ধের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। চমকে তার দিকে ফিরতেই সে বললো,

‘ভাবী, তোমার কি মন খারাপ?’

আমি ক্ষীণ হেসে বললাম,

‘কই না তো বাবা! কেন এমন মনে হয়েছে তোর?’

সে আমার মুখের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

‘তাহলে তুমি এভাবে মিথ্যামিথ্যি হাসছো কেন? মন খারাপ না থাকলে কেউ এভাবে হাসে?’

আমাকে নিয়ে ছেলেটার এমন পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ দেখে অবাক হলাম। মুগ্ধ আমাকে আবারো বললো,

‘দেখি, এখন ভালো করে হাসো তো। তোমার হাসিটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।’

আমি মুগ্ধের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ করেই দু চোখ পানিতে টলমল করে উঠলো। গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ থেকে লুকিয়ে কান্নাগুলো মুছলাম। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই মুগ্ধ আমাকে বাধা দিয়ে দাঁড়ালো। বললো,

‘ভাবী, যাওয়ার আগে বলো তোমার মন ভালো হয়েছে কিনা!’

আমি তার দিকে চুপচাপ চেয়ে আছি। এখন তো ছেলেটাকে মিথ্যা বলতেও ভয় লাগছে। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুগ্ধ বললো,

‘সমস্যা নেই। দাঁড়াও আমি তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি এখনই!’

এই বলে মুগ্ধ তার চেহারাটা বিভিন্ন রকম করে পাল্টাতে লাগলো। একবার ঠোঁট দুটো টেনে তো অন্যবার চোখ দুটো উল্টে। মুখ থেকেও কি যেন অদ্ভুত কিছু শব্দ করছে সে। এটুকু শুনে আমি আর না হেসে পারলাম না। চওড়া এক হাসি হেসে মুগ্ধকে আরো একবার আদর করে দিলাম। তার চুলগুলো এলোমেলো করে বললাম,

‘আমার মন ভালো হয়ে গেছে, জনাব মুগ্ধ! চলুন, এজন্য আপনাকে মজার কিছু বানিয়ে দেই।’

মুগ্ধ খুশি হয়ে বড়দের মতো বললো,

‘আপনাকে আমার মনের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমার প্রিয় ভাবী!’

আমি আর সে হো হো করে হেসে উঠলাম। এমন সময় ড্রয়িংরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ এলো। মুখর ভেতরে আসতে আসতেই কিছুটা অভিমানী সুরে বলে উঠলো,

‘আমাকে ছাড়াই সব মজা করে ফেলছেন আপনারা! উহু..নট ফেয়ার।’

.

দেখতে দেখতেই আমাদের সংসার জীবনের প্রায় সাড়ে তিনটে বছর চলে গেল! এর মাঝেই আমাদের কোল জুড়ে এলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। যার নাম দিয়েছি মায়িদা! মেয়েটা আমাদের সবারই বেশ আদরের হয়েছে। তার এখন আড়াই বছর চলছে। মুখে ফুটেছে আদো আদো বুলি, যা শুনতে বেশ মধুর লাগে! তবে মেয়েটা তার বাবা-মা থেকেও বেশি ভালোবাসে তার ছোট মামাকে। মুগ্ধ এখন দিনের অর্ধেকটা-ই মায়িদার সাথে খেলাধুলায় কাটিয়ে দেয়। আর ছোট্ট মেয়েটা মামাকে পেলে কি যে খুশি! কি জানি মুগ্ধের ভেতর সে এতো খুশির কি পায়!

তবে আজ মেজাজটা একটু বেশিই খারাপ আমার! একে তো মুখর দেরিতে বাজার এনেছে, তারউপর ডিমের বদলে এনেছে এতোগুলো শুটকি। বাসায় ইতোমধ্যে ঢের শুটকি থেকে গেছে। তাই রাগ নিয়ে একটু চিৎকার করে মুগ্ধকে বললাম,

‘শুনছিস মুগ্ধ, আজও তোর ডিম খাওয়া হবে না!’

মুগ্ধ প্রথমদিকে আমার রাগ বুঝতে পারেনি। মায়িদাকে কোলে নিয়ে আমায় বললো সে,

‘ঠিক আছে ভাবী, সমস্যা নেই। ডিম ছাড়া-ই খেতে পারবো আমি!’

মুখর ফ্রেশ হয়ে সবে বেরিয়েছি। এ দেখে মুখরকে শুনিয়েই মুগ্ধকে বললাম,

‘ডিমের বদলে তুই বরং এই শুটকিগুলোই চিবিয়ে খেয়ে নিস।’

মুখর আমার কথা শুনে সোজা রান্নাঘরে চলে এলো। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করতে করতে বললো,

‘আরেহ, কাজের এতো চাপ ছিল কি আর বলবো! তাই ভুলে ডিমের বদলে শুটকি নিয়ে এসেছি।’

আমি মুখরের দিকে একবারও ফিরলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘আজ আপনাকে কাঁচা শুটকি খাওয়াবো, অপেক্ষা করুন!’

মুখর আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কিছুটা আহ্লাদী হয়ে বললো,

‘আহ! এতো রাগছেন কেন বলুন তো, মিস.তিথিয়া?’

কথাটায় রাগ যেন তরতর করে আরো বেড়ে গেল। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালাম মুখরের দিকে। মুখর আড়চোখে তা দেখেও পাত্তা দিলো না। আমার দিকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘নিন, পানি পান করুন। দেখবেন রাগ সব ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে।’

বাবার মুখে ‘ফুড়ুৎ’ শব্দটা শুনে মায়িদা খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার অমায়িক হাসিতে চোখ গেল আমাদের সবার। মুখর মায়িদার দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই আদুরে গলায় বললো,

‘ইশ! আমার প্রিন্সেসটা হাসছে কেন? হুম? এদিকে এসো, আমার মা!’

মায়িদাকে কোলে তুলে মুখর তার সাথে দুষ্টুমি করতে লাগলো। খানিকক্ষণ পর, আমাকে জ্বালাতে মুখর মায়িদাকে বলে উঠলো,

‘তোমার মাম্মা আমার সাথে ঝগড়া করছে, দেখছো?’

আমি মুখরের দিকে তাকাতেই দেখি মায়িদা তার বাবার কথা বোঝার ভান করে বললো,

‘ঝগগা?’

মুখরও মাথা দুলিয়ে মেয়ের সাথে তাল মেলালো। মায়িদা তখন আমার দিকে দেখে বললো,

‘বাববা-মাম্মা ঝগগা!’

তার আদো আদো কথাতে আমার রাগটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। ফিক করে হেসে দিলাম আমি। আমার সাথে হাসছে মুগ্ধও! আর মুখর আমাকে নিয়ে তার যাবতীয় অভিযোগ পেশ করছে মেয়ের সামনে। মায়িদাও যেন বাবার সব কথা বেশ বুঝতে পারছে! বাবার সাথে মিষ্টি মিষ্টি করে কি যেন বলছে সে! দেখেই আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মেয়েটা দেখতে যে এতো মিষ্টি হয়েছে!

প্রতিদিনের মতো আজও আমি আর মুখর বসে রাতের আকাশটা দেখছি। মায়িদা আমার কোলে আয়েশ করে ঘুমুচ্ছে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকেই আমরা আকাশ দেখার সাথে সাথে আমাদের মেয়েটাকেও দেখি। তার দেহের সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম ভাঁজও যেন আমাদের চোখ এড়ায় না। আজও তার নিষ্পাপ মুখখানা দেখে দুজনেই চোখ জুড়িয়ে নিলাম। মেয়েটার মুখটা দেখেই আমি আনমনে বললাম,

‘মুখর সাহেব, মেয়েটা একদম আপনার মতোই হয়েছে।’

মুখর প্রতিবারের মতো আজও আমার কথার বিপরীতে বললো,

‘না, মিস.তিথিয়া। মায়িদা একদম তার মায়ের মতো হয়েছে দেখতে।’

আমি প্রত্যুত্তরে হেসে আর কিছু বললাম না। লোকটার সাথে এ বিষয়ে আমি কখনোই পারবো না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে চাঁদ দেখতে দেখতেই বললাম,

‘আমাদের প্রণয়টা খুব অদ্ভুতভাবেই হলো, তাই না মুখর সাহেব? আপনার সাথে প্রথম দেখাটা ভীষণ অদ্ভুত ছিল। আপনার সাথে আমার বিয়ে হওয়াটাও ছিল বড্ড অদ্ভুত! যা ভাবলেই আমার হাসি পায়।’

মুখর গলাটা অত্যাধিক শান্ত করে হঠাৎ বললো,

‘আমি অন্যদের মতো নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে পারিনি বলেই আমাদের প্রণয়টা খুব অদ্ভুত ছিলো। হায়! নিজের ভালোবাসার কথাটাও অন্যদের মতো সাহস নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলতে পারিনি!’

মুখরকে আচমকা কেমন দুঃখিত দেখালো। ছেলেটা এতো ছোট বিষয়েও এমন মন খারাপ করছে কেন?
তার কাঁধে মাথাটা রেখে আমি বললাম,

‘আপনাকে ভালোবাসি এটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। অতোসব বিলাসিতা আমি কখনোই হজম করতে পারিনি। আমার যে অদ্ভুত বিষয়গুলোই প্রিয়। ঠিক যেমন আপনি এবং আমাদের অদ্ভুত প্রণয়নামাটা প্রিয়!’

মুখর মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ পর সে অনুরোধের সুরে বললো,

‘আর একটাবার বলবেন, মিস.তিথিয়া!’

আমি তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম,

‘কি বলবো?’

সেও হালকা লজ্জা পেয়ে বললো,

‘ঐ যে ঐ কথাটা!’

আমি বুঝতে না পেরে বললাম,

‘কোন কথাটা?’

‘আরে আপনি বুঝছেন না! ঐযে..’

‘ঐ যে..?’

মুখর এবার রাগ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অভিমান নিয়ে বললো,

‘অনেক হয়েছে! দরকার নেই আপনার বলার।’

এমন সময় আড়মোড়া ভেঙে মায়িদা শব্দ করে কান্না করে উঠলো। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও সে শান্ত হলো না। মুখর এবার আমার কোল থেকে মায়িদাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাকে শান্ত করলো! বেশ কিছুক্ষণ পর, মেয়েটা বাবার কাঁধেই ঘুমিয়ে গেল। মুখর আলতো করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমরাও বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই ফিসফিস করে মুখরের কানের কাছে বললাম আমি,

‘আপনাকে খুব ভালোবাসি, মুখর সাহেব!’

ঘন অন্ধকারে মুখরের চেহারাটা দৃশ্যমান হলো না। তবে সে পরম আদরে আমার কপাল জুড়ে একটা দীর্ঘ চুমু বসিয়ে দিলো। যা থেকে বুঝতে পারলাম, মানুষটা আমার কথায় বেশ খুশি হয়েছে! এভাবেই যেন আমাদের অদ্ভুত প্রণয়নামা সার্থকতা লাভ করলো।

(সমাপ্ত)