অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-০১

0
3

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
সূচনা পর্ব

“আজ রাতে যদি আমি তোমায় আমার করে পেতে চাই, তুমি কি খুব রাগ করবে জোনাকি?”

পাশাপাশি শুয়ে থাকা এক দম্পতি আজ সাত বছর পর এতটা কাছাকাছি। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া ঘরে অন্ধকার আর দু’জনার নিঃশ্বাস ছাড়া কিছু শোনা বা দেখা যাচ্ছে না। পাশে শুয়ে থাকা এই স্বামী নামক মানুষটাকে আজ নিয়ে জোনাকি দু’বার দেখেছে। প্রথম দেখেছিলো বিয়ের রাতে। অবশ্য সেটাই ছিলো শেষ দেখা। দীর্ঘ চার বছর পর আজ আবার দেখা। লোকটা বিয়ে করেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কোথায় গেছে কেন গেছে কেউ জানতো না প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। আশেপাশের সবাই দোষ দিয়েছিলো জোনাকির। কিন্তু জোনাকি কি করে জানবে কেন লোকটা বিয়ে নামক একটি পবিত্র বন্ধনে তাকে বেঁধে সে হারিয়ে গেছে? তারপর আরো এক সপ্তাহ পর পরিবারের সাথে সাথে জোনাকিও জেনেছিল কেন মানুষটা তাকে ফেলে চলে গিয়েছিলো। কি ভাবছেন কোন প্রেমের সম্পর্ক? না,এমন কোন বিষয় হলে জোনাকি নিজেই সেই চার বছর আগে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো। কিন্তু কারণটা ছিলো খুব ছোট। সেটা পড়ে বলা যাবে ক্ষণ। সে ছিল সাত সাগর তেরো নদী পাড় করে অনেক দূরে। বুঝতেই পারছেন কোথায়। হ্যাঁ বিদেশ। বিদেশ নামক এক দেয়াল তার জীবন থেকে কেঁড়ে নিয়েছিল তার স্বামীকে। অবশ্য এক তরফা কেঁড়ে নেওয়াও বলা যায় না। কারণ কেউ যেতে না চাইলে, কাউকে জোর করে কোথাও নেওয়া সম্ভব নয়। যখন জোনাকির বিয়ে হয়েছিলো,তখন জোনাকি সতেরো বছরের কিশোরী ছিলো। আজ চব্বিশ বছরের এক যুবতী। তার মাঝে সেই ছেলেমানুষী গুলো আর দেখা যায় না, যা সতেরো বছরে দেখা যেত। আজ যা দেখা যায়, তা হচ্ছে ম্যাচুরিটি। তার সাথে যখন এই পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার বিয়ে হয়,তখন ছিলো সাতাশ বছর। এখন সে চৌত্রিশ বছরের এক যুবক। সেদিন তাদের পরিস্থিতিতে যদি কারো ভুল করার কথা ছিলো,তাহলে সে ছিলো জোনাকি! কিন্তু সেদিন সেই ভুল কিনা করেছিলো সাতাশ বছরের এক যুবক। হাস্যকর একটা বিষয় এটা। সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে পড়ে ছিলো এই বাড়িতে জোনাকি। একটা ছোট্ট সূত্র, স্বামীর বাড়ি। আচ্ছা এটা তার স্বামীর বাড়ি ছিলো কি? যে স্বামীই তার হয়নি, সেই বাড়ি কি করে তার হবে? সে যাইহোক। হাজার মানুষের হাজার রকমের কথা শুনে প্রতিটি রাত জোনাকি বালিশ ভিজিয়ে কেঁদেছে। কতরাত সে নির্ঘুমে কাটিয়েছে তার হিসেব নেই। আর হিসেব করেই বা কি হবে,যার সাথে সব হিসেব নিকেশ করার কথা,সেই তো দূর দেশে ছিলো। নিজেকে সব কিছু থেকে বের করে গুছিয়ে নিতেই জোনাকির লেগেছিলো এক বছর। তারপর আস্তে আস্তে এই পরিবারের প্রতিটা মানুষের সাহায্য নিয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। এখন সে একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। বেস তো চলছিলো তাঁর জীবন! হঠাৎ করে কেন সে ফিরে এলো। সে যে কারণে জোনাকিকে ফেলে চলে গিয়েছিলো সব কি পূরণ হয়েছে। রোজকারের মতো আজও জোনাকি সকাল সকাল স্কুলের জন্য বেরিয়ে যায়। প্রাইমারী স্কুল তাই স্কুল ছুটি হতে হতে প্রায় তিনটা বেজে যায়। বাড়ি থেকে আধা ঘন্টার রাস্তা। যাওয়ার সময় হেঁটে গেলেও আসার সময় রিক্সা করেই ফেরা হয়। কারণ শরীরটা তখন আর এক পা-ও চলতে নারাজ। আজ যখন বাড়িতে পা দিলো জোনাকি!তখনই খেয়াল করলো, হঠাৎ করেই বাড়ির পরিবেশ থমথমে। বাহির থেকে বোঝা যাচ্ছিলো না তাই ভেতরে আসতেই দেখলো একজনকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কে? কে এলো এই বাড়িতে যাকে ঘিরে আছে সবাই । হঠাৎ জোনাকিকে খেয়াল করলো তাঁর ছোট জা শাপলা। জোনাকিকে দেখে শাপলা আনন্দে ডগমগো হয়ে কাছে এগিয়ে এলো।

_ জোনাকি আপু দেখো কে এসেছে! তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভাইয়া ফিরে এসেছে।

শাপলার মুখে কথাটা শুনে প্রথমে জোনাকি না বুঝলেও যখন বুঝতে পারলো,তখন চকমে উঠলো। মানুষটা ফিরে এসেছে, এতো বছর পর। নিশ্চয়ই এবার তাঁকে পুরোপুরি মুক্তি দিতেই তাঁর ফিরে আসা। একবার কি তাঁর কাছে লোকটা জানতে চাইবে,সে মুক্তি চায় কিনা। সে তো এভাবেই ভালো আছে সুখে আছে। কিন্তু মুক্তি দিলে যে জোনাকি পুরোপুরি ভেঙে গুড়িয়ে যাবে। তখনই শাপলা জোনাকির হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো স্বামী নামক সেই মানুষটার সামনে। সবাই সরে দাঁড়াতেই লোকটাকে নজর এলো জোনাকির চোখে। ঠিক সাত বছর আগের মতোই আছে,শুধু স্বাস্থটা একটু ভারি হয়েছে, আর গায়ের রংটা উজ্জ্বল। এক ঝলক দেখতেই জোনাকি চোখ সরিয়ে নিলো। কিন্তু সেই এক ঝলকেই মানুষটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখে চোখ পড়তেই কেমন এক শিহরণ বয়ে গেলো হৃদয় জুড়ে। কাউকে কোন কিছু না বলেই জোনাকি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লো। চোখটা অসম্ভব জ্বালা করছে,কিন্তু জল গড়িয়ে পড়ছে না। খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে! কিন্তু কেন জানি চোখ থেকে জল পড়লো না। পুরো বিকাল জোনাকি ঘর বন্দী হয়েই রইলো। এর মাঝে শাপলা এবং মানুষটা এসেছিলো। নিজের জিনিসপত্র রাখতে। কারণ ঘরটা যে তাঁর। আমিই তাঁর ঘর দখল করে এতোদিন বসে ছিলাম। যখন শাপলা দরজা নক করলো,তখনও আমি দরজার কাছে বসে ছিলাম।

_ আপু দরজা খোলো,ভাইয়া ঘরে ঢুকবে তো?

কিন্তু আমি কিছুই বলিনি! কেন জানি আমার সব কথা দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে আসছিলো। বারকয়েক কথা বলতে চেয়েও পারিনি। আমাকে নিরব থাকতে দেখে শাপলা আবার বললো।

_ কি করছো জোনাকি আপু,তুমি হঠাৎ এমন করছো কেন? ভাইয়া অপেক্ষা করছে তো দরজার কাছে। প্লিজ খোলো দরজাটা।

কিন্তু আমি পারলাম না দরজা খুলতে। এমন কি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকুও সঞ্চয় করতে পারলাম না। বহু কষ্টে যখন কিছু বলতে যাবো! তখন উনি বলে উঠলেন।

_ বাদ দাও শাপলা। ওকে একা থাকতে দাও কিছুক্ষণ,নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য ওর সময়ের দরকার। আমি না-হয় নিঝুমের ঘরে গিয়ে রেস্ট নেই। ওর ঘরটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে।

লোকটার কন্ঠ শুনে আমার কি হলো আমি জানি না! তৎক্ষনাৎ আমি দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিলাম। আমাকে দরজা খুলতে দেখে ওরা দুজন অবাক হলো। আমি দরজা থেকে সরে আসতেই উনি ঘরে ঢুকলেন,আর শাপলা চলে গেলো।

———-

প্রায় চার বছর, পাঁচ মাস, দেড় সপ্তাহ পর নিজের ঘরে পা দিলো মেঘ। কিন্তু ঘরটাকে দেখে মনে হচ্ছে না, সে এতদিন পর ঘরে পা দিলো।মনে হলো একটু আগে সে কোথাও গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে। সাত বছর আগে যেমন ঘরটাকে রেখেছিলো,আজও ঠিক তেমনটাই আছে। অথচ সে শুনেছে, তাঁর চলে যাওয়ার পর থেকে জোনাকি এই ঘরেই থাকে। তাহলে কি জোনাকি কিছু পরিবর্তন করেনি। কেন? কারণ মনে এসেই থেমে গেলো মেঘ। যে মরীচিকার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবন থেকে সাত বছর হারিয়ে ফেললো মেঘ, তা কখনোই ফিরে পাবার নয়। কিন্তু যে সময়টুকু এখন থেকে পাবে, সেটা সযত্নে আগলে রাখবে মেঘ। চোখ বুলিয়ে ঘরটাকে দেখলো মেঘ,সত্যি ঘরটা ঠিক আগের মতোই আছে,শুধু একটু পরিবর্তন হয়েছে। আর সেটা হলো পুরো রুম জুড়ে ছিলো ছেলেদের জিনিস, সেখানে জড়ো হয়েছে মেয়েদের জিনিস। দুই মিলিয়ে সেখানকার সব জিনিসপত্রের নাম দিলো “আমাদের ঘর” নিজের কথায় নিজেই অবাক হলো মেঘ। যাকে কিছু না বলেই কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেলো দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে। তাঁর উপর তাঁর অনুমতি ছাড়া কি করে সে তাঁকে আমার বলে দাবি করলো। না সব ঠিক করতেই তো ফিরে আসা। তাই পিছন ঘুরে যখন মেঘ কিছু বলার তাগিদ করলো,তখন দেখলো সেখানে জোনাকি নেই। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে মেঘ ভাবলো। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। তখনই মেঘের নাকে ভেসে এলো মিষ্টি গন্ধ। চোখ বন্ধ করে সেই গন্ধের অনুসন্ধান করতে রইলো। গন্ধটা মেঘের মাথার কাছে পড়ে থাকা একটি বালিশ থেকে আসছে। চোখ খুলেই বালিশটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। কিন্তু এই বালিশটা তো তাঁর বিছানার নয়,তাহলে কার বালিশ এটা? মেঘ ভালো করে তাকাতেই দেখলো এতো বড় বিছানায় শুধুমাত্র একটা বালিশ। যতোদূর মেঘের মনে পড়ে তাঁর বিছানায় দু’টো মাথার বালিশ,একটি কোলবালিশ,দু’টো কুশান ছিলো। তাহলে সেগুলো কোথায়। তখনই মেঘের ঘরে তাঁর বড় ভাবি মনি উপস্থিত হলো।

_ আসতে না আসতেই বউয়ের বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিলে মেঘ। কিন্তু ভাই বালিশ দিয়ে কি আর মন ভরবে যদি মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে নিজের মন না ভরতে পারো।

ভাবনার জগৎ থেকে ঘুরতে গিয়ে মেঘ নিজের অজান্তেই জোনাকির বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো। ভাবির কথায় মেঘ লজ্জা পেলেও সেটা বুঝতে দিলো না। নিজেকে স্থীর করে বললো।

_ যে ভুল করেছি ভাবি,তোমার কি মনে হয় এই বালিশটার মতো তাঁকে এতো সহজে জড়িয়ে নিতে পারবো।তাই যতোদিন না আসল মানুষকে দিয়ে মনের স্বাদ মেটাতে পারি,ততোদিন না-হয় এই বালিশেই স্বাদ মেটাই।

_ তারমানে দূধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর অপচেষ্টা।

_ তুমি যা ভাবার ভাবতে পারো আমার আপত্তি নাই।

মেঘের কথা শুনে মনি হাসিমুখে মেঘের পাশে এসে বসলো। ভাবিকে বসতে দেখে মেঘ শোয়া থেকে উঠে বসলো। কিন্তু বালিশটা তাঁর এখনো বুকের সাথেই লাগানো।

_ জানো মেঘ,জোনাকি যতটা সহজ সরল! ঠিক ততটাই অভিমানিনী। ওর প্রতিটা রাতের কান্নার সাক্ষী আমি নিজে। যখন ও বালিশে মুখ গুঁজে বলতো! কি অপরাধ তাঁর কেন তাঁর সাথেই এমন হলো। বিশ্বাস করো ভাই, তখন আমার মনে হতো আমি যদি যাদু জানতাম তখনই তোমাকে ওর সামনে হাজির করতাম। কিন্তু আফসোস আমি সেটা পারি না। এই বাড়িতে ও ছিলো ঠিকি,কিন্তু ওর অবুঝ মনটা শুধু তুমি তুমি করতো। ও খুব ভেতর থেকে শক্ত, তাই নিজের ভালোবাসা, অনুভূতি, রাগ, অভিমান সব নিজের করে রাখতে পেরেছে। জোনাকির জায়গায় আমি হলে এতোদিনে নতুন করে নতুন ভাবে সব শুরু করতাম। কিন্তু ও সেটা করেনি। কেন করেনি ওর থেকে সময় পেলে জেনে নিও। ওর সব পথ খোলা ছিলো নতুন করে শুরু করার,কিন্তু ও করেনি। হয়তো তুমি ওর শুরু থেকে শেষ অবধি সীমাবদ্ধ আছো। কিন্তু শুধু এটাই বলবো এবার অন্তত সব কিছু ঠিক করে না-ও।

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে মেঘ মাথা নিচু করলো। কে জানতো যাকে ফেলপ চলে গিয়েছিলো, আজ তাঁকেই তাঁর সব থেকে বেশি প্রয়োজন হবে।

_ভাবি আমি জানি আমি ভুল করেছি। আমি চাইলেই ফেলে আসা সময়টা ওকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না। কিন্তু এখন থেকে ওকে আমার জীবনের বেস্ট সময় গুলো উপহার দিবো ইনশাল্লাহ।

_ শুনে খুশি হলাম। চলো এবার ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো,সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে। সাথে সেও আছে। তোমার ভাগ্য খুব ভালো জনাব। কারণ আজ জোনাকির রান্নার দিন। আজ ও সকলের জন্য রান্না করবে,সপ্তাহে তিনদিন সে রান্না করে।আজ তাঁর মধ্যে একদিন। আর দেখো সেদিনই তোমার আগমন হলো।

_ সে আজ রান্না করবে ভাবি? তাঁর মন কি পারবে নিজেকে স্থীর রেখে সবার জন্য রান্না করতে।

_ তোমাকে বললাম না,ও ভেতর থেকে শক্ত। নিচে গিয়ে দেখো অলরেডি সবাই তাঁর তৈরি চা এবং নুডলস খাচ্ছে।

_ কি বললে ভাবি,আগে বলবে তো? আমার চা-টা বোধহয় ঠান্ডা হয়েই গেলো।

এই কথা বলেই মেঘ ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে মনি হেঁসে দিলো।

_ ছেলেটা আগের মতোই আছে,শুধু বয়স বেড়েছে ছেলেমানুষি গুলো ঠিক আগের মতো।

———–

খুব মনোযোগ দিয়ে সকালের খবরের কাগজ পড়ছেন আলতাফ হোসেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চশমাটা নাকে আসতেই বিরক্ত নিয়ে সেটা ঠিক করে টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা হাতে নিলেন। এক চুমুক চা মুখে দিয়েই পরম আবেশে চোখ বুজে নিলেন তিনি। সারাদিনের ক্লান্তি এই এক চুমুক চা-তেই শেষ। এই জন্যই অফিসে এই চা-টা খুব মিস করেন তিনি। বয়স কত হবে তাঁর এই তো পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। তবুও তাঁকে দেখলে বোঝা যাবে না আসল বয়স কত? এই বাড়িটার সকল মানুষ তাঁর উপর নির্ভর। বড় ভাইটা যখন সকল দায়িত্ব তাঁর উপর দিয়ে সবাইকে মুক্তি দিয়ে চলে গেলেন! তখন আলতাফ হোসেন কাঁদবে ভাই হারানোর শোকে, নাকি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্থীর করবে দোটানায় পড়ে সেদিন দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল তাঁর। তবুও সবার কথা ভেবে তিনি শক্ত হয়েছিলেন। সেই থেকে এখন অবধি সকল দায়িত্ব সে নিজ দায়িত্বে পালন করছে। প্রতিটা সদস্য তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও, নেয়নি শুধু মেঘ। একবারও যদি সেদিন আলতাফ হোসেন জানতেন অসহায় এই মেয়েটাকে একটু ভালো রাখবে বলে যাঁর সাথে বিয়ে দিয়েছিলো! সেই সব থেকে বেশি অসহায় করে চলে যাবে দূর দেশে,তাহলে নিজ দায়িত্বে মেয়েটাকে মেঘের বউ করতেন না। বুকটা ভারি হয়ে আসলো। মেয়েটাকে দেখলেই বড় মায়া হয় আলতাফ হোসেনের। কত সুন্দর তাঁর কথা,ব্যবহার। হাসিতে যেন মুক্ত ঝড়ে পড়ে। রূপে গুনে সবদিকেই পারদর্শী। অথচ স্বামীই বুঝলো না। মেঘ নাকি ফিরে এসেছে, ও কি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার ফিরে এসেছে। যে অপেক্ষায় মেয়েটা এতবছর এই বাড়িতে পড়ে রইলো,সেই অপেক্ষা কি শেষ করে দিতেই তাঁর ফিরে আসা। না আর ভাবতে পারলো না,মাথাটা ঝিমিয়ে উঠলো। তখন মনে হলো কেউ তাঁর কাঁধে হাত দিয়েছে। পিছনে তাকাতেই মেঘের হাসি মুখটা দেখলো। ছেলেটার এই হাসিই তো সবাইকে পাগল করে দেয়। কত ভালো ছেলেটা এভাবে বিগড়ে গেছে। তাহলে কি তাঁর মানুষ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে? হয়তো হয়েছে, না হলে তাঁর ভাইয়ের রক্ত যাঁর শরীরে সে অন্তত কারো সাথে বেঈমানী করতে পারে না।

_ কি ভাবছেন ছোট বাবা

হঠাৎ মেঘের কন্ঠে নিজেকে স্থীর করলো আলতাফ হোসেন। কিছু কথা নিজের মাঝে সাজিয়ে মেঘের উদ্দেশ্যে বলতে নিলে,হঠাৎ মেঘ তাঁর হাত জড়িয়ে নিজের মাঝে নিলেন।

_ যে ভুল আমি করেছি ছোট বাবা,আমি জানি তাঁর কোন ক্ষমা নেই। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি। আমি সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চাই ছোট বাবা। আপনি যদি আমায় ক্ষমা না করেন আমি কোন কাজেই সফল হবো না। তাই দয়া করে আমায় মাফ করে দিন।

নিজের চিন্তার উল্টোটা শুনতেই আলতাফ হোসেনের চোখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। তাহলে তিনি যা ভেবেছেন তা করতে মেঘ আসেনি। সে এসেছে সব ঠিক করতে। উফফ ইচ্ছে করলো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিতে! কিন্তু না এখনই তাঁকে বুঝতে দেওয়া যাবে না, সে মেঘের সিদ্ধান্তে খুশি। নিজেকে সামলে বললেন–

_ আমার কথা তুমি অমান্য করেছো,এতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাঁর সাথে তুমি অন্যায় করেছো,তাঁকে মানিয়ে নিতে পারলেই আমি খুশি। তাই আমার কাছে মাফ না চেয়ে তাঁর কাছে চাও।

_ ও হো ছোট বাবা শোন!

_ কি

_ আরে একটু কাছে আসো

আলতাফ হোসেন একটু এগিয়ে এলো মেঘের কাছে।

_ আরে কানে কানে বলতে হবে এগিয়ে আসো।

আলতাফ হোসেন খুব সিরিয়াস ভেবে সত্যি সত্যি মেঘের খুব কাছে এগিয়ে এলো,এবং কানটা তুলে ধরলো মেঘের মুখের সামনে। মেঘ তাঁর ছোট বাবা-র কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো–

_ অনেক দিন তো হলো নতুন কেউ এই বাড়িতে আসেনি,চিন্তা করো না এক বছরের মধ্যেই নতুন কাউকে এই বাড়িতে আনবো।

কথাটা বলেই মেঘ সামনের চেয়ারে বসলো। আলতাফ হোসেন মেঘের কথাটা বুঝতে না পেরে মেঘের দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু যখন মেঘের কথার মানে বুঝলো,তখন চোখ মোটা করে হাতের খবরের কাগজ মেঘের দিকে ছুড়ে মারলেন। মেঘ খপ করে কাগজটা ধরে ফেলে বললো–

_ তুমি খুশি হওনি। চিন্তা করো না,সবাই তোমাকে নাতি উপহার দিয়েছে, আমি নাতনি উপহার দিবো। কথাটা বলেই মেঘ চোখ মারলো।

আলতাফ হোসেন রেগেমেগে ছুটে গেলেন মেঘের কাছে। ছোট বাবাকে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে মেঘ দিলো ভোঁ দৌড়। পুরো ড্রইংরুম জুড়ে তাঁরা দু’জন ছোটাছুটি করতে রইলো। তাঁদের এই ছেলেমানুষী দেখে বাড়ির সবাই আনন্দে বিমোহিত হলো। এটারি বুঝি অভাব ছিলো এত বছর এই বাড়িতে। তবে কি শুরু হতে চলছে নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায়টা শুধু তুমিময়।

চলবে,,

ইনশাআল্লাহ চলবে….