অনপেখিত পর্ব-১৫

0
129

#অনপেখিত
পর্ব ১৫
লিখা: Sidratul Muntaz

উর্মি মেহেকের কাছে এসে তার একহাত ধরে টেনে খিটখিটে গলায় বলতে লাগল,” আপা, এইদিকে আসেন। গরমের মধ্যে এইখানে দাঁড়ায় কি করেন? আমার সাথে বিছানায় গিয়া শুয়া থাকবেন, চলেন। আপনার শরীরটাও তো ভালো না।”

মেহেককে অসহায়ের মতো মুখ করে উর্মির সাথে চলে যেতে হচ্ছিল। একবার মন চাইল উর্মিকে ধমক মেরে বলতে,” আমি যদি গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি তাহলে তোর সমস্যা কি? আর এই ভোরবেলা টইটই করে সারাবাড়ি ঘুরছিস কেন তুই? ঘুম নেই? ভেলকি জানি একটা!”

কিন্তু মেহেক বলতে পারল না কিছু। একটু আগে উর্মির জন্যই মেহেকের জীবনের অনেক বড় একটি ফাঁড়া কেটেছে। তাছাড়া এই ছোট্ট মেয়েটি যে তাকে অনেক ভালোবাসে এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে উর্মির সাথে চলে যায় মেহেক। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে ফারদিনের দিকে তাকিয়েছিল সে। ফারদিনও তাকিয়ে ছিল তার দিকেই। মেহেক ফারদিনের চোখ দু’টি দেখে বুঝেই ফেলল, সেই দৃষ্টিতে সুক্ষ্ম আক্ষেপ লেগে আছে। আরও লেগে আছে তীব্র ব্যাকুলতাপূর্ণ এক তৃষ্ণা!

উর্মির সাথে রুমে এসে বসতেই হঠাৎ হোসনেয়ারা চাচী হাজির হলেন। তাঁর চোখ-মুখ কি অস্থির! যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। মেহেকের দুই বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন,” তুমি নাকি শরীরে আগুন দিছিলা?”

মেহেক থতমত খেয়ে গেল। হোসনেয়ারা চাচী জিহ্বা কামড়ে বিলাপ শুরু করলেন,” ও আল্লাহ,ও আল্লাহ! কি সাহস তোমার মাইয়া! যদি কোনো সর্বনাশ হয়া যাইতো? আমার মাইয়া হইলে এতোক্ষণে ধইরা ছেঁচতাম তোমারে আমি। এমন বেকুবের মতো কাম কেউ করে? আইচ্ছা ক্যান করছো? জামাইয়ের লগে ঝগড়া কইরা এমন করছো নাকি? ”

মেহেক ইতস্তত বোধ করে বলল,” তেমন কিছু না।তাছাড়া আমি এখন ঠিকাছি চাচী। ভয়ের কিছু হয়নি।”

মেহেক আলোচনা শেষ করার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছিল। হোসনেয়ারা চাচী বুকে হাত দিয়ে প্রলাপ বকে যেতে লাগলেন।

” এসব ভালো না বুঝছো মাইয়া! আমি তো কিছুই জানতাম না। উর্মি যখন আমারে আইসা এই কথা কইলো আমি তখন মাত্র ঘুম থেকা উঠসি৷ শুইন্নাই আমার বুক ধড়ফড়ানি শুরু হইসে। দৌড়ায়া যে আমি কেমন আইসি সেটা খালি আমিই জানি। এখনও আমার বুকটা কাঁপতেছে। তোমার ডর লাগে নাই? আমারই মাথা ঘুরাইতাছে। কেমনে যে করো তোমরা এইসব?অবশ্য অল্পবয়সী মাইয়াগো আবেগ থাকে বেশি৷ তারা সব করতে পারে। আমাগো গ্রামেই তো একজন ছিল। আমগাছে উইঠা গলায় ফাঁস লাগাইতে গেছিল। দেখো কিরুম সাহস…”

হোসনেয়ারা চাচী গল্প করেই যাচ্ছেন। মেহেক অস্থিরবোধ করছিল। চাচীর এই একটা খারাপ স্বভাব। যেকোনো বিষয় নিয়ে ওভার রিয়েক্ট শুরু করেন। এজন্য তাকে কেউ কিছু বলতে চায় না। উর্মি যে কোন আক্কেলে চাচীকে বলতে গেল! এখন টানা একঘণ্টা বকবক শুনতে হবে। মেহেক মাথা নিচু করে মুখে আগলা হাসি রেখে কথা শুনে যাচ্ছিল। একটু পর ফারদিন ভেতরে প্রবেশ করল। সাথে সাথেই চাচী মাথায় ঘোমটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

তিনি আবার ফারদিনকে দেখলেই লজ্জায় কেমন যেন করেন! সামনে দাঁড়াতে চান না। এবারও দাঁড়ালেন না। উর্মিকে সাথে নিয়েই দ্রুত চলে গেলেন ঘর থেকে। মেহেক যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচল। আরেকটু হলেই মাথা ধরে যেতো তার। ফারদিন মেহেকের দিকে চেয়ে মুচকি একবার হাসল। তারপর খাবারের প্লেটটা নিয়ে খাটের সাথে লাগোয়া ছোট্ট টেবিলের উপর রাখল।

মেহেক তাকিয়ে দেখল, খুব সুন্দর করে খাবারের উপর ডেকোরেশন করা হয়েছে। একটা টমেটোর টুকরো ডিজাইন করে ডিমের উপর রাখা। ডিমের ভেতরে পাউরুটির পুর। অদ্ভুত রেসিপি তো! এবার খেতে কেমন হয় সেটাই দেখার পালা। ফারদিন বলল,” নাও টেস্ট করো। তারপর রেটিং দাও।”

মেহেক হেসে বলল,” দেখেই রেটিং দিয়ে দিলাম। দশে দশ!”

ফারদিন ভ্রু কুঁচকালো,” কেন? খেতে ভয় পাচ্ছো নাকি? ভাবছো এমন অখাদ্য মুখে তোলার চেয়ে ভালো আগে-ভাগেই দশে-দশ বলে দিই? ”

” আরে না, না, তা কেন হবে? আপনি শুধু শুধুই উল্টা ভাবছেন। আমি তো আপনার প্রেজেন্টেশনের প্রশংসা করতে কথাটা বলেছি। খাবো না সেটা তো একবারও বলিনি। তাছাড়া যে জিনিস আপনি হাত কেটে আমার জন্য রান্না করেছেন সেটা কি আমার কাছে অখাদ্য হতে পারে? এটা যেমনই হোক, আমার কাছে অবশ্যই অমৃত!”

” সত্যি?”

” হুম।”

” তাহলে দরজাটা বন্ধ করে আসি?”

মেহেক ভ্রু কুঁচকালো। খাবার খাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে হবে কেন? একটু পরেই দরজা বন্ধ করার কারণ সম্পর্কে অবগত হলো সে। ফারদিন খুব শান্তভাবেই তার পাশে এসে বসলো। তারপর আচমকাই দু’হাতে মেহেকের গাল চেপে ধরে ঠোঁটে গাঢ় স্পর্শটা দিয়ে ফেলল। যে স্পর্শ পেতে একটু আগেও মেহেক আকুল অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন আক্রমণে সে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল। কারণ এখন সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগে যেন এক ভয়ংকর অনুভূতির তীক্ষ্ণ আবেশ তাকে চারিপাশ থেকে জাপটে ধরল।

মেহেকের কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে কোনো সুখ সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। এমন ভালোলাগা আগে কখনও অনুভব করেনি সে। এতোটা মায়া, যত্ন, সুখানুভূতি, আদরমাখা মোহনীয় স্পর্শ যেন মেহেকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ তুলে দিচ্ছিল। ভালোবাসার স্পর্শ বুঝি এমনই হয়! মেহেকের জন্য পুরো পৃথিবীটা এখন নতুন। অনুভূতিগুলো একদম নতুন! ভীষণ তাজা! যেন সে মাত্র জন্ম নিয়েছে। কিন্তু আগের জন্মের সেই জরাজীর্ণ বিছরি স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই ডুঁকরে কেঁদে ফেলল সে। সত্যিই কি এতো ভালোবাসার যোগ্য সে? না, নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। কলঙ্কিনী হওয়ার এই হীনমন্যতা তাকে ভেতর থেকে যেন সম্পূর্ণ খুঁড়ে খেয়ে নিচ্ছে। মেহেকের কান্না দেখে ফারদিন স্তব্ধ হয়ে গেল। অদ্ভুত, মেয়েটা কেন কাঁদছে? ফারদিন ভয় পেয়ে গেল। সে কি তাহলে ভুল করেছে? মেহেক কি তার আচরণে আবার কষ্ট পেয়েছে?

অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ফারদিন,” কি হয়েছে মেহেক?”

মেহেক দুইহাতে চোখের জল মুছল। ফারদিন অপরাধে ক্লিষ্ট হয়ে বলল,” স্যরি। আমার হঠাৎ করে এটা করা উচিৎ হয়নি। তোমার কি খারাপ লেগেছে?”

ইশশ, ফারদিনের আদুরে প্রশ্নে মেহেকের আরও কান্না পাচ্ছিল। এইভাবে কেউ কখনও তার কাছে জানতে চায়নি, তার খারাপ লেগেছে কিনা! মেহেক নিজেকে সামলাতেই পারছিল না। কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল। খট করে দরজা আটকে দিল। ওর এহেন আচরণে ফারদিন অবাক! নিজেকে অত্যাচারী মনে হলো তার। অপরাধে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

মেহেক শুকনো টাইলসের মেঝেতে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগল। তার জীবনটা হঠাৎ এতো বেশি আলোকিত হয়ে যাচ্ছে কেন? আর এতো আলোর মাঝেও সে কেন কালো আঁধারের স্মৃতিগুলো ভুলতে পারছে না! কেন!

মেহেক কান্না-টান্না মুছে অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে বের হলো। এখন আর আগের মতো খারাপ লাগছে না তার। কি দরকার পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে কষ্ট পাওয়ার? খারাপ স্মৃতি মনে রাখতে নেই৷ তাই মেহেক ঠিক করেছে এখন থেকে আর ওইসব মনে রাখবে না।

বর্তমান নিয়েই সে এখন অনেক সুখী, বিজয়ী। তাহলে খারাপ অতীতের কাছে কেন নিজেকে পরাজিত করবে সে? কখনও করবে না। মেহেক বেরিয়েই দেখলো ফারদিন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পকেটে একহাত রেখে দেয়ালের সাথে এক হাত ঠেঁকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছে।

মেহেক মনে মনে বলল,” আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ! ”

সে গিয়ে বিছানায় বসলো। খাবারটা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে! আর মেহেক খেয়ালও করেনি,ফারদিন চা-ও বানিয়ে এনেছে। এইটা নিশ্চিত এতোক্ষণে সরবত হয়ে গেছে। মেহেক আগে ডিম থেকে টুকরো মুখে দিল। আর দারুণ একটা চমক পেল। খাবারটা এতো মজা হয়েছে!যে জীবনে কখনও রান্না করেনি তার পক্ষে এতো ভালো খাবার বানিয়ে ফেলা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি ফারদিনের কথাটাই সত্যি? ‘ Nothing is impossible in love!’

মেহেক নিজের মনেই হাসল। ফারদিনের দিকে চেয়ে বলল,” বাহ, ভালোই রান্না করেন আপনি। দারুণ হয়েছে এটা।”

ফারদিন মনখারাপের চোখে তাকাল একবার। এরপর পুনরায় জানালার দিকে চেয়ে বলল,” তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?”

মেহেকের হাস্যজ্বল চেহারাটা মুহুর্তেই নিভে গেল। নিচু গলায় বলল,” এমনি।”

” এমনি না। তুমি কেন কেঁদেছো আমাকে জানতে হবে। বলো!”

মেহেকের আবার ওই বিষয়ে কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে। সে বার-বার ফারদিনকে মনে করাতে চায় না যে সে একজন কলংকিনী! এতে যেমন ফারদিনের কষ্ট, তার নিজের আরও বেশি কষ্ট। মেহেক বলল,” আম্মা-আব্বার কথা মনে পড়েছিল।”

” আমি তোমাকে চুমু দিলাম আর তোমার আম্মা-আব্বার কথা মনে পড়ে গেল? আশ্চর্য! ”

মেহেক এই কথার উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারল না। অপ্রতিভ স্বরে বলল,” কি জানি? হঠাৎ মনে পড়লে আমি কি করবো?”

মেহেকের কণ্ঠটা ভীষণ অসহায় শোনাল। ফারদিন স্বাভাবিক হয়ে বলল,” আচ্ছা এদিকে এসো?”

মেহেক এগিয়ে গেল জানালার কাছে। ফারদিন মেহেকের বাহু স্পর্শ করে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালো। তারপর পেছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে মেহেকের মাথায় চিবুক ঠেঁকিয়ে বলল,” চলো কালকে যাবো তোমাদের গ্রামে।”

মেহেক সাথে সাথে ফারদিকের দিকে ঘুরে তাকাল। চাপা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,” সত্যি বলছেন?”

” হুম।”

” কালকে?”

” তুমি কি আজকে যেতে চাও? তাহলে আজকেই চলো।”

” না, না, কালকেই। সকাল সকাল রওনা হবো।”

ফারদিন মিষ্টি করে হেসে বলল,” ঠিকাছে।”

মেহেকের এতো আনন্দ লাগছিল! কতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে। ছোট খালামণিকেও ফোন করে তাদের বাড়ি আসতে বললে কেমন হয়? ছোট খালামণি আবার ফারদিনকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। বিয়েটা তো খুব তাড়াহুড়ায় হয়েছিল৷ তাও মেহেকের গ্রামে হয়নি। ফারদিনদের বাড়িতে ছোট্ট করে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। আব্বা খুব গোপনে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে মেহেকের শ্বশুরবাড়ির কেউ তার অতীত সম্পর্কে জানতে না পারে।

আর এখন তো ফারদিন সব জানে৷ তাই তাকে গ্রামে নিয়ে যেতেও কোনো অসুবিধা নেই। মেহেকের ভাবতেই ভালো লাগছে। এখন থেকে আর কোনো লুকোচুরি থাকবে না তাদের মধ্যে। ফারদিন বলল,” বৃষ্টিটা তোমার মতো।”

” মানে? বৃষ্টি কে?”

মেহেক অবাক হয়ে জানতে চাইল। ফারদিন হেসে তাকাল। ওইসময় তাকে এতো সুন্দর দেখাল! ফারদিন হাসলে তার চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। অসম্ভব সুন্দর লাগে! তাছাড়া যারা খুব কম হাসে তাদের হাসিতে এমনিতেও একটা আলাদা অসাধারণত্ব থাকে। ফারদিনের হাসিতেও আছে।

ফারদিন বলল,” আমি বাহিরে যে বৃষ্টি হচ্ছে সেই বৃষ্টির কথা বলছি। দেখো, কি এলোমেলো আর চঞ্চল! মনে হচ্ছে যেন কোনো চঞ্চলা কিশোরী নুপুর পায়ে দিয়ে মেঠোপথে নেচে বেড়াচ্ছে। কি যেন গানটা? আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কোন রূপসী হেঁটে যায়। আমি এখানে মেহেক রূপসীকে দেখছি।”

মেহেকের ঠোঁটে আহ্লাদী হাসি ফুটে উঠলো। জানালায় তাকিয়ে দু’জনই বৃষ্টি দেখছিল। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের মাঝে বৃষ্টির এই ছন্দময় নৃত্য কি চমৎকার লাগে। মেহেক হঠাৎ ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিল। তারপর আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে বিছানায় গিয়ে গাঁয়ে কাঁথা নিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ফারদিন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রইল। তার বুকের হার্টবিট বেড়ে গেছে। খুব ঝকঝকে একটা অনুভূতি হচ্ছে। কি আশ্চর্য! কিছুদিন আগেও যে মেয়েটির বাচ্চামি দেখে বিরক্তিতে দীর্ঘশ্বাস আসতো এখন সেই মেয়েটির হালকা একটু চঞ্চলতাই ফারদিনকে এলোমেলো করার জন্য যথেষ্ট! ভাবতেই অবাক লাগে, এই মেয়েটিকে সে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস সেই ভুলটা করেনি। নয়তো সারাজীবন আক্ষেপ করতে হতো। সে কোথায় পেতো এই ভালোবাসা? এই মায়াবী,আহ্লাদী,চঞ্চলা মেয়েটিকে কোথায় পেতো?

ফারদিন বিছানায় গিয়ে মেহেকের পাশে শুয়ে তাকে পেছন থেকে নরম করে জড়িয়ে ধরল। মেহেক চোখ বন্ধ করে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। ফারদিন মেহেকের চুলে নাক ঘষছিল। কি মিষ্টি একটা সুভাষ! এই সুভাষ আগেও পেয়েছে সে। কিন্তু তখন এতো ভালো লাগেনি তো! ফারদিন মেহেকের কানের কাছে ঠোঁট রেখে আবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” মেহেক, আই লভ ইউ।”

মেহেক বিছানার চাদর খামচে ধরল। চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পরিতুষ্ট কণ্ঠে সে বলল,” আমার একটা কথা রাখবেন?”

” বলো।”

ফারদিনের কণ্ঠে ঘোর। মেহেক বলল,” প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ঠিক এভাবেই আমাকে আই লভ ইউ বলতে হবে। নাহলে আমি ঘুমাবো না।”

ফারদিন হেসে ফেলল। মুখ তুলে মেহেকের দিকে তাকিয়ে তার কপালের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলল,” ঠিকাছে পিচ্চি, বলবো।”

মেহেক লজ্জা পেয়ে গেল। ধূর, এইটা কেমন আবদার করেছে সে? আবেগে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যা মনে এসেছিল তাই বলে ফেলেছিল। এখন খুব লজ্জা লাগছে। মেহেক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” সারারাত ঘুমাইনি। এখন আমার ঘুম আসছে।”

” ঠিকাছে ঘুমাও। আমি কি কপালে একটা চুমু দিবো?”

” যদি নিষেধ করি তাহলে কি দিবেন না?”

” দিবো”

” তাহলে নিষেধ করলাম। ”
ফারদিন হেসে মেহেকের কপালে চুমু দিল ছোট্ট করে। মেহেক ফারদিনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ রেখে বলল,” আমি এভাবেই ঘুমাবো। একদম নড়বেন না কিন্তু।”

ফারদিন মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ঠিকাছে প্রমিস করলাম। একটুও নড়বো না।”

মেয়েটা কয়েক মুহুর্তেই ঘুমিয়ে গেল। আর ফারদিন চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিল তাদের বিবাহিত জীবনের সূচনার কথা। একদম প্রথম যখন মেহেককে দেখেছিল সে। কত ছোট্ট একটা মেয়ে মনে হয়েছিল। বাসররাতে যখন জানতে পারল মেহেকের বয়স ষোল, তখন কি রাগটাই না উঠেছিল দাদুর উপর। দাদু কি ঠিক করে খোঁজটাও নিতে পারেনি? মেয়ের আসল বয়সটাও জানতে পারেনি? নাকি ইচ্ছে করে মিথ্যে বলেছিল?

অপরিণত বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিজেকে ভয়ংকর অপরাধী মনে হতো ফারদিনের। তারপর যখন সুজি এলো, শুরু হলো তার অভিমান, কান্নাকাটি, পাগলামী! বন্ধুরা পর্যন্ত ফারদিনকে দোষারোপ করছিল। তখন ফারদিনের মনে হচ্ছিল, সে দু’টো জীবন একসাথে নষ্ট করছে। সুজানার জীবনটা যেমন তার জন্য নষ্ট হলো তেমনি মেহেকের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছিল। না চাইতেও মেহেককে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল সে।

এসব ভাবলেও এখন নিজের প্রতি বিরক্ত হয় ফারদিন। আচ্ছা, মেহেকের তো ক্লাস এইটের পর আর পড়ালেখা হয়নি। ফারদিনের উচিৎ তাকে আবারও লেখা-পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা। নাহলে ভবিষ্যতে এটা নিয়ে মেহেকের খুব আফসোস হবে। ফারদিন মেহেককে সেই আফসোসটা করতে দিবে না। মোবাইল বেজে উঠলো। ফারদিনের মা আমেরিকা থেকে ফোন করেছেন।

এখন কথা বলতে গেলে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যেতে হবে। নাহলে নেটওয়ার্কের ঝামেলার কারণে কথা বলা যাবে না। কিন্তু মেহেক তো তার বুকের উপর ঘুমাচ্ছে। এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। ফারদিন একবার ভাবল মেহেকের মাথাটা আস্তে করে তুলে বালিশে রেখে সে উঠে যাবে। কিন্তু ফারদিন তো প্রমিস করেছিল, সে নড়বে না।পরে যদি মেহেক জেগে দেখে ফারদিন পাশে নেই তখন কি কষ্ট পাবে? আসলে এই ছোট্ট মেয়েটা তার অল্প পরিসরের জীবনে এতো বেশি কষ্ট পেয়েছে যে তাকে আর একফোঁটাও কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। ফারদিন তার মায়ের ফোন কেটে দিল।

চলবে