#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
তপ্ত দুপুরের তাপদাহে ঘেমেনেয়ে একাকার শরীর। স্যাঁতস্যাঁতে শরীরের সাথে শুভ্র রঙা শার্ট লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্টে। ক্লান্ত মাহমুদের চোখেমুখে বিরক্তি ঝরে পড়ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখজোড়া মলিন দেখাচ্ছে। গলা বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে ঘামের বিন্দুকণা। চুলের ভাঁজে বার কয়েক আঙ্গুল চালিয়ে পেছন দিকে ঠে*লে দিলো। এদিকওদিক চোখ ঘুরিয়ে রিকশা খুঁজলো। যখন তরী পাশে থাকে, কেবল তখনই সিএনজি নেয়। আশেপাশের মানুষকে খুব পরোয়া করে মেয়েটা। প্রচন্ড সংকোচ তার।
কলেজের কাছাকাছি সেই লাইব্রেরিতে গিয়ে দাঁড়ালো মাহমুদ। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে চোখ রেখে হুমায়ুন আহমেদ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কয়েকটি বই নিলো। তরী বই পড়তে ভালোবাসে। বইগুলো তার জন্যই নেয়া।
বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। আরও একটা জিনিস কিনলো। রিকশা ডেকে একেবারে বাসার সামনে এসে নামলো। আগামীকালই হলুদ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হবে। গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই তরীর বারান্দায় তাকালো মাহমুদ। চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। মেয়েটা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মাহমুদ স্পষ্ট তার লজ্জা টের পাচ্ছে। প্রথমদিকে তরী লজ্জা পেলে মাহমুদের বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হতো ব্যাপারটা। ধীরে ধীরে তা সেটা চূড়ান্ত ভালোলাগায় পরিণত হলো। যেন এই লজ্জা না পেলে তরীকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। কোথাও একটা কমতি থেকে যায়। ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো মাহমুদ। অতঃপর বাসার ভেতরে চলে গেল।
বিকেলেই তরীর ডাক পড়লো তিনতলায়। আয়েশা সুলতানা ডেকেছেন।
-“জামাকাপড় গুছিয়ে নিও তাড়াতাড়ি। আমরা কাল সকালেই বের হবো।”
তরী ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
-“সকালে উনি কিভাবে যাবেন? ক্লাস আছে না?”
আয়েশা সুলতানা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-“কার কথা বলছো।”
তরীর হুট করেই গরম লাগতে শুরু করলো। সে কখনো সরাসরি মাহমুদের নাম ধরে ডাকেনি। ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। নামটি উচ্চারণ করতে তার ভেতর জড়তা কাজ করছে। সংকোচ করে বলল,
-“মানে রামির ভাইয়ার কথা বলছিলাম।”
আয়েশা সুলতানা বেশ শব্দ করে হাসলেন।
-“মাহমুদের কথা বলছো? সে বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়েছে। শুক্র, শনি এমনিতেই সরকারি ছুটি থাকবে।”
-“ওহ।”
তরীর গলার স্বর পেয়ে মাহমুদ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার বিপরীতে সোফায় বসলো। তরী আড়চোখে মাহমুদকে তাকিয়ে দেখছে। তার বুক ধড়ফড় করেছে। মাহমুদ ব্যাপারটি লক্ষ করেই মিটিমিটি হাসছে। গভীর স্বরে ডাকলো,
-“তরী!”
চমকে উঠলো তরী। চমক কাটতেই লজ্জা পেল সে। কান গরম হয়ে উঠছে। মানুষটি কি দেখে ফেললো সবটা? থতমত খেয়ে জবাব দিলো,
-“জি।”
-“ছাদে যাবেন?”
-“এখন?”
-“হুম। সমস্যা হবে?”
তরী তড়িঘড়ি করে বলল,
-“না না। সমস্যা হতে যাবে কেন?”
মাহমুদ হাসলো। তরী ফের লুকিয়ে দেখলো। হাসলে চমৎকার লাগে মাহমুদকে। তরী মুগ্ধ হয়। তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। মাহমুদ ঘরের দিকে যেতে যেতেই বলে,
-“ছাদে গেলেও দেখতে পারবেন, তরী। আমি বাঁধা দিচ্ছি না তো।”
তরী চোখমুখ খিঁচে উঠে পড়লো। আয়েশা সুলতানাকে ডেকে বলে গেল,
-“আন্টি আমি যাচ্ছি।”
বাসায় না গিয়ে ছাদে উঠলো তরী। অরু দাঁড়িয়ে ফুল দেখছে। ফুল তার ভীষণ পছন্দের হলেও কখনো ছিঁড়ে ফেলেনা অরু। বরং কেউ যখন গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে, অরু তখন তাকে খুব বকা দেয়।
মাহমুদ আসলো কিছুক্ষণ পর। হাতে একগাদা বই। তরী কৌতুহলী চোখে বইগুলো দেখছে। মাহমুদ তরীর দিকে বই বাড়িয়ে দিলো,
-“এগুলো আপনার জন্য।”
তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমার জন্য? এতগুলো বই?”
মাহমুদ মৃদু হাসলো।
তরীর ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি। কৃতজ্ঞতা সূচক হেসে বলল,
-“ধন্যবাদ।”
মাহমুদ রুষ্ট হলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
-“ধন্যবাদ দেওয়া আমার পছন্দ হয়নি, তরী।”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মেয়েটির মায়া মায়া চেহারা। এই যে তার দিকে টানাটানা চোখে তাকিয়ে আছে? লুকিয়েচুরিয়ে তাকে দেখে? মাহমুদের ভীষণ ভালোলাগে। একটু কাছে ঝুঁকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
-“নিজের মানুষকে কখনো ধন্যবাদ দিতে নেই, তরী।”
তরীর হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে মনে বার দুয়েক আওড়ালো “নিজের মানুষ!”
তরী টের পেলো সে সত্যিই প্রেমে পড়েছে। আকাশ-পাতাল এক করা প্রেম। অবাধ্য হলো মন। বুক কেঁপে কেঁপে উঠলো। হুট করেই তার কেমন কান্না পাচ্ছে। এমনিতেও সে ভীষণ আবেগি একটি মেয়ে। এখন যেন আরও আবেগি হয়ে পড়ছে। খুশিতে নাকি দুঃখে বুঝতে পারছেনা। কেন সে প্রেমে পড়তে গেল? সে তো প্রেম নামক আজব জিনিসকে নিমন্ত্রণ জানায়নি! তবুও দিন শেষে সে তলিয়ে গেল। সমু্দ্রের জলের মতো জোয়ার-ভাটা হলো বুকের ভেতর।
মাহমুদ অপলক অশান্ত মেয়েটিকে দেখছে। হাত বাড়িয়ে কানের পাশের চুল সরিয়ে দিতেই তরী থমকে গেল। হৃৎপিণ্ড যেন তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর।
অরু সেই কখন থেকেই ফুল দেখা বাদ দিয়ে কোমরে হাত রেখে ধারালো নজরে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো,
-“তোমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে প্রেম করছো?”
তরী ভয়ে সিটকে গেল দু-কদম। চোখেমুখে রাজ্যের ভয়। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একবার অরু আর একবার মাহমুদকে দেখছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। অথচ মানুষটি কতটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। চোখেমুখে আতঙ্কের চিহ্নটুকু নেই। অরু চোখের নজর আরেকটু তীক্ষ্ণ করে গম্ভীর স্বরে কথা বলার চেষ্টা করলো। শাসনের সুরে বলল,
-“কী হলো? কথা বলছো না কেন? তোমরা কি প্রেম করছিলে? এত বড় সাহস তোমাদের!”
মাহমুদ মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তোমার কেন মনে হলো আমরা প্রেম করছি?”
অরু গাল ফুলিয়ে বলল,
-“আমিতো কার্টুনে দেখেছি। রাজকুমার রাজকুমারীর পাশে এসে দাঁড়ালেই তাদের প্রেম হয়ে যায়।”
মাহমুদ ঠোঁট টিপে হাসলো। অরুর মতোই ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-“আমাদের দেখে কি রাজকুমার আর রাজকুমারী মনে হচ্ছে?”
অরু দুপাশে মাথা দুলিয়ে জানালো,
-“না তো। তোমাদের তো মানুষের মতো লাগছে।”
-“এক্সাক্টলি, তাহলে তুমিই বলো আমরা কি প্রেম করছিলাম?”
অরু এবারও মাথা নেড়ে না জানালো।
মাহমুদ একটা ফুল ছিঁড়ে অরুর কানে গুঁজে দিতেই অরু চিৎকার করে উঠলো। এক মুহুর্তের জন্য মাহমুদ আতঙ্কিত চোখে তাকালো। অরু কানের পাশ থেকে ফুল নিয়েই গাল ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো।
-“তুমি পঁচা। একটুও ভালো না। আমাকে বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে চাও আবার আমার ফুল ছিঁড়ে ফেলো। একদম তোমার সাথে কথা বলবোনা। আমি বাবাকে বলে দেবো তোমাদের যেন বাসা থেকে বের করে দেয়।”
মাহমুদ হতবিহ্বল হয়ে গেল। একটা ফুল ছেঁড়াতে অরু এভাবে রিয়েক্ট করবে জানলে কখনোই ছিঁড়তোনা। মাহমুদ অরুকে কোলে তুলে নিলো। তাকে শান্ত করতেই আদুরে গলায় বলল,
-“সরি অরু! একহাতে কান ধরেছি দেখো। আমি তোমায় অনেকগুলো ফুলগাছ কিনে দেবো ঠিক আছে?”
অরু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মাহমুদের কথা না শুনেই বলল,
-“তোমাকে পাগল নজরুলের কাছে দিয়ে আসবো। সে তোমাকে খামছি দিয়ে ব্যথা দেবে। তুমি আমার ফুল ছিঁড়েছ কেন? আমি কষ্ট পেয়েছিনা!”
-“আমার অরুপাখি খুব কষ্ট পেয়েছে, তাইনা?
সরি তো! আর ফুল ছিঁড়বো না। কথা দিলাম।”
তরী ওদের দুজনকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। মাহমুদ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
-“খুব হাসি পাচ্ছে, তাইনা? ছোটো বোনকে সামলাতে এত কষ্ট, বড়োটাকে কিভাবে সামলাবো আমি?”
লজ্জায় আরক্তিম হলো গাল দুটো। তরী আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালোনা। বই নিয়ে দ্রুত কে*টে পড়লো। লোকটি তাকে লজ্জা দিতে ওস্তাদ। সে কি জ্বালায় নাকি মাহমুদকে?
অরুকে থামাতে না পেরে তাকে নিয়ে দোকানের দিকে রওনা হলো মাহমুদ। আপাতত চিপস-চকলেট দিয়েই শান্ত করতে হবে।
★★★
সকলেই তৈরি। আয়েশা সুলতানা তরীকে ডাকতে উপরে এলেন। মিঠু আগেই নেমে পড়েছে। বাবা তরীর সাথে সাথে নিচে নেমে এলো। মাহমুদ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলো এবার একটা গাড়ি কিনতে হবে।
তরীকে বসিয়ে দিয়ে বাবা বারবার করে আয়েশা সুলতানাকে বলে দিলেন,
-“আপনাদের কথা ফেলতে না পেরে ছেলেমেয়ে দুটোকে দিয়েছি। আপনার কাছে আমানত রাখলাম দুজনকে। আমার মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখবেন। বিয়ে বাড়িতে অনেক ছেলেপেলে থাকে।”
আয়েশা সুলতানা আশ্বস্ত করলেন।
-“আপনি চিন্তা করবেন না। তরীকে আমি নিজের মেয়ের মতো জানি। মায়ের সাথে মেয়ে নিরাপদ থাকবে।”
তরীর মা’ও তরীকে বলে দিলেন,
-“সবার সাথে সাথে থাকবি। পৌঁছে গিয়েই কল দিয়ে জানিয়ে দিবি।”
তরী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-“আসছি বাবা।”
অরু কান্না করছিল যাওয়ার জন্য। ছোটো বলেই তাকে বাবা-মা যেতে দিলেন না। আয়েশা সুলতানা অনেকবার বলেছেন,
-“অরুকেও আমাদের সাথে দিন।”
তরীর বাবা-মা দিলেন না। মা বললেন,
-“ছোটো মানুষ। রাতে কান্নাকাটি করে বিরক্ত করবে সবাইকে।”
হাইওয়ে ধরে গাড়ি চললো শাঁইশাঁই করে। জানালার পাশে বসা তরীর চুল উড়ছে অবিন্যস্তভাবে। চোখেমুখে মুগ্ধতা। বাইরের পরিবেশ বেশ এনজয় করছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মাহমুদ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে কেবল তরীকেই দেখে গেল। আজ রামির চোখে একটা বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হলো। ভাইয়া সেই প্রথম থেকেই তরী আপুকে দেখে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। কেমন অশান্ত, উন্মাদনা সেই দৃষ্টি।
#চলবে…….
#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম। রক্তিমা সূর্য বিদায় নিয়ে এক টুকরো চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে। শরৎ এর আগমনী বার্তা দিতেই কাশফুলের জন্ম। মরিচ বাতির ঝিকিমিকি আলোয় একঝাঁক হলুদ পাখি স্টেজের দিকে ছুটলো ডালা হাতে। ইরার বোন মিরার হলুদ অনুষ্ঠানে সবাই আজ হলুদ সাজে সেজেছে। হলুদ পাঞ্জাবি আঁটসাঁটভাবে গেঁথে আছে মাহমুদের শরীরে। শক্তপোক্ত পেটানো শরীরে দারুণভাবে রঙটি ফোটে উঠেছে। চমৎকার লাগছে তাকে। মাহমুদের আঁকাবাঁকা দৃষ্টি তরীকে খুঁজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।
রামি আর মিঠু গোয়েন্দা সংস্থার দুইজন ভাঙা অফিসার গোয়ান্দাগিরিতে লেগে পড়েছে। রামির নজর পড়ার সাথে সাথেই খোঁচা মে*রে সেটা মিঠুর কান, চোখ দুটো পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। দুজনে অভিযান চালিয়ে সকাল থেকেই একটা ব্যাপার মাথায় ভালোভাবে গেঁথে নিয়েছে। তা হলো মাহমুদ, তরী দুজনের মাঝেই প্রেম-ভালোবাসা জনিত কিছু একটা আছে। রামি দুঃখী গলায় বলল,
-“তোর বোন আমাকে ছ্যাকা দিলো রে মিঠু। একটা ফোনও নেই, যে বিরহের গান শুনে নিজেকে শেষ করে দেবো।”
মিঠুর মাথায় অন্য ধরনের চিন্তা। একটা ভাই বড়ো হোক কিংবা ছোটো। ভাইয়ের প্রেম জনিত ব্যাপার যতটা সহজভাবে নিতে পারে, বোনের ক্ষেত্রে ততটা সহজ তারা হতে পারেনা। মিঠুর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হচ্ছে। বাবা জানতে পারলে আপুর দিকে মুখ ফিরেও তাকাবেন না। বাবা যতটা আদর দিয়ে মাথায় তুলতে পারেন, ঠিক ততটা শাসন করে মাথা থেকে আঁচড়ে ফেলতেও পারেন। প্রচন্ড একরোখা মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি।
রামি খোঁচা দিলো মিঠুকে।
-“বেয়াই, ও বেয়াই, ও না হওয়া শা*লা।”
মিঠুর ঘোর কাটলো। গভীর চিন্তা জগৎ থেকে বেরিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে?”
রামি গান ধরলো,
”বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা,
কারা যে ডাকিল পিছে!
বসন্ত এসে গেছে।”
মিঠু ভুরু কুঁচকে তাকালো।
-“গন্ডমূর্খ। এখন শরৎকাল।”
-“ওহ। ভুলেই গিয়েছি। ”বলে আরেকটি গান ধরলো।
“হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলো রে…,
নেশা লাগিলো রে….,
বাঁকা দু-নয়নে নেশা লাগিলো রে।”
মিঠুর কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তাকে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো রামি। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে।
-“কিরে মিঠু! তোর দেখি কোন হেলদোল নেই। কী এত ভাবছিস? কিছু নিয়ে চিন্তিত!”
মিঠু নিজের চিন্তাভাবনা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো।
-“নাহ্, আমার আবার কিসের চিন্তা? চল আর কতক্ষণ এভাবে নজর রাখবি ওদের উপর?”
রামি মিঠুর সাথে গিয়ে চেয়ার টে*নে বসলো।
তরীর আগমন ঘটলো সব মেয়েদের পরে। আয়েশা সুলতানার সাথেই এসেছে। তিনি চোখে চোখে রাখছেন তরীকে। নিজ দায়িত্ব মেয়েটাকে নিয়ে এসেছেন। তাই কোনরূপ সমস্যা যেন না হয়, সেজন্যই বেশি বেশি খেয়াল রাখছেন। মাহমুদের দৃষ্টি অবিচল। হলুদ শাড়িতে মেয়েটিকে মাহমুদের চোখে অপ্সরা লাগছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার নিজেরই না নজর লেগে যায়। তরী এখনো মাহমুদকে দেখেনি।
একে একে সবাই মিরাকে হলুদ ছুঁইয়ে সরে গেল। উপস্থিত রইলো ছেলেমেয়েরা। নাচ-গানে মেতে উঠলো সকলে। আয়েশা সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,
-“আমার কোমর ব্যথা করছে। নিচে চলে যাচ্ছি। তুমি থাকবে এখানে?”
তরী ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
-“আপনি যখন নিচে চলে যাচ্ছেন, আমি ও চলে যাবো।”
ইরা বাঁধা দিলো আয়েশা সুলতানাকে।
-“থাক না মা। আপনি গিয়ে রেস্ট নিন। ছোটোরা সবাই এখানে। তরী আপনাদের বড়োদের ভীড়ে বোরিং ফিল করবে।”
-“আচ্ছা, তাহলে ওর দিকে খেয়াল রেখো।”
ইরা হাসতে হাসতে বলল,
-“কোন ছেলেপেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবো।”
তরী লজ্জা পেল ইরার কথায়।
কনের বড়োবোন হিসেবে ইরার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। তরীকে বসিয়ে রেখেই উঠে পড়লো সে।
এতক্ষণ যাবত সবটাই সাবধানী নজরে খেয়াল করেছে মাহমুদ।
তরীর মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দ হলো। উচ্চ আওয়াজের গান-বাজনার শব্দে টের পেলোনা তরী। মাহমুদ কখন থেকে অধীর আগ্রহে বসে আছে। তরী ফোন চেইক দিচ্ছে না। এবার কল দিলো।
ফোনের বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠা লক্ষ করে রিসিভ করলো তরী। মাহমুদের কথা স্পষ্ট শুনতে পারছেনা। মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো মাহমুদ আগেই পাঠিয়েছে,
❝ছাদের দিকটায় আসুন।❞
তরী উঠে পড়লো। স্টেজ ছেড়ে বাড়ির ভেতর দিকে প্রবেশ করলো। সিঁড়ির প্রথম ধাপ পার করতেই একটি শক্ত হাত এসে তার হাত আঁকড়ে ধরলো। ভয়ে শিউরে উঠলো তরী। পাশ ফিরে তাকাতেই মাহমুদকে দেখে স্বস্তি পেলো। মাহমুদ নরম স্বরে শুধালো,
-“ভয় পেয়েছেন, তরী?”
তরী অস্ফুট স্বরে বলল,
-“হুম।”
মাহমুদ তরীর হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে কোমল স্বরে বলল,
-“আমি আছি তো, তরী! একদম ভয় পাবেন না।”
তরী মাথানিচু করে মাহমুদের সাথে ছাদে পৌঁছে গেল। মনের গোপন কুঠুরিতে চলল তাদের অপ্রকাশিত প্রেম। ঘন আবেশিত সুর ভেসে আসছে নিচ থেকে। স্টেজ কাঁপিয়ে নেচে চলেছে তরুণ-তরুণী। মাহমুদ ডানহাত বাড়িয়ে দিলো তরীর দিকে। তরী হাত বাড়িয়ে দিতেই তার আঙ্গুল ছুঁয়ে ঘুরিয়ে নিলো কয়েক পাক। মরিচবাতির আলোয় ঘোর লাগা দৃষ্টিতে মাহমুদের চোখে চোখ রাখলো তরী। লজ্জা, ভয়, সংকোচ সবকিছুকে ছুটি দিয়ে আরেকটু কাছাকাছি হতে ইচ্ছে হলো৷ আবেগপ্রবণ তরী ভুলে গেল বাবার ভয়। নরম হাত ছুঁয়ে দিলো মাহমুদের খোঁচা খোঁচা দাড়িযুক্ত গাল। মাহমুদ নিজের গালে তরীর হাত চেপে ধরে চোখ বুজে নিলো। হুট করেই সংবিৎ ফিরে পেলো তরী। ঝট করেই হাত ছাড়িয়ে নিলো। বড্ড অস্থির হয়ে উঠলো মন। প্রচন্ড লজ্জাও লাগছে। দূরে সরে তড়িঘড়ি করে বলল,
-“আমি নিচে যাচ্ছি। মাথা ব্যথা করছে।”
মাহমুদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিথ্যে বলে নেমে পড়লো। চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। বিড়বিড় করে বলল,
-” খুব শীঘ্রই আমাদের মাঝের দূরত্ব ঘুচবে, তরী। আপনি শুধু আমার তরী হয়ে থাকবেন।”
★★★
মিরার বিয়ের কার্যক্রমের পর থেকেই মাহমুদ একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। তরী তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। আগে সামনে পড়লে মেয়েটা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতো। আজ যতবার সামনে পড়েছে, ততবারই চোখমুখ কঠিন ছিল। মাহমুদ যতবার তাকিয়েছে ততবারই তরীর দৃষ্টি নিচু ছিলো। একটিবারের জন্যেও তাকায়নি। মাহমুদের বুকের ভেতর বিষাদের ঢেউ বয়ে গেল। মনে করার চেষ্টা করলো সে কিছু করেছে কি-না! এমন কিছুই মনে পড়লোনা। বৈঠকখানায় আয়েশা সুলতানার সাথে উদাস হয়ে বসে আছে তরী। রামি, মিঠু দুজনই উপস্থিত। এখানে মায়ের সামনে ডাকা যাবেনা। তাই রামিকে ডাকলো। রামি অনেকক্ষণ ধরেই নজর রাখছিল মাহমুদের উপর। উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“ডেকে দেবো?”
-“হ্যাঁ।” বলেই মাহমুদ চমকে উঠলো।
-“কাকে ডেকে দিবি?”
রামি মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তরী আপুকে।”
মাহমুদ বিরক্তি গলায় বলল,
-“এভাবে হাসছিস কেন? প্রয়োজন আছে, ডেকে দে।”
রামি আবারও মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তোমার নৌকার মন খা*রা*পে*র কারণ কিন্তু আমি জানি।”
মাহমুদ এবার আর চমকালোনা। রামির চোখমুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তার গোয়ান্দাগিরি করে সব জানা শেষ। ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“কী জানিস তুই?”
-“এই যে, তরী আপু কেন মন খা*রা*প করে আছে!”
-“কেন?”
-“মা তোমার জন্য মেয়ে দেখছে। তরী আপুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে ‘দেখোতো তরী, মেয়েটাকে মাহমুদের সাথে দারুণ মানাবে, তাইনা?
ওই মেয়েটার খোঁজখবর ও নেওয়া শেষ। তখন থেকেই তোমার তরীর হাওয়া ফুস।”
মাহমুদ আর তরীকে ডাকার চেষ্টা করলোনা। মায়ের সাথে কথা বলা দরকার। তাই মাকে ডাকলো।
আয়েশা সুলতানা উঠে আসতেই মাহমুদ উনাকে একপাশে টে*নে নিয়ে গেল। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“রামি বলল তুমি নাকি এখানে এসে মেয়ে দেখছো আমার জন্য!”
-“হ্যাঁ, বিয়ে করতে হবে না তোর? মেয়েটাকে আমার ভীষণ মনে ধরেছে। তরীরও ভালো লেগেছে জিজ্ঞেস করে দেখ।”
মাহমুদ মনে মনে হাসলো মায়ের ওপর। সে সময় নিলোনা। সোজাসাপটা বলে দিলো,
-“মা আমার জন্য অন্য মেয়ে দেখা বাদ দাও। প্রস্তাব পাঠাতে হলে তরীর বাসায় পাঠাও।”
এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে চলে গেল মাহমুদ। আয়েশা সুলতানা স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আকস্মিক শক খেয়ে কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে।
নিস্তব্ধ রাত। ছাদের এককোনায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরী। তার কিছুই ভালো লাগছেনা। এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তিক্ত বিষাদে মন তেতো হয়ে উঠলো। চোখের কোনে অশ্রুকণার ভীড়। আয়েশা সুলতানার এক কথা, এই মেয়েটিকে তিনি বউ করেই ছাড়বেন। এবার যেভাবেই হোক ছেলেকে রাজি করাবেন। মাহমুদ নিশ্চয়ই মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নেবে। তরী হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলো। এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার?
★★★
পরদিনই বাড়িতে ফিরে এলো তরী। গতকাল থেকে একবারও মাহমুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। মাহমুদ ও আর জোর করেনি। পরে ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।
আয়েশা সুলতানা মাহমুদের ঘরে এসে বসলেন।
-“কিছু বলবে, মা?”
আয়েশা সুলতানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“হ্যাঁ। গতকাল তরীর কথা বলেছিলি কিছু একটা।
কিন্তু এটা কিছুতেই সম্ভব নয়!”
-“কেন?”
-“তরীর বাবা কখনোই মত দেবেন না। তিনি অন্যত্র কথা দিয়ে ফেলেছেন।”
চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো মাহমুদের। সে সহজে রাগ করতে চায় না। তবে আজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তরী তাকে কিছুই জানায়নি!
#চলবে………