#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
তরীদের বিল্ডিং এর সামনে দুটো মালবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তিনতলা থেকে মালপত্র সব টেনে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। মাহমুদ সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা তার তদারকি করছে। মাঝেমাঝেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেলছে। চারতলার ঝুল বারান্দায় টলমল চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তরী। কষ্ট হচ্ছে তার। চোখেমুখে লালচে আভা। বাবা ওদের বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা না বললেও পারতেন। পাশেই ছোট্ট অরু ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে তরীর কোমর আঁকড়ে ধরলো। সে গাল ফুলিয়ে রেখেছে। রাজ্যের মন খা*রা*প এসে ভীড় জমিয়েছে তার মনে। রামি আর মাহমুদ ভাইয়ার সাথে ভীষণ রাগ তার। একেবারে আড়ি। আর কথা বলবেনা। অরুর ও অভিমান হলো। তারা কেন এভাবে চলে যাচ্ছে? অরু ঝ*গ*ড়া করবে কার সাথে? বড়োদের মতো গম্ভীর স্বরে তরীকে বলল,
-“ পঁচা লোক ওরা। চলে যাক। আমরা আর কথা বলবো না আপু। তুমিও কথা বলবে না।”
তরীর কান্না ঠেলে আসছে। ঢোক গিলে কান্না রোধ করার চেষ্টা করলো। মাথা দুলিয়ে অরুর কথায় তাল মেলালো। হুট করেই অরু ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ফেললো। তরী চমকে উঠলো। অরুকে দু’হাতে কোলে তুলে নিয়ে আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমার অরুপাখি কাঁদছে কেন?”
অরু হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তরীর ঘাড়ের সাথে মাথা মিশিয়ে ছোট্ট নরম হাত দুটো তরীর গলা জড়িয়ে ধরলো। কান্না কান্না গলায় বলল,
-“ওরা যাচ্ছে কেন? পঁচা সবাই।”
তরীর মনটা আরও খা*রা*প হয়ে গেল। অরুর পিঠে হাত বুলিয়ে এটা-ওটা বলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিয়ে মাহমুদ ক্লান্ত হয়ে পড়লো। মলিন চোখে একবার চারতলার কাঙ্ক্ষিত বারান্দায় তাকালো। চোখজোড়া আটকে গেল তার। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।
মিঠু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রামি ম্লান হেসে তাকে কাছে ডাকলো। কয়েকমাসে দুজনের মাঝে গভীর এক বন্ধুত্বের জন্ম নিয়েছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে দুজনের কতশত পাগলামি, মা*রা*মা*রি, ঝ*গ*ড়া। মিঠু এগিয়ে এলো। আলতো হেসে বলল,
-“ভালো থাকিস।”
মিঠুর এমন অন্ধকার চেহারা ঠিক ভালো লাগলোনা রামির। এখানেও সে দুষ্টুমি শুরু করলো। মিঠুর পেটে গুতা মে*রে বলল,
-“জমিদারের কলিজা ইঁদুর কে*টে ফেলেছে নাকি? এখন থেকে তিনতলার ভাঁড়া হাত ফসকে যাবে, এই দুঃখে না জানি স্ট্রোক করে বসে।”
মিঠু নিস্তেজ। আজ আর রামির দুষ্টুমিতে তার হাসি পাচ্ছে না। বড্ড দুঃখ হচ্ছে তার। মনে হলো কেমন যেন একা হয়ে যাচ্ছে সে। রামি মৃদু হেসে বলল,
-“বোকা ছেলে। স্কুল তো চেঞ্জ করবো না। তখন দুজনের দেখা হবে।”
এতক্ষণে হাসলো মিঠু। রামির পিঠে কিল বসিয়ে বলল,
-“ভাগছিস না কেন, এখনো? আর কতদিন তোকে আশ্রয় দিয়ে উদার হবো? তাহলে তো আমার জমিদারি লাটে উঠবে।”
রামি হেসে ফেললো শব্দ করে। বুকে জড়িয়ে ধরলো মিঠুকে।
আয়েশা সুলতানা চারতলার বেল দিলেন। তরীর মা এসে দরজা খুলে দিতেই আয়েশা সুলতানা উনার কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
-“আসছি ভাবি। তরী আর অরু কোথায়?”
তরীর মা তরী আর অরুকে ডেকে উঠলেন। দুজন আসতেই আয়েশা সুলতানা ম্নান হেসে তাদের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে নেমে পড়লেন। তরীর বাবা বাসায় নেই। অরুকে কোলে নিয়ে পিঠে বাঁ হাত রাখায় মায়ের নজর পড়লো তরীর হাতে। ভুরু কুঁচকে গেল উনার। জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর রিং কই?”
তরী থমথমে মুখে জবাব দিলো,
-“গোসলের সময় জালে আটকে গিয়েছিল, তাই খুলে রেখেছি। তাছাড়া চুল বাঁধার সময়ও চুল পেঁচিয়ে টা*ন পড়ে।”
-“এমন ভাবে জবাব দিচ্ছিস কেন? বিয়ে ঠিক হয়েছে, রিং হাতে পরে থাকবি। ঘরে গিয়ে পরে নিস।”
তরী বিরক্তি ঝাড়লো মায়ের উপর।
-“সবসময় তোমরা যেভাবে বলবে সেভাবেই করতে হবে? আমার মর্জি বলতে কিছুই নেই?”
মা ধমকালেন,
-“তরী! তুই কী বলতে চাইছিস? সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এতোটা মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন আমাকে?”
অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো তরী। নরম স্বরে বলল,
-“খেলতে যা অরু। আপু এসে চকলেট দেবো।”
অরুর মন ভালো হয়ে গেল। আপুর কথা শুনে চলে গেল খেলতে। তরী ঠান্ডা গলায় বলতে বলতে ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে পড়লো,
-“আমি কী বলতে চাইছি, সেটা জানতে চাচ্ছো? আমার মতামতের কোন দাম আছে কি? আমার মতামত না নিয়ে বিয়ে ঠিক করলে, আমার মতামত না নিয়ে রিং পরাতে চলে এলো। অথচ আমি কিচ্ছু জানিনা। রিমোট কন্ট্রোল পুতুলের মতো সামনে বসিয়ে দিলে, রিং পরানো হয়ে গেল। আমি যদি তখন মুখ দিয়ে সামান্য কিছু উচ্চারণ করতাম, তখন শুনতে আমার কথা? বলোনা, শুনতে?
শুনতে না। বরং সেদিনই ধরে বিয়েটা করিয়ে দিতে। তখন যখন মতামত জানতে চাওনি, এখন যেনে কী হবে?”
তরীর কথায় বি*স্ফো*র*ণ ঘটলো যেন। মায়ের চোখের আকার স্বাভাবিকের তুলনায় বড়ো হয়ে এলো। হতবাক তিনি৷ ছোটোবেলা থেকেই মেয়েটা বাধ্যগত, ভীতু ধরনের। যে যা বলে, সেটাই মেনে নেয়। বাবার শাসন, সিদ্ধান্তে অভ্যস্ত মেয়েটা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত কী নেবে! কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে সেটা পর্যন্ত বাবার উপর ছেড়ে দিয়েছে। স্কুল, কলেজে থাকাকালীন শিক্ষাসফরে যাওয়ার অনুমতি না পেয়েও বিনা তর্কে বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। সবাই বলতো তরী কাঁচা মাটি। তাকে ইচ্ছে মতো গড়া যাবে। মিঠু হলো ত্যাড়া প্রকৃতির। সে নিজের স্বাধীনতা হাসিল করার জন্য বাবার সাথে না পেরে মাকে খোঁচাবে। বাবার হাতের মা*র তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। তার বড়ো চাচা ঘটা করেই একদিন ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখেন।
তরীর মা নিজেও স্বামীর সিদ্ধান্তের উপর কোন মতামত রাখেন না। মূলত উনার মতামতকে গ্রাহ্য করা হয়না। সেদিন তবুও তিনি ইনিয়েবিনিয়ে মেয়ের মতামত জানার কথা বলতেই এক কথায় উনাকে চুপ করিয়ে দিলেন তরীর বাবা।
-“তুমি মহিলা মানুষ সংসার সামলাবে। সিদ্ধান্তের কী বোঝ? তটিনী আমার মেয়ে, তার পেছনে পয়সা ঢালি আমি, তার জীবনে সিদ্ধান্ত আমি নেব না কে নেবে? তটিনীর আবার মতামত কী? ছোটো মানুষ এসবের কী বুঝবে? আমার মেয়ে কখনো আমার সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেনা।”
সেদিনই ঢোক গিলে ফেললেন তরীর মা। আজ যদি মেয়ে বেঁকে বসে, তবে সমস্ত দো*ষ উনার ঘাড়ে এসে পড়বে। এমনিতেও মেয়েরা কোন দো*ষ করলে তার দায়ভার মাকে নিতে হয়। বলা হয় ‘পুরুষমানুষ সারাদিন বাইরে থাকে আর টাকা ঢালে। মেয়েদের মানুষ করে মা। যেমন শিক্ষা দেবে, তেমনই তৈরি হবে। মা শিক্ষা দিতে পারেনি, দো*ষ তার।’
একটা প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানকে মা কী শেখাবে? সে জগৎ চিনে, মানুষ চিনে। মাকে সংসারের সবকিছু সামলাতে হয়। তিনি চাইলেই প্রতিটি সন্তানের পেছন পেছন লেগে থাকতে পারেন না। আতঙ্ক নিয়ে বললেন,
-“খবরদার তরী! তোর বাবার কানে যেন এসব না যায়।”
তরীর মোজাজ খা*রা*প হলো। গলা চড়িয়ে বলল,
-“বাবাকে আমি আজই নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে চাই। এতে আমাকে মা*রু*ক, কা*টু*ক যা ইচ্ছে তাই করুক। আমি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছিনা।”
মাকে পরোয়া না করেই ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিলো তরী। সবচেয়ে বেশি রা*গ হচ্ছে নিজের প্রতি। কেন সে চাইলেই সবাইকে নিজের মতামত, সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনা? এখন থেকে নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কারো চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত সে মেনে নেবে না। বিয়ের মতো এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত যখন নিতে পেরেছে, তখন বাবাকে কেন জানাতে পারবেনা? আজ হোক বা কাল, সবাইকে তো জানাতেই হবে। এই সপ্তাহের মাঝেই তিয়াসের সাথে বিয়ে, তার আগেই বাবার মুখোমুখি হবে সে। সরাসরি জানিয়ে দেবে সে বিবাহিত। মাহমুদ তার স্বামী।
বাবার আসার অপেক্ষায় রইলো তরী।
★★★
নতুন বাসা কলেজের কাছাকাছি। বাসায় মায়ের সাথে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে গিয়ে তরীকে ফোন দেওয়ার ফুরসত মেলেনি। আজ কলেজ থেকেও ছুটি নিয়েছে মাহমুদ। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো। চেয়েও চোখ মেলতে পারেনি। ঘুমিয়ে পড়লো মাহমুদ। তার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই বাসার বারান্দাটি তরীদের বাসার মতো ঝুল বারান্দা নয়। পুরোটা ইট-সিমেন্ট আর গ্রিল দিয়ে আবদ্ধ। হুট করেই তরীর কথা মনে পড়ে গেল। তরীর বিয়েটা আটকানো দরকার। সে তাদের বিয়ের ব্যাপারে বাসায় জানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তরীকে চাপ দিতে চাইছেনা। তরীর বাবাকে যতটুকু চিনেছে, এতে তাদের দেখা হওয়ার রাস্তাটুকু বন্ধ হয়ে যাবে। ভেবে ভেবে মাথায় এলো তিয়াসের কথা। ছেলেটার সাথে একবার কথা বলে দেখা উচিত। সে যদি তরীকে বিয়ে করবে না বলে পরিবারে জানিয়ে দেয়, তবে আপাতত তরী, মাহমুদ দুজনই চিন্তামুক্ত। সময় নিয়ে পরে আবার তার বাবার কাছে প্রস্তাব রাখা যাবে। তিয়াসের কথা মাথায় আসতেই মনে হলো তার কাছে তো নম্বর নেই। তরীর কাছ থেকে নেওয়া যাবে ভেবে ঘরে ঢুকে ফোন হাতে নিতেই চোখ চড়কগাছ। তরীর অনেকগুলো ফোন, মেসেজ জমা হয়েছে। আজকের দিনটা মেয়েটাকে সময় দেওয়া হয়নি।
দ্রুত কল ব্যাক করলো। রিং হচ্ছে, কিন্তু রেসপন্স নেই। পঞ্চমবারে কল রিসিভ হলো। থমথমে গলা শোনা গেল,
-“কী চাই?”
মাহমুদ নিঃশব্দে হাসলো। তার কোমলমতি তরী ঠান্ডা স্বভাবের হলেও বেশ রাগী, সেটা বুঝলো মাহমুদ। আর এটাও বুঝলো তার উপর রা*গ করেই কল ওঠায়নি এতক্ষণ। তবে আফসোস রাগটা সে সঠিক জায়গায় দেখাতে পারেনা। মাহমুদ গলা ঝেঁড়ে স্বর নরম করলো,
-“সরি! ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
ওপাশে দীর্ঘক্ষণ নিরবতা চললো। কোন সাড়াশব্দ নেই। তরী নরম মনের মানুষ। তার অল্পতেই রাগ পড়ে যায়। সরিতে লাজ হলো। নিরবতার ইতি টেনে খানিকটা কোমল হলো,
-“তাই বলে একটা কল ও দেবেন না?”
-“তার জন্য এক বাক্স সরি!”
তরী পূর্বের সেই গম্ভীর রূপে ফিরে গেল। বলল,
-“আমি আজ বাবাকে আমাদের বিয়ের কথা জানিয়ে দেব।”
বাঁধা দিলো মাহমুদ।
-“এখনই নয়। আগে অন্য পন্থা অবলম্বন করে দেখি। আপনি আমায় তিয়াসের নম্বর সেন্ড করুন। আমি উনার সাথে কথা বলে দেখছি, তিনি কী বলেন। যদি মানতে না চান, তবে আমরা আপনার বাবাকে বিয়ের ব্যাপারটা জানাবো।”
-“কিন্তু..
-“কোন কিন্তু নয়, তরী। আমি চাই সবটা শান্তভাবে হোক। কোন ঝড় না আসুক।”
-“ঠিক আছে, আমি পরে সেন্ড করে দেবো।”
-“কাল ক্লাস আছে?”
-“হুম।”
মাহমুদ আবদার করলো,
-“আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ভিডিওতে আসুন না!”
মাহমুদ স্পষ্ট শুনতে পেল তরীর মায়ের ডাক। তিনি তরীকে ডাকছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“ডাকছে আপনাকে, যান।”
তরী মাহমুদের সাথে কথার ইতি টে*নে মায়ের কাছে গেল।
★★★
মাহমুদের কথা ধরে তরী আর বাবাকে কিছুই বললোনা। নাস্তা করে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। পরনে মিষ্টি কালার একটা জামদানি। চোখে কাজল টানতে ভুললোনা তরী। শাড়ি পরা নিয়ে কেউ কিছু বললোনা। কারণ তরী প্রায়শই বান্ধবীদের সাথে বের হলে শাড়ি পরে। তবে মা জিজ্ঞেস করলেন,
-“শাড়িটি কার?”
তরী মিষ্টি হেসে জবাব দিলো,
-“আমি কিনেছি। সুন্দর না?”
তার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা হাসি দেখে সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। তরীকে বাবা কমবেশি হাত খরচের টাকা দেন। সে বেলায় কার্পণ্য করেন না। তাই এরকম একটা শাড়ি কেনার টাকা তার কাছে থাকবে এটা আশা করা যায়।
এই শাড়ির প্রতিটি কুঁচি তরী ভীষণ যত্নে দিয়েছে। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে আঁচল টে*নে*ছে। শাড়িটা মাহমুদের দেওয়া। পরশুদিন বাসায় ফেরার পথে এই শাড়িটি পছন্দ করে কিনে দিয়েছে। সে মাকে মিথ্যা বলেছে। তরী খেয়াল করলো সে দিন দিন কেমন দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলছে। অনায়াসে মিথ্যা বলছে। ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার পূর্বে বাবা বললেন,
-“দাঁড়াও, আমি বাসে উঠিয়ে দেবো। আমার ওদিকে একটু কাজ আছে।”
তরী দ্বিরুক্তি করলো না। বাবার সাথেই বাস স্টপেজ পর্যন্ত গেল। বাবা বাসে উঠিয়ে নিশ্চিন্তে নিজের কাজে গেলেন। লেকচার শেষ দিয়ে তরী সময় দেখলো। মাহমুদের কলেজ ছুটি হয়েছে মাত্র। এখানে এসে পৌঁছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। সে ক্যান্টিনে পা বাড়ালো। বান্ধবীদের সাথে কফির সাথে আড্ডা চললো অনেকক্ষণ। মাহমুদের কল পেয়েই সবাইকে রেখে সে বেরিয়ে পড়লো। ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেলো মাহমুদের দিকে। ক্লান্ত ঠোঁটেও তার নিখুঁত হাসি। দুনিয়াতে কেউই নিখুঁত হয়না, কারো হাসিও বোধহয় নিখুঁত হয়না। যার যার কাছে তার ব্যক্তিগত মানুষটাকে সবরকম রূপেই নিখুঁত লাগে, সুন্দর লাগে। তাই তরীর কাছেও মাহমুদের সবকিছুই ভালোলাগছে। তরীও ঠোঁট প্রসারিত করে এসে দাঁড়ালো। মাহমুদের কপালে অল্প অল্প ঘাম জমেছে। ভীড় ঠে*লে বেরিয়ে এলো দুজন। তরী আঁচল টে*নে মাহমুদের কপালের ঘাম আলতো হাতে মুছে দিলো। অপলক তাকিয়ে রইলো মাহমুদ। চোখেমুখে তার মুগ্ধতা। গভীর আবেগ নিয়ে বলল,
-“আজ তোমায় ভয়*ঙ্কর সুন্দরী লাগছে, তরী। একদম বউ বউ।”
#চলবে……..
#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বাতাসের ঝাপটায় অবিন্যস্তভাবে দুলে উঠলো দুজনের চুল। নীল আকাশে শুভ্র মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য। তরী ভালোলাগা আর লজ্জার সংমিশ্রণে মাথা নিচু করে নিলো। গাল দুটো ক্রমশ ফুলে উঠছে। কান গরম হয়ে এলো তার। পলক ঝাপটাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠছে কালো পাপড়ি। মাহমুদ তন্ময় হয়ে দেখলো। তার চোখদুটোতে তরীকে বুকে টে*নে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় মাহমুদ। এই চাওয়াটা পূরণ হয়ে গেলে তার মনে লো*ভ জন্মাবে। তরীকে সম্পূর্ণভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠবে। সে চায় সব সুষ্ঠুভাবে হোক। তরীর পরিবার তাদের মেনে নিক। বিনা বাঁধায় তরীকে বাহুডোরে বেঁধে নিতে চায়। মাহমুদ জানে তাদের প্রচুর কাঠখড় পোহাতে হবে তরীর পরিবারকে মানাতে। তবুও সে চায় এই যুদ্ধের সৈনিক হতে। যে জিনিস পেতে ভীষণ কষ্ট পোহাতে হয়, তার মূল্য তত বেশি হয়। তরী তার কাছে অমূল্য। তাকে পেতে এইটুকু কষ্ট অনায়াসে করে নিতে পারবে।
তরীর বাঁ হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজলো মাহমুদ। হাত দুটো লুকিয়ে পড়লো শাড়ির আঁচলের নিচে। তরীর ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে নিটোল হাসি। স্টপেজ এ এসে হাতে হাত রেখে আগেপিছে বাসে চড়লো। জানালার পাশটা বরাদ্দ হলো তরীর জন্য। চলমান গাড়ি আর বাতাসের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে তরীর ঢিলে হয়ে যাওয়া চুল দোল খাচ্ছে মাহমুদের চোখেমুখে। সে পরম আবেশে চোখ দু’টো বুজে আছে। মুখের কোথাও বিরক্তি বা ক্লান্তির চিহ্ন টুকু নেই। তরী নিজেই চুল টেনে শক্ত করে বেঁধে নিলো। মাহমুদ ভুরু কুঁচকে ফেললো। ঝট করেই চোখের পাতা খুলে ফেললো। মৃদুস্বরে শুধালো,
-“চুল বাঁধলে কেন?”
তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কিছু শব্দ বের করার জন্য উদ্ধত হওয়ার পূর্বেই চুলে টান পড়লো। ঝরঝরে করে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো কেশরাশি। তরী হতভম্ব হয়ে রইলো। মাহমুদ তরীর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে নির্লিপ্ত রইলো। বাসের জানালায় মুখ আড়াল করার চেষ্টা করলো তরী। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। মাহমুদের নজর এড়ালোনা। সেও হাসলো নিঃশব্দে। তরী আড়চোখে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহমুদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তরীর মিটিমিটি হাসি রূপ নিলো প্রাণখোলা হাসিতে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে হাসির দমকে। তবে শব্দ হচ্ছে না। বাতাসের দাপটে এলো চুলের ঝাপটা মাহমুদের চোখেমুখে বাড়ি খাচ্ছে। প্রাণভরে শ্বাস নিলো সে। চুলের ভাঁজে ভাঁজে কি যেন এক সুগন্ধি খুঁজে পেল। অনায়াসে টে*নে নিলো সেই ঘ্রাণ।
তরীর গন্তব্য আসার পূর্ব স্টপেজ এ বাস থামলো। মাহমুদ তার হাত টে*নে নামিয়ে নিলো। তরীর চোখেমুখে প্রশ্ন জমা হলো। কৌতুহলী মন জিজ্ঞেস করলো,
-“এখানে কেন নামলাম, আমরা?”
মাহমুদ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,
-“আসো তো!”
হুট করে আজ এই তুমি তুমি ডাকটা কেমন চমকে দিল তরীকে। মায়া মায়া ডাক। এতে জমে আছে ভীষণ যত্নে গড়া ভালোবাসা। তরীর ভালোলাগছে আবার কেমন লজ্জাও লাগছে। মাহমুদের সাথেই সিএনজিতে উঠলো। মাঝে মাহমুদ তাকে সাবধান করে দিল,
-“শাড়ি টে*নে বসো। চাকায় লেগে দু*র্ঘ*ট*না হতে পারে!”
তরী আঁচল গুটিয়ে বসলো। মাথা রাখলো মাহমুদের ঘাড়ে। আজ কেমন নির্লজ্জ হয়ে উঠলো তরী। বন্দী খাঁচার পাখি যেমন মুক্ত হয়ে গেলে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়! ঠিক তেমন। নিজের ইচ্ছেকে আজ প্রাধান্য দিল। জলে যাক জড়তা, লজ্জা। তাদের আজ ছুটি দেওয়া হলো। মাহমুদ একবার তাকালো। সামনে দৃষ্টি রেখে হাত নিয়ে রাখলো তরীর পিঠ ছুঁইয়ে বাহুতে। আগলে রাখলো নিজের সাথে। নরম স্বরে ডাকলো,
-“তরী।”
-“হু।”
-“ভয় করছে না?”
-“উঁহু।”
তরীর এই সরল জবাব টুকু যেন প্রশান্তি দিল মাহমুদকে। বুক ভরে শ্বাস নিলো। এই মেয়েটাকে আর দূরে দূরে রাখা যাচ্ছে না। দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। কেন এত আদুরে আদুরে লাগছে তাকে?
তরী ঘাড়ে মাথা রেখেই প্রশ্ন করলো,
-“আমরা বাস থেকে কেন নামলাম? আর বললেন না তো কোথায় যাচ্ছি?”
-“নতুন বাসায়।”
দ্বিরুক্তি করলোনা তরী। মাহমুদের সাথে ওভাবেই মিশে রইলো। পূর্ব স্টপেজ এ নেমে পড়ার কারণ আছে অবশ্য। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা মাহমুদের বাসায় গিয়ে নামতে পারবে। কেউ দেখবেনা। কিন্তু তরীদের এলাকায় এসে নামলে দুজনকে একইসাথে তরীর বাবা হয়তো দেখে ফেলতে পারেন। আগে ভয় ছিলনা। কিন্তু এখন তিনি মাহমুদের ব্যাপারটা জানেন। দুজন এসে নামলো মাহমুদের নতুন বাসার সামনে। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল। মাহমুদ সামনে, তরী তার পেছনে। দুতলায় এসে বেল দিল মাহমুদ। তরী মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের বাহুতে হাত রেখে ভয়কাতুরে চেহারায় জিজ্ঞেস করলো,
-“আন্টি কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবো?”
মাহমুদ চাপা হেসে বলল,
-“সেটা আমি কী জানি?”
ততক্ষণে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন আয়েশা সুলতানা। তরী ঝট করে মাহমুদের বাহু থেকে হাত ছাড়িয়ে মিষ্টি হেসে সালাম দিল আয়েশা সুলতানাকে। তিনি অবাক হয়েছেন তরীকে দেখে। হেসে সালামের জবাব দিয়ে তাকে টে*নে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মাহমুদ ধীরেসুস্থে ভেতরে ঢুকলো। সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লো। নতুন বাসায় চোখ বুলিয়ে দেখছে তরী। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন,
-“তুমি যে এখনাে এসেছো, বাসায় সমস্যা হবে না?”
তরী মাথানিচু করে বলল,
-“বাসায় কেউ জানেনা।”
চমকালেন আয়েশা সুলতানা। আতঙ্কিত স্বরে বললেন
-“তোমার বাবা জানলে সমস্যা হয়ে যাবে। কেন আসতে গেলে এভাবে?”
নিচু স্বরে জবাব দিল তরী,
-“আপনাদের দেখতে ইচ্ছে করছিল।”
-“মাহমুদের দেখা কোথায় পেলে?”
-“উনিই আমাকে ভার্সিটির সামনে থেকে নিয়ে এসেছেন।”
বলেই থতমত খেয়ে গেল তরী।
আয়েশা সুলতানা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। উনার খানিকটা সন্দেহ হলো।
-“তোমার বাবা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাহলে তুমি মাহমুদের সাথেই বা কেন এলে? তুমি ও কি মাহমুদকে পছন্দ কর?”
আয়েশা সুলতানার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কবলে পড়ে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। ঢোক গিললো তরী। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। তবুও তার গরম লাগছে। কেমন হাঁসফাঁস করে উঠছে। তরীর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে আয়েশা সুলতানার সন্দেহ গাঢ় হলো। তিনি আরেকটু চেপে বসলেন৷ ফের জিজ্ঞেস করলেন,
-“বলো, তুমিও কি পছন্দ করো?”
তরী হ্যাঁ, না কি বলবে বুঝতে পারছেনা। হুট করেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,
-“আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।”
আয়েশা সুলতানা বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। অস্ফুট স্বরে শুধালেন,
-“কী?”
এভাবে বিয়ে করাকে তিনি কিছুতেই সমর্থন করেন না। আয়েশা সুলতানার মুখের দিকে তাকিয়ে তরীর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। গলা কাঁপছে তার। ঢোক গিলে বলল,
-“আন্টি প্লিজ আপনি
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলোনা তরী। হাত উঠিয়ে বাঁধা দিলেন আয়েশা সুলতানা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি প্রচুর অসন্তুষ্ট। হাঁক ছেড়ে মাহমুদকে ডাকলেন। সে মাত্রই গায়ের ঘর্মাক্ত শার্ট ঝেড়ে ওয়াশরুমে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মায়ের ডাক পড়ায় তার কাজে বাঁধা পড়লো। দ্বিতীয়বার গলা চড়িয়ে ডাকলেন মা। মাহমুদ লম্বা কদম ফেলে বেরিয়ে এলো। রামি স্কুল থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিল। সেও চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো। তরীকে দেখে ঈষৎ চমকালো। মাহমুদ নিচু গলায় শুধালো,
-“কী হয়েছে মা?”
আয়েশা সুলতানা চোয়াল শক্ত করে নিলেন। কঠিন গলায় বললেন,
-“তরী এসব কী বলছে? বিয়ে করেছিস তোরা?”
মাহমুদ একবার তরীর দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে আছে সে। বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মায়ের দিকে ফিরে শান্ত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ,
-“হ্যাঁ।”
মাহমুদের স্বীকারোক্তি যথেষ্ট ছিল রামিকে চমকে দেওয়ার জন্য। চমকালেও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বলা চলে। আয়েশা সুলতানা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কবে বিয়ে করলি? আজই? কে কে জানে?”
মাহমুদ একইভাবে শান্ত গলায় জবাব দিল,
-“তরীর বাসায় থাকাকালীন বিয়ে করেছি। যেদিন ওকে রিং পরিয়ে গিয়েছিল, সেদিন। বিয়ের ব্যাপারে আমার কয়েকজন বন্ধু জানে।”
আয়েশা সুলতানা কঠিন হয়ে বললেন,
-“তরীকে বাসায় দিয়ে আয়।”
-“কিছুক্ষণ থাকুক। তারপর দিয়ে আসছি।”
-“এক্ষুণি দিয়ে আসবি। আর তরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবিনা।”
তরীর ভেতরটা তড়াক করে উঠলো। মাথা তুলে টলমল চোখে তাকালো। কপোল ঘেঁষে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাহমুদের চোখমুখ শক্ত। কন্ঠের ভীত দৃঢ়। অনড় গলায় বলল,
-“তরী আমার স্ত্রী, মা।”
-“তো? কেউ তো জানেনা। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের মেয়েকে এভাবে বিয়ে করার মতো বে*হা*য়া*প*না*র শিক্ষা তো আমি তোকে দেইনি!”
-“আমরা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক।”
-“আমি এতকিছু শুনতে চাইনা। এক্ষুণি তরীকে বাসায় দিয়ে আসবি।”
মাহমুদ গটগট পা ফেলে একটা শার্ট জড়িয়ে বোতাম আটকাতে আটকাতে বেরিয়ে এলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে তরীর হাত চেপে ধরে বলল,
-“চল।”
রামি মায়ের হাত ধরে অনুনয় করলো,
-“মা প্লিজ এমন করো না! তুমি তো তরী আপুকে পছন্দ কর।”
আয়েশা সুলতানা নির্লিপ্ত রইলেন।
তরীর হাত চেপে ধরায় সে মাহমুদের দিকে আশাহত চোখে তাকালো। মানুষটা কি সত্যিই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে? এটাই বুঝি বিশ্বাস? এই ঠু*ন*কো বিশ্বাসের বলে মানুষটার হাত ধরেছিলো? অঝোর ধারায় জল গড়ালো দু-চোখ ভরে। মাহমুদ তরীর অশ্রুমাখা চোখে তাকালো। মজবুত কন্ঠে বলল,
-“যত ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন! আমি তোমার হাত ছাড়ছিনা, তরী। এই হাত ধরেছি ছাড়ার জন্য নয়।”
#চলবে…..