অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-৩১+৩২

0
375

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩১
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীর বাবা সকালে বের হতেই একজন ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা তুললেন। সাথে আরো কয়েকজন সঙ্গ দিয়ে মাহমুদের মায়ের কথা তুললেন। আকাশ থেকে পড়লেন যেন তিনি। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ! মেয়ের শাশুড়ীকে নিয়ে এমন নিম্ন মানসিকতার চিন্তাভাবনা মানুষের কোথা থেকে আসে? অবশ্য তরী মাহমুদের বিয়ের ব্যাপার তিনি এখনো খোলাসা করেন নি। শুধু মেয়ের জন্য পাত্র হিসেবে মাহমুদ কেমন হবে, এতটুকুই আলোচনা করেছিলেন পরিচিত কয়েকজনের সাথে। রেগে গেলেন তরীর বাবা। রুক্ষ গলায় বললেন,

-“আজেবাজে কথা বলা থেকে দূরে থাকুন। কে দেয় আপনাদের এমন বুদ্ধি? উনি আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এখন উনার ছেলের সাথে মেয়ের জন্য সমন্ধ নিয়ে আলোচনা চলছে। সেটা জেনেও কী করে এমন ধরনের কথা বলতে পারেন?”

একজন বললেন
-“আহা! রাগ হচ্ছেন কেন ভাই? মেয়ের বিয়েও দিলেন, সাথে আপনার ঘরও পূর্ণ হলো। তখন মেয়ে শাশুড়ী নয়, মা পাবে। আপনি বরং বড়ো ছেলে পাবেন। আমরা আপনার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।”

অতিরিক্ত রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তরীর বাবার। চোখের রং পরিবর্তন হয়ে সফেদ অংশে লালছে আভা দেখা দিল। হুংকার ছাড়লেন তিনি,
-“আমার ভালো আপনাদের ভাবতে বলিনি। নিজের ভালোমন্দ আমি নিজেই বুঝি। বিপদের সময় আপনাদের পাইনা। অথচ মানুষ যখন একটু সুখে থাকতে চায়, সেখানে ব্যাঘাত ঘটাতে তখনই আপনাদের দেখা যায়। উস্কানিতেতো খুবই উস্তাদ আপনারা। আর যদি দোকানপাট, কিংবা বাজার-ঘাটে এই সমস্ত আলোচনা শুনি, তবে মা*ম*লা করতেও আমার দিল কাঁপবে না। নয়তো যার মুখে শুনবো তাকে ধরেই পায়ের জুতা খুলে পে*টা*বো। কিছু বলিনা বলে আস্কারা পেয়ে যাচ্ছেন খুব, তাইনা?”

লোকগুলো কিছুটা দমে গেল। কেটে পড়ার ভঙ্গিতে একজন বলল,
-“আজকাল মানুষের ভালো করতে নেই। থাক বাবা আমাদের দরকার নেই। নিজের জীবন নিয়ে ভেবেই কুল পাই না।”

তরীর বাবা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। সারাদিন ব্যাপারটা নিয়ে মনের মাঝে খচখচানি ভাব ছিলো। যতই হোক তিনি তো জানেন মেয়ের শাশুড়ী হয় আয়েশা সুলতানা। কতটা লজ্জার ব্যাপার। বাসায় এসেই গম্ভীরমুখে বসে রইলেন।

তরী বাবার এই গাম্ভীর্যের কারণ সম্পর্কে অবগত। বিকেলেই ছাদে এক ভাড়াটিয়া আন্টি তাকে বাবার সাথে হওয়া ঘটনা খুলে বললেন। উনার স্বামীও নাকি সেখানে ছিলেন। যদিও সবকিছু শুনেন নি। যতটুকু শুনেছেন ঠিক ততটুকুই স্ত্রীকে এসে বলেছেন। আর সেটাই তরীকে জাননো হলো। একটা কথা এক কান থেকে দুকান তারপর তিন কান পর্যন্ত এসে হুবহু আগের ঘটনা থাকেনা। পরিবর্তন হয়ে যায় অনেকটাই। তরীও সম্পূর্ণ না জেনেই আতঙ্কিত হয়ে আছে। বাবা যদি মান সম্মানের কথা ভেবে তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখা টুকু ও বাদ দিয়ে দেন! তরী পাগল হয়ে যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই প্রেম তাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। সে জানে মাহমুদ নিজেও তাকে কতটা ভালোবাসে, যত্ন করে। মাহমুদের ভালোবাসা টুকু গভীর কিন্তু প্রকাশ খুবই কম।

তরী ভয়ে ভয়ে বাবাকে ডাকলো,
-“বাবা!”

-“হু।”
ধ্যান ভাঙা স্বরে সাড়া দিলেন বাবা। চোখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। অতঃপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি?”

তরী ঢোক গিলে ফের জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”

বাবা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
-“তেমন কিছু না।”
মাথা থেকে খা*রা*প চিন্তা টুকু দূর করতে আজ নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন। তরী আশ্চর্য হলো! মায়ের মৃত্যুর পর বাবা একদিনের জন্যেও নিজেদের ঘরে পা রাখেন নি। এতগুলো মাস পর আজ পা রাখলেন। ভেতর থেকেও দরজা বন্ধ করে দিলেন। তরী আর ভেতরের দৃশ্যটুকু সম্পর্কে অবগত হতে পারলোনা।

★★★

স্ত্রীর হাতে গড়া প্রতিটি জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন তরীর বাবা। চোখের কোনে মেঘ জমেছে। হুটহাট বৃষ্টি নামতে পারে। গলা ভার হয়ে এলো। তিনি আজ ভীষণভাবে উপলব্ধি করলেন, স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন তার কদর বোঝেননি। এখন বোধদয় হলো। রুবিনা নামক নারীটি উনার জীবনে অনেক বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল। কখনো নিজের একরোখা মনোভাবের কারণে স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব পর্যন্ত দিতেন না। এখন বুঝতে পারছেন কতটা ভুল তিনি করেছেন। বাংলায় প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে,” আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।”

তরীর বাবা আজ সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের দিকটা ভেবে দেখবেন। সত্যিই তো সংসারটা মেয়ে করবে। এখানে তার মতামতের গুরুত্বটাই আসল। পিতামাতার দায়িত্ব হলো কন্যাকে সুপাত্রে দান করা। মাহমুদ খা*রা*প ছেলে নয়। তবুও তিনি আত্মগর্বে মেয়ের মতামতের বিরোধীতা করলেন। কিছুক্ষণ স্ত্রীর কথা ভেবে অশ্রু ঝরালেন। অতঃপর চোখেমুখে পানি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তরীকে ডাকলেন।
-“তটিনী।“

তরী অরুকে নিয়ে ছুটে বাবার কাছে এলো। ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,
-“জি বাবা।”

বাবা স্বাভাবিক গলায় তরীকে সামনের সোফা দেখিয়ে বললেন,
-“এখানে বস। কথা আছে তোর সাথে।”

তরীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা হঠাৎ কী কথা বলতে চাইছেন! তটস্থ চোখের দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এলো। ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে বসতেই তিনি মেয়েকে বেশ খানিকক্ষণ অবলোকন করলেন। একটু সময় নিয়ে গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
-“তুই কী চাস?”

তরীর নত মস্তক হুট করেই সোজা হয়ে গেল। বাবার পানে তাকিয়ে রইলো চোখজোড়া। বুঝতে পারলোন সে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিসের কথা বলছো বাবা?”

বাবা সরাসরি বললেন,
-“মাহমুদের সাথেই থাকতে চাস, না-কি আমাদের সাথে?”

তরীর চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। পানি চিকচিক করছে। কিন্তু জবাব দিলোনা। বাবা তাড়া দিলেন।
-“আমি তোকে কিছু প্রশ্ন করেছি!”

আপনাআপনি নিরব অশ্রু কপোল স্পর্শ করলো। হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো তরী। রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় বলল,
-“বাবা আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে এভাবে দোটানায় ফেলো না! আমি তোমাদের ও ছাড়তে পারবোনা আর না মাহমুদকে।”

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন,
-“আমি তোকে দেখে দিনদিন অবাক হচ্ছি, তটিনী। আমার ভীরু মেয়েটা দিনদিন সাহসের উচ্চ পযার্য়ে চলে যাচ্ছে। আগের তটিনী হলে কখনোই আমার সামনে কথাটুকু বলতে পারতোনা!”

তরী মাথানিচু করে নিলো। বাবার সামনে এভাবে বলায় লজ্জাও হচ্ছে। কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। সে না-হয় ভীরুতাকে বিসর্জন দিলো!

বাবা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উঠে চলে গেলেন। অরু পিটপিট করে তরীকে দেখছে। দুপাশে ঝুলে থাকা লম্বা বিনুনি দুটো পেটের কাছটা স্পর্শ করছে। গোলাপি রঙের ফ্রকে মেয়েটাকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। যখন ঝগড়া করার মুডে থাকে, তখন বেশি আদুরে দেখায়। অরু তরীর চোখের পানি মুছে দিল। নরম স্বরে বলল,
-“কাঁদছো কেন আপু? মাহমুদ ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে, এজন্য?”

তরী অরুর ধারণা বদলাতে দিলোনা। উপরনিচ মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। ছোট্ট অরু নাক ফুলিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। বড়োদের মতো গম্ভীর হতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আলমারির ভেতর লুকিয়ে রাখবো। মাহমুদ ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো ‘আপু আলমারির ভেতর নেই’। তখন আর খুঁজে পাবেনা তোমায়।”

তরীর দুঃখের মাঝেও হাসি পেল অরুর কথা শুনে। চেপে রাখলোনা। কান্না চোখেই ফিক করে হেসে ফেললো। অরু উৎফুল্ল হয়ে বলল
-“দেখলে তো, আমার খুউউউব বুদ্ধি।”

অরুর নাক টিপে দিয়ে হেসে তরী বলল,
-“হ্যাঁ, আপনার খুব বুদ্ধি।”

★★★

ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও কথা বললেন না তরীর বাবা। তিয়াসের বাবা বিদ্রুপ করেই বললেন,
-“আজকাল সাপের পাঁচ পা দেখেছিস না-কি?
না-কি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিস?”

তরীর বাবা হাসলেন। না দাঁড়িয়ে হেঁটে যেতে যেতেই বললেন,
-“নাহ্, তবে আমার পেছনে লোক লাগানো মানুষ দেখেছি।”

কথাটা তিয়াসের বাবাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন বুঝতে পেরেই তিনি তেতে উঠলেন। পেছন থেকেই উচ্চস্বরে বললেন,
-“বাপ যেমন বে*য়া*দ*ব, ঠিক ছেলে-মেয়েদের ও তেমনই শিক্ষা দিয়েছে।”

তরীর বাবা জবাব দিলেন না। ঠুনকো মানুষ বিবেচনা করে এড়িয়ে গেলেন তিয়াসের বাবাকে। বিপদের সময় পাশে থাকেনা। মেয়েকে বিয়ে দেবেনা জানতেই তিনি দু*শ*ম*ন হয়ে গেলেন। আজ বুঝতে পারলেন তরীকে বিয়ে করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য কী। ভেবেছিলেন হয়তো এমন সহজ সরল মেয়েকে যেভাবে ইচ্ছে চালাতে পারবেন, খাটাতে পারবেন। জীবনে বহু ভুল করেছেন তরীর বাবা। তবে এবার আর ভুল করবেন না।
পরদিন দুপুরেই আয়োশা সুলতানাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ জানালেন।

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_৩২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তরীদের বাড়ির সামনে এসে থামলো মাহমুদদের গাড়ি। ভাড়াটে লোকেরা অনেকেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কেউ কেউ পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে আয়েশা সুলতানার সাথে কথা বললেন। তিনি ও হাসলেন, কথা বললেন। সিঁড়ি বেয়ে চারতলা বিল্ডিং এর উপরতলায় উঠলো সবাই। তরীর বাবার ফোনের পর বড়ো ভাইয়া আর ভাবিও সকালে এখানে ছুটে এসেছে।

তরী সকাল থেকেই ব্যস্ত। মামির হাতে হাতে সব সামলাচ্ছে। সাথে মিঠুও সাহায্য করছে। যদিও সে অগোছালো থাকতে পছন্দ করে, তবুও আজ সকাল থেকে গোছগাছের দায়িত্ব নিলো। অরু বারবার এটা-ওটা প্রশ্ন করছে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে মামি তরীকে গোসলে পাঠিয়ে দিলেন।
-“তুই গিয়ে গোসল করে নে। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারবো। সবাই বোধহয় এসে পড়েছে।”

তরীর আজ ভীষণ লজ্জা হচ্ছে, সাথে ভয়। বাবার মত না যেন পাল্টে যায়! মামির কথায় বাধ্য মেয়ের মতো গোসলে চলে গেল।
তরীর বাবা দরজা খুলে দিলেন। সবার সাথে সালাম বিনিময় হলো। সাথে তরীর মামাও আছেন। ইরা তরীর ঘরে সোজা ঢুকে পড়লো। রামি মিঠুর ঘরে ঢুকলো। দেখলো বেচারা বিছানার চাদর পরিবর্তন করে নতুন চাদর বিছিয়ে নিতে ব্যস্ত। রামি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। যেই ছেলে অগোছালো থাকে, সে আজ কাজে ব্যস্ত। ব্যাপারটা রামিকে আশ্চর্য করলো না, তবে মজা পেল খুব। ক্লান্ত মিঠু বিরক্ত ঝেড়ে বলল,
-“এমন হাসছিস কেন? মুখ বন্ধ কর। তোর মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ আসছে আর দাঁত দেখে তো মনে হয় এক সপ্তাহ ধরে ব্রাশ করিস না।”

রামি রাগলো না। উল্টো গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল,
-“তোর ধারণা ভুল। আমি এক সপ্তাহ নয়, বরং একমাস যাবত দাঁত ব্রাশ করছি না। তুই ঘটা করে আমার বিয়াই হবি, দুর্গন্ধযুক্ত মুখে চুমু খেয়ে তোকে অভ্যর্থনা জানাবো। তারপর এখান থেকে তোর ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করে বাসায় যাবো। আমার শরীর শুঁকে দেখ, এক সপ্তাহ যাবত গোসলও করছিনা। শুধু তোর জন্য। আজ এখান থেকে ব্রাশ, গোসল দুটোই সম্পন্ন করে যাবো। তুই তো উদার, জমিদার। নিশ্চয়ই তোর সাবান, ব্রাশ ব্যবহার করলে কিছু মনে করবি না!”

মিঠু নাকমুখ কুঁচকে বমি করার ভান করে বলল,
-“তোকে দেখেই তো আমার বমি পাচ্ছে। আমার ব্রাশ তোর ওই লাল দাঁতে প্রবেশ করলে বোধহয় আমার শেষকার্য সম্পন্ন করেই তোকে ফিরতে হবে।”

রামির চোখ চড়কগাছ। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,
-“আস্তাগফিরুল্লাহ মিঠু, তোর বমি পাচ্ছে কেন? তাছাড়া আমি ছেলে হলেও তুই তো মেয়ে নয়! বল কোন মেয়ের সাথে প্রেম করে নিজের এত বড়ো সর্ব*নাশ করেছিস?”

মিঠুর মেজাজ খা*রা*প হলো। পেছন থেকে রামির কোমরে লা*থি বসিয়ে ক্ষান্ত হলো।
-“বে*টা অ*স*ভ্য। আমি কি তোর মতো না-কি? পারলে আমার সাথে কাজ কর। নয়তো চারতলা থেকে নিচে ধা*ক্কা দিয়ে ফেলে দেবো।”

রামি কথা বাড়ালো না। মিঠুর হাতে হাতে কাজ করলো। সুযোগ বুঝে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। হাতে হাতে কাজ করে মিঠুকে বলল,
-“এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।”

মিঠু নিজেও ক্লান্ত। কাজ না করা মানুষ আজ এতটুকুতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তারও পানি খাওয়া দরকার। রামির জন্য পানি আনতে চলে গেল সে। রামি সুযোগ বুঝে উঠে পড়লো। ভিলেনের মতো তার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে রইলো শয়তানি হাসি। আস্তে ধীরে মিঠুর আলমারি খুললো। তার ইউনিফর্ম বের করে কফ, থুতু মিশিয়ে রেখে দিল। কাল পর্যন্ত ইউনিফর্ম দুর্গন্ধ হয়ে থাকবে। স্কুলে পরে যেতে পারবেনা। কোমরে লা*থি মা*রা*র শোধ স্যার তার পাছায় বেত ভেঙে নিয়ে নেবে।
কাজ শেষ করে দ্রুত খাটে গা এলিয়ে দিল। মিঠু পানি এনে দিতেই তিন চুমুক খেয়ে রেখে দিলো।

★★★

ইরা বসে বসে তরীর অপেক্ষা করছে। বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হলো অনেকক্ষণ। খট করে দরজা খুলেতেই তাকালো ইরা। তরী চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। হুট করে ইরার দিকে দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। ইরা দুষ্টু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“খুব খুশি লাগছে, তাই না? মাহমুদ কে পাঠাবো?”

তরীর মাঝে পুরোনো লজ্জা ফিরে এলো। লজ্জায় আলুথালু চেহারা। চোখদুটো এলোমেলো ভাবে দৃষ্টি ফেলছে। জড়োসড়ো হয়ে তরী বলল,
-“ধুর ভাবি।”

-“ধুর? মাহমুদ আসলে ঠিকই খুশি হতে।”

তরী ফের লজ্জা পেয়ে বলল,
-“যাও তো।”

তরী আলমারি থেকে একটা জামা বের করতে নিলেই ইরা বাঁধা দিলো। বলল,
-“আজ একটা শাড়ি পরো।”

ইরা নিজেই বেছে বেছে একটা কালো শাড়ি বের করে নিলো। তরীর কমবেশি শাড়ি আছে, মাঝেমাঝে মায়ের শাড়ি পরেও বান্ধুবীদের সাথে বের হতো। সিল্কের শাড়িটি ইরা সুন্দরভাবে পরিয়ে দিল। মানাসই একটা সাজ দিয়ে বের করে নিয়ে গেল সাথে। তরী মাথানিচু করে রেখেছে। মামি নাস্তা পানি দিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজেও এসে বসেছেন সবার সাথে। আয়েশা সুলতানা তরীকে উনার আর ইরার মাঝখানে বসালেন। মাহমুদ তাদের ঠিক বিপরীতে নয়, তবে আড়াআড়ি সোফায় বসা৷ একবার আড় চোখে তাকাতেই তরী বিষম খেলো। মাহমুদের তন্ময় চোখজোড়া ঘুরেফিরে তাকে দেখতেই ব্যস্ত। সবার মাঝে উপস্থিত থাকায় তরীর অস্বস্তি হলো। কখন না জানি কার নজর পড়ে যায়, আর তাকে লজ্জায় পড়তে হয়। তরী আরেকবার তাকালো। মাহমুদের দৃষ্টি এখনো আগের মতোই অবিচল। ইরা মিটিমিটি হাসছে। ব্যাপারটা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। তরীকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“দুজনকে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো?”

ইরার কথায় চমকে উঠলো তরী। ঝটপট মাহমুদের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসলো।
তরীর বাবা সবার দিকে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“নিন।”

আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“নাস্তা পরে হবে। আগে আমি এই ঘটা করে নিমন্ত্রণের কারণ শুনতে চাই। আশা করি এবার হয়তো আমাদের নিরাশ হতে হবে না।”

খানিকক্ষণ চুপ থেকে তরীর বাবা মুখ খুললেন।
-“আমি ভেবে দেখলাম ছেলেমেয়ে দুটো যখন কাজটা করে ফেলেছে, তখন আর আমাদের বাঁধা দিয়ে লাভ নেই। মেয়েটা আমার। আমি যতই সন্তানদের শাসন করি, রাগ দেখাই না কেন? বেশিদিন তাদের উপর রাগ ধরে রাখতে পারিনা। রাগ পড়লে একদিন ঠিকই মেয়েকে বুকে টেনে নিতাম। সে সময়টা একদিন না হয়ে এখন হলে তো ক্ষতি নেই।”

সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি। তরীর বাবা বুঝতে পেরেছেন, এটাই বা কম কিসে? আয়েশা সুলতানা “আলহামদুলিল্লাহ” বলে মিষ্টি তুলে নিলেন। দুটো সুখী পরিবারের মিলনের দৃশ্য এক মনোরম সৌন্দর্য সৃষ্টি করলো। বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ইরা বুদ্ধি করে তরী, মাহমুদকে কথা বলার সুযোগ করে দিল। কেননা সেই কখন থেকেই মাহমুদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা চোখজোড়া তার নজরে এসে নিবদ্ধ হয়েছে। ইরা বলল,
-“এখানে যেহেতু বিয়ের কথা চলবে, তরী আর মাহমুদ না থাকাই ভালো। তারা বরং নিজেদের মধ্যে আরেকবার কথা বলে নিক।”

তরীর বাবা না করলেন না। তবে হ্যাঁ ও বললেন না। মামা বললেন,
-“হ্যাঁ, এখন যেহেতু বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ওদের দুজনের এখানে না থাকাই ভালো।”

মাহমুদ মনে মনে খুশি হলেও তরীর কাজে খানিক বিরক্ত হলো। মেয়েটা গাঁট হয়ে সবার মাঝখানে এখনো বসে আছে। লজ্জা পাচ্ছে তরী। তাই মাহমুদ ইরাকে চোখে ইশারা দিল। বাকিটা ইরা সামলে নিল। তরীকে ঠেলে শব্দ করেই বলল,
-“যাচ্ছো না কেন তরী? না-কি নিজের বিয়ের কথা শোনার জন্য বসে আছো।”

তরী থতমত খেয়ে উঠে পড়লো। ইরা একইভাবে মাহমুদকে বলল,
-“তুমি যাচ্ছো না কেন?”

মাহমুদ ভাবির বুদ্ধি দেখে মনে মনে হাসলো। তবে বেশ সন্তুষ্ট হলো ভাবির প্রতি। সে ও তরীর পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। দরজা ছাড়িয়ে সিঁড়ি ঘরে পা রাখতেই তরীর হাতে টা*ন পড়লো। আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল গুঁজে দিল মাহমুদ। পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চললো। তরীকে হুটহাট সাজে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে ছিল মাহমুদ। সেই রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তরীর চোখে চোখরেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে ভীষণ গভীরভাবে বলল,
-“আমায় পাগল করে দিচ্ছো কেন, তরী?”

তরী অপলক মানুষটিকে দেখে গেল। কতশত মুগ্ধতার ছড়াছড়ি ওই দৃষ্টি জোড়ায়। তরীরও যেন দেখার সাধ মেটে না। সেও বিভোর হয়ে তাকিয়ে রয়। সময় কাটে, বাক্যহীন, মনে মনে গভীর পেমের আদান-প্রদান ঘটে। মাহমুদ তরীর নরম হাতের পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
-“কবে তোমায় খুব কাছে পাবো, তরী? তুমি যে আমায় ভীষণভাবে টানছো!”

তরীর গাল দুটো আরক্তিম হলো। চোখের দৃষ্টি নিচু হয়ে গেল মুহুর্তেই। দৃষ্টি ঘুরিয়ে পাশের ছাদে তাকাতেই মাহমুদ বলল,
-“আমার দিকে তাকাও না, প্লিজ!”

★★★

আয়েশা সুলতানা বললেন,
-“বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তাই আর দেরি করা উচিত হবে না। দ্রুত শুভ কাজ সেরে নেওয়াই ভালো। আপনাদের কী মতামত? ”

তরীর বাবা নিজেও ভাবলেন, দ্রুত বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ আশেপাশের মানুষের বি*শ্রী কিচ্ছা একবার যদি আয়েশা সুলতানার কানে যায়, নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলাও লজ্জায় ঘর ছেড়ে বের হবেন না! ইসলামি শরিয়তে ব্যাপারটি জায়েজ হলেও খুবই লজ্জাজনক আর বি*শ্রী ব্যাপার মনে হয় তরীর বাবার কাছে।
তাই সপ্তাখানেকের মাঝেই সব কিছুর আয়োজন করতে চান। তরীর মামা বলল,
-“আমাদের প্রথম মেয়ের বিয়ে, একটু সময় নিয়ে তারপর কাজ এগোলে ভালো হতো। সবটা সুন্দরভাবে করতে চাই আমরা।”

তরীর বাবা বাঁধা দিলেন। বললেন,
-“আমি দেরি করতে চাই না। বিয়ের কাজটা এক সপ্তাহের মাঝে হয়ে গেলেই ভালো হয়। তাছাড়া আমার ভাই ঝামেলা করতে পারে!”

তিয়াসের বাবার কথা মাথায় আসতেই মামাও দ্রুত বিয়েতে একমত হলেন। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো এক সপ্তাহ পর। অরু মাহমুদের বড়ো ভাইয়াকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে। তিনিও বারবার অরুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারছেন। অরুর রাগ লাগছে। সে মুখ ভেংচি কাটলো। বড়ো ভাইয়া অরুরকে রাগিয়ে ভীষণ মজা পাচ্ছেন। তিনি মুখে হাতের উল্টো পিঠ রেখে চুপিচুপি হাসছেন। ফের অরুকে জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

#চলবে……