অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-১৪+১৫

0
241

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

জোরেসোরে বাতাস বইছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। খানিক বাদে বৃষ্টি নামবে বলে! জানালার ফাঁকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো সুহা। মিঠুর গাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে ফোনের মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। স্ক্রিন অন করতেই ভেসে উঠলো মিঠুর মেসেজ।
“আমাকে দেখছেন সুহা? আমিও দেখছি, এক বিষন্ন চাঁদকে।”

সুহা জানালার পাশ থেকে দ্রুত সরে গেল। মিঠুর মেসেজকে অগ্রাহ্য করে ফোন রেখে বসে রইলো থম ধরে। সে কিছুতেই সামনে এগোতে চায়না। শূন্যে ছেড়ে দিয়েছে জীবন। নিজেকে আড়াল করতে সিদ্ধান্ত নিলো বাসা পরিবর্তন করার। পরক্ষণেই নতুন বাসা নেওয়ার ঝা*মে*লা মাথায় আসতেই তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। এই বাসাটা নিতেই অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। ইবতেসামের বাহ্যিক আচরণ দেখে তাকে ভালো মানুষ মনে হলেও তার ভেতরটা সুহার অজানা। একজন মানুষ আমাদের যতটুকু দেখায়, আমরা ঠিক ততটুকুই দেখি, বিশ্বাস করি। পরবর্তীতে ইবতেসাম যে তাকে বি*প*দে*র মুখে ঠে*লে দেবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে! সুহা আপন ভাবানায় বিভোর হয়ে থাকে। জীবনে করা চরম ভু*ল*টা তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
সন্ধ্যা নামার আগে সুহা আড়াল থেকে আরও একবার বাইরে তাকালো। এখন আর গাড়িটি দেখা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট থেকে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে গ্রিলে হাত রাখলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো ধরনীর বুকে। সুহা বৃষ্টির পানিতে হাত বাড়িয়ে দিল। বহুদিন পর আজ আবার বৃষ্টি দেখে তার ভালোলাগছে, ভেজার ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ! একটা ভয় থেকেই আর ভেজা হলোনা। নাজুক শরীর অল্পতেই অসুস্থতায় ডুবে যায়। অসুস্থ হলে নিজেকে নিজে ছাড়া দেখার মতো আর কেউ নেই। এসব ভেবেই মনের সুপ্ত ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দেয়।

★★★

অন্ধকার ছাপিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে আকাশে। বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তরী। জানালার পর্দা দুহাতে সরিয়ে দিতেই সূর্যের আলো এসে চোখে পড়লো। চোখমুখ কুঁচকে বাবার বুকে মুখ মিশিয়ে দিল অমি। মাহমুদ নিজেও চোখ কুঁচকে নিলো। চোখে আলো সয়ে যেতেই ক্ষীণ চোখে তাকালো তরীর দিকে। স্বভাবসুলভ ঠান্ডা গলায় শুধালো,
“আমাদের দুজনের সাথে তোমার কীসের শ*ত্রু*তা?”

তরী হেসে বলল,
“আমাকে রেখে বাবা-ছেলে আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। এটা আমার সহ্য হলোনা।”

অমির ঘুম হালকা হয়েছে। বাবার বুকে থেকেই চোখ কচলে জবাব দিলো,
“তুমিও আসো। একসাথে ঘুমাবো।”

“আমিও তোমাদের সাথে যোগ দিলে সকালের নাস্তা কে তৈরি করবে?”

অমি ভাঙা গলায় বলল,
“মা আছে।”

তরী নিষ্পাপ চেহেরা বানিয়ে বলল,
“মা একা একা কাজ করবে? আম্মু না গেলে তো পিট্টি দিবে।”

অমি গোলগাল চেহারা নিয়ে পিটপিট করে তাকালো। মিষ্টি কন্ঠে বলল,
“মা ভালো। তোমায় পি*ট্টি দেবে না।”

তরী বলল,
“আচ্ছা এখন উঠে পড়ো।”

অমির এখন বিছানা ছাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে বাবার দিকে আরেকটু চেপে ছোটো ছোটো দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরলো। বলল,
“আমি আর পাপা ঘুমাবো। উঠবো না।”

তরী অমিকে টে*নে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। মাহমুদ অমি দুজনই একজোট হয়ে তরীর বিপক্ষে ল*ড়ে যাচ্ছে। দুজনকে তুলতে গিয়ে সে নিজেই পাশে ধপ করে বসে পড়লো। অমি খিলখিল করে হেসে উঠলো। মাহমুদও হাসছে। তরী কান্না মাখা গলায় বলল,
“উঠো না বাবা! ব্রাশ করিয়ে দিচ্ছি। নয়তো দাঁতে পোকা হবে।”

অমি উঠে বসলো। মাহমুদকে হা করিয়ে দাঁত চেইক করে তরীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাপার দাঁতে পোকা নেই তো।”

তরী বলল,
“তোমার পাপা তো ভোরে নামাজ পড়তে উঠে ব্রাশ করে ফেলেছে। তুমিই এখন বাকি।”

অমি গালে আঙ্গুল ডুবিয়ে কিছু একটা ভাবলো। বলল,
“আমি ব্রাশ করবো না। আগে দেখবো দাঁতে পোকা হলে কেমন লাগে।”

তরী কপাল চাপড়ে বলল,
“তুমি কি আমার ছেলে নাকি অরুর? স্বভাব দেখি তার মতোই হচ্ছে।”

মাহমুদ শব্দ করে হাসলো। বলল,
“জন্মের পর থেকেই তো অরু, রামি, মিঠুকে দেখে এসেছে। স্বভাবটা তাদের মতো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

★★★

অরুর পড়াশোনার পাশাপাশি রুটিনে আরও একটি বিষয় যোগ হয়েছে। রামির সাথে কথা বলা। একদিনও দুজনের ভালোভাবে কথা হয়না। প্রতিদিন কাটে ঝগড়ায়। ক্লাস শেষ দিয়ে বের হতেই একজন সহপাঠী এগিয়ে এসে বলল,
“অরু বিয়ে করে ফেলেছো?”

অপরজন বলল,
“আবির ভাইয়ার সাথে তো মাস দু-য়েক আগেই বিয়ে হলো তোমার। তাহলে৷ এখন আবার!”

অরু মৃদু হেসে বলল,
“যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তার সাথেই স্ট্যাটাস দেওয়া আছে। লোকমুখে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই।”

কাল রাতেই রামি ম্যারেড স্ট্যাটাস শেয়ার করলো। সেখান থেকেই সবাই অরুর বিয়ের ব্যাপারে অবগত হলো। যাদের মনে আবির পূর্বে সন্দেহ ছাড়িয়েছে, তাদের মনে প্রশ্ন জমা হচ্ছে। অরু পাশ কাটিয়ে চলে এলো। গোসল করে এসে প্রথমেই খেয়ে নিলো। আজ সকালেও খাওয়া হয়নি। পেটে প্রচুর খিদে ছিল। পড়তে পড়তেই চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো। টেবিলে মাথা রেখে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়লো অরু। তার ঘুম ভাঙলো রাত আটটায়। ফোনের শব্দে হুড়মুড়িয়ে উঠলো। রামির ফোন। সময় দেখে চোখ চড়কগাছ৷ জুমান তাকে একবারও ডাকে নি! মেয়েটার উপর মেজাজ খা*রা*প হলো। সেই মেজাজ ঝাড়লো রামির উপর। কল রিসিভ করেই ঝাড়ি দিলো,
“ভিডিও কল দিতে কে বলেছে? আমি এখন পড়াশোনা করবো।”

রামি আজ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। প্রতিদিন দুজন ঝ*গ*ড়া করেই কাটিয়ে দেয়। স্ক্রিনে অরুর ফোলা চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে। তৈলাক্ত মুখ, এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে চুল। এখন আর চোখে চশমা নেই। ঘুমানোর সময় খুলে রেখে দিয়েছে অরু। রামি এই এলোমেলো মেয়েটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এখন সে দেশের বাইরে আছে। গোসল করেই অরুকে কল দিল। শান্ত স্বরে বলল,“রেগে আছিস কেন?”

অরু উত্তর খুঁজে পেল না। হাই তুলে থমথমে গলায় বলল,
“রা*গ করতে যাবো কেন?”

মাঝেমাঝে অযথাই সবার উপর রাগ চলে আসে। অরু নিজেও রাগের কারণ স্পষ্ট খুঁজে পায়না। একজনের উপর রেগে থাকলে তা সবার উপর ঝাড়বে। রামি বলল,“তোকে দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছিস। পড়ার প্রেশার খুব বেশি?”

এবার রাগ গিয়ে পড়লো পড়ার উপর। রাগে গজগজ করতে করতে অরু বলল,
“জীবনে এত পড়া কেন থাকতে হবে? একটা বই থাকবে। মাসে দুই-তিনটা ক্লাস থাকবে, শেষ। এত কেন পড়তে হবে?”

রামি ঠান্ডা গলায় বলল,
“আচ্ছা মিঠু বা ভাইয়াকে বলে দিচ্ছি, কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়, ভালোলাগবে।”

“আমার সময় নেই।”

রামি ঠোঁট টিপে হাসলো। একটু আগে নিজেই পড়া থেকে বাঁচার উপায় বলছিল। এখন নিজেই পড়ায় ডুবে থাকতে চাইছে। অরু গরম চোখে তাকিয়ে বলল,
“হাসছো কেন তুমি?”

রামি বলল,
“এমন তেঁতুল গাছের ভূত হয়ে বসে থাকলে কী করবো? চুল বাঁধছিস না কেন?”

অরুর কেন যেন রাগ হলো না। গাল ফুলিয়ে বলল,
“চুল বাঁধার সময় পাইনি। ঘুম ভেঙেছে তোমার ফোনকলের শব্দে। এখন অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে বসে বসে। কালই জমা দিতে হবে। এখন ফোন রাখো।”

রামি বলল,
“আমি কলে থাকছি। তুই অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি কর।”

অরু কথা বাড়ালোনা। রামিকে কলে রেখেই একটা ক্লিপ দিয়ে চুল আটকে নিলো। চা বানিয়ে এক কাপ নিজের জন্য নিয়ে এলো। জুমানকে দিলো না। মেয়েটার উচিত ছিল তাকে জাগিয়ে দেওয়া। বিকেল থেকে মোট চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে অরু।
রামি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। অরুকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। যখন রেগে গিয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়ায় নামে, তখন তাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে ভীষণ ভালোলাগে রামির। ছোটো থেকেই সবার সাথে ঝগড়ায় পারদর্শী মেয়েটা। কিছু বললেই তেলে বেগুনে ছ্যাৎ করে ওঠে। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে করতে রাত দুটো বাজলো। এতক্ষণ কলে ছিল রামি। বিকেল চারটায় তার ফ্লাইং। অরুকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর জন্য এখান থেকে কিছু আনবো?”

অরু বই খুলে বসলো। একবার স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,
“কী আনবে? আমার তো এখন কিছু লাগবে না।”

রামি বলল,
“আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে যা। ভোরে উঠে পড়তে পারবি। এখন জেগে থাকলে ক্লাসে ঘুম পাবে।”

অরু বলল,
“আচ্ছা, এখন কল কাটো।”

“ঠিক আছে।” বলে রামি কল কেটে দিল।
সকাল দশটায় বের হলো শপিংমলে। অরুর জন্য পছন্দমতো বেশ কিছু কেনাকাটা করলো। অমি আর ঈশিতার জন্যও কেনাকাটা করলো। শপিংমল থেকে বের হওয়ার সময় চোখ গেল বাঁ দিকে। একটা কালো রঙের ড্রেস পছন্দ হলো। সেটাও অরুর জন্য নিয়ে নিল। এই প্রথম তার নিজের পছন্দে অরুর জন্য কেনাকাটা করা। রামি উৎফুল্ল মেজাজে কেনাকাটা করে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো দুপুরের খাবার খেতে।

#চলবে……

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আজ বাড়িঘর শান্ত। কোথাও বিন্দুমাত্র অমির শব্দ নেই। বাসায় থেকেও না থাকার মতো ঈশিতার পাশে বসে আছে ভদ্র বাচ্চা হয়ে। খটকা লাগলো ঈশিতার। আগাগোড়া অমিকে পর্যবেক্ষণ করে ভহরু কুঁচকে নিলো। সন্দীহান গলায় বলল,
“কী ব্যাপার অমি? আজ এত ভদ্র কেন?”

অমি নিষ্পাপ মুখশ্রী নিয়ে বলল,
“আমি কি দুষ্টুমি করি, ঈশু আপু?”

ঈশিতার কুঁচকানো ভুরু জোড়া শিথিল হলো। তার আর বুঝতে বাকি নেই অমি দ্যা গ্রেইট ভদ্র বাচ্চা কোন একটা অঘটন ঘটিয়ে এসে বসে আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় সে কখনোই ঈশিতাকে আপু বলে না। বাকিদের মতো ঈশু ডাকে। প্রথম প্রথম দাদু আপুর মুখ থেকে শুনে সবাইকে নাম ধরে ডাকতো। এখন অবশ্য ঠিক হয়েছে। ঈশিতা বলল,
“বল কী করেছিস?”

অমি ঈশিতার আরেকটু গা ঘেঁষে বসলো। বলল,
“তুমি আমায় ভালোবাসো না ঈশু আপু?”

ঈশিতা মুখ ভেংচি কে*টে বলল,
“তুই আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলিস? তোকে কেন ভালোবাসবো?”

অমি গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি তোমার একটা মাত্র ভাই। বলো, ভালোবাসো না?”

রান্নাঘরে এলো তরী। মিনিট দশেক পূর্বে এদিক থেকে
ঝনঝন করে কিছু পড়ার শব্দ পেয়েছিল। হাতে কাজ থাকায় উঠে আসতে পারেনি। রান্নাঘর চেক করে বুঝলো শব্দের উৎস রান্নাঘর নয়। বেরিয়ে যেতেই জুতার নিচে উঁচুনিচু কিছু অনুভূত হলো। তাকিয়ে দেখলো ফ্লোরে, আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিন্দু বিন্দু কাঁচের টুকরো। মাথা তুলে ডানদিকে শোকেসের দিকে তাকালো। আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে অমির বল খুঁজে পেল। তরী নিচু হয়ে আগে ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করলো। ছেলেটাই যে এই অকাজ করেছে, তার বুঝতে বাঁকি নেই। সবার আগে ইরার ঘর খুঁজলো। অমি কোন দো*ষ করলেই ইরার কাছে লুকিয়ে পড়ে। ইরাকে ঘুমাতে দেখে চলে এলো তরী। সেখানে অমি নেই। আয়েশা সুলতানার ঘরেও নেই। চুপিচুপি চলে গেল ঈশিতার ঘরে।

ঈশিতার সাথেই কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে অমি। তরী পেছন থেকে আলতো হাতে কান টে*নে ধরলো তার। কপট রা*গ দেখিয়ে বলল,
“শোকেসের গ্লাস কে ভেঙেছে?”

অমি কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
“আমার কান ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমি ব্যথা পাচ্ছি।”

সূঁচালো নজরে তাকিয়ে ছেলের নাটকবাজী দেখলো তরী। অরু থেকে কোন অংশে কম নয়। ঢিলে হাত আরেকটু ভিড়িয়ে ধরে বলল,
“খুব ব্যথা পাচ্ছো, না? শোকেসের গ্লাস কেন ভাঙলে?”

অমি অভিনয় বাদ দিয়ে সত্যিই কাঁদোকাঁদো চোখে তাকালো। কান্না মাখা গলায় বলল,
“আমি ভাঙিনি আম্মু। ঈশু ভেঙেছে।”
অতঃপর চোখ দুটোর আকার বড়ো করে বলল,
“এই দেখো, আমি দেখেছি, এই চোখদুটো দিয়ে দেখেছি।”

ঈশিতা হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের ঘাড়ে দো*ষ আসতেই নিজের হয়ে সাফাই দিলো তরীকে।
“মামনী আমি ভাঙিনি। মি*থ্যা বলছে অমি। আমি তো স্কুল থেকে ফিরে আর বের হইনি।”

তরী ঈশিতাকে ইশারায় শান্ত হতে বলল। অমিকে বলল,
“ঈশিতা তোমার বল বের করে গ্লাস ভেঙেছে, এটাই বলতে চাইছো?”

তরীর চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো অমি। ভয়কাতুরে চোখে তাকিয়ে বলল,
“ঈশু কিছু করেনি, আমিও করিনি। বিড়াল করেছে। আমি দেখেছি।”

তরী বেশিক্ষণ হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। আড়ালে মুখ লুকিয়ে হেসে অমির দিকে ফিরলো। গম্ভীর হয়ে বলল,
“বিড়ালের নাম কি অমি?”

অমি গাল ফুলিয়ে রেখেই উপরনিচ মাথা দুলিয়ে স্বীকারোক্তি দিল বিড়ালের নাম অমি।

★★★

দু-দিন ধরে পড়াশোনার ঝামেলায় কারো সাথেই কথা বলা হয়নি অরুর। রামিকেও পুরোদস্তুর ইগনোর করে গিয়েছে। আজ আর ইগনোর করা গেল না। কল রিসিভ করতেই রামির উৎকণ্ঠিত স্বর শোনা গেল,
“গত দুদিন তোকে কত কল, মেসেজ করেছি, তুই দেখিস নি?”

অরু শান্ত গলায় জবাব দিল,
“গত দুদিন একটু বেশিই প্রেশার ছিলো।”

ধমকের সুর শোনা গেল,
“তাই বলে তুই আমাকে জানাবি না? আমি টেনশনে আধ পাগল হয়ে গিয়েছি।”

অরু মিটিমিটি হেসে বলল,
“পাবনায় একটা সিট বুকিং দেব?”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ পেল অরু। রামি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখলো। মন্থর স্বরে বলল,
“দুটো সিট বুকিং দিবি, প্লিজ! আমার বউ না থাকলে ডাক্তাররাও আমাকে সামলাতে পারবে না।”

অরুর নিকট কথা খানা অতিরিক্ত ঠান্ডা শোনালো। জমাট বাঁধার মতো ঠান্ডা। রামির সাথে ওই হুটহাট ধমক আর ঝগড়াঝাটিতেই সে কম্ফোর্ট ফিল করে। এতটা কোমলতা তার সয় না। অরু তখন ভিন্ন জগতে চলে যায়। লজ্জারা তার নিকট ভয়ঙ্কর নিমন্ত্রণ প্রত্যাশা করে। নিজের সত্তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই অরু নিজেকে আঁকড়ে ধরে। লজ্জা থেকে বাঁচতে মুহূর্তেই ফিরে যায় নিজের রণচণ্ডী রূপে। তেতে উঠে বলল,
“আমি তোমার সাথে যাবো কোন সুখে? পা*গ*ল তো আমি নই, তুমি।”

রামি বলল,
“সে কি অরু। তুই এমন ছ্যাৎ করে উঠছিস কেন? আমি তো আমার বউয়ের কথা বলেছি। তুই কি আমার বউ, বল?”

অরু নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেল। চুপসে যাওয়া গলায় ইতিউতি করে বলল,
“তো? আমাকে ছাড়া আর কয়টা বিয়ে করেছো?”

“তুই আমার বউ? তাহলে আমায় প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছিস কোথায়? পুরোপুরি আমাকে ইগনোর করে যাচ্ছিস। যেন আমি কোন ব*খা*টে, তোকে দিনরাত বিরক্ত করি!”

অরু উঁচু গলা করে বলল,
“ব*খা*টে থেকে কম কীসে? নিজে সম্মান খোঁজো, আমাকে সম্মান দাও তুমি?”

“তোকে আমি কীভাবে অসম্মান করলাম?”

“এই যে, আমাকে তুই করে ডাকছো। এটা কি অসম্মান নয়?”

রামি অবাক হয়ে বলল,
“তো তোকে কী বলে ডাকবো?”

“আপনি ডাকবে। আমি ছোটো থেকেই তোমাকে বড়ো হতে দেখেছি।”

রামি ভেবে পেল না, কথাটা কি তার বলা উচিত ছিল না-কি অরুর! নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। সে তো ভুলেই গিয়েছে তার বউ অরু। আর কেউ নয়। সরকার যেখানে নারী, সেখানে তার কথার দুই টাকা মূল্য পাবে ধারণা করাও বোকামি। একে বিয়ে করার উচিলায় মিঠু তার কাছ থেকে মোবাইল হাতানোর অভিযানে নেমেছে। যু*দ্ধ ক্ষেত্রে অ*স্ত্র হিসেবে থাকছে ফোনকল। কন্ট্রাক করার সুযোগ হলেই ফোনের কথা মনে করিয়ে দেয় মিঠু। কেবল তরী আপু ছাড়া বাকি দুটোই ধান্ধা*বাজ । সে ফোন চেয়ে যাচ্ছে, অথচ তার বোনের পাত্তা দেওয়ার খবর নেই। অতিষ্ঠ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বড়ো আপা, আপনি আমায় ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখে বড়োই উপকার করেছেন। কিন্তু আপনাকে তুই বলার অপ*রাধ*বোধে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই।”

অরু গম্ভীর স্বরে বলল,
“বাড়ি এলে তোমার গর্দান নেওয়া হবে।”

রামির রাগি স্বর পাল্টে গেল। অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, গর্দানটা তোমার হাতেই নিও!”

অরু যেন কানে ভুল শুনলো। রামি তাকে একটু আগে কী বলে ডেকেছে! তুমি!

★★★

মিঠুর দৈনিক রুটিনে নতুন আরেকটি কাজ যুক্ত হয়েছে। রাতে সব কাজ গুছিয়ে সুহার বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। মেয়েটা বড্ড পা*ষা*ণ। কিছুতেই তার মন গলে না। মিঠুর মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে সুহার মুখ দিয়ে “হ্যাঁ” শব্দটি বের করা। সেই কখন থেকে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটিবার জানালায় পর্যন্ত আসছেনা।
কানে মুঠোফোন চেপে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বসে আছে। ব্যাকুল দৃষ্টি ঘুরেফিরে সুহার জানালায় গিয়েই নিবদ্ধ হচ্ছে।

অনেকক্ষণ যাবত সুহার ফোনে রিং হচ্ছে। সে ফোন তুলছেনা। কল কে*টে গিয়ে আবার রিং হচ্ছে। রাত গভীর হলেও শহরের মানুষগুলোর জন্য তেমন একটা সময় নয়। কয়েকদিন যাবত ইবতেসাম তার বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে কতদিন? বাড়িওয়ালা যদি জানতে পারে, রাত-বিরেতে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তার জন্য আসছে, তবে বাসা ছাড়তে বাধ্য করবেন। এমনিতেই সবাই জানে সে বিবাহিত, হাসবেন্ড দেশে নেই। এখন না আবার প*র*কী*য়া*র অভিযোগ উঠে তাকে বাসা ছাড়তে হয়! এতক্ষণের চঞ্চল মুঠোফোনটি নির্জীব হয়ে পড়ে রইলো। এখন আর কল আসছে না। পাঁচমিনিট এভাবেই অতিবাহিত হলো। সুহা ধীর পায়ে জানালার পাশে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। দেখতে চাইলো ইবতেসাম আছে কিনা? মানুষটি এখনও যায় নি। ঘরে মৃদু আলো জ্বালানো। জানালার পাশটা বলতে গেলে অন্ধকার। সেখানটায় খুব একটা আলো নেই। ওখানে দাঁড়িয়ে ইবতেসামকে দেখলো পলকহীন। ফোনেই কিছু একটা করছে। সুহার ফোন হাতেই ফোন ছিল। টুংটাং শব্দে নোটিফিকেশন আসতেই তার চমক কাটলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো সেই নাম্বার থেকে বার্তা এসেছে।
“দূর থেকে দেখছেন কেন, সুহা? আমি চাই আপনি খুব কাছ থেকে আমায় দেখুন। আপনি সেটা মানতে পারবেন না, অথচ আড়াল থেকে চোখের তৃষ্ণা মেটাবেন। তা তো হয়না, সুহা।”

সুহা থমকে গেল। ভেবেছিল প্রায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় তার অবয়ব বোঝা যাবে না। সে বুঝতেই পারলো না অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইবতেসামের চোখ সয়ে এসেছে। স্বল্প আলোয় সুহার ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জানালার পাশ থেকে সরে গেল না সুহা। ফোন কানে চেপে স্পষ্ট রাগ নিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো।

সুহার ফোন পেয়ে মিঠুর হাসি প্রশস্ত হলো। গভীর স্বরে বলল,
“বলুন সুহা।”

সুহা তেজী গলায় বলল,
“আপনার সমস্যা কোথায়?”

মিঠু বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বুজে হাসলো। ছোটো করে বলল,
“হৃদয়ে।”

“তবে আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত। ”

“আমি তো ডাক্তার দেখাতেই চাই। তবে কিছুতেই ডাক্তরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছি না।”

সুহা রাগে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো। শান্ত গলায় বলল,
“আপনি জানেন,আমি অন্য কাউকে ভালোবেসেছি।”

মিঠু চোয়াল শক্ত করে নিলো। কঠিন গলায় বলল,
“সে আপনার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমি হতে চাই, এবং হবো।”

সুহা বলল,
“আমি যদি আপনার না হয়ে অন্যকারো হয়ে যাই?”

মিঠুর স্বরে দৃড়তা, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
“আমি হীন অন্য কোন পুরুষ আপনার না হোক। কেবল আমার বুকেই আপনার ঠাঁই হোক। ”
#চলবে…..