অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-২৪+২৫

0
237

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

প্রকৃতিতে শীতের আগমন। তবুও যেন হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে চমকে দিচ্ছে। ঝিরিঝিরি মন মাতানো প্রেমের বৃষ্টি। সুহা অফিস শেষ করে বের হলো মাত্র। মিঠু গাড়ির কাঁচ নামিয়ে তার দিকে তাকিয়েই বসে আছে। সুহা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলো। পিছু ডাকলো মিঠু।
“সুহা, আমি অপেক্ষা করছি তো।”

না চাইতেও একবার পেছন ঘুরে তাকালো সুহা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি যেতে পারবো। সাথে অবনি আছে।”

মিঠু বলল,
“অবনির এভাবে একা চলাফেরা উচিত নয়। বলুন বিয়ে করে নিতে। আর আপনার জন্য তো আমি আছিই।”

অবনি বলল,“চলাফেরা করতে হলে বিয়ে করতে হবে কেন?”

মিঠু বলল,“আশেপাশে শকুন থাকে।”

অবনি ফোঁড়ন কে*টে বলল,“আপনিও বুঝি শকুন?”

সুহা কড়া সুরে বলল,
“বড্ডো বেশিই কথা বলেন আপনি।”

“আপনি চুপচাপ গাড়িতে বসলেই তো আর আমার কথা বলার প্রয়োজন পড়ছে না।”

সুহা চারপাশে সাবধানী চোখে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দিল। অবনিকে বলল,
“তুই বাসায় যা, আমি আসছি।”

অবনিকে বিদায় দিয়ে মিঠুর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। মিঠু ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। ফ্রন্ট সিটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিতেই মিঠু ভুরু উঁচিয়ে তাকালো। সুহা কিছু বুঝতে না পেরে শুধালো,“কী, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“আপনাকে সিট বেল্ট কে বাঁধতে বলেছে? আমাকে কি চোখে পড়ছে না?”

সুহা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। রিমঝিম বৃষ্টিতে গাড়ি অবনির বাসার রাস্তা না ধরে অন্যদিকে ঘুরলো। সুহা জিজ্ঞেস করলো,
“এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”

কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে মুখ ভিজে আছে সুহার। ঝলমলে মুখশ্রী, দৃষ্টি স্বচ্ছ। চোখের চাহনি কতটা গভীর। মিঠুকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে সবকিছু। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না সে। ড্রাইভিং এ আছে। এই মুহূর্তে একটা অ*ঘ*ট*ন ঘটে যেতে পারে। তার আগেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সুহা জবাব না পেয়ে দ্বিতীয়বার আর জিজ্ঞেস করলো না। সামনের কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা নেমে যাচ্ছে। এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সুহা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তুমুল বর্ষণে রূপ নিলো। সাথে বাড়লো ঠান্ডার প্রকোপ। ওড়নাটা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে নিলো। মিঠু বৃষ্টির গতি দেখে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ সুহার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“বেশি ঠান্ডা লাগছে?”

একটা ওড়নায় শীত নিবারণ হচ্ছে না। তবুও সুহা চুপচাপ রইলো। মিঠু বুঝতে পারলো ঠান্ডা লাগছে সুহার। তার নিজের কাছেও লাগছে। বাড়তি কোন কাপড়ও নেই, যা সুহাকে দিতে পারবে। সুহা আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার ঠান্ডা লাগছে না?”

সুহার কাছ থেকে এই প্রশ্নটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। মিঠু ভারি অবাক হলেও পরক্ষণে প্রফুল্লচিত্তে হাসলো। ধীর গলায় বলল,
“এখন একটুও ঠান্ডা লাগছে না। বিশ্বাস করুন!”

সুহা জড়োসড়ো হয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসলো। প্রশ্নটা সে মানবিকতার দিক থেকেই করেছে। কিন্তু পাশের মানুষটার রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে সে দু-একটা চুমু দিয়ে বসেছে।
মিঠুর কথায় তার দিকে ফিরতে বাধ্য হলো সুহা। সে বলল,
“আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে সুহা। একটু কাছে এসে বসবেন?”

মিঠুর এমন আবদারে সুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমায় বাসায় দিয়ে আসুন। আপনিও বাসায় যান৷ ঠান্ডা কমে যাবে।”

মিঠু সুহার কথা উপেক্ষা করে বলল,
“বৃষ্টিতে ভিজবেন?”

সুহা কাঠকাঠ জবাব দিলো,“না।”

“বৃষ্টি আপনার পছন্দ না?”

“এখন ভেজার ইচ্ছে নেই।”

মিঠু সুহার চোখে চোখ রেখে অনুরাগী স্বরে বলল,
“বিয়ের পর দুজন ভিজবো, একসাথে। তখন কিন্তু কোন বারণ শুনবো না আমি।”

সুহা শক্ত থাকতে গিয়েও বারবার দুর্বল হয়ে পড়ে। সে এত সহজে ধরা দিতে চায় না। আরেকটু বুঝতে চায় মিঠুকে। বৃষ্টির তেজ কমতেই মিঠু গাড়ি স্টার্ট করলো। ধীরে ড্রাইভ করছে। যেন তাড়াতাড়ি পথ না ফুরিয়ে যায়। অবনির বাসা আসতেই গাড়ি থেমে গেল। সুহা নেমে বাসার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার পিছু ফিরে এলো। মিঠু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সুহা দু-কদম এগিয়ে বলল,“একদম বৃষ্টিতে ভিজবেন না।”

মিঠু আলতো হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। সুহা ফিরতে গিয়ে আরও একবার পিছু ফিরলো। মিঠু অপলক তাকিয়ে রইলো। আজ মনের কালো মেঘগুলো কে*টে গিয়েছে। কেন যেন মনে হলো সুহার মনে তার জন্য একটু হলেও জায়গা আছে!

★★★

অরু ফোন হাতে বসে আছে। রামিকে বলল,
“তুমি তো দুদিন পর আসবে। আমি তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করবো। আমার খুব শখ ড্রাইভ করে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসা।”

রামির চোখ কপালে। বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,
“তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? ড্রাইভিং ও তো জানিস না। না জানি দুদিন পরই আমার শেষদিন হয়! সাথে পুলিশের ঝামেলা তো আছেই।”

অরু সূঁচালো নজরে তাকিয়ে রইলো। রামি বলল,
“কী? ভুল কিছু বলেছি? সেবার মনে নেই? বাড়ির সামনের রাস্তায় কী করেছিস! আমি আর মিঠু ছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছিস। অন্যকেউ থাকলে তোকে মে*রে আলুভর্তা বানিয়ে দিতো।
ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে গাছের সাথে গাড়ি মে*রে দিয়েছিস।”

“তো? শিখতে গেলে এমন একটুআধটু হয়ই।”

“তুই যেখানে ড্রাইভিং টাই জানিস না, সেখানে আমাকে ড্রাইভ করে বাসায় নেওয়া বিলাসিতা।”

“তবুও আমি বিলাসিতা করতে চাই।”

“তোর বিলাসিতার জন্য আমি ম*র*তে পারবো না।”

“ম*র*তে কে বলেছে? বড়োজোর হাত-পা ভাঙবে। তোমার জন্য বরং ভালোই হবে। বেশ লম্বা একটা ছুটি পাবে।”

“কোন বউ স্বামীর হাত-পা ভাঙা কামনা করে? তোর মতো ডা*কা*ত আমি দুটো দেখিনি।”

“অন্যদিকে চোখ দিলে, একেবারে চোখ তুলে অন্ধ বানিয়ে রাখবো। তখন দুটো কেন, একটা ডা*কা*তও দেখার সৌভাগ্য হবে না।”

রামি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“না, দেখছি অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”

“আমাকে আবার বিয়ে দেবে না-কি? ছেলে ঠিক করেছো? দেখি, ছবিটবি দেখাও। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে না! প্রথমবার নাহয় সবাই গরু ধরে বিয়ে দিয়েছে। এবার আর তেমন ভুল চাই না।”

রামি কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“খুব বিয়ে করার শখ তোর, না? আমি একবার বাড়ি এসে নিই, তারপর তোর বিয়ে করার শখ মেটাচ্ছি।”

রামি কল কে*টে দিল। অরু কল ব্যাক করলেও রামি ফোন তুললো না। দুদিন আর কোন কল দেয়নি, না অরুর কল মেসেজের রিপ্লাই করেছে।

রামি বাসায় ফিরবে। অরুর তখন ক্লাস। তাই এবার আর ইচ্ছে পূরণ হলো না। রামি প্রতিবারের মতো বাসায় পৌঁছে গেল। সবার সাথে দেখা করলেও অরুর সাথে দেখা হলো না। সারাদিন গড়িয়ে বিকেল গড়ালো। তারপর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। অরু এ বাসায় আসলো না। রামি প্রচন্ড রেগে আছে। সেদিন অযথাই রাগ উঠিয়ে দিল, এখন রাত হয়ে গেল, অথচ তার দেখা নেই। রাতের খাবার খেয়ে গম্ভীরমুখে রুমে ফিরে গেল। অরুর কল পেয়েও ধরলো না। মেসেজ আসতেই চেক করলো।
❝ছাদে আসো।❞

রামি যাবে না বলে ঠিক করলো। পরক্ষণেই চিন্তা হলো একা একা নিশ্চিয়ই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ঝটপট ছাদে পা বাড়ালো। অরু তাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। রামি ছাদে উঠতেই তারদিকে একটা কাগজ ছুঁড়ে মা*র*লো। কাগজ এসে পড়লো রামির শরীরে। ছাদের লাইট জ্বালানো। আলোতে কাগজ মেলে ধরলো রামি।
“হেই বালক, ডেটে যাবা?”

রামি কাগজ সরিয়ে অরুর দিকে তাকালো। দেখলো মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে। রামি কাগজ ছুঁ*ড়ে ফেলে বলল,
“লজ্জা করে না বখাটেদের মতো আচরণ করতে?”

“তোমাকে দেখলে আমার লজ্জা করে না জান। প্রেম প্রেম পায়।”
বলে চোখ মা*র*লো অরু।
রামি একটা চিকন রড তুলে নিলো নিচ থেকে। এটা দেখিয়ে বলল,
“মা*র না খেতে চাইলে এখান থেকে যা। বরের সাথে ফ্লার্টিং। কতবড়ো সাহস!”

অরু দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল। রামি রাগ ধরে রাখতে চাইলেও পারলো না। অরু নেমে যেতেই হেসে ফেললো। অরুকে বোঝাতে হবে সে এখনো রে*গে। ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নিচে নেমে এলো। নিজের ঘর পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে এলো কলিংবেলের শব্দে। এতরাতে কে হবে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলেই থমকে গেল। অরু দাঁড়িয়ে আছে, তাও আবার শাড়ি পরে। তাকে সরিয়ে দিয়ে সোজা রামির ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
রামি দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে গম্ভীর স্বরে বলল,
“এসব কী শুরু করেছিস? রাত বিরেতে শাড়ি পরে আমার ঘরে কী?”

অরু দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ধীরে ধীরে কাছে এসে বলল,“রা*গ কমেনি এখনো? দেখ আমি শাড়ি পরেছি। সুন্দর লাগছে না?”

রামি ঢোক গিললো। রাগের অভিনয়ট টুকুও ঠিকমতো ধরে রাখতে পারলো না। অরুর দিকে দু-কদম এগিয়ে অরুর গালে হাত রাখলো। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“কেন এত জ্বালাচ্ছিস অরু?”

অরুর মিটিমিটি হাসি ভয়ঙ্কর শব্দে রূপ নিলো। চমকে উঠলো রামি।
“হাসছিস কেন?”

অরু বলল,
“আমি যাচ্ছি।”

“যাচ্ছি মানে?”

অরু হাসতে হাসতে বলল,
“তুমি কতক্ষণ আমার উপর রাগ ধরে রাখতে পারো এটাই দেখার ছিলো। দেখা শেষ, এবার আমি যাচ্ছি।”

অরু বেরিয়ে গেল। রামি পেছন থেকে বলল,“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না অরু। আমাকে জ্বালিয়ে কী শান্তি পাচ্ছিস?”

অরু ছুটে বেরিয়ে গেল। বাসায় এসে শাড়ি খুলে ফেললো। সাহস করে গিয়েছে। কিন্তু রামির কাছে আসায় প্রচন্ড লজ্জা হচ্ছিল। ভাবতে পারেনি রামি এত সহজে গলে যাবে। তাই তো দ্রুত কে*টে পড়েছে।

#চলবে………

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

গতরাতের ঘটনার পর আজ পুরোটা দিন অরু পালিয়ে বেড়ালো রামির কাছ থেকে। অথচ রামি তাকে খুঁজতে একটিবারের জন্যেও তাদের বাসায় আসেনি। মস্তিষ্ক বলে ‘বেঁচে গিয়েছিস অরু। রামি ধরতে পারলে রক্ষে থাকবে না।’
অথচ মন কোথাও একটা চেয়ে বসলো রামি তাকে খুঁজতে আসুক। পুরো দিন কে*টে গেলেও রামির দেখা নেই। খানিকটা অবাক হলো অরু। আয়েশা সুলতানা অরুকে বাসায় ডাকলেন। সন্ধ্যার পর শাশুড়ির ডাকে উপস্থিত হলো এ বাসায়। আয়েশা সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন,
“কাল থেকে এ বাসায় তোকে আসতে দেখলাম না। কী ব্যাপার?”

অরু মিথ্যে বলল,“পড়ার চাপ তো, তাই।”

আয়েশা সুলতানা মেকি ধমক দিলেন।
“রাখ তোর পড়াশোনা। চা*প তো প্রতিদিনই থাকে। এ দু’দিন একেবারে কী এত চা*প হয়ে গিয়েছে?”

অরু মাথানিচু করে নিলো। আয়েশা সুলতানা পরপরই অরুকে টে*নে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বললেন,“রাগ করেছিস?”

অরু দু’দিকে মাথা দুলিয়ে জানান দিলো সে রাগ করেনি। হাসলেন আয়েশা সুলতানা। বললেন,“এ বাসা আর ও বাসা কী? দু’টোই তো এক। তাহলে এ বাসায় আসতে সমস্যা কোথায়?”

অরু এখন কীভাবে শাশুড়িকে বোঝাবে সে কেন আসে নি। একেবারে যে আসেনি, তেমনটাও না। গতরাতেই এসেছে। এটা বলবে কীভাবে? সে নিশ্চুপ রইলো। আয়েশা সুলতানা অরুর চুপ থাকা দেখে বললেন,“যা, সবার সাথে গিয়ে গল্প কর।”

অরু ধীর পায়ে উঠে দরজা পেরিয়ে একবার পেছনে তাকালো। আয়েশা সুলতানার চোখের আড়াল হতেই পায়ের গতি বাড়লো। হরিণীর মতো লাফিয়ে চললো রামির ঘরে। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো ঘর একদম ফাঁকা। তাই ছুটলো তরীর কাছে। অমি বিছানায় খেলনা ছড়িয়ে খেলছে। অরু ডাকলো তাকে,
“এই পুঁচকে, এই দিকে আয়।”

অমির নাকমুখ কুঁচকে গেল ‘পুঁচকে’ শুনে। সে-কি ছোটো বাবু? মুখ গোমড়া করে বলল,“আমি পুঁচকে না।”
দু’হাত ছড়িয়ে বিশাল পরিমাপ দেখিয়ে বলল,“এত্ত বড়ো আমি।”

অরু এগিয়ে এসে বলল,“তাহলে আমায় কোলে নে।”

“বাবা গো! তোমাকে কোলে নিলে আমি তো ম*রে*ই যাবো। তখন আমার পাপা আর আম্মু ছোট্ট অমিসোনা পাবে কোথায়?”

তরী ছেলের পাঁকা কথায় মিটিমিটি হাসছে। অরু মুখ ভেংচি কে*টে বলল,“তাহলে নিজেকে বড়ো দাবি করিস কীভাবে? উনি না-কি বড়ো, হুহ!”
শেষ কথাটা ব্যঙ্গ করেই বলল অরু। অমি রেগে নাক ফুলিয়ে ফেললো। কথা বলতে গিয়েও কেমন হাঁপাচ্ছে। বলল,“আমার মেজাজ ঠান্ডা হচ্ছে কিন্তু।”

অরু, তরী দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। অমি সবসময় মেজাজ গরমকে মেজাজ ঠান্ডা বলে থাকে। অমি রাগে কেঁদে ফেললো। তরী আর অরুকে ঠে*লে বিছানা থেকে উঠিয়ে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিল। লক করতে না পেরে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন অরু বা তরী কেউ ঘরে ঢুকতে না পারে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দু-বোন সমান তালে হেসে চলেছে। পেছন থেকে মাহমুদের শান্ত স্বর শোনা গেল।
“দু-বোনের এভাবে হাসাহাসির কারণ কী? আমিও কি আপনাদের সাথে সামিল হতে পারি?”

তরী ঠোঁটে চওড়া হাসি ধরে রেখেই অমির কাণ্ডকীর্তি বর্ণনা করলো। মাহমুদ শব্দহীন হাসলো। তরীর এখনো মাহমুদের হাসি সেই প্রথমদিকের দিন গুলোর মতোই চমৎকার লাগে। মনে হয় মাহমুদের ঠোঁটের পাশাপাশি চোখদুটোও চিকচিক করে হাসে। অরুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে মাহমুদ বলল,“অরুর ভাগ্নে বলে কথা। সে যেমন আমায় ছাদে আটকে রেখেছিল, আমার ছেলেও তেমন করে দু-বোনকে বের করে দরজা আটকে দিয়েছে।”

তরীও মাহমুদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে। অরু হাসির মাঝেও তেজী গলায় বলল,“ঠিকই তো করেছি। তুমি কীভাবে উঠেপড়ে লেগেছিলে আমায় বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিতে।”

মাহমুদ অরুকে রা*গা*তে বলল,“এখনোও বুড়োবরই পেয়েছো। রামিকে কি বুড়ো মনে হয় না?”

অরু মাহমুদের কথার ঘোর বিরোধিতা করলো,
“মোটেই না। কোনদিক থেকে তাকে বুড়ো মনে হয়?”

মাহমুদ এবার শব্দ করে হাসলো। তরীকে শুনিয়ে বলল,“শুনেছো তরী, অরুর কী মায়া তার বরের জন্য। শুধু তুমিই আমায় কদর করলে না!”

অরু বিড়বিড় করে বলল,“কদর না করলে অমি নামক এটম বো**ম কোথা থেকে ডাউনলোড হলো? আকাশ থেকে উড়ে উড়ে কোলে এসে জুড়ে বসেছে?”

মাহমুদের কানে কথাখানা পৌঁছাতেই সে কেশে উঠে পাশ কাটিয়ে গেল। দরজায় করাঘাত করে বলল,“পাপা এসেছি বাবা, দরজা খুলবে না?”

অমি দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই মাহমুদ ভেতরে প্রবেশ করলো। অমি বলল,“পাপা দরজা লক করে দাও। অরু আর তরী দুষ্ট মেয়ে দুটোকে ঢুকতে দেব না।”

মাহমুদ ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে দরজা লক করে দিল। ইরা, তরী রাতের খাবারের ব্যবস্থায় রান্নাঘরে ঢুকলো। অরু গেল ঈশিতার ঘরে। ঈশিতা পড়ছে। অরু তার বিছানায় বসলো। চুপচাপ বসে থাকতে গিয়ে ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ঈশিতার বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়লো। রাতের খাবার খেতে ঈশিতা, তরী অনেক ডাকাডাকি করেও অরুকে তুলতে পারেনি। সবাই খেতে বসেছে। সাদাদ, রামি সকলেই বাসায় এসেছে। খাবার টেবিলে উপস্থিত। আয়েশা সুলতানা তরীকে জিজ্ঞেস করলেন,“অরু কোথায়? খাবে না?”

“ঘুমাচ্ছে, অনেক ডাকাডাকি করেও লাভ হলো না।”
আয়েশা সুলতানা আর তরীর কথপোকথনে রামি জানতে পারলো অরু এ বাসাতেই আছে।
আয়েশা সুলতানা বললেন,
“না খেয়ে কীসের ঘুম? যাও, ডেকে নিয়ে আসো।”

তরী হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,“অনেক তো ডাকলাম। উঠবে বলে মনে হচ্ছে না।”

রামি বলল,“তোমরা খাওয়া শুরু করো, আমি ডেকে আনছি।”

তরী বলল,“ওঁ ঈশুর ঘরে ঘুমাচ্ছে।”

রামি চেয়ার ছেড়ে ঈশিতার ঘরে ঢুকলো। চুলে চোখমুখ ঢেকে আছে অরুর। একটা বালিশ জড়িয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। রামি পাশে বসলো। অরুর মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে নরম স্বরে ডাকলো,“অরু।”

চুল সরানোয় মুখের উপর কারো ছোঁয়া পেয়ে নড়েচড়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে গেল। রামি নিচু গলায় আরও কয়েকবার ডাকলো,“অরু, এ্যাই অরু। চল খেয়ে তারপর ঘুমাবি।”

অরু ঘুমঘুম গলায় চোখ বন্ধ রেখেই বলল,“আমি খাবো না।”

রামি বলল,“খাবো না বললে কীভাবে হবে? শক্তি না থাকলে লাফাবি কী করে?”

ঘুমকাতুরে অরু বুঝলো না রামি তাকে সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে বসেছে। সে তখনো নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। রামি এবার ধমক দিল।
“এ্যাই অরু, ওঠ। মা*র খেতে মন চাচ্ছে?”

আচমকা ধমকে ধড়ফড়িয়ে উঠলো অরু। মাথা ভার ভার লাগছে। ঝাপসা চোখে রামির দিকে তাকাতেই দ্বিতীয় ধমকে কেঁপে উঠলো,“এতক্ষণ ধরে ডাকছি, আপু ডেকে গেল। তুই সবাইকে উপেক্ষা করে ঘুমাচ্ছিস? যা হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”

অরু উল্টো ঝাড়ি দিয়ে বলল,“খাবো না আমি। আমাকে ঘুম থেকে তুলেছো কেন?”

রামি শীতল চোখে তাকালো। ধীর অথচ নিরেট শোনালো কন্ঠস্বর। বলল,
“সবার আদর পেয়ে খুব মাথায় চড়েছিস। ভেবেছিস কেউ তো আমায় কিছু বলছেই না। যা ইচ্ছে করবো। সহ্যের একটা সীমা থাকে অরু। অতিরিক্ত কিছুই ভালো নয়। দ্রুত খেতে আয়।”

রামি বেরিয়ে গেল। অরু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রামির কথায় আজ প্রথমবারের মতো কষ্ট পেল সে। এই যে সবাই তাকে রাগানোর জন্য নানা কথা বলে, অরু রাগ করে না। মিছেমিছি ক্ষে*পে যাওয়ার অভিনয় করে সবার সাথে দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। এই পর্যন্ত রামি তাকে যতবারই ক্ষে*পি*য়ে*ছি একটিবারও অরুর খা*রা*প লাগে নি। আজ অজান্তেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে।
সত্যিই তো বয়সের তুলনায় সে অতিরিক্ত চঞ্চলতা প্রকাশ করে। ছোটোবেলায় মায়ের মৃ*ত্যু*র কারণেই বোধহয় সকলে তাকে মা হা*রা বলে অতিরিক্ত আদর দিয়ে বড়ো করেছে। শাসন পায়নি বললেই চলে। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে থাকা মিঠু পর্যন্ত বোনের কাছে এলে ঠান্ডা হয়ে যেত। এখনো মিঠুর আচরণ তাকে মনে করিয়ে দেয় সে সেই ছোট্ট অরু। সবার আচরণে সে ভুলেই বসলো দিনদিন তার বয়স বাড়ছে। যদিও পরিবারের বাইরে সবার কাছে সে ম্যাচিউর একটা মেয়ে। অজান্তেই অরুর চোখ ভিজে এলো। দ্রুত চোখ মুছে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে খাবার টেবিলে বসলো। সকলের খাওয়া প্রায় অর্ধেক শেষ। অরু বসতেই তরী খাবার বেড়ে দিল। খাবারে হাত নড়াচড়া করছে অরু। অনেকেরই চোখ পড়লো তার উপর। মাহমুদ শুধালো, “খাচ্ছো না কেন অরু?”

অরু কথা এড়িয়ে বলল,“ঘুম থেকে উঠে এভাবে খেতে ভালোলাগছে না।”
রামি একপলক অরুকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,“সব খাবার শেষ করে ঘুমাতে যাবি। কোন অনিয়ম চলবে না।”

অরু কথা বললো না। অল্প একটু খেয়ে উঠে গেল। রামি ভালোভাবেই অরুর মন খা*রা*প লক্ষ করেছে।
মনে মনে নিজেকে বেশ কয়েকবার দো*ষা*রো*প*ও করেছে। সে হয়তো ঠিকভাবে অরুকে বোঝাতে পারেনি। অরু সবার উদ্দেশ্যে বলল,“আমি বাসায় যাচ্ছি।”

ইরা বলল,“এখানে কী সমস্যা? তোমার বর এ বাসায়, তুমি ও বাসায়।”

আয়েশা সুলতানা টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন। ছেলে-বড়দের মাঝে থেকে আপাতত কাজ নেই। মাকে চলে যেতে দেখে রামি বলল,“পরে যা।”

অরু দ্বিরুক্তি করলো না। চুপচাপ মেনে নিয়ে রামির ঘরে চলে গেল। রামি স্পষ্ট টের পেল অরুর অভিমান। অন্য সময় হলে অরু তার মুখের উপর না করে দিয়ে নিজেদের বাসায় চলে যেত। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সে-ও খাবার টেবিল ছেড়ে ঘরে এলো। অরু নিস্তেজ ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে। কিছুক্ষণের মাঝেই মেয়েটাকে কেমন প্রাণহীন দেখালো। রামি চুপচাপ পাশে বসে অরুর হাত আঁকড়ে ধরলো। অরু বিন্দুমাত্র বাঁধা দিলো না। তবে আগ্রহও প্রকাশ করলো না। রামি ক্রমশ কোমল হলো। ভীষণ আদুরে হলো স্বর।
“রা*গ করেছো? খাবারদাবারে অনিয়ম করলে এসব দেখার দায়িত্ব কার? কে বকাঝকা করে তোমায় ঠিক করবে,বলো? আমিই তো।”

অরু স্বাভাবিক থাকতে গিয়েও কথায় কিছুটা অভিমান প্রকাশ পেল।
“আমাকে খুব কষ্টে সহ্য করো, তাইনা? আমি রাগ করিনি। তুমি ঠিকই বলেছো। আমিই ভুলে বসেছি আমার বয়স বাড়ছে।”

রামি দিশেহারা হয়ে পড়লো। মেয়েটাকে বোঝাতে গেল এক আর হচ্ছে আরেক। অরু খাবারদাবারের ব্যাপারে ভীষণ অমনোযোগী। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সবদিক দেখার দায়িত্ব তার। সে হিসেবেই দুটো কথা বলে ফেলেছে। এখন পস্তাতে হচ্ছে। রামি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো অরুকে।
“নিজেকে পরিবর্তন করার কথা আমি বলিনি অরু। তোকে সবাই এভাবেই ভালোবাসে। আমি শুধু তোর নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কথা বলেছি।”

অরু গাল ফুলিয়ে বলল,“এমনিতেও আমার নিজেকে পরিবর্তন করা উচিত।”

রামি অস্থির স্বরে বলল,“একদম না অরু। তোমাকে আমি এভাবেই সবসময় দেখতে চাই। গতকাল যে তুমি আমায় নাকে দড়ি দিয়ে পালিয়ে গেলে, আমি কিছু বলেছি তোমায়? তাহলে একটুখানি বকাঝকায় কেন রাগ করে আছো? আমার কি তোমাকে শাসন করার অধিকার নেই?”
অরুর অভিমান কমেছে। রামির বকাঝকা করার কারণ বুঝতে পেরে নিজেই নিজের উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনার জন্য অনুতপ্ত হলো। ছোট্ট করে বলল,“সরি!”

“তুমি কেন সরি বলছো?”
বলে রামি আরেকটু কাছাকাছি এগোতেই অরু পলক ঝাপটালো। নিজেদের মধ্যকার ক্ষীণ দূরত্ব অনুভব করে জমে গেল। এতক্ষণে সে টের পেল রামি তাকে সেদিনের মতো তুমি সম্বোধনে ডেকেছে। অরু ভীত চোখে তাকিয়ে হড়বড়িয়ে বলল,“আমি ভালো হয়ে যাব। আর কোনদিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবো না।”

রামি মিটিমিটি হেসে বলল,“কিন্তু আমি তো ভালো হবো না। কাল মিসেসের দিন ছিল, আজ আমার।”

ঘাড়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই নিজের জামা শক্ত করে খামচে ধরলো অরু। প্রেমের উষ্ণতা ক্রমশ গাঢ় হলো।

মধ্যরাত। শীতের তীব্রতা হু হু করে বাড়ছে। বারান্দায় একই চাদর গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রামি কোমল স্বরে বলল,“ভেতরে চল্, এভাবে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

অরু ঘুরে দাঁড়ালো। চাদরের নিচ দিয়েই রামির বুকে মুখ গুঁজে আহ্লাদী স্বরে বলল,“আরেকটু থাকি।”

রামি বলল,“কেউ যদি সকালে ক্লাসে না যেতে পারে, তখন যেন আমার দো*ষ না দেয়।”

অরু চোখ পাকিয়ে বলল,“তো কার দো*ষ?”
রামি ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“আমার একার দো*ষ?”
চাদর সরিয়ে অরু বেরিয়ে গেল। মুখ গুঁজে রুমে ফিরতে ফিরতেই বলল,“যাও তো।”
রামি হাসতে হাসতে চাদর ভাঁজ করে এসে অরুর পাশে শুয়ে পড়লো।
#চলবে………