#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:২১+২২
পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের জায়গা মায়ের কোল। কিন্তু সেই সৌভাগ্যটা অনেক বছর পূর্বেই হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আমি সুখে। মায়ের ভালোবাসাগুলো বাবা পূরণ করে দেওয়ার চেষ্টা করে সর্বক্ষণ।
বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি আমি। শুধু আমি নই, জয়াও। দু’জনে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। বাবা ছোটবেলার মতো রাজপুত্রের কল্পকাহিনী বলছেন। যখন গল্পের মাঝখানে ছিলেন তখন কেবিনে ঢুকলেন রৌধিক। সাথে দুজন নার্স। তারা আমার সমস্ত জামা কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছেন। রৌধিক এগিয়ে এলেন। তার হাতে দুই কাপ চা। বাবার নিকট এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন। অন্যকাপ জয়াকে। বাবা তা দেখে বলেন,” কী করছ? তুমি খাবে না?”
“আমি কফি ছাড়া আর কিছু খাই না।”
তুই তো বেডা, করলার রসই খাবি। চা তো মিষ্টি পানীয়। খাবি কীভাবে? তোর গলা দিয়ে নামবে? ঢং!
টুল টেনে সামনের বসলেন। উঠে বসলাম আমি। আমাকে উঠতে বারণ করে বললেন,
“জোনাকি, টেইক রেস্ট। উঠতে হবে না।
বাবা আমি জোনাকিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আপনার অনুমতি দরকার।”
বাবা একগাল হাসলেন। অফুরন্ত হাসিমাখা মুখ নিয়ে বললেন, ” তোমাদের বাড়ির বউ। তোমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারো।”
রৌধিক ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরলেন কিয়ৎক্ষণ। কিছু বলার প্রয়াস করেও শব্দ মেলাতে পারছেন না। টেনে টেনে বললেন, ” আমি আপনার ছেলের মতো নই, আপনার একটা ছেলে। আমি আপনার মেয়েসহ আপনার পরিবারের দায়িত্ব নিতে চাই।”
বাবা দ্বিমত পোষণ করলেন। আত্মসম্মানের প্রশ্ন এখানে। রাজি হতে পারছেন না। রৌধিকও নাছোড়বান্দা। বাবাকে অনেক কথা বুঝিয়ে অবশেষে রাজি করলেন। ততক্ষণে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছেন নার্সরা। ড্রাইভারও চলে এসেছেন ব্যাগপত্র নিতে। রৌধিক মালপত্র ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন,
“বাবা আর জয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এইগুলো বাড়িতে রেখে আসবেন।”
ড্রাইভার যেতেই রৌধিক বাবাকে আলিঙ্গন করলেন। জয়াকে এক বক্স চকলেট উপহার দিল। জয়া আকাশের চন্দ্রটা হাতে পেল এমন উচ্ছাস প্রকাশ করল। আমি নামতে নিলে রৌধিক থামিয়ে দিলেন। হুট করে কোলে তুলে হাঁটা দিলেন। গলায় স্বর নত। তবুও মুখ ফুলিয়ে বিনা শব্দে শুধালাম,
“নামান আমাকে। আমি হাঁটতে পারবো!”
“আমি জানি তুমি হাঁটতে পারবে। পারলে কথা বলে দেখাও। দেখি কত পারো? পারবে কী?”
থেমে গেলাম আমি। রৌধিকের মুখের দিকে বিনা বাধায় চেয়ে আছি। অগোছালো চুলগুলোর মাঝে ঝাপসা রোদ চিকচিক করছে মুখে। নীলাভ রঙের তিলটা জ্বলজ্বল করলে লালচে হয়। এই প্রথম নয়, আমি তার কাছাকাছি। তবুও একেক সময়ে একেক রকমের দেখতে লাগে। আমি কী সাধে তাকে গিরগিটি বলি। এরজন্যই তো বলি। তিনি গিরগিটির খালাত ভাই। হি! হি! হি!
আলাদা গাড়িতে করে আমি আর রৌধিক বেরিয়ে এলাম। গাড়ি এসে থামালেন অফিসের সামনে। আমি বাড়ি মনে করে, বাইরে একনজর তাকালাম। কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা দেখে বুঝলাম। বাকহীন আমি রৌধিকের মুখের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে রইলাম। রৌধিক পুনরায় কোলে তুলে নিলেন। শব্দ করে পা ফেলতে ফেলতে বললেন, ” আমার ছোট একটা কাজ বাকি আছে, সেটা করতে হবে।”
আমাদের এভাবে দেখে সবাই কাজ রেখে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জায় রৌধিকের বুকে মাথা গুঁজে আছি। আরু কফি খাচ্ছে আর কাজের তদারকি করছে। রৌধিক আমাকে নিয়ে দাঁড় করালেন তার সামনে। আরু কফি অধরের সাথে চেপে আছে। হাতে নিতে ভুলে গেছে। অসাবধানতায় ছ্যাঁকা খেল সে। রৌধিক সময় নিল না। কফির মগটা নিজের হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল আরুর মুখে। গরম কফির কারণে মুহূর্তেই লালচে হয়ে গেছে। চোখজোড়াও টলটল। পিছিয়ে গেল দুই’পা। মুখে হাত দিয়ে আহ্ করে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল। সবাই হতভম্ব। চিৎকার করে পানি আনতে বলছে। স্টার্ফরা পানি নিয়ে ছুটে এলো। আরুর হাতে দেওয়ার পূর্বে হাতের ইশারায় রৌধিক থামিয়ে দিল। আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে তর্জনী দিয়ে না বোধক বোঝালেন। স্টার্ফরা পিছিয়ে গেল। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,
“একদম না। এক পা সামনে আগাবেন না কেউ।”
রৌধিক ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আমি গুটিসুটি হয়ে পশ্চাৎ লুকিয়ে রইলাম। রৌধিক আমাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। আঙুল তুলে বললেন,
“সাহস হয় কী করে তোমার, আমার ওয়াইফকে বন্ধ করে রাখার। আর আপনারা সত্যিটা না জেনে ওকে বা’জে কথা কেন বলেছেন? হোয়াই? সি ইজ মাই ওয়াইফ। আমার এই অফিসে জয়েন করার আগেই এই মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়েছে এবং সর্বদা যাতে তাকে দুচোখ ভরে দেখতে পারি তাই অফিসে আসা। যদি আমার সেই জানের সাথে কেউ খারাপ বিহেবিয়ার করে আপনাদের কী মনে হয়, আমি চুপ করে থাকব?
সবাই রৌধিকের কথায় সায় দিল। রৌধিক পুনরায় বলতে লাগলেন,
“তাহলে আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
আর এই মেয়েটা (আরুকে উদ্দেশ্য করে) জোনাকিকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করেছে। এসির পাওয়ার হাই করে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। ও কী জানত না, জোনাকি আমার ওয়াইফ?”
সবাই হতভম্ব। অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে আরুর দিকে। আরু তাকানোর স্পর্ধা নেই। তবুও সহানুভূতি অর্জন করতে চেপে চেপে বলে,
“ইয়েজ। আই নো। হু আর সি! জোনাকি ইউর ওয়াইফ। আই ওয়ান্টেড টু কিল হার, দ্যান টক টু জোনাকি।”
আরুর প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বাকহীন। স্থির। শব্দ নেই কন্ঠে। কিছু বলার দৌবল্য নেই। আমাকে প্রশ্নের জবাব দিতে না দেখে ক্ষিপ্ত হল সে। বসার উপযোগী চেয়ারটা ছুড়ে ফেলল পায়ের কাছে। তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে গেলাম আমি। পায়ের উপরে পড়লে ভেঙেই যেন পায়ের পাতা। এতোবড় বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েও বড় বিপদে পড়তে হতো আমাকে। রৌধিক সময় নিল না। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই অবিলম্বে বিকট শব্দে চড় বসিয়ে দিল আরুর গালে। আরুর বাহু টেনে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। স্টার্ফদের পানি নিয়ে আসতে বললেন। পানি দিয়ে হাত ধুয়ে টিসু দিয়ে হাত মুছল। এমন ভাবে বিহেবিয়ার করল, যেন তার হাতটা খোয়া গেছে। ছুঁয়ে বড় অন্যায়ের ভাগীদার হয়েছে সে। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“একটাও কথা বলবে না তুমি। একটাও নয়। তুমি জানো, জোনাকি কথা বলতে পারে না। তাই ওকে ইউস করার চেষ্টা করছ।
নেক্সাস টাইম তোমাকে আমার আশেপাশে যাতে না দেখি, মাইণ্ড ইট। আমার কোম্পানির সম্মানের কথা ভেবে আপনাকে পুলিশে দিলাম না। তবে আপনি যাতে অন্য কোথাও চাকরি না পান, সেই ব্যবস্থা করব। আউট..
দৌবল্য চরণে প্রস্থান করল সে। রৌধিক সবাইকে নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করার নির্দেশ দেয়। অতঃপর নিজের কেবিনে যায়। আমিও তার পিছুপিছু কেবিনে গেলাম। রৌধিক ওয়াশরুমে গেছে। আমি টেবিলের উপরে বসে পা দুলাচ্ছি। মানুষটা বড়ই অদ্ভুত। ভিন্ন! আলাদা সে। দ্বার খুলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। পড়নের জামা পাল্টে নিয়েছেন। মুক্তার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। নিজের চেয়ারে বসলেন। একহাত গালে দিয়ে অটল নেত্র যুগলের সহায়তায় চেয়ে রইলেন। প্রানোজ্জল।
“কবে তুমি শব্দ করে হাসবে? তোমার বাচ্চা বাচ্চা অট্টহাসিতে আমার হৃদয়ে শীতল ছোঁয়ার পরশ পাবে! আমি তৃষ্ণার্ত। তোমার হাসিতে মাতানো শব্দগুলো শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে ছেড়ে যাবে।”
“তখন তো দিব্যি আরুকে ছুঁয়ে ছিলেন?”
“আর জন্যই তো ড্রেস চেঞ্জ করেছি, হাত পা ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেছি।”
আমি অবুঝ। বোধগম্য হলো না কথার মানে। ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচু করে তুললাম। রৌধিক প্রত্যুত্তর করলেন না। হাত টেনে কোলের উপর বসিয়ে দিলেন। টাল সামলানোর পূর্বেই আমি তার দখলে। গলায় পেঁচিয়ে রাখা মাফলার আরেকটু পেঁচিয়ে দিয়ে বললেন,
“তো কী খাবেন মেডাম, চা না কফি?”
মাথা দুলিয়ে না বোধক বুঝালাম আমি। রৌধিক তোয়াক্কা করলেন না। দুই কাপ চা আনতে বললেন। আদা চা। কথা বলতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। তিনি আমার রাগ ভাঙাতে ভেজা গালটা আমার গালের সাথে চেপে ধরল। চমকে উঠলাম আমি। গাল ঘুরিয়ে তাকানোর প্রয়াস করতেই দৃঢ় করে চেপে ধরলেন। নরম, কোমল, তুলতুলে গাল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দাড়ির সাথে লেপ্টে থাকা পানিগুলোতে কম্পন সৃষ্টি হলো আমার। ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেল ওষ্ঠদ্বয়। তাকে সরানোর প্রয়াস করলাম। কিন্তু রৌধিক হাতটাও নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। দুঃখ, অভিযোগে কপাল কুঁচকে গেল আমার। অটুট তার হাত। রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
“ফুস। ক্ষমতা শেষ। তোমার দৌড় কতোদূর আমার জানা আছে। তাই চুপচাপ বসে থাকো, নাহলে এবার মরিচের গুঁড়ো দাঁড়ির সাথে মিলিয়ে একদম গুঁতা দিবো।”
আঁধারে আবৃত শহর। নিভু নিভু আলো জ্বলছে। মস্ত চাঁদের জ্যোৎস্না। যাকে বলে জ্যোৎস্নাময় রাত্রি। তারাস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ। বেলকেনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রাত দশটা ছাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ নেই ঘণ্টা খানেক। সহসা হৃৎপিণ্ড কাঁপানো শব্দে বিষ্ফোরণ হয়। তৎক্ষণাৎ আঁধারে মিলিয়ে যায় সবকিছু। আজ রাতে বিদ্যুৎ আসবে কি-না জানা নেই। সারাদিন উত্তপ্ত পৃথিবী। রাতের বেলায়ও উত্তপ্ত। বর্ষণের পূর্বাভাস। বর্ষণমন্দ্রিত শ্রবণ করার অপেক্ষায় বসে আছি। মাঝখানে কেটে গেছে চারদিন। একটু কথা বলতে পারি আমি। কর্ণপথে এসে হানা দিল পায়ের শব্দ। আমি পিছু ফিরলাম। মানুষটিকে দেখার প্রয়াস পূর্বেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল কেউ। সেকেন্ড খানেকের জন্য মনে হলো, বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে। তার স্পর্শে প্রতিবারই বিদ্যুতের মতো শর্ক খাই আমি। রৌধিক এসেছে। নড়াচড়া করলাম না আমি। রৌধিক কাঁধে মুখ গুঁজে দিল। তার মুখের ঘামগুলো আমার কাঁধে লেপ্টে গেল। উষ্ণ গরম লবণাক্ত জলকণা। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, যদি তাকে সুইচ বোর্ডের সাথে মিশিয়ে দেই তাহলে বিদ্যুৎ চলে আসবে। তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ফিরলাম আমি। রৌধিক আমার কাঁধে দুইহাত রেখে নিচু হলো। আমি নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে তার নামগুলো মুছে দিলাম। তিনি ওড়নাটা নিজের গলায় পেঁচিয়ে নিলেন। তৎক্ষণাৎ ফোন বেজে উঠল। রৌধিক ওড়না না দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। মোজা খুলতে খুলতে কথা বলছেন। মায়া লাগল আমার। ক্রমাগত গরমে ঘামছেন তিনি। আমি নিচে নেমে গেলাম। একগ্লাস শরবত বানিয়ে উপরে চলে এলাম। পড়ার টেবিল থেকে বই এনে হাওয়া করতে লাগলাম। রৌধিক জামা কাপড় না ছেড়েই বেডের উপর শুয়ে পড়লেন। কান থেকে কিছুটা দূরে ফোন নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আজকে কত তারিখ?”
” ৩১ মার্চ।”
“কী বার?”
“বৃহস্পতিবার। এখন কী সালটাও জিজ্ঞাসা করবেন?”
রৌধিক প্রত্যুত্তর করলেন না। কাবার্ড থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জামাকাপড় গুলো নিয়ে বললেন,
“আমি আদ্রিতার ওয়াশরুমে যাচ্ছি। দশ মিনিট সময় দিলাম, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। বার্থডে তে যাবো। ফাস্ট।”
“মানে?”
রৌধিক হাই তুললেন। আমার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে অর্ধেকটা শেষ করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাকিটা আমাকে খেতে বলে তিনি চলে গেলেন। আমি বেডের উপর বসলাম। পুরোটা শেষ করে টেবিলের উপর রাখলাম। কী বলে গেলেন তিনি? এখন বার্থডেতে যাবো।
আমি গভীর ভাবনায় লিপ্ত হয়ে স্থির হয়ে বসে রইলাম। দশ মিনিট ফুরিয়ে গেল কিন্তু আমার ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে সরল না। রৌধিক ফিরে এলো। কালো পাঞ্জাবি পড়নে। তাকে দেখেই টাস্কি খেলাম আমি। চোখ কপালে। চোখ ঢলে পরিস্কার করে পুনরায় তাকালাম। না তিনি রৌধিকই। অনেক বেশি কিউট লাগছে তাকে। পার্টিতে অনেক মেয়েরা যাবে, তাই তিনি এতো সেজেছেন। নিশ্চয়ই তাই। আমি ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচু করলাম। কই বাড়িতে থাকতে তো এমন করে সাজে না। আমি কি মেয়ে না? ধ্যান ভাঙল আমার। ফট করে উঠে কাবার্ড খুঁজতে লাগলাম। কালো রঙের একটা শাড়ি খুঁজছি। একদম রৌধিকের সাথে মিলিয়ে। রৌধিক ফিরে এলেন। হাতে তার মোমবাতি। ড্রেসিং টেবিলের উপর গলিত মোম রাখলেন। তার উপরে ফিট করে দিলেন মোমবাতি। চুলগুলো মুছতে মুছতে বললেন,
“এখনো চেঞ্জই করতে পারো নি? তোমাকে আর চেঞ্জ করতে হবে না। যেতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি থেমে গেলাম। নাক ফুলিয়ে রইলাম। রৌধিক আমাকে না নিয়ে একা একা পার্টিতে যাচ্ছে। আমার সন্দেহটাই ঠিক। রাগ দেখিয়ে কাবার্ডের জামা কাপড়গুলো ফেলে দিলাম নিচে। রৌধিক বিষ্ময়িত চোখে তাকাল। আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে একটা গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। হাত জোর করে টেনে টেনে বললেন,
“যাও। চেঞ্জ করে আসো।”
আমি তার পাঞ্জাবীর কলার টেনে বললাম, ” আপনারটা কালো হলে আমি কেন সবুজ পড়ব? কেন?”
“কালো শাড়ি নেই।”
“তাহলে আপনি এটা চেঞ্জ করে সবুজ রঙের টা পড়বেন।”
আমার হাত ছেড়ে পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে বললেন, ” সারাদিন ড্রেস চেঞ্জ করতে পারব না। ইচ্ছে হলে এটা পড়। নাহলে যাও। পড়তে হবে না। যেতেও হবে না।”
আমি মুখ ভার করে রইলাম। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম। তৎক্ষণাৎ আদ্রিতা হাজির হলো। শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে প্রবেশ করল। না তাকিয়েই বলল,
“জোনাকি, আমার কুচিগুলো একটু ঠিক করে দে তো!”
ওয়াশরুমে না ঢুকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “আদ্রিতা তুমি।”
“হ্যাঁ তো! ভাইয়া তার বন্ধুর বার্থডেতে নিয়ে যাচ্ছে। কতো করে বললাম, যাবো না। কে শোনো এখন আমার কথা। আমাকে ধমকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। ভালো লাগে না।”
ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে ফুঁসতে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো রুপ ধারণ করলাম। আদ্রিতাকে কেন নিচ্ছে? যাতে আমি আদ্রিতার সাথে ব্যস্ত থাকি আর তিনি মেয়েদের সাথে পার্টিতে ইনজয় করতে পারে। মোমবাতির হলদেটে আলোয় আমার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। পা টিপে টিপে আদ্রিতার কাছে গেলাম। হাঁটু মুড়ে বসে কুচিগুলো ঠিক করে দিলাম। আদ্রিতা চলে গেল। আমি সবুজ শাড়িটা কাবার্ডে রেখে বেডের এককোণে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। গরমের মাঝেও কাঁথা মুড়ি দিলাম। যাবো না আমি পার্টিতে। কেঁদে দিলাম আমি। নাকের জলে চোখের জলে একাকার অবস্থা।
রৌধিক নিজের কাজে এতোটাই ব্যস্ত ছিল আমাকে খেয়াল করে নি। হুট করে আমাকে দেখতে না পেয়ে বেশ কয়েকটা ডাক দিলেন। একদম সাড়া দিলাম না আমি। খুঁজুক তিনি। খুঁজতে খুঁজতে সময় চলে যাক। তিনি যাতে আমাকে খুঁজে না পায়। আমিও তার সামনে যাবো না। যাবো না মানে যাবো না।
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে আমার। হেঁচকির শব্দে রৌধিক আমায় খুঁজে পেলেন। কাঁথা সরানোর প্রয়াস করলেন। আমি খামচে ধরে রইলাম যাতে কিছুতেই তিনি কাঁথা সরাতে না পারে।
তার পুরুষালি শক্তির কাছে আমার শক্তি তুচ্ছ। কাঁথা সরিয়ে টেনে বসিয়ে দিলেন আমায়। সহজ স্বরে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার? আ’ম স্যরি। তোমার সাথে ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। আমিই বা কী করব? অফিস থেকে এসেই যেতে হচ্ছে। একটু বিরক্ত তো লাগছেই!”
ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম আমি। তিনি তো ঠিকই বলছেন। রৌধিক পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্বল্প রাগান্বিত স্বরে বললেন, ” আবার কী?”
“আপনি আদ্রিতাকে কেন নিচ্ছিস আমাদের মাঝে। নিশ্চয়ই আমার জন্য। আমি আদ্রিতার সাথে বসে থাকব আর আপনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবেন?”
রৌধিক একগাল হাসলেন। বামগালে টোল পড়ল। মাতাল করা মুগ্ধকর সেই হাসির রেশ। আমি জন্ম জন্মান্তর এই হাসির জন্য দিন রাত পার করে দিতে পারি।
“ইভু আসছে। হসপিটালের চাপে আদ্রিতাকে সময় দিতে পারে না। আদ্রিতা তাই রাগ করে নিজের একাউন্ট থেকে ইভুকে ব্লক করে দিয়েছে। ফোন দিলে রিসিভ করছে না, কথা বলছে না। যাকে বলে এড়িয়ে চলা। তার রাগ ভাঙানোর জন্য ইভু আসবে। তাই ওকে নিচ্ছি। এক মুহুর্তের জন্যও তোমার হাত ছাড়ছি না আমি। যাও! এবার তৈরি হয়ে নাও।”
বলেই রৌধিক উঠে দাঁড়ালেন। ফোন নিয়ে গেমস খেলতে বসলেন আসন পেতে। আমি নিজের মাথায় চপল মা’রলা’ম। তুই সত্যি একটা অপদার্থ জোনাকি। গাধা। কি ভাবল রৌধিক তোকে। হ্যাংলা কোথাকার। নিশ্চয়ই ভাবছে, আমি তাকে নিয়ে জেলাস। তার বোনটাকেও সহ্য করতে পারি না।
জোনাকি এখনো সময় আছে, অপদার্থ থেকে পদার্থ হ। নাহলে এই রৌধিকটা, জোনাকি নামের ওই অবুঝ বাচ্চাটাকে গাধা ভেবে হাঁটে বিক্রি করতে উঠে পড়ে লাগবে।
যেহুতু যেতেই হবে, সময় অপচয় ঠেকাতে আমি তৈরি হয়ে নিলাম। অতঃপর বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।
চলবে.. ইনশাআল্লাহ