#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:৩৩+৩৪
ধোঁয়া ওঠা গরম সুপ্যের বাটি টেবিলে। ওষুধের সময় দেখতে মনযোগী। অধিকতর নিদ্রাচ্ছন্ন রৌধিক। ব্যথায় টনটনে দেহখানা। নড়াচড়া করলেই তাজা হয়ে উঠে লহমায়। যাতনায় ছটফট করতে করতে সবে নিদ্রায় মগ্ন। নিদ্রাকর্ষক মুখশ্রীটা ভিন্নরকম। জেগে তোলার স্পৃহা নিমিষেই ঘুচে গেছে। অথচ করণীয় কিছু নেই। ক্ষুধার্ত রাখা যাবে না। নিজের সাথে লড়াই করে অবশেষে ডাকলাম রৌধিককে। ক্লান্ত নেত্র যুগল মেলেই আরও দৃঢ় হল নিদ্রায়। এবার শরীরে হাত দিয়ে ডাকলাম। রৌধিক নিদ্রাঘোরে ‘আহ্’ শব্দটি নির্গত করলেন। তৎক্ষণাৎ আমি হতাশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বলি,
“কি হয়েছে? ঠিক আছেন? ব্যথা লেগেছে?”
“বুকেও আঘাত পেয়েছি, তাই..
নতজানু করলাম মস্তিষ্ক। নিজের অগোচরেই তাকে তীব্রতর আঘাতে জর্জরিত করলাম। মিনমিনে গলায় বললাম, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি।”
“ইটস্ ওকে। স্যরি বলার দরকার নেই।”
পিঠের পেছনে বালিশ দ্বারা আবৃত করলাম। অতঃপর তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলাম। ট্যাবলেট ও পানি এগিয়ে দিলাম। হাতে ব্যান্ডেজ বিধেয় ধরতে সক্ষম হলেন না। তাই আমি খাইয়ে দিলাম। স্যুপ তুলে চামচ পরিমাণ এগিয়ে দিতেই নাকচ করলেন তিনি। সোজাসাপ্টা বললেন, ” গলায় ব্যথা জোনাকি। সামান্য ট্যাবলেট খেতেই গলায় আঁটকে আসে। খেতে পারব না।”
“এতবড় শক্তিশালী একজন সুদর্শন সুপুরুষের মুখে একথা মানায় না। সামান্য একটা ট্যাবলেট খেতে পারছে না। হাউ ফানি।
লোকেরা জানতে পারলে, আপনাকে মিউজিয়ামের রাখার ব্যবস্থা করবে। তার আগে চট করে খেয়ে ফেলুন তো!”
ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরনো সেই দিনের মত। হাত পা যথারীতি কম্পিত লাগল। আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পাল্টে দিয়ে বললেন,
“তুমি আমাকে বিদ্রুপ করছ না-কি বাচ্চা বোলাচ্ছ কোনটা বলত?”
“মিস্টার আপনি কি বাচ্চা যে, আপনাকে বোলাতে যাব।”
“তাও..
পরবর্তী শব্দটা মুখের আঁটকে রইল। নির্গত হওয়ার সময় হল না। আমি চামচ মুখে তুলে দিলাম। পরপর কয়েক চামচ খাইয়ে দিলাম। অতঃপর খাবারের পরবর্তী মেডিসিনগুলো খাইয়ে দিলাম। রৌধিক রীতিমত ঘামছেন। সর্বদা সন্ধ্যার পর মুহুর্তে কিংবা অফিস থেকে এসেই শাওয়ার নেয়। আজকে ব্যান্ডেজের কারণে পানির সংস্পর্শে অব্দি যায়নি। উপরের শার্টটা খুলে দিতে বললেন। খুলতে সাহায্য করার পরক্ষণেই এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। উষ্ণতা যেন কমছেই না। অথচ হিমলতায় আমার অবস্থা শোচনীয়। বাধ্য হয়ে টাওয়াল ভিজিয়ে নিয়ে এলাম। তার সর্বাঙ্গ আর্দ্র টাওয়াল দ্বারা ভিজিয়ে দিতে লাগলাম। তার স্থির দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ।
গলার কাছে মুছে এক পলক অবলোকন করলাম তার মুখ। এখনো একই ভঙ্গি। অস্বস্তি বোধ হল। আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করলাম। হাত ধরে ফেললেন। ফিচেল হেসে বললেন,
“আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে জোনাকি। আ’ ম রিয়েলি স্যরি।”
আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। পুনরায় মুছতে শুরু করি। তার দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই। তবুও নিজের অস্বস্তির ইতি টেনে বলি,
“আপনি আর আমি একই। এক আত্মা এক প্রাণ। আপনাকে সাহায্য করা মানে নিজের সাহায্য করা। নিজের জন্য কেউ কখনো বিরক্ত বোধ করে।”
রৌধিকের অপলক দৃষ্টি। তার দৃষ্টি ক্রমশ প্রখর হচ্ছে। আমি অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছি। নিজের কাজের মাঝে আমার বেবীটার যত্ন নিতে ভুলে গেছি। খাওয়া-দাওয়া করা হয় না সময়মত। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে রৌধিক বললেন,
“তা না-হয় বুঝলাম। এবার কি এত ভাবছ?
জোনাকি, আমি কখনো আমার কাজ অন্যকে দিয়ে করাইনি। তুমিও প্রথম। কেমন একটা লাগছে। ঘরেও থাকতে ভালো লাগছে না। নড়াচড়া করতে পারছি না।”
বলেই দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন। হুট করেই অন্তঃকরণের বাঁধ ভাঙল। দ্বিধাহীন চিত্তে বলে ফেলি, “আমি একটা খবর দিলে, আপনার ঘর ছেড়ে কোথাও যাবে ইচ্ছে করবে না।”
“কী, খবর?”
“এখন বলব না। কিছুদিন পর বলব, আগে আপনি সুস্থ হন। এই সংবাদটা পেলে আপনি চুপ থাকতে পারবেন।”
ততক্ষণে তার দেহখানা মুছা শেষ। আমি টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের নিমিত্তে পা বাড়ালাম। দু’পা ফেলে তৃতীয় পা ফেলতেই হাত ধরে ফেললেন রৌধিক। কোমর জড়িয়ে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়বেন না। আমি পড়লাম ফেঁসাদে। কীভাবে সূচনা ঘটাব। মিনিটের ব্যবধানে রাজ্যের লজ্জারা বেষ্টিত করল আমায়। লজ্জামিশ্রিত মুখটা নত হল। গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিন্দু পরিমাণ কিঞ্চিৎ করতে ব্যর্থ আমি। অথচ সর্বদা কারণে অকারণে ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। নিঃশ্বাস টানলাম। অধর কামড়ে ধীরে ধীরে বললাম,
“আমি। আমি। আমি..
“তুমি কী জোনাকি?”
“আমি। না না আমি নই, আপনি। আপনি..
“আমি কি জোনাকি..
কথনগুলো গলায় দলা পাকিয়ে রইল। আমি নিরুপায়। বচনহীন। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন একটি শব্দও মুখ দেখে নির্গত করতে পারলাম না। তখন বোধগম্য হল, তাকে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। আমি আঙুল তুলে কাবার্ডের তিন নং ড্রয়ারে ইশারা করলাম। মিনমিনিয়ে বললাম, “ওখানে আপনার কাতরতার উত্তর রয়েছে।”
রৌধিক সন্দিহান চোখে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলেন। ড্রয়ারের দিকে অগ্ৰসর হলেন। স্বযত্নে খুললেন। অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করে। আমি ক্রমাগত ঘামচি। রৌধিক পশ্চাৎ ফিরলেন। এমন ব্যবহারে আমার অস্বস্তি তরতর করে বাড়ছে। কাবার্ড খুলতেই বাচ্চাদের ছবি নজরে এলো। ঘাড় কাত করে ছবিটা দেখলেন তিনি। দৃষ্টি সরি আমার দিকে আকর্ষণ করে ইশারায় বললেন, “কী?”
পরক্ষণে ড্রয়ারে হাতরে দু’টো জুতা পেলেন। বাচ্চার জুতো। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের পড়ার উপযোগী জিরো সাইজের কাপড়ের জুতো। রৌধিক একবার জুতো আরেকবার বাচ্চার ছবিটার দিকে তাকাচ্ছেন। অবশেষে ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলেন। আমাকে মাথা চুলকে বলেন,
“তোমার কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই জোনাকি। এইসব দিয়ে কাবার্ড ভরে রেখেছ? এজন্যই বলেছিলে, আমি বাইরে যেতে চাইব না। সিরিয়াসলি! আমাকে আবার তুমি ছেলে বুলাচ্ছ। আমি ফেলে দিচ্ছি এগুলো।
“না” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম আমি। রৌধিক এক’পা ফেলে উপর পা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে, সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে আমার রিয়েকশন এমন কেন?
আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। এই লোকটাকে কীভাবে বুঝালে তিনি বুঝবেন? সব দিব্যি বুঝেন, এটা বুঝেন না। টেনে টেনে বললাম, ” কিছু না। আপনাকে কিছু বুঝতে হবে না। ওগুলো আমার দিন। আপনি আসুন শুয়ে পড়ুন। রাত বাড়ছে। ঘুমের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন!”
“আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না জোনাকি। এগুলো যখন তখন কেনা যায়। সামান্য এই জিনিসগুলো নিয়ে এত বিরক্ত কেন তুমি?”
প্রত্যুত্তর দিলাম না। কোনো কথা নেই তার সাথে। কোনো কথা নেই। আমি তাকে ঠিকই বলব, তবে মুখে নয়। তার যেমন বুঝার ক্ষমতা নেই, আমার তেমনি বলার মত তেজ অবশিষ্ট নেই। ফাঁকা মস্তিষ্কে কিয়ৎক্ষণ গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলাম। অতঃপর উঠে ব্রাশদানী থেকে তিনটা ব্রাশ নিলাম। রৌধিকের অগোচরেই। তার ব্রাশটা এগিয়ে দিলাম। তিনি ধরে এপিঠ ওপিঠ করে বললেন,
“এটা আমার ব্রাশ। এখন আর ব্যবহার করব না। অনেকদিন হয়ে..
“চুপ একদম চুপ। বুঝতে তো পারেন না। আমি বুঝাচ্ছি তাও বকবক করে যাচ্ছেন। একদম চুপ।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে বললাম আমি। রৌধিক বাক্যের সমাপ্তি না টেনেই চুপ করে রইলেন। লহমায় নিজের ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ব্যবধান মিটিয়ে নিলেন তর্জনীর সহায়তায়। শান্ত বাচ্চার ন্যায়।
পরক্ষতেই আমার ব্রাশ দিলাম। তিনি হাতে নিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। অন্য আঙুল দিয়ে শব্দহীন স্বরে বললেন, ” তুমি!”
“হ্যাঁ।”
তৃতীয় ব্রাশটা একদম ছোট। আদ্রিতা এনেছিল আজকে। ব্রাশটা দেখে বাবুর কথা মনে পড়েছিল। তবে বাবুর কোনো নাম রাখা হয়নি। সেটা আপাতত মহাশয়ের কাজ।
তিনি জানতে পারলে বলবেন,
“আমি বাবা হতে চলেছি, অথচ আমিই জানি না। তোমরা নাম ঠিক ফেলেছ?”
আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে রৌধিকের হাতে তৃতীয় ব্রাশটা এগিয়ে দিলাম। তিনি ব্রাশটা নিয়ে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলতে না দিয়ে আমি তার হাতটা নিজের পেটের উপর রাখলাম। রৌধিক বাকহীন। তার অনুভূতিটা দেখার জন্য চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে রইলাম। হাত সরিয়ে ফেললাম। রৌধিক তার হাত সরালেন না। ভুলে গেলেন। বিনিময়ে দৃঢ় করে চেপে ধরলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। তিনি পাথর। হাঁটু মুড়ে বসলেন। দুই হাত রাখলেন। পিছিয়ে যেতে ব্যর্থ হলাম। তার নেত্রযুগল চিকচিক করছে জলে। টেনে টেনে বললেন,
“জো জোনাকি, সত্যি? আমি বাবা..
“হম, আপনি সত্যিই বাবা হতে চলেছে। ও আমাদের সন্তান। আপনার আর আমার অংশ।”
রৌধিকের পলক স্থির। কোনো শক্তপোক্ত অদৃশ্য বন্ধন দ্বারা তিনি বেষ্টিত। তিনি পেটের উপর থেকে কাপড় সরালেন। শব্দ করে ওষ্ঠদ্বয়ের শীতল স্পর্শ ছুয়ালেন। কম্পিত হলাম। হাত পা ক্রমশ বরফাচ্ছন্ন হয়ে কাঁপছে। এটা প্রথম নয়, বরাবরই এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। অস্বস্তির ইতি টেনে ওনার কাঁধে হাত রেখে বলি,
“উঠুন, রাত বাড়ছে।”
প্রতুক্তি নেই। আমার কথন তার কর্ণদ্বয় অবদি পৌঁছেছে কি-না, তার ভাবাবেগ দ্বারা বুঝা গেলা না। হুট করেই কোলে তুলে নেয়। বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিলেন। পুনরায় হাঁটু মুড়ে বসে ধীরে ধীরে বললেন,
“জোনাকি, তোমার পেটের উপর একটু মাথা রাখব। বেশি না, একটু সময়। আমি আমাদের সন্তানের হৃদস্পন্দন গতি শুনতে চাই। প্লীজ।”
উত্তরের প্রত্যাশায় থাকলেন না। লহমায় তার মস্তিষ্ক গুঁজে দিলেন আমার পেটে। শরীর পর্যাক্রমে হিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আমি টেবিলের উপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। তিনি তথাপি বলে উঠেন, ” আলফা, দেখতে পাচ্ছো প্রিন্সেস। আমি তোমার পাপা!”
“অ্যা! আলফা।” এক লহমায় নাম স্থির করে ফেললেন। ছেলে না-কি মেয়ে তাও ফ্রিক্স। কীভাবে সম্ভব? তবে ‘আলফা’ নামটা যথেষ্ট সুন্দর। একদম হার্ট টার্সিং। সন্দিহান স্বরে বললাম,
“আপনি কীভাবে জানলেন, মেয়ের হবে? ছেলেও হতে পারে মিস্টার।”
“না, মেয়ে হবে। একদম তোমার মত। ছোট জোনাকি। একই নাক, একই চোখ, একই হাসি। আধো আধো স্বর। ঠিক তোমার মত? তোমার ছোটবেলা আলফার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে চাই। জ্যোতিষী বলেছে মেয়ে হবে।”
আমার চোখ চড়কগাছ। ইতোমধ্যে তার জ্যোতিষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বাপেক্ষা কিৎকর্তব্যবিমূঢ় বিষয় তিনি এইসব বিশ্বাস করেন। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বলি,
“আপনার মত একজন ছেলে এইসবে বিশ্বাসী?”
“আমি এইসব বিশ্বাস করি না কিন্তু এককালে করতাম। তখন ছোট ছিলাম। জ্যোতিষী বলেছে, আমার একটা কিউট দেখে মেয়ে হবে। অবিকল আমার স্ত্রীর ন্যায়। তারপর থেকে সর্বদা ভাবতাম আমার মেয়ে হবে।
ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না।”
আমি নিশ্চুপ। মানুষটা বড়ই অদ্ভুত, বুঝা কঠিন। আমাকে নিজের স্ত্রীরুপে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন, অথচ এখন বলছেন তার মেয়ে লাগবে। আচ্ছা, তার আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা পাবে তো?”
______
বৃষ্টি পতিত হচ্ছেনা, তবে রেশ এখনো কাটেনি। দুদিন থেকে ঢেড় বজ্রসহ বৃষ্টি হচ্ছিল, তবে এখন নেই। সেদিনের পর কেটে গেছে দিন পনেরো। এখন পুরোপুরি সুস্থ রৌধিক। একদম সুস্থ। নতুন একটা জবের জন্য ট্রাই করেছেন। বিনা বিলম্বে জবটা পেয়ে গেছে। তিনদিন হল জয়েন করেছে। তিনি অফিসে থাকলেও ঘণ্টা অন্তর অন্তর ফোন করে বেবীর কথা জিজ্ঞেস করতে বিস্মৃত হয় না। ধীরে ধীরে তার পাগ’লা’মী ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাড়ির সকলে যোগ দিয়েছে সাথে। আগামীকাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। রৌধিকের অ্যাক্সিডেন্টের নিমিত্তে বিয়েটা পিছিয়ে ছিল। ইতোমধ্যে গ্ৰাম থেকে সবাই চলে এসেছে। বাড়ির বাদবাকি ঘরগুলো জনমানবে পরিপূর্ণ। আমি প্রেগন্যান্ট বিধেয় এই ঘরটায় অন্য কারো প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। রৌধিক কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।
সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছি আমি। কেশসমূহে টাওয়াল জড়াচ্ছি। ইদানিং ওয়াশরুমে একবার ঢুকলে বের হতে ইচ্ছে করে না। হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি। এইত সেদিনের কথা,
বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল। তখন রাত আটটা নাগাদ। আইপিএস ডিসপ্লেতে সমস্যা ছিল। প্রচুর উষ্ণতায় আমার অবস্থা নাজেহাল। তখন আমার কি করা উচিত ছিল! সর্বোচ্চ ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ান। নতুবা আদ্রিতাকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করা। কিন্তু তেমন কিছু করিনি। ওয়াশরুমের দরজার ভিড়িয়ে বালিশে মাথায় দিয়ে ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম। শাওয়ার চালু ছিল। ভিজে জবুথবু হয়ে গেছিলাম। এদিকে রৌধিক বাড়িতে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় করেছিলেন। সর্বস্থানে খুঁজেও মেলেনি আমার সন্ধান। চিৎকার করে ডেকেছিলেন। তাতে আমার কী?
আমি আমার মত ঘুমিয়েছি। অবশেষে রাত দুটোর দিকে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে আমার। জামা কাপড় চেঞ্জ না করে সেভাবে বেডের উপর শুয়ে ছিলাম। বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। সবাই আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। অতঃপর ভেজা জামা কাপড় নিয়েই নিচে যাই, প্রচুর ক্ষুধা লেখেছিল। স্টার্ফরা আমাকে দেখে রৌধিককে ফোন করে জানায়। মিনিট দশেক পর সবাই হাজির। আমাকে দেখে ভয় জবুথবু হয়ে যায়। রৌধিক তো সবার সামনে জড়িয়ে ধরেছিল। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
কিন্তু পরক্ষণে সে লজ্জা ধুয়ে গেছিল। রৌধিকের পরপর ধমকে সেদিন এই উদ্ভর ভাবনার কথা মস্তিষ্ক হতে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। সকালে গা কাঁপিয়ে ধুম জ্বরে আক্রান্ত হই। রৌধিকের কড়া নির্দেশ ছিল, ডাক্তার দেখান যাবে না। বিনিময়ে জ্বরের মাত্রা বাড়ছিল। জ্বরের ঘোরে অচেতন অবস্থায় ছিলাম। প্রচুর জ্বালিয়েছি তাকে, ইচ্ছাকৃত। অবশেষে নিজেই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। কি যত্ন! আলফার জন্য বেঁচে গেছিলাম। যদি পারতেন, প্রচুর শাস্তি দিতেন।
ফোনের রিংটোনের তুমুল শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটল। ব্যালকেনি থেকে রুমে এসে দেখলাম, রৌধিক ফোন করেছেন। রিসিভ করতেই কড়া গলায় বললেন,
“তিনবার ফোন দিয়েছি। কোথায় ছিলে? কতবার বলেছি ঘর থেকে একদম বের হবে না। মনে নেই?
সূচনা হলো তার ভাষণ। কর্ণপথ থেকে ফোন সরিয়ে কিছুদূর রেখে দিলাম। কর্ণ পরিষ্কার করে কিয়ৎক্ষণ ফোন পর কর্ণের কাছে ধরলাম। তিনি বললেন,
“ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে নিচে এসো। আদ্রুকে বলো, তোমাকে রাস্তায় দিয়ে যেতে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দ্রুত..
বলেই ফোন টেনে দিলেন। আমি ফোন কানে নিয়েই ব্যালকেনিতে চলে এলাম। রৌধিকের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি এসেছেন। এখন কোথায় নিয়ে যাবে?
আমি দ্রুত জামা চেঞ্জ করে নিলাম। আদ্রুপুকে নিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। বাবা এবং জয়াকে নিয়ে এসেছেন তিনি। ব্যাগপত্র দাড়োয়ান চাচাকে দিয়ে উপরে পাঠালেন। আদ্রুপুকে জয়াকে নিয়ে যেতে বললেন। বাবা এবং জয়ার সাথে টুকিটাকি কথা হল। বাবাকে নিয়েই কোথাও একটা যাবেন। আমি বুঝতে পারলাম না তার কথার ধরণ।
গাড়ি এসে থামল জমকালো বাড়ির সামনে। বাইরে তাকাতেই ‘আমহৃদ’ বাড়ি নজরে এলো। চমকালাম আমি। এতদিন পর হঠাৎ এখানে কেন? বাবা গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতরে গেলেন। আমাকে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামালেন রৌধিক। আমি আহাম্মকের ন্যায় জিজ্ঞেস করি,
“আমরা এখানে কেন এসেছি? আজকের পর থেকে তারাই তো আমাদের বাড়ি যেতেন।”
“কারণ তুমি, জোনাকি! তুমি আমাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছ। আমিও চাই, যে আমাকে এই স্বাদ দিয়েছে, তার বাবা মাকেও একই স্বাদ দিতে।”
“মানে!” না বোঝার স্বরে।
“ভেতরে চলো, বুঝতে পারবে।”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অতঃপর পা বাড়ালাম। ভেতরে ঢুকতেই ইমতিয়াজ আমহৃদ আর মিতা আন্টিকে বসা দেখলাম সোফায়। বাবা তার পাশে বসে আছে। রৌধিক আমাকে সবার সামনে নিয়ে দাঁড় করালেন। মিতা আন্টি উঠে এলেন আমায় দেখে। হাত হাত ছুঁয়ে বললেন,
“কেমন আছো জোনাকি? বাবু কেমন আছে?”
“বাবু নয় আলফা। তোমার নাতনি আলফা।”
মিতা আন্টি বিরবিরিয়ে করে আওয়ালেন,” আল-ফা! আল-ফা!”
নামটা তার হৃৎপিণ্ডে ছড়িয়ে গেল। অনুভূতিতে পূর্ণ হলেন। রৌধিক আমার হাতজোড়া তার হাতের মাঝে গুঁজে দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কথা দিয়েছিলাম মামুনি। তোমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিব। এই নাও তোমার মেয়ে। আমি আমার কথা রেখেছি।”
“মা..মানে?” কাঁপা কাঁপা মিতা।
“মানে এই তোমার ছোট, ইফা! তিনবছর বয়সের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এখন একটু বড় হয়েছে। তবে তোমার কাছে ছোটই আছে।”
মিতা আন্টি স্থির, কথা বলতে ভুলে গেছেন। আমিও স্থির। আমি কেন তার মেয়ে হতে যাবো। আমার মা তো নেই, গত হয়েছেন। সব প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে।
“কিসব বলছেন আপনি। আমি জোনাকি, আমার বাবার মেয়ে। ইফা নই।”
ইমতিয়াজ আমহৃদ আবেগে আপ্লুত হলেন। তবুও তার সিদ্ধান্তে অনড়। প্রমাণ চাইলেন। রৌধিক সময় নিলেন না, আমার গলা থেকে লকেটটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এপিঠ ওপিঠ করে দেখে বললেন,
“এ এটা তো আমার মেয়ের, ওর কাছে কি করে গেল?”
“এটা আমার।” বলেই তার হাত থেকে নিয়ে নিলাম।
রৌধিক দৃঢ় প্রমাণ স্বরুপ বাবাকে দাঁড় করালেন। সন্দিহান স্বরে বললেন, “ওনাকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, চিনতে পারছেন কি-না?”
“না।” একত্রে বলে উঠে দু’জনে।
লহমায় একটা ছবি এগিয়ে দিলেন তাদের দিকে। উক্ত ছবিতে আমি বাবার কোলে। ছোট বেলার ছবি। মাথার দু’পাশে দুটো বেনুণী করা। আমি চুল ধরে আছি। ছবিতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“এই মানুষটাকে চিনেন?”
বেশ কিয়ৎক্ষণ সময় নিলেন। লহমায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, “এই সেই লোকটা, যার কাছে আমার মেয়েকে রেখেছিলাম।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]