#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:৩৫+৩৬
“এই সেই লোকটা, যার কাছে আমার মেয়েকে রেখেছিলাম। আমাকে মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল। আমি কত খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।”
মিতা যথারীতি ক্ষিপ্ত হলেন। এগিয়ে গেলেন বাবার দিকে। রৌধিক থামিয়ে দিলেন। স্টার্ফদের ডেকে পানি আনতে বললেন। আমি নিশ্চুপ। একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ড দেখছি। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই এগিয়ে এলাম। চড়া গলায় বললাম,
“হচ্ছেটা কি এখানে? কী হচ্ছে। [রৌধিককে উদ্দেশ্য করে] আপনি আমাদের এখানে কেন এনেছেন। বাবার অপারেশন করতে আপনার থেকে টাকা নিয়েছিলাম বলে। ঠিক আছে, শর্ত মোতাবেক আমি চলে যাবো। হ্যাপি।”
“জাস্ট শাট আপ, জোনাকি। এতটা অবুঝ নয় যে, ধরে ধরে বুঝাব। কান খুলে শুনে রাখো,
তুমি এই বাড়ির ছোট মেয়ে। যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। ইয়ানাত ও ইভুর ছোট বোন।
তোমার মনে না থাকা, স্বাভাবিক। তবে এই বাড়ির ছোট মেয়ে ছিল। তা নিশ্চয়ই অজানা নয়।”
আমি শব্দহীন স্বরে মাথা নাড়ালাম। রৌধিক মিতা আন্টিকে বলতে বললেন। মিতা আন্টি এতক্ষণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করলেন, আমিই তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। অশ্রুসিক্ত নয়ন। দৃষ্টি টলমলে। শ্বাস-প্রশ্বাস টেনে বলেন,
“তখন আমার মেয়ের সবে তিন বছরে পা রেখেছে। ঘরমুখো পরিবেশ। ট্রেনে গ্ৰামের উদ্দেশ্য পাড়ি জমাই। এর আগে কখনো ভিড়ভাট্টায় গ্ৰামে যাওয়া হয়নি।মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে যাত্রা শুরু হয়। আমার কোলে ছিল ইফা আর হাত ধরা ছিল ইয়ানাত। ওর বাবার কাছে ছিল ইভু আর জামা কাপড়ের ব্যাগপত্র। আমি ওর বাবার আগেই ট্রেনে উঠি। ট্রেন ছেড়ে দেয়, কিন্তু ইভু আর ওর বাবাকে দেখতে পাই না। আমি বিচলিত হই। সামনের কেবিনে তিনি আর তার স্ত্রী ছিলেন। তাদের কাছে ইয়ানাত আর ইফাকে রেখে দরজার কাছে আসি। ইয়ানাত বয়সে বড় হওয়ার কারণে আমার আঁচল ধরে সাথেই আসে। ভিড়ভাট্টা ঠেলে দরজার কাছে আসতেই ধাক্কাটা জোয়াল হলো। মুখ থুবড়ে পড়ে যাই চলন্ত ট্রেন থেকে। ইয়ানাত তা দেখে সেও লাফ দেয়। মাথা ফেটে যায় ইয়ানাতের। আমি জ্ঞান হারিয়েছি। ধরাধরি করে হসপিটালের নিয়ে যায়। ইয়ানাতের চিন্তায় ইফার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পরে যখন মনে পড়ে তখন অনেক খুঁজেছি, পাইনি। বিজ্ঞাপন দিয়েছি। নিউজ করেছি। বোনকে হারিয়ে ইয়ানাত ইভু ভেঙে পড়েছিল আর রৌধিক তো পাগল হয়ে গেছিল। নয় বছরের রৌধিককে শান্ত করাই যাচ্ছিল না। মেন্টাল এসাইলামেও পাঠান হয়েছিল। হিতে বিপরীত হয়। সে স্টেশনে গিয়ে বসে থাকত। উগ্র মেজাজী। ব্যবহারের পরিবর্তন হতে থাকল। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।”
আমি বরাবরের ন্যায় নিশ্চুপ। একদম প্রাণহীন। রৌধিক এত পাগলামি করেছেন? আমার ভাবনার মাঝেই বাবা বলেন,
“সারারাত মা মা বলে কাঁদছিল ইফা। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। গ্ৰামে ফিরে আপনাদের খোঁজার চেষ্টায় বাকি রাখিনি। আমরাও বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। শহরে ওসেও খুঁজেছি, পায়নি। আমার স্ত্রী এক পর্যায়ে বলেন ওকে আমাদের কাছে রেখে দিতে। নিসন্তান পিতা মাতার সন্তান হিসেবে। ওর নাম জানতাম না আমি। আমাদের আঁধার ঘরের নিভু নিভু আলো হিসেবে ওর নাম রাখি জোনাকি। তারপর ও আমাদের পরিচয়েই বড় হয়। কখনো বুঝতে দেইনি, আমরা ওর আসল পিতা মাতা নই।”
তিনি থামতেই রৌধিক বলতে শুরু করল, “বিদেশে গিয়ে সবকিছু মানে ইফাকে মিস্ করতাম। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম প্রচুর। কিন্তু পারিনি। একসময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ইফাকে ভুলতে শেফা নামের একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি। কিন্তু বিয়ের সময় সে পালিয়ে যায়। বাবা ধরে বেঁধে জোনাকির সাথে বিয়ে দেয়। জোনাকির সাথে থাকতে অহেতুক ভালো লাগে আমার। ওর অশ্রু দেখলে কষ্ট পাই আমি। সেদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আশেপাশে জোনাকি নেই। আমি বাড়ি থেকে বের হই দ্রুত। কিছুদূর যেতেই জোনাকির দেখা পাই। একটা জুয়েলারি দোকানে। জোনাকি বের হতেই আমি সেই দোকানে গিয়ে জানতে পারি, লকেট বিক্রি করতে এসেছিল। লকেটটা দেখেই আমার সন্দেহের সুত্রপাত। কারণ সেইম লকেট ছিল ইফার। ধীরে ধীরে খোঁজ খবর নিতে থাকি। আশেপাশে মানুষের কাছ থেকেও জানতে পারি। তারপর ব্লাড টেস্ট, ডিএনএ টেস্টে আমি সিউর হয়ে যাই।”
মিতা অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন আমায়। ইমতিয়াজ আমহৃদ আবেগে আপ্লুত হলেন। তার ছোট মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন বলে কথা। তবে ব্যাপারটা আপাতত কেউ জানে না। বিয়ের পরে সবাইকে জানাবে। ভাবতেই অবাক লাগে আমি এই বাড়ির মেয়ে। এত ভালোবাসা সব আমার। আনন্দে তো কেঁদেই দিয়েছি শেষে।
_________
জানালার পাশে বসে আছি। রৌধিক শাওয়ার নিতে গেছে। ঘণ্টাখানেক পূর্বে বাড়িতে ফিরেছি। মা অনেকবার বলেছিলেন, থাকার কথা। বহুদিন, বহুবছর পর নিজের মেয়েকে কাছে পেয়েছে। রৌধিক কিছুতেই রাজি হয়নি। তার এক কথা, বউ বাচ্চা ছাড়া থাকতে পারবে না। প্রয়োজনে বিয়ের পর আমাকে রেখে যাবে। আমারও মন ভার হলো, মা বাবার সাথে একটু থাকতে পারলাম না। আর্দ্র স্পর্শে ভাবনার ছেদ ঘটল। রৌধিক ছাড়া কেউ নয়। সেটা বোধগম্য হতে সময় লাগল না। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। ছোট আলফার সাথে কথা বলা।
মাথা তুলে বেশ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর বললেন, “রেগে আছো?”
প্রতুক্তি নেই। পুনরায় বললেন, ” বেশি রেগে আছো? ওহ্ আচ্ছা। বাবা মা পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ?”
“আপনাকে কেন ভুলব, হ্যাঁ? একটু মায়ের কোলে মাথা রেখে কথা বলতে পারলাম না। বাবার সাথে মন খুলে হাসতে পারলাম না। ভাই বোনকে এক নজর দেখতে পারলাম না।”
বিনিময়ে দৃঢ় করে মাথা গুঁজে দিলেন পেটে। ভিজে গেল খানিকটা জামা। কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন,
“কিন্তু তুমি আমার কাছে না থাকলে তোমাকে দেখতে পারব না, হাসতে পারব না, ঘুমাতে পারবে না, খেতে পারব না। সবগুলোই যে একত্রে।”
মানুষটা আজব। ঠিক হারিয়ে যাওয়া সকলের থেকে খুঁজে বের করেছে। এত ভালোবাসা কি আদৌও আমার প্রাপ্য।
__________
লালে নীলে সেজে উঠেছে আহম্মেদ বাড়ি। বাইরে কাজে ব্যস্ত পুরুষ জাতি। মেয়েরা সাজতে ব্যস্ত। আদ্রিতার সাজ প্রায় শেষের দিকে। পাক্কা দুই ঘণ্টা লেগেছে হলুদ সাজে। গ্ৰাম থেকে অনেকে এসেছে। গমগম করছে চারিপাশ। তাই হলুদের অনুষ্ঠান দুপুরে করা হয়েছে। দুই পক্ষের হলুদ একসাথে। এতে লোকজনের আনাগোনা একটু বেশিই। রৌধিক বোনের বিয়ে উপলক্ষে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছেন। সবে জয়েন করেছে নাহলে আরও কয়েকটা দিন নিতেন। বর্তমানে কোমর বেঁধে কাজ করছেন বাইরে। বিরিয়ানি রান্না করছে। সেখানে তদারকি করছেন।
আদ্রুপু শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বলেন,
“জোনাকি, তুই সেজে নে। অনুষ্ঠান শুরু হলে বলে।”
“না, আদ্রুপু। তুমি সাজো। এই অবস্থা না সাজাই ভালো। মেকআপ ধুতে ধুতে অনেক কষ্ট হবে।”
ইতোমধ্যে সেজে গুজে বেরিয়ে গেছে সকলে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলে বলে, শুধু আদ্রুপুকে নেওয়ার অপেক্ষায়। নুপুরের মৃদু শব্দে উপস্থিত হলেন ইয়ানাত আপু। আদ্রুপুকে পরখ করে নিয়ে যেতে লাগলেন। আদ্রুপু পা বাড়িয়ে পেছনে ফিরলেন একচোট। পার্লারে বিউটিশিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তাড়াতাড়ি হালকা মেকআপে ওকে সাজিয়ে দিন। অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি আসিস।”
“ওর সাজার কি দরকার!” বিরক্ত হয়ে ইয়ানাত।
” তোমার কাছে আমি যতটা প্রিয় আমার কাছে জোনাকি ততটা প্রিয়। আর আমার প্রিয় মানুষ সাজবে না। তা হতেই পারে না।”
ইয়ানাত আপু দমে গেল। আঠা লাগানোর ন্যায় চুপ। আদ্রুপুকে নিয়ে গেলেন। আমি ইয়ানাত আপুর কাণ্ডে একটু হাসলাম। তিনি জানতেই পারলেন না, তার বোনকেই এইসব বলছে। পাত্তা দিলাম না। সাজতে বসলাম। মিনিট বিশেকের মাথায় আমার সাজ কম্পিলিট। একদম হালকা। হালকা মেকআপ, কাজল, লিপস্টিক। এতেই ঢের সুন্দর লাগছে। চোখ ফেরান দায়। রৌধিকের ভাষ্যমতে, প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকেই ক্রমশ মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরীতে রুপান্তরিত হচ্ছি। আমি ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। রৌধিক রান্নার দিকটায় তদারকি করছেন। হাতে চিকন বাঁশ। কোমড়ে গামছা বাঁধা। গায়ে সেন্টো গেঞ্জি। পড়ণে লুঙ্গি। সাথে যুক্ত হল, রোদের প্রখর উত্তাপ্ত। আজ প্রথম তাকে এই পোশাকে দেখলাম। পুরো ক্রাশড্। রৌধিকের নেত্রযুগল আমার দিকে নিবদ্ধ হতেই থমকে গেলাম। দ্রুত বাঁশ ফেলে ছুটে এলেন। বুঝতে অসুবিধে হল না, তিনি এখানেই আসছেন। রুমে পার্লারের বিউটিশিয়ান ছাড়া কেউ নেই। আমি দ্রুত পা বাড়ালাম। রৌধিক পৌঁছানোর পূর্বেই প্রস্থান করতে হবে আমায়। কিন্তু তা আর হল না। দ্বার পর্যন্ত অগ্ৰসর হতেই হন্তদন্ত হয়ে এলেন রৌধিক। দুই পাশে হাত রেখে আটকে দাঁড়ালেন। হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন। তার ছুটলেন বৈদ্যুতিক গতিতে। রৌধিক শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তার পায়ের সাথে মিল রেখে আমিও পিছিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।
“এত সাজ কিসের? হলুদ কি তোমার? অভিজ্ঞ মহিলারা দেখলে আদ্রুকে রেখে তোমায় হলুদ দিতে চলে আসবে। যাও, দ্রুত মুখ ধুয়ে এসো।”
তথাপি পা জোড়া গতিশীল। ক্রমশ এগুতে এগুতে উক্ত কথাটি বলেন। আমি পিছানো থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ভ্রু কুঁচকে সোজাসাপ্টা বললাম,
“কোথায় সেজেছি। এটাকে সাজ মনে হচ্ছে আপনার? চোখ না-কি চুলা? সরুন।”
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই হাত টেনে ধরল। দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দু’পাশে হাত দিয়ে আবদ্ধ করে দাঁড়ালেন। নাকের ডগার সাথে আমার নাক ঘষলেন। আদুরে গলায় বললেন, “তুমি তো ই’বলি’শ। বুঝ না কেন? তোমার এই সাধারণ সাজেই আমি ঘায়েল হয়ে যাই। তাই এত সাজের দরকার হয় না। বুঝেছ?”
উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ স্পর্শ করলেন আমার ওষ্ঠদ্বয়ে। বিনিময়ে সরে গেলাম আমি। মাথা ধরে উঠল। তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। রৌধিকের শার্ট ধরে শরীরের ভারসাম্য রাখলাম। ক্রমশ হিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে দেহ। আমাকে এভাবে দেখে বিচলিত হয়ে গেল রৌধিক। দ্রুত চেপে ধরলেন। কোলে তুলে বেডের উপর বসিয়ে দিলেন। সাবধানে বালিশে মাথা রাখলেন। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“ওয়াট হ্যাপেণ্ড, জোনাকি? কী হয়েছে, এমন করছ কেন?”
বেডশিট আঁকড়ে ধরে ব্যথায় ছটফট করছি আমি। হুট করে ব্যথার কারণ খুঁজে পেলাম না। ধৈর্য হারা হয়ে বলি,
“জানি না। হয়তো আপনার শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে।”
রৌধিক নিজের শার্ট শুকলেন। কিন্তু তিনি মাছের আশেপাশে যায়নি। রান্নার তদারকি করছিলেন, দূরে দাঁড়িয়ে। তাহলে কীভাবে সম্ভব? রৌধিক মেঝেতে কিয়ৎক্ষণ পদচারণ করলেন। অতঃপর রিনরিনে গলায় বলল, “আমি মাকে ডেকে আনছি।”
“না, আপনি মাকে ডাকবেন না। নিচে অনুষ্ঠান চলছে। আমি চাইনা, আমার জন্য নষ্ট হোক। আপনি বরং একগ্লাস পানি দিন। পানি খেয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি।”
বলা বাহুল্য কিন্তু পানি এগিয়ে দিতে সময় লাগল না। তড়িৎ গতিতে পানি ঢেলে নিজেই আমাকে খাইয়ে দিলেন। কোমরে বাঁধা গামছাটা দ্রুত পানি ঢেলে ভিজিয়ে ললাটের উপর রাখলেন। হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন সন্নিকটে। চুল ভেদ করে তালুতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমাকে নিদ্রামগ্ন হতে বললেন। আমিও তার কথ্যমত প্রয়াস করলাম। মিনিট কয়েক পেরুবার পূর্বেই গভীরতর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হলাম। কতক্ষণ নিদ্রাঘোরে ছিলাম, জানা নেই। নেত্রযুগল উন্মীলিত করতেই চলন্ত সিলিং ফ্যান দৃষ্টিতে হানা দিল। রক্ত বর্ণ সূর্য মামা ততক্ষণে অন্তরিক্ষের বক্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে। আরমোড়া ভেঙ্গে উঠতেই আদ্রুপুকে নজরে এলো, তিনি ফোনে কথা বলছেন। কোমল তুলতুলে ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে ধীরে ধীরে কথা বলছেন। আমি জানালার বাইরে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। লাল নীল আলো জ্বলছে। একটু পরই মেহেদির রঙে হাতের করতল সেজে উঠবে। এতক্ষণ জ্ঞানহীন অবস্থায় ছিলাম ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে আদ্রুপুর সামনে গিয়ে অভিমানী সুরে বলি,
“তুমি আমাকে ডাকলে না কেন, আদ্রুপু? আমার একদম ভালো লাগছে না। এত সাজ সব বৃথা। আমি আর সাজবই না।”
চটজলদি ফোনের লাইন কেটে বেডের পাশে রাখলেন। কিছুটা নত স্বরে বললেন, ” আমি ডাকতে এসেছিলাম তোকে। কিন্তু ভাই ডাকতে বারণ করেছে। তুই না-কি অসুস্থ। তুই অসুস্থ তাও কাউকে বলেনি। ভেবে দেখ একবার। আমাকে এই রুমে তোকে পাহারা দিতে রেখেছে, যাতে কেউ না আসে।
মন খারাপ করিস নে। একটু পর মেহেদি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। তুই তখন মজা করিস।”
প্রত্যুত্তর করলাম না। শব্দহীন পা জোড়া টেনে টেনে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কামরার দিকে অগ্ৰসর হলাম।
গোছানো পরিপাটি ঘর। আজ অতিশয় বেশিই পরিচ্ছন্ন। আমার অনুপস্থিতিতে রৌধিকের কর্মকাণ্ড, তা বুঝতে আমায় বেগ পেতে হয় নি। শরীর টা মেচমেচ করছে। ঘণ্টা কয়েক এমন ভারী মেকআপে থাকার ফলে স্ক্রিনটা জ্বলছে। শাওয়ার না নিলে চলবে না। একটা গোলাপি রঙের চুরিদার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম।
টুলের উপর বসলাম। রৌধিক ওয়াশরুমের অভ্যন্তরীণ অন্যরকম ভাবে সাজিয়েছে। সেদিনের পর থেকে শুয়ে থাকা তো দূরের কথা বসার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গাটাও নেই। আজ শরীরটা ভালো নেই। তাই বাথটাবে পানি ভর্তি করলাম। হ্যান্ড শাওয়ার চালু করলাম। ধীরে ধীরে উপরে উঠলাম। বাথটাবের পানিতে পা রাখতেই কেঁপে উঠলাম আমি। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। খিঁচুনি দিয়ে উঠল। প্রবল মাত্রায় ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। মাত্র পাঁচ সেকেন্ড স্থায়ী হলো সেই যাতনা। আমি বুঝতে ব্যর্থ হলাম সবকিছু, তার পূর্বেই জড়থড় হয়ে নিচে পড়ে গেলাম। জ্ঞানহীন হলাম, তবে বাইরে থেকে কেউ ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু তার কথায় সাড়া দেওয়ার ন্যায় শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই দেহে। অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, ইনি আর কেউ নয় রৌধিক। ভেতর থেকে মেঝেতে আঘাত করছি। শব্দহীন কণ্ঠে ডাকছি তাকে। তিনি শুনতে পারছেন না। আর তার কণ্ঠ আমি স্পষ্ট শুনতে পারছি। অতঃপর আর কিছু মনে নেই। অবশিষ্ট শক্তিটুকু সেখানেই লোপ পেল। আঁধারে আবৃত হলো আমার অচেতন মস্তিষ্ক। নেত্রযুগলও আঁধারে আবৃত হল।
____________
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। পাতার উপর পড়তেই ছমছম শব্দ হচ্ছে। জনশূন্য নির্জন রাস্তাঘাট। হাত জোড়া বন্ধ কোনো দৃঢ় বাঁধনে। আমি নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলাম। শরীরটা দূর্বল লাগছে। অচেনা জায়গা। পাশে অবলোকন করলেই দেখতে পেলাম রৌধিকের ঘুমন্ত মুখশ্রী। আমার বামহাত ধরে ঘুমিয়ে আছে। মাথা বেডের সাথে হেলেছে। আমি হাত ছাড়ানোর প্রয়াস করতেই নড়চড়ে উঠলেন। থেমে গেলাম। চারদিকে অবলোকন করে বোধগম্য হলো, হসপিটালে আমি। আমি অন্য হাত তার মাথায় লাগলাম। রৌধিক ধরফরিয়ে উঠলেন। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছে, জোনাকি?”
“শান্ত হোন। আমার কিছু হয়নি। কিন্তু আমরা এখানে কী করছি।”
“কিছু না।” একরোখা জবাব তার।
বলেই প্রস্থান করলেন। পা জোড়া শূন্য। জুতা কোথায়। আমার চিন্তায় জুতার কথা ভুলে গেছেন। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নার্স সমেত হাজির হলেন। নার্স আমাকে চ্যাক করলেন। স্যালাইনের ক্যানেল খুলে দিলেন। আমি কথা বলতে চাইলে, থামিয়ে দিলেন। সোজাসাপ্টা বললেন,
“কথা বলবেন না। এতক্ষণ স্যালাইন না চলাই ভালো। জ্ঞান ফিরেছে, কিছু খাইয়ে দিন। কেউ দেখা করতে চাইলে দেখা করে নিন। শরীর দুর্বল, ঘুমের ইনজেকশন পুশ করব। সো কুইক।”
বলেই চলে গেলেন। রৌধিক পকেট হাতরে ফোন বের করে কল করলেন কাউকে। হুড়মুড়িয়ে হাজির হলেন বাড়ির লোক। যেন হসপিটালেই ছিলেন। মায়ের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। কেঁদেছেন নিশ্চয়ই। হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন, তারমধ্যে এতবড় দূর্ঘটনা। আদ্রুপু, ইভু ভাইয়া, বাড়ি সবাই থমথমে। আমার জন্য তাদের আনন্দ মাটি হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“সোনা মেয়ে আমার। খুব কষ্ট হয়েছে তোর।”
“না, আমি ঠিক আছি। কিন্তু হয়েছেটা কী, সেটা তো বলবে?”
রৌধিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “সেটা তোমাকে বুঝতে হবে না। আগে সুস্থ হও।
তোমার আশেপাশে শত্রুর অভাব নেই, তবুও এতটা কেয়ার-ল্যাস কেন তুমি?”
“কী হয়ে..
“চুপ, বলেছি না, আগে সুস্থ হও।”
হুরমুড়িয়ে প্রবেশ করলেন ইয়ানাত। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখজোড়া ছলছল অশ্রুতে। মা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ইয়ানাতকে চড় মারলেন। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “তুই আবার এসেছিস। তোকে যেতে বলেছি না।”
“মা। আমি সত্যি অনুতপ্ত। আমি বুঝতে পারিনি।”
“তাহলে আমিও বুঝতে চাইছি না। যা এখান থেকে।”
টানতে টানতে বের করে দিলেন। বেশ খারাপ লাগল তাকে দেখে। রৌধিক নিশ্চয়ই তাকে বলে দিয়েছেন, আমি তার বোন হই। এরজন্যই হয়ত তিনি এতটা হাইপার। তাকে দেখে এটা বেশ বুঝতে পারছি, তিনিই কিছু করেছেন। কিন্তু করেছেন টা কী? আমার অসুস্থ হওয়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই তো!
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]