অনুভবে তুই পর্ব-২৩+২৪

0
504

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৩

রোজা জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। মন খারাপের সময়গুলোতে ওর ইচ্ছে হয়, আকাশে ওড়তে থাকা মেঘকুঞ্জের ন্যায় দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে আদ্রিশকে বলতে, ‘আপনার জন্য আমার মন খারাপ হয়।’ কিন্তু এই একটি বাক্যই সে বলতে পারে না। ফিহাকে সেদিন কিছু কথা বলার পর ও কিছুই বিশ্বাস করে নি। উলটো রাগ দেখিয়ে ওর ফোন কেটে নাম্বারটি ব্ল্যাক লিস্টে যুক্ত করেছে; যার ফলে রোজা ওর সঙ্গে আর কথাই বলতে পারে নি। অন্যদিকে নেহা সিম পালটে বসে আছে। উৎসের সঙ্গে দু-একবার কথা হলেও নিজের মনের অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ রোজা। এরমধ্যেই গত পরশুদিন বিকেলে আচমকা এক আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো রোজার ফোনে। নেহা ভেবে কলটি রিসিভ করার কিছুক্ষণ পর রোজা বুঝতে পারলো ফোনের ওপাশের মানুষটি আসলে ইশার মা সুহানা শেখ। তৎক্ষনাৎই রাগে জর্জরিত হয়ে মুখাবয়ব রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো রোজার। এই মহিলার জন্যই আজ এতকিছু হচ্ছে। কিন্তু শত হলেও সুহানা শেখ ওর গুরুজন। অতিকষ্টে রাগ দমাতে চেষ্টা করলো রোজা, যেন পুরো ব্যাপারটা আবছা দুঃস্বপ্নের মতো মিলিয়ে যায়। একা একা মনের ভেতর সব চেপে রাখতে রাখতে ইদানীং মন-মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছে ওর। সুহানা শেখ স্পষ্ট স্বরে কুশল বিনিময় করার পরে রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি রোজা বলছো?’

রোজা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘জি।’

ওপাশ থেকে বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছো? আমি আদ্রিশ-নেহার ফুপি।’

রোজা ভীষণ অবাক হলো। গলার স্বরটা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে নিশ্চিত হলো যে এটা সুহানা শেখ। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে সংকোচ নিয়ে রোজা বলল, ‘চিনতে পেরেছি। কিন্তু হঠাৎ করে আমার কাছে? কোনো প্রয়োজনে ফোন করেছেন?’

সুহানা শেখ মন্থর কন্ঠে বললেন, ‘একপ্রকার তা-ই।’

রোজা বিরস মুখে বলল, ‘আমার কাছে কী প্রয়োজন আন্টি?’

সুহানা শেখ অপরাধী গলায় বললেন, ‘আসলে সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম মা। সেদিন আমি ঠিক বুঝতে পারি নি তোমার সাথে কতটা জঘন্য ব্যবহার করেছি। তখন অকারণেই আমার মন-মেজাজও ঠিক ছিল না। আমার এই ব্যবহারের কারণে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছো, এটা মোটেও কাম্য ছিলো না ওবাড়ির কারোরই। সবটা যখন আমার জন্যই হয়েছে তখন আমিই বলছি, আমার ওপর রাগ পুষে রেখো না তুমি মা।’

রোজার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিতো, সুখ অনুভব করতো। কিন্তু রোজার তেমন কোনো অনুভূতিই হলো না। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফোনের ওপাশ থেকে সুহানা শেখ সেটা টের পেলেন। নম্র কন্ঠে বললেন, ‘কিছু বলছো না যে? তোমার কী মন ভালো নেই?’

রোজা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না। হাসার চেষ্টা করে শুধু বলল, ‘তেমন কিছু না আন্টি।’

সুহানা শেখ ব্যকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার এই বুড়ো আন্টিটাকে কী মাফ করে দেওয়া যায় না? মানুষ মাত্রই ভুল, আমার এই কাজটাকে কি ভুলা যায় না?’

এতবার করে নিজের ভুল স্বীকার করলে কি আর রাগ পুষে রাখা যায়? রোজার খুব খারাপ লাগছিলো। তথাপি সে হাসিমুখেই উত্তর দিল, ‘আমি আপনার ওপর রেগে নেই আন্টি। নিজের ভুলটা স্বীকার করে আপনি মহৎ একটি কাজ করেছেন। আমি আপনার মেয়ের মতো। এতবার করে মাফ চেয়ে আমাকে বিব্রত করবেন না দয়া করে।’

সুহানা শেখ মুগ্ধ হলেন। মেয়েটি কী স্পষ্ট করে কথা বলে! এমন একটা মেয়েকে কি করে যে এতসব কথা বলেছিল ভাবতেই লজ্জিত হলেন। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে রোজার মনোবস্থা বুঝার চেষ্টা করে অতি নরম গলায় তিনি অনুরোধপূর্ণ কন্ঠে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

রোজা বিব্রত গলায় উত্তর দিল, ‘জি বলুন।’

‘আমার জন্য যেসব ঘটে গেছে সেসব ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায় না?’

রোজা চমকিত গলায় বলল, ‘আপনি কীসের কথা বলছেন?’

সুহানা শেখ শান্ত গলায় এবার প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘তুমি কী আমার ছেলেটাকে একটুও ভালোবাসো না?’

গ্রিল আঁকড়ে ধরে রাখা রোজার হাতটা শিথিল হয়ে এলো। হৃদযন্ত্র দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলো। নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুত হতে লাগলো। রুক্ষ প্রকৃতি হঠাৎই যেন দখিনা হাওয়ায় গা এলিয়ে দিলো। মনের এক গোপন কুঠুরিতে কে যেন কড়া নাড়তে লাগলো।
রোজার কণ্ঠনালি থেকে কথা বেরুতে চাচ্ছে না কিছুতেই। চোখজোড়া বুজে আসতে চাইলো, কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে করলো না। উফফ, ওর এত লজ্জা লাগছে কেন? রোজা কোনোরকমে উত্তর দিল, ‘জানি না।’

সুহানা শেখ হেসে ফেললো। হালকা কেশে তিনি বললেন, ‘নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো মেয়ে, হয়তো খুব সহজেই উত্তরটা জেনে যাবে। আমাকে বলতে ইচ্ছে না হলে বলো না, তবে যাকে ভালোবাসো তাঁকে অবশ্যই বলো।’

রোজা নিশ্চুপ রইলো। সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। সুহানা শেখের গলা আবার শোনা গেল, ‘আর একটা কথা, নেহার বিয়েতে যদি তুমি না আসো তাহলে আমি বুঝে নেব যে তুমি আমার জন্যই আসো নি! আমাকে এখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারো নি।’

রোজা হতচকিত হয়ে বলল, ‘তেমনটা ভাববেন না আন্টি। এরকম কিছুই নয়।’

সুহানা শেখ মৃদুস্বরে বললেন, ‘তোমার আসার অপেক্ষায় রইলাম। তখন কথা হবে মেয়ে!’

ফোনটা রেখে রোজা কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো বিছানার একপাশে। সুহানা শেখের প্রশ্নের উত্তরটি তো ওর জানা, তাহলে? ও কেন সত্যিটা বলতে পারল না? এইযে, সময়ে-অসময়ে যে আদ্রিশকে আজকাল সে অনুভব করে এটা কি প্রথম প্রেমের অনুভূতি? ওর হাতে হাত রেখে সুদূরে যাওয়ার তীব্র চেষ্টাটাকে বাস্তবে পরিণত করার যে বাসনা এটাকে কি প্রয়োজনীয়তা বলে? আদ্রিশের প্রতি ও যে প্রচন্ড এক মানসিক আসক্তিতে ভুগছে, এটাই কি প্রেম? ওর সাথে সারাটি জীবন একসাথে কাটানোর যে সুপ্ত এক ইচ্ছে ওর মনোজগতের গোপন কুঠুরি থেকে মুক্ত হতে চায় এর নাম-ই কি ভালোবাসা?

————————————————————————-

চারদিকে শীতের আমেজ। ধোঁয়া উঠা ভুতুড়ে কুয়াশারা জেঁকে বসেছে প্রকৃতিতে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে বিশালাকৃতির সূর্য। রোজাদের বাড়ির অন্দরমহলে সকাল থেকেই অনেকটা হুলস্থুল রব। তার কারণ আজ ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ। আর ঠিক পাঁচদিন পরে নেহার বিবাহের দিন ধার্য করা হয়েছে। এ উপলক্ষে ইনায়েত ও ইমতিয়াজ সাহেব ফোন করে জানিয়েছেন তারা যেন পুরো পরিবার নিয়ে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ও বাড়িতে উপস্থিত থাকে। এর মধ্যে দুটো দিন পেরিয়ে গেছে। বিয়ের বাকি চারদিন। গত রাতে নিশিতা ফোন করে আজই যেতে বলেছে ওদের। সেজন্য আজিজুর রহমান বড় ভাইয়ের পরামর্শ মোতাবেক দ্রুত কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়েছে। বাড়ির সকলেই নিমন্ত্রিত বলে রোজার মন খানিকটা বিষন্ন। ও ভেবেছিল, বিয়েতে যাবে না। বাড়িতে চাচা-চাচীর সঙ্গে থেকে যাবে। কিন্তু সুলতানা এমনভাবে জোরজবরদস্তি করলো যে রাজি না হয়ে পারলো না রোজা৷ কীভাবে নেহা-ফিহার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ভাবলেই ওর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করে। সবচেয়ে বড় কথা, কোনমুখে সে আদ্রিশের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? লোকটার চোখে চোখ রাখলেই তো ওর মনের ভেতরটা পড়ে ফেলতে পারবে আদ্রিশ!
মনোবল শক্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে আকাশী-নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ গায়ে জড়িয়ে নিলো রোজা। চুলগুলো কোনোরকমে একটা বিনুনি বেঁধে নিলো। সুলতানা মেয়ের মতিগতি সুবিধের মনে করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একি! তুই বড় স্যুটকেসটা নিবি না? বইখাতা ছাড়া ওখানে গিয়ে কি পড়াশোনা করবি? তাছাড়া তোর ভার্সিটির ছুটিও তো প্রায় শেষ। আবার ফিরতি আসবি নাকি এখানে?’

রোজার টনক নড়লো। বাড়ির কেউ-ই তো এসব ঝামেলার কথা জানে না। রোজা যে ওখানকার সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছে এটা তো ওদের বলে নি সে। বাড়ির সবাই জানে ও গ্রামে ছুটি কাটাতে এসেছে। কিন্তু এখন মা’কে কি বলবে? বলে দেবে যে ও আর শহরে ফিরতে চায় না? ওকে ভাবনায় নিমগ্ন দেখে সুলতানা রেগে ওঠলেন, ‘তোর হয়েছেটা কী আমাকে বলবি? ফাজিল মেয়ে কোথাকার। থম মেরে বসে না থেকে সবকিছু গুছিয়ে নে। এখন রওয়ানা দিলে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে।’

রোজা মাকে আরকিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না। দরকারি জিনিসপত্র ব্যাগে গোছাতে শুরু করলো। দূরত্বই ভালোবাসার গুরুত্ব বোঝায়। বোধহয় এতদিনের বিচ্ছেদটা রোজার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। নয়তো নিত্যনতুন সব অনুভূতির সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটতো না। হিম ছড়ানো ঠান্ডা বাতাসে ওর হৃদকম্পন বারবার প্রমাণ করছিলো ওর চেতনায়-অনুভূতিতে আদ্রিশ নামক লোকটি কতটা মিশে আছে। সময় নামক প্রতিটি মুহূর্ত নিদারুণ সব স্বপ্নের জন্ম দিচ্ছিলো ওর অনুভবের প্রহরে প্রহরে!

—————————————-

বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে আদ্রিশদের কাছের আত্মীয়স্বজন সবাই বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছে। বাড়ির সব কাজকর্ম সবাই মিলেমিশে করছে। সুহানা শেখকে তার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে উৎস। অপরাধবোধে তিনি আর বেশি বাড়াবাড়ি না করলেও ইশা মায়ের কাছে ঘেঁষলো না, এমনকি কথাও বললো না। মনে মনে খুবই দুঃখ পেলো সুহানা শেখ। তবে অন্য দিনগুলোর মতো আদ্রিশ আজ আর ঘরের ভেতর কাটালো না। মেহমান ভর্তি বাড়িতে লোকজনদের কাজকর্মের দিকটা সে-ই দেখার দায়িত্ব নিলো৷ ইদানীং যেন রাগ ওর মাথায় চেপে বসে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই ওর রাগের শিকার হতে হয় সবাইকে। কি হয়েছে, কেন হয়েছে সবকিছুর কৈফিয়ত ওকে দিতে হয়। এমনকি বাড়ির বাইরের লোকদের সাথেও একই ব্যবহার। ওর এই আচরণে বাড়ির সকলেই অতিষ্ট। তবে সুহানা শেখের সাথে বেশ নম্রভাবেই আচরণ করলো, যাতে ইশা কষ্ট না পায়। আজ বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ইভেন ম্যানেজমেন্টের লোকদের কাজ তদারকি করছিলো আদ্রিশ। হঠাৎ ম্যানেজমেন্টের এক লোক ওর সাথে বেয়াদবি করায় এক থাপ্পড়ে ছেলেটির দাঁত ভেঙ্গে দেয়। গালের চামড়া রক্তাক্ত করে ছেড়েছে আদ্রিশ। উৎস আর ইমতিয়াজ সাহেব ওকে ছাড়িয়ে নেয়। পরে ধরাধরি করে ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওরা। মিতালি ছেলের এই ব্যবহারে খুব রেগে অনেক কথাক শুনিয়ে দিলেন। লিভিংরুমের শান্ত পরিবেশে মিতালির তেজদীপ্ত কন্ঠ আর আদ্রিশের ভয়ঙ্কর রাগ দেখে মেহমানরা সবাই চুপ করে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলো। পাছে আবার কার কাজে ভুল হয়ে যায় সে চিন্তা করে ওরা আর সেখানে এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে নিজেদের কাজে মন দিলো। কেউ কেউ আবার মনে মনে আদ্রিশকে গালাগালও দিলো।

আদ্রিশের মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য ফিহা একগ্লাস শরবত এনে ধরিয়ে দিলো ওর হাতে। সোফায় বসে গ্লাসে চুমুক দেওয়ারত অবস্থায় হঠাৎই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর পদার্পণ করা মেয়েটিকে দেখে রক্ত ছলকে ওঠলো যেন! ও কি ভুল দেখছে? কয়েক সেকেন্ড চোখদুটো বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলো আদ্রিশ। তারপর চোখদুটো খুলে আবারও সামনে চাইলো। নাহ, ও ভুল দেখেনি। রোজানু সত্যিই এসেছে। কিন্তু কেন? আবারও ওকে কষ্ট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে? কিন্তু আগের মতো ভুল যে সে আর করবে না! রোজানু নামক রোগটি যদি ওর মস্তিষ্ক থেকে দূর না হয়; তাহলে সেই মস্তিষ্কটাকেই এবার নষ্ট করে দেবে সে! তবে নিজের জায়গা থেকে উঠলো না আদ্রিশ, চোখদুটো মোবাইল ফোনে নিবদ্ধ রেখে ধীরেসুস্থে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলো।

এ বাড়িতে পা রাখতেই যে আদ্রিশকে চোখের সামনে দেখতে পারবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি রোজা। মিতালি-নিশিতা সবাই ওদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও রোজার মনযোগ ছিলো সম্পূর্ণ আদ্রিশের ওপর। কতদিন পর ওকে দেখলো সে? একদিন, দুইদিন নয়, একমাসেরও বেশি সময় পর। নিজের মধ্যে খুব লজ্জাবোধ কাজ করলেও আদ্রিশের পাশের সোফায় বসে থাকা ইশা, নেহা-ফিহার সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে গেলো রোজা। ইশা-নেহা ওকে দেখে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও ফিহা তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আদ্রিশ ভুলেও ওর দিকে তাকালো না। মোবাইল স্ক্রল করতে করতেই দোতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো ও। এটা দেখে রোজা খুব আহত হলো। নেহা সেটা টের পেয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাইয়া তোর নামটাও শুনতে পারে না এখন।’

রোজা হতভম্ব হয়ে তাকালো। কখন যে অশ্রুজলে দু-চোখ ভিজে ওঠেছিল বুঝতেই পারেনি সে। কীভাবে ভাঙ্গাবে আদ্রিশের রাগ? কীভাবে বোঝাবে আদ্রিশকে ওর অনুভূতির কথা? কীভাবে বলবে যে, সে আদ্রিশকে ভালোবাসে?

——————————————-

চলবে….

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৪

রোজা এসেছে শুনে রান্নাঘর থেকে মিতালি একপ্রকার ছুটেই এলেন। ঘরভর্তি মানুষের ভিড়ে রোজাকে দেখতে পেয়ে মনটা যেন শান্ত হলো। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই রোজা আলতো করে হাসলো। এগিয়ে এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলোও। মিতালির চোখেমুখে অপরাধবোধ ফুটে ওঠলো যেন। সবার সামনে কোনো বাক্য বিনিময় করতে না পারলেও কাজ সেরে লিভিংরুমটা একটু ফাঁকা হতেই রান্নাঘরের পাশের একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে এলেন রোজাকে। তারপর অনুতপ্ত গলায় বললেন, ‘তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম মা। তুমি এসেছো দেখে খুব খুশি হয়েছি।’

রোজা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল, ‘আপনাদেরকে না জানিয়ে চলে যাওয়াটা উচিৎ হয়নি আমার। স্যরি আন্টি।’

মিতালি অপরাধী গলায় বললেন, ‘এভাবে বলো না মা। জানি তুমি কোন পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিলে। আমাদেরকে মাফ করে দিও মা, তোমার সম্মান রক্ষা করতে পারি নি আমরা।’

রোজা হতচকিত গলায় বলে, ‘আরে কি করছেন আন্টি। আ আমি রেগে নেই আপনাদের প্রতি। এভাবে ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ।’

‘তুমি খুব ভালো মেয়ে।’

রোজা নিশ্চুপ থাকলো। সৌজন্যতা বজায় রাখতে হাসার চেষ্টা করলো। মিতালি একটু সময় নিয়ে একসময় রুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠলো, ‘আমি জানি আদ্রিশ তোমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। দেখো মা, প্রেম-ভালোবাসার বিষয়টা কারোর হাতে নেই। কখন, কীভাবে হয়ে যায় বুঝতেও পারি না, নতুন অনুভূতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। তুমি হয়তো ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছো তাইনা? এজন্য ওর হয়ে আমি তোমার কাছে বিশেষভাবে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।’

রোজা নিশ্চুপ বসে রইলো। ওর অস্বস্তি না হলেও খারাপ লাগছে। মিতালির এভাবে ক্ষমা চাওয়াটা ওর ভালো লাগছে না৷ বরংচ নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক ভালোবাসা বলে-কয়ে আসে না। এজন্য আদ্রিশ ওকে পর্যাপ্ত সময় যে দেয়নি তা নয়। কিন্তু রোজাই সেসব পাত্তা দেয়নি। এজন্য অবশ্য আদ্রিশ জবরদস্তি করেনি ওকে। কিন্তু মাঝখানে সেসব ঘটনায় সবটা কেমন ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। অযথাই আদ্রিশকে ও অপমান করেছে, ওর ভালোবাসা-অনুভূতি এসবকে তাচ্ছিল্য করেছে। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই৷ এই বিষয়গুলো একজন মানুষের কাছে খুবই অমূল্য, দামী। সেখানে বিনা কারণে আঘাত করলে, পালটা আঘাতে নিজেকেই ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়। রোজা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে মিতালির কথায়, ‘অজান্তেই ওর ফুফু তোমাকে নিয়ে উদ্ভট ধারণা পোষণ করেছিল। সেসব ভুলে যেও মা।’

রোজা শান্ত কন্ঠে বলল, ‘হুম।’

মিতালি অনেক কষ্টে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘পুরোনো সব ভুলে গিয়ে বিয়েতে কিন্তু খুব আনন্দ করবে, একদম মন খারাপ করে থাকবে না। কেমন?’

রোজা ওপর-নিচে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। মিতালি আলতো হেসে ওঠে দাঁড়িয়ে ওর কপালে চুমু এঁকে দেয়। রোজা ব্যাপারটায় অনেক চমকালো। মিতালি আলতো হেসে বলল, ‘তোমার মতো একটা মেয়ের খুব প্রয়োজন আমার। শুধু নিজের মেয়ে করে রাখবো বলে!’

রোজা থমকায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মিতালির ছলছল করা দুটি চোখের দিকে। তড়িঘড়ি করে আঁচলের কোণা দিয়ে জলটুকু মুছে নেন তিনি।
অপ্রস্তুত হেসে কাজের বাহানা দিয়ে চলে আসেন। রোজার জন্য যে তার ছেলে কতটা কষ্টে পুড়ছে তা দেখে তিনি খুব ব্যথিত। রোজা যদি রাজি থাকতো তাহলে এক্ষুনি কাজি ডাকিয়ে নিজের পুত্রবধূ করে নিতেন তিনি। কিন্তু আফসোস,রোজার মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ তিনি। ওদিকে রোজা হতভম্ব হয়ে চিন্তাজগতে মগ্ন হয়ে পড়ে৷ মিতালি এটা কী বলে গেল? ইনডাইরেক্টলি কি তিনি রোজাকে নিজের পুত্রবধূ করার কথা বুঝিয়েছেন? ব্যাপারটা অন্যরকম লাগলো ওর কাছে। রোজা নিজেও জানে না ও কতটুকু আনন্দ করতে পারবে এই বাড়িতে ওই মানুষটার সামনে থেকে। মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও ঠাঁই সেখানেই বসে পড়ে। তখনি ওখানে নেহা আসে। রোজা বাস্তবে ফিরে আসে। গোমড়ামুখে বসে থাকা রোজাকে দেখে নেহা ওর মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে। গেস্ট রুমে নেহার বান্ধবীরা মিলে গায়ে হলুদে কি কি করবে তার পরিকল্পনা করছে, আর রোজা এখানে একলা বসে! নেহা মুখ কালো করে রাগ দেখিয়ে একপ্রকার জোর করেই রোজাকে গেস্ট রুমের আড্ডায় নিয়ে যায়।

—————————————————————————–

বিয়ের দিন যতই এগুচ্ছে ততই বাড়ির লোকেদের কর্মব্যস্ততা যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠেছে। বাড়ির সকলের সাথে রোজা আর ওর মা-ও বিভিন্ন কাজে মিতালি-নিশিতাকে সাহায্য করছে। ইতোমধ্যে
বাড়ির ভেতর-বাইরে খুব সুন্দর ডেকোরেশন করা হয়েছে। সাদা রঙের মরিচবাতির আলোয় দূর থেকে বাড়িটাকে একটা শুভ্র পাথরের তৈরি ছোটখাটো প্রাসাদ বলে মনে হয়। অতিথিরা প্রায় সবাই এসে পড়েছে। দূরের আত্মীয়স্বজন কিছু বাকি রয়ে গেছে, ওরা আসবে একেবারে হলুদের দিন। কারণ বাড়িতে থাকা প্রতিটা রুমই ব্লকড, এখন অতিরিক্ত মেহমানের জন্য পর্যাপ্ত থাকার জায়গা নেই। এই কারণে উৎসকে অবধি নিজের ঘরটা ছেড়ে আদ্রিশের ঘরে শিফট হতে হয়েছে। ফিহা-ইশার সঙ্গে নেহার ঘরে থাকলো রোজা। এনগেজমেন্টের দিন রোজা নেহার বরকে দেখেনি, তাই রিজভীর সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নেহা। যাইহোক, বাড়ির সবাইকে হাসিখুশি দেখে বেশ ভালোই লাগছে সুহানা শেখের। তিনি কোনো ঝামেলা আঁটার চিন্তাভাবনা না করে রোজার কাছে সন্তপর্ণে আবারও নিজের দোষ স্বীকার করে মাফ চেয়ে নিলেন। রোজা ইশার ব্যাপারটা জানতো। সেজন্য স্বাভাবিকভাবে সুহানা শেখকে মাফ করে ইশার সাথে মিলিয়ে দিলো। মা-মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটিও করলো। সেটা দেখে রোজা মুচকি হাসলো। ওকে ঘিরে যেসব ঝামেলা তৈরি হয়েছিলো সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে প্রায়। রোজার বাবা সারাক্ষণ ইনায়েত সাহেবের সঙ্গেই বিয়ের কাজকর্ম দেখছেন, ওর মা সুলতানা বোন নিশিতা আর মিতালির সঙ্গে রান্নাবান্নায় সাহায্য করছেন। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ বরাবরই বিরক্তিকর একটা বিষয়। সেজন্য উৎস ওর বন্ধুদের নিয়ে ছাদে গিয়ে আড্ডায় মেতে ওঠেছে। লিভিং রুমে ইশা মেহেদীর প্যাকেট গুনছে, বোধহয় দুটো কম পরেছে তাই ছোট একটা বাচ্চাকে বললো লন থেকে ফিহাকে ডেকে নিয়ে আসতে। বাচ্চাটি দৌড়ে যাওয়ার আগেই দরজা দিয়ে ঢোকা কারো সাথে ধাক্কা খায়। রোজা তখন ইউটিউবে কিছু রান্নার রেসিপি দেখছিলো সোফায় বসে, হুট করে আদ্রিশকে দেখেই ও ওঠে চলে যায় রান্নাঘরে। লোকটা যদি সকালের মতো ওকে চোখের সামনে দেখে আবার চেঁচামেচি করে ওঠে? পরিবেশ শান্ত রাখতেই ও আদ্রিশের চোখের আড়ালে চলে যায়। ওদিকে ধাক্কা খেয়ে সামনে তাকাতেই আদ্রিশকে দেখে ভয়ে গুটিশুটি মেরে দরজার আড়ালে লুকায় বাচ্চাটি। দৃশ্যটি দেখে আদ্রিশ চোখ কুঁচকে তাকায়। পরক্ষণেই ভাবে বাচ্চাটা হয়তো লিভিংরুমে করা ওর আচরণ দেখেই ভয় পেয়েছে আজ সকালে। ও দু’পা এগিয়ে মুচকি হেসে হাঁটু ভেঙ্গে বাচ্চাটির সামনে বসে পড়ে ওর স্নিগ্ধ গালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার নাম কী?’

বাচ্চাটি জড়োসড়ো হয়ে বলল, ‘আ আমি মিমি সোনা।’

আধো আধো বুলিতে নামটি উচ্চারণ করতেই আদ্রিশ হেসে ফেলল, ‘খুব সুন্দর নাম তো তোমার।’

মিমি ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ত্যাংক’য়ু।’

‘তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো?’

মিমি গাল ফুলিয়ে উত্তর দিল, ‘হুঁ।’

আদ্রিশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘কেন?’

‘তুমি সবাইকে বকো?’

‘উহু।’

‘আমাকে বকবে?’

আদ্রিশ হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আমাকে ওমন মনে হয়?’

মিমি উপরনিচ মাথা নাড়াতেই আদ্রিশ বলল, ‘তুমি খুব মিষ্টি বাচ্চা৷ ওদের আমি পছন্দ করি।’

মিমির চোখ চকচক করে ওঠে। ঘাড় কাত করে বলে, ‘আমাকেও?’

আদ্রিশ হাসিমুখে মিমির নাকটা টেনে দিয়ে বলল, ‘হুম, মিমি সোনা।’

মিমি আদ্রিশের গালে ছোট একটা চুমু এঁকে বলে, ‘তুমি খুব ভালো তো! তাহলে সকালে ওই লোজাপ্পির সাথে ওভাবে কতা বললে কেন?’

‘রোজা’ নামটা যে ‘লোজা’ উচ্চারণ করছে মুহূর্তেই সেটা বুঝতে পারলো আদ্রিশ। অজান্তেই হেসে ওঠলো ও৷ কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর চোখ উঁচিয়ে বলল, ‘রাগ হয়েছিল।’

মিমি বড়বড় চোখ করে বলল, ‘লাগ হলেও লোজ্জাপ্পির সাথে এভাবে কথা বলবে না। বড়দের সাথেও এভাবে কতা বলতে নেই। ওদেরকে দুষ্ট বলে। কিন্তু তুমি তা নও।’

আদ্রিশ মিমির পাকাপাকা কথা শুনে অপ্রস্তুত হেসে বলল, ‘আচ্ছা মিমি সোনা। আর বলবো না।’

মিমি মিষ্টি হেসে ওর গাল টেনে দিলো। তারপর আধো আধো বুলিতেই বলল, ‘আমি এখন যাই। পরে কতা হবে। কেমন?’

আদ্রিশ হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, মিমি সোনা।’

মিমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দৌড়ে চলে যায়। আদ্রিশ এতক্ষণ হাঁটু ভেঙ্গে বসেছিলো। এবার সে ওঠে দাঁড়ায়। স্যুটটা খুলে হাতে নিয়ে ডান হাতের তিনটে আঙুল দিয়ে কপালটা ঘষতে ঘষতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ে সোফায়৷ তারপর হাঁক-ডাক ছেড়ে মিতালির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ‘কফি চাই আমার।’

রোজা তখন রান্নাঘরে অযথাই দাঁড়িয়ে ছিলো। নিশিতা মুরগী কাটছে আর মিতালি আটা গুলছে। হাত বন্ধ থাকায় তিনি নিশিতাকে বললেন, ‘কফি তৈরিই আছে। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দে তো।’

নিশিতা কাজ করছিলো বিধায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোজাকে হন্তদন্ত গলায় কফির মগটা আদ্রিশকে দিয়ে আসতে বললো। নিশিতার মাথায় তখন ঝামেলার ব্যাপারটা ছিলো না। মিতালি একটু দূরে থাকায় কথাটা ঠিক খেয়াল করলো না। এদিকে খালার আদেশ শুনে রোজার পা সেখানেই আটকে গেলো। তবুও অগ্রাহ্য করতে পারলো না। নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ফোনটা সেলফের ওপর রেখে কফির মগ হাতে নিতেই খেয়াল হলো ওর হাত কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ড নিজেকে ধাতস্থ করে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে কফির মগ নিয়ে লিভিং রুমের দিকে পা বাড়ালো।

আদ্রিশ চোখদুটো বন্ধ করে আঙুল ঘষারত অবস্থায়ই বিরক্তির সুরে তৃতীয়বারের মতো কফির মগটা দ্রুত আনতে বললেই ওর কানে বাজে মেয়েলি কন্ঠ। ঘাড় সোজা করে চোখ খুলে তাকাতেই রোজার বিমূঢ় চেহারা দেখে আপনাআপনিই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওঠে। খানিকটা সময় চুপ করে রোজার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী চাই?’

উঁচু গলায় বলা কথাটা শুনে রোজা কেঁপে ওঠে। মিনমিন করে বলে, ‘আ আ আপনার কফি।’

আদ্রিশ এতক্ষণে ওর হাতের দিকে তাকায়। নিজের প্রিয় কফি মগটা রোজার হাতে দেখেই চোয়াল শক্ত করে গর্জে ওঠল, ‘এটা আপনার হাতে কেন? হুয়াই?’

রোজা অবাক হয়ে কাঁপতে কাঁপতেই উত্তর দিল, ‘আ আ আন্টি দিলেন।’

রোজার কাঁপা-কাঁপি দেখলো আদ্রিশ। চেহারা কালো করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গেই। আশ্চর্য, এভাবে কাঁপছে কেন রোজানু? আদ্রিশকে কি ভয় পাচ্ছে? হতেই পারে। সকালের ঘটনাটার জন্যই হয়তো! তিরিক্ষি মেজাজে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সকালে নিচে নামতেই আদ্রিশ দেখলো রোজা ইশার সঙ্গে কাজ করছে। নিশ্চিন্ত মনে ফুলদানিতে জমা ধুলোর আস্তরণ ঝাড়ছে আদ্রিশেরই প্রিয় একটা শার্ট দিয়ে। নিজের অতি প্রিয় শার্টের বেহাল অবস্থা দেখে রাগ আয়ত্ত্বে আনার বদলে মাথায় চড়ে বসে ওর। এগিয়ে গিয়ে রোজাকে কিছু কড়া কড়া কথা শুনাতেই মিতালি এসে ওকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও আদ্রিশের রাগ কমে না। মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলতে থাকে, অতিথিদের কেউ কেউ আড়াল থেকেও তা শুনেছে। মা ছেলের কথা কাটাকাটি আর বাগবিন্ডতায় অপমানে রোজার চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। হঠাৎ ওই চোখগুলোতে চোখ পড়তেই কন্ঠস্বর আটকে যায় আদ্রিশের। বক্ষগহ্বরের সূক্ষ্ম ব্যথা চিনচিন করে ওঠতেই হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রোজানুটা কী বুঝে? ওকে কষ্ট দিয়ে আদ্রিশ নিজেই বেশি কষ্ট পায়? ভাবনার প্রহর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে এসে মুখাবয়বে কাঠিন্যতা ছড়িয়ে আদ্রিশ বলে ওঠে, ‘চাই না আমার কফি।’

বলেই পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। রোজা কাঁপতে কাঁপতেই হন্তদন্ত পায়ে ওর পেছন পেছন ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি এনেছি বলে খাবেন না?’

আদ্রিশ রাগী স্বরে বলে, ‘অফকোর্স। যার-তার হাতের কফি আমি খাইনা।’

রোজা হতাশ কন্ঠে বলল, ‘এটা আমি বানাইনি। আন্টি মানে আপনার মা বানিয়েছেন। ওনি কাজ করছেন বলেই আমার হাত দিয়ে পাঠালো।’

আদ্রিশ ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। রোজা অস্বস্তি নিয়ে মাথা নিচু করলো। আচমকা ছোঁ-মেরে ওর হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে নেয় আদ্রিশ। রোজা হতভম্ব হয়ে যায়। একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে তারপর বলল, ‘সকালে রাগ করে বেরিয়ে গেলেন তাই কথাটা বলতে পারি নি। আসলে ওটা যে আপনার শার্ট আমি জানতাম না, কাজের খালা কোথা থেকে নিয়ে এসে আমাকে দিলো, আমিও কিছু না ভেবে… ‘

‘থাক। আপনার কাছে এক্সকিউজ চাইনি। নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করার জন্য সবসময় একটা এক্সকিউজ রেডি রাখেন তাইনা?’

রোজা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আ আমি বুঝতে পারলাম না আপনার কথা। আ আ আমি আমি এক্সকিউজ রেডি করে রাখি না। আমি আমি সত্যটা ব…..’

কথার মাঝপথে রোজাকে থামিয়ে দেয় আদ্রিশ। তারপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে, ‘স্টপ ইট। তোতাপাখির মতো এক লাইনে কয়বার ‘আমি আমি’ করছেন? আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক নই এই আদ্রিশ। যত্তসব ঢং আর বাচ্চামিপনা…’

একটা তাচ্ছিল্যকর ভাব নিয়ে আদ্রিশ সেখান থেকে চলে যায়। রোজা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতে। রোজা প্রচন্ড বিরক্ত হলো নিজের ওপর, ভীষণ রকম বিরক্ত। ঘরের সবকিছু ভেঙ্গে নিজের বিরক্ত ভাবটা কাটাতে ইচ্ছে করলো!

—————————————-

★আদ্রিশকে একটা শিক্ষা পেতেই হবে ওর ব্যবহারের জন্য!

চলবে…..