অনুভবের প্রহর পর্ব-২৫

0
487

#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___২৫

দরজায় হালকা করে টোকা দিল অনুভব। বুকের ভেতর রীতিমতো ঝড় বইছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সে। দ্বিতীয় বার একটু জোরে টোকা দিল। প্রহর দরজা খুলছে না কেন? ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল তার। ফোন বের করে দ্রুত কল দিল। কল রিসিভড হলো না। তবে দরজা খুলে গেল। দরজা খুললেও তৎক্ষনাৎ ভেতরে প্রবেশ করলো না অনুভব। মনের গহীনে তলিয়ে দেখলো, সে ভয় পাচ্ছে। সাথে লজ্জাবোধ। ভয় আর ছিঁটেফোঁটা লজ্জার সংমিশ্রণে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। শেষমেশ ভেতরে ঢুকলো সে।

প্রহর বসার ঘরে নেই। রান্নাঘর থেকে থালাবাসনের টুকটাক আওয়াজ আসছে। অনুভব এগিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ আড়াল থেকে প্রহরকে লক্ষ্য করলো। প্রহর কিছু একটা পরিষ্কার করছে। অনুভবের মাথায় ঢুকছে না কি বলে শুরু করবে। কি করলে, ঠিক কি বললে এতদিনের দূরত্ব ঘুচবে। সে এগিয়ে গেল। গলা পরিষ্কার করে বললো,

‘ক্ষুধা লেগেছে আমার। খেতে চাই।’

প্রহরের হাত থেমে গেল। তবে তা অল্প সময়ের জন্য। পরক্ষণে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনুভব বিস্মিত হয়ে গেল। প্রহর তার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না? সে এবারে গলার স্বর উঁচু করে বললো,

‘বললাম না ক্ষুধা লেগেছে?’

প্রহর হাতের ধোয়া প্লেটটা নামিয়ে রাখলো। নিশ্চুপ সে। চোখে মুখে গম্ভীর ভাব। রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতে অনুভব পথ আগলে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলেও ভড়কালো না প্রহর। অনুভবকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বেশিদূর এগোতে পারলো না। ভেজা হাতে টান পড়লো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। অনুভব আর দ্বিরুক্তি করলো না। একটানে প্রহরকে বুকে টেনে নিল। প্রহর চমকালেও এত সহজে মন গললো না। সব দোষ এই মানুষটার। এই নির্দয় মানুষটা তাকে বোঝে না কেন? তার ভালোবাসার গভীরত্ব কেন বোঝে না? সবসময় কেন নিজের মতো ভেবে বসে থাকে? দু চোখে অভিমানেরা এসে ভিড় জমলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। বার বার অনুভবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু অনুভব ছাড়লো না। আরো দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো। দ্বিধাহীন সুরে বলে ফেলল,

‘ভালোবাসি! ভালোবাসি প্রহর।’

অবশেষে ঝড় থামলো। এতক্ষণ ছটফট করতে থাকা প্রহর স্থির হয়ে গেল। বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা পাহাড়সম অভিমানে ধ্বস নামলো। ভেঙ্গে চূড়ে গুড়িয়ে গেল একটি মাত্র শব্দে। ‘ভালোবাসি!’ অনুভব তাকে ‘ভালোবাসি’ বলেছে। অবশেষে স্বীকার করেছে৷ নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। প্রহর আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না। ঝরঝর করে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ অপ্রকৃতস্থের মতো রইলো। পরিশেষে অনুভবের বুকে মিশে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘আপনাকে বলেছিলাম না? আপনি যদি আগামী কালও পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তবুও আপনাকে ছাড়ছি না আমি৷’

‘প্রহর, কাঁদবে না একদম। যা বলবে, চোখের পানি না ফেলে বলবে। কেমন? তোমাকে কাঁদতে দেখলে, তোমার চোখের পানি দেখলে আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। দেহে সুঁচ ফোঁটার মতো যন্ত্রণা হয়।’

প্রহর অনুভবের বুক থেকে মুখ তুলল। প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর কপাল কুঁচকে বললো,

‘তাহলে এত কষ্ট দিলেন কেন?’

অনুভবের চেহারা জুড়ে অপরাধ বোধের কালো ছায়া নেমে এলো। প্রহরকে কষ্ট দিয়ে সে এক সেকেন্ডের জন্য ভালো ছিল না। নিজেকে আড়ালে রাখতে, নিজের ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখতে তাকে কতটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা শুধু সে-ই জানে। শ্বাস ফেলে প্রহরের গাল মুছে দিল সে। তারপর চাপা স্বরে বললো,

‘স্যরি বললে তোমার কষ্ট গুলো অনুভব করতে পারবো না। তার থেকে বরং শাস্তি দাও আমায়। ভয়ংকর শাস্তি। যাতে তোমার পুরনো সব কষ্টের স্মৃতি দূর হয়ে যায়।’

প্রহর শ্যেন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো অনুভবের পানে। আচমকা দু’হাতে অনুভবের গলা জড়িয়ে ধরলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,

‘অবশ্যই শাস্তি দিবো।’

বলে সে অনুভবের ঠোঁটে চুমু খেল।

_______

ভোরবেলা প্রহরের ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। পাশ ফিরে দেখলো অনুভব নেই। ঘুম ঘুম চোখে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। স্ক্রিণে চোখ বুলাতে ঘুম ছুটে গেল। এক লাফে উঠে পড়লো সে। ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

‘নাস্তা করবে না?’

ব্যাগে বইপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল প্রহর। অনুভবের কন্ঠস্বর শুনে হাত থেমে গেল। রক্তিম এক আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখ জুড়ে। কান লাল হয়ে গেল। পেছন ঘুরে তাকালো না সে। উত্তরও দিল না। ঝটপট ব্যাগ গোছানোতে মনোযোগ দিল। অনুভব এগিয়ে এলো।

‘না খেয়ে বের হওয়ার কথা ভাবছো?’

‘ক্ষুধা নেই।’

দুষ্ট একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল অনুভব। মুচকি হাসলো শুধু। আড়চোখে তার দিকে তাকালো প্রহর। লজ্জা বেড়ে গেল আরো। দ্রুত কাঁধে ব্যাগ চেপে নিল। বললো,

‘সময় নেই আমার। আসছি!’

পথ আগলে দাঁড়ালো অনুভব। হাতের প্লেটটা উঁচু করে ইশারা করলো। মাত্র খেয়াল করলো প্রহর। অনুভবের হাতে খাবারের প্লেট। প্লেটে দুটো রুটি আর ভাজি শোভা পাচ্ছে।

‘তুমি আমার দিকে সরাসরি তাকাচ্ছো না কেন, বল তো?’

প্রহরের ছটফটানি আরো বেড়ে গেল। তার অস্থিরতা দেখে হাসলো অনুভব। বুঝতে পারলো, মেয়েটা তার থেকে পালাতে চাইছে। সে প্রহরের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। রুটি ছিঁড়ে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘হাঁ করো তো।’

প্রহর ভয়াবহ চমকে উঠলো। রাতারাতি অনুভবের এত পরিবর্তন মানতে কষ্ট হচ্ছে। এত ভালো ব্যবহার ঠিক হজম হচ্ছে না। সে ব্যস্ত হয়ে বললো,

‘আমি খেতে পারবো। প্লেটটা আমার হাতে দিন।’

‘উঁহু। আমি খাইয়ে দিবো বলেছি।’

‘আমি নিজে খেতে পারবো তো।’

‘ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে না? চটপট হাঁ করো তো।’

বাধ্য হয়ে প্রহর হাঁ করলো। তাকে জড়তা নিয়ে খেতে দেখে অনুভব বললো,

‘নিজেকে অভ্যস্ত করো প্রহর। আজকের পর থেকে প্রতিবার আমি খাইয়ে দিবো।’

অক্ষিযুগল প্রসারিত হলো প্রহরের। গলায় খাবার আটকে গেল। খকখক করে কাশতে অনুভব দ্রুত পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল। পানি খেয়ে নিজেকে একটু ভারসাম্যে আনলো প্রহর। অনুভবের দুষ্টুমি মাখা ঠোঁটের হাসি অনেক কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাকে বারংবার লজ্জায় ফেলতে চাইছে৷ প্রহর কথা ঘুরানোর জন্য বললো,

‘আপনি রুটি বানাতে পারেন?’

‘আমি সব পারি।’

‘শুধু ভার্সিটি থেকে পাস মার্কস নিয়ে বের হতে পারেন না। তাই তো?’

অনুভব উত্তর দিল না। মুখের হাসি বিস্তৃত হলো শুধু।

‘ক্লাস শেষ হবে কয়টায়? আমি ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

প্রহর ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। অনুরোধের সুরে বললো,

‘থাকতে হবে না। আমি একা চলে আসবো। একদিনে আপনার এত এত ভালো ব্যবহার নিতে পারছি না। আমাকে আর চমকে দিবেন না প্লিজ!’

শব্দ করে হেসে ফেলল অনুভব। হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। প্রহর কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো অনুভবের পানে। মানুষটাকে কখনো প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি সে। হাসলে কি পৃথিবীর সব পুরুষকে এত সুন্দর লাগে? নাকি শুধু তার অনুভবকে? অনুভব তার দিকে তাকাতে সে মাথা নিচু করলো। মানুষটা খেয়েছে কি না সে জানে না। লজ্জায় জিগ্যেসও করতে পারলো না। ছোট্ট করে ‘আসছি’ বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বসার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফেলল সে। পায়ে জুতা গলিয়ে দিল। ক্লাসের বড্ড দেরি হয়ে গেছে।দরজার ছিটকিনিতে হাত রাখতে আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো। চমকে উঠলো প্রহর। সেই চেনা ঘ্রাণ, চেনা স্পর্শ। অনুভবের দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বিস্মিত স্বরে শুধু জিগ্যেস করলো,

‘কি করছেন!’

‘কিছু না।’

কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিল অনুভব। প্রহরের মাথার চুলে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,

‘এবার যাও। সাবধানে যাবে কিন্তু!’

প্রহর মাথা নাড়লো। শেষমুহুর্তে হুট করে অনুভব হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। বুক পকেট থেকে কাগজে মোড়ানো একটা জিনিস বের করলো। প্রহর অবাক হয়ে দেখলো মসৃণ শুভ্র রঙের একটা আংটি। অনুভব এক পলক তার দিকে চেয়ে বাম হাতটা টেনে নিল। আংটি টা পড়িয়ে দিয়ে প্রহরের চোখে চোখ রাখলো। গভীর আবেগ মেশানো সে দৃষ্টি না বলা অনেক কথা ব্যক্ত করলো যেন। প্রহর অস্ফুটস্বরে শুধু বললো,

‘কি করছেন এসব? উঠে দাঁড়ান!’

অনুভব উঠে দাঁড়ালো না। প্রহরের হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে মনে মনে বললো,

‘আমি বাঁচতে চাই প্রহর। ভীষণ ভাবে বাঁচতে চাই৷ দীর্ঘদিন তোমার পাশে থাকতে চাই।’

প্রহর কি বুঝলো কে জানে। তবে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো তার। সে আর দেরি করলো না। দ্রুত বেগে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। অনুভব পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,

‘মিসেস অনুভব মোর্শেদ! এতদিন আপনার জন্য, আপনাকে দেখার জন্য ইচ্ছে করে চতুর্থ বর্ষে আড়াই বছর যাবত রয়েছি। তবে আপনি যদি চান তাহলে এবার সিরিয়াসভাবে পরীক্ষা দিবো। কিন্তু আমি পাস করলে কি পুরষ্কার দিবেন বলুন তো?’

________

বর্তমানে চৌদ্দ তলার এক বিল্ডিংয়ের সামনে প্রহর দাঁড়িয়ে আছে। এই বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় তার বাবার অফিস। আজ এখানে প্রথম নয়। এর আগে বহুবার এসেছে। হুটহাট ক্লাসের ফাঁকে সে অফিসে চলে আসতো। কখনো বা দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে এসে বাবাকে চমকে দিতো। তবে বিয়ের পর একবারও আসা হয়নি। আজ প্রথম। বাবা নিশ্চয়ই খুশি হবে। ভীষণ খুশি হবে!

শহরের বুকে বিকেল নেমে এসেছে। বেলা পড়ে গেছে অনেক। বাবা অফিসে আছে কি না প্রহরের সন্দেহ হলো। আস্তে ধীরে সে এগিয়ে গেল। লিফটে করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছয় তলায় পৌঁছালো।

অফিসে কর্মরত সবাইকে প্রহর চিনে না। দু-চারজন কে ঝাপসা ভাবে চিনে শুধু। তার মধ্যে পড়ে বাবার তরুণ সেক্রেটারি নাজমুল হাসান একজন। বাবার মুখে অনেক প্রশংসা শুনেছে ছেলেটার। অনেক সৎ, কর্মঠ ইত্যাদি! আজও অফিসে ঢুকতে প্রথম মুখোমুখি হলো নাজমুল হাসানের। প্রহর ক্লান্ত স্বরে বললো,

‘বাবা কি এখনো অফিসে আছে?’

(চলবে)